আরশিকথা – ৩
সুপ্রভার বন্ধু পিয়ার বাসায় সবার দাওয়াত ছিল। সুপ্রভা বলেছে, সে যেতে পারবে না। কিন্তু পিয়ার ফোন করল আবারও, তাই ওর কথা ফেলতেও পারল না। পরে ভাবল, শুভ্র নিশ্চয়ই সেখানে যাবে না।
ভাবতেই যেন পিয়া বলল, প্রভা, শুভ্র ভাইয়াকে ইনভাইট করেছি। তোকে জানিয়ে রাখলাম।
প্রভা একবার ভাবল, যাবে না। পরে ভাবল, শুভ্র এখন তার কিছুই হয় না। গেলেও কিছু না, না গেলেও কিছু না।
তাই প্রভা বলল, তো?
পিয়া বলল, তোকে রাজী করিয়ে তারপর জানালাম। শুভ্র ভাইয়ার বিষয়টা তো দীপ্র জানে না এখনো তাই না?
সুপ্রভা বলল, শোন, এখন দীপ্রর জানা বা না জানায় আমার কিছু আসে যায় না৷
তুই দীপ্রকে নিয়ে ভাবিস নি কখনো?
পিয়া, তোর কি পাশের বাসার আন্টিদের মত খোঁচা খুচি খুব পছন্দ? আমি শুভ্রর সাথে প্রেম করেছি, একা একা ওর বাসায় গিয়েছি, ওর সাথে চুমু খেয়েছি, এখন ওর ভাইকে আমি বিয়ে করার ভাবব? ইজ ইট পসিবল?
দীপ্র আমার বন্ধু হয়েছে পরে, ওর সাথে মেশার গল্পটা ভুলে গেছিস? এখন দীপ্র আমার খুব ভালো বন্ধু, কিন্তু এর বেশি একটুও বলবি না তোরা! কক্ষনো না। তাহলে আমি তোদের সার্কেলেই আর মিশব না।
সরি, এত গুলো কথা শুনিয়ে দিবি বুঝি নাই রে। বাদ বাদ বাদ, তোর উপর দিয়ে কি গেছে, সেটা তুই জানিস।
এসব নিয়ে আর কোনো কথা হবে না। চলে আসিস প্লিজ। – পিয়া ফোন রেখে দিলো।
সুপ্রভা শুয়ে পড়ল জানালার পাশে। কতদিন আগের কথা, মনে হয় এই তো সেদিন!
দীপ্র ক্লাশ টেনে এসেছিল ওদের সাথে। পলাশতলা হাউজিংয়ে বাড়ির কাজ শুরু করায় ওর রেজিট্রেশন নাইনেই করে গিয়েছিল, যার কারনে সমস্যা হয় নি ভর্তিতে। দীপ্রদের বাড়ির পাশেই বাড়ি করেছেন লিপি ম্যাডাম, বাংলার মিস। সুপ্রভা, পিয়া, চৈতি ওরা সকালে মিসের কাছে বাংলা পড়ত ব্যাচে।
সেদিন সকাল বেলায় পড়া শেষ করে বের হতেই চোখে পড়ল, দীপ্রদের বাসার গেটে রিক্সায় নামছে একটা ছেলে। ভাড়া মিটিয়ে গেট খুলে ভেতরে ঢুকলো ছেলেটা। কাঁধে একটা ব্যাগ, সম্ভবত ঢাকা থেকে ফিরেছে। মুখের আদল দীপ্র এর মতো।
সুপ্রভার দৃষ্টি আটকে গেল। ছেলেটা মাথায় ক্যাপ পরা ছিল। ক্যাপ সরিয়ে সুপ্রভাকে দেখল কিনা বোঝা গেল না। গেটের সামনে দাঁড়ালো সুপ্রভা। পিয়া আর চৈতি নিজেরা হাসাহাসি করছে, দারুণ না দেখতে ছেলেটা? দীপ্রদের বাসায় ঢুকেছে, কি হয় ওর!
সুপ্রভা কথা বলল না।
কি হল প্রভা!
সুপ্রভার একটু অস্বস্তির লাগছে, একটা ছেলেকে দেখে এমন লাগার কারণ কি! ছেলেটা কি বেশি সুন্দর দেখতে!
এই প্রভা!!
প্রভা বলল, ছেলেটাকে চিনিস তোরা?
না, আগে দেখি নি।
দীপ্রকে জিজ্ঞেস করব?
ওর সাথে কথাই তো বলিস নাই কখনো! আর সরাসরি জিজ্ঞেস করলে যদি কিছু মনে করে!!
সুপ্রভা ভুরু নাচিয়ে বলল, আচ্ছা আমি ম্যানেজ করছি। ওয়েট, কাল ক্লাশে আসতে দে!
★★★
দীপ্রকে টিফিন পিরিয়ডে পিছু ডাকল সুপ্রভা।
দীপ্র, তোমার কাছে কেমিস্ট্রি স্যারের লাস্ট শিট দুটো আছে? – দীপ্র হেঁটে যাচ্ছিল, সুপ্রভার ডাকে থামল।
-আছে।
-আমাকে দেবে একটু?
-কেন, তোমার কাছে নেই? পিয়া, তন্বী ওদের কাছে তো আছে! ওরা তো ছিল ক্লাশে।
উফফ, এত বাড়তি কথা বলে এই ছেলে!
-আছে, কিন্তু …… ভ্রু নাচিয়ে সুপ্রভা বলল, একটু প্রবলেম আছে।
দীপ্র এবার হেসে বলল, বুঝেছি! তোমরা মেয়েগুলো না কেমন জানি, এই এত খাতির, আবার কমন নোটগুলোও দিচ্ছ না একে অপরকে।
সুপ্রভা মনে মনে বলল, কচু জানো!
দূর থেকে পিয়া, চৈতি হাসছে। সুপ্রভা এত ডেস্পারেট হয়ে যেতে পারে ভাবে নি। কেমিস্ট্রি নোট না তো, ছাই। ওরা বাংলা মিসের কাছ থেকে ফিরছিল। তখনি কোথা থেকে একটা ছেলে এসে থামল দীপ্রদের বাসার সামনে। দীপ্র এখানে নতুন এসেছে। এতদিনেও ওর সাথে কথা বলা হয় নি সেভাবে, কিন্তু গতকাল থেকেই দীপ্র এর বিষয়ে আগ্রহের বিষয় বেড়ে গেছে।
-নোট তো সাথে নেই, বাসায়।
-আমি কি তোমার সাথে যাব, বাসায় ঢুকব না, গেটে দাঁড়াব, তুমি এনে দিও।
-আচ্ছা চলো।
সুপ্রভা বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে দীপ্রর সাথে সাথে ওদের বাসার দিকে চলল! বাসার গেটে ঢোকার সময়ই সেই ছেলেটা বের হচ্ছিল।
-এই দীপ, সাইকেলটা নিয়ে যাচ্ছি একটু।
-কোথায় যাচ্ছ ভাইয়া?
-এই তো সামনে….
দীপ্র জানে ভাইয়া কোথায় যাচ্ছে। নাওমি আপুর বাসা কাছেই, ভাইয়ার সাথেই ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ে।
সুপ্রভা আঁড়চোখে খেয়াল করে দেখল। দেখল শুভ্রও প্রভাকে। এই মেয়েটাকে সে চেনে, গতকালই দেখেছে। আরো কয়েকজন মেয়ের সাথে ছিল। তাকে দেখে নিজেরা হাসাহাসি করছিল। এই সব টিনএজ মেয়েদের দৃষ্টি বুঝতে শুভ্রর সময় লাগে নি!
-ভাইয়া, আমার ও ক্লাশমেট, সুপ্রভা।
সুপ্রভা একটু হাসার চেষ্টা করল।
শুভ্র বলল, হাইই!
ব্যস এটুকুই!
শুভ্র চলে গেল, সুপ্রভা নোটগুলো নিতে ভেতরে ঢুকল।
অল্প কিছু বাকি আছে, সুপ্রভা টুকে নিতে নিতে জিজ্ঞেস করল, উনি তোমার কাজিন?
-আরে না, আমার বড় ভাই!
-ওহ আচ্ছা। এখানে থাকে না?
-না, ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে।
-আচ্ছা। তোমরা দুই ভাই?
-হুম!
সুপ্রভা আর কিছু জানতে চাইলো না।
দুদিন পরেই আবার দীপ্রকে ডাকল, দীপ্র থ্যাঙ্কস, তোমার কাছে উপপাদ্যের নতুন এক্সট্রা গুলো আছে?
দীপ্র বলল, আছে।
আজ শুভ্র বাড়িতেই ছিল। সুপ্রভা ভেতরে ঢুকে দেখ শুভ্র দীপ্রর রুমে পিসিতে ফুল ভলিউমে গান শুনছে!
-ভাইয়া, আমরা একটু নোটস লিখব!
-ওহ, সিওর! শুভ্র নড়েচড়ে বসল উঠে যাবে বলে।
সুপ্রভা বলল, না না কোনো সমস্যা নেই, আপনি থাকুন! অল্প একটু কাজ।
শুভ্র হেডফোন মাথায় ঢুকিয়ে নিলো।
রুমটা বেশ অগোছালো, দেয়ালে একটা ছোটো টেরাকোটার আয়না। সুপ্রভা মাথা নিচু করে লিখছিল, এই গুলো ওর কাছে আছে, মিছেমিছি কার লিখতে ভালো লাগে, যতটা টুকলো, তার চাইতে অনেকবার তাকিয়ে দেখল শুভ্রকে। চোখ বন্ধ করে গান শুনছে!
দীপ্র গিয়েছিল চা নিয়ে আসতে, দীপ্র ফিরতেই সুপ্রভা উঠল, আমি যাই আজ। তুমি ক্লাসে একটু নিয়ে এসো এই কপিটা।
শুভ্র চা নিতে নিতে বলল, চা নাও তুমি?
-না ঠিক আছে, আমি চা খাই না।
শুভ্র একটু হাসল তবে কেমন যেন হাসিটা, যেন সুপ্রভাকে বুঝে ফেলেছে।
সুপ্রভা দ্রুত চলে গেল।
সুপ্রভা চলে যেতেই মা এসে দীপ্রকে ধরলেন, ক্লাসে আর কোনো মেয়ে নেই, তোর সাথেই আসছে কেন ও?
দীপ্র বিব্রত হতে হতে শুভ্র সামলে দিলো, তুমিও না মা! দেখলে তো বসে বসে নোট টুকলো।
দীপ্র মাথা চুলকে বলল, ওর বন্ধুদের সাথে কী যেন সমস্যা আছে, নোট দেয় না!
শুভ্র প্রথম দিনের কথা মনে করার চেষ্টা করল,, দেখে তো কোনো সমস্যা আছে বলে মনে হয় নি!
শুভ্র মনে মনে একটু মুচকি হাসল।
চলবে
শানজানা আলম