#আমার_পূর্ণতা
#রেদশী_ইসলাম
পর্বঃ ১৮
ঝড় বৃষ্টির সময় তো আকাশে বেশ উজ্জ্বল আলোর ঝলকানি আর গুড়গুড়ে শব্দের বজ্রপাত হয়। তবে এবার আকাশে নয়, বজ্রপাত হলো চৌধুরী বাড়ির ড্রয়িংরুমে। প্রত্যেক সদস্যের মধ্যে। ইনসাফ চৌধুরী চমকে উঠে বললেন—
” কি বলছেন ভাইজান? আপনার মাথা ঠিক আছে? ”
” আমার মাথা একদম ঠিক আছে ইনসাফ। আমার ইচ্ছা প্রাচুর্য আম্মাকে আমার একমাত্র ছেলের বউ করার”
পাশ থেকে তাফসির গর্জে উঠে বললো—
” বাবা এসব কি বলছেন? ছেলের বউ মানে? আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন?”
সাথে সাথে মিসেস ফারাহ বলে উঠলেন—
” আব্বা চুপ কর তুই। তোর বাবাকে আমি সব বলেছি ”
” সব বলেছো মানে? কি বলেছ তুমি? ”
” তুই যে প্রাচুর্যকে ভালোবাসিস সেটা ”
” হোয়াট? কি বলছো তুমি মা? আমি না তোমাকে নিষেধ করেছিলাম এ কথাটা এতো তাড়াতাড়ি কাউকে না জানাতে? তবুও তুমি শুনলে না? ”
পাশ থেকে ইশতিয়াক চৌধুরী বিরক্তিতে কপাল কুঁচকালেন। গলার স্বর গম্ভীর করে বললেন—
” একটু চুপ করে বসো তো। আমার কথা শেষ করতে দাও। তারপর নাহয় যা বলার বলো? ”
ইশতিয়াক চৌধুরীর কথা শুনে তাফসির কিছু বলতে গেলেই পাশ থেকে ইকরাম চৌধুরী তাফসিরের হাত চেপে ধরলেন। তাতে তাফসির পাশ ফিরে তাকাতেই ইকরাম চৌধুরী চোখের ইশারায় তাফসিরকে চুপ করে থাকতে বললেন। তার মধ্যেই পুনরায় শোনা গেলো ইশতিয়াক চৌধুরীর গলা। তিনি ইনসাফ চৌধুরীর উদ্দেশ্যে বললেন—
” বলো ইনসাফ তোমার মতামত কি? আশা করি তুমি আমার তাফসিরকে ভালো করেই চেনো। এবং তার চরিত্র সম্পর্কে ও অবগত আছো। আমার ছেলের কাছে মেয়ে দিতে তোমার কোনো আপত্তি নেই তো? ”
” ভাইজান এখানে তাফসিরের চরিত্রের কথা আসছে কেনো? ও বুঝি আপনার একার ছেলে? আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন ও যখন ছোট ছিলো তখন আমার সাথেই ওর সবচেয়ে বেশি সখ্যতা ছিলো। তাই ও কেমন তা আমি খুব ভালো করেই জানি। আর মেয়ে দেওয়ার কথা বলছেন? তাফসির যদি আমাদের প্রাচুর্যকে বিয়ে করে তাহলে নিঃসন্দেহে প্রাচুর্য ভাগ্যবতী হবে। আর সেখানে যতটুকু শুনলাম তাফসির নাকি প্রাচুর্যকে ভালোবাসে। তাহলে তো মেয়ে না দেওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। কিন্তু ভাইজান কথা তো সেখানে না। কথা হচ্ছে প্রাচুর্যের বয়স সবে মাত্র আঠারো। এখনো এইচএসসি ও দিলো না। এতো তাড়াতাড়ি মেয়েকে বিয়ে কিভাবে বিয়ে দিই বলুন? আমার মেয়ে সংসারের এখনো কিছুয় বুঝে না। ”
” এতো চিন্তা করছো কেনো? এখনি ওকে সংসারের দায়িত্ব নিতে বলেছে কে? এখন যেমন আছে তেমন ই থাকবে। আমি শুধু দু’জনের আকদ করিয়ে রাখতে চাইছি। পরে যখন তাফসির পুরোপুরি দেশে চলে আসবে তখন নাহয় সবাইকে জানিয়ে বড় করে অনুষ্ঠান করা যাবে”
” ভাইজান যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা বলি? ”
” বলো কি বলবে?”
” আমাকে একটু সময় দিবেন? ”
” আচ্ছা তোমাকে আজ রাতটুকু সময় দেওয়া হলো। যতো ভাবনা চিন্তা আজ রাতের মধ্যে শেষ করবে আশা করি। কাল আমি উত্তর শুনবো ”
” জ্বী ভাইজান ”
.
.
ঘড়ির কাটা বরাবর ০১:০৫ মিনিট। অন্যদিন এ-সময় চৌধুরী বাড়ি পুরোপুরি নিস্তব্ধ অন্ধকার থাকলেও আজকে সন্ধ্যার মতোই ঝলমলে আলো জ্বলছে। বাড়ির প্রায় প্রত্যেক সদস্যই এখনো জাগ্রত শুধু মাত্র সামি-সাদনান ছাড়া।
প্রাচুর্য বর্তমানে বসে আছে ইনসাফ ও শাহানাদের রুমের খাটের এক কোনায়। চিবুক গিয়ে ঠেকেছে গলার নিচ বরাবর। তার সামনে বসে আছেন ইনসাফ চৌধুরী ও একপাশে তার মা শাহানা। ইনসাফ চৌধুরী অনেক ভাবনা চিন্তা শেষে প্রাচুর্যের দিকে তাকিয়ে বললেন—
” প্রাচুর্য মা? আমি কি করবো বল তো? আমি তো নিরুপায়। একদিকে বড় ভাইজান অন্যদিকে তুই। ভাইজান জীবনের প্রথম আমার কাছে কিছু চাইলো আমি কিভাবে না করতে পারি বলতো। আর আমি তোর মতামত না জেনে বিয়ে দিলে ভবিষ্যতে তুই আমাকে দোষী ভাববি। তবে চিন্তা করিস না মা। বিয়েতে তোর মত না থাকলে আমি দেবো না তোকে বিয়ে। আমি ভাইজান আর তাফসিরকে বুঝিয়ে বলবো। আমি নিশ্চিত ওরা বুঝবে। তোর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছুই হবে না। নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে রে। ”
ইনসাফ চৌধুরীর কথায় প্রাচুর্য মাথা তুলে তাকালো। মুচকি হেঁসে বললো—
” এতো চিন্তা করছো কেনো বাবা? তোমরাই আমার সব। আমি জানি আমার জন্য তোমরা যেই সিদ্ধান্তই নিবে তা ভালোর জন্য নিবে ”
প্রাচুর্য কিছু সেকেন্ডের বিরতি নিয়ে ক্ষীণ স্বরে উত্তর দিলো—
” আমি রাজি বাবা। তুমি বড় বাবাকে যেয়ে বলো এ বিয়ে তে আমার কোনো আপত্তি নেই ”
প্রাচুর্যের মত শুনে ইনসাফ চৌধুরী ও শাহানার মুখে চওড়া হাসি ফুটে উঠলো। ইনসাফ চৌধুরী মনে মনে শতবার আলহামদুলিল্লাহ বললেন। শুকরিয়া জানালেন সৃষ্টিকর্তার নিকট। যাক এবার আর কোনো চিন্তা রইলো না। ভাইজানের চাওয়া ও পূর্ণ হলো আবার মেয়ে ও রাজি হলো। সাথে বাড়ির মেয়ে বাড়িতেই থাকলো। এতোদিন তো তিনি চিন্তা করতেন যখন মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবে তখন তিনি কিভাবে থাকবেন। একমাত্র মেয়ে বলে কথা। তাও আবার অনেক আদরের।
এর মধ্যে পাশ থেকে শাহানার উচ্ছ্বসিত কন্ঠ শোনা গেলো। তিনি প্রাচুর্যের উদ্দেশ্যে বললেন—
” তুই একদম কষ্ট পাইস না মা। তাফসির অনেক ভালো ছেলে। সোনার টুকরো একদম। তোকে অনেক ভালো রাখবে দেখিস ”
আবার কিছুদিন আগের কথা মনে করে মুখ চুপসে গেলো তার তাই অপরাধীর স্বরে বললেন—
” শুধু মাঝখানে একটু ভুল বুঝেছিলাম যা। কিন্তু ছেলেটা একদম পাই টু পাই সব বুঝিয়ে বলেছে। কি যে ভুল করলাম একটা। না জেনে শুনে কি না কি বুঝেছিলাম। ও যখন সব ক্লিয়ার করে বললো তখন কি লজ্জা টাই না পেয়েছিলাম। তবে তুই এতো ভাবিস না। দেখবি একসময় না একসময় তুই ও ভালোবেসে ফেলবি তাফসিরকে। ওকে ভালো না বেসে থাকায় যায় না। মানুষ করলাম তো ছোট থেকে। ও কেমন জানি তা।”
এতোক্ষণ যাবত শাহানার কথা কান দিয়ে শুনলেও মন দিয়ে শুনেনি প্রাচুর্য। শাহানা এখনো অনবরত তাফসিরকে নিয়ে কথা বলেই যাচ্ছেন কিন্তু সেদিকে মন নেই প্রাচুর্যের। তার মন অন্য জায়গা। এর মধ্যেই ইনসাফ চৌধুরী প্রাচুর্যের উদ্দেশ্যে বললো—
” প্রাচুর্য? এবার ঘরে যেয়ে ঘুমিয়ে পরো তুমি। কালকে হয়তো তোমার উপর দিয়ে অনেক ধকল যেতে পারে। যদিও বাবা আছিতো। সব সামলে নেবো। ”
ইনসাফ চৌধুরীর কথায় প্রাচুর্য উঠে দাড়ালো। নিচু স্বরে ” আচ্ছা বাবা ” বলে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।
অন্যদিকে তাফসিরের সামনে মুখ কাচুমাচু করে বসে আছেন মিসেস ফারাহ। তিনি তো ভেবেছিলেন এখনি ছেলের বিয়ে টা দিয়ে দিলে ছেলে বোধহয় খুশি হবে খুব। কিন্তু এখন তো পুরোটাই উলটো দেখছেন। ছেলে রাগে বোম্ব হয়ে দুহাতে মাথার চুল টানছে। মিসেস ফারাহ পাশে বসে থাকা ইশতিয়াক চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে ইশারায় ছেলেকে বোঝাতে বললেন। ইশতিয়াক চৌধুরী মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলেন—
” আচ্ছা এখন বিয়ে টা করলে সমস্যা কি? ভালোবাসতে পেরেছো আর বিয়ে করতে পারছো না? ”
” বাবা আমি তো বলি নি বিয়ে করবো না। আমি শুধু বলেছি এতো তাড়াতাড়ি কিসের বিয়ে? প্রাচুর্যের আঠারো শেষ হয়ে পারলো না। তাছাড়া ও ওর সামনে এইচএসসি। এখন বিয়ে করলে ওর কনসেনট্রেট করতে পারবে না পড়ালেখায় ”
” তুমি শুধু শুধু একটু বেশিই চিন্তা করছো ”
তাফসির আরও কিছু কথা বলতে চেয়েছিলো। কিন্তু ইশতিয়াক চৌধুরীর কথায় চুপ করে গেলো। বুঝতে পারলো এখানে কথা বলে আর কোনো লাভ নেই। বুঝবে না কেউই। তাই আর কোনো কথা না বলে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।
.
.
.
তখন ইনসাফ চৌধুরী ঘুমিয়ে পরার জন্য প্রাচুর্যকে রুমে পাঠালেও ঘুমালো না প্রাচুর্য। তার চোখে একফোঁট ঘুম ও ধরা দিচ্ছে না। তাই উঠে বেলকনিতে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই ফোন বেজে উঠলো তার। সে ফোন হাতে উঠিয়ে নাম দেখতেই তাফসিরের নাম ভেসে উঠলো। প্রাচুর্য সময় নষ্ট না করে ফোন রিসিভ করে কানে ঠেকালো। তাফসির সেকেন্ড খানিক চুপ থেকে গম্ভীর কন্ঠে শুধালো—
” ঘুমিয়ে পরেছিস?”
প্রাচুর্য মিন মিন করে বললো—
” না ”
” ছাদে আয়। অপেক্ষা করছি “___বলেই ফোন কেটে দিলো তাফসির।
.
.
.
অক্টোবরের রাত। কিছুক্ষণ আগেই শেষ হয়েছে ঝুম বৃষ্টি। ফলস্বরূপ ছাঁদের কিছু কিছু জায়গায় পানি এখনো জমাটবদ্ধ। তাফসির রেলিংয়ের উপর হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছে। দৃষ্টি তার মেঘলা আকাশে। যদিও আকাশে চাঁদের চিহ্ন মাত্র নেই তবুও তার ভালো লাগছে ওই দুর আকাশে তাকিয়ে থাকতে। তবে মাথা ঘুরছে নানান রকমের চিন্তা। হয়তো বর্তমান বা ভবিষ্যতের।
প্রাচুর্য সিড়ি ভেঙে ছাঁদের দরজায় এসে থামতেই শীতল বাতাসে শরীর সিউরে উঠলো তার। গায়ের ওড়নাটা ভালো ভাবে গায়ে জড়িয়ে সামনে তাকাতেই তাফসিরকে দেখতে পেলো সে। গায়ে ডিপ মেহেরুন রঙের শার্ট। বাতাসে তার চুল গুলো উড়ছে। প্রাচুর্য ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে তাফসিরের পাশাপাশি দাঁড়ালো। কিন্তু তবুও তার ভাব ভঙ্গি পরিবর্তন হলো না। তাফসিরকে কিছু না বলতে দেখে প্রাচুর্য ও কোনো কথা বললো না। কিছুক্ষণ পর তাফসির আকাশের দিক তাকানো অবস্থাতেই বলে উঠলো—
” তুই চাইলে বিয়েটা ক্যানসেল করতে পারিস।”
তাফসিরের এমন কথায় প্রাচুর্য পাশ ফিরে তাফসিরের দিক চাইলো। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে প্রশ্ন করলো—
” কেনো? ”
তাফসির প্রাচুর্যের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বললো—
” যদি তোর মত না থাকে। আমি জোর করে বিয়ে করতে চাইছি না ”
” আপনাকে কে বললো আমার মত নেই? ”
” আছে বলছিস? ”
” হ্যাঁ ”
প্রাচুর্যের কথায় তাফসির প্রাচুর্যের দুহাত হাতের মুঠোয় পুরে নরম দৃষ্টিতে প্রাচুর্যকে বোঝানোর স্বরে বললো—
” প্রাচুর্য? আমি বিয়ে করার জন্য জোর করছি না। আমি তোর অমতে এখনি বিয়ে করতে চাইছি না। তবে এখন বা পরে যখনি করিস না কেনো বিয়ে তোর আমাকেই করতে হবে। এ নিয়ে কোনো ছাড় নেই। তবে তুই যদি মনে করিস তুই এখনি বিয়ের জন্য প্রস্তুত না বা এখনি বিয়ে করলে তোর পড়ালেখায় ক্ষতি হতে পারে তবে তুই নির্দ্বিধায় তা বলতে পারিস। আমি সবাইকে বুঝিয়ে বলবো। আমি চাই না আমার জন্য তোর পড়ালেখায় ক্ষতি হোক ”
তাফসিরের কথায় প্রাচুর্য তাফসিরের হাতের মঠো থেকে নিজের হাত বের করে তাফসিরের মতো করে তাফসিরের হাত মুঠোয় নিলো। তারপর ভরসার স্বরে বললো—
” আপনি শুধু শুধুই একটু বেশি চিন্তা করছেন তাফসির ভাই। এতো অস্থির হবেন না। আর এ বিয়েতে ও আমি রাজি। ”
প্রাচুর্যের কথায় তাফসিরের দু’পাশের ঠোঁটের কোণ প্রসারিত হলো। আচমকা তাফসির দু’হাতে ঝাপটে ধরলো প্রাচুর্যকে। প্রাচুর্য স্তব্ধ হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। তখনি কর্ণকুহরে বেজে উঠলো তাফসিরের ফিসফিসে কন্ঠে বলা ” থ্যাংক ইউ ” শব্দটি।
#চলবে
[ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন]