আগন্তুক পর্ব ৩

আগন্তুক 🍁
তৃতীয় পর্ব
মিহি

” মা!মনে হচ্ছে এসব থেকে বেরোনো দরকার! “শুভ্রর কথায় ক্ষেপে উঠেন আজমিরা বেগম। খ্যাঁক করে উঠে পানটা মুখ থেকে ফেলে ক্ষীপ্ত দৃষ্টিতে শুভ্রর দিকে তাকিয়ে থাকেন। শুভ্রর কিছুই ভালো লাগছে না এখন। নিকোটিনের মাঝে আর শান্তি নেই,কি যেন একটা মিস করছে সে। আদিরাকে? অসম্ভব! এমনটা হতেই পারে না। শুভ্র কেন আদিরাকে মিস করতে যাবে? সে তো আদিরাকে কখনো ভালোই বাসেনি। শুভ্রর মাথা ধরে আসছে। অসহ্য যন্ত্রণায় বুকের ভেতরটা শেষ হয়ে যাচ্ছে তার। কোনরকম নিজের ঘরে ঢুকে গায়ে কাঁথা দিয়ে শুয়ে পড়ল সে। গলা অবধি যেন জ্বলে যাচ্ছে। “শুভ্র! কেন করলে এমন? ভালোবাসার নামে এত বড় প্রতারণা? সামান্য ক’টা টাকার লোভে আমাকে এভাবে মেরে ফেলতে পারলে? “ধপ করে উঠে বসল শুভ্র। ঘা ঘেমে ভিজে গেছে তার। এখনো কানে বাজছে আদিরার কণ্ঠে বলা কথাগুলো। এসব কি স্বপ্ন ছিল নাকি আদিরা সত্যিই এসেছিল? কিন্তু আদিরা কিভাবে আসতে পারে? এতক্ষণে হয়তো আদিরার লাশটা অবধি মাটিচাপা দেওয়া হয়ে গেছে। ফোন বেজে চলেছে অনবরত। উঠে দাঁড়ানোর শক্তিটা অবধি পাচ্ছে না শুভ্র। আচমকা যেন সমস্ত অনুতাপ, অনুভূতি আর যন্ত্রণা ঘাড়ে চড়ে বসেছে। হাত বাড়িয়ে ফোনটা রিসিভ করেই কানে ধরে শুভ্র। অপরপাশ থেকে একটা লোকের ক্লান্ত গলা শোনা যায়,” ভাই অনেক চেষ্টা করছি মারার,অনেক খুঁজছিও মাইয়াডারে কিন্তু আচমকাই একটা পোলার লগে উধাও হইয়া গেল আর পাইলাম না। “শুভ্রর মুখে মুচকি হাসি ফুটে ওঠে কিন্তু তার তো রাগ হওয়ার কথা। আদিরার কথা ভাবতেই আগের মতো আর রাগ ওঠেনা তার বরঞ্চ মনের মাঝে এক অদ্ভুত রকম ভালোলাগা সৃষ্টি হয়। এ ভালোলাগার কারণটা অজানা তার। আজমিরা বেগম চিৎকার করছেন। সম্ভবত ঝগড়া চলছে আজমিরা বেগম এবং শুভ্রর বাবার মধ্যে। শুভ্রর বাবা মানুষটা খুব ভালো তবে ইন্ট্রোভার্ট রকমের। আদিরার জন্য সবকিছুই করতেন তবে তা বাবা অর্থাৎ আদিরার দাদার মাধ্যমে। নিজেকে জাহির করতে চাইতেন না। তিনি জেনেবুঝেই আদিরার জন্য একটা ভালো ছেলে দেখেছিলেন কিন্তু আদিরা পালিয়ে গেল। আজমিরা ভেবেছিলেন বিপদ পালিয়েছে এবার সব সম্পত্তি তার কিন্তু আদিরার দাদা আগেই অর্ধেক সম্পত্তি আদিরার নামে উইল করে গেছেন।

” আপনি কিছু খাবেন? রেঁধে যাবো? অফিস আছে আমার। অন্য দিন হলে ছুটি নিতাম কিন্তু আজ মিটিং আছে একটা। ” আদৃতের কথায় মাথা নেড়ে না বুঝায় আদিরা। আদৃত ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নেয়। আদিরা মূর্তির মতো বসে আছে বিছানায়। আদৃত আর কথা বাড়ায় না আদিরার সাথে। চুপচাপ অফিসের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেল। তন্বী আজ দুবার কল দিয়েছিল তাও ভোরবেলা! কারণ কি হতে পারে? বিষয়টা খুব ভাবাচ্ছে আদৃতকে। অফিসে ঢুকতেই শুরু হলো শত রকমের কাজের ব্যস্ততা। তন্বী কিংবা আদিরা কারোর বিষয়গুলোই আর প্রশ্রয় দিল না আদৃত।

তন্বী বেশ চটে আছে। সকালে দুবার ফোন দিয়েছিল আদৃতকে। আগে একটা রিং বাজতে না বাজতেই ফোন রিসিভ হত অথচ এখন? দুবার কল করার পরও আদৃত কল ধরেনি উল্টো কেটে দিয়েছে। এত বড় সাহস ঐ ছেলের? ডিভোর্স পেপারে সাইনটা পেলে আর ওর ছায়াও মাড়াবে না তন্বী। কথাগুলো ভাবতেই আবিদ এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে তন্বীকে। আবিদ তন্বীর সেই প্রেমিক যার জন্য তন্বী সব ছেড়ে চলে এসেছে।

~আহ আবিদ,কি হচ্ছে টা কি?

~কি আবার হবে? যা দেখছো তাই হচ্ছে।

~সরো তো। এমনিতেই মেজাজ গরম আছে।

~কেন?

~পরে বলছি। আগে আমার বের হতে হবে একটু।

আবিদ বারবার জিজ্ঞাসা করল কই যাবে কিন্তু তন্বী বলছে না। মেয়েটার এই স্বভাব একদমই ভালো লাগেনা আবিদের,কখনোই কিছু বলতে চায় না। তন্বীকে আবিদের বাবা-মা মেনে নিবে না,সেজন্য দুজনেই পরিবার ছেড়ে হোটেলে। এখন দুজনের দরকার একে অপরকে বোঝা,সাপোর্ট করা। অথচ মেয়েটা কিছুই বলতে চায় না। রাগ উঠে যায় আবিদের। হোটেল থেকে বের হয়ে যায় সেও। আদৃতের বাড়ির সামনে আসতেই সবাই বাঁকা চোখে দেখতে থাকে তন্বীকে।

~ওই দেখ! আদৃতের বউ না? নির্লজ্জ বেহায়া মেয়ে! বর থাকতে আরেক ছেলের লগে পালাইয়া আবার মুখে চুনকালি মাখাইতে আইছে।

~আমি পালাইছি তাতে আপনার কোথায় পুড়ল খালাম্মা? আমার সাথে বেহুদা কথা বলার আগে বুঝে নিবেন আমি মারাত্মক লেভেলের বেয়াদব। আপনি আমার চরিত্রে প্রশ্ন তুললে আমি আপনার সংসার নিয়ে প্রশ্ন তুলতেও লজ্জাবোধ করব না।

~মুখের কি শ্রী! বাপ রে বাপ! আয় দেখি! আমার সংসার নিয়ে কি প্রশ্ন তুলবি রে তুই? বল দেখি!

~তেমন কিছু নাহ! আপনার বোন যে আপনার বাড়িতে এসে আপনার অগোচরে আপনার স্বামীর সিথে রাত কাটায় সেসব সবার সামনে না বলাই ভালো।

~ বেহায়া মেয়েছেলে! লজ্জা করলো না নিজের বাবার বয়সী পুরুষের নামে এসব বলতে?

~ আপনার স্বামীর যদি নিজের বোনের মতো বয়সী মেয়ের সাথে শুতে লজ্জা না লাগে,আমার বলতে লাগাটা তো অস্বাভাবিক। ওনাদের বলে দিয়েন আমি প্রায় রাতেই বারান্দার রকিং চেয়ারে বসি তাই পর্দাটা যেন টেনে দেয়। এখন আমি নেই তবে অন্য কেউ দেখলে তাদেরই বিপদ।

তন্বীর কথা শেষ না হতেই ঐ মহিলা মুখে কাপড় গুঁজে চলে গেলেন। তন্বী হাসল। তন্বী যা বলেছে সবটুকুই সত্যি। তন্বীর এই অভ্যেসটার জন্য ছোট থেকে বাবা-মা তাকে সহ্য করতে পারত না। তন্বী যা বলে মুখের উপর,সমাজের ভয়ে চুপ থাকার অভ্যেসটা তার নেই। গালিগালাজ থেকে শুরু করে কলেজে উঠেই সিগারেট-বেহায়াপনা আর বিভ্রান্ত একটা পথে ক্রমশ এগিয়ে চলছিল সে। এরই মধ্যে আবিদ ছেলেটার সাথে গভীর এক সম্পর্ক। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়েটা আদৃতের সাথে দিয়ে দেন তন্বীর বাবা-মা কিন্তু লাভ হলো না। আদৃত খুবই শান্ত-শিষ্ট ছেলে,খুব রেগে গেলেও তার মুখ থেকে গালি বের হয়না আর সেখানে তন্বীর সামান্য কথাতেও গালিগালাজ চলেই তবুও আদৃত কখনোই তন্বীকে বকাঝকা করেনি। তন্বী যখন যা আবদার করেছে সাধ্যমতো তা পূরণ করে গেছে। আদৃতের এত ভালোবাসার মূল্য দিতে ব্যর্থ তন্বী। সে কখনোই আদৃতের যোগ্য হয়ে উঠতে পারেনি।

আদৃতের বাড়ির দরজায় তালা ঝুলানো। একটা স্পেয়ার কী সবসময়ই থাকে তন্বীর কাছে। আদৃতকে সেটা এখনো ফেরত দেয়নি সে। চাবি দিয়ে তালাটা খুলল তন্বী। দরজা খুলতেই বড় রকমের একটা ধাক্কা খেল সে। সামনে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। মাত্রই গোসল করে বের হলো। ভেজা চুলের পানিতে জামা ভিজে একাকার। স্নিগ্ধ মুখখানি থেকে যেন সৌন্দর্যের মুক্তো ঝরে পড়ছে। তন্বীও খানিকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মুখটার দিকে। শ্যামবর্ণের মুখটাতে এমন কি মায়া থাকতে পারে! পরক্ষণেই তন্বীর মন বলে ওঠে কে এই মেয়ে? আদৃত তাহলে অন্য একটা মেয়েকে ঘরে তুলেছে? আদিরা হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তন্বীর দিকে,কি করবে বুঝে উঠতে অক্ষম সে। এরই মধ্যে তন্বী চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করল। ভয়ে আঁতকে উঠল আদিরা। তন্বীর চিৎকার শুনে উপরতলার বাসাওয়ালী খালাম্মা দৌড়ে আসল। তিনি তন্বীকে খুব যত্ন করতেন । মেয়েটা পালিয়ে যাওয়ার পর বেশ কান্নাকাটিও করেছেন তিনি। তন্বীর গলা শুনে দৌড়ে আসলেন তিনি। পাশের বাড়ির মহিলারাও নতুন ঝামেলার গন্ধ পেয়ে দৌড়ে আসলো।

কুলকুল করে ঘামছে আদৃত। মিটিং শেষ করে বের হতেই বাড়ি থেকে কল এসেছে। খালাম্মা ফোন করে বলেছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়িতে যেতে। আদিরাকে নিয়ে এমনিতেই ভয়ের শেষ নেই আদৃতের এখন নতুন কি বিপদ হলো ভাবতেই কলিজা শুকিয়ে আসছে তার।

চলবে…

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here