#আমার_আকাশে_তারা_নেই
#লাবিবা
পর্ব: 5
আকাশটা আজ ধূসর রঙে রেঙেছে। তার বুকে আজ সূর্যি মামা উকি দেয়নি। কৃষ্ণরাঙা মেঘের রাজত্ব আজ আকাশের বুকে। গতকাল রাতেও ঝুম বৃষ্টি হয়েছে। ভেজা রাস্তা ঘাট তার জানান দিচ্ছে। ইচ্ছের ঘুম ভাঙতেই সে ছাদে চলে আসে। ছাদের পাশগুল কেমন পিচ্ছিল হয়ে আছে। পা দিলেই স্লিপ করবে। ইচ্ছে খুব সাবধানে পা ফেলে ছাদের কিনার ঘেঁষে দাঁড়াল। ঠান্ডা বাতাসে তার লোমকূপ কেঁপে উঠল। সে বেশি সময় দাড়াতে পারলনা। সাবধানে পা ফেলে ছাদ থেকে নেমে এল। বাড়িতে সবাই ঘুমিয়ে আছে। ইচ্ছে উত্তর দিকের ইরার রুমের দিকে পা বাড়ালো। দরজা হালকা ফাঁকা করতেই তার নজর পড়লো ইরা মেঝেতে কাঁচুমাচু হয়ে ঘুমিয়ে আছে। ইচ্ছে অবাক হলো। এই ঠান্ডার মধ্যে মেয়েটা মেঝেতে কেন? পরক্ষণই বেডের দিকে নজর যেতেই তার কাছে সবটা ক্লিয়ার হল। বেডে টিনা হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। পুরো বেডটাই তার দখলে। টিনা হচ্ছে ইহানের ফুপাত বোন। মেয়েটাকে ইচ্ছের কাছে কেমন সুবিধার মনে হয়না। তাদের বিয়ের সময় একবার দেখেছিল আর এই দেখা হল। মেয়েটা এখানে এসেছে আজ দুদিন হলো। তারা যেদিন কক্সবাজার থেকে ফিরেছে তার পরদিনই এই মেয়ে এসেছে।
ইচ্ছে আলত করে ইরাকে ডাকল। এভাবে ঠান্ডায় শুয়ে থাকলে নির্ঘাত মেয়েটা জ্বর বাঁধিয়ে বসবে।
–‘এই আপু! উঠো!’
বারকয়েক ডাকার পর আলত করে চোখ মেলে তাকাল ইরা।
–‘কি হয়েছে ভাবী?’
–‘তুমি আগে উঠো।’
ইরা ঘুমঘুম চোখে উঠে দাঁড়ালো।
–‘যাও এবার মার পাশে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়। এভাবে ঠান্ডায় শুয়ে থাকলে তো জ্বর এসে যাবে। আব্বু নেই এখন, হাঁটতে গেছেন। তুমি যেয়ে বরং মার সাথে শুয়ে পড়।’
–‘কি করব বলো ঐ ডায়নি যেভাবে হাত পা ছুড়ে তাতে নির্ঘাত আমার প্রাণ চলে যাবে। তাই বাধ্য হয়ে নিচে শুয়েছি।’
ইরার কথায় ইচ্ছে চোখ বড়বড় করে তাকাল।
–‘ইসস আস্তে বল। শুনতে পাবে তো।’
ইরা আর কোন কথা না বলে ঢুলতে ঢুলতে শারমিন বেগমের রুমের দিকে চলল। ইচ্ছেও রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো।
________________
–‘ইচ্ছে! উঠেছিস মা?’
শারমিন বেগম রুম থেকে বের হতে হতে ডাক ছাড়লেন। ইচ্ছে তখন রান্নাঘর থেকে নাস্তা টেবিলে সাজাচ্ছিল।
–‘শুভ সকাল মা!’
হাসি মুখে শাশুড়িকে শুভেচ্ছা জানাল।
–‘এমা তোর তো দেখছি নাস্তাও বানানো শেষ! কখন উঠেছিস? ঘুমোসনি রাতে?’
–‘ঘুমিয়েছি তো মা। তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে গেল। তাই নাস্তা বানিয়ে ফেললাম।’
–‘ভালো করেছিস।’
বলে শারমিন বেগম হাসলেন। হিরের টুকরো বউ পেয়েছেন তিনি। মাঝেমধ্যে তার মনে হয় এই মেয়েটা তার পরিবারে না এলে তার পরিবারটা অপূর্ণ থেকে যেত। পাড়ার অন্যসব শাশুড়িরা যখন তাদের বৌ এর বিভিন্ন দোষ নিয়ে কথা বলতে ব্যস্ত তখন সে অহংকারের সাথে নিজের বউ এর প্রশংসা করেন। তখন গর্বে যেন তার বুক ভরে যায়।
নাস্তা শেষে ইহান রুমে এসে রেডি হতে থাকে অফিসের জন্য। সব ঠিক থাকলেও সে তার হাত ঘড়িটা কোথাও খুঁজে পায়না। অবশেষে বাধ্য হয়ে সে ইচ্ছেকে ডাকে। একবার ডাকতেই ইচ্ছে হাজির হয়।
–‘আমার হাতঘড়িটা কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। একটু জলদি খুঁজে দাওতো।’
ইচ্ছে মাথা নাড়িয়ে ড্রেসিংটেবিলের সামনে চলে যায়। মিনিটের মাঝে সে হাতে ঘড়ি নিয়ে ফিরে আসে। ইহান তা দেখে কপাল কুঁচকায়। সে এতক্ষণ খুঁজে যা পেলনা তা ইচ্ছে মিনিটের ভিতর কিভাবে পেয়ে গেল?
–‘আমি পড়িয়ে দেই?’
ইচ্ছের কথায় ইহান তার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলল,
–‘কেন আমি পড়তে পাড়িনা?’
বলে ইচ্ছের হাত থেকে ঘড়িটা নিতে চাইলে ইচ্ছে তার হাত সরিয়ে ফেলে।
–‘আপনি পড়তে পারেন না সেটা আমি বলিনি। আমি চাচ্ছি আমার হাতে ঘড়িটা পড়িয়ে দিতে।’
ইচ্ছের একরোখা কণ্ঠ শুনে ইহান অবাক হলো। এই প্রথম মেয়েটা নির্ভয়ে তার সাথে কথা বলছে।
–‘এসব ছেলেমানুষির মানে কি ইচ্ছে?’
ইচ্ছে কিছুক্ষণ ইহানের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে উঠলো,
–‘ভালোবাসি ইহান, কেন বুঝেননা? নাকি বুঝতে চাননা!’
ইহান প্রতিউত্তর করল না। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এই সুযোগে ইচ্ছে অতি সাবধানে ইহানের হাতে ঘড়িটি পড়িয়ে দিল। ইচ্ছে তার দৃষ্টি ঘুড়িয়ে ইহানের সামনে থেকে সরে যায়। রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে ইহানকে উদ্দশ্য করে বলে,
–‘এত অবাক হওয়ার কিছু নেই। আজ থেকে এটা রোজ একবার করে বলব। তাই অভ্যাস করে নেন।’
ইহান অবাক হতেও যেন ভুলে গেছে। তার ভেতর কেমন অনুভব হচ্ছে সেটা সে নিজেও জানে না। সে নির্বাক দাঁড়িয়ে রইল। আজ একসাথে এতগুলো চমক সে নিতে পারছেনা। যে মেয়েকে চোখ গরম দিলে চোখের পানির বন্যা বইয়ে দেয় সে কিনা তাকে থ্রেট করল। কিছু সময় অতিবাহিত হতেই ইহানের ঠোঁটের কোণে হালকা হাসির সন্ধান মেলে।
–‘পাগলি মেয়ে!’
নিজ মনে আবারো হাসলো ইহান। হঠাৎ কিছু মনে পড়তেই সে নিজের হাতের দিকে তাকালো। তার মুখে আবার ও হাসি ফুটে।
–‘এই প্রথমবার তবে নিজের বুদ্ধি খাটালে!’
ঠোঁট কামড়ে হাসলো ইহান। হাতঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে সে দ্রুত বাইরে পা বাড়ালো। আজ বড্ড দেরি হয়ে গেছে তার।
________________
আকাশ এখনো ধোঁয়াময় মেঘে ঢেকে আছে। দুপুরে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। এখন পরিবেশ একদম সতেজ। ইচ্ছে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাহিরের পরিবেশ উপভোগ করছিল। তখনই তার নজর যায় নিচে গেটের ভেতর ঢুকছে একটি কালো রঙের গাড়িটির উপর। গাড়িটি চিনতে তার ভুল হয়না। এটা ইহানের গাড়ি। কিন্তু ইহান এ সময়ে বাসায় কেন ফিরল? চিন্তায় তার কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ে। বারান্দা থেকে বেরিয়ে সে সোজা ড্রয়িংরুমে চলে আসে। সেখানে আপাতত কেউ নেই। তার এখানে আসার কারণ একটাই তা হলো ইহান বাসার ভেতর ডুকতেই তাকে জেরা করা। সে পায়চারি করতে করতে সাজিয়ে নিল ইহান আসলে কি কি বলবে। তখনই ইহান বাসায় ঢোকে। ইচ্ছেকে এভাবে পায়চারি করতে দেখে সে ভ্রুকুচকায় তবে নিরব থাকে। কোন কথা ছাড়াই নিঃশব্দের সে রুমের দিকে অগ্রসর হয়।
–‘আপনি আজ এ সময়ে কেন?’
পেছন থেকে ইচ্ছের কথা শুনে ইহান দাঁড়িয়ে যায় তবে কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে আবারও বড় বড় পা ফেলে রুমে চলে যায়। ইচ্ছেও তার পিছু পিছু রুমে চলে যায়।
–‘কোই বললেন না তো!’
ইহান বেডে বসে। একহাতে গলার টাইটা খুলে ইচ্ছের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকায়। তার মুখ একদম স্বাভাবিক। ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে থেকেই গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করে,
–‘তুমি জানতে চাইলেই কেন আমি উত্তর দিব?’
ইহানের এরূপ কথায় ইচ্ছের রাগ হলো। কঠিন ভাবে কিছু কথা শুনিয়ে দিতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু মুখে সে কিছুই বলল না। মোন খারাপ করে রুম থেকে বের হতে নিলে পেছন থেকে ইহান বলে ওঠে,
–‘রেডি হয়ে নাও বাইরে বের হব।’
কথাটা ইচ্ছের কানে পৌঁছতে সে যেন শকড হয়ে গেল। এটা কি সত্যিই ইহান? ইহান তাকে ঘুরতে নিয়ে যাবে? নিজের ভাবনাকে প্রমাণ করতে সে নিজ হাতে চিমটি কাটল। হাতে তীব্র ব্যথা অনুভব হতেই সে শিওর হল হ্যা এটা সত্যি।
ইচ্ছে রেডি হয়ে আয়নায় নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। কোন কিছুর কমতি আছে কি? সাদা জমিন লাল পাড় বিশিষ্ট শাড়ির সাথে ম্যাচিং ব্লাউজ। খোপায় তার প্লাস্টিকের ফুলের গাজরা। গাজরাটা রিয়েল ফুলের হলে আরো ভালো হতো। সুন্দর সুবাস ছড়াত। সামনের কাটা চুল গুলো সিঁথির দুপাশে ছেড়ে দিয়েছে যা কাঁধ অবধি ঝুলে আছে। কপালের মাঝে ছোট্ট একটা টিপ তার জায়গা করে নিয়েছে। চোখের নিচে হালকা কাজল রেখা টেনেছে যা চোখের সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে তুলেছে। কানে তার সোনার ঝুমকো, হাতে সোনার বালা। ইহান ওয়াসরুম হতে বের হতেই এমন দৃশ্য দেখে থমকে গেল। তার সামনে যেন মায়া রাজ্যের রাজকুমারী দাঁড়িয়ে! যার চোখ মুখ সবটা জুড়ে কেবল মায়া ছেয়ে আছে।
চলবে……