আরশিকথা পর্ব -০২

আরশিকথা-২

টেবিলে খাবার দেওয়া হয়েছে। সুপ্রভা বসে পড়েছে। খেতে ইচ্ছে করছে না একদম। না খেয়ে চলে যাওয়া অশোভন দেখায়। দীপ্র সার্ভ করে দিচ্ছে।

শুভ্র চেইঞ্জ করে কফির মগ নিয়ে বের হলো রুম থেকে।

পিউ বলল, ভাইয়া, প্লিজ বসেন আমাদের সাথে!

শুভ্র বলল, আরে তোমরা খাও, আফটার অল আমি তো হোস্ট!

রনি বলল, ভাই আপনে হোস্ট না, আপনে বড় গেস্ট! আমরা তো ইচ্ছে করলেই আসি, আপনি তো প্রবাসী হয়ে গেছেন! কত বছর পর আসলেন?

সুপ্রভা বিড়বিড় করে বলল, সাড়ে চার বছর!

-এই প্রভা, কি বলিস?

প্রভা বলল, কিছু না!

শুভ্র একদম টেবিলের এক মাথায় দাঁড়িয়ে পড়ল। কেন যেন প্রভাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। সামনে আসার আগ অবধি এই রকম কিছু মনে হয় নি। মনে হয় প্রভা বুকের ভেতর ছাই চাপা আগুন হয়ে জমে ছিল, এতদিন পরে কেউ নাড়া দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে।

প্রভাকে ভুলে থাকতে অনেক মেয়ের সাথে ডেট করেছে শুভ্র। সেটা যেই সেই ডেট না। একেবারে চূড়ান্ত পর্যায়৷ শুয়ে পরা যাকে বলে! প্রতিবার তীব্র অতৃপ্তি নিয়ে সঙ্গিনীকে বিদায় দিয়েছে। প্রভার আনাড়ি ভাবে দেওয়া একটা চুমু যে ঝড় তুলেছিল, অন্যরা কেউ বিছানায় ঝড় তুলেও কোনো আলোড়ন তুলতে পারে নি হৃদয়ে!

প্রভার প্লেটে দীপ্র ইলিশ মাছ তুলে দিতেই শুভ্র বলল, এ্যাই কি করিস, ওর ইলিশ মাছে এলার্জি আছে!

দীপ্র অবাক হয়ে বলল, তাই, কখনো তো বলিস নাই প্রভা! আর তুমি জানলে কীভাবে ভাইয়া?

শুভ্র অপ্রস্তুত হয়ে গেল। একটু সামলে নিয়ে বলল, বলেছে, এই বাসায় কি প্রভা আজ প্রথম এসেছে নাকি! আগেও বলেছে, তখন শুনেছিলাম, নাথিং সিরিয়াস ইস্যু!

প্রভা প্লেট ফেলে উঠে পড়ে বলল, না, এলার্জি নেই। এডজাস্ট হয়ে গেছে। উনি জানেন না সেটা৷ দীপ্র আমার খুব মাথা ধরেছে, কিছু মনে করিস না রে, আমি এখন যাব!

-খাওয়াটা তো শেষ কর!

-না রে, বমি হয়ে যাবে। প্রেশার ফল করে ইদানিং খুব!

প্রভা উঠে সিংকে হাত ধুয়ে ফেলল। তারপর আন্টিকে বলে বের হয়ে গেল দ্রুত!
এ্যই দীপ্র তুই যা ওর সাথে – রনি বলল দীপ্রকে।

শুভ্র বলল, আচ্ছা৷ তুই থাক। আমি ওকে ছেড়ে দিয়ে আসছি।

দরজা খুলে শুভ্র কোথাও প্রভাকে দেখতে পেলো না।

প্রভা বের হয়ে অটো পেয়ে গেছে। কান্না পাচ্ছে খুব! প্রভার এলার্জি আছে, সেটা এখনো মনে রেখেছে।
সেই কবে মাছ খেয়ে এলার্জি হয়েছিল, সেই পোড়োবাড়ির আড়ালে শুভ্র প্রভার জামার বোতাম খুলে ছুঁয়ে দেখে আদর করে দিয়েছিল। কেমন গা শিরশিরে অনুভূতি এখনো! এত ফাঁকা জায়গায় একা পেয়েও প্রভাকে অপমান করে নি শুভ্র! এত ভালোবাসত দুজন দুজনে , আর শুভ্র কি করল শেষ অবধি! কেন করল প্রভা আজও জানে না!

এখন তো সুন্দরী কোনো এক বিদেশিনীকে বিয়ে করছে সম্ভবত! ওদের আবার বিয়ে লাগে নাকি! লিভ করে হয়তো! ইশ্! এত খারাপ, ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারে নি সুপ্রভা!

রাতটা অস্থিরতায় কেটে গেল প্রভার। সকাল সকাল মন খারাপ লাগছিল। একটু বেলা বাড়তেই বের হলো একা একা। শহরের বাইরে একটা রাস্তা আছে, হাঁটলে ভালো লাগবে কিছুক্ষণ।

এই রাস্তাটা আগে ইটের ছিল, বহুদিন আসা হয় নি। প্রভা আসার সাহস পায় নি, ভীষণ একাকিত্ব গ্রাস করে নিতো। এখানে নিয়ে আসত শুভ্র। ছোট্ট মফস্বলে স্কুলে পড়ুয়া সুপ্রভাকে নিয়ে বসার মত কোনো জায়গা ছিল না৷ শুভ্র খুঁজে খুঁজে এই রাস্তা বের করেছিল৷ তখন একটু ভয় ভয়ও লাগত । শুভ্র আগলে নিয়ে আসত। একটু নেমে ঢালু মত জায়গা, সেখানে শুভ্র প্রভার কোলে মাথা রেখে শুয়ে শুয়ে গল্প করত! তখন প্রভার কত প্ল্যান, শুভ্রর পড়া শেষ হতে হতে প্রভা ইউনিভার্সিটিতে ঢুকে যাবে। শুভ্র জব পেয়ে গেলে বিয়ে করে নেবে দুজন। তারপর দুজনের লাল নীল সংসার!
প্রভা বলত, আমি কখনো জব করব না, তোমার বউ হয়ে থাকব!
সেই প্রভা এখন কত ক্যারিয়ারিস্টিক হয়ে গেছে! মাস্টার্সে ভর্তি হয়ে জবে ঢুকে গেছে। এখন ক্লাশে পার্সেন্টেজ নেই। জব করলে সেটা সিভিতে এ্যাড হয়ে যাবে।

দূর থেকে কতগুলো ছেলেকে দেখা যাচ্ছে, সুপ্রভা ইতস্তত করে৷ একা একা যাওয়া ঠিক হবে না। অটোওয়ালাকে বলেছে, একঘন্টা পরে এসে নিয়ে যেতে৷
এক ঘন্টার আগে এখান থেকে ফেরাও যাবে না, একটু ভয় ভয় লাগে, যদি কোনো অঘটন হয়, ছেলেগুলো যদি গাজা খোর হয়, ইয়াবা খেয়ে ওকে রেপ করে! না না কি সব ভাবছে প্রভা!

হঠাৎ করে একটা গাড়ির হর্নে প্রভা পেছন ফেরে, একটা কালো প্রাইভেট কার এসে থেমেছে। ভেতর থেকে নেমে এলো শুভ্র!

তুমি এই সময়ে এখানে এসেছ কেন? – প্রভাকে কোনে ভূমিকা না করেই শুভ্র জিজ্ঞেস করল।

প্রভা উত্তর দিলো না। শুভ্রর সাথে সব কথা শেষ হয়েছে৷ অনেক দিন আগেই। একটু সামনে হাঁটতে লাগল৷ শুভ্র গাড়ি স্লো করে ওর পাশে পাশে কিছুদূর গিয়ে ওর পথ আটকে দাঁড়ালো।

সুপ্রভা বলল, এটা কি হলো?

-আমি তোমাকে আগে প্রশ্ন করেছি।

-আপনার উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই।

-হুম, জানি৷ এই জায়গাটা এখন আর সেফ না৷ ফিরে চলো।

সুপ্রভা বলল, আমি আমার সময় মত ফিরব। আপনি কাইন্ডলি আমাকে বিরক্ত করবেন না।

ছেলেগুলো এগিয়ে আসছিল, কাছাকাছি চলে এসে হয়তো কিছু আন্দাজ করে জিজ্ঞেস করল, কি সমস্যা? কারা আপনারা? এখানে কি?

শুভ্র মনে মনে বলল, দেড় ব্যাটারির তেজ কত! হাঁটুর বয়েসী পোলাপান সব!

সুপ্রভা বলল, আমাদের ব্যক্তিগত আলোচনায় ঢুকবেন না৷ আপনারা চলে যান।

আমরা সম্পর্কটা জানতে চাই, কি হয় আপনার!

শুভ্র বলে উঠল, হাজবেন্ড ওয়াইফ, বউ হয় আমার! হয়েছে?

-দেখে তো মনে হয় না, মোবাইলে ছবি আছে? দেখান?

-আশ্চর্য, আমার বউ প্রমাণ করতে হবে? বাড়াবাড়ি হচ্ছে না?- সুপ্রভা দেখল শুভ্র রেগে যাচ্ছে।

এখন আপনার বউ হইলে একটা ছবি থাকব না মোবাইলে মিয়া, ভুগোল বুঝান নাকি- চেংড়া ছেলেটা তেড়ে আসে।

শুভ্র বলল, ওয়েট। বলে একটা নম্বরে ডায়াল কল করে কানে ধরল।

ওয়াসিম, থ্যাঙ্কস দোস্ত যে একবারে তোরে পাইছি। আরে তোর ভাবিরে নিয়ে এই চওড়া রাস্তায় আসছিলাম, কয়েকটা ছেলে পেলে ধরছে, বউ প্রমাণ দিতে বলে, এখন ফোর্স পাঠা। উদ্ধার কর।
আরে না, গুন্ডা না, লোকাল ছেলেপেলে, না কেস দিস না। আমাদের নিয়ে যা।

ফোন রেখে শুভ্র বলল৷ ওকে ফাইন, দাঁড়াও এখানে। ক্যান্টনমেন্ট থেকে জিপ আসবে। তোমরা তখন যেও।

ছেলেগুলো একটু ইতস্তত করে আস্তে আস্তে কেটে পড়ে।

ওর চলে যেতেই সুপ্রভা বলল, এত সুন্দর করে মিথ্যে বলা কবে শিখলেন?

শুভ্র একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, মিথ্যেটাই জীবন। সত্য হচ্ছে সব চাইতে বড় মিথ্যা। যাক, এসো, এখানে থাকতে হবে না৷

সুপ্রভা বলল, আমি এখানে কিছু সময় থাকব৷ আপনি চলে যান, আপনার কাজ হয়ে গেলে।

শুভ্র বলল, যা শেষ হয়ে গেছে, কেন শুধু শুধু সেই দিনগুলো মনে করতে চাচ্ছ সুপ্রভা৷ মানুষ বর্তমানে বাঁচে, অতীতে না৷

সুপ্রভা হেসে বলল, আপনি ভুল ভাবছেন৷ আমি কিছু মনে করতে চাই না৷ আমার সেই সময়, ইচ্ছে, শক্তি কোনোটাই অবশিষ্ট নেই৷

-তুমি আগে আমাকে তুমি করে বলতে!

ওহ, তাই! ভুলে গেছি, অনেক দিন আগে তো! আপনি আমার বন্ধুর বড় ভাই, সম্মানিত ব্যক্তি! বাদবাকি কোনো কিছু আমি মনে রাখতে চাই না৷ আপনি এখানে আসা নিয়ে কোনো জটিল কিছু মনে করবেন না৷ সেই সুপ্রভা অনেক দিন আগেই মরে গেছে! আমি এমনিতেই এসেছিলাম৷ কাকতালীয় ভাবে আপনি এসে পড়লেন। একা এলে হয়তো এই ছেলেগুলো আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করত না।

-আচ্ছা, দেখা হলো যখন, একা ফেলে যাই কি করে তোমাকে- বলেই শুভ্রর মনে হলো এটা বলা ঠিক হয় নি। সে একা ফেলেই চলে গিয়েছিল। এখন সুপ্রভা ওকে কথা শোনাবে।

সুপ্রভা কিছুই বলল না। হেঁটে আরেকটু সামনে এগিয়ে গিয়ে বসে পড়ল একটা গাছের নিচে।

শুভ্রর চোখের সামনে সেই দিনগুলো ভেসে আসে, কত খুনসুটি, মাসে দুইবার বাড়িতে চলে আসা, সুপ্রভাকে নিয়ে এখানে এসে বসে থাকা। আচ্ছা৷ দীপ্রর সাথে কি সুপ্রভার প্রেম হয়েছে? কাল ও তো সারপ্রাইজ দিলো দীপ্রকে। মা সারাক্ষণ বলতে থাকে, প্রভাকে বউ করে আনবে। শুভ্র কি কোনো ভুল করে ফেলেছে!

সুপ্রভা কাউকে ফোন করছে, শুভ্র এগিয়ে গেল সামনে। সুপ্রভা ফোনটা রাখল।

শুভ্র আরো একটা সিগারেট ধরিয়েছে।

সুপ্রভা খেয়াল করলেও কিছু বলল না। শুভ্র দেখল, সুপ্রভা ওর সিগারেটের দিকে তাকিয়েছে।

শুভ্র নিজেই বলল, অভ্যাস হয়ে গেছে, প্রচুর কাজের প্রেশারে থাকি!

সুপ্রভা উত্তর দিলো না। দূরে তাকিয়ে দেখল অটো চলে আসছে। তাই উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটা শুরু করল।

শুভ্র বলল, তুমি অটো ডাকছিলে? আমার সাথে যাবে না তাই?

সুপ্রভা বলল, শুভ্র, আমার জীবনের কোথাও আপনি এখন আর নেই। আমি একা চলতে পারি! শিখে গেছি।

অটোতে উঠে সুপ্রভা চলে গেল। শুভ্র বসে পড়ল সুপ্রভার জায়গায়।

-তুমি বুঝবে না সুপ্রভা, আমি কত কষ্ট করে তোমাকে ভুলতে চেয়েছি! কিন্তু বিশ্বাস করো, একটা মুহুর্তেও তোমাকে ভুলে থাকতে পারি নি! আমি জানি তুমি অনেক কষ্ট পেয়েছ, কিন্তু তোমার হাত ধরে দীপ্র ছিল। আমার পাশে কেউ ছিল না। দূর প্রবাসে একা একা আমিও কষ্ট পেয়েছি সুপ্রভা, তুমি কখনো জানবে না।

কিছুক্ষণ বসে শুভ্র উঠে পড়ল।

চলবে

শানজানা আলম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here