#আরোও_একবার_বসন্ত
#২০তম_পর্ব
নিস্তদ্ধ রাতের শীতল হাওয়ায় যেনো যে কেউ মাতাল হয়ে যাবে। প্রিয়ন্তী কিছু বলার আগেই আরাফাত তার মুখের সম্মুখে চলে আসে। আরাফাতের এরুপ আচারণে মস্তিষ্ক শূণ্য হয়ে পড়ে প্রিয়ন্তীর। কোনো পুরুষ তার এতোটা কাছে এই চার বছরে আসে নি। আরাফাতের উষ্ণ নিঃশ্বাস তার মুখমন্ডলে আচড়ে পড়েছে। গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল রক্তের প্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। আরাফাতের দৃষ্টি তখন প্রিয়ন্তী ঠোঁটের ঠিক নিচে গাঢ় কালো নজর টিকাটার দিকে, মাদকতা যেত রাতের নিস্তব্ধতার সাথে বেড়েই চলেছে। রাতের গাঢ়ত্ব বাড়ছে। ছাদের এক কোনায় রাফিজা বেগমের নিজ হাতে বাগান করা। সেখানে গোলাপ, গাঁদা সহ নানা ফুলের গাছ সারি বদ্ধ করে রাখা। ফুলের গন্ধ মম করছে ছাঁদ। প্রিয়ন্তীর মস্তিষ্ক শূণ্য। সে যেনো বরফের দলার ন্যায় জমে গিয়েছে। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। আরাফাত তার ঠোঁটজোড়ার দিকে অগ্রসর হতে লাগলে আবেশে চোখ বুঝে নেয় প্রিয়ন্তী। হৃদস্পন্দন যেনো বেড়েই চলেছে। উত্তেজনায় মাথা শূন্য হয়ে আসছে। প্রিয়ন্তী খামছে তার শাড়ির আঁচল ধরে রইলো। অনেকক্ষণ কিছু অনুভব না হলে চোখ খুলে তালায় সে। দেখতে পায় আরাফাত হেসেই চলেছে। কন্ঠে দুষ্টুমির ছাপ রেখে আরাফাত বললো,
– কি ভেবেছিলেন? আমি কিছু করবো?
– মো…মোটেই না।
আমতা আমতা করে উত্তর দিলো প্রিয়ন্তী। তার শ্যাম গালজোড়া টমেটোর ন্যায় লাল হয়ে আছে। হাসতে হাসতে আরাফাত বললো,
– তবে চোখ বুঝে নিলেন কেনো?
– ……………
প্রিয়ন্তী কি উত্তর দিবে তার জানা নেই। নিজের উপর রাগ হচ্ছে, ইচ্ছে করছে দুখানা গালি দিয়ে বসিয়ে রাখতে। কিন্তু নিজেকে নিজেকে গালি দিয়েও কি লাভ। একটা অকওয়ার্ড সিচ্যুয়েশনে সে পড়ে গেছে। আরাফাতের চোখ চোখ রাখতেও লজ্জা লাগছে। ছুটে পালিয়ে গেলে হয়তো মন্দ হতো না। আচ্ছা দুতালার ছাঁদ থেকে লাফ দিলে কি হাত পা ভাঙ্গে। ভাঙ্গতেই পারে। শাড়ি পড়ে ছুটে সিড়ি দিয়ে নামাটা সম্ভব নয়। পায়ে বেধে উলটে পড়ে যাবার সমূহ সম্ভবনা রয়েছে। নিজেকে কোনো মতে সামলে নিয়ে বেশ জোর গলায় বললো,
– হুট করে এমন কাজে যে কেউ ভ্যাবাচেকা খেয়ে যাবে। আমিও তার থেকে আলাদা নই।
– ভয় পাবেন না, আপনার সম্মুতি ছাড়া আমি আপনার কাছে আসবো না। বিয়ে হয়েছে মানেই কোনো নারীর সাথে শারীরিক সম্পর্ক করার লাইসেন্স পেয়ে গেছি এমনটা নয়। আমি অন্তত মনে করি না। আপনি সময় নিন। আমার কাছে আমৃত্যু সময় আছে।
– যদি সেই সময়ের মাঝেও আমি সিদ্ধান্ত না নিতে পারি?
– তাহলে আর কি! মরে গেলে কোনো বাধার মাঝে আপনাকে থাকতে হবে না। তখন আপনি মুক্ত।
– আমার জীবনে বসন্ত ফুরিয়ে গেছে! সেই বসন্ত কি পুনরায় ফিরে আনা সম্ভব!
– আজ ১৪ই চৈত্র, কিছুদিন পর বসন্তের অবসান ঘটবে। তাই বলে কি প্রকৃতিতে আর বসন্ত আসবে না? প্রকৃতিতে বসন্ত আসতে পারলে আপনার জীবনে কেনো আসবে না? মানুষের জীবন কখনোই থেমে থাকে না প্রিয়ন্তী। হয়তো সেই পুরুষটি আপনার জীবনের প্রথম পুরুষ ছিলো। হয়তো তার প্রতি আপনার হৃদয়ে এখনো সুপ্ত অনুভূতি আছে। কিন্তু তাই বলে আপনার জীবনটা থেমে কখনোই থাকবে না। প্রিয়ন্তী আমি আপনার জন্য সমাজের সাথে লড়তে পারবো। শুধু আপনার সাথে আমি লড়তে পারবো না। আপনার সাথে লড়াইটা আপনাকেই করতে হবে। আমি শুধু আপনাকে ভালোবাসতে পারবো।
– আমি ভয় পাই! পাঁচ বছরের সম্পর্কের পর কেউ যদি আপনাকে বলে সে আপনাকে ভালোবাসে না, অন্য কোনো নারীকে নিজের আলিঙ্গনে নিতে পারে। আপনিও তেমনটি করবেন না তার কি কোনো গ্যারান্টি আছে? এমন হতেই পারে আগামী দিনে আপনার কোনো যুবতীকে ভালো লেগে গেলো। আমি তো যুবতী ও না।
– আমার জীবনের প্রথম নারী আপনি। কথাটার মানে হয়তো আপনি এখনো বুঝেন নি। অন্য কোনো নারীকে আমার ভালোলাগবে না। কারণ আমার হৃদয়ে একজন নারীর ই বিচরণ। সেখানে অন্য কেউ কখনোই আসবে না। আর আমি কমিটমেন্টে বিশ্বাসী। আমি আপনার প্রতি কমিটেড। একবার ট্রাই করে দেখতে পারেন।
অকপটে কথাগুলো বলে দিলো আরাফাত। অবাক নয়নে প্রিয়ন্তী তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মানুষের চোখ কখনো মিথ্যে বলে না। আরাফাতের চোখ প্রমাণ দিচ্ছে সে তার কথাগুলোর সত্যতার। অবাধ্য মনটা আবারো এই চোখজোড়াকে বিশ্বাস করতে চাইছে। কিন্তু মস্তিস্ক হরতাল করছে। প্রিয়ন্তী কিছু বলার আগেই আরশাদের ভারী গলার ডাক কানে আসে। আরাশাদ জোর গলায় আরাফাতকে ডেকে যাচ্ছে। আরাফাত সময় নষ্ট করে ছুটে গেলো নিচে। প্রিয়ন্তীও পিছু পিছু ছুট লাগালো। আরশাদ তখন রাফিজা বেগমের রুমে দাঁড়িয়ে রয়েছে, রীতিমতো চিন্তায় তার অবস্থা নাজেহাল। রাফিজা বেগম বুকে হাত দিয়ে ছটপট করছেন। তার এমন অবস্থা দেখে প্রিয়ন্তী ছুটে যায় তার আছে। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে,
– আন্টি, কোথায় পেইন হচ্ছে?
– ব্যাথা করছে, ব্যাথা করছে
– কোথায় ব্যাথা করছে? একটু বলুন?
– বুকে বুকে
রাফিজা বেগম ব্যাথায় চিৎকার করেছেন। রাফিজা বেগমের মুখ নীল হয়ে এসেছে। প্রিয়ন্তীর হাতে কোনো যন্ত্র ও নেই। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। আরাফাত ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। রাফিজা বেগম খুব শক্তপোক্ত মহিলা। আজ পর্যন্ত জ্বরে ভুগতে তাকে দেখে নি আরাফাত। তার কাছে মনে হতো মা যেনো ওন্ডার ওমেন। তার কিছুই হয় না। অথচ আজ তার মাকে এভাবে ছটপট করতে দেখে যেনো জমে গিয়েছে সে। প্রিয়ন্তী কখন থেকে ডেকেই যাচ্ছে কিন্তু তার কানে যেনো কোনো কথাই ডুকছে না। আরাফাতের সাড়া না পেয়ে আরশাদের উদ্দেশ্যে প্রিয়ন্তী বলে,
– আমাদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে আন্টিকে। এখনই আমার কাছে কিছুই নেই যে আমি ট্রিটমেন্ট করবো।
– মার কি হয়েছে ভাবি?
– বুঝতে পারছি না, তবে হার্টের সমস্যা হতে পারে।
– কিন্তু মার হার্টে প্রব্লেম তো আগে ছিলো না।
– আরশাদ, কথা বলার সময় এখন না। তোমার ভাই ফ্রিজ হয়ে আছে। আমাদের দ্রুত কাজ করতে হবে। ফাস্ট
প্রিয়ন্তীর কথা শুনে আরশাদ বাহিরে চলে যায় যানবাহনের খোঁজে। রাত এখন দেড়টার কাছাকাছি। কোনো যানবাহন আদৌ পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ আছে। মোটর সাইকেলে করে নিয়ে যাওয়াটা হয়তো ভালো হবে না। এদিকে প্রিয়ন্তী আরাফাতের কাছে এসে তার হাত ধরে ঝাকিয়ে তাকে ডাকে।
– আরাফাত, আরাফাত শুনছেন?
প্রিয়ন্তীর ঝাকুনিতে আরাফাতের স্বম্বিত ফিরে। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে প্রিয়ন্তীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
– মা, ঠিক হয়ে যাবে তো?
– ইনশাআল্লাহ, দাঁড়িয়ে থাকার সময় এখন নয় আরাফাত। চলুন।
আরাফাত মোবাইলটা বের করে থানায় একটা ফোন লাগায়। কন্সটেবল শামীম দ্রুত গাড়ি নিয়ে এসে হাজির হন। পাজাকোল করে রাফিজা বেগমকে বাসা থেকে নামায় আরাফাত। গাড়িতে উঠে বসে প্রিয়ন্তীর কোলে মাথা রেখে শুইয়ে দেওয়া রাফিজা বেগমকে। প্রিয়ন্তী তাকে সাহস দেবার জন্য বলতে থাকে,
– আন্টি, একটু সময়। সব ঠিক হয়ে যাবে। একটু ধৈর্য ধরুন।
এ.এস হসপিটাল আরাফাতের বাসা থেকে বিশ মিনিটের দূরুত্বে অবস্থিত। কিন্তু আজ এই বিশ মিনিট যেনো পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা বিশ মিনিট লাগছে তার কাছে। মাতৃত্বের ছায়া তার জন্য অনেক কিছু। তার বাবা-মা সব কিছুই এই খাটাশ মহিলাটি। এই মহিলাটি তার কাছে বাড়ির ছাঁদের মতো। মহিলাটির কিছু হলে দুনিয়াটাই শেষ হয়ে যাবে তার। মাথার উপর অনাথ লেভেলটা পারমানেন্ট হয়ে যাবে। বাবা যখন মারা যায় তখন আরাফাতের বয়স দশ। এই মা একা হাতে তাকে এতো বড় করেছেন। এই মা না থাকলে তার দুনিয়াটাই অন্ধকার হয়ে যাবে। তখন ক্লান্ত শরীরে কার কোলে মাথা রাখবে সে, কাকে বলবে মা আমার ইউনিফর্ম ধুয়ে দাও। আচ্ছা সে কি ছেলে হিসেবে খুব নালায়েক? সকাল বেলা আজ জীবনে প্রথম তার কথার বিরুদ্ধে কাজ করেছে। সেটার শাস্তি কি পাচ্ছে? এদিকে আরশাদ হাতে হাত ঘসছে, খুব অপরাধী লাগছে নিজেকে। এই বিয়ে নিয়ে মার সাথে কত দুর্ব্যবহার না করেছে সে। কিন্তু আজ মাকে এই অবস্থায় দেখে যেনো দুনিয়াটা অন্ধকার লাগছে। মার কিছু হবে না তো!! এই পথ যেনো শেষ হবার নাম ই নিচ্ছে না। গাড়ির চলছে, গন্তব্য এ.এস হাসপাতাল।
রাত তিনটা,
সিসিউ তে ভর্তি করা হয়েছে রাফিজা বেগমকে। ঔষধ, ইঞ্জেকশন এবং ঘুমের ঔষধ খাওয়িয়ে ব্যাথা প্রশমণ করা হয়েছে। প্রিয়ন্তী ডিউটি ডাক্তারকে কিছু জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন,
– উনার ইজিসি নরমাল, কাল সকালে কিছু টেস্ট করবো৷ এটা কি হার্ট এটাক ছিলো কিনা সেটা টেস্টের পর বুঝা যাবে। তবে আমার মনে হচ্ছে এটা হার্ট এটাক ই ছিলো
– উনার তো তেমন হিস্ট্রি নেই।
– হিস্ট্রি নেই বলে, কখনো হবে না। এমন তো কথা নেই। সিসিউ তে এডমিট থাকুন। কালকে টেস্টের রিপোর্ট আসলে আমি তোমাকে ইনফর্ম করে দিবো।
– আমি আজ থাকি তাহলে?
– না না প্রিয়ন্তী, তুমি চলে যাও। আমরা আছি তো। বাই দ্যা ওয়ে উনি কি হন তোমার?
– আমার মাদার ইন ল
– তুমি বিয়ে করেছো? কবে?
মাদার ইন ল কথাটা কিছু না ভেবেই বলে দিয়েছে প্রিয়ন্তী। প্রিয়ন্তীর কথার পিঠে প্রশ্নটি করে মেয়েটি। মেয়েটি প্রিয়ন্তীর কলিগ, প্রিয়ন্তী ওয়ার্ডের ডিউটিতে থাকে আর মেয়েটি সিসিউ তে। প্রিয়ন্তী বেশ ইতস্তত বোধ করছে। কি উত্তর দিবে সে। বিয়েটা হুট করেই হয়ে গেছে। সে চাচ্ছিলো না হাসপাতালে কথাটা ছড়াক। আমতা স্বরে বলে,
– বেশি দিন হয় নি, ঘরোয়া ভাবে হয়েছে তো।
– কংগ্রেচুলেশনস।
– থ্যাংক্স
ডিউটি ডাক্তারের সাথে কথা বলে বের হতেই আরাফাত ছুটে আসে তার কাছে। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে,
– মা, কেমন আছে?
– ঘুমোচ্ছেন
– কি হয়েছিলো? হুট করে এতো ব্যাথা?
– বুঝতে পারছি না, ইসিজি নরমাল। এখন কাল কিছু টেস্ট করতে হবে। তবে হয়তো আন্টির হার্টের কোনো সমস্যা হয়েছে। আই এম নট সিওর নাও হতে পারে।
আরাফাতের চোখ ছলছল করছে। পা যেনো অবশ লাগছে। প্রিয়ন্তী তার হাত ধরে ধীর কন্ঠে বলে,
– ধৈর্য রাখুন, ইনশাআল্লাহ কিচ্ছু হবে না। আন্টি ঠিক হয়ে যাবেন। আল্লাহ রোগ দিয়েছেন, তার নিস্তার ও দিয়েছেন। ধৈর্য ধরুন, ভেঙ্গে পড়বেন না। আন্টি এবং আরশাদের জন্য ভেঙ্গে পড়বেন না। আপনি তাদের জন্য সেই খড়কুটো যাকে আকড়ে তারা আছেন।
প্রিয়ন্তীর কথায় একটু সাহসের আলোর উদয় হয় মনে। চোখ মুছে নেয় আরাফাত। লোকটার এমন মুখ দেখতে একেবারেই রাজী নয় প্রিয়ন্তী। আরাফাতের মুখের সবথেকে আকর্ষণীয় ব্যাপারটা হলো তার স্বচ্ছ হাসি। কোনো পুরুষ এতো সুন্দর করে হাসতে পারে এটা যেনো তার ইহজীবনে অজানা ছিলো। এই হাসিতে কোনো কলুষতা নেই। আজ সেই হাসিটা ম্লান হয়ে রয়েছে। দুশ্চিন্তার ভাজে হাসি যেনো কোনো অজানায় হারিয়ে গিয়েছে। এটাই বাস্তবতা, চিরন্তন সত্যি।
_______________________________________________________________________________________
সকাল ৯টা,
সিসিউ তে মোটামুটি তুলকালাম অবস্থা। রাফিজা বেগম মোটেই থাকবেন না এই হাসপাতালে। হাসপাতাল শুনলেই তার গা গুলোয়। রক্তের পরীক্ষা করতেও হাসপাতালে আসতে চায় না সে। অথচ এই খানে এই নিয়ে দুদিন হয়ে গিয়েছে তিনি রয়েছেন। ছাড় পাবার নাম নেই। তার দৃঢ় বিশ্বাস এটা প্রিয়ন্তীর চাল৷ সে ইচ্ছে করে তাকে এই কারাগারে রেখে দিয়েছে। তাই ছাড়া পাবার উপায় একটাই সবাই কে জ্বালিয়ে অতিষ্ঠ করা। এদিকে ডিউটি ডাক্তার অতিষ্ঠ হয়ে প্রিয়ন্তীকে ফোন লাগায়। ডিউটি ডাক্তারের ফোনে ছুটে আছে প্রিয়ন্তী। প্রিয়ন্তী আসতেই হিনহিনে কন্ঠে বলে উঠে রাফিজা বেগম,
– এই মেয়ে এতোক্ষণে আসার সময় হলো।
– আন্টি কি হয়েছে?
– ওদের বলো আমাকে ছেড়ে দিতে।
– ওরা কি আপনাকে ধরে রেখেছে?
– আজিব তো আমি বাসায় যাবো।
– আন্টি আপনি সুস্থ হয়ে গেলেই আপনাকে রিলিজ দিয়ে দিবে।
– এই মেয়ে আমি কি অসুস্থ নাকি, আমাকে এই রোগাটে মানুষদের মাঝে রেখে দিয়েছো। আমি এখন ই বাসায় যাবো। আমার বাবুরা না জানি কি খাচ্ছে এই দুদিন কি জানে।
– ওরা কি কচি খোকা নাকি, বড় বড় ধামড়া ছেলে। ওদের নিয়ে আপনার চিন্তা করা লাগবে না।
– এই মেয়ে তুমি কি বেশি বুঝো নাকি। ওরা আমার রান্না বাদে খায় না। আমাকে তুমি এখনই রিলিজ দাও। নয়তো তোমার নামে আমি কেস করবো। শ্বাশুড়ি মা নির্যাতন কেস। তুমি একটা দজ্জাল
– আপনার যা খুশি করুন। পরশুর আগে আপনার রিলিজ হবে না।
– এটা কি মামদোবাজি নাকি
– যদি সেটা মনে করুন তবে তাই। এই সালেহা, ঘুমের ঔষধ দাও তো উনাকে। আর আপনি, আর একবার যদি কাউকে জ্বালিয়েছেন। আমি আরো একদিন এক্সট্রা আপনাকে এখানেই আটকে রাখবো। আর আপনার বাসা কবজা করে নিবো বুঝলেন? সাবধান
প্রিয়ন্তীর ধমকের স্বরে বলা কথাগুলো তড়িতের মতো কাজ করলো। রাফিজা বেগম আর একটা কথাও বললেন না। সব চোটপাট যেনো ফুস হয়ে গেলো। সিসিউ এর কেবিন থেকে বের হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো প্রিয়ন্তী৷ মার বয়সী মহিলাকে ব্লাকমেইল করা লাগছে। সেও অপারগ, টেস্টের রিপোর্টগুলো ততোটা ভালো নয় রাফিজা বেগমের। কন্সাল্টেন্ট ডাক্তার এনজিওগ্রাম করাতে চেয়েছেন। তিনি কাল সেই সময়টা দিয়েছেন। তাই তাকে সিসিউ তে এডমিট রাখা। কিন্তু সে তো বুঝতেই চায় না। মাথাটা প্রচন্ড ধরে গিয়েছে রাফিজা বেগমের সাথে ঝগড়া করে। আরাফাত ই পারে তাকে ঠান্ডা করতে। একটু পর সে আসবে ভিজিটিং এর জন্য। তখন যদি তাকে একটু বুঝানো যায়। চিন্তাগুলো লিফটে কল করে প্রিয়ন্তী। ওয়ার্ডে যাবে সে। লিফট এগারো তম ফ্লোরে আসলে খুলে যায়। লিফট খুলতেই প্রিয়ন্তীর পা জোড়া বরফ হয়ে যায়। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। লিফট থেকে তখন.………..
চলবে
[ সরি দেরি করে দিলাম। তবে আমি আমার কথা রেখেছি। বড় করে পর্বটি লিখেছি। পরবর্তী পর্ব আগামীকাল রাতে ইনশাল্লাহ পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না]
মুশফিকা রহমান মৈথি
আরোও_একবার_বসন্ত
#২১তম_পর্ব
চিন্তাগুলো ঝেড়ে লিফটে কল করে প্রিয়ন্তী। ওয়ার্ডে যাবে সে। লিফট এগারো তম ফ্লোরে আসলে খুলে যায়। লিফট খুলতেই প্রিয়ন্তীর পা জোড়া বরফ হয়ে যায়। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। লিফট থেকে তখন একজন লোক বেড়িয়ে আসে। আজ চারটি বছর পর লোকটিকে পুনরায় দেখছে প্রিয়ন্তী। পৃথিবীটা সত্যি গোল। সেই ঘুরেফিরে অতীতটা সামনে চলে এলো। লিফট খুলে আবার বন্ধ হয়ে নিচে চলে গেলো, প্রিয়ন্তীর সেদিকে খেয়াল নেই। সে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। মস্তিস্ক বন্ধ হয়ে আসছে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। প্রিয়ন্তীর বোধ হতে লাগলো কেউ তার বুকটা চেপে বসে রয়েছে। কষ্ট হচ্ছে, গলা যেনো শুকিয়ে আসছে। পানি পেলে ভালো হতো। শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। মানুষটি তার দিকে এগিয়ে আসছে। চার বছর পুরোনো স্মৃতিগুলো পুনরায় সেলুলডের ফিল্মের মতো চোখের সামনে চলে এসেছে। সে মূহুর্তগুলো যা কখনো প্রিয়ন্তীকে হাসিয়েছে, কখনো কাঁদিয়েছে, কখনো পুরুষ জাতির উপর ঘৃণা তৈরি করে দিয়েছিলো। ইরফানকে আজ চারটি বছর পর দেখছে সে। ইরফান নামক মানুষটিকে শেষ দেখেছিলো তাদের ডিভোর্সের শুনানির সময়। অনেকটা বদলে গিয়েছে লোকটা। মুখে বার্ধক্যের ছাপ পড়েছে। কত হবে বয়স সাইত্রিশ কি আটত্রিশ। কিছু কিছু চুল পাক ধরেছে। এখন চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা পড়ে সে। আগের মত বলবান নেই সে। একটু কুজো হয়ে গেছে, চোখের নিচে কালি। দেখেই বোঝা যাচ্ছে মানুষটা ভালো নেই। কিন্তু কেনো? তার তো ভালো থাকার কথা। সুখ তো প্রিয়ন্তী তাকে দিতে পারে নি। তার তো সুখে থাকার কথা। কারণ প্রিয়ন্তী তার জীবনে নেই। আর সবচেয়ে বড় কথা সে এখানে কেনো? তবে কি তার বউ ও সাথে আছে? না আর চিন্তা করতে পারছে না। এখান থেকে পালিয়ে যেতে পারলে হয়তো খুব ভালো হতো। প্রিয়ন্তী খুব দ্রুত পা চালালো। পাশ কাটিয়ে তাড়াতাড়ি লিফট আবারো কল করলো। কিন্তু লিফট আসতে বেশ দেরী হচ্ছে। ইরফান খুব এলোমেলো ভাবে চলছে। সে হয়তো খেয়াল ও করে নি তার আশেপাশে কে আছে! হুট করে প্রিয়ন্তীর মনে হলো আরাফাত থাকলে হয়তো ভালো হতো। আরাফতের কথা মনে পড়তেই মনে জমায়িত কালো মেঘের আস্তরণ সরতে লাগলো। সে এতো ভয় পাচ্ছে কেনো? তার সাথে এই লোকটার কোনো সম্পর্ক নেই। আর সবথেকে বড় কথা তার ও বিয়ে হয়ে গেছে। সে তো আর একা নেই। তাহলে কিসের এতো কষ্ট। লোকটা তো তার অতীত। কালো অতীত যে অতীত চার বছর আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো। না সে ভয় পাবে না। আর এখন না হলেও কোনো না কোনো সময় তো এই অতীত তার সামনে আসতোই। তাকে শক্ত হতে হবে, শক্ত হতে হবে। যাতে কেউ তাকে ভাঙতে না পারে। আর ভাঙবে না সে। মনে মনে বলতে লাগলো,
“ বি স্ট্রং প্রিয়ন্তী, বি স্ট্রং। সে কমপ্লিটলি স্ট্রেঞ্জার একটা মানুষ। তুই চিনিস না তাকে। কিসের ভয় তোর। গত পরশু রাতের কথা মনে কর। তোর জীবনেও বসন্ত এসেছে। এটা একটা দুস্বপ্ন মাত্র”
মনকে সাহস দিতে দিতেই লিফট চলে আসলো। লিফট খুলতেই প্রিয়ন্তী ভেতরে ঢুকার চেষ্টা করলো। তখনই কানে আসলো,
– প্রিয়ু!
ডাকটি আজ একসময় বেশ ভালো লাগতো প্রিয়ন্তীর। এক অন্যরকম মায়া ছিলো ডাকটিতে। আর কন্ঠটি শুনতেই পা জোড়া আটকে গেলো তার। চার বছর পর এই কন্ঠ শুনছে সে। চারটা বছর, কম নয় এক হাজার চারশত ষাট দিন। বুক থেকে অচিরেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো প্রিয়ন্তীর। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকালো সে। চোয়াল শক্ত করে নিলো। পেছনে ফিরে দেখলো মুখে ম্লান হাসি একে ইরফান দাঁড়িয়ে আছে। নিজেকে শক্ত রেখে প্রিয়ন্তী বললো,
– জ্বী আমাকে ডাকলেন?
– এখানে তো আর কোনো প্রিয়ু নেই। কেমন আছো?
– আমার প্রিয়ন্তী, ডা. প্রিয়ন্তী আহমদ। প্রিয়ু নামটা আমার প্রিয় মানুষেরা ডাকে। সুতরাং ঠিক করে আমাকে সম্বোধন করুন। বলুন কিভাবে সাহায্য করতে পারবো?
– তুমি এমন একটা ভাব করছো যেনো আমরা অচেনা মানুষ।
– হ্যা, উই আর কমপ্লিটলি স্টেঞ্জারস। তাই সেভাবেই কথা বলা উচিত নয়? বলুন কিভাবে সাহায্য করতে পারি?
– সাহায্য? আদৌ কেউ করতে পারবে কি না সন্দেহ!
ইরফানের কন্ঠে বেদনার ছাপ, তার চোখ বলে দিচ্ছে সে অসহায়। সে ভালো নেই। কিন্তু প্রিয়ন্তীর জানতে ইচ্ছে হলো না তার কি হয়েছে? তার প্রতি সহানুভূতি অনুভব হচ্ছে কিন্তু সে মায়া, ভালোবাসাটা যেনো মরে গেছে। দয়া হচ্ছে লোকটার প্রতি। হসপিটাল এমন একটা স্থান যেখানে অসহায় না হলে মানুষ আসে না। খুব অসহায় ব্যাক্তিরাই হাস্পাতালে আসে। ম্লান হাসি টেনে ইরাফান বললো,
– বললে না তো কেমন আছো?
– আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো আছি। আপনি?
– আছি, আসলে সামিহা অসুস্থ। হসপিটালে এডমিট। তাই দৌড়াদৌড়িতে আছি।
– ওহ! আচ্ছা থাকুন, আমি আসছি
বলে যেতে নিলেই হাতটা টেনে ধরে ইরফান। প্রিয়ন্তী ভ্রু কুচকে কড়া ভাবে তাকাতেই হাতটি ছেড়ে দিলো সে। ইতস্তত স্বরে বললো,
– তোমার একটু সময় হবে? কিছু কথা বলার ছিলো
– না আমার সময় হবে না, খুব ব্যাস্ত রয়েছি। একদম সময় হবে না।
– বেশী না আধা ঘন্টা হলেও হবে। একটু কথা ছিলো। না বলতে পারলে আর কখনো বলা হবে না হয়তো?
– দেখুন মি. আমার অনেক কাজ থাকে। আমি না এখানে মুখ দেখানোর টাকা পাই না। যে আপনি বললেই আমি সময় বের করে দিবো। আর আপনার কি মনে হয় আমি এখনো সেই আগের মানুষটি আছি। আপনার চ্যাটামচুটাম কথায় গলে যাবো, আর সব ফেলে আপনার পিছু নিবো। আমাদের পথ আলাদা ইরফান। একেবারেই আলাদা। আর আপনার না বউ অসুস্থ। তাহলে আমার কি চাই আপনার? আমার সাথে যা করেছেন অন্তত সেই মেয়েটার সাথে সেটা করবেন না। আসছি
বলেই হাটা দিলো প্রিয়ন্তী। দম বন্ধ লাগছে, খুব কষ্ট হচ্ছে তার। এখান থেকে সরে গেলে হয়তো দু দন্ড শ্বাস নিতে পারবে সে। ইরফান ফ্যালফ্যাল নজরে তাকিয়ে রইলো। তার চোখে অনুতাপের ছাপ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামিহার কেবিনের দিকে রওনা দিলো সে। দৃশ্যটা সবার দৃষ্টি এড়িয়ে গেলেও একজনের নজর এড়ালো না। হাতটা মুঠ করে নিজেকে শান্ত করলো। তারপর হাটা দিলো নিজের গন্তব্যের দিকে
____________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________
বিকেল ৫টা,
রাফিজা বেগমের সামনে বসে রয়েছে আরাফাত। রাফিজা বেগম ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছেন। আর সে মায়ের কান্নাগুলো চুপচাপ শুনে যাচ্ছে। সেই যে সকালে ঘুমের ঔষধ দিয়ে ঘুমিয়েছিলেন। এখন ঘুম ভেঙ্গেছে। সকালে তার বাবুর সাথেই দেখা হয় নি। নালিশ জমে গেছে এক সাগর। হিচকি তুলতে তুলতে বললেন,
– জানিস বাবু, তোর বউ আমাকে ঘুমের ঔষধ দিয়েছিলো। এখানে কিছুক্ষণ পর পর আমার রক্ত সিরিজ দিয়ে নিয়ে যায়। কাল নাকি কি একটা টেস্ট করাবে। পা দিয়ে নল ঢুকাবে। বাবুরে আমাকে নিয়ে যা না বাসায়। তোর দজ্জাল বউ। খুব খারাপ ও। আমাকে বকে জানিস।
– কাঁদে না মা, আমি ওকে বকে দিবো। তুমি কেঁদো না। আর ও তো ডাক্তার। ও তো তোমার চিকিৎসা করছে
– ছাতার মাথা চিকিৎসা, উট্টিন্না মাইয়া। ও চিকিৎসার কি বুঝে! ভুলভাল সব কিছু করছে।
– মা, ও তো তোমার ডাক্তার না। ও তো সিসিউ এরো ডাক্তার নয়। তাহলে কি সমস্যা?
– তুই তো বাচ্চা মানুষ তুই বুঝবি না। ও সবাইকে শিখিয়ে দিয়েছে। বাবু আমি বাসায় যাবো
– মা তুমি বাচ্চা হয়ে গেলে? উফফফফ ঠান্ডা হও। কালকের ওই টেস্টের পর ই তোমাকে বাসায় নিয়ে যাবো। খুব সামান্য একটা টেস্ট। আমি ওর কথা শুনে করছি না। খুব ভালো একজন ডাক্তারের কথা শুনেই করছি। ওই যে সকালে তোমাকে যেই ডাক্তার দেখে গিয়েছিলো। বলো ওতো বড় ডাক্তার কি কিছুই পারে না? বলো?
– না উনি ভালো ডাক্তার। আচ্ছা, আমার কি বড় রোগ ধরা পড়েছে বাবু? হার্টের রোগের চিকিৎসা তো অনেক খরচা। তোরা তো জানিস না, এই হাসপাতালটা ও অনেক খরচার। আমি চাই না শুধু শুধু তুই টাকা খরচ করিস। কিভাবে পারবি তুই বাবু? শোন আমার ডিপিএসটা ভেঙ্গে ফেল। দেখবি একটু দম নিতে পারবি। তিনটা দিন এই আইসিউ তে উপরে এই টেস্ট ওই টেস্ট। পঞ্চাশ তো খরচ হয়েই গেছে মনে হয়।
– মা, কেনো চিন্তা করছো? আমি আছি তো। আর আরশাদ ও ইনকাম করছে। তুমি চিন্তা করো না। তোমার তেমন কিছুই হবে না। এইজন্য ঐ টেস্টটা করে নিচ্ছি যাতে আগ থেকেই ভালো ভাবে চিকিৎসা শুরু করতে পারি। তুমি চিন্তা করো না। তোমার বাবু আছে তো।
– ওর কথা তো বলবি না। ওই হারামজাদা একবার ও আসলো না।
রাফিজা বেগম এই তিনদিন আইসিউ তে আছেন, কিন্তু এই তিনদিন শুধু আরাফাতের সাথেই তার দেখা হয়েছে। আর প্রিয়ন্তী টানা চব্বিশ ঘন্টা ডিউটি নিয়ে এই তিনদিন তার খেয়াল রাখছে। প্রিয়ন্তীকে সে চাইলেও বেশি গাল্লাতে পারছেন না। কারণ মেয়েটা এই তিনদিন বাসায় ও যায় নি। কিন্তু এই তিনদিনে আরশাদ একবারো তার সামনে আসে নি। তার খুব ক্ষোভ জমে গিয়েছে আরশাদের উপর। তাই অভিমানী গলায় কথাগুলো বললেন। উনার অভিমানী কথা শুনে হেসে দেয় আরাফাত। হাসি থামিয়ে বললো,
– তোমার ছেলে তো একেবারেই তোমার মতো। প্রতিদিন আসে, এসে বাহিরে বসে থাকে। তার তোমার কাছে আসতে অপরাধবোধ হয়। এখনো বাইরে বসে আছে। শাস্তি দিচ্ছে নিজেকে। জানো রুপন্তীর নাম্বারও ডিলেট করে দিয়েছে। তার সাথে সকল যোগাযোগ বন্ধ। তোমার অনুমতি ছাড়া কিছুই করবে না সে। আচ্ছা মা, প্রিয়ন্তী কি খুব খারাপ মেয়ে?
হুট করে আরাফাতের প্রশ্নটি শুনে হতচকিত হয়ে উঠেন রাফিজা বেগম। কিছু বলতে যাবেন তখনই……………
চলবে
[ পরবর্তী পর্ব আগামীকাল রাতে ইনশাল্লাহ পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না]
মুশফিকা রহমান মৈথি