আমার অবেলায় তুমি পর্ব -২১

#আমার_অবেলায়_তুমি
#সানজিদা_বিনতে_সফি(সাথী)
#পর্ব_ ২১

ময়না বেগম কে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে খাইয়েছে মাহতাব। ময়না বেগম সারাদিন তাদের পিছনে লাগলেও ভাইদের সে অসম্ভব ভালোবাসেন। মাহতাব আর মেহরাব তা খুব ভালো করেই জানে। তাই খুব ধৈর্য নিয়েই তারা বোন কে সামলায়।

ময়না বেগমে কে খাইয়ে মাহতাব রুমে এসে দেখে মধু মুখ ভার করে বসে আছে। মাহতাব একবার আড়চোখে তাকিয়ে নিজের ল্যাপটপ নিয়ে সোফায় বসলো। মাহতাবের গম্ভীর থমথমে মুখ দেখে মধু চোখ নামিয়ে ফেললো। মাহতাব কিছু কি বুঝতে পেরেছে? কপালে সুক্ষ্ম ঘামের রেখা দেখা দিল। পুরনো ঘা তাজা হয়ে বুকের ভিতর রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে গেলো৷ কাপা কাপা হাতে কপালের ঘাম মুছে বিষাদ চোখে মাহতাবের দিকে তাকাতেই দেখলো মাহতাব ও তার দিকেই তাকিয়ে। মাহতাবের শান্ত আস্বস্তপূর্ণ চাহনিতে মধুর অশান্ত মনটা হঠাৎ করেই শান্ত হয়ে গেলো। মাহতাবের বিশ্বস্ত চোখের দিকে তাকিয়ে চোখে জল নিয়েই মুচকি হাসলো সে।

— কাছে এসো মধু।

মধু দেড়ি করলো না। বলার সাথে সাথেই মাহতাবের সামনে গিয়ে দাড়ালো। উৎসুক দৃষ্টিতে মাহতাবের পরবর্তী বাক্য শোনার জন্য আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইলো।

— আমার কাছে এসে বসো। যতটা কাছে বসলে তুমি আমার হৃদপিন্ডের ধুকপুকানি শুনতে পাও ঠিক ততটা। নাহলে বুঝবে কি করে, আমার মনে তোমার জন্য কতটা বিশ্বাস আর ভালোর আছে?

মধু বিমূঢ় নয়নে তাকিয়ে রইলো। নিষ্পলক দৃষ্টি মাহতাবের চোখের পানি রেখেই এগিয়ে গিয়ে মাহতাবের বুকে মাথা রাখলো।

— আপনার বুকে আসার আগেই আপনার চোখ সবকিছু বলে দেয় বর সাহেব৷ আমি আপনাকে ভরসা করি। আমাকে কখনো ভুল বুঝবেন না প্লিজ। আমি খুব সাধারণ একটি মেয়ে। আপনার জানার থেকেও আমি অনেক বেশি সাধারণ।
আমার জীবনে দু’জন পুরুষের আগমন হয়েছে। যাদের আমি অসম্ভব ভালোবাসি আর বিশ্বাস করি। একজন আমার বাবা। যে আমাকে জন্ম না দিয়েও নিজের মেয়ের মতো ভালোবেসেছেন। সে যদি আমাকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে না আনতেন তাহলে আজ আমার জায়গা কোথায় হতো তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শুনেছি বাবা আমাকে ডাস্টবিনের পাশ থেকে তুলে এনেছেন। তখন আমার ছোট্ট শরীরটা কিছু কুকুর টানাটানি করছিল। বাবা তখন আমাকে আগলে না নিলে আমি হয়তো সেদিন কুকুরের পেটে চলে যেতাম।

কথা গুলো বলেই হালকা হাসলো মধু। মাহতাব একদৃষ্টিতে মধুকে দেখছে। মাহতাবের বুক থেকে নিজের মাথা টা তুলে সোজা হয়ে বসলো। মাহতাব এখনো তাকে বাহুবন্ধনে আটকে রেখেছে। মধু ধীর গলায় আবার বলতে শুরু করলো,

— আমার জীবনের দ্বিতীয় আর শেষ পুরুষ হচ্ছেন আপনি। আমি আমার মনের সম্পুর্ণ অংশ আপনার নামে করে দিয়েছি৷ বিয়ের দিন আপনি হয়তো ভেবেছেন আমি বিয়ে করতে চাইনি বলে তারা আমাকে মা*র*ধ*র করেছে। আসলে কিছুদিন আগের করা তাদের কুকর্ম আমি যাতে কাউকে না বলি তাই তারা আমাকে মা*র*ধ*র করেছে৷ আমি পালিয়ে যেতে চাইছিলাম। এ জীবন থেকে মুক্তি চেয়েছিলাম। বাবার মৃত্যুর পর থেকে মা আমাকে সহ্য করতে পারতো না। মায়ের ধারণা আমার জন্য বাবার মৃত্যু হয়েছে। সেদিন যদি আমি ঘুরতে যাওয়ার বায়না না করতাম তাহলে বাবার মৃত্যু হতো না। মায়ের জায়গায় হয়তো মা ঠিক। সেসব কথায় আর যেতে চাইছি না। আমি আপনাকে আমার মন থেকেই ভালোবেসেছি। আমার মনে আপনার জন্য অনেক বিশ্বাস আর ভরসা তৈরি হয়েছে। যেমনটা আমি আমার বাবা কে করতাম। আমার কোন ব্যবহারে যদি আপনি কষ্ট পেয়ে থাকেন তার জন্য আমি খুবই দুঃখিত। আপনি যেমন আমি আপনাকে ঠিক সেভাবেই ভালোবাসি। আমকে নিয়ে মনে কোন সংশয় রাখবেন না।

মাহতাব মধুকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। ওর মাথা টা বুকের সাথে চেপে ধরে চুপ করে বসে রইল। মধুও তার স্বামী কে শক্ত করে আকড়ে ধরলো।

দরজায় নক হতেই দুজন দুজন কে ছেড়ে বসলো। মাহতাব মুচকি হেসে মধুর মাথায় হাত বুলিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। সামনেই মেহরাব বোকা বোকা হেসে দাঁড়িয়ে। মেহরাবের হাসি দেখে মাহতাব কপাল কুচকে ফেললো।

— কি চাই?

— বউ চলে গেছে। টাকা দাও,বউয়ের রাগ ভাঙ্গাতে হবে।

— কত টাকা?

— পঞ্চাশ হাজার।

— আমার কাছে এখন ক্যাশ নেই। কার্ড নিয়ে যা।

— আচ্ছা।

মাহতাব কার্ড এনে দিতেই মেহরাব দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলো। মাহতাব মুচকি হেসে দরজা আটকাতে নিতেই ময়না বেগম প্রকট হলো। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে কটমট করে বলল,

— তুই ওকে টাকা দিলি কেন?

— ওর টাকা দরকার ছিল আপা।

মাহতাবের শান্ত গলা শুনে ময়না বেগমের মন শান্ত হলো না। কর্কশ গলায় বলল,

— ওর কাছে টাকা নেই? ডাক্তার হয়েছে কি জন্য? এতো টাকা ইনকাম করে সেই টাকা কই যায়? আমি বলে দিচ্ছি মাহতাব, এই ছেলের ভাবগতি কিন্তু সুবিধার নয়। নিশ্চয় বিপথে টাকা উড়ায়। তুই আজ ই খবর নে। কোথায় কোন আকাম কুকাম করে বেরাচ্ছে তার একটা লিস্ট করে আমাকে দিবি। বেয়াদবটার জন্য বউ টা বাড়ি ছাড়া হল। ওর এ বাসায় ভাত বন্ধ। তোর বউ কে ডাক। ওকে বলতে হবে আজ থেকে মেহরাব কে বাসায় যেন খেতে না দেয়। খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে রইলি কেন? যা,ডেকে আন।

— আমি বলে দিবো আপা।

— আমি তোকে বিশ্বাস করি না।

— আজ থেকে করবে আপা। আমি সত্যিই মেহরাবের বাসায় খাওয়া বন্ধ করে দিবো।

— সত্যি তো?

— হুম।

— ঠিক আছে। চা খাবি? আমি বানাবো।

— খাবো।

— আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।

ময়না বেগম খুশি মনে কিচেনের দিকে চলে গেলো। বদটাকে এবার একটা উচিত শিক্ষা দেয়া যাবে। তার পিছনে লাগতে আসা! অসভ্য একটা।

মাহতাব দরজা লাগিয়ে মধুর পাশে গিয়ে বসলো। মধু কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে।

— এসবের অভ্যাস করে নাও। এখন এটাই তোমার বাড়ি। আর এই মানুষ গুলোই তোমার আপনজন। কারোর মনে কষ্ট না দিয়ে কিভাবে তাদের সামলাতে হয় তা বুঝতে চেষ্টা করো আস্তে আস্তে। আমি আছি তোমার পাশে।
মধু মাথা নেড়ে সায় জানালো।

— অফিসের কিছু কাজ করবো। তুমি আপার কাছে গিয়ে দেখো সে কি করে। মায়ের ঔষধ খাওয়া হয়েছে কি না একটু দেখে এসো।

মধু মুচকি হেসে ‘আচ্ছা’ বলে চলে গেলো। মাহতাবও নিজের কাজে মন দিলো। আজকে কিছু ইমপোর্টেন্ট মিটিং ছিল তার। অফিসে না যাওয়ায় বাসা থেকেই মিটিং সারতে হবে।
মধু কিচেনে গিয়ে ময়না বেগমের পাশে দাড়াতেই ময়না বেগম গদগদ গলায় বলল,

— আজকে তোমার ছোট ভাইয়ের বাসায় ভাত বন্ধ। জানো তো?

— জি আপা।

— কিছুতেই খেতে দিবে না।

— আচ্ছা।

— আমি চা করছি। খাবে তো?

— হুম।

— ঠিক আছে। আগে মাহতাব কে এক কাপ দিয়ে এসো। না থাক,তুমি বরং তোমার চা টাও নিয়ে যাও। দুজনে একসাথে বসে খাবে।

— সে তো অফিসের কাজ করছে আপা।

— তাহলে আমরা দুজনই গল্প করতে করতে চা খাবো।লামিয়া টা থাকলে কতো ভালো হতো। বজ্জাত টা মেয়েটাকে এক মুহুর্ত শান্তি দেয় না। তুমি মাহতাব কে চা দিয়ে এসো।আমি বরং লামিয়া কে একটা কল করে দেখি ও কোথায় আছে।

মধু মুখ টিপে হেসে চা নিয়ে চলে গেলো। ময়না বেগম কে তার কাছে একটা আদুরে টেডিবিয়ারের মতো লাগে। বড্ড আদুরে।
মধু চা নিয়ে রুমে যেতেই দেখলো মাহতাব কনফারেন্স মিটিং করছে। মধু নিঃশব্দে চা রেখে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। কুলসুম বেগমের রুমে গিয়ে তাকে একবার দেখে আসতে হবে।

চলবে,,

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here