আমি কাউকে বলিনি সে নাম
তামান্না জেনিফার
পর্ব ৭
__________________________
দিনগুলো খুব মধুর কাটছে নিপার ৷ আজাদ তাকে রোজ অফিস থেকে ফেরার সময় মোবাইলে কল দেয় ৷ সাদাকালো নকিয়া মোবাইলটাও আজাদই কিনে দিয়েছে ৷ অবশ্য একটা অসুবিধা হয় নিপার ৷ বাড়িতে নেটওয়ার্ক ভালো না , কথা বলার জন্য পুকুরপাড়ে যেতে হয় ৷ আজাদ ফোন দেয় সন্ধ্যা সাতটা থেকে সাড়ে সাতটার মধ্যে ৷ এই সময় একা পুকুরপাড়ে গেলে তার বাবা খুব রাগ করে ৷ নিপাকে সরাসরি না বললেও আকারে ইঙ্গিতে সে কথা বেশ কয়েকবারই বলেছেন তিনি ৷
নিপা ঝামেলা চায় না ৷ তাই কদিন ধরে সে সন্ধ্যায় রূপাকে সাথে নিয়ে পুকুরপাড়ে যায় ৷ এতেও অবশ্য সমস্যা , আলেয়া চাচীও কম গজগজ করে না ৷ তবে রূপা খুব আগ্রহ করেই আসে ৷ নিপা লাজুক গলায় আজাদের সাথে কথা বলে আর সে এদিক ওদিক তাঁকানোর ভান করে গোগ্রাসে তাদের কথা শোনে ৷ রূপার এত ভালো লাগে শুনতে ….. নিপার প্রথম দুদিন রূপার সামনে কথা বলতে অস্বস্তি লাগলেও , এখন আর লাগে না ৷ সারাদিনে এই একবারই মানুষটাকে পায় সে , এই সময়টা সে নষ্ট করতে চায় না ৷
কত কথা হয় , কতই না কথা … অর্থহীন সব কথা ৷ কখনও বা বিয়ের পরের সংসার গুছানোর গল্প হয় ৷ গ্রামের খোলা পরিবেশ রেখে শহরের বদ্ধ জীবনে নিপা নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে কী না এই নিয়ে আজাদের খুব চিন্তা হয় … আজাদের তো কেউই নেই যে নিপাকে একটু সঙ্গ দিবে সারাদিন ৷
এই কথা শুনে নিপা মনে মনে ভাবে সে এবার একটু একলাই হতে চায় ৷ সারাদিন ধরে চার দেয়ালের ঘরটাকে সে একটু একটু করে গুছিয়ে গুছিয়ে সংসার বানাবে , সন্ধ্যায় পরিশ্রান্ত আজাদ যখন ঘরে ফিরবে একগ্লাস লেবুর শরবত নিয়ে তার সামনে দাঁড়াবে ৷ ঐ শরবত খেয়ে আজাদের ক্লান্তি চলে যাবে আর তাকে দেখে নিপার একাকীত্বও চলে যাবে …
কথা বলা শেষে রূপাকে বাড়িতে পৌছে দিয়ে নিপা তার বাড়ি যায় ৷ আজ বাড়ি ফিরতেই বড়ভাবী তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে নিজে নিজে বলতে লাগলেন “বিয়ের জন্য এইরাম পাগলা হইতে কাউরে দেখি নাই বাবা ! লাজ শরম পানি দিয়া ধুইয়া খাইছে ! ছি ! বাপের জম্মে এমুন কাজ কারবার দেখি নাই ”
নিপা অনেকক্ষন শুনলো ৷ একবার ভাবলো উত্তর দেয় , আবার মনে হলো আর সে আছেই বা কটা দিন ৷ বলুক , বলেই যদি শান্তি পায় তো পাক না ৷
***
আজ লাকীর মনটা খুব খারাপ ৷ অবশ্য মন খারাপ হবার তেমন কোন নির্দিষ্ট কারণ নেই ৷ তবে সারাদিন নিপার গালের লালচে আভা দেখলে তার খুব আফসোস হয় ৷ এমনদিন তো তার জীবনে কখনও আসেনি ৷ এই যে রোজ রোজ নিপা তার হবু স্বামীর সাথে গল্প করতে যায় , আড়ালে দাঁড়িয়ে প্রায়ই সেসব শোনেন তিনি ৷ হাহাকারে বুকটা ভরে যায় লাকীর ৷
স্বামী মানে আসলে কী ? স্বামী মানে এমন কেউ যে চোখ দেখলে মনের গহীনের খবরও বলে দিবে .. স্বামী মানে ভরসার হাত , যে হাত শুধু শরীর ভালোবেসে হাত ধরে না ৷ নাদের মিয়ার এত সময় কই যে তার মনের খবর নিতে আসবে …. বিয়ের এত বছর পরও যে লোক ঘুমের ঘোরে অন্য কারো নাম নেয় , সেই লোকের সাথে সংসার করা সহজ কথা তো নয় ৷ সহ্য না হলে মায়ের কাছে চলে যায় ৷ তার মা সবই জানে , কিন্তু মেয়ে জামাইয়ের কোন কিছুই তার কাছে দোষ মনে হয় না ৷ বহুবার সংসার ছাড়তে চেয়েছে সে , কিন্তু ঐ যে লোক , সমাজ আর পরিবার ! তার মায়ের সাফ কথা “আইবা , খাইবা , থাকবা তারপর সোয়ামীর ঘরে চলে যাইবা ৷ সংসার ছাড়নের চিন্তা মাথায় আননের আগে আগে বাপ মা ছাড়নের চিন্তাটা কইরা নিবা …”
এখন আর লাকী কাউকে কিছু বলে না ৷ আপাত দৃষ্টিতে স্বামীর নামে অভিযোগ করার মত তেমন কিছু নেইও আসলে ৷ তার স্বামী তাকে মারধোর করে না , তার সাথে ঝগড়াও করে না , তার চাওয়ার আগেই শাড়ি কাপড় চলে আসে , ছেলেদের জন্য খরচ করতে নাদের মিয়ার হাত সবসময়ই খোলা …. তারপরও সংসারে মন বসে না লাকীর ৷ নিজেকে প্রতারিত মনে হয় ৷
নিপাকে কী সে হিংসা করে ! হয়তো করে … হিংসার মত নোংরা ব্যাপারটা তার মধ্যে কিভাবে এলো সে জানে না ৷ শুধু জানে তারও একটা ভালোবাসার মানুষ পাবার কথা ছিল , কিন্তু সে পায়নি …. তার সাথে এমন একজন মানুষের জীবন বাঁধা হয়েছে যার অন্তরে আজও আরেক নারীর হৃদয় বাঁধা ….
*****
নয়নের ছুটি শেষ হয়ে গেছে ৷ আগামীকাল সকালে সে আবার শহরে যাবে নিজের কলেজ হোস্টেলে ৷ আলেয়া বেগম বসে বসে মুড়ির মলা করছেন , ছেলের সাথে দিবেন ৷ রূপা হাতে হাতে এগিয়ে দিচ্ছে তাকে ৷
নয়ন এমন আগেও অনেকবারই ছুটি শেষে শহরে চলে গেছে ৷ কখনই রূপার কিছুই মনে হয়নি ৷ আলেয়া বেগম যখন ছেলেকে বিদায় দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছেন সে মনে মনে ভেবেছে “ভাইজান তো আবার কয়দিন পরই আইবো , এমুন কইরা কান্দে ক্যান চাচী ….” অথচ আজ কেন যেন সবকিছু ভিন্নরকম লাগছে …. রূপারও খুব কান্না পাচ্ছে ৷ এমন কেন হচ্ছে রূপা জানে না ৷ রাতে যখন সবাই খেতে বসলো রূপা নয়নের দিকে একবারও তাঁকায়নি , ওর মনে হচ্ছিল তাঁকালেই সে কেঁদে ফেলবে ৷ মানুষটাকে বাড়িতেই রেখে দিতে ইচ্ছে করছে তার ৷ কিন্তু তার এই ইচ্ছাটা কেন হচ্ছে !
সবাই ঘুমিয়ে পড়ে , রূপার ঘুম আসে না ৷ আস্তে আস্তে দরজা খুলে বারান্দায় এসে বসে রূপা ৷ নয়নের ঘরে এখনও বাতি জ্বলছে … রূপার খুব ইচ্ছে করে একটাবার নয়নের ঘরে যায় ৷ কিন্তু এতটুকু বুঝ তো তার আছে , এত রাতে একটা পুরুষ মানুষের ঘরে তার যাওয়া ঠিক হবে না ৷ দুহাতে চোখ ঢেকে রূপা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে …
এ কান্নার উৎস যে কৈশোরের ভীষণ শক্ত প্রেম , রূপা তা জানে না …
আমি কাউকে বলিনি সে নাম
তামান্না জেনিফার
পর্ব ৮
__________________________
সব ভালোই চলছিল নিপার জীবনে ৷ হঠাৎ করে গত তিন দিন থেকে আজাদের কল আসছে না ৷ নিপা কল দিলেও বন্ধ পাচ্ছে মোবাইল ৷ এদিকে বিয়ের বাকী আর মাত্র এক সপ্তাহ …
নিপার মনে নানান কুচিন্তা আসে ৷ একেক বার মনে হয় আজাদের কোন বিপদ হলো না তো ! আবার মনে হয় স্বপ্ন দেখিয়ে আজাদ তাকে ধোকা দিচ্ছে না তো …. কদিন আগে প্রজাপতির মত উচ্ছ্বল জীবন কাটানো মেয়েটা আবার যেন চুপসে গেল মাত্র তিন দিনেই ৷
বাড়িতে বিয়ের আয়োজন শুরু হয়ে গেছে ৷ আজকে দুটো গরু কেনা হয়েছে বিয়ের ভোজের জন্য ৷ গাজী মিয়া বিয়েতে নমঃ নমঃ করে রাজী হলেও মেয়ের বিয়ের আয়োজনে কোন কমতি রাখতে চান না ৷ তার একমাত্র মেয়ে , সারা গ্রামের মানুষ যেন একটা বেলা ভরপেট খেতে পারে সে ব্যবস্থাই তিনি করছেন ৷ বাড়িতে থাকা বছর কামলা রতন তার সাথে সাথে সব কাজে ছুটে বেড়াচ্ছে ৷ গাজী মিয়া বারান্দায় বসে রতনকে ডাকলেন ৷
—রতইন্যা , এদিক আয় দি বাপ
—জে মামা কন
—মধুখালীর বড়মিয়াসাবরে দাওয়াত পৌছাইছোস ?
—হ , কাল বৈকালে গেছিলাম ৷ বড়মিয়াসাব কইছেন তিনি অবশ্যই আইবেন ৷
—আলহামদুলিল্লাহ ৷ বাজার সদাই সব হইছে ? দিন তো আর বেশি নাই ৷
—সব হইতাছে মামা , আপনে পেরেশান হইয়েন না
—বাবুর্চি কারে আনবা ? মোতালেব মিয়া বলে কাম ছাইড়া দিছে !
—হ মামা , মোতালেব মিয়া চোক্ষে দেখে না , বুইড়া হয়া গেছে ৷ তয় তার বেটা শুনছি ভালোই পাকানি হইছে ৷ ভাবতেছি তারেই ডাকুম ৷
—ভালো মনে করলে তারেই ডাক , তোর উপ্রে আমার বিশ্বাস আছে রে রতইন্যা …
—মামা , বড়মামীর কী করবেন কিছু ভাবছেন ? বিয়ার দিন ঝামেলা পাকাইলে অসুবিধা হইয়্যা যাইবো ৷ কদিন ধইরা বড়মামীর চিল্লাফাল্লা বাড়ছে ৷ ঐ দেখেন অহনও চিল্লাইতাছে …
—দেখি , ব্যবস্থা কিছু করুমনে …
নিপার মায়ের আজ বোধহয় শরীর বেশি ভালো না ৷ সকাল থেকেই চিৎকার করছে ৷ গাজী মিয়া তার ঘরের বন্ধ দরজার সামনে কতক্ষন দাঁড়ালেন , তারপর দরজার তালা খুলে ঘরে ঢুকলেন ৷ বউটা মাটিতে শুয়ে ঘরঘর আওয়াজ করছে কুকুরের মত ৷ কেউ বোধহয় পানি খেতে দিয়েছিল , সেই পানি মেঝেতে পড়ে কাদা হয়ে গেছে ৷ নিপার মা সেই কাদায় হাত দিয়েছিল বোধহয় , তার মুখে চুলেও কাদা লেগে আছে ….
গাজী মিয়া বউয়ের সামনে সহসা আসেন না ৷ বউটার এই অবস্থার জন্য ভেতরে ভেতরে নিজেকেই দায়ী করেন তিনি ৷ নিপার জন্মের আগে ছয়বার গর্ভপাত হয়েছিল তার ৷ কোনটা তিন মাসে কোনটা পাঁচমাসে …. তিনি স্বামীকে অনেক অনুরোধ করেছিলেন , বলেছিলেন দুটা ছেলে তো আছে , আর বাচ্চা না নেই … গাজী মিয়ার এক কথা ছিল “একখান মাইয়্যা না হইলে ঘরের শোভা হয় না ! একখান মাইয়্যা আমার লাগবোই ৷ ”
এরপর নিপার জন্ম হলো ঠিকই , কিন্তু তার বউটা আর স্বাভাবিক থাকলো না ৷ অনেকেই বলেছিল শহরে নিয়ে তাকে ডাক্তার দেখাতে ৷ গাজী মিয়া ভেবেছিলেন ঠিক হয়ে যাবে ৷ আবার শহরে নেওয়ার ঝামেলাও তো কম না ! আসলে সেই সময় কোন ঝামেলাতেই জড়াতে মন সায় দেয়নি তার ৷ গ্রামের কবিরাজের ঔষধ খাইয়েছে বছরখানেক ৷ তারপর থেকে চিকিৎসা বন্ধ ৷ অথচ তার টাকা পয়সার তো কমতি ছিল না ৷ এখন তার মনে হচ্ছে তিনি বড্ড বেশি অন্যায় করে ফেলেছেন নিপার মায়ের সাথে ৷ স্ত্রীর মাথার কাছে বসে তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেন “আমরার নিপার বিয়া ঠিক হইছে বউ ৷ ওর বিয়াটা মিটা গেলেই তুমারে আমি শহরে বড় ডাক্তরের কাছে নিয়া যামু বউ ৷ ”
স্বামীকে দেখে আটোসাটো হয়ে বসে পাগলী বউটি ৷ তারপর মাথায় কাপড় তুলে নিয়ে বলে “আসসালামু আলাইকুম , আপনে ভালো আছেন নাদেরের বাপ ?”
গাজী মিয়া জবাব দিতে গিয়ে হঠাৎ খেয়াল করেন তার বউয়ের হাতে শক্ত করে ধরা একটা বটি ! তার চোখে মুখে কেমন ভয়ঙ্কর হাসি….. উত্তর না দিয়ে তিনি ঘর থেকে ছুটে বের হন …. তার পাগল বউটির হাতে বটি কিভাবে পৌছালো কে জানে ! ঘরের দরজায় কোনমতে তাল দিয়ে চিৎকার করে ডাকতে থাকেন “ওরে রতইন্যা ! তোর বড়মামীর হাতে বটি !”
বন্ধ ঘরের ওপার থেকে একটা বিভৎস্য হাসির শব্দ আসতে থাকে ….
********
শ্বশুরের চিৎকার শুনে ঘরে বসে বসে ঘামছে লাকী ৷ মনে হচ্ছে তার জীবনটা এবার বের হয়ে যাবে ৷ শাশুড়ির কাছে বটি পৌছানোর কাজটা সেই করেছিল ৷ গতকাল তার শাশুড়িকে যখন সে ভাত দিতে যায় তখন উনি বলছিলেন “আম্মাজি , একখান বটি লাগবো , হাত পায়ের নখডি বড় হইয়্যা গেছে … এইগুলান কাটতাম ”
লাকী ঝামেলা এড়াতে বটি দিয়েছে ৷ পাগল মহিলার সাথে ভেজালে যেতে চায়নি অথবা বটি তার হাতে গেলে কী বিপদ হতে পারে এই চিন্তাটা করা জরুরি মনে করেনি সে ৷ এখন কেউ যদি জানতে পারে এই কাজ সে করেছে তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে ….
নাদের মিয়া আজ গঞ্জে যায়নি ৷ রাত থেকেই তার জ্বর জ্বর ভাব , একটাদিন বিশ্রাম নিতে এখনও বিছানায় শুয়ে আছে সে ৷ লাকীর চোখের আতঙ্ক তার দৃষ্টি এড়ায় না …. লাকীর হাত দুটো ধরে নাদের মিয়া বলে উঠে “আম্মারে তুমি দিছো বটি ? ”
লাকী এক ঝটকায় স্বামীর হাত ছেড়ে জবাব দেয় “হ ! আমার ঠেকা পড়ছে না ! আপনের মায়েরে আমি বটি দিতে যামু কুন দুঃখে ! আপনে আমারে এমন কতা কইতে পারলেন ….. অক্ষন আমি বাপের বাড়ি চলে যামু ৷ যেই সংসারে মান নাই , সেই সংসারে লাকী থাকবো না !”
নাদের মিয়া পাশ ফিরে শুয়ে পড়েন ৷ তার বউ দুদিন পরপর নাই কথার ছুতো ধরে বাপের বাড়ি চলে যায় , এটা দেখে সে অভ্যস্ত ৷ কখনও বাঁধা দেয় না সে , যার যেখানে ভালো লাগবে যাবে … থাকতে না চাইলে তো আর কাউকে আটকে রাখা যায় না ! মানুষ তো আর খাঁচার পাখি না !
তবে এবার যেন একটু শক্ত হলো নাদের মিয়া ৷ গম্ভীর গলায় বললো “নিপার বিয়া শ্যাষ হইলে কই যাইবা যাইও ৷ এখন তোমার কোথাও যাওন চলবে না ৷ যাও নিজের কামে যাও ৷ ”
লাকী অবাক ভালোবাসায় স্বামীর পিঠের দিকে তাঁকিয়ে থাকে , তার মুখ অপর পাশে ফেরানো ….
এই প্রথম তার স্বামী তাকে অধিকার নিয়ে বললো যাওয়া হবে না ৷ তা সে যেভাবেই হোক…
চলবে…
চলবে…