#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির
[পর্ব-২৭]
ড্রয়িংরুমে সকলে উপস্থিত থাকলেও আবরারের অনুপস্থিতি লক্ষ্য করলো রোশান। গম্ভীর চোখেমুখে আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো আবরারের। কিন্তু আবরার নিচে আসছে না। তাই তাকে ডেকে আনার জন্য আরিয়ানকে পাঠালো উপরে। মেরুন কালার ব্লেজার টা ঠিক করে দ্রুত পায়ে আবরারের রুমে আসলো আরিয়ান। দেখলো আবরার ডিভানের উপরে আধশোয়া অবস্থায় ল্যাপটপ চালাতে ব্যস্ত।
‘ভাই? সবাই কখন থেকে ওয়েট করছে। তুমি এখনো রডি হও নি?’
আরিয়ানের কথা কর্ণকুহর হলো আবরারের। কিন্তু প্রতিক্রিয়া দেখালো না। ল্যাপটপ চালাতে চালাতেই প্রত্যুত্তর করলো, ‘আমি কি একবারো বলেছি যে যাবো? তাহলে নিচে আমার জন্য ওয়েট করার কোনো মানে দেখছি না।’
আরিয়ান অত্যন্ত শান্ত ভাবে বললো, ‘ভাইয়া প্লিজ। সিনক্রিয়েট চাই না। আসো আমাদের সাথে।’
আবরার নির্বিকার ভাবে ল্যাপটপ বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো। আড়মোড় ভেঙ্গে বিছানার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে শুধাল, ‘আমাকে জোর করে তোরা সিনক্রিয়েট করিস না।’
বলেই বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পরলো। আরিয়ান কিছু বলতে যাবে তার আগেই আবরার বলে উঠলো, ‘আর হ্যাঁ! তোর অতিশয় ভদ্র বাপ কে বলে দিস। তার সাথে কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা এই আবরার জুহায়ের নেই।’
‘কিন্তু ভাই..’
আরিয়ানের কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই আবরার কিছুটা রাগ মিশ্রিত গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘আরিয়ান??’
আরিয়ান আর কিছু বললো না। চুপচাপ হতাশার নিশ্বাস ফেলে দরজা ভিড়িয়ে চলে গেলো। বাবা ভাইয়ের এই মনোমালিন্য তাকে বিষিয়ে তুলেছে। ভালো লাগে না একদম। আগের প্রাণোচ্ছল শান্তি নিবাস এখন তার ভাই আর বাবার আড্ডা ছাড়া মৃ:ত। তপ্ত শ্বাস ফেলে নিচে আসলো। তাকে একা নিচে আসতে দেখে হোসেন জানতে চাইলো, ‘আবরার কোথায়? আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবো?
আরিয়ান জবাব দিলো, ‘আরব ভাই যাবে না।’
রোশান গম্ভীর মুখে আরিয়ানের দিকে তাকালো একবার। প্রতিক্রিয়া না করে চুপচাপ বাহিরে যাবার জন্য পা বাড়ালো। হোসেন চোখের ইশারায় সবাইকে যেতে বললো। তখুনি নিশিতা অভ্র আর আরিয়ানকে সাবিতের কথা বলতেই আরিয়ান জানায় সাবিত তার একটা কাজে আরো আগেই বেড়িয়ে গেছে। কাজ শেষে সরাসরি রেস্টুরেন্টে চলে আসবে। অতঃপর সবাই মিলে গাড়িতে উঠলো। রোশান, নিশিতা, অভ্র, রাইমা ও দীবা বসলো একটা গাড়িতে। অপর গাড়িতে হোসেন, আরিয়ান, রিমি ও নুরা।
_____________________
রজনীর প্রথমভাগ। বিশালাকৃতির চাঁদটা থালা ন্যায় ঝলঝল করছে দূর আকাশে। চার তলায় সজ্জিত বিল্ডিংয়ের উপর জ্যোৎস্নার আলো পরে সৌন্দর্য করেছে দ্বিগুণ। গাড়ি থেকে নামার পর রাজিব এসে ভদ্রতার সাথে ভিতরে নিয়ে গেলো সবাইকে। দীবা, নুরা ও রিমি মুগ্ধ চোখে দেখছে। ছোট ছোট ঝাড়বাতি তে সজ্জিত চারপাশ। রঙবেরঙের মোমবাতি জ্বলছে আপন মনে। রেস্টুরেন্টের তৃতীয় তলায় এসে দেখলো এখানে অনেকে উপস্থিত। সবাই অনুমান করে নিলো এরাই রাজিবের পরিবারের লোকজন। তবে অপরিচিত মানুষের মাঝে পরিচিত একজনের মুখ দেখে বিস্ময়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে রিমি, নুরা ও দীবা। অবাক হওয়ার কারণটা হচ্ছে রাইমার শ্বশুরের পাশে তাদের কলেজ টিচার মুনতাহির রাজ। তাকে দেখে যতোটুকু না বিস্মিত হলো ; তার থেকেও হাজার গুন বিস্মিত হলো এটা শুনে যে রাজ রাজিবের আপন ছোট ভাই। তিনজন একে অপরের দিকে প্রথমে হতভম্ব হয়ে তাকালো। পরক্ষনে ফিশফিশ করে নিজেদের শান্ত্বনা দিলো, ‘আত্মীয় হবে যেহেতু পরিক্ষায় মার্ক একটু বাড়িয়ে দিতে পারে! আমাদের লস বৈকি লাভ-ই হলো।’
নুরা উপরে নিজেকে স্বাভাবিক রাখলেও ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে আছে তার মন। ঘনঘন ভারি নিশ্বাস তাকে আড়ষ্ট করে তুলছে। অদ্ভুত অজানা এক কারণে রাজের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না। কারণটা তার সত্যি অজানা। তবে রাজের গেটআপ দেখে মনে মনে আকাশ সমান ভালোলাগা কাজ করছে তার। রক্তিম হচ্ছে গাল। লজ্জাভূতি হচ্ছে সে।
রোশানকে ভিতরে আসতে দেখে আফজাল ও রাজ এগিয়ে আসলো। আফজাল প্রথমে কুষলবিনীময় করে রাজের সাথে রোশানের পরিচয় করিয়ে দিতে বললো, ‘এইযে আমার ছোট ছেলে রোশান। মুনতাহির রাজ। ওর কথাই সেদিন বলেছিলাম।’
রাজ নম্রতার সাথে এক হাত এগিয়ে দিয়ে রোশানের সাথে হাত মিলিয়ে সালাম দিলো। সংক্ষেপে কুষলবিনীময় ঘটালো। কথার এক পর্যায়ে রোশান বলল, ‘রাজের সাথে তো আগেও পরিচয় হয়েছিলো আফজাল। রিমিদের কলেজের টিচার। ওদের মার্কশিট আনতে গিয়ে পরিচয় হয়েছিলো আমাদের।’
রাজ মিষ্টি করে মৃদু হাসি দিলো একটা। আফজাল এবার মহা খুশি হয়ে বললো, ‘তাহলে তো ভালোই পূর্ব পরিচিত তোমরা। সম্পর্ক করতে আরো সুবিধে হবে। হাহা!’
বলেই একা একা হাসতে লাগলো আফজাল। মেয়েরা কথাটার অর্থোদ্ধান করতে না পারলেও অন্যরা ঠিকই ধরতে পারলো। অভ্র আরিয়ানের দিকে সূক্ষ্ম চোখে তাকাতেই আরিয়ান হালকা গলার টাই ঠিক করে একটু নড়েচড়ে দাঁড়ালো। দুইজন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। আরিয়ান পকেট থেকে মোবাইল বের করে আবরারকে ম্যাসেজ পাঠিয়ে দিলো একটা।
‘আফজাল হোসেনের ছোট ছেলে মুনতাহির রাজ। দীবার ক্লাস টিচার। ভাই, আসো নি ভালো করেছো। আলাপ করতে সুবিধে হচ্ছে।’
ম্যাসেজটা পাঠিয়েই অভ্রের দিকে সকলের অগোচরে মোবাইল কাত করে দেখালো আরিয়ান। অভ্র চোরা চোখে ম্যাসেজ টা দেখে ঠোঁটে ঠোঁট টিপে মনে মনে হাসলো। তার ঠিক কয়েক মিনিট পরেই অভ্রের মোবাইলে কল আসলো। মোবাইল বাইব্রেশন থাকায় টের পেলো সে। হাসি পেলো দুজনের। অভ্র পকেট থেকে মোবাইল বের করে কল রিসিভ না করে ছোট করে ম্যাসেজ দিল, ‘কোনো দরকার স্যার?’
আবরার সাথে সাথে রিপ্লাই করলো, ‘রাজ কে? বাবার সাথে কি কথা হচ্ছে তাদের? কোথায় তোমরা?’
অভ্র নিজের হাসি ধরে রাখতে বৃথা চেষ্টা করছে। নিজেকে আর সামলাতে পারলো না। সবার উদ্দেশ্যে ‘এক্সকিউজমি!’ বলে সড়ে এলো। দ্রুত পা চালিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো অভ্র। সে যেতেই আরিয়ান মাথা চুলকে সবার উদ্দেশ্যে বলল, ‘আমিও আসছি।’
কথাটা বলে কাউকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে অভ্রের পিছু গেলো। সবাই ব্যাপার টা স্বাভাবিক ভাবে নিলেও রিমি ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। অভ্রের পর আরিয়ানের যাওয়ার ব্যাপার টা তার সন্দেহ লাগলো। তাই দীবার দিকে হালকা ঝুকে ফিশফিশ করে বলে উঠলো, ‘দুইজন একই সাথে ওয়াশরুমে কি করবে?’
দীবা কোল্ডড্রিংকে চুমু দিতে নিয়ে ভিমরি খেয়ে খুকখুক করে কেশে উঠলো। নিজেকে অল্প সময়ে সামলে নিয়ে রিমির উদ্দেশ্যে বলল, ‘ওয়াশরুমে গিয়ে মানুষ কি করে? ইডিয়ট নাকি তুই।’
দীবার প্রত্যুত্তর শুনে রিমি বুঝলো সে অন্যদের মতোই ব্যাপার টা স্বাভাবিক নিয়েছে। কিন্তু অভ্র আরিয়ানের মিটমিট হাসি, অগোচরে মোবাইল দেখা, দুইজন একই সাথে ওয়াশরুমে যাওয়ার ব্যাপার মোটেও স্বাভাবিক না। মাথায় এইসব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তার। বিরক্ত হলো কিছুটা। সে এইসব নিয়ে ভাবছে কেন সে? আশ্চর্য! ‘
ওয়াশরুমে এসেই উচ্চ হাসিতে মেতে উঠলো অভ্র আরিয়ান। হাসি দুজনের থামছেই না। অবস্থা আরো গুরুতর করতে আরিয়ান আবরার কে আবারো ম্যাসেজ দিলো, ‘ছেলেটা দীবার কলেজের লেকচারার। আব্বুর পরিচিত। দেখতেও সুন্দর। দীবাও বোধহয়….! ”
এইটুকু লিখে ডট ডট দিয়ে দিলো আরিয়ান। হেসে ফেললো অভ্র! এইটুকু বার্তা পেয়েই অস্থির হয়ে উঠলো আবরার। বাড়িতে কেউ না থাকায় একা একা বসে চিল করছিলো সে। উল্লাসিত মনে যখন ল্যাপটপে ব্যস্ত ; তখনই আরিয়ানের ম্যাসেজের আগমন ঘটলো। এমন উদ্ভট ম্যাসেজ দেখে আরিয়ানের নাম্বারে ডায়াল করতে গিয়ে ভেবেছে হয়তো আরিয়ান মজা নিচ্ছে। তাই ডিরেক্ট অভ্রের নাম্বারে কল দিলো। অভ্র কল রিসিভ না করায় প্রকাণ্ড রকমের রাগ হলো তার। অতঃপর এক মুহূর্তও বিলম্ব করলো না। অভ্রের লোকেশন ট্র্যাক করে বেড়িয়ে গেলো রেস্টুরেন্টের উদ্দেশ্যে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নিলো ‘যদি রোশান এমন কোনো কাজ করে থাকে তাহলে সে ছাড়বে না কাউকে।
রাজিবের রেস্টুরেন্ট আগ্রাবাদ হওয়ায় আবরারের সুবিধে হলো বেশ। সেখানে পৌঁছাতে বেশি সময় লাগে নি। লোকেশন মোতাবেক সঠিক স্থানে পৌঁছাবার পর গাড়ি থেকে নেমেই দ্রুত পা চালিয়ে উপরে আসলো। রিসিপশনের লোকটার কাছ থেকে জেনে তৃতীয় তলায় আসলো। বড় একটা ডাইনিং টেবিলে সবাই একত্রে বসে খাবার খাচ্ছে। রোশানের পাশে বসেছে দীবা। রোশানের ঠিক সামনে বসেছে রাজ। যদিও আবরার প্রথম দেখায় রাজকে চিনতে পারে নি। তাকে দেখে হোসেন হেসে কাছে ডাকলো। আবরার এগিয়ে আসার পর আফজালের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো রোশান। আবরার সাবলীল ভাবে হাত মিলালো। পরিচয় হলো রাজিবের পরিবারের সাথে। আবরার হোসেনের পাশের চেয়ারে বসলো। প্রথমেই তাকালো দীবার দিকে। নীল রঙের হিজাবে দীবাকে ভীষণ কিউট লাগছে। তবে মুগ্ধ হওয়ার বদলে ক্ষুব্ধ হলো আবরার। আজ কেন এতো সুন্দর করে সেজে আসতে হলো মেয়েটার? রুক্ষ চোখে দীবার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে রাজের দিকে তাকালো। হেসে হেসে কথা বলছে সবার সাথে। দেখতেও খারাপ লাগে নি আবরারের। হয়তো তার সমবয়সী হবে কিংবা কয়েকবছরের ছোট। যেহেতু দীবাদের কলেজের টিচার ; সেহেতু দীবা রাজের সম্পর্কে কিছুটা হলেও অবগত। যদি সত্যি সত্যি রাজি হয়ে যায়? নিজের এমন ভাবনায় নিজেই চমকালো আবরার। ভয়ার্ত হলো মন। যে করেই হোক দীবার মনে নিজের জায়গা করে নিতে হবে।
সকালের ঘটনার কারণে আবরারকে দেখেই লজ্জা পাচ্ছে দীবা। এখন ভুলেও চোখ তুলে আবরারের দিকে তাকাচ্ছে না। চুপচাপ নিজেকে স্বাভাবিক রেখে খাবার খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। এক পর্যায়ে টেবিলে থাকা সকল আইটেমের দিকে চোখ বুলাতে লাগলো। কোনটা খাবে ভেবে দ্বিধায় আছে আপাতত। ঠোঁট কামড়ে ভাবতে লাগলো। তাকে সম্পূর্ণ ভাবে খেয়াল করলো রাজ। যদিও কথার ফাঁকে ফাঁকে তার সম্পূর্ণ নজর, খেয়াল দীবার দিকে ছিলো। খাবার নিয়ে তার এমন দুটানা দেখে রাজ স্মিতি হেসে বিফ স্ট্রোগানোফের প্ল্যাট দীবার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘এটা নিতে পারো। এখানে বিফ স্টেক খুব ভালো বানায়।’
দীবা মুচকি হেসে রাজের হাত থেকে প্ল্যাটটা নিয়ে বলল, ‘এটা আমার অনেক পছন্দ।’
রাজ মনে মনে বলল, ‘আর আমার তোমাকে!’ কিন্তু মুখে প্রত্যুত্তরে মুগ্ধ কন্ঠে শুধাল, ‘আমারো!’ তারপর রিমি ও নুরার দিকে পাস্তা এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘তোমরাও নাও।’
রিমি জবাবে মিষ্টি হেসে পাস্তার বাটি হাতে নিলো। দীবা খুশির মনে খাচ্ছে। আশেপাশে কারোর দিকে বিন্দুমাত্র ধ্যান নেই তার। কেউ একজন যে তার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে সেটা তার কল্পনাতীত। আবরার এবার প্রকাণ্ড রকমের রাগান্বিত হলো। সবচেয়ে বেশি রাগ হলো রোশানের উপর। রাজের সাথে অতিরিক্ত ন্যাকামি সহকারে আলাপের কারণে মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে তার। দীবা তার বিবাহিত স্ত্রী তার পরেও কিভাবে রাজকে নিয়ে এইসব চিন্তা করতে পারে? চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে রইলো দীবার দিকে। প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারলো না। নিরবে বসে সহ্য করতে লাগলো।
________________
রাত্রীর দ্বি-প্রহর শেষে তৃতীয় প্রহরের সূত্রপাত ঘটলো। রাস্তাঘাট নিরব নিস্তর। পিচ ঢালা রাস্তার উপর বৃষ্টির পানির বিন্দু কণা গুলো চিকচিক করছে। আকাশের অর্ধবৃত্ত চাঁদটা ভীষণ সুন্দর লাগছে। শীতল বাতাসে বৃক্ষের নেত্রপল্লব দুলছে। হালকা হালকা শীতের আমেজ চারপাশে। তবে সহ্য করার মতো! কিন্তু দীবার এই হালকা শীতল হাওয়া নিতে পারছে না। এমনিতেই সন্ধ্যা রাত থেকে শীত শীত লাগছিলো তার। আর এখন শীতল বাতাসের কারণে তখনের তুলনায় দ্বিগুণ শীত লাগছে। গায়ে হালকা কাঁপুনি দিয়ে উঠছে বারংবার। সকালে বৃষ্টি ভেজা তার সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো। তাই এখন জ্বর এসেছে বোধহয়। ব্যাপার টা আচ্ করতে খুব বেশি সময় লাগে নি দীবার। চুপচাপ এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে। রোশান আফজালের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে আসলো। নিজেরা গাড়িতে উঠার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগলো।
.
জরুরি ইমেইল আসায় অভ্র সবার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে মোবাইলে চেক করছিলো। রিমি তার দিকে এগিয়ে আসলো ধীর গতিতে। দুই হাত পিছনে নিয়ে হাস্যউজ্জ্বল চেহারায় অভ্রের সামনে দাঁড়ালো। তাকে এখানে দেখে অভ্র মোবাইল পকেটে রেখে প্রশ্ন করলো, ‘কিছু বলবে?’
রিমি মাথা উপর নিচ নাচিয়ে ‘হ্যাঁ’ বুঝালো। তারপর দাঁত কেলিয়ে বললো, ‘আপনাকে কালো হনুমানের মতো লাগছে।’
রিমির কথা শুনে ভ্রুঁ জোড়া কিঞ্চিৎ বাঁকা করলো অভ্র। কালো হমুমান বলার কারণ হলো সে আজ ব্ল্যাক কালার ব্লেজার পরেছে। মেয়েটা ইচ্ছে করে ঝ’গ’ড়া করতে এসেছে। মনে মনে হাসলো অভ্র। পকেটে এক হাত গুঁজে সটান হয়ে দাঁড়ালো। বাঁকা হেসে তাচ্ছিল্যের সাথে বলল, ‘ঝ’গ’ড়া করার এতো সখ তোমার? বেচারা যে সারাজীবন তোমাকে কিভাবে সহ্য করবে আল্লাহ জানে।’
রিমি বুঝতে না পেরে পালটা প্রশ্ন ছুড়লো, ‘আপনি কার কথা বলছেন?’
‘তোমার জামাইয়ের কথা ইডিয়ট!’ কিছুটা বিরক্তি সহিত কথাটা বলে চলে গেলো গাড়ির কাছে। রিমি আহাম্মকের মতো তাকিয়ে রইলো অভ্রের দিকে। কথাটার অর্থোদ্ধান ও কারণ বুঝার পর দাঁতে দাঁত লেগে আসলো আপনা আপনি। চোখমুখ শক্ত করে গটগট পায়ে গাড়িতে এসে বসে পরলো।
রিমি গাড়িতে উঠার পর রোশান দীবাকে ডাকলো। দীবা একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো। শরির দুর্বল লাগছে তার। তাকিয়ে থাকার মতো স্বস্তি পাচ্ছে না চোখ দুটো। জ্বরের উত্তাপে মৃদু কাঁপুনির কারণে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি টুকু নেই দেহে। রোশানের ডাক শুনে শক্তিহীন দেহ ধীর গতিতে টেনে রোশানের কাছে আসলো। রোশান গাড়ির দরজা খুলে ভিতরে বসার ইশারা দিতেই পিছন থেকে আবরার বলে উঠলো, ‘দীবা আমার সাথে যাবে।’
দাঁড়িয়ে পরলো দীবা। হতভম্ব হয়ে পিছু ফিরে আবরারের দিকে তাকালো। রোশান গম্ভীর মুখে বলল, ‘এসেছো যেহেতু একা, সেহেতু একা-ই ফিরে যাও। দীবা আমার সাথেই যাবে।’
আবরার এগিয়ে এসে দীবার বাম হাত ধরে নিজের কাছে নিয়ে আসলো। হাতটা ধরে রেখেই এটিটিউট দেখিয়ে শুধাল, ‘আমার বউকে আমি সাথে নিয়ে যাবো নাকি অন্য কারোর সাথে যাবে সেটা আমি ডিসাইড করবো। আপনি যেতে পারেন। দীবা আমার সাথেই যাচ্ছে।’
রোশান আর কিছু বললো না। মৌনতার সাথে গাড়িতে উঠে বসলো। অন্যরাও গাড়িতে উঠতেই ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিয়ে সু-সু শব্দ তুলে চলে গেলো। গাড়ি চোখের আড়াল হতেই দীবা আবরারের হাত ঝামটা দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে উঠলো, ‘হুটহাট সবার সামনে হাত ধরা বন্ধ করেন। অস’হ্যকর!’
চলমান…#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির
[পর্ব-২৮]
প্রথমত অসুস্থতা, দ্বিতীয়ত সবার সামনে এভাবে হাত ধরা। সব মিলিয়ে দীবা মহা বিরক্ত। তাই আবরারের হাত ধরাতে প্রসন্ন হওয়ার বদলে বিরক্ত হয়ে ছাড়িয়ে নিলো। অন্য কোনো সময় হলে দীবার এই কর্মকাণ্ডে রাগান্বিত হতো আবরার। কিন্তু আজ পরিস্থিতি ভিন্ন। তাই রাগান্বিত হওয়ার বদলে বিষণ্ণবদন হলো তার মন। দীবার একদম কাছে এগিয়ে এসে দুই গালে হাত রাখলো। কপাল স্পর্শ করে বিচলিত কন্ঠে বললো, ‘তোমার শরির এতো গরম কেন? জ্বর এসেছে নাকি?’
মলিন চোখেমুখে আবরারের দিকে তাকালো দীবা। রাগ না দেখিয়ে দুর্বল হাতে আবরারের হাত দুটো নিজে থেকে সরিয়ে দিয়ে বললো, ‘আমি বাড়ি যাবো। ভালো লাগছে না আমার।’
করুণ চোখে তাকালো আবরার। কোনো প্রকার প্রতিক্রিয়া দেখালো না। চুপচাপ গাড়ির কাছে এসে দরজা খুলে দিলে দীবা উঠে বসলো। ক্লান্ত চোখ দুটো বন্ধ করে সিটে হেলান দিলো। টিকে থাকার মতো শক্তি পাচ্ছে না আর। চোখ দুটো ভীষণ ব্যাথা করছে। জ্বর আসায় শীতে কুঁকড়ে উঠছে দীবা। আবরার খেয়াল করলো। নিজের গায়ের জ্যাকেট টা খুলে গাড়িতে বসলো।
‘দেখি এদিকে আসো।’ বলেই দীবাকে টেনে কাছে আনলো। জ্যাকেট টা যত্ন সহকারে দীবার গায়ে পরিয়ে দিলো। দীবা কোনো বাধা দিলো না। কথা বলার ইচ্ছেও নেই তার। তাই চুপচাপ আবরারের জ্যাকেট আঁকড়ে ধরে সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রইলো। আবরার এসি বন্ধ রাখলো। দীবার কমফোর্টেবলের কারণে লাইট অফ করে দিলো। দীবার ঘুমের ব্যাহাত যেন না ঘটে তাই খুব সাবধানতার সাথে গাড়িয়ে চালিয়ে শান্তি নিবাসে আসলো। গাড়ি থামিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলো আবরার।
চারপাশ নিঝুম নিস্তর। রাস্তার পাশে সোডিয়ামের কৃতিম আলোতে আলোকিত রাস্তাঘাট। পাশের বাড়ির একটা কালো কুচকুচে কুকুর আছে। সেই কুকুরের আর্তনাদ এখান থেকেও শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। কুকুরের এই কর্কষ ধ্বনিতে বিরক্ত হলো আবরার। গাড়ির কাচ লাগিয়ে দিয়ে দীবার দিকে তাকালো। জ্বরের অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে ফ্যাকাশে হয়ে আছে দীবার মায়াবী মুখশ্রী। দীবার মুখের দিকে তাকাতেই আবরারের বুকটা ধক করে উঠলো। বাম পাশে ব্যাথা অনুভব করলো সে। দীবার দিকে এগিয়ে এসে ঝুকে বসলো। তারপর দীবার গালে এক হাত রেখে আলতো ভাবে ডাকলো, ‘দীবা? ঘুমিয়ে গেছো? আমরা এসে পরেছি। দীবা?’
দীবা ক্লান্তিকর চোখ দুটো খুলে পিটপিট করে তাকালো। আবরার বুঝলো দীবার শরির দুর্বল। এভাবে ডেকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। হেঁটে যাবার মতো শক্তি বোধহয় এই মেয়ের নেই। কিছুক্ষণ বসে থেকে ভাবলো আবরার। তারপর চোখ ঘুরিয়ে বাড়ির দিকে তাকালো। সবাই ঘুমিয়ে পরেছে? নাকি ড্রয়িংরুমে কেউ আছে? জানার জন্য রিমির নাম্বারে ডায়াল করলো। কয়েকবার রিং হবার পর কল রিসিভ করলো রিমি। আবরার বিলম্ব না করে প্রথমেই জিজ্ঞেস করে উঠলো, ‘সবাই কোথায়? ড্রয়িংরুমে কেউ আছে?’
আবরারের এমন প্রশ্ন শুনে কপাল কুঁচকালো রিমি। কন্ঠ শুনে বুঝলো ব্যাপার টা খুব সিরিয়াস কিছু। তাই মজা না নিয়ে ‘দেখছি’ বলে ড্রয়িংরুমে আসলো। জানালো কেউ নেই। সবাই যার যার রুমে।
‘তাহলে দরজা খোল।’ বলে লাইন কেটে দিলো আবরার। রিমি একদম বেক্কল বনে গেলো। আবরার মোবাইলটা পকেটে রেখে গাড়ি থেকে নামলো। দীবার পাশে এসে দরজা খুলে দীবাকে স্বযত্নে কোলে তুলে নিলো। দীবা জড়সড় হয়ে আবরারের কোলে ছোট বাচ্চাদের মতো নিশ্চুপ রইলো। এক হাতে আবরারের গলা জড়িয়ে ধরলো। স্মিতি হাসলো আবরার। দীবার কপালে প্রগাঢ় একটা চুমু একে বাড়ির ভিতরে ঢুকলো। রিমি দুজনকে এভাবে দেখে হতভম্ব হয়ে গেলো। অস্থির হয়ে আবরারের কাছে এসে বলতে লাগলো, ‘আরব ভাই? দীবার কি হয়েছে? ব্যাথা পেয়েছে নাকি? ভাইয়া? বলো না দীবার কি হয়েছে?’
সিঁড়ির কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো আবরার। খুবই শান্ত গলায় প্রত্যুত্তর করলো, ‘সকালে বৃষ্টি ভিজায় জ্বর এসেছে। তুই দীবার রুমে জলপট্টি, প্যারাসিটামল আর একটা থার্মোমিটার নিয়ে আয়।’
কথা মতো রিমি দ্রুত পা চালিয়ে যাবতীয় জিনিস আনতে গেলো। আবরার দীবার রুমে এসে তাকে বিছানায় শুইয়ে দিলো। শীতে কনকন করছে দীবা। গায়ে মোটা চাদড় জড়িয়ে দিলো আবরার। দীবার পরনে হিজাব রয়েছে। প্রথমে ভেবেছিলো খুলবে না। পরোক্ষনে যখন দেখলো হিজাবে অনেক গুলো পিন, তখন বিরক্ত হলো কিছুটা। এখন এই পিন গুলো যদি ভুলবশত মাথায় ফুটে যায় তখন? তাই গভীরে মনোযোগের সাথে দীবার হিজাব খুলার চেষ্টা করতে লাগলো। মাথার উপরের দুইটা পিন খোলে হিজাব টান দেবার পরেও খুললো না। ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকালো আবরার। আরো পিন আছে? দীবার ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে পিন খুঁজতে লাগলো। কিন্তু পিন আর খুঁজে পাচ্ছে না। তাই বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করতে লাগলো, ‘আল্লাহ জানে কোন চিপায় পিন ঢুকিয়ে রাখছে।’
তখুনি রুমে আসলো রিমি। তাকে দেখেই আবরার উঠে দাঁড়িয়ে বিরক্তিকর কন্ঠে বললো, ‘তোর বান্ধুবির হিজাবটা খুলে দে। মানে একটা ওড়নার জন্য এতো পিন লাগে? আশ্চর্য মেয়ে তোরা। ওড়নাটা খালি গায়ে পেঁচিয়ে ফেললেই হয়। সহজ কাজ না করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কাজ করা তোদের দ্বারাই সম্ভব।’
কথাটা বলেই বেড়িয়ে গেলো আবরার। তার কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলো রিমি। হাসবে নাকি কাঁদবে বুঝে আসলো না। ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলো শুধু। অতঃপর নিঃশব্দে হেসে ফেললো। চোখ ঘুরিয়ে দীবার ফ্যাকাশে চেহারার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো একটা। কাপড় বদলাতে এগিয়ে আসলো দীবার কাছে।
দীবার রুম থেকে বেড়িয়ে নিজের রুমে আসলো আবরার। মনটা একদম ভালো নেই তার। বারংবার দীবার ক্লান্তিকর মুখশ্রীর কথা মনে পরছে। সুস্থ মেয়েটা হঠাৎ অসুস্থ পরলো কেন? তপ্ত শ্বাস ফেললো একটা। চটজলদি ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসলো। মোবাইল টা হাতে নিয়ে দ্রুত পায়ে দীবার রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। রুমে এসে দেখলো রিমি দীবার গ্রাউন বদলে টিশার্ট পরিয়ে দিয়েছে। স্বস্তি হলো আবরার। এতো বড়ো জুব্বা দেখে তারই কেমন অস্বস্তি লাগছিলো। তাকে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই রিমি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আম্মুকে ডাকবো?’
আবরার বারণ করলো, ‘না! তুই চুপচাপ গিয়ে শুয়ে পর। আমি দীবার খেয়াল রাখছি।’
রিমি বাধ্য মেয়ের মতো মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলো। তবে যাবার আগে বলে গেলো, ‘এখন একটা প্যারাসিটামল খাইয়ে দাও। রাতে জ্বর আসলে কপালে জলপট্টি দিও। আর যদি দেখো ঘামছে তাহলে কাথা সরিয়ে ফেলবে। দরকার লাগলে ডাক দিও।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ যা! আমি জানি এইসব।’ কিছুটা ধমকের স্বরে বললো আবরার। রিমি বিরক্তিকর চোখেমুখে তাকিয়ে বললো, ‘আশ্চর্য! কাজের বেলা রিমি। আর কাজ শেষে ধমক। বাহ্ ভাই বাহ্। এমন করলে জীবনেও বউ পাবা না।’
কথাটা রাগের ছলে বলেই আহাম্মক হলো রিমি। বউ? ভাইয়ার তো বিয়ে হয়েই গেছে। নিজের কথায় নিজেরই হাসি পেলো। আবরার জবাবে বললো, ‘আমার জন্য তোর এই ভাবিটাই যথেষ্ট।’
জবাব শুনে মুচকি হাসলো রিমি। বিদায় দিয়ে চলে গেল সে। আবরার দরজা লাগিয়ে লাইট অফ করে দীবার কাছে বসলো। ড্রিম লাইটের মৃদু আলোতেই দীবাকে মেডিসিন খাইয়ে দিলো। অতঃপর আদরের বউটাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পরলো।
___________________
রাতের ঘড়ির কাটা তিনটার ঘরে। মিনিটের বোধহয় ত্রিশ-চল্লিশ! প্রকাণ্ড রকমের গরমের কারণে দীবার শরির ঝালাপালা করে উঠলো। দুর্বল হাতে গায়ের ভারি কাথাটা সরিয়ে দিলো। ধীর গতিতে উঠে বসলো বিছানায়। এতোক্ষণে জ্বর নেমেছে তাই ঘেমে একাকার দীবার শরির। উন্মুক্ত চুল গুলো খোঁপা করে নিলো। লাইটের আবছায়া আলোতে অস্পষ্ট ভাবে চারপাশ ভাস্যমান চোখে। বিছানার পাশে ছোট কর্নার টেবিলের দিকে চোখ গেলো তার। একটা বাটিতে জলপট্টি রাখা। চোখ ঘুরিয়ে নিজের পাশে তাকাতেই আবরারের ঘুমন্ত মুখশ্রীর দিকে নজর গেলো তার। উলটো পাশ হয়ে ঘুমে বিভোর আবরার। তারমানে আবরারই তাকে জলপট্টি দিয়েছে? আনমনে ঠোঁটে স্মিতি হাসি ফুটে এলো দীবার। অতিরিক্ত ঘামার কারণে গায়ের টি-শার্টের অর্ধাংশ ভিজে আছে। কেমন অস্বস্তি লাগছে তার। তাই বিছানা থেকে নেমে একটা সাদা টিশার্ট হাতে নিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসলো। যদিও হাঁটার মতো শক্তি গায়ে ছিলো না তবুও জোরপূর্বক গিয়েছে। এখন শরিরটা হালকা হালকা লাগছে। বিছানার কাছে আবরারের পাশে এসে দাঁড়ালো দীবা। খেয়াল করে দেখলো আবরার কিছুটা ঘেমে আছে। এসি আর ফ্যান দুটোই অফ! দীবা এসিটা অন করে আবরার যে পাশে শুয়ে আছে ঠিক সেই পাশে আবরারের দিকে মুখ করে শুয়ে পরলো। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো আবরারকে। এই মানুষটা তার জীবনসঙ্গী! তার ভালোবাসা! সত্যি কি তাই? এক হাত তুলে আবরারের গালে রাখলো। কোমল হআতের স্পর্শ পেয়ে পিটপিট করে ঘুম জড়ানো চোখে তাকালো আবরার। দীবাকে বিছানার একদম কার্নিশে শুয়ে থাকতে দেখে এক হাতে দীবার কোমড় জড়িয়ে ধরে টেনে নিজের একদম কাছে আনলো। কপাল ছুঁয়ে দিয়ে বললো, ‘এখন জ্বর একটু কম। শরির কেমন লাগছে?’
দীবা প্রত্যুত্তর করলো না। চুপচাপ এক মনে তাকিয়ে রইলো আবরারের দিকে। আবরার মৃদু হেসে বললো, ‘খাওয়া দাওয়া করো না নাকি? এইটুকু জ্বরেই গলে পরে গেলে একদম। আল্লাহ! তোমার শরিরে শক্তি এতো কম? হেঁটে আসার মতো জোর শরিরে ছিলো না। নাকি সবটাই কোলে উঠার ধান্দা?’
শেষের কথাটা আবরার মজার ছলে ভ্রুঁ জোড়া যুগল নাচিয়ে বললো। দীবা স্মিতি হেসে আবরারের গালে আলতোভাবে চি’মটি কা’টলো। অল্প শব্দে হাসলো আবরার। দীবার কাছে একটু এগিয়ে নিবিড় হলো আরো। দীবার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে কন্ঠস্বর মোলায়েম করে বললো, ‘বৃষ্টি ভিজলে জ্বর আসে তাহলে বৃষ্টি ভিজতে গেলে কেন?’
দীবা ভড়াট কন্ঠে উত্তর দিলো, ‘এমনি। ভালো লাগে তাই।’
আবরার কিছুটা রাগ মিশ্রিত কন্ঠে শাসনের ভঙ্গিতে বললো, ‘ভালো লাগে তাই? জ্বর যে আসলো? কষ্টটা কে করেছে শুনি?’
দীবা আবরারের চোখে চোখ রাখলো। কোমলায়ন কন্ঠে শুধাল, ‘বৃষ্টি ভেজার উছিলায় যদি আপনার ভালোবাসা পাই, তাহলে সেই বৃষ্টিতে আমি আরো হাজার বার ভিজতে চাই।’
ঠোঁট প্রসারিত করে মৃদু হাসলো আবরার। দীবার গালে নিজের নাক ঘেঁষে আহ্লাদিত কন্ঠে বললো, ‘আমি তো সারাজীবন ভালোবাসবো তোমায়। তাহলে? সারাজীবন বৃষ্টি ভিজতে পারবে?’
দীবা চোখ দুটো আবেশে বন্ধ করে ফেললো। কম্পিত কন্ঠে বললো, ‘আপনার ভালোবাসার বর্ষণে নাহয় ভিজলাম সারাজীবন।’
__________________
নিস্বব্ধ রাত্রী কাটিয়ে ভোরের আলো ফুটলো। সূর্যোদয় হলো পূর্ব আকাশে। ধরনী করলো আলোকিত। ঘড়ির কাটা ছয়ের ঘরে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন আবরার। সারারাত মিলিয়ে মাত্র কয়েক ঘন্টা ঘুমিয়েছে বোধহয়। এই ঘুম বেশিক্ষণ টিকলো না। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ঘুমের ব্যাহাত ঘটলো তার। কিছুটা বিরক্তিকর মুখে মাথা তুলে দরজার দিকে তাকালো। এতো সকালে কার আগমন ঘটলো? আবারো কড়া নাড়ার শব্দ আসলো। এবার অতিরিক্ত বিরক্ত হলো। শুয়ে থেকে উঠতে চাইলে দেখলো দীবা তার বুকে মাথা রেখে জড়সড়ভাবে ঘুমিয়ে আছে। কয়েকটা অবাধ্য উন্মুক্ত চুল মুখের উপর পরে আছে দীবার। আবরার যত্ন সহকারে চুল গুলো কানের পিছনে রাখলো। জ্বরের উত্তাপে ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া মুখখানি দেখে বুকটা চিনচিন করে উঠলো। শুকিয়ে যাওয়া উষ্ঠধয়ে প্রগাঢ় ভাবে কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে একটা চুমু খেলো। তারপর অতী সাবধানে দীবাকে নিজের থেকে সরিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ঘুম জড়ানো চোখেমুখে দরজা খোলে দিতেই রোহানাকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। ভাবান্তর আসলো না আবরারের মাঝে। নির্বিকার ভাবে তাকিয়ে রইলো শাশুড়ি মায়ের দিকে।
রোহানা এখানে আবরারকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেলো। দুজনের ঘুমের ব্যাঘাতের কারণ নিজে হবার কারণে লজ্জিত হলো কিছুটা। কিছু না বলে চলে যাবে বলে মনস্থির করলো। কিন্তু চোখ ঘুরিয়ে বিছানায় তাকাতেই দীবার শুকিয়ে যাওয়া ফ্যাকাশে মুখ নজরে আসলো তার। হঠাৎ কি হলো মেয়েটার? চিন্তিত হলো অনেক। রুমের ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে অস্থির কন্ঠে প্রশ্ন করতে লাগলো, ‘দীবার কি হয়েছে? ওকে এমন লাগছে কেন?’
আবরার ভাবলেশহীন ভাবে রুম থেকে যেতে যেতে উত্তর দিলো, ‘অস্থির হওয়ার কিছু নেই। রাতে জ্বর এসেছিলো। এখন ঠিক আছে।’
বলেই দীবার রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। রোহানা দীবার পাশে বসে রইলো। কর্ণার টেবিলের উপর জলপট্টি দেখে সব বুঝলো। রাতে তাহলে খুব বেশি জ্বর এসেছিলো মেয়েটার। জলপট্টি কি তবে আবরার দিয়েছে? মেয়ের প্রতি আবরার এই কেয়ারিং দেখে মনটা ভালো হলো তার। রোহানা বরাবরই সরল মনের মানুষ। কোনো প্রকার প্যা:চ, ঝামেলা, রাগারাগি তার মাঝে নেই। সবার সাথে মিলেমিশে থাকতে পছন্দ করে খুব। নাহলে কয়েকমাস আগে আবরারের কর্মকাণ্ডে রাগান্বিত হতো প্রচুর। যদিও কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়ে ছিলো। বিয়ের উক্ত ঘটনার কারণে এই বাড়ি ছেড়ে রাউজান চলে যেতে চেয়েছিলো। নিশিতা, আয়েশা বুঝালো অনেক। তাই থেকে গেলো। দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিরবে। চোখ ঘুরিয়ে মেয়ের দিকে তাকালো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ভাবতে লাগলো। দীবার এইসএসসির পরেই রাউজান চলে যাবে রোহানা। এখানে থাকার আরো একটা কারণ হচ্ছে দীবার পরিক্ষা। দীবার বাবা মা:রা যাবার পর রাউজান চলে যেতে চেয়েও পারে নি। কারণ রাউজান থেকে আগ্রাবাদ এসে ক্লাস করা, পরিক্ষা দেওয়া দুটোই কষ্টসাধ্য। তাই বাধ্য হয়ে পূর্বের ফ্ল্যাটেই একা থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো রোহানা। কিন্তু রোশান নারাজ! তারা দুইজনের একা থাকা রিক্স হয়ে যেতে পারে ভেবে শান্তি নিবাসে আনার প্রস্তাব রাখে। রোহানা প্রথমে বারণ করলেও রোশানের পরিবারের জোরাজুরিতে এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে শান্তি নিবাসে চলে আসলো। কিন্তু এখানে আসার আগে জোর গলায় জানিয়ে দিয়েছিলো যে দীবার পরিক্ষার পরেই রাউজান চলে যাবে। এইসব ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো রোহানা।
চলমান..#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির
[পর্ব-২৯]
রজনীর শেষভাগে এক পলাশ বৃষ্টি শেষে প্রভাতের অন্তরিক্ষ এখন কোমল। সূর্যালোকের ঝলমলে রশ্মিতে ধরনী মুখরিত। ছোট ছোট পাখির কিচিরমিচির ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো দীবার। পিটপিট করে তাকাতেই বারান্দার এক ফালি সূর্যরশ্মি চোখে এসে পরলো। খুশিতে আমোদিত হয়ে আড়মোড় ভেঙ্গে শুয়া থেকে উঠে বসলো সে। পাশে তাকিয়ে দেখলো আবরার বিছানায় নেই। তার দেওয়া হুডিটা এক পাশে পরে আছে। ঘড়িতে দেখলো সময় আটটা দশ! সাড়ে আটটায় নাস্তা। শরিরটা গতকাল রাতের চেয়ে এখন অনেকটা সুস্থ। মনটাও ফুরফুরে। গতকাল রাতের কথা মনে পরতেই মুচকি হাসলো। বিছানা থেকে নেমে হুডিটা আলমারিতে রাখার জন্য আলমারির দরজা খুললো। পছন্দের জিনিস গুলো সবসময় নিদিষ্ট একটা ড্রয়ারে রাখে দীবা। হুডিটাও তার পছন্দের। তাই সেটা যত্নে রাখতে ড্রয়ার খুলে এক পাশে রাখলো। তখুনি ড্রয়ারের এক পাশে নজর গেলো তার। শ্যাওলা রঙ্গের একটা শার্ট। এই শার্টটা তার বাবার। বাবার স্মৃতি গুলো চোখের সামনে জ্বলজ্বলন্ত হয়ে উঠলো। বুকের ভেতরটা পাথরের ভারে আবারো চাপা পরলো। সকালটা সুন্দর, হাসিখুশি ভাবে শুরু হলেও বাবার প্রিয় শার্টটা চোখে পরতেই সব কিছু বিষাদগ্রস্ত হয়ে গেলো দীবার। চোখ হয়ে এলো ঝাপসা। কার্নিশ বেয়ে নোনাজলের বিন্দু কণা গড়িয়ে পরতে লাগলো আপনা-আপনি। নিঃশব্দে ড্রয়ার লাগিয়ে আলমারি বন্ধ করলো। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে পড়ার টেবিলের একদম নিচের ড্রয়ারটা টেনে খুললো। ভিতর থেকে একটা ফটো এলবাম বের করেই ফ্লোরেই হাঁটু ভেঙ্গে বসলো দীবা। চোখের পানি মুছে এলবামের প্রথম পাতা উল্টালো। ভেসে উঠলো হাস্যউজ্জ্বল একটি ছোট পরিবারের ছবি। দীবার বাবা, রোহানা আর দীবা নিজে। ছবিটা অনেক বছর আগের। তখন দীবার বয়স মাত্র সাড়ে তিন ছিলো। পরের পৃষ্টা গুলো একের পর পাল্টাতে লাগলো দীবা। প্রতিটা পৃষ্টায় পরিবারের সবাই একত্রে কাটানো হাসিখুশি মুহূর্ত গুলো ফুটে উঠলো। প্রতিটা ছবিতে দীবা তার বাবাকে প্রাণোচ্ছল দেখে স্মিতি হাসলো। কি এমন ক্ষতি হতো যদি তার বাবা বেঁচে থাকতো? কান্না আটকানোর মতো সাধ্য তার নেই। এলবাম বুকে জড়িয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। হারিয়ে যাওয়া বাবার দুঃখে কেঁদে উঠা কান্নার ভড়াট শব্দ গুলো চার দেয়ালে বন্দি রইলো। তখুনি দরজা ধাক্কানোর শব্দ কানে আসলো দীবার। কান্না থামিয়ে নাক টেনে নিজেকে স্বাভাবিক করলো দীবা। ড্রয়ারে ফটো এলবাম টা রেখে উঠে দাঁড়ালো। দরজায় আবারো টোকা পরলো। এখন দরজার বাহির থেকে আবরারের কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো।
‘দীবা? দরজা লাগিয়েছো কেন? দীবা? ঠিক আছো তো?’
বারবার ডাক শুনে কিছুটা বিরক্তবোধ করলো দীবা। ওড়না দিয়ে মুখ মুছে দরজা খুলে দিলো। আড়ষ্টতার সঙ্গে আবরারের দিকে তাকালো। দীবার চেহারার এমতাবস্থা দেখে বিস্মিত হলো আবরার। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো শুধু। লাল হয়ে যাওয়া চোখ দুটোতে এখনো পানির কণা চিকচিক করছে। নাকটা গাঢ় লাল হয়ে আছে। আবরার অনায়াসে বুঝে ফেললো দীবা এতোক্ষণ কেঁদেছে। কিন্তু কেন? শরির কি বেশি খারাপ লাগছে? এইসব ভেবে অস্থির হলো আবরারের মন। বিচলিত কন্ঠে দীবার গাল, কপাল ছুঁয়ে দিয়ে বলে উঠলো, ‘কি হয়েছে? শরির বেশি খারাপ লাগছে? কেঁদেছ কেন? ডক্টর দেখাবো?’
নিরবে আবরার হাত দুটো সরিয়ে দিলো দীবা। মলিন চেহারায় তাকিয়ে বলল, ‘কিছু হয়নি। আমার ভালো লাগছে।’
‘নাস্তার জন্য এসেছিলাম। নিচে গিয়ে খেতে পারবে নাকি এখানে নিয়ে আসবো?’
আবরারের কথা গুলো এই মুহূর্তে দীবার অতিরিক্ত ন্যাকামি লাগলো। বিরক্ত হয়ে অপ্রসন্ন চোখেমুখে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘আমাকে নিয়ে আপনার এতো না ভাবলেও চলবে। বিরক্ত করবেন না প্লিজ।’
আবরারকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মুখের উপরে দরজা টা লাগিয়ে দিলো দীবা। তার এমন প্রতিক্রিয়ায় আবরার স্তম্ভিত হয়ে গেলো। বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলো দরজার দিকে। হঠাৎ কি হলো মেয়েটার? কাল রাতেও তো ভালো ছিলো। তাহলে এখন এমন ব্যবহারের কারণ কি? রাগ হলো আবরারের। মুখের উপরে দরজা লাগিয়ে দেওয়ায় অপমানিত হলো সে। ইগো তে লাগলো তার। ‘বিরক্ত করবেন না প্লিজ!’ কথাটা বারবার কানে বাজতে লাগলো। আসলেই সে দীবাকে বিরক্ত করে? ক্রোধান্তিত হলো মন। চোয়াল শক্ত করে চলে গেলো রুমে। মনে মনে ভেবে নিলো দীবাকে আর কখনোই ডাকবে না সে। যতোক্ষণ না দীবা তার কাছে আসবে ততোক্ষণ সে দীবার কাছে যাবে না!
.
দরজাটা লাগিয়ে অপ্রসন্ন বিরূপ চেহারায় বিছানায় বসলো দীবা। দুই হাতে মুখ ঢেকে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগলো। হঠাৎ-ই মন খারাপের মাঝে রাগ উঠলো কেন? মন খারাপের সময় নাকি মানুষের তার প্রিয় জনের প্রয়োজন পরে। আবরার তো তার প্রিয়জন। আবরারকে কাছে পেয়ে মন ভালো হবার কথা ছিল। কিন্তু উলটো রাগ হলো কেন সে? এবার নিজের উপর নিজেই বিরক্ত হলো দীবা। তখুনি মাথায় আসলো একটা কথা। মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দেওয়ায় রেগে গেলো নাকি লোকটা? নিজের এই অহেতুক এহেন কান্ডে বিরক্ত হয়ে অশ্রাব্য ভাষায় গালি ছুড়লো একটা। অতঃপর জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করলো। দ্রুত পা চালিয়ে দরজার কাছে এসে দরজা খুলে বাহিরে তাকালো। আবরারকে দেখতে না পেয়ে নিজে নিজে বিড়বিড় করে বলল, ‘বাহ্ দীবা! দরজা লাগিয়ে দেবার পরেও তুই তাকে এখানেই এক্সপেক্ট করছিস? তুই কি আসলেই গাধা?’
তপ্ত শ্বাস ফেলে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো। দ্রুত পা চালিয়ে ডাইনিং টেবিলের কাছে এসে রিমির পাশের চেয়ার টেনে বসে পরলো। তাকে বসতে দেখেই রিমি সকলের অগোচরে দীবার কপালে এক হাতে রেখে ফিশফিশ কন্ঠে অস্থির হয়ে প্রশ্ন করলো, ‘ইয়ার শরির ঠিক আছে তো তোর?’
দীবা রিমির হাত নিজের কপাল থেকে সরিয়ে বললো, ‘আমি কি অসুস্থ নাকি আশ্চর্য।’
দীবার কপালে হাত রেখে শরিরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক বুঝলো রিমি। তাই দুশ্চিন্তা মুক্ত হলো সে। দুশ্চিন্তা গেলেও শ’য়’তা’নি কমলো না। দীবার বাহুতে নিজের বাহু ধাক্কা দিয়ে ভ্রুঁ জোড়া নাচিয়ে নাচিয়ে বলল, ‘রাতে রোমান্টিক কিছুমিছু হয়েছে তো? আমরা ফুফু ডাক শুনতে পাবো?’
রাগে গিজগিজ করতে করতে রিমির বাহুতে জোরে একখান চা’পড় বসিয়ে দিলো দীবা। কিড়মিড় করে বললো, ‘অ’সভ্য মাইয়া।’
চা’পড়টা জোরেই পরলো রিমির গায়ে। ব্যা’থায় আর্তনাদ করে উঠলো। টেবিলে উপস্থিত থাকা সকলের দৃষ্টি দুজনের দিকে নিবদ্ধ হলো। একইসঙ্গে সবার অদ্ভুত চাহনীতে হকচকিয়ে গেলো দীবা। রাইমা শাসনের ভঙ্গিতে কপাট রাগ দেখিয়ে বললো, ‘খাবার খাওয়ার সময়ও ঝ’গ’ড়া করছিস তোরা?’
আরিয়ান বললো, ‘ঝ’গ’ড়া এক পাশে রেখে খাবার খা। আজকের ব্রেকফাস্টের সব আইটেম দারুণ হয়েছে।’
দীবা রিমি কেউ প্রত্যুত্তর করলো না। তবে রিমি দীবার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো একবার। অর্থাৎ তাকে মা’রার কারণে দীবাকে পরে পস্তাতে হবে। তার এমন চাহনীতে পাত্তা দিলো না দীবা। নির্বিকার ভাবে খেতে লাগলো।
আয়েশা পানির জগ টেবিলের উপর রেখে কমলাকে ডাকলো, ‘আবরারকে ডাকো নি? খেতে আসলো না যে।’
কমলা প্রত্যুত্তরে জানালো, ‘হ্ ডাকি আইস্যি। ইতে বলে ন হাইবু। জ্বালাইতু মানা গইজ্যি। হোন হারণে গরম অই আছে ফানলার। তাই আর ন ডাকি।’ (হ্যাঁ ডেকে এসেছি। সে নাকি খাবে না। বিরক্ত করতে বারণ করেছে। হয়তো কোনো কারণে রেগে আছে প্রচুর। তাই আর দ্বিতীয়বার ডাকি নি।)
আবরারের নাম উঠতেই সজীব হলো দীবার মস্তিষ্ক। এতোক্ষণে খেয়ালে আসলো আবরার। আসলেই তো! লোকটা এলো না কেন? মনে পরলো কিছু সময় পূর্বের কথা। তখন আবরার দীবাকে নাস্তার জন্য ডাকতে এসেছিলো। নিচে না আসার সম্পূর্ণ কারণ ধরতে পেরে বিস্মিত হলো দীবা। এক হাত মাথায় চা’পড়ে হতাশা হলো বেশ। নিজেকে নিজেই শ’খানেক গালি দিলো। কেন সে তখন রাগ দেখালো? কেন তখন মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিলো? বিরক্তিতে দাঁতে দাঁত পিষে চুপচাপ বসে রইলো। কোনো মতে কয়েক লোকমা মুখে তুলে উঠে দাঁড়ালো। রান্না ঘরে চুপি গিয়ে দেখলো কমলা আর আয়েশা সেখানে কাজ করছে। দুই পাশে দুইজন। দীবা পানি খাবার ভান করে কমলার পাশে দাঁড়ালো। তারপর ফিশফিশ গলায় বললো, ‘দাদী? একটা প্লেটে খাবার সাজিয়ে দিয়েন তো।’
কমলা বিস্মিত হয়ে বলে উঠলো, ‘অবাজি! তুই ন টেবিলত বইস্যু! হানা ন হাও?’ (ওমা! তুমি না টেবিলে বসছিলা? খাবার খাও নাই?’)
দীবা ফিশফিশ করে বললেও কমলা কণ্ঠস্বর বড় করে বললো। আয়েশার কান পর্যন্ত পৌছালো। এই খাবার যে দীবার জন্য নয় সেটা কমলা না বুঝলেও আয়েশা অনায়াসে বুঝে গেলো। তাই কার জন্য জানতে চাইলো, ‘খাবার কার জন্য?’
দীবা ইতস্ততবোধ করতে লাগলো। প্রথমে বলতে না চাইলেও আয়েশার চোখ পাকানো দেখে সত্যি বলে দিলো। আমতা আমতা করে বললো, ‘আসলে উনার জন্য নিয়ে যেতে চাইছিলাম। আমার উপর রেগে আছে তাই নিচে আসে নি।’
দীবার প্রত্যুত্তর শুনে মুচকি হাসলো আয়েশা। কমলা প্লেট সাজিয়ে দিলে দীবা দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলো রান্না ঘর থেকে। আয়েশা আমোদিত হয়ে হাসলো। মনে মনে দোয়া করলো যেন আবরার আর দীবার সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে যায়।
.
প্লেট হাতে হাঁটতে হাঁটতে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো দীবা। কি ভয়ানক লজ্জায় পরেছিলো সে। ওই লোকের জন্য আর কি কি দেখতে হবে আল্লাহ জানে। ভাবতে ভাবতে আবরারের রুমের সামনে চলে আসলো দীবা। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ভাবলো। ডাক দিবে? কিন্তু কি বলে ডাকবে? ঠোঁট কামড়ালো প্রথমে। পরোক্ষনে ভাবলো স্যার ডেকে দিবে নাহয়। ভেবে চিন্তে হাত উঠালো নক করতে। দরজায় টোকা দিতে যাবে তখুনি রুমের দরজা খুললো আবরার। চোখাচোখি হলো দুজনের। দীবা মিষ্টি করে একটা মুচকি হাসি দিলো। কিন্তু আবরার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। দীবা ঠোঁটে হাসি রেখে বললো, ‘নাস্তা করতে আসেন নি কেন? আপনার জন্য নাস্তা নিয়ে এসেছি। ঝটপট খেয়ে নিন।’
প্রত্যুত্তর করলো না আবরার। নিরবে উপেক্ষা করে রুম থেকে বেরুলো। দীবা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আবরারকে দেখতে লাগলো। আবরার রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমের দরজাখানা বাহির থেকে লাগিয়ে দিলো। তারপর দীবার দিকে না তাকিয়েই নিচে যাবার জন্য পা বাড়ালো। হতভম্ব হয়ে গেলো দীবা। অবাক হয়ে আবরারের চলে যাবার দিকে তাকিয়ে রইলো। আবরার যে তার উপর রেগে আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ঠোঁট উল্টালো দীবা। মন খারাপ হলো। ইশ! তখন কেন দরজা লাগিয়ে দিয়েছিলো সে? যদি না দরজা লাগাতো ; আবরার রাগ করতো না। নিজের উপর রাগ হলো প্রচুর। মন খারাপ নিয়ে প্লেটটা রান্না ঘরেই রেখে আসলো।
দীবা রান্না ঘরে প্লেট রেখে যাওয়ায় বিস্মিত হলো আয়েশা। মেয়েটার মন খারাপ, আর প্লেটের খাবার দেখে অনায়াসে বুঝে গেল যে আবরারের রাগ ভাঙ্গে নি। কি এমন হয়েছে দুজনের মাঝে যে ছেলেটা এতো রেগে আছে? চিন্তিত হলেও পরে হেসে ফেললো। সম্পর্কের মাঝে ভালোবাসা খুনসুটি না থাকতে সম্পর্ক প্রগাঢ় হয় না। স্বামি স্ত্রীর ব্যাপার। ওরাই মিটমাট করে নিবে নাহয়।
________________
দিবার শেষ প্রহরে অম্বর ঘন কালো মেঘে আচ্ছন্ন। থোকায় থোকায় মেঘেদের আনাগোনা চলছে। প্রভঞ্জনের বেগ জানান দিচ্ছে আজকের পরিবেশটা সবচেয়ে সুশ্রী। তবে মন ভালো থাকার পারিপার্শ্বিক অবস্থায় ভালোবাসার মানুষটা যদি অভিমান করে থাকে তাহলে মন কি করে প্রফুল্লিত হতে পারে? যেমনটা দীবার। মনটা তার ব্যাকুল হয়ে আছে। পুরোটা দিন আবরারের অপেক্ষায় ছিলো দীবা। সকালে অনাহারে বেরিয়েছে লোকটা। বিকেল গড়িয়ে রাত হলো। কিন্তু এখনো বাড়ি ফিরে নি। ভেবে ভেবেই মহা চিন্তিত দীবা। সন্ধ্যার পর আড্ডা জমেছে লিভিং রুমে। কিন্তু এই আড্ডায় মনোযোগ দিতে পারছে না সে। আবরারের চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে মন। বারবার চোখ দুটো সদর দরজার দিকে চলে যাচ্ছে। মন বলছে এই বুঝি আবরার আসছে। কিন্তু তাকে আশাহত করে দিয়ে আবরার এখনো ফিরে নি।
দীবার এই দুটানা, অস্বস্তি দেখে রাইমা জিজ্ঞেস করে বসলো, ‘কিরে দীবা? আজ এতো চুপচাপ কেন তুই? কিছু হয়েছে কি?’
রাইমার এমন উদ্ভট কথা শুনে সবাই দীবার দিকে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকালো। সবার এমন চাহনীতে কিছুটা বিব্রতবোধ করলো দীবা। কোনো রকমে প্রত্যুত্তর করলো, ‘এমনি! কিছু হয়নি।’
দীবার কথায় এতোটাও গুরুত্ব দেয় নি কেউ। বিশ্বাস করলো সবাই। যে যার মতো আড্ডায় আবারো মশগুল হলো। দীবা প্রথমের ন্যায় বারবার দরজার দিকে তাকাতে লাগলো। বেশ কিছুসময় পর আগমন ঘটলো আবরারের। পকেটে এক হাত রেখে অপর হাতে মোবাইল টিপতে টিপতে সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করলো আবরার। তাকে দেখে দীবার অস্থির মন কিছুটা শান্ত হলেও স্বস্তি পেলো না। আগ্রহাতিশয় চেহারায় তাকিয়ে রইলো আবরারের দিকে।
আবরারকে আসতে দেখে আরিয়ান ডেকে উঠলো, ‘হ্যালো ব্রাদার? কোথায় ছিলে এতোক্ষণ? এদিকে আসো। আড্ডায় জয়েন করো।’
আরিয়ানের ডাক কর্ণপাত হতেই সিঁড়ি অব্ধি গিয়েও দাঁড়িয়ে পরলো আবরার। পিছু ফিরে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘আমার কারণে তো মানুষ বিরক্তবোধ করে। এখানে থাকলেও করবে। তোরা-ই আড্ডা দে। আমি গেলাম।’
বলেই নির্বিকার ভাবে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলো। আবরারের এমন প্রত্যুত্তর শুনে তব্দা খেলো সবাই। কেউ না বুঝলেও দীবা ঠিকই বুঝতে পেরেছে। খোঁচাটা মূলত তাকেই দিয়েছে আবরার। লোকটা যে তার উপরেই রেগে আছে এটা শতভাগ নিশ্চিত হলো দীবা। দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিরবে। আরো কিছুসময় বসে থেকে নিজেও উঠে উপরে চলে আসলো।
চলমান..