#আমি_তারে_দেখেছি (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#৫ম_পর্ব
সবগুলো চুড়ি দোকান থেকে কিনে বের হবার সময় শান্তর মোবাইলে ফোন এলো। নবনীতাকে প্যাকেটটি ধরিয়ে বলল,
“তুমি গাড়ির কাছে যাও, আমি আসছি”
নবনীতা মাথা দোলালো। সে চলে গেলে ফোন ধরলো শান্ত। অপাশ থেকে ভারী কণ্ঠ ভেসে এলো,
“স্যার, মাস্কে দুটো ফিঙ্গারপ্রিন্ট আর একটি ডিএনএ স্যাম্পল পাওয়া গেছে। ছাপ দুটো আপনি যাদেরটা আশা করেছিলেন”
“আর ডিএনএ?”
“নবনীতা ম্যামের। মাস্কের ডিএনএ আর ম্যামের চুলের ডিএনএ ম্যাচ করেছে। এখন কি করবো স্যার?”
শান্ত কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। তারপর গম্ভীর স্বরে বললো,
“তুমি কি এই কথাগুলো ইরশাদকে জানিয়েছো?”
“না স্যার, যদি আপনি বলেন তবেই জানাবো”
“গুড, জানানোর প্রয়োজন নেই। তুমি আমার জন্য আরেকটি কাজ করবে। মাস্কটি সাধারণ নয়, বেশ সুন্দর কারুকাজ রয়েছে তাতে। বলা যেতেই পারে, কোনো একটা স্পেসিইফক জায়গা থেকে মাস্কটা কেনা হয়েছে বা সাপ্লাই পেয়েছে। তুমি সেই সাপ্লায়ারকে খুজে বের করো। কারা কারা এই মাস্ক নিচ্ছে সেটা বের কর। আর রাকা, শ্রীবাস, বিভার কি খবর? ওদের উপর একটু খেয়াল রাখতে হবে”
“জি স্যার। অলরেডি ওদের ফোন, বাসার সিসি টিভি এবং গাড়ি ট্রাক করা হয়েছে কোনো গতিবিধির পরিবর্তন হলেই আপনাকে জানাচ্ছি। কিন্তু স্যার একটি প্রশ্ন?”
“করে ফেলো নির্ভীক”
নির্ভীক যেন শান্তর সম্মতিতে সাহস পেলো। তাই বিনা দ্বিধায় শুধালো,
“আমরা এই কাজগুলো ইরশাদ স্যারের আড়ালে কেনো করছি স্যার?”
“তুমি সুন্দর প্রশ্ন করো। সত্যি ইম্প্রেসিভ। সাধারণত অধঃনস্তদের এমন তুখর প্রশ্ন করে না। নিজের নামের মান রেখেছো তুমি”
“থ্যাংক ইউ স্যার। উত্তরটা?”
“উত্তর হলো, কেসটা আমি নিজ দায়িত্বে ক্লোজ করিয়েছি। এখন যদি ইরশাদ জানে আমি এই কেসটির কাজ এখনো করছি তাহলে ছেলেটা অভিমান করবে। মেয়েমানুষের মতো অভিযোগ করবে, কেঁদেও দিতে পারে। সেটা করা যাবে না। খুব নরম মনের তো। তাই তাকে জানানো যাবে না। জানানোর কথায় মনে পড়লো, তুষার ছেলেটির কোনো ক্লু পেলে?”
“খুব বেশি না স্যার। তবে ফোনে বলতে চাচ্ছি না। আপনি একটু থানায় আসতে পারবেন?”
“এখন তো ছুটিতে আছি। এই শুক্রবার আমার বিয়ে”
“সরি স্যার, তাহলে তো আপনি ব্যস্ত। ম্যাডামকে সালাম দিবেন। কিছু মনে না করলে স্যার একটি পার্সোনাল প্রশ্ন করবো?”
“হ্যা করো, মনে করা বা না করার দায়িত্ব আমার উপর ছেড়ে দাও”
“সরি স্যার, আসলে জানতে ইচ্ছে হচ্ছে ম্যাডাম কি করেন! আসলে কৌতুহল হচ্ছে, আপনার মতো দশে দশ পুরুষকে বিয়েতে রাজি করিয়েছেন। তাই জানতে ইচ্ছে হচ্ছে তিনি কে”
নির্ভীকের প্রশ্নে সশব্দে হেসে উঠলো শান্ত। বেশ কিছুক্ষণ হাসলো সে। মনে হলো যেন এর থেকে হাস্যকর কোনো প্রশ্ন সে ইহজীবনে শুনে নি। অবশ্য নির্ভীকের প্রশ্নটি খুব একটা অসঙ্গত নয়। কারণ শান্তর সাথে নবনীতার বিয়ের কথাটা খুব অল্প মানুষ ই জানে। তাই হাসি থামিয়ে বলল,
“ওই যে নবনীতা ম্যাম, যার চুলের স্যাম্পল তোমাকে দিয়েছি সে আমার বাগদত্তা”
বলেই ফোন কেটে দিলো শান্ত। নির্ভীকের মুখখানা এখন দেখার মত হবে। ভেবেই পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে তার। শান্ত হুট করেই মনে হল সে মানুষ হিসেবে এই জংধরা গোয়ার সমাজের ভালো মানুষের কাঠামোতে পড়ে না। বরং তাকে যদি বলা হয় সে কেমন মানুষ, তবে সে বলবে “নিতান্ত চা/মা/র” _______
নীলাম্বর জুড়ে ধূসর মেঘের আস্তরণ, এক রত্তি জায়গা ফাঁকা নেই। আকাশের পানে চাইলে মনে হচ্ছে এখনি মেঘগুলো ধরণীতে নেমে পড়বে। নবনীতার বিরস চোখ এখনো মেঘের মিছিল দেখতে ব্যস্ত। হঠাৎ করে অনুভূত হলো একজোড়া রুক্ষ হাত ছুঁলো। গাঢ় স্বরে বললো,
“অপেক্ষা করানোর জন্য অধম ক্ষমাপ্রার্থী”
শান্তর দিকে একপলক চাইলো সে। তার ভাবটা এমন যেন ওই মেঘের সারির মধ্যে সন্ধানী চোখে নবনীতা তাকে খুঁজছিলো। বেশ ভাব নিয়েই বললো,
“আমি তো আপনার অপেক্ষায় ছিলাম না”
“জানি, তবুও আমার ভ্রান্ত ধারণার কাঁচ ভাঙ্গতে চাই না। তোমার উদাসীন চোখ আমাকেই খুঁজে— এই ধারণাটা যে আমাকে আনন্দ দেয়”
লোকটির দিকে বিমূঢ় দৃষ্টিতে চাইলো নবনীতা। লোকটি এমন করে কথা বলে কেন? মনে হচ্ছে শান্ত তার প্রেমের চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছে। নবনীতা তার হৃদয়ে বিস্তার করে আছে। সে কি জানে এমন বাক্য নবনীতার মনকে অশান্ত করে তোলে। তখন মনে হয় কঠিন হৃদয়টি একটু গলুক, ক্ষতি কি! সে কি জানে এখন নবনীতার নির্লিপ্ত হৃদয়টা দামামা বাজাচ্ছে। নিরস মুখটা লাজের রঙ্গে রঞ্জিত হয়েছে। এক আবেগের মায়া গ্লানি হয়ে তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে, আবার সেই আবেগের জুয়ায় মত্ত হতে চায় না। অতর্কিতে কোমল গালে হাত রাখলো শান্ত। অবাক স্বরে বললো,
“তোমার গাল এমন গরম হয়ে আছে কেন? জ্বর আসছে?”
নবনীতা সাথে সাথে হাত সরিয়ে সাথে সাথে। ধমকের সুরে বলল,
“এভাবে ছোঁবেন না”
“কেন? ছোঁবো না কেন?”
“আমি বলেছি তাই”
নবনীতার কথায় বাম হাতটা পকেটে গুজলো শান্ত। ডান হাত দিয়ে কপালের চুলগুলো পেছনে ঠেলে নবনীতার কানের কাছে ঝুকে কণ্ঠ খাদে নিয়ে বলল,
“বেশ, শুক্রবারটা আসুক। সেই অপেক্ষাতেই আছি। এভাবে না, সব ভাবেই ছুঁবো। তুমি মানা করতে পারবে না, শ্যামলী”
শান্তর কথা শেষ না হতেই নবনীতা রাগী স্বরে বলে উঠলো,
“অসভ্য”
এদিকে গাড়িতে বসে থাকতে থাকতে হেনা বেগম বিরক্ত। বিরক্ত স্বরে বললেন,
“শান্ত তোমার হয়েছে। বাড়ি যাবো। অনেক কাজ বাকি”
নবনীতা হনহন করে গাড়িতে বসলো। যা একটু ভালোলাগা ছিলো এই মানুষটা সব মাটি করে দিয়েছে। এখন রাগে গা জ্বলছে। এমন অসহ্য লোকটিকে কি করে সহ্য করবে সে!
*******
সিফাতুল্লাহ আকবর নামক একটি লোকের কাছে এসেছে শান্ত। এপোয়েন্টমেন্ট নিয়ে এসেছে। সে নাকি বাংলাদেশের খুব নামকরা একজন ডাক্তার। কিন্তু লোকটিকে দেখে তেমন মনে হচ্ছে না। খুব অসাধারণ বা মেধাবী ব্যাক্তিত্বের চোখে মুখে যে ঔজ্জ্বল্য থাকে এই মানুষটির মধ্যে নেই। নিতান্ত জীর্ণ শরীর, বয়স ষাটের বেশ। দাড়ি বুক অবধি। একটি চুল ও কাঁচা নেই। চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ। মোটা ফ্রেমের চশমা পড়েন তিনি। চেহারাটি দেখতে যেমন অশোভনীয়, কণ্ঠ তার চেয়েও অশ্রবণীয়। অতিরিক্ত তীক্ষ্ণতা, এমন মানুষ কি করে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হন সেটা বুঝে উঠতে পারছে না শান্ত। সাধারণত সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে কথা বলতেই আসে মানুষ। কিন্তু এই মানুষের কাছে কি করে কথা বলবে? তার কণ্ঠ শুনতেই কথা বলার ইচ্ছে চলে যাবে। তবুও মুখে প্লাস্টিকের হাসি ঝুলিয়ে শান্ত বললো,
“আপনি তুষার মাহমুদকে চিনতেন?”
“ত্রিশ বছরের ক্যারিয়ারে কম রোগী দেখি নি। কোন কোন রোগীর কথা মনে রাখবো বলুন”
“যৌক্তিক, কিন্তু আমি বিশ বর্ষীয় তুষার মাহমুদের সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি। যে আপনার কাছে তার ক্রোনিক ডিপ্রেশন নিয়ে এসেছিলো। আপনি তাকে মেডিসিন দিয়েছিলেন। প্রায় একবছর আপনার আন্ডারে ছিলো সে। ২০২০ সালে সে হুট করে নিখোঁজ হয়ে যায়”
সিফাতুল্লাহ এর মুখোভাব বদলালো। কপালে পড়লো তীব্র ভাঁজ, অনেক ভেবে বলল,
“ইয়া ইয়া, নাও আই রিমেম্বার। তুষার মাহমুদ, আমার ই প্যাশেন্ট। বিশ সালে ছেলেটা নিখোঁজ হয়। পুলিশি তদন্ত হয়, আমার কাছে তিনবার জিজ্ঞেসাবাদে এসেছিলো তারা। উফফ হাউ কুড আই ফরগেট! এক প্রশ্ন? সে কি আ ত্ম হ ত্যা করতে পারে?”
“তিনবার এসেছিলো?”
“হ্যা, তিনবার”
“আচ্ছা, আপনার কি মনে হয় সে কি আসলেই আ ত্ম হ ত্যা করেছিলো?”
“ডাক্তার হিসেবে জিজ্ঞেস করলে বলবো, করতেই পারে। তার অবস্থা খুব একটা সুবিধের ছিলো না। যতই হোক, অবৈধতা কিন্তু সাধারণ মানুষ মেনে নিতে পারে না”
সিফাতুল্লাহ এর কথায় চমকালো শান্ত। “অবৈধ” শব্দটি তার কাছে বেশ নতুন ঠেকলো। তুষারের ফাইলে কোথাও তার বাবা-মার কথা উল্লেখ নেই। তাই ব্যাপারটা বেশি আকর্ষণ করলো তাকে। তবে কি ক্লাসের সবার হেয় হবার কারণ এই অবৈধতা?
***********
শুক্রবার, মেঘের তীব্র কন্দনে কাঁপছে পৃথিবী। তবুও আনন্দের জোয়ার ঢেউ তুলছে নবনীতার বাসায়। পড়ণে লাল বেনারসি। হাত ভর্তি চুড়ি, ভারী গহনা গলায়, কানে। শারমিন বেগম নিজ হাতে মেয়েকে সাজিয়েছেন। নবনীতা বাধা দেয় নি। আর তো কয়েকটা ঘন্টা। তারপর সে এই চিরচেনা বাসাটা ছেড়ে চলে যাবে অচেনা গৃহে। যেখানে থাকবে না ভাই, বাবা কিংবা প্রিয় মা। অভিযোগের খাতাটা ভরবে কিন্তু ঠোঁটে আসবে না। জেদ, বদমেজাজি ব্যাপারগুলোকে গিলে ফেলতে হবে। না খাইতে ইচ্ছে হলে কেউ জোর করে খাওয়াবে না, মাথা ব্যাথা করলে টেবিলে মলম এগিয়ে বলবে না,
“লাগিয়ে নে, সেরে যাবে”
নিশাদের চুল ছেড়া যাবে না। সবকিছু খুব মনে পড়বে। হয়তো এই বাড়ি ফিরা হবে অতিথি হয়ে। অদ্ভুত তাই না? নিজের হাতের রক্তিম লাল মেহেদি দেখতে দেখতে চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে এলো নবনীতার। তখন ই কানে এলো,
“বর এসেছে”
নির্লিপ্ত হৃদয়টা কেঁপে উঠলো, শান্তরা চলে এসেছে। একটু বাদেই তাকে দেখতে এলেন, হেনা বেগম, সামিয়া, স্নেহা। নববধুর মুখ দেখে প্রশংসায় পঞ্চমুখ সবাই। আজ রেবা একটি জমকালো লাল শাড়ি পড়েছে। তার ঠোঁট লাল লিপস্টিকে রাঙ্গা। খুশি যেন ধরছে না তার। মানত সফল হয়েছে। কিন্তু সবই ফিকে হয়ে গেলো যখন শোনা গেলো,
“শান্ত আসে নি”
নবনীতা মলিন দৃষ্টিতে চাইলো, তখন সামিয়া বলল,
“ওর একটা কাজ পড়ে গেছে, বোঝ ই তো পুলিশ মানুষ”
নবনীতা ম্লান হাসলো। কিন্তু বুকে ভয় সৃষ্টি হলো। সেই ভয় তীব্র হলো যখন আধ ঘন্টা পার হবার পর ও শান্ত আসলো না। হেনা বেগম ফোন দিতেই অপাশ থেকে শুনলেন,
“কাঙ্খিত নম্বরটিতে সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না”………………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি