গল্পঃ #আবর্তন (২য় পর্ব)
লেখায়ঃ #তাজরীন_খন্দকার
চন্দ্রা তার ভাবীর মুখ চেপে ধরে বললো,
___ আস্তে ভাবী আস্তে, কেউ শুনে ফেলবে তো!
তার ভাবী উমম্ উমম্ করতে করতে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। একটু দূরে সরে বললো,
___ তোমাকে কোনো বিশ্বাস নেই চন্দ্রা। একটা মেয়ে হয়ে এতো বড় একটা চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা, আল্লাহ আমার কাছে তো পুরো দিনটাই একটা স্বপ্ন মনে হয়েছে। কোনো ইঞ্জিনিয়ারও কোনো কাজ করতে গেলে এতটা নিখুঁত ভাবেনা!
চন্দ্রা তার ভাবীর কাঁধ চাপড়ে বললো,
___ এএ ভাবী এটা তো আমার ভবিষ্যৎ ইঞ্জিনিয়ার জামাই,রনির পরিকল্পনাতেই হয়েছে, সারাজীবন না তাকে বাচ্চা বাচ্চা বলে চেঁচালে, এবার বুঝো বুদ্ধিজীবি কাকে বলে!?
চন্দ্রার ভাবী মুখ ঘুরিয়ে বললো,
___নিঃসন্দেহে রনি একটা বাচ্চা ছেলে! ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাত্র ২য় বর্ষের ছাত্র। তোমার থেকে মাত্র এক বছরের সিনিয়র। যার কিনা বিয়ে করার জন্য কমপক্ষে আরো ৫ বছর সময় লাগবে। সে বাচ্চা নয়তো কি? আর এতোদিন কি করে নিজের বিয়ে আটকাবে শুনি?
চন্দ্রা কপাল ভাজ করে ভ্রু কোচকে বললো,
___মাথায় কি গোবর তোমার? আরে এতদিন বাবাকে যে পড়ালেখা শেষ করে বিয়ে করবো বলে এতো বুঝালাম, শুনলো নাতো!
এবার উনি শুনবে বুঝলে? আর ভালো ঘর থেকে বিয়ে ভেঙে যাওয়া মেয়ের রহস্যময় বেড়াজালে কেউ বিয়ে করতে আসবেনা, দেখে নিও! আর ওই মেয়েটাকে এই অভিনয়ের জন্য আমার জমানো টাকা থেকে পুরো দশ হাজার টাকা এডভান্স দিতে হয়েছে। আরো দশহাজার দিতে হবে, কারণ কয়েকমাসের জন্য তাকে শহর ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যেতে বলছি। অরুণের চেনাজানা কারো সামনে যেন না পড়ে তার জন্য টোটালি বারণ করেছি! নইলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।
খুব টেনশনে ছিলাম মেয়েটা কাজ করতে পারবে কিনা,, কিন্তু এতো ভালো করেছে যে আরো বাড়িয়ে টাকা দিতে ইচ্ছে করছে। আর আমিও কি ঢংটাই না করলাম। ওহহহো নিজেকে নায়েকা নায়েকা লাগছে!
বলেই চন্দ্রা তার ভাবীর বেরসিক চেহেরার দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,
___আচ্ছা ভাবী এসব বাদ, এখন বলো আম্মুর বিলাপ কমেছে?
চন্দ্রার ভাবী মুখ ভার করে মাথা নাড়ালো, উনি আবার পরক্ষণেই বললো,
___খুব খারাপ করেছো চন্দ্রা। অরুণ ছেলেটা সবদিক থেকেই খুব ভালো ছিল, তুমি যখন বাইরে এসব বলছিলে সে খুব কান্না করছিল, জানোতো ছেলেরা কতটা কষ্ট পেলে চোখের জল আটকাতে পারেনা। এর জন্য তুমি খুব পস্তাবে দেখে নিও।
চন্দ্রা তার ভাবীর কথাকে জোকস শোনার মতো হেসে উড়িয়ে দিলো। চিরুনি হাতে নিজের চুল ঠিক করতে করতে বললো,
____ তাই বলে কি দ্বিগুণ বয়সের একটা বুড়োকে বিয়ে করবো? আমার বয়স এখনো বিশ হলোনা অন্যদিকে ওই লোকের বয়স ত্রিশ হবে প্রায়, আরে ভাবী তার উপর ওইটা তো একটা বোকার বাক্স! এতোগুলো মিথ্যা অভিযোগ উঠলো, এতো অপমান করলো সবাই,,এইটা চুপ করে শুনেই গেলো। কোনো প্রকার রিয়েক্টও করলোনা। এমন মানুষের সাথে সংসার করবে চন্দ্রা? ও মাই গড, এটা ভাবা যায়না ভাবী!
ভাবী কিছুটা জোর গলায় বললো,
___তোমার কি মনে হয় ব্যাপারটা এখানেই থেমে যেতে পারে? কখনোই না! অরুণ নিশ্চয়ই আসবে, সে মিথ্যা অভিযোগ অবশ্যই কাটাবে। সে চুপ ছিল হয়তো এতো মানুষের মধ্যে অন্য দশটা ছেলের মতো বেয়াদবি করে হইহট্টগোল করতে চায়নি বলে। আর অরুণ যথেষ্ট স্মার্ট একটা ছেলে, অন্যদিকে চাকরি করলে এইটুকু বয়স তো হবেই।
আর শুনো চন্দ্রা,, তোমার ভাই যখন আমাকে বিয়ে করতে গেছিলো আমিও সেইম কথাটাই বলেছিলাম, তোমার ভাইয়ের বয়স বেশি। কিন্তু আজকে ৬ বছর পর আমাকে দেখো কেমন হয়ে গেছি অথচ তোমার ভাইয়া সেই আগের মতোই আছে । নিজেকে নিয়ে অহংকার করতে হয়না বুঝলে?।
অরুণের কোনো দোষ ছিল না, কিন্তু তাকে জগণ্যভাবে অপমান করা হয়েছে, আমি অসংখ্যবার বারণ করেছিলাম তাই এতোকিছুর পরিকল্পনা করলে কিন্তু আমাকে কিছুই জানালে না। তুমি অন্যভাবেও বিয়েটা ভাঙতে পারতে!
চন্দ্রা চুলে বিনুনি করতে করতে তার ভাবীর দিকে এগিয়ে আসলো। কিছুটা নরম স্বরে বললো,
___আর কি করার ছিল বলো? এটা ভেঙে দিলে বাবা আরেকটা পাত্র আনতো, বারবার কি করে বিয়ে ভাঙবো বলো? এখন যেটা করেছি সেটা যদি অরুণের পরিবার থেকে কোনো উল্টো ঝামেলা না হয়,তাহলে আমার বাবা অন্তত বছরখানেক চুপ থাকবে। এটা ভালো পরিকল্পনা ছিল না বলো? আমি জানি অরুণের সাথে খারাপ হয়েছে, তবে আমার সাথে যে তিনবার সে কথা বলেছে, তার একবারও জিজ্ঞাসা করলোনা বিয়েতে আমার মত আছে কিনা। নিজের মতো করে এতো এতো স্বপ্নের ব্যাখা,নিজের আবেগ,নিজের যা সব বললো। এখন দুজনেরই বদনাম হয়েছে, ওরটা কয়েকমাস পরে ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু আমারটা তো ইচ্ছে করেই করেছি। আমার অনেক দেরিতে বিয়ে হবে এবং রনির সাথেই হবে। বাবাকে থামানোর জন্য আমি এটাই তো চেয়েছিলাম ভাবী।
চন্দ্রার ভাবী আর কথা বাড়ালো না। উনি জানেন এই মেয়েকে অহেতুক বুঝিয়ে লাভ নেই। সে যা করার তাই করবে৷ বিমর্ষ চেহেরায় তিনি আবারও চন্দ্রার মুখের দিকে তাকিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন।
এই ঘটনার মূল বিষয়াদি আর কেউ-ই জানলোনা। সারাজীবন চন্দ্রার বাবার মধ্যে ধারণা ছিল পরিবারের সিদ্ধান্তে বিয়ে দিলেই তার মেয়ে সুখে থাকবে। কিন্তু এমন একটা ঘটনায় শিকার হয়ে অদ্ভুত কারণে তার মনে হচ্ছে আসলে ছেলে-মেয়ে উভয়েই দুজনকে চেনাজানা দরকার। সত্যি যদি বিয়েটা হয়ে যেতো কতো বড় ক্ষতি হয়ে যেতো। তাই তিনি চন্দ্রাকে বুঝালেন এবং তার নিজের পড়ালেখায় মনযোগী হতে বললেন।
নিজের বাবার মুখে এই কথাটা শোনার জন্য কতো কতোদিন ধরে চন্দ্রার অপেক্ষা ছিল। অবশেষে নিজের দুষ্টবুদ্ধির ছলে এইদিনটা দেখার পরে খুশিতে সে আত্মহারা! যাক তার টাকা আর অভিনয় দুটোই সার্থক হলো।
কেটে গেলো প্রায় পনেরোদিন। চন্দ্রা রনির সাথে এখন নিশ্চিন্তে ছুটিয়ে প্রেম করে। রনিও এবার আশ্বস্ত, অন্তত হুড়মুড় করে বিয়ে হয়ে যাওয়ার ভয়টা দূর হয়েছে। অন্যদিকে চন্দ্রা অরুণকে প্রায় ভুলেই গেছে।
”
”
সেদিন বিকেল বেলা চন্দ্রার বাবা একসাথে অনেকগুলো ছোট মাছ নিয়ে বাসায় ফিরেছে। সাথে কৈ,শিং,পুটি,টেংরা এগুলোও আছে। চন্দ্রার বাবা এসেই নিজের বউ আর ছেলের বউকে ডাকতে লাগলো। তারা এতগুলো মাছ দেখে চন্দ্রাকেও ডেকে সাহায্য করতে বললো। তখন চন্দ্রা রনির সাথে নিজের রুমে ফোনে কথা বলছিল, অসময় ডাকাডাকিতে কিছুটা বিরক্ত হলেও হাসিখুশি চেহেরাতেই ওদের কাছে গেলো। কারণ কালকে রনির সাথে দেখা করতে যাবে, তার জন্য চন্দ্রার চেহেরায় উৎফুল্লভাব।
চন্দ্রা বসেই বেছে বেছে মাছ এদিক ওদিক করতে লাগলো, তার ভাবী আর মা পুঁটি মাছ কাটছে কারণ এরা তারাতাড়ি মরে যায়। এদিকে চন্দ্রা যে কৈ মাছগুলো এদিক ওদিক লাফাচ্ছে। সে প্রথমেই এগুলো আলাদা করে একটা একটা করে ধরে তাদের মাথা কেটে পাতিলে রাখা পানিতে রাখলো৷
তাকিয়ে দেখলো মাথা কাটার পরেও এরা ছটপট করছে। চন্দ্রা হাসতে হাসতে তার ভাবীকে উদ্দেশ্য করে বললো,
___ ভাবী আমি আমার দিব্যকর্ণে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি, মাছগুলো পানিতে ঘুরছে আর বলছে,,বেঁচে থেকে লাভ কি বল মাথা ছাড়া!
চন্দ্রার কথা শুনে তার মা আর ভাবী হুহুহু করে উঠলো,! ঠিক সময় চন্দ্রার ঠিক পেছন থেকে একটা আওয়াজ আসলো,
___ আপনি দিব্যকর্ণে অরুণের আর্তনাদ শুনতে পাননা?
কথাটা শুনে চন্দ্রা এতোটাই চমকে উঠলো যে সাথে সাথে তার হাতটা দা’য়ের সাথে লেগে অনেকটা কেটে গেলো।
চন্দ্রার মা আর ভাবী উঠে দাঁড়িয়ে গেছে। চন্দ্রা পেছনে তাকানোর সাহস পেলোনা। আঙুল থেকে রক্ত বের হচ্ছে,এরপরও সারা শরীরের কম্পন থামছেনা। এক দিয়ে ক্ষতস্থানটা চেপে ধরার শক্তিটাও নেই।
চন্দ্রার মা হাত না ধুয়েই এগিয়ে বললো,
___ অরুণ তুমি এখানে?
তখন অরুণ বললো,
___আন্টি এবং ভাবী আপনারা আসেন একটু, জরুরী প্রয়োজন, বেশি সময় লাগবেনা। আমার মনে হয় সবারই থাকা দরকার। আমার বাবা-মাও আসছে এখানে। প্লিজ আসুন!
চন্দ্রার মা আর ভাবী উঠে চলে গেলো। এদিকে ভয়ে চন্দ্রার গলা পর্যন্ত শুকিয়ে গেছে। অরুণ এখানে কেন এলো তাও আবার জরুরী প্রয়োজন। কয়েকমিনিট লেগে গেলো চন্দ্রা ঘোর কাটাতেই। হঠাৎ মনে হলো নাহ তাকে শুনতে হবে কি দরকারী আলাপ হচ্ছে।
সে উঠে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে ড্রয়িং রুমের পর্দাটার পাশে এসে উঁকি দিয়ে দেখতে চাইলো। দেখলো সবার সামনে একটা আধবয়সী মহিলা দাঁড়িয়ে আছে৷ অরুণ মহিলাকে দেখিয়ে চন্দ্রার বাবার উদ্দেশ্য করে বললো,
___আঙ্কেল, সেদিন যে মেয়েটা দাবী করেছিল আমার সাথে তার সম্পর্ক ছিল কিংবা বিয়ে হয়েছে উনি সেই মেয়েটার মা। আমি এই ১৫ টা দিন সারা শহর তন্নতন্ন করে ওই মেয়েকে খুঁজেছি। বিয়েতে আমার পক্ষ থেকে যতজন লোক এসেছে সবাই-ই তো মেয়েটাকে দেখেছিল, তাদেরকেও খোঁজার জন্য লাগিয়ে দিলাম। তো আমার এক চাচাতো ভাইয়ের বন্ধু ওই মেয়েটার সাথে উনাকে দেখলো, তারপর উনার পিছু নিলেও একটা সময় তাদের হারিয়ে ফেলে। কিন্তু আজকে সকালে শুধু উনাকে বাজারের ব্যাগ হাতে দেখতে পেয়ে একদম আমার কাছে নিয়ে আসছে। উনার কথা অনুযায়ী উনার মেয়ে ইদানীং গ্রামের বাড়িতে আছে। আর সত্যিই মেয়েটার বিয়ে হয়েছিল কিন্তু সেটা আরো ৪ বছর আগে। ছেলেটা তাকে ডিভোর্স দিয়েছিল, তারপর মেয়েটা গার্মেন্টসে চাকরি করে। কিন্তু কেউ একজন অল্প কাজে টাকার লোভ দেখিয়ে সাথে মিথ্যা কাবিননামা বানিয়ে আমাকে এতো খারাপভাবে ফাঁসিয়েছে। এতে উনার মেয়েরও দোষ নেই, হাত আছে অন্য কারো!
এটুকু বলেই অরুণ থামলো। এদিকে চন্দ্রার মাথা ঝিমঝিম করছে, হাত থেকে এখনো রক্ত পড়ছে। আজকে সে একদম শেষ! তার বাবা যদি তার এতো বড় মহৎ কাজের কথা জানতে পারে,এক্কেরে জানে মেরে ফেলবে। যেখানে প্রেমের কথা বলার সাহস হলোনা সেখানে তার বিয়ে সে নিজেই ভেঙেছে এবং সাথে এতোগুলো কান্ডকারখানা করলো,এবং অরুণের পরিবারে চরম অপমানের ছুরি বসালো। এতোগুলো অন্যায়ের কথা শুনলে তাকে জীবনেও তার বাবা ক্ষমা করবেনা।
এর মধ্যেই অরুণ মহিলাটাকে বললো ,
___আপনি প্লিজ আপনার মেয়ের ডিভোর্সের কাগজগুলো দেখান। আর বলুন আপনি সেদিনের সাজানো অভিনয় সম্পর্কে কি কি জানেন?
চন্দ্রা দরজা থেকে সরে পড়লো, নাহ এখানে আর থাকতে পারবেনা। চারদিকে নাকি শীতের আভাস অথচ তার সারা শরীর ঘামে একাকার! সেই ঘামার সাথে সাথে আবার কাঁপছেও! দাঁতে দাঁত ধাক্কা লাগছে।
কীভাবে সামাল দিবে এই পরিস্থিতি!
চলবে….