#আমার_মেয়ে
#Khadija_Akter
#পর্ব_০৩
–মা বলেছেন তুমি যদি না যাও আমার সাথে তাহলে মা অন্য ব্যবস্থা নিবেন!
–কি কি কি ব্যবস্থা নিবে তোমার মা?বলো?
রাশেল কিছুক্ষন চুপ করে থেকে একবার আড়চোখে আমার মায়ের দিকে তাকালো।তারপর মিনমিনে কন্ঠে বললো,
–তা তো আমি জানি না।কিন্তু ভালো কোনো ব্যবস্থা যে নিবেন না সেটা তো তুমিও জানো রাকা।
–উনার যা করার উনি করুক।আমি যাচ্ছি না তোমার সাথে আর ঐ বাড়িতে।
তুমি নাস্তা করেছো?না করে থাকলে নাস্তা করে বাড়ি চলে যাও।
–প্লিজ রাকা,কেনো শুধু শুধু সংসারে অশান্তি করতে চাইছো বলোতো?মা যেহেতু চাইছে না আমাদের এই বাচ্চাটা,তাহলে আমরা মা’র কথা মেনে নিলেই তো সব ঝামেলা মিটে যায় রাকা!
–বাচ্চাটা কি আপনার মায়ের?আমার বাচ্চা আমি সিদ্ধান্ত নিব যে আমি ওকে জন্ম দিব নাকি মেরে ফেলবো।বড়জোর বাচ্চার বাবা হিসেবে আপনি আমার সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করতে পারেব।কিন্তু আপনার মা কে আমাদের সন্তানের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বলুন?
বিয়ের পর আজ পর্যন্ত উনার কোন কথা মেনে চলিনি আমি?আমি কখন ঘুমাবো,কখন উঠবো,কখন খাবো,কখন কাজ করবো,কখন পড়তে বসবো,কখন আপনার সাথে সময় কাটাবো এমনকি কখন আপনার সাথে শুবো সেটা পর্যন্তও পারে না আপনার মা ডিসাইড করে দেয়।কিন্তু আর কত?
একটা প্রাণ হত্যার হুকুম দিবে আর আমি সেটাও চুপচাপ পালন করবো?
আর আপনি?আপনার কি নিজস্ব মতামত বলতে কিছুই নেই?আপনার মা যা বলবে তাই?
আপনাকেও না আমার একদম সহ্য হচ্ছে না এই মুহুর্তে। যান এক্ষুনি বেরিয়ে যান আমাদের বাড়ি থেকে।
চেঁচিয়ে একটানা কথাগুলো বলতে বলতে একসময় কান্নায় আমার গলা জড়িয়ে আসে।মুখে আঁচল টেনে এক দৌঁড়ে ঘরে ঢুকে যাই।
রাশেল আমার যাওয়ার পানে চেয়ে থেকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তারপর কাউকে কিছু না বলেই চুপচাপ উঠে চলে যায়।
রাশেল যেতে না যেতেই মা’র অগ্নিমূর্তির সামনাসামনি হতে হলো,
“ওরে পোড়ামুখী জামাইটাকে এইভাবে ফিরায় দিলি ক্যান,কিসের এমন দেমাগ তোর।তোর বাপের কি গোলা ভরা ধান আছে যে সেই জোরে তুই তোর জামাই – শাশুড়ীর লগে এম্নে কথা কস!একে তো শাশুড়ীরে ফাঁকি দিয়া পলাইয়া আইসা একটা ভুল করছোস,কপালডা ভালা বইলাই সকাল সকাল জামাই নিবার আইছিলো।আর তুই কিনা তাচ্ছিল্য কইরা জামাইডারও খেদায় দিলি?
জামাইর সংসার করতে হইলে মাইয়া মাইনসের অনেক কিছু মুখ বুইজ্জা সইবার লাগে।এমন গলা উঁচাইয়া কথা কইবার হয় না।
আসুক আজ তোর বাপ ক্ষেত থেইক্কা, তোর কীর্তিকলাপ সব কইতাছি।
আরে জামাই যদি এহন রাগ হইয়া তোরে তালাক দিয়া দেয় তাইলে তুই তহন কার ঘাড়ে বইয়া খাবি ক?পেডের মধ্যে তো আরেকটারে বড় করতাছোস।ঐডার দায়িত্ব নিব কেডায়?
তোর ছোড ২টা বইন যে বিয়ার লাক হইছে সেই খেয়াল কি আছে তোর?
আহ্ কি হইবো গো আমার কপালে,আমি আর পারতাছি না এই জগৎ সংসারে টিকিবার।”
কতগুলো কথা শুনিয়ে কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে মা চলে গেলেন।
আমি মাথা নিচু করে চুপ করে বসেই রইলাম।চোখ দিয়ে টপাটপ পানি পড়ছিল।
আসলে মা তো ভুল কিছুই বলেনি।কৃষক বাবার একার রোজগার দিয়ে যেখানে মা,ছোট ২টা বোন আর ছোট্ট ১টা ভাইয়ের পেট চলে সেখানে আমার এমন অপ্রত্যাশিত ভাবে উড়ে এসে জুরে বসা তো তাদের ক্ষুধার্ত উদরে লাথি দেওয়ার মতনই হয়ে গেল।
গরীবের ঘরের মেয়ে বলেই হয়তো শ্বশুর বাড়ির লাঞ্চনা বঞ্চনা সহ্য করে হলেও শ্বশুর বাড়িতে পরে থাকতে হবে আমাদের।আজকে আমার বাবার যদি অনেক টাকা-পয়সা থাকতো তাহলে তো আমার ভরণপোষণ নিয়ে মাকে এতো চিন্তা করতে হতো না।শ্বশুর বাড়িতে মেয়ের একটু কোনো সমস্যা হলেই নিয়ে আসতো নিজের বাড়িতে।
কিংবা তখন দেখা যেতো আমার শাশুড়ীও হয়তো আমাকে তুলোতুলো করে পালছে।
মা’র একটা কথা আমার খুব করে কানে বাজতে লাগলো সারাক্ষণ।
সত্যিই কি রাশেল আমাকে তালাক দিবে যদি আমি ওর মায়ের কথা না শুনি?রাশেল এটা পারবে আমার সাথে করতে?যদি আসলেই তালাক দেয়, তাহলে আমি কই যাব!কি করবো তখন?
আমি দিকভ্রান্ত হয়ে চিন্তা করতে থাকি,করতেই থাকি।যে চিন্তার কোনো শেষ নেই,কোনো দিককূল নেই।দুচোখ শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার দেখি আমি।
——————–
২দিন পর আমার শাশুড়ী আর বড় জা এসে হাজির হয় আমাদের বাড়িতে।
তারা আমাকে নিতে এসেছে।
আমি শাশুড়ীর মুখের উপর সোজাসাপ্টা বলে দিলাম,”উনি যেটা চায় সেটা কখনোই হবে না।”
শাশুড়ী মা বললেন,”এটা নিয়ে কথা বলবো কিন্তু এখানে না।আগে বাড়িতে চল।”
আমার বড় জাও অনেক করে বুঝাতে লাগলো,বাড়িতে ফিরে যাওয়ার জন্য।সেখানে সবাই একসাথে বসে বুঝেশুনে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।
ক্লিনিক থেকে পালিয়ে যাওয়ার ৪দিন পর অবশেষে আমি শাশুড়ী ও বড় জা’য়ের সাথে আবার শ্বশুর বাড়িতে ফিরে আসি।
শুধু যে আমার শাশুড়ী ও জা’য়ের মিষ্টি মিষ্টি কথায় মন গলিয়ে তাদের সাথে ফিরে এসেছি তা নয়।
দরজার আড়ালে থাকা আমার মায়ের চোখের ভাষাও পড়ে নিয়েছিলাম আমি।যে চোখের দৃষ্টি উপেক্ষা করা আমার সাধ্যে ছিল না।
স্পষ্ট দেখেছিলাম সেই দুটো চোখ ইশারায় আমাকে বলছিল, “তুই যদি এহন তোর শাশুড়ীর সাথে না যাস আর তাদের ফিরায় দেস,তাইলে আমার চাইতে খারাপ আর কেউ হবে না।”
———————
শ্বশুর বাড়িতে আসার পর প্রথম ২দিন সবকিছু স্বাভাবিক ভাবেই চললো।কেউ আমার গর্ভের সন্তানকে নিয়ে কোনো কথাই তুললো না।আশ্চর্যজনকভাবে এই দুইদিন আমার শাশুড়ী তো আমার সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার করলোই না বরং আমার ডাকখোঁজ দিয়ে রাখলো।
আমার মনের গোপন কোনো অংশে হয়তো এই আশা বাসা বাঁধতে শুরু করেছিল,”হয়তো সবাই মেনে নিয়েছে আমার সন্তানকে””
আবার এটাও মনে হচ্ছিল,বড় কোনো ঝড় আসার পূর্বে যেমন সব কিছু থম মেরে থাকে,হয়তো এখন সেটাই চলছে।হয়তো বড় কোনো ঝাপটা আমার সামনে আসতে চলেছে।
হলোও তাই,তৃতীয় দিন সন্ধ্যাবেলাতেই আমাকে শাশুড়ীর একটা বড় সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হতে হলো।
সবার সামনে ডেকে নিয়ে শাশুড়ী আমাকে তার পাশে আদর করে বসালেন।তারপর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে হাসি মুখে বললেন,
–ছোড বউমা,আমরা সবাই সিদ্ধান্ত নিছি আমরা আমাগো নাতনীডারে পৃথিবীর আলো দেখামু।যেহেতু হিসাবে এহন জন্মের সময় আইসাই পড়তাছে, এইসময় বাচ্চাডারে মাইরা ফেলা ঠিক হইবো না।
–সত্যি আম্মা!
আমি খুশিতে শাশুড়ী মাকে জড়িয়ে ধরলাম।গত তিন বছরে এই প্রথম হয়তো আমি এতো খুশি হলাম।শাশুড়ীর এই সিদ্ধান্তে উনার প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার চোখে পানি চলে আসলো।
রাশেলের দিকে তাকিয়ে দেখলাম,সবার মতো সেও হাসছে কিন্তু কেনো যেনো তার হাসিতে প্রাণ খুঁজে পেলাম না।
হয়তো খুশি অনুভব করার জন্যই শাশুড়ী আমাকে কিছুক্ষণ সময় দিয়েছিলেন,এরপর উনি যা বললেন তাতে আমার মাথায় যেনো বাঁজ পড়লো!
–কিন্তু বাচ্চাটাকে তুমি রাখতে পারবা না।মাইয়াটাকে আমরা একটা নিঃসন্তান দম্পতিকে দিয়া দিমু।উত্তর পারার হাবুল্লার বউ কইছে,মাইয়াডা নিতে অয় রাজী আছে।
আম্মার কথা শুনে আমার কান ঝিমঝিম করে উঠলো।চরম বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে দৃঢ় কন্ঠে বললাম,
–কি বলেন আপনি এগুলো আম্মা!আমার মেয়েকে আমি কেনো অন্যজনকে দিতে যাব!এরকম হয় নাকি?
আমার মেয়ে আমার কাছেই থাকবে।না,আমি কাউকে দিতে পারবো না।
–আরে বউমা,হাবুল্লার বাজা বউডারে তোমার বাচ্চাডা দিয়া দিলে তুমি অনেক সাওয়াব পাইবা।পরের বার যদি পেডে ছেলে বাচ্চা আহে তাহলে তুমি নিজের লাইগা ঐডা রাইখা দিবা,তাইলেই তো হইয়া গেলো
–আম্মা আমি আমার বাচ্চা কাউকে দিব না,এটাই আমার শেষ কথা।আমার পেটের বাচ্চাটা মেয়ে, তা বলেই তো আপনার এতো সমস্যা আম্মা?
আপনি নিজেও তো একজন মেয়ে আম্মা!আপনার কিসের এতো বিদ্বেষ মেয়ে সন্তান জন্মদানে বলবেন একটু?মেয়ে সন্তান কি আল্লাহর সৃষ্টি না?আল্লাহই তো নিজের সিদ্ধান্তে মানুষের গর্ভে ছেলে বা মেয়ে সন্তান দেন।তাহলে আপনি কে আল্লাহর সিদ্ধান্তকে পায়ে ঠেলার!
ছেলে হলেই রাখবেন আর মেয়ে হলে মেরে ফেলবেন বা বাচ্চা পয়দা করিয়ে তারপর আরেকজন কে দিয়ে দিবেন,এটা কেমন নিয়ম আপনার!
আপনি আমার গুরুজন আপনার সব কথা মেনে চলি আমি ঠিক আছে,তাই বলে অন্যায় কিছু বললে সেটা অবশ্যই মানবো না।
আপনি আমার সওয়াবের কথা বলছেন কি,নিজে যে কত বড় গুনাহর ভাগীদার হচ্ছেন সেই খবর রাখেন?
আমার দৃঢ় সিদ্ধান্ত আর কড়া কথা শুনে আমার শাশুড়ী যেনো তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। লাফ দিয়ে উঠে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন।তিনি তার ভালোমানুষির মুখোশটা এবার খুলে ফেললেন,যেটা উনি গত ২দিন ধরে পড়ে ছিলেন।রাগে চোখ লাল করে উনি বললেন,
–আমি জানতাম, আমি জানতাম এই বেদ্দপ মেয়েডা আমার কোনো কথাই শুনবো না।উলটা আরও কত্তগুলা কথা শুনাইয়া দিল দেখছোস রাশেল?আমার অন্য কোনো বউ সাহস করবো আমার লগে এম্নে কথা কইবার?আমার পোলারা না টুটি টাইন্না ধইরা ছিড়া ফালাইতো ওই বউয়ের।
এই যে মাইয়া তোর ব্যবস্থা আমি করতাছি।সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে আঙ্গুল বেঁকাও করতে জানেএই হোসনে আরা বেগম।একটা কথা আছে ন, যেমন কুকুর তেমনি মুগুর।এইবার সময় আসছে তোকে মুগুর দেখানোর।
হায়রে এমন দিনও আমার কপালে আছিলো,পোলার সামনে বউ মায়রে অপমান করে আর পোলা আমার খাঁড়ায় খাঁড়ায় দেখে।
কপট কান্নার ভাণ করে আমার শাশুড়ী সেখানেই মুখে হাত দিয়ে বসে পড়লেন।তার অন্যান্য ছেলেরা ও বউরা শশব্যস্ত হয়ে গেল শাশুড়ীকে সামলাতে।
আমি শাশুড়ীর কথার প্রতুত্তরে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলাম তার আগেই রাশেলের রাশভারি কন্ঠ আমাকে থামিয়ে দিল,
–চুপ একদম চুপ।বড়দের মুখে মুখে কথা বলার স্পর্ধা দেখাবা না।আসো,আসো আমার সাথে।
–হাত ছাড়ো।আমাকে বলতে দাও। কিছু কথা উনাকে শোনানো খুব প্রয়োজন।তোমরা সব ভাইয়েরা তো নিজেদের বিচারবুদ্ধি সব খেয়ে ফেলছো।তোমার ভাবীরাও ঠিক সেইরকম,দশ ঘায়েও তাদের মুখে এক রা আসবে না।কিন্তু আমি কেন চুপ থাকবো?আমার বিবেকবোধ তোমাদের মতো অত ভোঁতা না…..
আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রাশেল হাত ধরে একপ্রকার টেনেই সবার সামনে থেকে বের করে নিয়ে আসলো।
ঘরে এসে রাশেল দরজা আটকে দিল ভিতর থেকে।তারপর আমার হাতটা ছেড়ে দিয়ে চুপ করে বসে রইলো চকির উপর।
প্রত্যেকবার শাশুড়ীর সাথে আমার কথা কাটাকাটির পর রাশেল ঠিক এটাই করে।
সবার সামনে থেকে আমাকে নিয়ে এসে ঘরের দরজা আটকে দিয়ে চুপচাপ বসে থাকে আর আমাকেও সামনে বসিয়ে রাখে।
মাঝে মাঝে বেচারার উপর খুব মায়া হতো আমার।সে পারে না তার মায়ের মুখের উপর দুটো কথা বলতে,আবার কোনো এক কারণে সে আমাকেও কিছু বলতে পারে না।অসহায় নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে যায় শুধু।
আজ আর তার জন্য আমার বিন্দুমাত্রও সহানুভূতি জাগলো না।আমাকে ঐভাবে থামিয়ে দিয়ে,কথা বলতে না দিয়ে টেনে নিয়ে আসার কারণে আমার মনে থাকা সমস্ত রাগ গিয়ে পড়লো রাশেলের উপরে।
মনের যত রাগ আছে সব ইচ্ছে মতো ঝাড়লাম সব তার উপরে।এমনকি তাকে কাপুরুষ,পুরষত্বহীন বলতেও বাদ রাখলাম না।
আমার এতোগুলো বকাঝকা আর কড়া কড়া কথার পরিপ্রেক্ষিতে রাশেল নির্লিপ্ত জবাব ছিল,
“যত ইচ্ছে আমাকে ঝাড়ো,কিন্তু প্লিজ মা’র মুখের উপর কিছু বলতে যেও না।”
আমি বুঝে গেছিলাম,রাশেলকে কথা শুনানো একদমই বেকার।
————————
রাতে না খেয়ে শুয়েই রইলাম।আজ একটাবারও আমাকে কেউ ডাকতে এলো না খাওয়ার জন্য।
একটুপর রাশেলও খেয়েদেয়ে পাশে এসে শুয়ে পড়লো।
রাত কত হবে এখন,১২টা কি ১টা!
গ্রামাঞ্চলে এটাই অনেক রাত।মনে অশান্তি আর পেটে ক্ষুধা থাকার কারণে একদম ঘুম আসছিল না।
ঘাড় ফিরিয়ে রাশেলকে দেখলাম,দু’হাত বুকের উপর ভাঁজ করে রেখে এক পা অন্য পায়ের উপর তুলে সোজা হয়ে শুয়ে দিব্যি ঘুমাচ্ছে।রাশেলের এই ঘুমের স্টাইলটা আমার কাছে বহুল পরিচিত।বিয়ের পর থেকেই তাকে এভাবে ঘুমাতে দেখে আসছি।
অনেক চেষ্টা করেও দুচোখের পাতা এক করতে পারছিলাম না যখন,তখন বৃথা ঘুমের চেষ্টা বাদ দিলাম।
প্রচন্ড গরম লাগছে।
যতই দিন যাচ্ছে শরীরটা কেমন বেড়েই চলেছে,কিন্তু গায়ের জামা তো সেই আগের মাপেই আছে।বাচ্চা পেটে আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত নতুন কোনো জামা বানানো হয় নাই আমার।অন্য সবার মতো আমার পেট অত বেশি বড় হয়নি,এটাই যা রক্ষা।কষ্ট করে হলেও টেনেটুনে আগের জামাগুলো পরা যাচ্ছে এখন।
গরম সহ্য করতে না পেরে হাসফাস করতে করতে হাত বাড়িয়ে মাথার কাছের ছোট্ট জানালাটা খুলে দিলাম।
জানালা খুলে দিয়ে যেই না এপাশ হয়ে শুয়েছি রাতের নীরবতাকে ভেঙে দিয়ে রাশেল শান্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
–এই সময়েও এমন টাইট টাইট জামা পড়ো কেন?পুরান জামা দিয়ে আর কতদিন চলবে?কাল দক্ষিণকান্দির রেশমীর মা’র কাছে গিয়ে নতুন ২টা জামা বানাতে দিয়ে আসবা।
আমি কিছুটা বিব্রত হলাম।প্রথমত রাশেল এতোক্ষণ জেগে ছিল অথচ আমি একটুও বুঝতে পারিনি।দ্বিতীয়ত্ব আমি যখন আমাদের বাড়িতে ছিলাম,রাশেল তখন আমার খাওয়ার খরচ বাদ দিয়েও এক্সট্রা করে দুইবার টাকা দিয়েছিল নতুন জামা বানানোর জন্য।
আমি জামা না বানিয়ে সেই টাকা সংসারে কাজে লাগানোর জন্য আমার মায়ের হাতে দিয়ে দিছিলাম।
তখন মনে হয়েছিল পুরুষ মানুষ এতোটা খেয়াল করবে না,নতুন কাপড় বানালাম কি না বানালাম।
কিন্তু রাশেল যে আমার জামাকাপড়ের দিকে লক্ষ্য দিবে সেটা আমার একদমই মনে হয়নি।
যাইহোক,অস্বস্তি কাটিয়ে উঠে আমি স্বাভাবিক কন্ঠেই জবাব দিলাম,
–নতুন জামা বানানোর টাকা কে দিবে?
–তোমার জামাই কি বেকার?
–আমাকে নতুন জামা বানিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে আমার শাশুড়ীর কাছ থেকে যদি জামাই পারমিশন নিতে ব্যর্থ হয় তবে?শাশুড়ী পারমিশন না দিলে তো বেচারী বউয়ের সেই পুরান জামা দিয়েই চালিয়ে নিতে হবে।
আমার সুক্ষ্ম এই খোঁচাটা রাশেলের গায়ে লাগলো কিনা বোঝা গেল না।কারণ রাশেল কখনোই কোনো কিছুতে রিয়েক্ট করে না।তাই ওর মনের ভাব বা অনুভূতি অন্যের পক্ষে জানা বেশ দুষ্কর।
আমি হাজার ঝগড়া করলেও,হাজারটা খোঁচা মারলেও সে চুপ করেই থাকে।তার এই স্বভাবের কারণে মাঝে মাঝে আমার খুব রাগও হয়।আবার মাঝে মাঝে ভাবি এই রোবটটার সঙ্গে আমার প্রেমটাই বা হলো কি ভাবে!
রাশেল কিছুক্ষণ চুপ থেকে টপিক চেঞ্জ করে অপেক্ষাকৃত শান্ত গলায় বললো,
–ঘুমাচ্ছো না কেন?
–ঘুম আসছে না।
–ভাতের সাথে রাগ করে লাভ কি?
–এই কথা আসছে কেন?
–তোমার পেটে এখন খুব ক্ষুধা তাই তুমি ঘুমাতে পারছো না,আমি জানি।
আমি কিছু বললাম না,চুপ করে রইলাম।আমার আসলে কিছু বলারও নেই।আসলেই ক্ষুধায় পেট চো চো করছে।
আমার নীরবতা দেখে রাশেলই আবার কথা বললো,
–টিনের কৌটায় বিস্কুট আছে।৩/৪ দিন আগে কিনে রেখেছিলাম।রাতে আমার খুব ক্ষুধা লাগে আজকাল তাই।
তুমি খাবে?
–দাও
রাশেল উঠে টিনের কৌটাটা আমার হাতে দিল।আমি অন্ধকারে বসে থেকে বুভুক্ষের মতো বিস্কুট খেতে শুরু করে দিলাম।আর সে টেবিলের উপরে থাকা খালি জগটা হাতে নিয়ে কলপাড়ে চলে গেল পানি আনতে।
———————
খুব সকালেই ঘুম ভেঙে গেল আমার।পাশে চেয়ে দেখি রাশেলও সজাগ;উপরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কি যেনো ভাবছে আপন মনে।
আমি আলগোছে তার হাতটা নিয়ে আমার পেটের উপর রেখে বললাম,
–সত্যি করে বলো তো রাশেল, এই বাচ্চার জন্য কি তোমার আদৌও কোনো অনুভূতিই নেই?তুমি আসলেই চাও এই বাচ্চা আমাদের না হোক?
আমার স্পর্শে রাশেলের চিন্তায় ছেদ পড়ে গেছে আগেই, এবার আমার প্রশ্নে সে যেনো অনেকটাই চমকে উঠলো।
তার মুখের ভ্যাবাচ্যাকা ভাব দেখে মনে হচ্ছে,আমি তাকে এই মুহুর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কোনো প্রশ্ন করে ফেলেছি!
আমি রাশেলের মুখের পানে চেয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি তার উত্তর শোনার..।
#চলবে