#আমার_আকাশে_তারা_নেই
#লাবিবা_আল_তাসফি
পর্ব: ৮
সময় গড়িয়ে রাত গভীর হলো। শীতের প্রকোপ বেড়েছে। হিমেল হাওয়া বইছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূর আকাশ পানে তাকিয়ে আছে ইহান। তার ভেতরটা কেমন শূন্য লাগছে। অভিমান হচ্ছে খুব ইচ্ছের প্রতি তার।
–‘আজ রাত অবধি অপেক্ষা করতে কেন পারলেনা ইচ্ছে! এতটা দিন সহ্য করতে পারলে যখন আর কয়েকটা ঘন্টা কেন পারলে না?’
পরমুহূর্তে আবার ভাবে না ইচ্ছে যা করেছে সেটা একদম ঠিক আছে। তাকে তো এতটুকু শাস্তি পেতেই হতো!
রাত বাড়তে থাকে। ঘড়ির কাঁটা এখন দুইটার কাছাকাছি। বেডে শুয়ে ইহান এপাশ ওপাশ করছে। কিছুতেই তার চোখে ঘুম ধরা দিচ্ছে না। ঘুম ও আজ তাকে একা ফেলে রেখে দূর দেশে পাড়ি জমিয়েছে। দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে মনে মনে কিছু ভাবতেই তার মুখে হাঁসি ফুটে উঠল। সে আর দেরী না করে দ্রুত রেডি হয়ে নিল। উদ্দেশ্য ইচ্ছে! যেতে যেতে ভোর হয়ে যাবে। তবে ব্যাপার না। এতটুকু কষ্ট করাই যায় বউ এর জন্য।
মোশাররফ মোড়ল মসজিদ থেকে ফিরে বাড়ির সামনে চেয়ার পেতে বসেছিলেন। এটা তার নিত্য দিনের অভ্যাস। তিনি বসে বসে সূর্য উঠতে দেখবেন। অন্ধকার কাটিয়ে দিনের আলো ছড়াতে দেখার মাঝে আলাদা আনন্দ অনুভব করেন তিনি।
বাড়ির সামনে কালো রঙের গাড়িটি থামতেই মোশাররফ মোড়ল সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। এই ভোরে আবার গাড়ি করে কে এলো? তার ভাবনার সুতো ছিঁড়ে গাড়ি থেকে ইহান নেমে দাঁড়াল। ইহানকে দেখে মোশাররফ মোড়ল মনে মনে হাসলেন। তিনি জানতেন ইহান আসবে। এবার তিনি এই ছেলেকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়ে তবে ছাড়বে।
–‘আসসালামু আলাইকুম আব্বু।’
ইহান হাসি মুখে মোশাররফ মোড়লকে সালাম দিল। কিন্তু মোশাররফ মোড়ল তার দিকে ফিরেই তাকালেন না। এমন একটা ভাব ধরল যেন তার সামনে কেউ নেই আর না সে কারো কথা শুনেছে। ইহান বুঝল শশুর তার বড্ড ঘাড় ত্যাড়া মানুষ। এখান থেকে বউ নিয়ে যেতে তাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে।
–‘ওকে ব্যাপার না আমার সামনে উত্তর নিতে হবেনা। আমি গেলে না হয় উত্তর নিবেন।’
ইহান পাশ কাটিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেল। বাড়িটি পুরনো আমলের দোতলা ভবন। পুরো বাড়িতে রাউন্ড করে বারান্দা রয়েছে। ইহান চলে যেতেই মোশাররফ মোড়ল বলেন,
–‘আমিও দেখব কিভাবে এখান থেকে আমার মেয়েকে তুমি নিয়ে যাও। আমি জমিদার মোশাররফ মোড়ল।’
ইহান ভেতরে ঢুকতেই তার শাশুড়ির সামনে পড়ে। তিনি তখন স্বামীর জন্য চা এর পেয়ালা হাতে উঠানের উদ্দেশ্যে বের হচ্ছিল।
–‘আসসালামু আলাইকুম মা। কেমন আছেন?’
হঠাৎ এই ভোরে ইহানকে দেখে নাজিয়া খাতুন চমকান। কাল সে ইচ্ছের কাছ থেকে সবটা শুনেছেন। তবে ইচ্ছেকে এভাবে নিয়ে আসায় তিনি খুশি হননি। ওদের স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার ওরা মিটাবে সেখানে মেয়ের বাবার এভাবে নাক গলানো তার পছন্দ হয়নি। এই ভোরে জামাইকে দেখে তিনি বেশ খুশি হন।
–‘আরে জামাই বাবা যে! এসো এসো বসো। মনে হচ্ছে রাতে রওনা দিয়েছো। তুমি বরং ইচ্ছের ঘরে যাও। ওখান থেকে ফ্রেস হয়ে এসো আমি ততোক্ষণে নাস্তা রেডি করে ফেলি। আর একটু ঘুমিয়ে নিও। রাতে তো ঘুমাতে পারোনি।’
–‘মা ব্যাস্ত হবেন না।’
ইহান আলতো হেসে বলল।
–‘তা কি করে হয় বলোতো! কতদিন বাদে এলে।’
বলতে বলতে সে কাজের মেয়ে রেবেকাকে ডাকলেন।
–‘জে খালা কন।’
–‘তোর দুলাভাইকে ইচ্ছের রুমটা দেখিয়ে দে।’
রেবেকা মাথা নাড়ল।
–‘আহেন দুলাভাই।’
দোতলার ডান পাশের প্রথম রুমটাই ইচ্ছের।
–‘এইডাই আফামনির রুম। আফামনি ভেতরেই আছে আপনে যান।’
–‘আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি এবার যেতে পার।’
–‘জ্বে আইচ্ছা।’
রেবেকা যেতেই ইহান রুমের দরজায় হালকা কড়াঘাত করে। সে জানে ইচ্ছে ভোরে উঠে যায়। কিন্তু অনেক সময় কেটে যাওয়ার পরও যখন ভেতর থেকে আওয়াজ আসে না তখন ইহান আলতো করে দরজা ঠেলে রুমে ঢুকে পড়ে। তার চোখ যায় বিছানায় কাঁথা গায়ে জড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকা ইচ্ছের দিকে। মেয়েটা এখনো ঘুমিয়ে আচ্ছে। চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। হয়ত সারা রাত কেঁদে কাটিয়েছে। ইহান নিঃশব্দে দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিল। হাতে থাকা জিনিস গুলো টেবিলে রেখে ফ্রেশ হতে চলে যায়।
শহরের তুলনায় গ্রামের দিকে শীতের প্রকোপ বেশি। এখানে হাড় কাঁপানো শীত পড়ে গেছে। ফ্রেশ হয়ে বের হতেই ইহানের কাঁপা কাঁপি অবস্থা। সে ধীরে পায়ে বেডের দিকে এগিয়ে গেল। অতি সাবধানে ইচ্ছের কাঁথার মাঝে নিজেকে মুড়িয়ে নিল কিন্তু সমস্যা হল বেডে বালিশ একটাই যা ইচ্ছের মাথার নিচে অবস্থান করছে। সে আর কিছু না ভেবে ইচ্ছের বালিশের এক কোণে মাথা রেখে ইচ্ছের গা ঘেঁষে সুয়ে পড়ল। আর হাত দ্বারা ইচ্ছের কোমর জড়িয়ে ধরে কোলবালিশ বানালো।
উষ্ণ শরীরে হঠাৎ ঠান্ডা স্পর্শ পেয়ে ইচ্ছের পুরো শরীর কেঁপে উঠল। তৎক্ষণাৎ সে চোখ মেলে তাকাল। চোখ মেলতেই তার খেয়াল হলো সে এখন তার বাবার বাড়িতে নিজের রুমে শুয়ে আছে। তাহলে তাকে আষ্টেপিষ্টে এভাবে জড়িয়ে রেখেছে কে? মুহূর্তেই মনের মাঝে ভয় জেকে ধরল। মার কাছ থেকে সে অনেকবার শুনেছে জিনের গল্প। এখন রীতিমত তার ভয়ে হাত-পা কাঁপছে। ঘাড়ে কারো উষ্ণ নিঃশ্বাস অনুভব হচ্ছে। ভয়ে তার হাত পা অবশ হয়ে আসছে। কিন্তু তাকে ভয় পেলে চলবে না। যেভাবেই হোক রুম থেকে বের হতে হবে। ইচ্ছে এবার তার হাতের কনুই দ্বারা আঁকড়ে ধরা ব্যক্তিকে আঘাত করে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই বিপরীতে থাকা ব্যক্তি কুঁকড়ে উঠল।
–‘আহ! এভাবে বুঝি কেউ তার বরকে আঘাত করে!’
ইহানের কন্ঠ শুনতেই ইচ্ছে চমকে উঠে বসল। সত্যিই ইহান তার সামনে। ইচ্ছে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। আঘাতটা ইহানের বুকে লেগেছে। বেশ জোরেই লেগেছে। ব্যাথায় বুক চেপে চোখ মুখ কুঁচকে রেখেছে ইহান। ইচ্ছের খারাপ লাগলো। না বুঝেই সে অনেক জোরে আঘাত দিয়ে ফেলেছে ইহানকে। ইচ্ছে ব্যাস্ত হয়ে ইহানের কাছ ঘেঁষে বসল।
–‘দেখি কোথায় লেগেছে? আমি সত্যি সরি। বুঝতে পারিনি এটা আপনি ছিলেন।’
ইচ্ছের চোখের দৃষ্টি চঞ্চল। চোখেমুখে ভয় স্পষ্ট। ইহানের ব্যথা পাওয়া নিয়ে সে খুবই আহত সেটাই ইহান বুঝতে পারল। তাই সে আরো একধাপ এগিয়ে অভিনয় করতে শুরু করল।
–‘বুকে খুব লেগেছে ইচ্ছে। খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। এবার বেঁচে গেলেও পরবর্তীতে এমন হলে হয়তো আর বেঁচে থাকতে পারবো না।’
ইচ্ছের মুখে আধার ছেয়ে গেল। চোখে জলধারা নামতে লাগলো।
–‘কি সব বলছেন আপনি। অনেক কষ্ট হচ্ছে? দাঁড়ান আমি ডাক্তার আনার ব্যবস্থা করছি।’
ইহান ইচ্ছের হাত ধরে আটকালো।
–‘ডাক্তার এর চিকিৎসা করতে পারবে না ইচ্ছে। এর চিকিৎসা কেবল তোমাকে দিয়েই সম্ভব।’
ইচ্ছে কিছু না বুঝতে পেরে ইহানের মুখের দিকে চেয়ে রইল। ইহানের এই জটিল কথা তার বোধগম্য হলো না। ইহান বুঝল ইচ্ছে তার কথার মানে বুঝতে পারেনি।
–‘আমায় একা রেখে চলে আসায় আমি খুব আহত হয়েছি ইচ্ছে।’
ইচ্ছের চোখে চোখ রেখে বলল ইহান। বুকের বা পাশে হাত রেখে ইশারা করে বললো,
–‘এখানে খুব যন্ত্রণা হয়েছে। পুড়ে গেছে ভেতরটা। তবে অঙ্গার হয়ে যায়নি। কিছুটা বেঁচে আছে যা কেবল তোমার সংস্পর্শেই আবার পুরোপুরি বেঁচে উঠবে।’
ইচ্ছে এবার ইহানের কথার অর্থ বুঝল। ইহানের কথা শুনে মনে মনে খুশি হলেও পরবর্তীতে তার করা অবহেলা গুলো মনে পড়তে নিমিষেই সে খুশি মিলিয়ে গেল। নাহ সে মানবে না। এত সহজে কেন সে মেনে যাবে? কম কষ্ট দিয়েছে নাকি তাকে ইহান? সব কষ্ট শুধে আসলে ফেরত নিবে সে। এতদিন ইহান তার নরম মনটা দেখেছে এবার সে তার কঠিন রূপটাও দেখবে। বদ লোকটাকে সায়েস্তা করবে সে।
চলবে……..