#আমি_তোমার_গল্প_হবো🍁
লেখিকা- মাহিয়া তাহসীন মেরিন
পর্ব:::০৩
আশ্বিন একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে দাদিকে শুইয়ে দিয়ে গায়ে চাদর দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে।
আশ্বিন ধীরে ধীরে নিজের রুমে প্রবেশ করে দেখে অধরা হাত পা ছড়িয়ে বাচ্চাদের মতো করে ঘুমিয়ে আছে। অধরাকে এভাবে ঘুমাতে দেখে আশ্বিন অজান্তেই মুচকি হেসে, ধীরে ধীরে অধরার সামনে এসে তাকে ভালোভাবে শুইয়ে দিয়ে গায়ে চাদর দিয়ে দেয়।
আশ্বিন এক ধ্যানে ঘুমন্ত অধরার মায়াবী মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
হঠাত মনে পড়ে যায়, অনেক বছর আগে বাচ্চা কণ্ঠে বলা অধরার কিছু কথা,,
— ” এই ছেলে…! হ্যা, তোমাকেই বলছি। তুমি কি আমার বর হবে? আমি বড় হয়ে কিন্তু তোমাকেই বিয়ে করবো। ”
কথাটা মনে হতেই আশ্বিন মুচকি হেসে অধরার মুখের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো আলতো করে সরিয়ে দিয়ে,,
— ” আসলেই একটা গাধী। ”
কথাটা বলেই উঠে দাঁড়িয়ে ল্যাপটপ নিয়ে সোফায় বসে পড়ে। দুদিনের ব্যাস্ততার জন্য অফিসের কোন খোঁজ খবর নিতে পারেনি সে। তাই,, আর সময় নষ্ট না করে সব ফাইল চেক করতে শুরু করে আশ্বিন।
🌻সকালে🌻
অধরার ঘুমের ঘোরে মনে হচ্ছে কেউ একজন তাকে একদম কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করছে। এক জোড়া চোখ তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
হঠাত কারো গরম নিশ্বাস তার মুখের উপর অনুভব করতেই অধরা এক লাফে উঠে বসে।
— ” ভুত ভুত ভুতততত…! ” কথাটা বলেই অধরা চোখ বন্ধ করে হাত পা ছড়াছড়ি করতে শুরু করে।
— ” এতোদিন ধরে দেখেছি মানুষ ঘুম থেকে উঠে গুড মর্নিং বলে।
আর ভাগ্যক্রমে আমার কপালেই এমন একজন জুটেছে, যিনি ঘুম থেকে উঠে ভুত ভুত করে চিৎকার করছে।
আজব পাবলিক। ”
এমন অপমানজনক কথা শুনে অধরা চোখ খুলে সামনে তাকিয়ে দেখে আশ্বিন সোফায় বসে কিছু ফাইল নিয়ে ল্যাপটপে কাজ করছে।
আশ্বিনকে দেখে অধরা এক লাফে খাট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে,,
— ” আশ্বিন, আপনাদের বাসায় ভুত আছে। আমি থাকবো না এখানে, আজই চলে যাবো আমি। হুম। ”
— আশ্বিন অধরার দিকে একবার তাকিয়ে আবার ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে,, ” এতো ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এ বাসায় কোন ভুত নেই। আর থাকলেও এতোক্ষণে তোমাকে দেখে ভয়ে কোথাও মরে পড়ে আছে। ”
— অধরা কোমরে হাত রেখে রাগী কণ্ঠে,, ” কি বললেন আপনি? এতো বড় অপমান! ”
— আশ্বিন সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে,, ” দাদি ব্রেকফাস্টের জন্য ডেকেছে। জলদি ফ্রেশ হয়ে নিচে এসো। ”
কথাটা বলেই আশ্বিন রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে একটা বাঁকা হাসি দেয়।
এদিকে অধরা রাগী চোখে আশ্বিনের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে,,
— ” কতো বড় পাজি। আমাকে অপমান করলো,, এই অধরাকে? আমিও দেখে নিবো।হুহহহ। ”
কথাটা বলে অধরা ফ্রেশ হতে চলে গেলো।
🌻🌻
অধরা ফ্রেশ হয়ে নিচে আসতেই দেখে দাদি আর আশ্বিন একসাথে খাবারের টেবিলে বসে আছে।
— দাদি অধরাকে দেখেই,, ” আরে আমার ছোট্ট বুড়িটা চলে এসেছে। এখানে বসো। ”
অধরা মুচকি হেসে আশ্বিনের পাশে বসে পড়ে। আশ্বিন অধরার দিকে না তাকিয়েই খাওয়া শুরু করে। অধরা তার দিকে তাকিয়ে একটা ভেংচি কেটে, খাওয়া শুরু করে।
— আশ্বিন খাওয়া শেষ করে,, ” দাদি বলে দাও তোমার আদরের বউমাকে, দশ মিনিটের মাঝেই যেনো কলেজের জন্য রেডি হয়ে আসে। ”
— দাদি অধরার দিকে একবার তাকিয়ে,, ” কি বলিস দাদুভাই? আজকেই কলেজে যেতে হবে মেয়েটাকে? দুদিন পর থেকে না হয়…”
— ” না দাদি, আজ থেকেই সে কলেজে যাবে। কিছুদিন পর থেকেই তার পরীক্ষা।
আমাকে যেনো শুনতে না হয়, আশ্বিন চৌধুরীর বউ পরীক্ষায় ফেইল করে। ”
কথাটা শুনেই অধরার কাশি উঠে যায়। কোথায় সে পড়ালেখা ছেড়ে দিবে ভেবেছিল। আর এখন আশ্বিন এসব কি বলছে…
— অধরা আমতা আমতা করে,, ” ইয়ে মানে, দাদি বলছিলাম কি, আমার আর পড়ালেখা করার কি দরকার? বিয়ে তো হয়েই গিয়েছে তাই না? ”
— আশ্বিন রাগী কণ্ঠে,, ” দাদি বলে দাও তাকে, কোন অশিক্ষিত মূর্খ মেয়েকে আশ্বিন চৌধুরী তার বউ হিসেবে মানে না।
আমি দশ মিনিট অপেক্ষা করবো, এর মাঝে যদি সে রেডি না হয় তাহলে যেনো এ বাসায় না থাকে। ”
কথাটা বলেই আশ্বিন চলে গেলো। অধরা রাগী রাগী ভাবে তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে,,
— ” এমন ভাবে বললো, যেনো আমি তার বাসায় থাকার জন্য একদম মরেই যাচ্ছিলাম। তাই উনি আমাকে দয়া করে এখানে থাকতে দিচ্ছেন।
যত্তোসব ঢং। ”
— দাদি মুচকি হেসে,, ” আর কথা না বাড়িয়ে গিয়ে জলদি রেডি হয়েনে। নাহয় তোমার বর আবার রেগে যাবে।
যাও যাও। ”
অধরা গাল ফুলিয়ে আশ্বিনকে বকতে বকতে রুমে চলে আসে।
🌻🌻
আশ্বিন অধরাকে নিয়ে কলেজের সামনে গাড়ি থামিয়ে,,
— ” কলেজ শেষে আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিবো। খবরদার, একদম একা একা যাবে না। আর কলেজ থেকে যেনো কোনো উল্টো পাল্টা অভিযোগ না শুনতে হয়।
আর, বই খাতা তো বিক্রি করেই দিয়েছো, আমি নতুন বই রহিমকে দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দিবো।
এখন যাও। ”
অধরা এতোক্ষণ মাথা নিচু করে আশ্বিনের সব কথাগুলো শুনছিলো। সারা রাস্তা তাকে বকতে বকতে নিয়ে এসেছে আশ্বিন।
আশ্বিন তাকে যেতে বলার সাথে সাথেই অধরা এক দৌড়ে কলেজের ভেতর চলে আসে।
— অধরা আপনমনে হাটতে হাটতে,, ” হুহ। কি পেয়েছে আমাকে? আমি আজ চুপচাপ শান্তশিষ্ট মেয়ে বলে উনি যা ইচ্ছা তাই বলবে নাকি আমাকে? আমি কি সব মেনে নিবো নাকি? হুহহ। ”
হঠাত একদল ছেলে অধরার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। অধরা তাদের দিকে তাকাতেই মুখে বিরক্তি ফুটে ওঠে,,
— ” কি চাই? এভাবে খাম্বার মতো সামনে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? ”
— সাদ একটা বাঁকা হাসি দিয়ে,, ” জানেমান, দুদিন ধরে তোমাকে দেখি না। জানো কতো মিস করেছি? কোথায় ছিলে এতোদিন? ”
অধরা একটা বিরক্ত ভাব নিয়ে সেখান থেকে সরে আসতে নিতেই সাদ অধরার হাত ধরে ফেলে। অধরা ভ্রু কুঁচকে সাদের দিকে তাকিয়ে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই, কেউ একজন এসে সাদের হাত থেকে এক টানে অধরার হাত ছাড়িয়ে, সাদের হাত পেঁচিয়ে ধরে।
— সাদ চিৎকার করে,, ” হাত ছাড়। কে রে তুই? ”
— রাগী কণ্ঠে,, ” এতোক্ষণ যার হাত ধরে ছিলি সেই অধরার বর আমি, আশ্বিন…চৌধুরী।
আমার ওয়াইফের গায়ে হাত দেওয়ার সাহস হয় কিভাবে? ”
কথাটা বলেই আশ্বিন সাদকে এক ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়। সাদ অবাক হয়ে একবার আশ্বিনের দিকে তাকিয়ে আবার অধরার দিকে তাকায়।
এদিকে,, অধরা এতোক্ষণ অবাক হয়ে আশ্বিনের দিকে তাকিয়ে ছিলো। আজ সারাদিন অনেক কথা শুনালেও এখন তার কাজে মনে মনে অনেক খুশিই হয়েছে অধরা।
সাদ অধরাকে মুচকি হাসতে দেখে একটু রাগী ভাবে তাকিয়ে সেখান থেকে চলে আসে।
— আশ্বিন অধরার দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে,, ” ক্লাসে না গিয়ে এভাবে হাঁটছো কেনো তুমি? সমস্যা কি, হ্যা? যাও ক্লাসে। আর এই নাও তোমার ব্যাগ। কেমন স্টুডেন্ট, ব্যাগ রেখেই চলে এসেছে।
গাধী একটা। ”
অধরা চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে সেখান থেকে চলে আসে। আশেপাশের মানুষরা এতোক্ষণ হা করে আশ্বিনের দিকে তাকিয়ে ছিলো।
ক্লাসে প্রবেশ করতেই তিশা দৌড়ে অধরার কাছে এসে,,
— ” কিরে? তুই না লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছিস? তাহলে কলেজে কি করিস?
জিজু জোর করে তোকে পাঠিয়েই দিলো, তাই না? ”
তিশা কথাটা বলেই হাসতে শুরু করে।
এদিকে অধরার কোন হুশ নেই। সে আশ্বিনের বলা কথাটাই ভেবে যাচ্ছে।
” আমার ওয়াইফের গায়ে হাত দেওয়ার সাহস হয় কিভাবে? ”
অধরার কথাটা মনে হতেই তার গলুমলু গালগুলো হালকা লাল হয়ে যায়।
একদম হিরোর মতো এসে কিভাবে আশ্বিন নিজেকে অধরার বর বললো, কথাটা মনে হতেই অধরার মনে ভালো লাগা কাজ করছে।
আশেপাশের কোন খেয়াল তার নেই। অধরা শুধু আশ্বিনের বলা কথাই ভেবে যাচ্ছে আর লাজুক হাসি দিচ্ছে।
🌻বিকেলে🌻
অধরা কলেজ থেকে ফিরেই এক দৌড়ে দাদির রুমে চলে আসে।
দাদি তখন পুরনো এলবাম দেখছিলো। অধরাকে আসতে দেখেই একটা মুচকি হাসি দিয়ে…
— ” আরে চলে এসেছিস? এখানে বসো। ”
— ” কি দেখছো তুমি দাদি বুড়ি? ”
— মুচকি হেসে,, ” তোর দাদার ছবি দেখছিলাম। পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে গেল।
যদিও মানুষটা এখন আর নেই তবুও তার প্রতি ভালোবাসা একবিন্দুও কমে যায়নি। ”
— অধরা ছবি দেখতে দেখতে,, ” দাদি বুড়ি, দাদাভাই তো দেখছি অনেক হ্যান্ডসাম ছিলেন। এই জন্যই তো বলি বুড়িটা কেনো এখনো উনার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। ”
— দাদি হাসতে হাসতে,, ” হয়েছে থাক। আমার আশ্বিনটাও কিন্তু কোন অংশে কম না। শুধু একটু বেশি রাগী। তবে,, মনটা অনেক ভালো।
দেখবি একদিন তুইও আমার নাতিটার প্রেমে হাবুডুবু খাবি। ”
অধরা দাদির কথা শুনে হাসতে শুরু করে। দাদিও অধরার দিকে তাকিয়ে হাসে।
— অধরা হাসি থামিয়ে দাদির দিকে তাকিয়ে,, ” আচ্ছা দাদি? আশ্বিনের মা বাবা কি তোমাদের সাথে থাকেন না? ”
— দাদি হাসি থামিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে,, ” আশ্বিনের মা বাবার ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে। তখন আশ্বিনের বয়স ছিলো মাত্র ছয় বছর।
আশ্বিনের বাবা মানে আমার ছেলে আকাশ চৌধুরী, এখন লন্ডনে থাকে।
আর, অনুরিমা তার দ্বিতীয় স্বামী আর ছেলেকে নিয়ে এখানেই থাকে।
তাদের দুজনের সাথেই আমাদের দীর্ঘদিন কোন যোগাযোগ নেই। ”
— অধরা অবাক হয়ে,, ” কেনো? ”
— ” একটা ছয় বছরের বাচ্চা ছেলের যখন তার বাবা মা ছিলো পৃথিবী,
তখন তারা দুজন আশ্বিনকে একা ফেলে নিজেদের জীবন সাজাতে ব্যস্ত।
বাচ্চা ছেলেটার মা বাবা থাকতেও যেনো নেই। দিনের পর দিন ছেলেটা মায়ের জন্য যখন কান্না করতো, তখন দাদি হয়ে আমি শুধু তাকে সান্ত্বনাই দিতে পেরেছিলাম।
কখনো কারো কাছে ভালোবাসা পায়নি তো তাই আশ্বিন একা একা থাকতে পছন্দ করতো। হয়তো এই কারণেই এমন বদমেজাজি হয়ে গিয়েছে। ”
অধরা এতোক্ষণ দাদির কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো। সবটা শোনার পর আশ্বিনের জন্য খারাপ লাগছে তার।
অধরা গভীর ভাবে বিষয়টা নিয়ে ভাবতে শুরু করে।
—চলবে❤