#আমি_তোমার_গল্প_হবো🍁
লেখিকা- মাহিয়া তাহসীন মেরিন
পর্ব:::১৭
অনুরিমা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে,
— ” সেদিন শাহিন এসে আমাকে জানায় রবিবার সকালে আকাশ বিজনেসের এক কাজে লন্ডনে যাবে। আর এই সুযোগে আমাদের বিয়ে করে ফেলা উচিত। আমিও তখন কোন কিছু না ভেবেই রাজি হয়ে যাই।
আমার বাবা তখন অনেক বার আমাকে এমন ভুল করতে নিষেধ করেছিলো। কিন্তু আমি শুনিনি। আসলে, পারিবারিক ভাবেই আমার সাথে আকাশের বিয়ে হয়, বলতে পারো অনেকটা জোর করেই। কিন্তু বিয়ের পর আকাশের ব্যাবহার, তার সব কেয়ারগুলো আমার মনে ভালোবাসা সৃষ্টি করেছিলো ঠিকই। কিন্তু শাহিনের মিথ্যা ভালোবাসার অভিনয়ের সামনে আমি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। ”
” সব কিছু প্ল্যান মতোই হচ্ছিল হঠাত আকাশ জেনে যায় আমাদের বিয়ের কথা। সে তখনি ফ্লাইট মিস করে আমাদের কাছে চলে আসে। সত্যি বলতে আমি কখনো ভাবিনি আকাশ এভাবে চলে আসবে। তাই তখন আকাশকে দেখে আমি অনেকটাই চমকে গিয়েছিলাম। ”
— অধরা অনুরিমার দিকে তাকিয়ে, ” তারপর? ”
— ” আকাশ এসে আমাকে অনেক অনুরোধ করে কথাই বলে। আশ্বিন জন্য হলেও আমাদের সাজানো সুন্দর সংসারটা এভাবে ভেঙে দিতে না করে।
আকাশ বলেছিলো, একজন স্ত্রীর দায়িত্ব তার স্বামীর কোন বিপদে তার পাশে থেকে তাকে সাপোর্ট করা। এভাবে দায়িত্ব থেকে পালিয়ে নিজের জীবন নিজের মতো করে সাজিয়ে গুছিয়ে নেওয়া না।
সত্যি বলতে, সেদিন আকাশের কথাগুলো আমার মনে দাগ কেটেছিলো। তখন বুঝতে পেরেছিলাম, সত্যিই আমি স্বার্থপরের মতো, নিজের কথা ভেবে কতো বড় ভুল করতে যাচ্ছি।
কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে যায়।
শাহিন আকাশের উপর রেগে যায় আর তাদের মাঝে এই নিয়ে কথা কাটাকাটি শুরু হয়। এক পর্যায়ে আকাশ বলে ওঠে,
” অনুকে নিয়ে যাওয়ার সম্পূর্ণ অধিকার আমার আছে। কারণ আমাদের ডিভোর্স এখনো হয়নি। সেই হিসেবে অনু এখনও আমার স্ত্রী। আমি বেঁচে থাকতে আমার অনুকে কখনোই ছেড়ে যাবো না।
আর, আমার আশ্বিনেরও তার মাকে খুব প্রয়োজন। এই পৃথিবীতে তার কাছে তার মা সবচেয়ে আপন। আমি পারবো না আমার ছেলেকে মা ছাড়া রাখতে।
কাল রাতেও আমি আশ্বিনকে কথা দিয়েছি, বলেছি বাবা যেভাবেই হোক মাকে নিয়ে আসবে। আর আমি আমার দেওয়া কথা রাখবো। ”
সেই মূহুর্তে আমি আকাশের বলা কথাগুলো শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমি কখনো একজন ভালো মা হতে না পারলেও, আকাশ একজন ভালো বাবা হয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলো। আশ্বিন ঠিকই বলতো ড্যাড আমার সুপারম্যান, আর আমি তার সুপারহিরো। ”
অনুরিমা কথাগুলো বলে একটু থামলো। জানালার বাইরে এক নজর তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে,
— ” আকাশ কথাগুলো বলে কোন কিছু না ভেবে আমার কাছে এসে আমার হাত ধরে চলে আসতে নিতেই শাহিন তার সামনে আসে। শাহিন কোনভাবেই আমাকে যেতে দিবে না আর আকাশ আমাকে না নিয়ে যাবে না। আমি সম্পূর্ণ একটা ঘোরের মাঝে ছিলাম। হঠাত শহিন আমাকে জিজ্ঞেস করলো আমি কি চাই? আমি কিছুক্ষণ তাদের দিকে তাকিয়ে অনেক ভেবে বলেছিলাম, আমি আশ্বিনের মা আর আকাশ চৌধুরীর স্ত্রী হয়েই ফিরে যেতে চাই।
আমার উত্তরে আমার বাবা আর আকাশ খুশি হলেও শাহিন খুব রেগে যায়। সে কোন কিছু না ভেবেই একটা গান বের করে আকাশের দিকে তাক করে গুলি করে বসে। পর পর দুটো গুলি, আর সব শেষ। ঘটনাটা এতো জলদি হয়েছিলো যে আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই আকাশ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পুরো ফ্লোর রক্তে ভেসে যাচ্ছিলো, আমি এসব দেখে স্তব্ধ হয়ে যাই। দৌড়ে আকাশের কাছে গিয়ে বাবাকে চিৎকার করে বলেছিলাম এম্বুলেন্স ডাকতে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়, আকাশ…আকাশ আমাদের ছেড়ে চলে যায়। আমি তার নিথর দেহ দেখে নিজেকে সামলে রাখতে পারিনি তাই সেখানেই জ্ঞান হারাই। ”
কথাগুলো বলে চুপ হয়ে যায় অনুরিমা।
— অধরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ” তারপর? আপনি পুলিশকে জানানি কেনো? আর সবটা জানার পরে কিভাবে এখনও শাহিন হাসাদের সাথে থাকছেন আপনি? ”
— ” সব বলবো।
আমার জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে একটা বদ্ধ ঘরে আবিষ্কার করি। আকাশের কথা মনে হলেই যখন আমি বাসা থেকে বের হতে চাই তখন দেখি শাহিনের লোকেরা পুরো বাসা ঘিরে ফেলেছে। যেনো কোন ভাবেই আমি বাসা থেকে বের হতে না পারি।
কিছুক্ষণ পর শাহিন তার ছোট্ট সাহিলকে কোলে নিয়ে আমার কাছে আসে। শাহিনের কাছে জানতে পারি সে দুদিন আগেই আকাশকে দাফন করেছে কিন্তু কোথায় সেটা আমাকে বলেনি। মানে আমার দুদিন পর জ্ঞান ফিরে এসেছিলো। আমি তাকে ভয় দেখিয়ে বলেছিলাম,
” আমি সবাইকে বলে দিবো যে আপনি আমার আকাশকে হত্যা করেছেন। পুলিশকে সব জানিয়ে দিবো আমি। ”
কিন্তু শাহিন আমাকে অবাক করে দিয়ে বলেছিলো, ” তোমার কি মনে হয় আমি তোমাকে সেই সুযোগ দিবো? একবারও কি ভেবে দেখেছো তোমার বাবা এখন কোথায় আছে? ”
সত্যি বলছি অধরা, আমি ভাবতেও পারিনি শাহিন আমার বাবাকে….। ”
কথাগুলো বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ মুছে অনুরিমা। অধরা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে,
— ” আপনার বাবা? আপনি তো বলেছিলেন আপনার বাবা আপনার ভাইয়ের কাছে থাকে। ”
— ” হ্যা বলেছিলাম। আমার কাছে কোন উপায় ছিলো না। এতোগুলো বছরেও আমি জানি না আমার বাবা কোথায় আছে কেমন আছে। শহিনকে লুকিয়ে আমি বাবাকে অনেক খুঁজেছি কিন্তু কোন লাভ হয়নি। আমার একার পক্ষে কোনকিছু করাই সম্ভব ছিলো না, সবাই আমাকে পর করে দিয়েছিলো।
অল্প বয়সের একটা ভুল এতোটা প্রভাব ফেলবে বুঝতে পারিনি।
ভেবেছিলাম আকাশের মা হয়তো আকাশকে নিখোঁজ হওয়ার কথা পুলিশকে জানাবেন। কিন্তু পরে জানতে পারি শাহিন প্ল্যান করে সবকিছু ধামাচাপা দিয়ে দিয়েছে। সবাইকে জানিয়েছে আকাশ লন্ডনে থাকে তার বিজনেস সামলাতে কিন্তু লন্ডনের সবাই জানে আকাশ দেশেই আছে। আমার বাবার কথাও সেই বলেছে। সেদিন আকাশকে গুলি করা, তার কবর এই সবকিছু যারা সাক্ষী হয়ে ছিলো তাদেরকেও সে সরিয়ে দিয়েছে। কোন প্রমাণ নেই শাহিনের বিপক্ষে। আমি চাইলেও কিছু করতে পারিনি। একটা মিথ্যা সম্পর্কের পরিচয়ে আমি সেখানে পরে আছি।
আমি আশ্বিনকে কখনোই বলতে পারিনি তার বাবার কথা। আমি জানি এই কথাগুলো যদি আশ্বিন কোনদিন জানতে পারে সে আমাকে ঘৃণা করবে। আমি এই ভয়ে সব সময় আশ্বিনের থেকে দূরে দূরে থেকেছি। আমি যে নিজের কাছেই অপরাধী। ”
অনুরিমা কথাগুলো বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। অধরা কিছুক্ষণ চুপ থেকে কথাগুলো শুনে। বেশ কিছুক্ষণ পর অনুরিমা শান্ত হয়ে,
— ” আমার এখান যেতে হবে। বেশি দেরি করলে শাহিন আমাকে সন্দেহ করবে।
অধরা, আমি জানি তুমি আশ্বিনকে কথাগুলো বলবে। কিন্তু সাবধান, শাহিন জানতে পারলে অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, এতোগুলো বছর পর মনে আটকে রাখা কথাগুলো তোমাকে কথাগুলো বলে নিজেকে অনেকটা হালকা লাগছে। এখন আমি অনেকটাই নিশ্চিন্ত। ”
অনুরিমা কথাগুলো বলে ধীরে ধীরে চলে যায়। অধরা এখনো সেখানে মাথা নিচু করে বসে আছে। তার এই মুহূর্তে কি করা প্রয়োজন? হঠাত জনি এসে তার পাশে বসে,
— ” ছোট মনি কি হয়েছে? উনি কি কি বলেছেন? ”
— অধরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ” আমরা যা ভেবেছিলাম তাই। অনুরিমা মামুনীকে বাধ্য করা হয়েছে মুখ বন্ধ রাখতে। কারণ শাহিন হাসাদের কাছে উনার বাবা এখনো জিম্মি হয়ে আছেন। ”
— ” এখন কি করবে? পুলিশকে জানালে কেমন হয়? ”
— ” আমার মনে হচ্ছে আগে আশ্বিনকে সবটা বলা উচিত। আমি আজই আশ্বিনকে সব সত্য বলে দিবো। তারপর আশ্বিন যা বলবে তাই হবে। ”
অধরা কথাটা বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে যায়।
🌻বিকেলে🌻
আশ্বিন আজ তারাতারি অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে ল্যাপটপে কাজ করছিলো। হঠাত অধরা তার পাশে এসে বসে পড়ে।
— আশ্বিন ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে, ” কিছু বলবে? ”
— অধরা একটা বড় শ্বাস নিয়ে, ” আশ্বিন আমি আপনাকে একটা সত্যি বলতে চাই। এই সত্যটা আপনার জানা অনেক প্রয়োজন। ”
— আশ্বিন ল্যাপটপ রেখে অধরার দিকে তাকিয়ে, ” কি হয়েছে? বলো আমাকে…। ”
— ” আশ্বিন, আপনার বাবা….। ”
— অধরাকে থামিয়ে দিয়ে, ” উফ অধরা! আবার শুরু করে দিয়েছো? কাল রাতেও না বলেছি উনার কথা আমার কাছে বলবে না। ওই লোকটার নামও শুনতে চাই না আমি। উনাকে নিয়ে কোন কথা বলবে না তুমি, বুঝতে পেরেছো? আমি চাই না….। ”
— অধরা আশ্বিনের কথার মাঝেই চিৎকার করে, ” আপনার বাবা আর নেই আশ্বিন। ”
হঠাত কথাটা শুনে আশ্বিন চুপ হয়ে যায়। তারপর অবাক হয়ে,
— ” নেই মানে? কোথায় আছে? কি উল্টো পাল্টা বলছো তুমি? ”
— অধরা শান্ত কণ্ঠে, ” আশ্বিন, আপনার বাবা আমাদের সবাইকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গিয়েছেন। ”
— আশ্বিন কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান্ত কণ্ঠে, ” কি বললে? ড্যাড ম..মারা গিয়েছে? ক..কবে? কে বলেছে তোমাকে? কই আমার কাছে তো কোন খবর আসেনি। তুমি মজা করছো তাই না অধরা? ”
— ” না আশ্বিন, আমি সত্যি কথাই বলছি। এই যে সকল প্রমাণ। আর এটা…। ”
অধরা তার ফোনের রেকর্ড প্লে করে যেখানে আজকে অনুরিমার বলা সব কথা অধরা রেকর্ড করে রেখেছিলো।
আশ্বিন সবটা শোনার পর স্তব্ধ হয়ে যায়। সে প্রমাণগুলো একবার হাতে নিয়ে দেখে তারপর চুপ করে মাথা নিচু করে বসে থাকে।
— ” আশ্বিন, আমি কথাগুলো আপনাকে কালই বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আপনি…। ”
— আশ্বিন স্তব্ধ হয়ে বসে শান্ত কণ্ঠে, ” অধরা, আমাকে একবার বাবার কাছে নিয়ে যাবে? আমি শুধু ড্যাডের কবরটা একবার দেখতে চাই। প্লিজ, অধরা। ”
আশ্বিনের এমন কষ্ট মেশানো শীতল কণ্ঠে শুনে অধরার বুকের ভেতর কেপে ওঠে। সে চোখের পানি ছেড়ে মাথা নেড়ে আশ্বিনকে হ্যা বোঝায়।
#আমি_তোমার_গল্প_হবো🍁
লেখিকা- মাহিয়া তাহসীন মেরিন
পর্ব:::১৮
🌻পরদিন🌻
অধরা আশ্বিনকে নিয়ে কবরস্থানে আসে। আশ্বিন অধরার দিকে একনজর তাকিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে আকাশের কবরের দিকে এগিয়ে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। অধরা একটু দূর থেকে আশ্বিনকে দেখছে।
— আশ্বিন স্তব্ধ হয়ে শীতল কণ্ঠে,
” ড্যাড…..আমি এসেছি।
তোমার ছোট্ট সুপারহিরো এতগুলো বছর পর তোমাকে দেখতে এসেছে। আমাকে..বুকে জড়িয়ে ধরবে না?
সুপারম্যান কি কখনো এভাবে হেরে যায় ড্যাড?
তুমি কি আর উঠবে না? আমাকে সুপারহিরো বলে ডাকবে না? ”
অধরা আশ্বিনের কথাগুলো শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিরবে চোখের পানি ফেলে।
— ” আই এম সরি, ড্যাড।
আমি এতোগুলো বছর ধরে তোমাকে ভুল ভেবে এসেছি। আমি ভেবেছিলাম তুমি মমের উপর রাগ করে আমাকে একা রেখে চলে গিয়েছো। আমি কতোটা ভুল ছিলাম।
তুমি আমার জন্যই তো আজ….। ”
কথাটা বলেই আশ্বিন কিছুক্ষণ চুপ হয়ে বসে থাকে। তার মনের অজান্তেই চোখ থেকে পানি বের হয়ে আসছে।
— ” ড্যাড, আমার মমকে চাই না। আমি তোমাকে চাই ড্যাড।
তোমার ওই খুনিদের আমার কোন দরকার নেই। মমের জন্য তুমি আজ আমার সাথে নেই।
আমি শিওর তারা প্ল্যান করে তোমাকে কষ্ট দিয়েছে ড্যাড। আমি তাদের ছাড়বো না। যারা তোমার সাথে এমন করেছে তাদের শাস্তি আমি দিবোই।
এমন শাস্তি দিবো যেনো বাকি জীবন তাদের আফসোস করতে হয়। ”
আশ্বিন কথাগুলো বলে থেমে যায়। অধরা দূর থেকে ঠিকই বুঝতে পারছে আশ্বিন কান্না করছে। অধরা ধীর পায়ে আশ্বিনের কাছে এসে তাকে দাঁড় করিয়ে,
— ” আশ্বিন, এভাবে ভেঙে পড়বেন না। আপনি ভেঙে পড়লে দাদিকে কে সামলাবে? প্লিজ শান্ত হোন। ”
আশ্বিন চোখ মুছে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে অধরাকে নিয়ে চলে আসে।
গাড়িতে অধরা আর আশ্বিন পাশাপাশি বসে আছে। কেউ কোন কথা বলছে না। হঠাত নিরবতা কাটিয়ে আশ্বিন বললো,
— ” অধরা, দাদিকে এসব কিছু বলো না। ”
— ” কোনো আশ্বিন? উনার তো জানার অধিকার আছে। ”
— ” কোন প্রয়োজন নেই। দাদি বয়স্ক মানুষ আবার অসুস্থও। আমি জানি, বাবাকে শেষবার দেখার আশায় তিনি এখনও বেঁচে আছেন। যদি সত্যিটা জানতে পারে, দাদি সহ্য করতে পারবে না। ”
— ” কিন্তু আশ্বিন…। ”
— ” অধরা জেদ করো না। পৃথিবীতে আমার আপন মানুষের সংখ্যা একদম কম। আমি কোনভাবেই তাদের হারাতে চাই না। বুঝেছো তুমি? ”
অধরা কিছুক্ষণ চুপ করে আশ্বিনের কথাগুলো শুনে মাথা নেড়ে হ্যা বোঝায়। আশ্বিন একনজর অধরার দিকে তাকিয়ে গাড়ি থেকে নেমে বাসায় চলে আসে।
🌻🌻
আশ্বিন বাসায় প্রবেশ করেই সোজা দাদির রুমে চলে আসে। দাদি তখন খাটের উপর সোজা হয়ে বসে বই পড়ছিলো। আশ্বিন এসে হঠাত দাদির কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে।
— দাদি কিছুটা অবাক হয়ে, ” কি হয়েছে আশ্বিন? মন খারাপ?
কি হয়েছে দাদিকে বল। ”
— ” কিছু হয়নি দাদি। অনেকদিন তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাইনি। তাই…। ”
আশ্বিন কথাটা বলতেই অধরা দাদির রুমে প্রবেশ করে। দাদি অধরার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে,
— ” ছোট্ট বুড়ি, দেখেছিস পাগলটা কি বললো? এখনো ছোটই রয়েই গেলি, ছোট্ট বাচ্চাদের মতো আবদার। ”
অধরা দাদির কথা শুনে মুচকি হাসি দেয়।
— আশ্বিন উঠে বসে, ” দাদি তোমাকে তো বলাই হয়নি। শিউলি দাদি তোমাকে তাদের বাসায় যেতে বলেছে। অনেকদিন নাকি তোমাকে দেখে না। অসুস্থতার জন্য উনি নিজেও আসতে পারছেন না। ”
— দাদি খুশি হয়ে, ” শিউলি ফোন দিয়েছিলো তোকে? তাকে বলো আমি আজই আসবো তাকে দেখতে। এই এখনি রেডি হচ্ছি। ”
— দাদির কথা শুনে আশ্বিন মুচকি হেসে, ” ঠিক আছে। ”
— দাদি অধরার দিকে তাকিয়ে, ” ছোট্ট বুড়ি, তুইও চল আমার সাথে। আমার মামাতো বোনকে দেখে আসবি। ”
অধরা কিছু বলার আগেই আশ্বিন তাকে থামিয়ে দিয়ে,
— ” না দাদি। অধরার সামনে পরীক্ষা তার যাওয়ার দরকার নেই। তুমি ঘুরে এসো। ”
আশ্বিনের কথা শুনে দাদিও আর কথা না বাড়িয়ে রেডি হতে চলে যায়।
অধরা চুপচাপ বসে আছে। সে আন্দাজ করতে পারছে আশ্বিন তার উপর রেগে আছে। তাকে শিক্ষা দিতেই দাদিকে পাঠিয়ে দিচ্ছে। কথাটা ভেবে অধরার আত্মা শুকিয়ে আসছে।
🌻🌻
দাদি চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর অধরা ধীরে ধীরে রুমে প্রবেশ করে। আশ্বিন এতোক্ষণ ল্যাপটপে বসে কাজ করছিলো। অধরা রুমে প্রবেশ করছে তা বুঝতে পেরে,
— ” আমার সামনে এসে বসো। তোমার সাথে আমার কথা আছে। ”
আশ্বিনের কথাটা শুনে অধরা কেপে ওঠে। ধীর পায়ে হেঁটে আশ্বিনের পাশে বসে,
— ” ক…কি কথা আছে? ”
— আশ্বিন ল্যাপটপ রেখে অধরার দিকে তাকিয়ে, ” এইসব কবে থেকে চলছে অধরা? ”
— ” বুঝলাম না, কোনসব? ”
— ” আমার চোখ ফাঁকি দিয়ে যে এতো সব তথ্য খুঁজে বেড়াচ্ছো, আমাকে একবার বলার প্রয়োজন মনে করেছো? ”
— অধরা মাথা নিচু করে, ” আপনাকে জিজ্ঞেস করলে তো রেগে যাবেন। আর তাছাড়া..। ”
— চিৎকার করে, ” তাই বলে নিজ থেকে এসব খুঁজে বেড়াচ্ছো। আর তোমার একার পক্ষে তো এসব খুঁজে বের করা সম্ভব না। কে সাহায্য করেছে তোমাকে? ”
— অধরা কাঁপা কণ্ঠে, ” জ…জনি ভাইয়া। ”
— ” কোন জনি? অর্ণবের বিজনেস স্পাই জনি? ”
অধরা মাথা নেড়ে হ্যা বোঝায়। আশ্বিন রেগে উঠে দাঁড়িয়ে,
— ” মানে অর্ণবও এসব কিছু জানে অথচ আমাকে কিছুই বলেনি। ”
— ” ভাইয়া আগে জানতো না। সেদিন আমাকে জোর করায় আমি বলেছি। ভাইয়ার কোন দোষ নেই।
আর আমি তো আপনার ভালোর জন্যই এমন করেছি। আপনি রেগে যাচ্ছেন কেনো? ”
— ” ভালোর জন্য করেছো? অধরা তুমি এখনো এতোটাও বড় হয়ে যাওনি যে বিপদের সাথে যুদ্ধ করে এসব খুঁজে বেড়াবে।
ঠিক আছে মানছি তুমি সব সত্যিটা বের করেছো। তারপর আমাকে বললে না কেনো? ওই অনুরিমার কাছে যাওয়ার কি দরকার ছিল? ”
— ” উনার কাছে না গেলে তো সত্যিটা জানতে পারতাম না। উনিই তো এখন সব স্বীকার করছেন। ”
— আশ্বিন রেগে, ” কিছুই স্বীকার করেনি অধরা। তুমি ধারণাও করতে পারবে না অনুরিমা তার নিজ স্বার্থে কোন পর্যায়ে যেতে পারে। সে তোমাকে যা যা বলেছে সব মিথ্যা। ”
— ” কিন্তু উনি মিথ্যা কেনো বলবে আশ্বিন? ”
— ” কারণ তখন তোমার কাছে উনার বিপক্ষে প্রমাণ ছিলো। তাই তিনি বুদ্ধি করে এসব কথা বলেছে যেনো তুমি ইমোশনাল হয়ে প্রতিশোধ নেওয়া থেকে দমে যাও।
অধরা, তুমি ভুল করে ফেলেছো। আমাদের শত্রুদের তুমি জানিয়ে দিয়েছো যে তাদের বিপক্ষে আমাদের প্রমাণ আছে। ”
— অধরা অবাক হয়ে, ” আশ্বিন, হতেও তো পারে তিনি সত্য বলছেন। আপনি এমন করেও তো ভাবতে পারেন।”
— আশ্বিন কিছুক্ষণ চুপ থেকে,
” ঠিক আছে। আমি আমার লোকদের সত্যটা জানতে পাঠিয়ে দিবো। আর নানাভাইকেও খুঁজে বের করবো।
কিন্তু, উনার কথাটা যদি মিথ্যে হয় অধরা, তাহলে জেনে রাখো অনেক বড় বিপদ আসতে চলেছে। ”
অধরা কথাটা শুনে চিন্তায় পড়ে যায়। সত্যিই হয়তো আশ্বিনকে না জানিয়ে এমন করা তার ঠিক হয়নি।
আশ্বিন ফোন হাতে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। অধরা তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।
— ” হ্যালো অর্ণব, এখনি দেখা কর। ”
— ” কি হয়েছে আশ্বিন? সব ঠিক আছে তো? অধরা ঠিক আছে? ”
— ” আগে দেখা কর। তারপর সব বলছি। জলদি আমার অফিসে চলে আয়। ”
— ” ঠিক আছে আমি আসছি। ”
আশ্বিন ফোন রেখে দ্রুত অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়। গাড়িতে বসে ফোন নিয়ে,
— ” হ্যালো ফাহাদ, এখনি বাসায় কিছু গার্ড পাঠিয়ে দাও। অধরার সেফটি অনেক দরকার। আর কয়েকজনকে শিউলি দাদির বাসার সামনে গোপনে গার্ড দিতে বলো, দাদি আছে সেখানে। ”
— ” ওকে স্যার। ”
আশ্বিন ফোন রেখে রাগী কণ্ঠে,
” মিসেস অনুরিমা হাসাদ। অধরাকে অবুঝ পেয়ে আপনি তাকে যা তা বললেও আমি আপনার সত্য জানি। আপনি কতোটা নিচ নামতে পারেন আমি জানি।
অনেক আমার জীবন নিয়ে খেলেছেন। এখন সময় এসেছে প্রতিশোধ নেওয়ার। ”
—চলবে❤
—চলবে❤