আমি পদ্মজা – ৭৫
___________
পদ্মজার মৃদু আর্তনাদ শুনে আমিরের রক্ত ছলকে উঠে। সে দ্রুত তার শার্টের বুক পকেট থেকে লাইটার বের করে,আগুন জ্বালাল। হলুদ আলোয় পদ্মজার মুখখানা ভেসে উঠে। মাথা দুই হাতে ধরে রেখেছে। ভ্রুযুগল কুঁচকানো। আমির অস্পষ্ট কণ্ঠে উচ্চারণ করলো,’পদ্মজা!’
সে পদ্মজাকে ছোঁয়ার জন্য হাত বাড়ায়। তখন পদ্মজা বললো,’দূরে সরুন।’
পদ্মজার কণ্ঠে একটু তেজের আঁচ টের পাওয়া যায়। আমির কথা বাড়ালো না। সোজা লতিফার ঘরের দিকে গেল। লতিফা,রিনুকে ডেকে নিয়ে আসে। রিনুর হাতে হারিকেন। লতিফা,রিনু পদ্মজাকে উঠতে সাহায্য করে। পদ্মজার মাথা ফুলে গেছে। ভনভন করছে। পদ্মজা লতিফাকে ধরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার চেষ্টা করে। শেষ ধাপে গিয়ে একবার পিছনে ফিরে তাকাল। হারিকেনের হলুদ আলোয় আমিরের জীর্ণশীর্ণ মুখটা দেখে পদ্মজার বুকটা হাহাকার করে উঠে। কোথায় ছুড়ির আঘাত পেয়েছে কে জানে! পদ্মজা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। আমির রিনুকে বললো,’উপরে যা। লতিফা বুবুকে সাহায্য করিস।’
রিনু নতজানু হয়ে ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো,’তোমার ঘাড় দিয়া রক্ত আইতাছে ভাই।’
আমির হাসলো। সিঁড়ি ভেঙে নামার সময় পা ফসকে যায়। আমির কুঁজো হতেই পদ্মজার আক্রমণ! এক জায়গায় বার বার আঘাত পেতে হচ্ছে! আমির রিনুকে বললো,’ঘাড়টা পঁচে যাওয়া বাকি! যা,উপরে যা।’
আমির অন্দরমহলের বাইরে পা রেখে ঠান্ডা বাতাসে কেঁপে উঠে। শীতের প্রকোপ তীব্র! মাথায়,ঘাড়ে তীব্র ব্যাথা। ঠান্ডা বাতাসে আরো ভয়াবহ যন্ত্রনা হচ্ছে! সবকিছু ছাপিয়ে হৃদয়ের ব্যথাটা দ্বিগুণ আকারে বেড়ে চলেছে। পদ্মজার ঘৃণাভরা দৃষ্টি আমির আর নিতে পারছে না। প্রথম দিকের মতো শান্ত থাকা যাচ্ছে না। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সে পঙ্গু হওয়ার পথে। শরীরের রক্ত আর হৃদয়ের যুদ্ধ আমিরের শ্বাস-প্রশ্বাসে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে।
নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। আমির নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করে। দুই হাতে চুল ঠিক করে অন্দরমহলের পিছন দিকে হেঁটে আসে। তিন-চারটে কুকুর দেখতে পেল। ভাঙা প্রাচীর দিয়ে হয়তো প্রবেশ করেছে। আমির কুকুরগুলোর দিকে এক ধ্যাণে তাকিয়ে থাকে। কুকুরগুলোও তাদের হিংস্র চোখ দিয়ে আমিরকে দেখছে। আমির দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
রাতের নিস্তব্ধতায় সেই দীর্ঘশ্বাসের শব্দ দুরন্ত বাতাস ভাসিয়ে নিয়ে গেল অনেকদূর পর্যন্ত। বেওয়ারিশ কুকুরগুলো সেই শব্দ শুনে চমকে উঠল।
নড়েচড়ে দূরে সরে গেল। আমির হেসে তাদের বললো,’ বুকের যন্ত্রনার এক অংশও দীর্ঘশ্বাসের সাথে বের হয়নি! আর এতেই ভয় পেয়ে গেলি তোরা?’
একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠলো। আমির এগিয়ে যেতেই কুকুরগুলো ছুটে পালায়। আমির অপলক চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। অকারণেই হাসলো। তারপর গভীর জঙ্গল পেরিয়ে পাতালঘরে প্রবেশ করে। রাফেদ আমিরকে দেখে আঁতকে উঠলো। বললো,’স্যার,কীভাবে হলো এসব?’
আমির চেয়ার টেনে বসে বললো,’দ্রুত পরিষ্কার করো।’
রাফেদ আমিরকে পরিষ্কার করে দিলো। আমির শার্ট পাল্টে পাঞ্জাবি পরলো। তার আর কোনো কাপড় এখানে নেই। সব অন্দরমহলে নিয়ে গিয়েছিল। সাদা পাঞ্জাবি রয়ে গেছে। পাঞ্জাবিটা পরতে গিয়ে মনে পড়ে পদ্মজার কথা। পদ্মজার সাদা রঙ পছন্দ। প্রতি শুক্রবারে আমির সাদা পাঞ্জাবি পরে জুম্মায় যেতো। জুম্মায় যাওয়ার পূর্বে পদ্মজা খুব যত্ন করে পাঞ্জাবির তিনটে বোতাম লাগিয়ে দিতো। লাগানো শেষে বলতো,’ আমার সুদর্শন স্বামী।’
পদ্মজা যতবার এ কথা বলতো,ততবার আমির প্রাণখুলে হেসেছে। সে জানে না পদ্মজার চোখে সে কতোটা সুন্দর! কিন্তু পদ্মজার দৃষ্টি ছিল মুগ্ধকর! মুগ্ধ হয়ে সে আমিরকে দেখতো। আমির পাঞ্জাবির বোতামে চুমু দেয়। তখনই কানে বেজে উঠে, “ছুঁবেন না আমায়!,দূরে সরুন!,আমি আপনাকে ঘৃণা করি!’
কথাগুলো তীরের মতো আঘাত হানে মস্তিষ্কে! আমির নিজের চুল খামচে ধরে। রাগে চিৎকার করতে করতে এওয়ানের পালঙ্কে লাথি দিতে থাকে। পালঙ্ক ভেঙে যায়। রাফেদ দৌড়ে আসে। কিন্তু আমিরকে ধরার সাহস হয় না। আমিরকে আর যে যাই ভাবুক! রাফেদ জানে,আমির পাগল। একটা সাইকো সে। যখন রেগে যায় সবকিছু তছনছ করে ফেলে। আমিরের এই রাগের স্বীকার যে মেয়ে হয়েছে,সে মেয়ে নিঃশ্বাসে,নিঃশ্বাসে নিজের মৃত্যু কামনা করেছে।
রাফেদ দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। সে মনে মনে,এই হিংস্র মানুষটার মৃত্যু কামনা করে। কত মেয়ে আমিরকে বাবা,ভাই ডেকেছে ছেড়ে দেয়ার জন্য। আমির ছাড়েনি। মুখের উপর লাথি দিয়ে ছুঁড়ে ফেলেছে মেঝেতে। রাফেদ বাধ্য হয়ে এই জগতে প্রবেশ করেছে। অর্থের অভাবে! ভাবেনি,এতোটা পাশবিক, নির্মম এরা! কিন্তু আর বের হওয়ার উপায় ছিল না। বের হতে চাইলেই,মৃত্যু অনিবার্য। তাই সে এই নৃশংসতার সাথে তাল মিলিয়েছে। পরিবারের দুর্দশা তাকে জ্ঞানহীন করে দিয়েছিল। এক কথায় গ্রহণ করে নিয়েছিল এই পথ! যখন একেকটা মেয়ের কান্না সে শুনে, মনে হয় তার বোন কাঁদছে,আকুতি করছে! প্রথম প্রথম সেও কান্না করতো। এখন মানিয়ে নিয়েছে। কিন্তু মনের কোণে মুক্তির আশা এখনো আছে। তলোয়ারের আঘাতের চেয়েও ধারালো কাছের মানুষের দেয়া আঘাত! যেদিন রাফেদ বুঝতে পেরেছে আমিরের দূর্বলতা পদ্মজা,সেদিন থেকে সে দোয়া করছে, আমির যেন এই দূর্বলতার ভার সহ্য করতে না পেরে দূর্বল হয়ে পড়ে। হাঁটুগেড়ে পড়ে যায় মাটিতে। নিঃস্ব হয়ে যেন দিকদিশা হারিয়ে ফেলে। আমিরের ছটফটানি, অস্থিরতা রাফেদের মনে আনন্দের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে। আমির শান্ত হয়! রাফেদকে বললো,’পানি আনো।’
রাফেদ পানি নিয়ে আসে। আমির পানি পান করে ধ রক্তে এসে প্রবেশ করে। বিথ্রিতে আমির পা রাখতেই মেয়েগুলোর চোখেমুখে স্পষ্ট ভয় জমে। রাফেদ চেয়ার নিয়ে আসে। আমির চেয়ারে বসলো না। মেয়েগুলোকে দেখে বেরিয়ে আসলো। বিওয়ানে গেল। সেখানে একটা মেয়েও নেই! শুকনো রক্ত পড়ে আছে। সবকয়টি মেয়ে কুরবান হয়ে গেছে। নদীর স্রোতে ভেসে গেছে। এই ঘরের দেয়ালে দেয়ালে শত শত মেয়ের আর্তনাদ বাজে। আমির পুরো ঘরটা ঘুরে ঘুরে দেখলো। বিশ বছর আগে সে এই পাতালঘরে প্রথমবার এসেছিল। তখন তার বয়স পনেরো। তার বয়সী একটা মেয়েকে সে প্রথম আঘাত করেছিল এই ঘরেই! মেয়েটা আমিরের পায়ে ধরে মুক্তি ভিক্ষা চায়। আমির মুখের উপর লাথি মারে। সঙ্গে,সঙ্গে মেয়েটার নাক,মুখ ফেটে রক্ত বেরিয়ে আসে। মনে পড়তেই আমিরের শরীরটা কেমন করে উঠে। তার ভেতরে অদৃশ্য কী যেন প্রবেশ করছে! ভেতরটা খুঁড়ে, খুঁড়ে খেয়ে নিঃস্ব করে দিচ্ছে। এক কোণে সুন্দর নকশায় তৈরি করা,সিংহাসনের মতো চেয়ার রয়েছে। আমির সেখানে বসলো। এই চেয়ারে বসে কত নগ্ন মেয়ের, তীব্র যন্ত্রনার আর্তনাদ সে উপভোগ করেছে! আমির এক হাতে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বুজে। চোখের পর্দায় পদ্মজার রাজত্ব! তাদের ঢাকার বাড়িতে কোনো এক বর্ষায়,পদ্মজা তার শাড়ি দুই হাতে গোড়ালির উপর তুলে দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নামছে। পিছনে ধাওয়া করেছে,আমির। পদ্মজার কলকল হাসিতে যেন পুরো বাড়ি নৃত্য করছিল। বাইরে ঝমঝম বৃষ্টি! কী অপূর্ব সেই মুহূর্ত। আমির চোখ খুলে ছাদের দিকে তাকায়। তারপর রাফেদকে ডাকলো,’রাফেদ?’
রাফেদ দৌড়ে আসে। আমির রাফেদকে মিনিট তিনেক সময় নিয়ে দেখলো। তার চোখের দৃষ্টি শীতল। রাফেদের বুক দুরুদুরু করছে। আমির বললো,’কেমন আছো?’
রাফেদ চমকে যায়। সে হতভম্ব। বেশ খানিক সময় নিয়ে উত্তর দিল,’ ভালো স্যার।’
‘তোমার বোনের ছেলে হয়েছিল নাকি মেয়ে?’
রাফেদের মনে হচ্ছে,তার কলিজা এখুনি ফেটে যাবে। তার চোখ দুটি মারবেলের মতো গোল,গোল হয়ে যায়। সে কণ্ঠে বিস্ময়তা নিয়ে বললো,’ছেলে-মেয়ে দুটোই।’
‘জমজ?’
‘জি,স্যার।’
‘তুমি মুক্তি চাও?’
রাফেদ বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে। আমির বললো,’ যদি চাও,তাহলে আজ থেকে তুমি মুক্ত।’
রাফেদের মাথায় যেন আসমান ভেঙে পড়ে। সে ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লো। অস্থির হয়ে পড়ে। তার অনুভূতি এলোমেলো হয়ে যায়। সে আমিরের দুই পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিল। বললো,’স্যার,স্যার আমি মারা যাচ্ছি।’
আমির আদেশের স্বরে বললো,’পা ছাড়ো রাফেদ। ত্রিশ মিনিটের মধ্যে জায়গা না ছাড়লে,আর যেতে পারবে না।’
রাফেদ ঝরঝর করে কাঁদতে থাকল। যেন পাহাড় ভেঙে ঝর্ণার পানি ঝরছে। আমির বললো,’উঠো তারপর দৌড়াও।’
রাফেদ দ্রুত উঠে দাঁড়ালো। সে তার ব্যাগ গুছিয়ে দ্রুত এই অন্ধকার ছেড়ে হারিয়ে যায়, আলোর সন্ধানে। আমিরের বুকটা খাঁখাঁ করছে। রাফেদের চোখেমুখে মুক্তির যেই আনন্দ সে দেখেছে,সেই আনন্দের তৃষ্ণায় তার কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছে। কবে এই তৃষ্ণা মিটবে? কবে?
আমিরের বুকে জ্বালাপোড়া শুরু হয়,মনে হচ্ছে কোনো ঘূর্ণিঝড় ধেয়ে আসছে। যে ঘূর্ণিঝড় চোখের পলকে সব লণ্ডভণ্ড করে,স্তব্ধ করে দিবে।
________
লতিফা,রিনু চলে যেতেই পদ্মজা বিছানা ছেড়ে টেবিলে বসলো। হাতে তুলে নিলো কলম-
প্রিয়তম,
আমার প্রতিটি রজনী যেন বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। আমি আপনাকে ভুলে যেতে চাই। কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না! বিছানার চাদরে আপনার শরীরের ঘ্রাণ। শরীরের প্রতিটি লোমকূপ বার বার জানান দেয়,তারা আপনাকে ভালোবাসে। আমার অস্তিত্বের পুরোটা জুড়ে আপনার বিচরণ। বুকের ভেতরটা দগ্ধ হয়ে খানখান। আপনার উন্মুক্ত বুকের সাথে চেপে ধরে বলেছিলেন, আপনার তেঁতো জীবনের মিষ্টি আমি। আপনার মুখে ছিল
হাজার,হাজার শুকরিয়া।অথচ,এই সময়ে এসে আপনি আপনার তেঁতো জীবনটা বেছে নিয়েছেন। ছুঁড়ে ফেলেছেন আমাকে! এ কোন গভীর সমুদ্রের অতলে আমাকে ছুঁড়ে দিলেন? আপনার পাপের শাস্তি কেন আমি পাচ্ছি? আবেগ-বিবেকের যুদ্ধে আমি বার বার আহত হয়ে পিছিয়ে যাচ্ছি। নিজের সবটুকু আপনার নামে দলিল করে দিয়ে,আমি ভুল করেছি। এখনো আপনার শরীরের একেকটা আঘাত আমাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়। কিন্তু আমি আপনাকে আঘাত করতে চাই। আমার ভেতরের জ্বলন্ত আগুন নেভাতে, আপনার এবং আপনার দলের প্রতিটি নরপশুর রক্তের ভীষণ প্রয়োজন!
——
এতটুকু লিখে পদ্মজা থামলো। তার দুই চোখ বেয়ে জল পড়ছে। আর লেখার শক্তি পাচ্ছে না। ডায়রির পৃষ্ঠাটি ছিঁড়ে, দিয়াশলাইয়ের আগুনে জ্বালিয়ে দিলো। আলমারি খুলে আমিরের দেয়া তলোয়ারটি হাতে নিল। তলোয়ারের দিকে দৃষ্টি রেখে বললো,’আপনার বুকের হৃদয়ে আমি আজীবন রানি হয়ে থাকতে চেয়েছিলাম। সেই বুকে আমি কী করে আঘাত করব?’
শেষ কথাটি বলার সময় পদ্মজার দুই চোখ বেয়ে নোনাজল নামে। সে তলোয়ার মেঝেতে রেখে,বিছানায় আছড়ে পড়ে কাঁদতে থাকলো। আমির যে পাশে সবসময় শুতো,সে জায়গাটা জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে। কিন্তু হায়! কোথায় মানুষটার উষ্ণ বুক? যে বুকে মুখ গুঁজে পদ্মজা তার সব কষ্ট ভুলে যেত!
আমি পদ্মজা – ৭৬
__________
রবিবার। তীব্র শীতের সকাল। সময় তখন আটটা। বাড়িজুড়ে সবার ছোটাছুটি। পদ্মজা বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাইরের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করছে। সে পাতালঘরের চাবি খুঁজছে। হাতে সময় নেই। আজ রাতের মধ্যে জীবন বাজি রেখে হলেও কিছু করতে হবে। আলগ ঘরের সামনে খলিল দাঁড়িয়ে রয়েছেন। মাথায় উলের টুপি। লম্বা গোঁফ। মগাকে ধমকে কাজ বুঝাচ্ছেন। চারিদিকে উৎসব উৎসব আমেজ! দুপুরের নামাযের পর স্কুলের মাঠে সমাবেশ। আলগ ঘরে এবং বাইরে শত-শত কম্বল আর শীতবস্ত্র। হাওলাদাররা হারাম টাকায় লোক দেখানো নাটক করতে চলেছে! পদ্মজা মনে মনে ব্যঙ্গ করে হাসলো। রিদওয়ান অন্দরমহল থেকে বের হয়ে খলিলের পাশে এসে দাঁড়াল। তার পরনে কালো রঙের পাঞ্জাবি। গায়ের রঙ ফর্সা। তাই কালো রঙের পাঞ্জাবিতে সুদর্শন দেখাচ্ছে। পদ্মজা লতিফার কাছে শুনেছে,কয়দিনের মধ্যে নাকি রিদওয়ানের বিয়ে! কার সাথে বিয়ে কেউ জানে না। তবে এটা নিশ্চিত, কোনো অভাগীর জীবন দুর্বিষহ হতে চলেছে! রিদওয়ান, খলিল কী বিষয়ে কথা বলছে তা পদ্মজার কানে আসার কথা নয়। তবুও সে সেদিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর সেখানে উপস্থিত হয় আমির। আমির এদিক-ওদিক দেখে খলিলকে বললো,’আমি বেরিয়ে যাচ্ছি। ফিরতে আগামীকাল ভোর হয়ে যাবে। আবারো বলে যাচ্ছি, পদ্মজার গায়ে হাত তো দূরে থাক,কারো চোখও যেন না পড়ে।’
রিদওয়ান নির্বিকার কণ্ঠে বললো,’তোর দুই চামচারে বলে যা,পদ্মজার উপর ভালো করে খেয়াল রাখতে। পাতালে তো কোনো মেয়ে নাই। তাই চিন্তাও নাই। তবে,কাউকে যেন কিছু না বলে। আর আমাদের উপর তেড়ে না আসে।’
‘তেড়ে আসলেও কিছু বলবি না। সুন্দর করে সামলাবি।’
রিদওয়ান তীব্র বিরক্তি নিয়ে বললো,’ধুর! এই মাইয়ারে কতদিন এভাবে রাখবি? হুদাই ভেজাল।’
আমির রেগে রিদওয়ানের দিকে এক পা বাড়ালো। খলিল পরিস্থিতি পাল্টাতে দ্রুত রিদওয়ানের বুকে ধাক্কা দিয়ে বললো,’যা কইতাছে হুন। বাবু তুই যা,তোর বউরে কেউ কিচ্ছু করব না।’
আমির রিদওয়ানের চোখের দিকে তাকালো। চোখের দৃষ্টি দিয়ে সে রিদওয়ানকে সাবধান করে দিল। তারপর জায়গা ছাড়ল। অন্দরমহলে ঢোকার পূর্বে চোখ পড়ে দ্বিতীয় তলার বারান্দায়। পাংশুটে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে পদ্মজা। এক মুহূর্তের জন্য হলেও ভেতরের অনুভূতিগুলো পাল্টে যায়। সে দৃষ্টি সরিয়ে দ্রুত অন্দরমহলে প্রবেশ করলো। পদ্মজা ঠায় সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। আমির ঘরে এসে শার্ট,জ্যাকেট খুলে গোসলখানায় ঢুকে। তাকে ঢাকা যেতে হবে। হাতে সময় আছে, তবুও সে আজই মেয়েগুলোকে সরিয়ে দিচ্ছে। সে নিশ্চিত, পদ্মজা চেষ্টা করবে মেয়েগুলোকে বাঁচাতে। আবার মুখোমুখি হতে হবে দুজনকে। একত্রিশটা মেয়ে যোগাড় হয়ে গেছে যখন আর রাখার মানে নেই। সে ঝুঁকি নিতে চায় না। পদ্মজা কী মনে করে দ্রুতপায়ে ঘরে আসলো। বিছানায় আমিরের শার্ট দেখে বুঝতে পারে আমির গোসলখানায় আছে। তাৎক্ষণিক পদ্মজা ভাবলো,আমিরের শার্টের পকেটে তল্লাশি চালাবে। যদি চাবি পাওয়া যায়! যেমন ভাবা তেমন কাজ।
চাবির কথা মনে পড়তেই আমির গোসলখানার দরজা খুললো। পদ্মজা শার্টের পকেটে একটা চাবি খুঁজে পায়। তার মুখে আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে। পুরোটা দৃশ্য আমিরের চোখে পড়ে। সে দরজা বন্ধ করে দেয়। পদ্মজার হাত থেকে চাবি ছিনিয়ে নেয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই তার। এই চাবি আর পদ্মজার কাজে লাগবে না! সে পাতালঘরে গিয়ে কিছু খুঁজে পাবে না। আমির নিশ্চিন্তে গোসল শেষ করলো। পদ্মজা চাবি নিয়ে রান্নাঘরে চলে আসে। সেখানে লতিফা, রিনু,আমিনা সহ আরো তিন-চারজন রান্না করছে। সমাবেশ শেষে আলগ ঘরে ভোজ আয়োজন হবে,তারই প্রস্তুতি চলছে। খলিল হাওলাদারের দুই মেয়ে শাহানা,শিরিনও আজ আসবে। পদ্মজা কাজ করার বাহানায় লতিফার কাছে গিয়ে বসলো। লতিফা পদ্মজাকে দেখে হাসলো তারপর কাজে মন দিল। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর পদ্মজা সুযোগ বুঝে লতিফাকে ফিসফিসিয়ে বললো,’উনি বেরিয়ে গেলে আমাকে বের হতে সাহায্য করো বুবু।’
লতিফা চোখ বড় বড় করে তাকায়। চাপাস্বরে প্রশ্ন করে,’কই যাইবা?’
পদ্মজা পিছনে ফিরে তাকায়। আমিনা থালাবাসন পরিষ্কার করছেন। পদ্মজা আমিনার দিকে তাকিয়ে হাসলো। তারপর লতিফাকে বললো,’ পাতালে যাবো।’
লতিফার হাত থেকে চামচ পড়ে যায়। ঝনঝন শব্দ হয়। শব্দ শুনে উপস্থিত সবাই উৎসুক হয়ে তাকায়। লতিফা দ্রুত চামচ তুলে নিলো। সবার দিকে চেয়ে হাসি বিনিময় করে পদ্মজাকে চাপাস্বরে বললো,’ চাবি কই পাইবা?’
পদ্মজা বললো,’পেয়ে গেছি। তুমি শুধু সুযোগ করে দাও।’
লতিফার চোখেমুখে ভয় বাসা বাঁধে,যা স্পষ্ট। সে ভয় পাচ্ছে,আমির জেনে গেলে তার জীবন শেষ! পদ্মজা সবাইকে আরো একবার এক নজর দেখে নিয়ে লতিফাকে বললো,’ভালো কাজের জন্য জীবন উৎসর্গ করা সম্মানের বুবু।’
লতিফা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলো। সে রাজি। পদ্মজা তার ঘরে ফিরে আসে। সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় আমির নিচে নামছিল। দুজন কেউ কারোর দিকে তাকায়নি। যেন কেউ কাউকে চিনে না। পদ্মজা ঘরে প্রবেশ করে দ্রুত দরজা বন্ধ করে দেয়। তারপর হাতে তুলে নিল ছুরি।
লতিফা আলগ ঘরে গিয়ে খোঁজ নেয়। আমির,মজিদ,রিদওয়ান কেউ বাড়িতে নেই। খলিল আলগ ঘরের বারান্দায় তিন জন লোকের সাথে কোনো বিষয়ে আলোচনা করছে।লতিফা দ্রুত এসে পদ্মজাকে পরিস্থিতি জানায়। পরিস্থিতি গুছানো। এবার পদ্মজার পিছনে আঠার মতো লেগে থাকা দুজন লোককে সরানোর পালা। পদ্মজা আবার রান্নাঘরে আসে। দুজন লোক সদর ঘরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাদের উপস্থিতি দেখে কেউ ভাববে না, এরা কাউকে নজরে রাখার জন্য পিছু,পিছু ঘুরে! পদ্মজা লতিফাকে ইশারা করতেই,লতিফা দুজন লোককে উদ্দেশ্য করে বললো,’আপনেরা খাইবেন না?’
তারা সত্যি অনেক ক্ষুধার্ত। আবার রান্নাঘর থেকে মাংসের ঘ্রাণ আসছে। সেই ঘ্রাণে ক্ষিধে যেন বেড়ে যাচ্ছে। দুজন সম্মতি জানায়,তারা খাবে। লতিফা চোখের ইশারায় পদ্মজাকে বেরিয়ে যেতে বলে। তারপর দুজন লোককে খেতে দিল। দুজন ক্ষুধার্ত পাহারাদার কব্জি ডুবিয়ে খেতে থাকে। পদ্মজা তাদের অগোচরে বেরিয়ে পড়ে। বাইরের চারপাশ দেখে দ্রুত জঙ্গলে ছুটে আসে। জঙ্গলের পথ তার চেনা। তাই পাতালঘরের কাছে আসতে বেশি সময় লাগেনি। আল্লাহর নাম নিয়ে সে পাতালে প্রবেশ করে। তার হাতের চাবি প্রবেশদ্বার খুলতে সক্ষম হয়।
পদ্মজা এক হাতে শক্ত করে ধরে ছুরি। ধ-রক্ত ও স্বাগতম দরজার মাঝ বরাবর এসে সে থমকে যায়। কেউ নেই! সবকিছু চুপচাপ,নির্জন। সে এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, তার পাশের দেয়ালে চাবুক ছিল। তাও নেই! পদ্মজা থম মেরে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। মেয়েগুলো আছে তো? প্রশ্নটা মাথায় আসতেই, পদ্মজার বুকে ধড়াস করে কিছু যেন পড়ে। সে দৌড়ে ধ-রক্তে প্রবেশ করলো। উন্মাদের মতো প্রতিটি ঘর দেখলো। কেউ নেই! তার শরীর বেয়ে ঘাম ছুটে। ধ-রক্তের কোথাও কোনো চাবুক,ছুরি,রাম দা,কুড়াল কিছু নেই! এখানে যে অনাচার-ব্যভিচার হতো তার কোনো প্রমাণই নেই। পদ্মজা স্বাগতম দরজা পেরিয়ে সবকটি ঘরে তন্নতন্ন করে অসহায় মেয়েগুলোকে খুঁজে। কিন্তু কোথাও কেউ নেই। যখন নিশ্চিত হলো,এখানে কেউ নেই,তার হাত থেকে ছুরি পড়ে যায়। দুই হাতে মাথা চেপে ধরে ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ে। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে। আমির তার চোখে ধুলো দিয়ে প্রতিটি মেয়েকে সরিয়ে দিয়েছে। পদ্মজার তীব্র যন্ত্রণা হতে থাকে। সে মেয়েগুলোকে বাঁচাতে পারেনি। আফসোস আর আত্মগ্লানি তাকে চেপে ধরে। মেয়েগুলোর ছটফটানি,বাঁচার অনুরোধ কানে বাজতে থাকে। দাঁতে দাঁত চেপে বসে থাকে পদ্মজা। তার মনে হচ্ছে,তার মাথায় অনেক ভারি একটা বোঝা। নিজের প্রতি খুব রাগ হয়। সে কাঁদতে থাকলো। শাড়ি খামচে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো,’আমি পারিনি! আমি এই ব্যর্থতা কোথায় লুকাবো আল্লাহ!’
পদ্মজার কান্না দেয়ালে দেয়ালে বারি খেয়ে পুরো পাতালপুরীতে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।
সমাবেশে বাড়ির মেয়ে-বউদের যাওয়া আবশ্যক। এটা হাওলাদার বংশের আরেক রীতি। পরিবারের সবাই সেখানে উপস্থিত থাকবে। শাহানা,শিরিন তৈরি। তারা নিচ তলায় অপেক্ষা করছে। পদ্মজা তার ঘরে স্তব্ধ হয়ে পালঙ্কে বসে আছে। লতিফা হন্তদন্ত হয়ে ঘরে প্রবেশ করলো। বললো,’ও পদ্ম,বোরকা পিন্দো নাই ক্যান? জলদি করো।’
পদ্মজা লতিফার দিকে তাকালো। তার চোখের চারপাশ লাল। চোখে ফোলা ফোলা ভাব। সে আত্মগ্লানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। বার বার মনে হচ্ছে, সে চাইলে পারতো মেয়েগুলোকে বাঁচাতে। সুযোগ ছিল। সত্যিকার অর্থে, তার সুযোগ ছিল না। পেছনের প্রতিটি নিঃশ্বাস সাক্ষী,সে প্রতি মুহূর্তে মেয়েগুলোর কথা ভেবেছে। আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। হন্ন হয়ে চাবি খুঁজেছে। ভেবেছিল,আরো দুই-তিন হাতে আছে। আমির এতো দ্রুত একত্রিশটা মেয়ে অপহরণ করে ঢাকা নিয়ে চলে যাবে সে ভাবেনি! ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি। ভাবলেও কাজ হতো না! কিন্তু এসব কিছুই পদ্মজার মাথায় আসছে না। সে সমানতালে নিজেকে দোষী ভেবে যাচ্ছে। মানসিক যন্ত্রনায় হারিয়ে যাচ্ছে অন্য জগতে। রিদওয়ান ঘরে এসে উঁচু গলায় বললো,’কি হলো? পদ্মজা এখনো তৈরি হয়নি কেন? আমাদের তো বের হতে হবে।’
পদ্মজার আচমকা মনে হলো,আমির মেয়েগুলোকে আজ রাতটা গোডাউনে অথবা অফিসে রাখতে পারে। আর নয়তো বাসায়। এর মধ্যে যদি কিছু করা যায়! কিন্তু কার সাহায্য নিবে সে? এখানে ঢাকার কে আছে? সেকেন্ড তিনেক ভাবার পর তার মাথায় লিখনের নাম আসে। লিখন চাইলে আমিরকে থামাতে পারবে। অবশ্যই পারবে! এতে আমিরের সম্পর্কে সব জেনে যাবে লিখন। বলি হবে আমির! এটা ভাবতে পদ্মজার কষ্ট হয়। সে ঢোক গিলে নিজের আবেগ,অনুভূতি সামলায়। সে আমিরকে মনে মনে বলি দিল। এখন লিখনই একমাত্র আশা। শুনেছে,শুটিং এখনো চলছে। পদ্মজা সিদ্ধান্ত নেয়,সে যেভাবেই হউক লিখনের সাথে আজ যোগাযোগ করবে। রিদওনের দিকে আগুন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পদ্মজা বললো,’আসছি।’
রিদওয়ান তাড়া দিয়ে বললো,’জলদি।’
তারপর বেরিয়ে গেল। রিদওয়ান বের হতেই পদ্মজা বিড়বিড় করলো,’বেজন্মা!’
তারপর দ্রুত বোরকা,নিকাব পরে নিল।
_________
মৃদুল তার মা-বাবাকে নিয়ে হাওলাদার বাড়িতে পা রাখে। তার বুকের গোপন কুঠুরিতে থাকা হৃদয়টা খুশিতে নৃত্য করছে। যখন সে তার মা বাবাকে বললো,সে বিয়ে করতে চায়। আর মেয়েও পছন্দ করেছে। তখনি তার মা-বাবা দুজনই খুশিতে আটখানা হয়ে যায়। মিয়া বাড়ির সবাই খুশিতে ভোজ আয়োজন করে। তাদের আদরের দুলাল মৃদুল। মৃদুল এতদিন অলন্দপুরে ছিল বলে,তার মা জুলেখা বানু অসুস্থ হয়ে পড়ে। ছয় বিঘা ভূমির উপর কাঠের বাড়ি আর নব্বই বিঘা জমির একমাত্র উত্তরাধিকারী মৃদুল! তার অনুপস্থিতিতে বাড়ির প্রতিটি মানুষ মৃতের মতো হয়ে গিয়েছিল। এমতাবস্থায়,মৃদুলের বিয়ের সিদ্ধান্ত তাদের মাঝে ঈদের আনন্দ নিয়ে এসেছে। তাই এতো দ্রুত তাদের আগমন। মৃদুলের বাবা গফুর মিয়ার মাথায় টুপি,গায়ে দামী পাঞ্জাবি। শরীর থেকে আতরের ঘ্রাণ ভেসে আসছে। জুলেখা নিকাব তুলে মৃদুলকে বললেন,’ বাড়িত কী কেউ নাই?’
মৃদুল জুলেখাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বললো,’অন্দরমহলে গেলেই মানুষ পাইবেন। একটু ধৈর্য্য ধরেন আম্মা।’
জুলেখা বানু কপাল কুঁচকালেন। তিনি স্বাস্থ্যবান একজন মহিলা। বাচাল প্রকৃতির মানুষ। রূপ এবং সম্পদ নিয়ে অহংকারের শেষ নেই। তিনি সরু চোখে চারপাশ দেখতে দেখতে অন্দরমহলে আসেন। অন্দরমহলের সামনে রিনু ছিল। রিনু মৃদুলকে দেখে দাঁত বের করে হাসলো। এগিয়ে এসে বললো,’মৃদুল ভাইজান আইয়া পড়ছেন?’
‘হ আইছি,দেখা যাইতাছে না?’
রিনু বোকার মতো হাসে। জুলেখা বানু আর গফুর মিয়ার পা ছুঁয়ে সালাম করে। মৃদুল বললো,’ফুফিআম্মা ঘরে আছে?’
‘না ভাইজান। বাড়ির সবাই স্কুলঘরে গেছে।’
মৃদুলের পূর্বে জুলেখা প্রশ্ন করলেন,’কেরে? ওইহানে কী দরহার(দরকার)?’
রিনু বিস্তারিত বললো। গফুর মিয়া সন্তুষ্টির সাথে বললেন,’মনডা জুরায়া গেলো। হাওলাদার বাড়ির আত্মীয় যে হইবো হেরই সাত জন্মের কপাল।’
গফুরের প্রশংসা জুলেখা বানুর ভালো লাগেনি। অন্যের প্রশংসা তিনি সহ্য করতে পারেন না। হাতের ব্যাগটা রিনুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে ঝাঁঝালো স্বরে বললেন,’এই ছেড়ি,ধরো ব্যাগডা।’
রিনু হাত বাড়িয়ে ব্যাগ নিল। জুলেখা বানু বললেন,’আমরা কোন ঘরে থাকমু? লইয়া যাও।’
‘আপনেরা আলগ ঘরে থাকবেন।’ বললো রিনু।
জুলেখা পিছনে ফিরে আলগ ঘরের দিকে ইশারা করে বললেন,’এই টিনের ঘরডাত?’
জুলেখার প্রশ্নে অবজ্ঞা। তিনি টিনের ঘরে থাকতে আগ্রহী নয় বুঝাই যাচ্ছে। রিনু কিছু বললো না। মৃদুল জুলেখাকে আদুরে স্বরে বললো,’আম্মা,কম কথা কন। আমরা মেহমান।’
রিনু জুলেখার কথাবার্তায় বুঝে গেছে,এই মহিলা কোন প্রকৃতির। সে মনে মনে ভাবে,পূর্ণার কপালে ঝাটা আছে! জুলেখা আলগ ঘরে থাকবে না,এটা নিশ্চিত। রিনু জুলেখাকে অন্দরমহলে নিয়ে আসে। রানি-লাবণ্যর খালি ঘরটা দেখিয়ে বললো,’এই ঘরে থাকবেন।’
জুলেখা ব্যাগপত্র রেখে বিছানায় টান,টান হয়ে শুয়ে পড়ে। হাত-পা ম্যাজম্যাজ করছে। একবার ভাবলেন,রিনুকে বলবেন পা টিপে দিতে। কী মনে করে যেন বললেন না। মৃদুল গফুর মিয়াকে বললো,’আব্বা,আমি গোসল কইরা,খাওয়াদাওয়া কইরা স্কুলঘরে যাইতাছি। আপনি যাইবেন?’
‘হ যামু। মহৎ কাজ নিজের চোক্ষে দেখাও ভাগ্যরে বাপ।’
মৃদুল জুলেখার উদ্দেশ্যে বললো,’আম্মা,আপনি যাইবেন?’
জুলেখা ক্লান্ত। তিনি মিনমিনিয়ে বললেন,’না আব্বা,আমি যামু না।’
মৃদুল ব্যাগ থেকে লুঙ্গি,গামছা বের করলো। জুলেখা উঠে বসেন। রিনুকে ডেকে বললেন,’এই ছেড়ি,কলডা কোনদিকে? আমারে দেহায়া দেও।’
জুলেখা আদেশ করলো নাকি হুমকি দিলো রিনু বুঝতে পারছে না। সে চুপচাপ জুলেখাকে নিয়ে কলপাড়ে গেল। লতিফা থাকলে ভালো হতো। নতুন কোনো মেহমান এসে তেড়িবেড়ি করলে লতিফা শায়েস্তা করতে পারে!
মাথার উপর সূর্য। মাঠভর্তি মানুষ। একপাশে মহিলা ও বাচ্চারা,অন্যপাশে পুরুষরা। শৃঙ্খলা বজায় রাখছে রিদওয়ান। উপর থেকে দেখলে,রিদওয়ান একজন মহৎ, ভদ্র,শান্ত ব্যাক্তি। যাকে সবমসময় দেখা যায় না। সবাই জানে,রিদওয়ান জ্ঞানী মানুষ। সারাক্ষণ বইপত্র নিয়ে থাকে। তাই তার দেখা পাওয়া যায় না। ভেতরে খবর যদি নিষ্পাপ মনের মানুষগুলো জানতো! হায় আফসোস! উপস্থিত প্রতিটি মানুষ খুব খুশি। এত এত মানুষকে শীতবস্ত্র দেয়া কম কথা নয়! সে কাজটা যখন হাওলাদার বাড়ির মানুষেরা করে,সবার কাছে তখন তারা ফেরেশতা হয়ে উঠে। ফেরেশতার সাথে তুলনা করা হয়। মজিদ হাওলাদার ও খলিল হাওলাদার শীতবস্ত্র বিতরণ করছেন। পদ্মজা একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। পদ্মজার সাথে আঠার মতো লেগে আছে দুটি লোক। দুজন দুই দিকে দাঁড়ানো। তাদের চোখ সর্বক্ষণ পদ্মজার উপর। পদ্মজার চোখ দুটি লিখনকে খুঁজছে। লিখন এখানে আসবে নাকি সে জানে না। তবে প্রার্থনা করছে,সে যেন আসে। আজ তার উপস্থিতি অনেকগুলো মেয়েকে বাঁচাতে পারে। লিখন নিঃসন্দেহে একজন ভালো মানুষ। সবকিছু শোনার পর সে কোনো ব্যবস্থা অবশ্যই নিবে।
লিখন ভীড় ঠেলে প্রান্তর পাশে এসে দাঁড়ালো। প্রান্ত লিখনকে দেখে অবাক হলো। তারপর হেসে করমর্দন করলো। বললো,’কেমন আছেন ভাইয়া?’
‘ভালো,তুমি কেমন আছো?’
‘ভালো ভাইয়া।’
‘পূর্ণা,প্রেমা আসেনি?’
‘আসছে। ওদিকে আছে।’ প্রান্ত স্কুলের ডানদিকে ইশারা করে বললো।
তৃধা লিখনকে প্রশ্ন করলো,’কে ও? ‘
লিখন চাপাস্বরে বললো,’পদ্মজার ভাই।’
তৃধা তাৎক্ষণিক প্রান্তকে প্রশ্ন করলো,’তোমার পদ্মজা আপা কোথায়?’
প্রান্ত সোজা আঙুল তাক করে বললো,’ ওইযে।’
তৃধা চোখ ছোট,ছোট করে সেদিকে তাকায়। প্রান্তকে আবার প্রশ্ন করে,’সবার তো মুখ ঢাকা। পদ্মজা কে?’
প্রান্তের আগে লিখন বললো,’লম্বা মেয়েটা।’
তৃধা আড়চোখে লিখনের দিকে তাকালো। বললো,’মুখ না দেখে চিনলে কী করে?’
‘জানি না, মনে হলো। প্রান্ত ঠিক বলেছি?’
প্রান্ত হেসে সম্মতিসূচক মাথা নাড়াল। তৃধার খুব মন খারাপ হয়। প্রান্ত বললো,’ভাইয়া,আপা আপনাকে খুঁজছিল।’
‘কোন আপা?’
‘পদ্মজা আপা।’
মুহূর্তে লিখনের কী হয়ে যায়,সে নিজেও জানে না। তার বুকে অপ্রতিরোধ্য তুফান শুরু হয়! পদ্মজা তাকে খুঁজছে! এ যে অসম্ভব! লিখন চকিতে পদ্মজার দিকে তাকালো। পদ্মজার মুখ দেখা যাচ্ছে না। হাত-পা ঢাকা। তবুও মনে হচ্ছে,সে পদ্মজাকে দেখতে পাচ্ছে। ছয় বছর পূর্বে পদ্মজাকে যে রূপে প্রথম দেখেছিল। সে দৃশ্য ভেসে উঠে। তাদের প্রথম কথা! টমেটো আছে নাকি জিজ্ঞাসা করা! কত সুন্দর সেই মুহূর্ত।
লিখন পদ্মজার কাছে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। লিখনের চোখেমুখে আনন্দ স্পষ্ট! পদ্মজা খুঁজছে শুনে এতোই আনন্দিত হয়েছে মানুষটা! ব্যাপারটা তৃধাকে কষ্ট দিচ্ছে। তার বুকে চিনচিন ব্যাথা শুরু হয়।
শাহানার অনেকক্ষণ ধরে মাথা ঘুরাচ্ছে। সে বেশি মানুষের মাঝে থাকতে পারে না। শরীর দূর্বল লাগছে। পদ্মজার এক হাত ধরে দূর্বল কণ্ঠে বললো,’পদ্ম,আমার মাথা ঘুরাইতাছে।’
পদ্মজা বিচলিত হয়ে বললো,’বেশি খারাপ লাগছে?’
শাহানার চোখ বুজে আসছে। সে অনেক কষ্টে বললো,’মাথাত পানি দেও আমার। দেও বইন,দেও!’
স্কুলের পিছনে ঝোপঝাড় আর মাদিনী নদী আছে। একটা ঘাটও আছে। পানির ব্যবস্থা আছে। পদ্মজা শাহানার এক হাত শক্ত করে ধরে ঘাটে নিয়ে আসে। দুজন লোকও সাথে সাথে যায়। শাহানা নিকাব খুলার আগে দুজন লোককে উদ্দেশ্য করে বললো,’এই তোমরা আইছো কেরে? নিকাব খুইললা পানি দিমু মাথাত। যাও তোমরা।’
দুজন লোক নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে চলে যায়। এদিকে কেউ নেই। কেউ আসতে চাইলেও তাদের সামনে দিয়ে আসতে হবে। তাই ভয় নেই।
শাহানা নিকাব খুলে মাথায় পানি দিল। শাহানা মাথা ঝুঁকে রাখে। আর পদ্মজা দুইহাতে পানি নিয়ে শাহানার মাথায় ঢালে। কিছুক্ষণ পানি দেয়ার পর শাহানা সুস্থবোধ করে। বিশ্রাম নেয়ার জন্য সে একটু দূরে একটা গাছের গোড়ায় বসলো। পদ্মজা চারপাশ দেখে নিজের নিকাব খুললো। চোখ দুটি জ্বলছে। পানি দেয়া প্রয়োজন।
পদ্মজা যেখানে ছিল সেখানে নেই! লিখন চারপাশে চোখ বুলিয়েও পদ্মজার দেখা পেলো না। এখানে আসতে আসতে কোথায় চলে গেল?
তৃধাও খুঁজলো। স্কুলে একবার শুটিং হয়েছিল। তাই লিখন জানে স্কুলঘরের পিছনে একটা ঘাট আছে। পদ্মজা সেখানে থাকতে পারে ভেবে,সেদিকে গেলো লিখন। দুজন লোক নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে তার পাশ কেটে ভীড়ের দিকে যায়। লিখন ঘাটে এসে থামে। কারো উপস্থিতি টের পেয়ে শাহানা পিছনে ফিরে তাকায়। আবার চোখ সরিয়েও নেয়। পদ্মজা মুখ ধুয়ে পিছনে ফিরতেই দূরে লিখনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। পদ্মজার গলার দুটো ঘাঢ় কালো-খয়েরি দাগ,মুখের ক্ষত,চোখের-মুখের অবস্থা দিনের আলোর মতো লিখনের চোখের সামনে ভেসে উঠে। শাহানা পদ্মজার এমন অবস্থা দেখে চমকে যায়। সে শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়ি এসেই সমাবেশে চলে এসেছে! পদ্মজার সাথে নিকাব পরা অবস্থায় কথা হয়েছে। তাই পদ্মজার এই অবস্থা সে দেখেনি। লিখনের কথা হারিয়ে যায়। বাকহারা হয়ে পড়ে সে। একেই বোধহয় বলে,পৃথিবী থমকে যাওয়া। পদ্মজা দ্রুত নিকাব পরে নিল।
চলবে…
®ইলমা বেহরোজ
চলবে…
®ইলমা বেহরোজ