আমার আকাশে তারা নেই পর্ব -০৩

#আমার_আকাশে_তারা_নেই
#লাবিবা
পর্ব: 3

সকাল হতেই ইচ্ছে গোছগাছ শুরু করে দিল। আজই সে ঢাকায় ফিরে যাবে। ইহানকে ছাড়া তার দমবন্ধ হয়ে আসছে। এখানে তার পক্ষে আর একটি দিন ও থাকা সম্ভব হচ্ছে না। নিলুফা বেগম সেই কখন থেকে কান্নাকাটি করে চলছেন। এতদিন পর মেয়ে তার কাছে এলো সপ্তাহখানেক থাকবে তা না তিন দিনের মাথায় চলে যাচ্ছে। আবার কবে মেয়েকে কাছে পাবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। ইচ্ছেরও খুব মন খারাপ হচ্ছে মা-বাবাকে ছেড়ে যেতে কিন্তু না গেলে সে বোধ হয় আর বেঁচে থাকতে পারবে না। ইহানকে ছাড়া তার কেমন পাগল পাগল লাগছে নিজেকে।
সব ঠিক থাকলেও সমস্যা হল ইচ্ছে একা অতদূর পাড়ি দিতে সাহস পাচ্ছে না। একা একা এভাবে কখনও আসা-যাওয়া করা হয়নি তার। অবশেষে ঠিক হলো মোশাররফ মোড়ল তাকে দিয়ে আসবেন। ইচ্ছের ও দুশ্চিন্তা দূর হলো।

_____________

গ্রাম থেকে ফিরে এসেছে ইচ্ছে আজ সপ্তাহখানেক হয়েছে। আগের নিয়মেই তার জীবন চলতে লাগলো। ইহান তার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে আর ইচ্ছে দিন শেষে ইহানের থেকে একটু ভালবাসা পাওয়ার আশায় মরিয়া হয়ে থাকে।

অফিসে অতিরিক্ত কাজ থাকায় আজ ফিরতে বেশ দেরি হয় ইহানের। সারাক্ষণ কাজের চাপে থাকার ফলে তার মন মেজাজ সবসময় খিটখিটে হয়ে থাকে। তার উপর আজ কাজে সামান্য ভুল ত্রুটি হওয়ায় তার থেকে উচ্চপদস্থ অফিসারের থেকে সামান্য বকা শুনতে হয়েছে যা তার ব্যক্তিত্বে আঘাত হেনেছে। প্রচন্ড ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ ইহান। বেল বাজতেই শারমিন বেগম দরজা খুলে দেন। মাকে দেখে হেসে সালাম দিয়ে নিজের রুমে চলে যায় ইহান। শারমিন বেগম ছেলের যাওয়ার পানে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ছেলেটি তার কাজ ছাড়া কিছুই বোঝে না। তার জীবনে যেন কাজ ছাড়া অন্য কিছুর অস্তিত্ব নেই।
ফ্রেশ হয়ে বের হতেই সে উপলব্ধি করে তার প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে। মাথাটা টিপে দিলে হয়তো ভালো লাগতো। কিন্তু সে আসার পর থেকে এখনো ইচ্ছেকে দেখতে পায়নি। জোরে জোরে নাম ধরে কয়েকবার ডাকার পরও ইচ্ছের কোন খবর নেই। মেজাজ তার আগে থেকেই বিগড়ে ছিল এখন আবার ইচ্ছের নিরুদ্দেশ হওয়ায় মেজাজটা আরও বিগড়ে গেল। নিজের রুম থেকে বেরিয়ে ইরারর রুমে যেতেই দেখতে পেল ইরা আর ইচ্ছে কোন একটা ব্যাপার নিয়ে হাসাহাসি করছে। এতে তার মেজাজ আরো খারাপ হলো। বোনের সামনে স্ত্রীর সাথে খারাপ ব্যবহার করাটা বেমানান তাই নিজেকে ধাতস্থ করে শান্তকণ্ঠে ইচ্ছে কে ডাকে নিজের রুমে চলে গেল।

-‘ভাইয়া দেখছি তোমায় চোখে হারায়! আসতেই বউয়ের খোঁজে নেমে পড়েছে। কি প্রেম!’

মুহূর্তেই ইচ্ছের মেদহীন গালে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়ল। কান থেকে যেন আগুন বের হচ্ছে। নিজের লজ্জা ঢাকতে ইরাকে কিছু না বলেই ছুটে রুম থেকে বেরিয়ে গেল ইচ্ছে। এমনিতেই ইরার ঠোঁটকাটা স্বভাব। ইচ্ছেকে এর থেকেও ভয়ানক লজ্জা দিতে সে দুবার ভাববে না। তাই ভয়ানক লজ্জার সম্মুখীন হওয়ার আগেই সেখান থেকে সরে যাওয়াই উত্তম।

-‘আমি বাসায় এসেছি সে খেয়াল আছে তোমার?’

ইচ্ছে চুপচাপ দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচল হাতে পেঁচিয়ে চলছে। রুমে আসতেই ইহানের রাগের সম্মুখীন হতে হয়েছে তাকে। একটু নাহয় দেরি হয়েছে তাই বলে এভাবে বকতে হবে?!

-‘মাথা ব্যাথা হচ্ছে খুব। মাথাটা টিপে দাও তো।’

বলেই বেডে শুয়ে পরলো ইহান। ইচ্ছে ভেবেছিলো ইহান তাকে আরো কিছু বলবে। কিন্তু এত অল্পে থেমে যাওয়ায় ইচ্ছে বেশ অবাক হলো আবার খুশিও হলো। সে আস্তে করে ইহানের পাশে বসল। সে বসতেই ইহান তার মাথাটা ইচ্ছের কোলে রাখলো। ইচ্ছে এবার আরো অবাক হলো। ইহানের আজ কি হলো? খুশির থেকে অবাক বেশি হচ্ছে সে।

-‘কি হলো মাথাটা টিপে দাও?’

ইহানের কথায় ইচ্ছে আলত হাতে মাথা ম্যাসেজ করে দিতে থাকে। ইচ্ছের ঠোঁটে লেগে আছে মিষ্টি হাসির রেখা। ইহান তার কোলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে এটাই তার কাছে অনেক। সারাটা রাত সে ওভাবেই ইহানের মাথা কোলে নিয়ে বসেছিল। ভোরের দিকে তার চোখটা লেগে আসে। সারারাত সে ডিম লাইটের আলোতে ঘুমন্ত ইহানকে দেখে কাটিয়েছে। কি নিষ্পাপ সুন্দর সে মুখশ্রী! সারারাত জেগে থাকতে ইচ্ছের একটুও কষ্ট হয়নি, এ ও যেন পরম এক শান্তি।

_________________

আজ ইহান আর ইচ্ছে কক্সবাজার যাচ্ছে ঘুরতে। যদিও এতে ইহানের মোটেও মত নেই। নাজমুল সাহেব ইহানকে বাধ্য করেছে অফিস থেকে ছুটি নিতে। তবে ইচ্ছে খুব খুশি। তার অনেক দিনের ইচ্ছা কক্সবাজার ঘুরতে যাওয়ার। অবশেষে তার ইচ্ছা পূরণ হতে চলেছে। ইচ্ছে তার জমানো টাকা গুলো নিয়ে নিল। সে অনেক কিছু কিনে আনবে ওখান থেকে।

ইহান বেশ নামকরা এক রিসোর্টে রুম বুক করেছে। রিসোর্টটা বেশ সুন্দর। ইচ্ছের বেশ পছন্দ হয়েছে। বেশ জমকালো পরিবেশ। তারা রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিল। তাদের পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ফ্রেশ হয়ে তারা নিচে নামল নাস্তা করে নেওয়ার জন্য। নাস্তা শেষে তারা আবারো ফিরে এলো রুমে। তারা আজ আর ঘুরতে বের হবে না। জার্নি করার ফলে দুজনেরই রেষ্ট দরকার।
রুমের সাথে একটি খোলা বারান্দা রয়েছে। বারান্দাটিতে দুটি বেতের সোফা রয়েছে। ইচ্ছে যেয়ে সেখানে বসল। দূর থেকে সাগরের কলকল ধ্বনি ভেসে আসছে। ইচ্ছের মন চাচ্ছে এখনই ছুটে যেতে। সাগর যেন তাকেই ডাকছে।

ইহান কিছুক্ষণ ফোন চাপাচাপি করল। কিন্তু তার ভালো লাগছেনা। আজকাল তার কিছুই ভালো লাগে না। সবকিছু কেমন বিরক্ত লাগে। কাজের মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে রেখেই সে শান্তি পায়। সে বেডে শুয়ে এপাস ওপাস করতে লাগলো।

-‘আপনি এমন করছেন কেন? শরীর খারাপ করেছে?’

ইচ্ছের কথা শুনা মাত্র ইহান নড়াচড়া বন্ধ করে দিল। এই মুহূর্তে ইচ্ছেকে তার একটুও সহ্য হচ্ছেনা। এই মেয়েটার জন্যই তাকে এখানে আসতে হল। সব কিছুর মূল এই মেয়েটা।

-‘কিছু বলুন? খারাপ লাগছে আপনার?’

ইহান এবার ইচ্ছের দিকে ফিরে তাকাল। বেশ শান্ত দৃষ্টিতে ইচ্ছের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। হঠাৎ এভাবে তাকিয়ে থাকায় ইচ্ছে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। তার ফর্সা গোলগাল মুখটা মূহুর্তেই লাল হয়ে উঠলো। দৃষ্টি এলোমেলো হলো। যখন সে নিজেকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল তখন ইহান শান্ত কন্ঠে বলে উঠলো,

-‘একটা অনুরোধ করব তোমায়?’

ইচ্ছে মাথা তুলে ইহানের দিকে তাকালো। তার দৃষ্টিতে কৌতুহল। ইচ্ছে ইহানের চোখে চোখ রেখে ও চোখের ভাষা বুঝতে চাইল। কিন্তু সে ব্যর্থ হলো। সে কখনোই ইহানের চোখের ভাষা পড়তে পারে না।

-‘তোমার ইচ্ছে গুলো কে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেবে না প্লিজ। এটা আমায় খুবই যন্ত্রণা দেয়।’

ইচ্ছে থমকালো। সে কি তার ইচ্ছাগুলো ইহানের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে? নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করল ইচ্ছে। হ্যাঁ সে তো চাপিয়েই দিচ্ছে। ইহানতো ঘুরতে আসতে চায়নি বরং তার জন্যই ইহানকে আসতে হল। ইচ্ছের বুক ভারী হয়ে আসলো। ইহানের এমন সহজ স্বীকারোক্তি যেন আর বুকে আঘাত হেনেছে। সে কোন কথা বলল না। ধীর পায়ে আবারো বারান্দায় ফিরে গেল। রাতটা আসে বারান্দাতে কাটিয়ে দিল নির্ঘুম ভাবে।

________________

-‘আমরা কি এখন ঘুরতে বের হব ইহান?’

ইচ্ছের কথায় আয়না থেকে চোখ সরিয়ে পাশে তাকায় ইহান। মেয়েটা সাদা একটা শাড়ি পড়েছে সাথে গোলাপি রঙের ব্লাউজ। চুল গুলো হাতখোপা করা। মুখের দুপাশে কাটা চুল গুলো ছড়িয়ে আছে। কৃত্রিম কোন সাজসজ্জা নেই মুখে তার। কিছুক্ষণের জন্য থমকালো ইহান। সাদা শাড়িতে মেয়েটিকে মোহনীয় লাগছে। নারীর রূপের মায়া খুবই ভয়ংকর! সে মায়ায় একবার আটকে গেলে ছাড়া পাওয়া দায়। দৃষ্টি সরিয়ে আবার ও আয়নার দিকে তাকালো ইহান। বেশিক্ষণ ওদিকে তাকিয়ে থাকলে তার চোখ ঝলসে যেত হয়তো।

-‘হ্যাঁ এখন বের হব। তুমি রেডি তো?’

-‘হুহ।’

ইহান আড়চোখে একবার ইচ্ছেকে পর্যবেক্ষণ করে নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালো। কিন্তু পরক্ষনেই ইচ্ছের কথা শুনে তার পা থেমে গেল। সে যেন জমে গেল।

-‘আমায় একবার জড়িয়ে ধরবেন ইহান?’

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here