#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_১০
Writer #পুষ্পিতা_প্রিমা
বড় সাইজের মগে করে কফি নিয়ে এল অভিক। সুজানা তখন অনা আর আবিদের সাথে বাগানের ভেতর। ফুলের নামগুলো সে শেখাচ্ছে তাদের। অভিক ধীরপায়ে হেঁটে হেঁটে তাদের পেছন পেছন গেল। অনা ঘাড় ঘুরাতেই অভিককে দেখে হেসে বলল
অভি আসি গেছে।
অভিক ফুলের টব টপকে ওদের কাছে গেল।
সুজানার দিকে মগ বাড়িয়ে দিয়ে বলল
নিন।
সুজানা অনিচ্ছা প্রকাশ করার আগেই অভিক বলল
তাড়াতাড়ি নিন।
সুজানা অনিচ্ছা স্বত্বেও নিল। বলল
আমার এখন খেতে ইচ্ছে করছেনা।
খেতে হবে। জুনিয়র আপনারা খাবেন?
দু’জনই চেহারা বিকৃতি করলো।
টিতা টিতা।
সুজানা ঠোঁট টিপে হেসে উঠলো। অভিক ভুরু কুঞ্চন করে তাকাতেই সুজানা অন্যদিকে ফিরে গেল।
কেন তিতা হবে?
সুজান বোলচে কফি টিতা টিতা।
সুজানা জিভে কামড় দিয়ে তাদের চুপ করতে বলল। অভিক এক হাতে কফির মগে অন্য হাতে জার নিয়ে পানি দিতে দিতে বলল
সুজানা আপনার মন খারাপ কেন?
সুজানা কফির মগে চুমুক দিয়ে দ্রুত হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুখ মুছলো। অভিকের দিকে সটান দৃষ্টি রেখে বলল
আমার মন খারাপ কে বলেছে আপনাকে?
সিক্সথ সেন্স।
সুজানা মাথা নামিয়ে নিল।
নিঃশব্দে একটি ভারী দীর্ঘশ্বাস পড়লো তার।
সে চায় না কেউ তাকে পড়তে পারুক তার মন খারাপের কারণ জানতে পারুক। খোলা খাতার মতো মানুষগুলোর পদে পদে বিপদ। তাদের পড়তে পারা মানুষগুলোর কাছে তাদের সবসময় দুর্বল হয়ে থাকতে হয়। সুজানা দুর্বল হতে চায় না।
সুজানা আপনাকে একটা প্রশ্ন করি?
প্রশ্ন?
হুহ।
যদি না পারি?
শাস্তি নেই।
তাহলে করুন।
অভিক জারটা নিয়ে হেঁটে অন্যপাশের গাছগুলোতে পানি দিতে দিতে বলল
এমন একটা জিনিস কিংবা কোনো বিষয়বস্তু আছে যেটা শুধুই আমার আছে।
সুজানা আগ্রহী হয়ে বলল
আচ্ছা। তারপর?
ওইটা আমি শুধু আপনাকেই দিতে পারি। ওটা কি?
সুজানা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকলো। বলল
প্রশ্নের উত্তর এখন দিতে হবে?
পরে দিলেও পারেন। আমার মনে হয় না আপনি পারবেন।
পারব। একটু হিসাব কষতে হবে।
গুড সুজানা।
আচ্ছা আমি আমার বন্ধুদের জিজ্ঞেস করতে পারি?
একদম না।
কিন্তু কেন?
অভিক জারটা রেখে সুজানার হাত থেকে খালি হওয়া কফির মগটা নিয়ে নিল। বলল
সব প্রশ্নের উত্তর হয় না সুজানা। এনিওয়ে আপনাকে আজকে একা ছেড়ে দিলাম। রিকশা করে চলে যেতে পারবেন। কিন্তু কাল তাড়াতাড়ি আসবেন। আসবেন তো?
সুজানা চুপ করে রইলো। মৌনতা সম্মতির লক্ষ্মণ ভেবে অভিক চলে গেল।
___________________________
ঘড়ির কাঁটা দশটার ঘরে গিয়ে পৌঁছেছে। মেহুলকে রাহেলা বেগম গত পাঁচ মিনিট যাবত ডেকে ডেকে অস্থির হয়ে উঠেছেন। মেয়ের এখনো খাবার টেবিলে আসার নামগন্ধ নেই। এবার তিনি ভারী অসন্তুষ্ট হলেন। মনিরুল সাহেবকে বললেন
তুমি কি একবারও ডাকবেনা ওকে?
টেবিল গুছিয়ে আসতে তো সময় লাগে রাহেলা। আসু্ক। তুমি খাওয়া শুরু করো।
রাহেলা বেগম দুটো প্লেটে ভাত বেড়ে দিতে দিতে বিরক্তিকর গলায় বললেন
তোমার মেয়ের কপাল অনেক খারাপ জানো? শ্বশুরবাড়িতে লাঠিপেটা খাবে। আমি মা তাই তার এসব সহ্য করি।
আহা এসব বলো না তো।
মেহুল কিছুপরেই এল। চুপচাপ খেতে বসলো। মনিরুল সাহেব মেয়েকে বললেন
মা ডাকার সাথে চলে আসতে হয়।
সরি বাবা। খাওয়ার পর আমি আর কাজ করতে পারিনা। তাই বইপত্রগুলো গুছিয়ে আসছিলাম। সরি মা।
তোর সরি রাখ। শ্বশুরবাড়িতে গেলে খাওয়ার পরপর বিছানায় শুয়ে যেতে পারবি? খাওয়ার পরে বাসনকোসন গোছগাছ করতে হয়। ধুঁতে হয়। তারপর সব সামলে ঘুমাতে যেতে হয়। আমি কিছুই শেখায়নি বলে কথা শোনাবে তখন।
মেহুল ভাতের লোকমা মেখে মুখে দেয়ার আগেই থেমে গেল।
মা সবসময় এসব কি কথা বলো? তখন আমি সেরকম হয়ে যাবো। অভ্যাস হয়ে যাবে।
মনিরুল সাহেব মুচকি হাসলেন। বললেন
আচ্ছা এখন সেসব কথা থাক। মেহুল একটা কথা জানার ছিল তোমার কাছ থেকে।
জ্বি বাবা।
অভিক ফারদিন লেকচারার তোমার ডিপার্টমেন্টে?
মেহুল মাথা নামিয়ে মিহি গলায় বলল
হুম।
তোমাকে তোমাদের স্যারের মা পছন্দ করেছিল। কিন্তু তুমি এখন উনার অপছন্দের।
মেহুল খাওয়া বন্ধ করে বাবার দিকে তাকালো।
কারণ উনি জানেন যে তোমার সাথে অন্য কোনো, মানে অন্য কারো সাথে সম্পর্ক, মানে বুঝতে পারছ আমি কি বলতে চাইছি।
রাহেলা তা শোনার সাথে সাথে গোলগাল চোখ করে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকালো মেহুলের দিকে। মেহুল পানি খেল।
এসব কি সত্যি শুনছি মেহুল? যদি সত্যি না হয় তাহলে আমায় বুঝাও কেন উনারা এসব বলছেন? আর যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে বলো কে সে?
মেহুল সাদা প্লেটে ভাত নাড়তে লাগলো শুধু। চোখ প্লেটে নিবদ্ধ।
মনিরুল সাহেব বললেন
আমি সুজানার কাছে এখন ফোন দিতে পারি কিংবা অনেক উপায় আছে যার মাধ্যমে সত্যিটা জানতে পারি। কিন্তু বেটার হয় তুমি যদি আমাকে সবটা খুলে বলো। আমি তোমার বাবা।
মেহুলকে কিছু না বলতে দেখে তিনি বললেন,
ওকে সময় নাও। তবে কালকের আগে জানতে চাই সবটা। আশা করি তুমি কিছু লুকোবে না আমার কাছ থেকে। তোমাকে উচ্চশিক্ষিত করছি তাই তোমার কাছ থেকে বেটার কিছু আশা করি আমি। আশা করি হতাশ হবো না। রাহেলা ওকে মাছ তুলে দাও।
রাহেলা বেগম বাটি ঠেলে দিলেন। মেহুল মাথা নামিয়ে চুপচাপ খেয়ে উঠে গেল আলু আর বেগুন ভাজি দিয়ে।
রাহেলা বেগম রাগে গজগজ করতে করতে বললেন
তোমার লাই পেয়ে পেয়ে নষ্ট হয়েছে ও। ওর সমবয়সী মেয়ে সুজানা নেই? বাপ মরা মেয়েটার চালচলন দেখেছ?
কি বলতে চাইছো রাহেলা? এখন সব দোষ আমার?
হ্যা তোমার। সময় থাকতে কি করবে করো? ছেলেটা কে খোঁজ নাও।
গলার আওয়াজ ছোট করো। দেয়ালেরও কান আছে ভুলে যেওনা। মেয়ে বড় হয়েছে। ওর পছন্দ অপছন্দ থাকতেই পারে। আমার মেয়ের উপর আমার পূর্ণ বিশ্বাস আছে। ও এমন কিছু করবেনা যাতে আমার মানসম্মান নষ্ট হয়।
________________
ট্রেনের বগি দখল করে বসলো বন্ধুমহল। ঘুম ঘুম আবেশের কারণে আলসেমি কেটে উঠেনি এখনো। চোখমুখ ফোলা আর হাই তুলতে তুলতে সিটে হেলান দিয়ে বসলো সবাই। ঝকাঝক শব্দ করে শাটল ছেড়ে দিতেই পিনপতন নীরবতা কেটে আহির বলে উঠলো
কাল একুশে ফেব্রুয়ারি না? প্ল্যান কি?
সুজানা ব্যাগের চেইন খুলতে খুলতে জবাব দিল
হ্যা। আপাতত কিছু জানিনা।
শান্তা বলল
আর কি শাড়ি পড়ব আর ফুল দিতে যাব। ব্যস। মজা হবে রে তাই না।
মেহুলকে চিন্তিত দেখে সুজানা কনুইয়ের গুঁতো মারলো।
কি রে চুপ কেন?
মাথা দুলালো সে। নিখিল বলল
এই শোন বড়দার বিয়ে ঠিক হয়েছে বুঝেছিস? তোদের দাওয়াত পড়ছে।
সবাই একসাথে হৈহুল্লোড় করে উঠলো। আহির বলল
কি বলিস দোস্ত? কতদিন বিয়া খায় না। তাইলে তো ভালোই জমবে। রাতে টাতে পড়ছে নাকি? তাইলে তো বিরাট সমস্যা।
শান্তা বলে উঠলো
হাহ রাখ তোর সমস্যা। বেডামানুষের এত ভয় কিসের? মায়ের আঁচলের তলে বইয়্যা থাক।
আহির চোখ রাঙিয়ে তাকালো।
চুপ থাক। তুই মায়ের কদর কি বুঝবি? তুই তো দাদীর আঁচলের তলে থাকিস।
শান্তা ক্ষেপে উঠলো। আঙুল তুলে শাঁসিয়ে বলল
আহিরের বাচ্চা।
আহির শার্টের কলার পেছনে ঠেলে দিয়ে বলল
মা তুলে কথা বলবি না।
আমার দাদী তুলে কথা বলবি না।
তুই আগে বলছোস।
সকাল সকাল মুখ খারাপ করবিনা আহিরের বাচ্চা।
তুই একটা আস্ত অশান্তির বাচ্চা।
রাগে গজগজ করতে করতে মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে বসলো শান্তা। নিবিড় বলল
আরেহ থাম।
সামান্য ব্যাপার নিয়েও তোদের ঝগড়া করতে হয় না? বিয়ে রাতেই পড়ছে। আর তোরা মেহেদিতে যাবিনা? দুদিন সময় নিয়ে যাবি। সমস্যা কোথায়? মেহু সুজু তোদের সমস্যা হবে? শান্ত তোর সমস্যা হবে?
শান্তা মাথা নাড়ালো।
নো। মুজে কই পেরেশানি নেহি।
সুজানা বলল
আম্মাকে বুঝিয়ে বলতে হবে। মেহু আর শান্ত গেলে সমস্যা নেই।
মেহুলও মাথা নাড়ালো।
আমার সমস্যা নেই।
নিখিল ফুঁস করে শ্বাস ছাড়লো। বলল
তাইলে তো সমস্যা নাই মামা। কিন্তু কবিসাহেব তো কিছু বলল না ।
শান্তা ডাকলো
ওই ভ্যাবলাকান্ত!
সবাই তাদের বিপরীত পাশের নিহাত নামের মেয়েটার পাশের সিটে জায়িন নামক ছেলেটার দিকে তাকালো। চিকন ফ্রেমের চশমা ঠেলে বোকাসোকা চোখে তাকালো ছেলেটা।
নো প্রব । আম্মুকে ম্যানেজ করে নেব। দু রাতের ব্যাপারই তো।
নিখিল উচ্চরবে বলে উঠলো
তাইলে তো কোনো সমস্যাই রইলো না গাইস।
জায়িন বলল
কিন্তু নিহাতকে দাওয়াত দিবিনা? ওকে ছাড়া গেলে আম্মু আর কাকিয়া আমাকে কি বলবে?
নিহাত কানে ইয়ারফোন গুঁজে জানালার বাইরে মগ্ন থাকায় কথাটা শুনতে পেল না। সবাই নিখিলের পানে তাকালো।
নিখিল কান মললো হাতে। সুজানা বলল
আমার মনে হয় না ও যাবে। তাও তোর ভাইয়ের বিয়েতে।
আহির বলল
আরেহ বেটা তোরে দিছে মানে নিহাতরেও দিছে।
জায়িন হাসলো। নিহাতের কান থেকে ইয়ারফোন খুলে নিয়ে বলল
নিহু গুড নিউজ ?
নিহাত ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করলো
হোয়াট !
বিয়ের দাওয়াত পড়েছে?
তোর বিয়ের?
জায়িন হাসলো।
নিখিলের।
মানে?
নিখিলের দিকে চোখ ফেলতেই নিখিল জানালার বাইরে মুখ করলো। গলা পরিষ্কার করে থুতু ফেলল।
মানে নিখিলের ভাইয়ের। দাওয়াত দিয়েছে। যাবিনা? কাকী আর কাকাইকে ম্যানেজ করা আমার দায়িত্ব।
শান্তা বলল
আমরা সবাই যাচ্ছি নিহাত। তুমি যেতে পারো আমাদের সাথে। একসাথে বেড়ানোর মজাটাই আলাদা। যাবে?
নিহাত চুল কানের পেছনে গুঁজে বেশ ভেবেচিন্তে জবাব দিল
কিন্তু আমাকে তো কেউ দাওয়াত দেয়নি।
সবার দৃষ্টি সাথে সাথেই নিখিলের দিকে ঘুরে গেল।
নিখিল সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল
কি দেখছিস?
ঘটা করে কাউকে দাওয়াত করে দিলাম কখন? তোদের সবাইকে বলেছি গেলে যাবি না গেলে বিয়ে আটকে থাকবে না।
সুজানা বলল
আচ্ছা আচ্ছা আমরা সবাই যাব। নে সবাই নাশতা খা। আম্মা খেজুরি পিঠা বানিয়েছে।
সবাইকে পিঠা বিলি করে দিল সুজানা। খেতে খেতে মায়ের হাতের পিঠার প্রশংসায় ভাসলো বন্ধুমহল।
________________________
বৈদ্যুতিক পাখার ভনভন শব্দ আর ছাত্রছাত্রীর কোলাহলে মাতানো লাইব্রেরীর ছোট্ট এককোণায় বই ঘাটাঘাটি করছে সুজানা।
প্রকান্ড লাইব্রেরীটি চবির অন্যতম নিদর্শন। যার গ্রন্থাগারের সংগ্রহ সংখ্যা চার লক্ষেরও অধিক। প্রকান্ড লাইব্রেরীটিতে চারপাশে অসংখ্য জ্ঞান আহরণকারীদের পদচারণায় মুখোরিত কল্লোলিত গ্রন্থাগারটিতে সুজানা সময় পেলেই ছুটে আসে বই সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। মেহুল আর শান্তাও এসেছিল সাথে করে কিন্তু হুট করে দু’জনেই উদাও। সুজানা উপন্যাসের বই ঘাটতে ঘাটতে ইতোমধ্যে অনেকগুলো ঘাটাঘাটি করে ফেলেছে। “রাত ভরে বৃষ্টি ” আর “নবনী” বইদুটো দেখে অন্যগুলো রেখে দিল সে। বইদুটো টানার সময় মনে হলো অপর পাশ থেকে কেউ বই ধরে রেখেছে। সুজানা বইটা ছেড়ে দিতেই ধপাধপ তিন চারটা বই একসাথে পড়ে গেল। মনে মনে ভারী বিরক্ত হয়ে ওপাশের মানুষটাকে দেখার চেষ্টা করলো সে। বইগুলো তুলে বলল
বই ধরেছেন যখন তখন আবার ছেড়ে দিলেন কেন? আজিব! মেহু নাকি? এই শান্তা?
কোনো আওয়াজ এলো না। তবে পাশ থেকে কয়েকটা বই ধীরেধীরে সরে গেল। হাহ তার পছন্দের বইগুলো নিয়ে নিল? বইগুলো সরলো আর ওপাশে ফর্মাল ড্রেসআপে অভিককে দেখে চমকে সটান হয়ে দাঁড়ালো সুজানা। অভিক তাকে চমকাতে দেখে চমৎকার করে হাসলো। ভুরু উঁচিয়ে বলল
বাচ্চাদের এসব উপন্যাস পড়া বারণ।
সুজানার চোখগুলো স্বাভাবিকের চাইতে বড় হওয়ায় হাঁসের ডিমের মতো দেখালো। অভিক কপালের একপাশে কলমের দিয়ে চুলকে বলল
সুজানা আপনাকে একটা প্রশ্ন দিয়েছিলাম না? উত্তর খুঁজে পেয়েছেন?
সুজানার মনে পড়লো প্রশ্নটি। নীরবতা কাটিয়ে উঠে চোখ ফ্লোরে রাখা অবস্থায় বলল
আপনার কাছে আছে অমন জিনিস আপনি আমাকে দেবেন কেন?
গুড কোয়শ্চন।
রেকটা খালি হওয়ায় দুজনেই একেবারে মুখোমুখি। সুজানা অন্য রেকের দিকে এগিয়ে বলল
আমি অন্য বই নিতে এসেছিলাম।
উহু। আপনি এসবই নিতে এসেছেন। নিয়ে যান। আপনার বড় হওয়া দরকার।
সুজানা তার দিকে আর ফিরলো না। বলল
না পড়ব না আর।
আপনাকে পড়তে হবে।
সুজানা মাথা নাড়ালো।
না।
আমার প্রশ্নের উত্তর এখানে।
সুজানা সাথে সাথেই ফিরলো।
কোথায়?
অভিক নাকের নিচে আঙুল টেনে চোখ নিভিয়ে হাসলো। বলল
এই বইগুলোতে।
সুজানা বইদুটো নিয়ে সে চোখ নত অবস্থায় জানতে চায়
যদি উত্তরটা ঠিকঠাক পারি আপনি আমাকে কি দেবেন?
অভিক এবার হেসে উঠলো সশব্দে।
ওই যে বললাম পুরো বাগান দিয়ে দেব। পুরোটা আপনার।
সুজানা কিছু বলবে তার আগেই মার্কেটিং বিভাগের অন্য একজন প্রভাষক এসে পড়লেন।
অভিক সাহেব আপনাকে খুঁজছিলাম।
মেহুল আর শান্তাও এসে পড়তেই সুজানা বড় করে শ্বাস ফেলে সরে পড়লো দ্রুত। বাবারে বাবা স্যারটা কোথাথেকে যেন উড়ে চলে আসে।
মেহুল আর শান্তার সাথে বকবক করতে করতে স্যারের সাথে দেখা হওয়ার ব্যাপারটা বর্ণনা করতে ব্যস্ত সুজানা। ওই রেকে রাখা কয়েকটা বইয়ের ফাঁক গলে কারো তুখোড় দৃষ্টি তখনও তার উপর নিবদ্ধ।
#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_১১
Writer #পুষ্পিতা_প্রিমা
হাটহাজারীর ফতেহপুরের জোবরা গ্রামে পাহাড়ঘেরা ২১শ একর সমতল-উঁচু-নিচু পাহাড়ি ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের হলসংলগ্ন ঝুপড়িগুলোতে আড্ডায় ব্যস্ত বন্ধুমহলের হঠাৎ ধ্যান ভাঙলো শাড়ি পরিহিত প্রসাধনীতে ঢাকা পুরুষালী চেহারার কয়েকজনকে দেখে। নানান ভঙ্গিতে হেঁটে হেঁটে দ্রু পায়ে এগিয়ে আসছে তারা। নিখিল, আহির আর জায়িনের হাতে সিংগাড়া। ছোট ছোট করে ভেঙে মুখে পুরতে পুরতে তিনজনই কপাল ভাঁজ করে তাকালো। নিখিলের ঠোঁট দুষ্টু হাসি। নিশ্চয়ই অনেক ডেঞ্জারাস কিছু ঘটতে চলেছে। দোকানদারের কাছে ছুটে গেল শাড়ি পরিহিত মহিলাগুলো। এক তালির উপর আরেক তালি দিতে দিতে আদেশীসুরে বলতে লাগলো
এই টাকা দে টাকা দে।
দোকানার চিল্লিয়ে বলল
এই দুরু দুরু। এডে কি? মরিবেল্লেই আর জায়গা নো পর। হোনো টিয়া নেই। যাহ যাহ।
জায়িন সিংগাড়া খেতে খেতে নিখিল আর আহিরের পেছনে গিয়ে লুকোলো। আহির তার হাত ধরে বলল
এইতো টাকার মালিক এইদিকে।
জায়িন ভীত গলায় বলল
না না কি করছিস ব্রো? ওরা বেইজ্জত করে ছাড়বে। আমার ভয় করে।
নিখিল আর আহির একসাথে হেসে উঠলো। মহিলাগুলি মাথার লম্বা বেণী এপাশ থেকে ওপাশ ফিরিয়ে আবারও তালি দিতে দিতে বলল
টাকা দে টাকা দে।
জায়িন এবার শুকনো ঢোক গিললো। নিখিলও একই ভঙ্গিতে হাত তালি দিতে দিতে বলল
এই টাকা দে, টাকা দে।
আশেপাশের মানুষজন হেসে উঠলো। আহির বলল
টাকার মানুষ এই তো।
জায়িন পালাতেই যাচ্ছিল। নিখিল তাকে ধরে ফেলল। বলল
বড়লোকের বেটা। ধরো ধরো। বড় বড় টাকা আছে।
জায়িন বলল
শালা কি করছিস? দিনদুপুরে ইজ্জৎ নিয়ে টানাটানি করার কোনো মানে হয়?
মহিলাগুলো জায়িনের দিকে তাকালো। তেড়ে আসতেই জায়িন উল্টোদিকে দৌড় দিল।
মহিলাগুলো জায়িনের পেছন পেছন ছুটে গেল। জায়িন কিছুদূরে গিয়ে পেছনে ফিরে তাদেরও দৌড়ে আসতে দেখে শুকনো ঢোক গিলে আবারও ছুটলো।
নিখিল আর আহিরও মহিলাগুলোর পেছন পেছন ছুটলো। জায়িন কিছুদূরে গিয়ে থামলো। তার উদ্দেশ্য ক্যাম্পাস। ছুটতে ছুটতে একসময় নিহাত আর দলবলকে দেখে চেঁচিয়ে ডাকলো। নিহাত তাকে অমন দৌড়াতে দেখে থমকে দাঁড়ালো। জায়িন তার কাছে ছুটে গিয়ে বলল
দেখ ওই মহিলাগুলো আমার পিছু নিয়েছে।
পিছু নিয়েছে? কেন?
টাকার জন্য?
কেন টাকা?
আরেহ ওইগুলা হিজড়ে। বুঝতে পারছিস না?
নিহাত চোখমুখ কুঁচকে বিকৃত করে বলল
ও আল্লাহ! তুই এদের ভয় পেয়ে এভাবে ছুটছিস? রিডিকিউলাস জায়িন।
আরেহ না না নিখিল আর আহির আমার পেছনে লাগিয়ে দিয়েছে। উফফ। আমার বুকটা এখনো কাঁপছে।
মহিলাগুলো তাকে ধরতে না পেরে ফিরে আসছিল। নিখিল আর আহিরকে দেখে ছুটে গিয়ে কলার ধরে পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিল। দুজনেই আকস্মিক আক্রমণে হতভম্ব। দুজনেই তোতলাচ্ছে। মহিলাগুলো পকেটে হাত ঢুকিয়ে গালে আলতো চাপড় মেরে বলল
এইই টাকা বের কর। বের কর। এক্ষুণি বের কর। নইলে ছাড়ব না।
আহির বলল
ধুরর বেয়াদব মহিলা। নিখিল আমারে বাঁচা ভাই। কি বেয়াদব মহিলা দেখ। আমার কাপড়চোপড় খুলে নিবে মনে হচ্ছে। ও আল্লাহ!
জায়িন দূর থেকে দুজনের এমন দশা দেখে হেসে কুটিকুটি। নিহাত বুকে আড়াআড়িভাবে হাত ভাঁজ করে কপাল কুঁচকে তাকালো।
মহিলাগুলো আলতোকরে ধাক্কা মারলো নিখিলকে। বলল
এই চিকনা টাকা দে। তাড়াতাড়ি দে। দে দে।
নিখিল বুক ঝেড়ে বলল
লম্পট মহিলা।
মহিলাগুলো ক্ষেপে উঠলো। তন্মধ্যে সুজানাদের দেখা মিললো নিহাতদের পেছনে। মেহুল বলল
এমা হিজড়া ধরছে আহিরদের। ও আল্লাহ!
আহির কপাল চাপড়ে বলল
কেসটা কি হলো দোস্ত। জায়িন্ন্যারে পঁচাইতে গিয়ে নিজেরাই কেস খাইলাম। কেউ তো বাঁচা ভাই। ওরেবাপরে কি শক্তি।
মহিলাগুলো ইতোমধ্যে পকেটে হাত ঢুকিয়ে টাকা হাতড়ানো শুরু করে দিয়েছে। আহির বলল
ও মা আমার সুড়সুড়ি লাগছে।
সুজানা মেহুল আর শান্তা কিছুদূরে এসে বলল,
হায় আল্লাহ এখন কি হবে?
শান্তা সাহস করে এগিয়ে এল। ব্যাগ থেকে যা আছে সব টাকা বের করে দেখিয়ে বলল
এই টাকা নাও। ওদের ছেড়ে দাও আগে।
টাকাগুলো নেয়ার জন্য সব মহিলা তেড়ে এল। শান্তা একছুটে পালালো সবাইকে তেড়ে আসতে দেখে। সেই সুযোগে নিখিল আর আহির পালালো। মহিলাগুলো আর কোনো পথ না পেয়ে নিহাত আর জায়িনদের দিকে ছুটতেই নিহাত তার দলবল নিয়ে পালিয়ে গেল। সবাই এসে থামলো শহীদ মিনারের কাছে। ধপাস ধপাস একজনের গায়ের উপর আরেকজন এসে পড়লো। হাসতে হাসতে একপ্রকার শুয়ে পড়লো আহির আর নিখিল। সুজানা মেহুল হাসির চোটে ব্যাগ দিয়ে মুখ চেপে ধরেছে। চোখে জল নেমে এসেছে ইতোমধ্যে। জায়িন এসে ধপ করে বসলো আহিরদের পাশে। বলল
টিট ফর ট্যাট।
সুজানা দম নিয়ে বলল
এই তোদের কে বলছে ওদের সাথে লাগতে? হ্যা? পারিসও বটে।
আহির জায়িনের গায়ে ঢলে পড়ে বলল
ইজ্জতভ্রষ্ট থেইকা বাইচা গেলাম।
নিখিল পেট চেপে ধরে বলল
মাগোমা বেডিমানুষ এমন বেয়াদব কেমনে হয়? কেমন কইরা ধরছে বাপরে।
শান্তা মেহুল রেগে তাকালো। জায়িন বলল
ওরা বেডি না।
বলেই সুজনা মেহুল আর শান্তার দিকে তাকিয়ে জিভ কামড় দিল।
নিখিল বলল
ওরা বেডা না বেডি সেইটা জাইনা আমাগো কাম কি? বাপরে বাপ যে শক্তি। এখনো হরলিক্স খায় নাকি?
আহির চোখ টিপে বলল
মানুষের ইজ্জতভ্রষ্ট করে হরলিক্স খাওয়া? আইচ্ছা আইচ্ছা।
শান্তা বলল
তোদের আবার ইজ্জত আছে নাকি? যে ইজ্জতভ্রষ্ট হবে? অসহ্য।
এই অশান্তির বাচ্চা চুপ থাক। তোরে কে ফটরফটর করতে কইছে? আমাদের ইজ্জত নিয়ে টানাটানি পড়ছে আর তুই বলছিস ইজ্জত আছে কিনা। কি শরম কি শরম।
শান্তা মুখ মোচড়ে বলল
মরে যাই।
তুই মরে যাহ। আমি করব কুড়ে আসি।
সুজানা বলল
আহ থামবি তোরা। সময় দেখ তো।
মেহুল সময় দেখে মাথায় হাত দিল। জায়িন বলল
ও মাই গড। অভিক স্যারের ক্লাস মিস।
সবাই একে অপরের দিকে তাকালো। নিখিল জায়িনের মাথায় ধপাস করে মেরে বলল
তোর বইন ক্লাসে চইলা গেল আর তোরে বলে নাই।
তুই না থাকলে বলতো।
আমি তোর বইনের কইলজ্যা খাইছি?
সুজানা বলল
আরেহ থামবি? ক্লাস আর পাবো না?
মাঝক্লাসে গিয়ে লাভ আছে? প্যারা নাই। আমার বাতাস খাই।
শান্তা বিরক্ত হয়ে বলল
স্টুপিট। তোদের কারণে ক্লাসটা মিস গেল। অসহ্য।
আহির বলল
ধুরর বেডি তুই চুপ কর তো। আমার এখনো শিরশিরানি যায়নি। ভাই মানুষ বিয়ার পর মরেনা ক্যান? আমি তো বউ ছোঁয়ামাত্র মইরা যামু।
সুজানা হেসে বলল
কথার কি ছিঁড়ি!
____________
ব্যস্ত জনপদের পদচারণায় মুখোরিত ব্যস্ত চট্টগ্রাম শহর। শান্তাকে সাথে করে নিউমার্কেটে চলে এসেছে সুজানা। আজ শাটল ধরেনি তারা। টেডি কিনবে অনা আর আবিদের জন্য। দাওয়াত যেহেতু পড়েছে সেহেতু না গেলে অভিক স্যার বারবার কথাটা রিপিট করতে থাকবে তার কানের উপর। কেমন আজব ধরণের মানুষ। যেন না শুনতেই চান না উনি।
সুজানা কাউকেই বলেনি যে সে অভিক স্যারের বাড়িতে সে পড়াতে যায়। সবাই জানলে সেটা নিয়ে অযথা মাতামাতি হবে। যদিও সে শান্তা আর মেহুলের কাছ থেকে কিছুই লুকোয় না। একাদশ শ্রেণী থেকে তার তিন বান্ধবী আর দুইবন্ধু একসাথে এতদূর। জায়িনের সাথে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙনে পরিচয় হলেও বোকাসোকা ছেলেটাও তাদের বন্ধুমহলের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ একজন।
শান্তা পছন্দ করে দুটো টেডিবিয়ার চুজ করে দিল। প্রায় হাজারের কাছাকাছি এল দুটোর দাম। অন্যগুলো খানিকটা সস্তা হলেও সুজানার পছন্দ হচ্ছে না। উনারা বড় মাপের মানুষ। নিজেকে অন্যের কাছে সস্তা উপস্থাপন করা নিয়ে সুজানার নিজের সাথে বহু দ্বন্দ্ব চলে। সে নিজের অভাব অনটনের ব্যাপারগুলো সহজেই কাউকে দেখাতে চায় না। কমবেশি সবারই এসব থাকে। অভাব অনটন না থাকলে অনেক কিছু শেখা থেকে বঞ্চিত হয় মানুষ।
শান্তা টেডি দুটোকে দেখিয়ে বলল
এগুলো তোর স্টুডেন্টদের হেব্বি পছন্দ হবে দেখিস।
একটু ছোট হয়ে গেল মনে হচ্ছে।
মাঝারি সাইজের। টাকা বের কর। বড় পেয়ে যাবি।
আচ্ছা থাক গে।
আর কিছু কিনবি?
হুম।
প্রসাধনীর বড় দোকানটাতে ঢুকে একজোড়া চুড়ি দেখলো সুজানা। শান্তা বলল
সুন্দর। আমিও কিনবো।
সুজানা তার দিকে ফিরে অবাক গলায় বলল
তুই কার জন্য কিনবি?
দাদুর জন্য। কখনো খেয়ালই হয়নি। আজ কিনব। খুশি হবে ভীষণ। মা থাকলে মায়ের জন্য কিনে নিয়ে যেতাম না?
সুজানা হাসলো। বলল
উনিই তো তোর মা।
শান্ত মৃদু হাসলো।
ইয়েস। মাই গ্র্যান্ডমা ইজ মাই এভরিথিং।
______________________________
জন্মদিন উপলক্ষে আজ অনা আবিদের ছুটি। তাদের টিচার আসবে মাগরিবের পরে। কেক কাটার আগে। ছোটোখাটো করে কেক কাটার আয়োজন হবে মনে করে এসেছিল সুজানা। কিন্তু এসেই নবকুঠিরে বিস্তর আয়োজন দেখে হা হয়ে গেল সে। সামান্য একটা জন্মদিনের জন্য এত আয়োজন করা লাগে? আর এত মানুষ? কালো আর সোনালী রঙের সেলোয়ার-কামিজটি গত ঈদে কিনেছিল সে। ওড়নাটা একটু ভারী হওয়ায় সে খুব কমই পড়েছে ড্রেসটা। এমনিতেও সে আরামদায়ক কাপড়চোপড় পড়তে বেশ পছন্দ করে। স্টুডেন্টদের জন্মদিন উপলক্ষে অন্যদিনের চাইতে একটু ব্যতিক্রম ভাবে এসেছে সে। কিন্তু এসেই মনে হলো আরও একটু ব্যতিক্রম হওয়া উচিত ছিল। বারো তের বছরের কয়েকটা মেয়েকে দেখা গেল স্কার্ট পড়া। বাচ্চা বাচ্চা কয়েকটা ছেলেপেলে। যুবক যুবতী তরুণ তরুণী সংখ্যাও নেহাত কম নয়। শুধুই জন্মদিন নয় নিশ্চয়ই আরও বড় কোনো কিছু উপলক্ষ আছে আজ।
সুজানাকে দেখে মর্জিনা আনিকাকে ডেকে নিয়ে এল। আনিকা তাকে দেখে হেসে বলল
সুজানা এসেছেন? বাহ আজকে টিচারকে মিষ্টি লাগছে ভীষণ। এমা এসব কি এনেছেন?
সুজানা হেসে বলল
ওরা কোথায়? সামান্য কিছু এনেছি।
এসবের কোনো প্রয়োজন ছিল না সুজানা। আপনি এখনো স্টুডেন্ট।
সুজানা বিড়বিড়িয়ে বলল
হাহ তো দাওয়াতের কি প্রয়োজন ছিল? বেতন থেকে এক হাজার গচ্ছা গেল।
সুজানা খেয়াল করলো গায়ের পড়নে খয়েরী রঙা জামদানীটা আনিকার গায়ে বেশ ভালো মানিয়েছে। যেমন মায়াবী চেহারা তেমন ব্যবহারও সুন্দর। অনা বড় হলে একদম মায়ের মতো হবে।
সুজানা আনিকার পেছন যেতে যেতে বলল
ম্যাডাম একটা কথা জানতে চাইবো?
হ্যা বলুন।
আজকে কি জাস্ট বার্থডে নাকি অন্য কিছু ও আছে।
আনিকা হাসলো। বলল
কিভাবে বুঝলেন?
না এত মানুষ তো হওয়ার কথা নয় তাই আর কি।
আজকে আমাদের দাদী শ্বাশুড়ি ইন্ডিয়া থেকে আসছেন। উনি উনার মেয়ে মানে মানে আমার ফুপী শ্বাশুড়ির কাছে গিয়েছেন চারমাস হলো। অভি দেশে ফিরেছে শুনে আসছেন। আর কাকীরও একটা মানত ছিল অভি দেশে ফেরার পর বড় করে একটা মেজবান দেবেন আমার দাদা শ্বশুরের। এতিমখানার লোকজন খাওয়াবে এই আর কি। জন্মদিন ও পড়লো একইদিনে।
সুজানা বলল
ওহহ তারমানে আসল ব্যাপার জন্মদিন না। তাহলে তো আমার না আসলেও চলতো।
আনিকা থেমে গিয়ে পেছনে ফিরলো। বলল
আমি কিন্তু বয়সে বড়। বকতে পারি। টিচারকে ছাড়া ওরা কেক কাটবে কি করে?
সুজানা হাসলো। বলল
আপনার দাদী শ্বাশুড়ি ফিরলে কি কেক কাটবে? মানে অনেক রাত হবে। আমাকে সাইফ ভাই নামিয়ে দিল। আমি নটার দিকে আসতে বললাম তো।
সাইফ?
হ্যা। আমার বড় ভাইয়ের মতো। আমার টিচারও বলতে পারেন। আমি উনার কাছে পড়তাম এখনো পড়ি।
ওহহ। আচ্ছা যাওয়া নিয়ে ভাববেন না। বেশি রাত হবেনা। সবাই মাঝপথে গাড়িতে আছে। অভি আর আবিদের বাবা গিয়েছে। এখনি ফিরবে তখন কেক কাটবে।
আবিদ আর অনা ততক্ষণে আরও কয়েকটা বাচ্চা কাচ্চাকে সাথে নিয়ে হাজির। আবিদ কালো চশমা খুলে সুজানাকে চাইলো। অনা সাদা ফ্রক মেলে ধরে বলল
সুজান বিটিফুল । অনা বিটিফুল।
সুজানা হাসলো। দুজনেই টেডিবিয়ারের প্যাকেটটা নিয়ে তন্মধ্যে খুলে ফেলল। টেডিবিয়ার পেয়ে ভীষণ খুশি হয়ে বলল
আলাভিউ সুজান।
সুজানা হেসে দু’জনের গালে আদর করে বলল
আলাভিউ ঠু। আপনাদের তো আজকে ভারী সুন্দর লাগছে।
আবিদ মাথা দুলিয়ে বলল
সুজানকে চুন্দুল লাছছে।
সুজানা আবারও হাসলো। দুজনেই বাকিদের সাথে খেলতে খেলতে চলে গেল।
চাপা স্বভাবের হওয়ায় সুজানা কারো সাথে কথা বলতে পারলো না নিজ থেকে। তবে আনিকার মা আনোয়ারা বেগমকে চেনায় উনার সাথে খোশগল্পে খানিক্ষণ মজে ছিল সে আনিকার ঘরে। খাওয়াদাওয়াও বেশ হলো। অনা আবিদ তখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। সুজানা দোতলায় ঘুরঘুর করলো অনেক্ক্ষণ। কয়েকটা তরুণীর সাথে টুকটাক পরিচয় হলো বৈকি। বেশ ভালোই লাগলো। কত বড় পরিবার আর কত আত্মীয়স্বজন এদের। মেহুলের এখানে বিয়ে হলে সে খুব সুন্দর একটা পরিবার পেত। পাগলটা তো সাইফ ওয়াহিদ ছাড়া কিছুই বুঝেনা। আজব ভালোবাসা তাদের।
পায়চারি করতে করতে আবারও আনিকার ঘরের দিকে পা বাড়াতেই নীচে হৈচৈ শোনা গেল। তারমানে বাড়ির বড় গিন্নী এসে গেছেন।
সুজানা যাবে যাবে করেও ওদিকে গেল না। কোনোমতে কেকটা কাটার পর চলে যেতে পারলেই হলো।
সে যখন আনিকার ঘরে বসেছিল তখন সতের আঠারো বছর বয়সী একটা মেয়ে এসে বলল
আপু তোমাকে আনিকা ভাবি ডাকছে।
কোথায়?
নীচে।
আচ্ছা।
সুজানা মাথা দুলিয়ে চুপচাপ বসে রইলো।
যাবে কি যাবে না করতে করতে ঘর থেকে বের হলো। পথিমধ্যে অভিককে আসতে দেখে দুপা থেমে গেল তার। অভিকের সাথে আরও কয়েকজন আছে। নিশ্চয়ই বন্ধুটন্ধু হবে। সুজানা পালিয়ে গেল। আনিকার ঘরের ভেতর ঢুকে আনোয়ারা বেগমের পাশে গিয়ে পালঙ্কে গুটিসুটি মেরে বসতেই খেয়াল হলো পুরুষালি গলার আওয়াজ এই ঘরের ভেতরেই প্রবেশ করেছে। এরা এখানে কেন এসেছে বাবা?
সুজানা পিছু করে বসে মাথায় দেয়া কাপড়টা আরও টেনে দিয়ে হাত দিয়ে হাঁটু আগলে তাতে থুঁতনি ঠেকিয়ে বসলো। কয়জন এল তার হিসেব নেই সুজানার কাছে। আনোয়ারা বেগম আর পুরো ঘরের সব মুরব্বি মহিলাদের সাথে কথা বলা হাসাহাসি তামাশা শেষ করার হঠাৎ একজন বলে উঠলো
উনি কে? কালো ড্রেস।
সুজানার বুকের ভেতর কেমন একটা করে উঠলো। সে মাথা আরও নামিয়ে নিল। পাশ থেকে একজন মহিলা বলে উঠলো
মেহমান আর কি। আচ্ছা তোদের টায়ার্ড দেখাচ্ছে। আগে খাওয়াদাওয়া কর। অভি ওদের নিয়ে যাহ।
অভিক মাথা দুলালো। পশ্চিমমুখী হয়ে নত মাথায় বসে থাকা মেয়েটার দিকে ভুরু কুঁচকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর বেরিয়ে গেল বন্ধুদের সাথে। সুজানা হাঁফ ছাড়লো।
আনিকা ডেকেছে তাই যুবকগুলো কোনদিকে গিয়েছে তা দেখার জন্য রুমের বাইরে উঁকি দিতেই চমকে উঠলো। লজ্জা পেয়ে রক্তিম হয়ে উঠলো মুখ। দেখলো কালো পাঞ্জাবি পরিহিত একজন সৌম্যদর্শন মানব তার সামনে দাঁড়িয়ে । পাঞ্জাবির কলারে সোনালী রঙের কাজ।
সুজানাকে অমন করে চমকাতে দেখে মানবের
সরল চোখদুটোতে ধীরেধীরে ফুটে উঠলো ক্রুর হাসির ছাপ। সুজানা মাথা নামিয়ে ওড়না মুচলেকা করতেই অভিক হাসলো। বলল
আপনি ম্যারিড?
নাহ।
তাহলে তখন ওভাবে ঘোমটা টেনে বসেছিলেন কেন?
এমনি। আমার অচেনা কাউকে ফেস করতে অসুবিধা হয় প্রথম প্রথম।
গুড। কিন্তু একটা সমস্যা।
কিহ?
আমার বন্ধুবান্ধব সকলকে বলে দিয়েছি ঘোমটা দিয়ে রাখা মহিলাটি ম্যারিড। তাই সে কারো সাথে কথা বলে না। সো এখন বুঝতে পেরেছেন?
সুজানা চোখ তুলে তাকিয়ে বলল
কিহ?
জাস্ট কারো সাথে কথা বলতে যাবেন না এটাই।
আচ্ছা।
তন্মধ্যে
আনিকা এসে বলল
এমা অভি তুই বললিনা চেঞ্জ করবি। এখানে গল্প শুরু করে দিয়েছিস সুজানার সাথে।
অভিক সুজানার দিকে একপলক তাকিয়ে চোখ ঘুরিয়ে নিল। যেতে যেতে বলল
চেঞ্জ করব না আমি।
আনিকা বিড়বিড় বলল
হঠাৎ মুড চেঞ্জ তার
চলবে……