#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির
[পর্ব-৪৮]
হৈহুল্লোড় চলছে পুরো শান্তি নিবাসে। বড় থেকে শুরু করে ছোটরা পর্যন্ত ভিষণ ভাবে ব্যস্ত। দায়িত্ব সহকারে পরিবারের সবাই নিজেদের কাজকর্ম সম্পন্ন করছে। কারণ একটাই। আজ সন্ধ্যা রাতেই রাইমার গায়ের হলুদ। অভ্র এখানের মেহমান। তবুও সাবিত ও আরিয়ানকে সঙ্গ দিয়ে রোশান ও হোসেন কে সাহায্য করছে। তার এমন সৌহার্দপূর্ণ ব্যাবহারে নিশিতা অনেক খুশি। সঙ্গে অন্যরাও। কিন্তু ভাবলেশহীন আবরার। সে কাজে হাত লাগাচ্ছে না। চরম লেভেলের অসল সে। শুধু কিভাবে কি করবে তা জানিয়ে দিচ্ছে আর বসে বসে কফি খাচ্ছে। যদিও তার থেকে অন্যান্য কাজের সাহায্য কেউ আশা করে না। পরিবারের সবাই তার স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে অবগত।
সূর্য পশ্চিমাকাশে ডুব দিয়ে ধরনী করেছে অন্ধকারাচ্ছন্ন। দূরের ওই আকাশটা আজ অদ্ভুত ভাবে একদম স্বচ্ছ। অথচ গতকালও ভারি বর্ষণ ও ঘন কালো মেঘে আবৃত ছিলো। পরিবেশ কোলাহলপূর্ণ থাকলেও নুরা একদম নিরব। বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থেকে আকাশটা দেখছে। মৃদু শীতল বাতাসে ভেসের সাথে আসছে ভেজা মাটির ভ্যাঁপসা ঘ্রাণ। শ্রাবণের সুন্দর সন্ধ্যায় মুগ্ধ না হয়ে রাজকে নিয়ে ভাবছে সে। ভাবছে কোনো এক সন্ধ্যাবেলায় রাজের সঙ্গে পাশাপাশি বসে সূর্যাস্ত দেখছে। দুজনের হাতে হাত রাখা। রাজের কাধে তার মাথা। হাতে দীবার বানানো এক কাপ রঙ চা। দীবা নামটা মাথায় আসতেই ভাবনা থেকে বেড়িয়ে এলো নুরা। নিজের মনের এই অদ্ভুত ভাসনা কোনো কালেই পূরণ হবার নয়। তবুও কেন অবুঝ মন বারংবার রাজ কে নিয়ে ভাবছে? রাজ তাকে চায় না, তাকে ভালোবাসে না, তবুও কেন সে রাজের প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে বেহায়া হচ্ছে? কেন? চোখ বন্ধ করে লম্বা করে একটা শ্বাস নিয়ে নিশ্বাস ফেললো। তখুনি পিছনে কারোর অস্তিত্ব টের পেলো। কে এসেছে তা পিছু না ফিরেও বুঝতে বাকি নেই। তাই চুপচাপ নির্বিকার ভাবে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে রইলো নুরা।
ধীর পায়ের কদম ফেলে নুরার পাশে এসে দাঁড়ালো রিমি। নুরার দৃষ্টি অনুসরণ করে আকাশের দিকে তাকালো। আনমনে সেদিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে প্রশ্ন করলো, ‘আকাশের রঙ কি জানিস?’
নির্লিপ্ত নুরা মলিন চোখে আকাশের পানে চেয়ে থেকেই শুধাল, ‘হ্যাঁ জানি তো। আকাশের না অনেক রঙ হয়। ঠিক মানুষের মনের মতো। কখনো নীল। কখনো সাদা। আবারো কখনো অভিমানী কালো মেঘেদের মেলা।’
রিমি আকাশ থেকে চোখ ফিরিয়ে নুরার দিকে তাকালো। মৃদু কন্ঠে আবারো প্রশ্ন করলো, ‘তোর কোনটা প্রিয়?’
তাচ্ছিল্য হাসলো নুরা। নিষ্প্রভ কন্ঠে ঠোঁট নাড়িয়ে বলে উঠলো, ‘স্বচ্ছ নীল আকাশটা আমার ভীষণ প্রিয় ছিলো। যেখানে ছিলো না কোনো ক্লান্তি, বেদনা, হারানোর যন্ত্রণা। সময় পরিবর্তনশীল জানিস তো। তাই সময়ের সঙ্গে আমার প্রিয় আকাশটাও পরিবর্তন হলো। অভিমানের কালো মেঘ এসে জড়ো হলো। এখন আর আমার প্রিয় নেই। যা আছে প্রিয় তা কেবল আমার একাকিত্ব।’
নুরার কথা গুলো শুনে বাকহারা রিমি। কথাগুলোর অর্থোদ্ধান করতে খুব বেশি সময় লাগে নি। তাই ভাবলো না কিছু। এতোদিন মনে লুকিয়ে রাখা প্রশ্নটা সময় বুঝে করেই ফেললো, ‘তোর মন খারাপের কারণটা রাজ স্যার। তাই না?’
রাজের নামটা শুনতেই কলিজাটা কেঁপে উঠলো নুরার। নিরবে মাথা নত করে চোখ বন্ধ করে ফেললো। ঠোঁট কামড়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করলো। তবুও আঁখি যুগলের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পরলো এক ফোঁটা তপ্ত জল। নজর এড়ালো না রিমির। নুরাকে কাঁদতে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলো। শান্ত্বনা দিতে এক হাত এগিয়ে নুরার কাধে রাখলো। বহুদিন পর নিজের দুঃখ গুলো প্রকাশ করার বিশ্বস্ত একটা জায়গা পেতেই ভেঙ্গে পরলো নুরা। রিমিকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। কান্নায় ভাঙ্গা গলায় বলে উঠলো, ‘আমার সাথে কেন এমন হলো? আমি তো মন থেকেই রাজকে ভালোবেসেছিলাম। তাহলে রাজ কেন আমাকে ভালোবাসলো না? কি এমন ক্ষতি হতো যদি রাজ আমার হতো?’
রিমি নুরার মাথায় হাত বুলাতে লাগলো। নুরাকে শান্ত করে বলে উঠলো, ‘স্যার তো আর জানে না তুই উনাকে ভালোবাসিস। জানলে ফিরাবে না। জানিয়ে দে তুই।’
রিমিকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো নুরা। কান্না থামিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো, ‘রাজ একজন কে ভালোবাসে। রাজ কখনো আমার ভালোবাসা মেনে নিবে না।’
বিস্মিত হলো রিমি। নুরার ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে তাকালো। রিমির প্রশ্নাতীত চাহনি দেখে চোখের পানি মুছলো নুরা। কান্না থামিয়ে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। চোখের পানি মুছে বললো, ‘রাজ দীবাকে ভালোবাসে। বহু বছর আগে থেকেই।’
কথাটা কর্ণপাত হতেই রিমির মাথাটা ঝাঁঝাঁ করে উঠলো। মাথা চক্কর দিয়ে উঠার উপক্রম প্রায়। এর আগে কখনো এতোটা বিস্মিত হয় নি সে যতোটা আজ নুরার কাছ থেকে হয়েছে। এটা কিভাবে সম্ভব? চোখেমুখে হাজারো প্রশ্ন নিয়ে নুরার দিকে তাকিয়ে রইলো। নুরা সব খুলে বললো তাকে। ফটিকছড়িতে আবরারের সঙ্গে রাজের বিবাদ, নুরার সঙ্গে রাজের বলা কথা গুলো, দীবাকে হারানোর যন্ত্রণায় রাজের দেশ ছাড়ার কথাসহ সব কিছুই বললো। এতো এতো ঘটনা জানার পর রিমি প্রায় প্রতিক্রিয়াহীন হয়ে পরেছে। বলার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পেলো না। কিংকর্তব্যবিমূঢ়তার সঙ্গে দাঁড়িয়ে রইলো কেবল। হতভম্ব হয়ে বলে উঠলো, ‘স্যার যে দীবাকে ভালোবাসে সেটা দীবা জানে না।’
নুরা মাথাটা এপাশ থেকে ওপাশ নাড়িয়ে ‘ না ‘ বুঝালো। অর্থাৎ দীবা জানে না। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো রিমি। নিচের ঠোঁট কামড়ে নুরার দিকে তাকালো। দেখলো নুরা চোখের চাহনি নিষ্প্রভ। মলিন চেহারায় চোখ দুটো তার অস্বাভাবিক ভাবে লাল হয়ে আছে। কাঁপছে শরির, পুড়ছে বুক। তবুও নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করছে নুরা। রাজকে হারানোর যন্ত্রণা তাকে গ্রাস করছে প্রতিনিয়ত। কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। চোখের পানি মুছে কান্না মিশ্রিত গলায় বললো, ‘আমি কি করবো বল না রিমি। কিভাবে রাজকে আটকাবো? আমার কিছু ভালো লাগছে না। কিছু না।’
‘তুই স্যারকে জানিয়ে দে তাহলেই সমস্যা সমাধান।’
রিমির সহজসরল উক্তিবাক্য টা শুনে তাচ্ছিল্য হাসলো নুরা। অন্য দিকে তাকিয়ে আড়ষ্ট কন্ঠে শুধাল, ‘সত্যিকারের ভালোবাসা অনেক অদ্ভুত জানিস। একজনকে ভুলে অন্যজনকে অনুভব করা যায় না। আর সে যদি হয় ভালোবাসার মানুষ তাহলে তো প্রশ্নই আসে না।’
হতাশার নিশ্বাস ছুড়লো রিমি। নুরাকে বুঝাতে বলে উঠলো, ‘পাগল তুই যে স্যারকে ভালোবাসিস সেটা তো আর স্যার জানে না। উনি তো দীবাকে ভুলার জন্যই দেশ ছাড়ছে। আমার মনে হয় তুই স্যারকে প্রপোজ করলে স্যার তোকে নিয়ে ভাববে। থেকে যাওয়ার জন্য হলেও একবার ভাববে। আর তা নাহলেও…!’
রেলিংয়ের উপর হেলান দিয়ে শরিরের সম্পূর্ণ ভর ছেড়ে দিলো নুরা। চোখ দুটো বন্ধ করে নিষ্প্রভ কন্ঠে বললো, ‘ব্যাপার টা তুই খুব সহজ ভাবে নিচ্ছিস।’
চুপ হয়ে গেলো রিমি। নিরবে দীর্ঘশ্বাস ফেললো শুধু। মনে মনে ভাবলো নুরার এই কষ্টটা যেন আল্লাহ খুব তাড়াতাড়ি দূর করে দেয়। নুরা তার আপন বোনের মতো। নুরার কষ্টে সে নিজেও কষ্ট পায় এবং পাচ্ছে। নুরার দিকে তাকাতেই বুকটা ভার হয়ে আসলো তার। নুরাকে শান্ত করতে নুরার কাধে এক হাত রাখলো। তখুনি নুরা আনমনে সামনে তাকিয়ে বলে উঠলো,
‘জীবনের প্রথম যাকে ভালোবাসলাম তাকে কাছে পাবার আগেই হারিয়ে ফেললাম। আসলে আমার কপালটাই খারাপ।’
আহত চোখে তাকালো রিমি। বললো, ‘এভাবে বলিস না প্লিজ। তুই স্যারকে তোর মনের কথা জানা। দেখিস স্যার রাজি হবে।’
নুরা আর কথা বাড়ালো না। মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝিয়ে বললো, ‘একটু পরেই তো অনুষ্ঠান শুরু হবে। তৈরি হবি না?’
‘হবো তো। তোকে দেখতে এসেছিলাম। বোইন প্লিজ, যা হবার হয়েছে। এইসব চিন্তা করে শরির খারাপ করিস না। তকদিরে যা থাকবে তাই হবে। যা তৈরি হয়ে নিচে আয়। আমি যাচ্ছি।’
নুরা বাধ্য মেয়ের মতো মাথা এক পাশে কাত করে সম্মতি দিলো। খুশি মনে চলে গেল রিমি। সে যেতেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো নুরা। নিজেকে স্বাভাবিক করে রুমে এসে হলুদ রঙ্গের লেহেঙ্গা পরে তৈরি হয়ে নিলো। প্রসাধনী বেশি ব্যবহার করেনি। মুখে শুধু ক্রিম আর ঠোঁটে লিপজেল ইউজ করলো। আয়নায় নিজেকে ভালো ভাবে একবার দেখে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে রুম থেকে বেরুলো। কিছুক্ষণ আগের বিষণ্ণ মন দূর করে নিজেকে হাসিখুশি রাখলো। কেউ টেরও পেলো না।
____________________
কানে ঝুমকা পরতে পরতে দ্রুত হাঁটছে দীবা। ধ্যাৎ! অনেক দেরি করে ফেলেছে। এতোক্ষণে নিশ্চয় অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে? ভাবতেই আরো অস্থির হয়ে উঠলো সে। হাত দিয়ে লেহেঙ্গা হালকা উঠিয়ে দ্রুত পা চালাতে লাগলো। তখুনি হাতে খেচকা টান পরলো তার। ভড়কে গেলো দীবা। ভয়ে চোখমুখ খিঁচে ফেলল একদম। বেশ কিছুক্ষণ ধরে কোনো কিছুর সাড়াশব্দ না পেয়ে পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালো দীবা। চোখ খুলতেই আবরারের মুখখানি নিজের খুব কাছে আবিষ্কার করলো। চোখ ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারলো দুজন একটা বদ্ধ রুমের ভিতরে আছে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো দীবা। হঠাৎ এভাবে টান দিয়ে আনায় বড্ড রাগ হলো তার। মুখ শক্ত করে আবরারের বক্ষস্থলে ধা’ক্কা দিয়ে কাটকাট গলায় বললো, ‘এখানে আনলেন কেন?’
দীবা রাগের ধা’ক্কাট আবরারের জন্য একদম তুচ্ছ। সে জায়গা থেকে নড়লো না। উল্টো দীবার দিকে এগিয়ে আরেকটু নিবিড় হলো। দীবার কোমড়ে এক রেখে অপর হাত দীবার গালে রেখে কপালে কপাল ঠেকালো। চোখে চোখ রেখে মৃদু গলায় বললো, ‘ভালোবাসি বউ।’
রাগটা মুহূর্তেই কর্পূরের ন্যায় উড়ে গেলো। লজ্জাভূতি হলো মন। গাল লাল হয়ে এলো। লজ্জায় আবরারের থেকে চোখ ফিরিয়ে মাথা নত করে ফেললো। দীবার এই লজ্জা মাখা মুখখানি দেখে নেশা জাগলো আবরারের মনে। দীবার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে বলল, ‘শাড়ি পড়ো না? ভেবেছিলাম হলুদে শাড়ি-টাড়ি পরবে বোধহয়।’
‘শাড়ি পরতে ঝামেলা লাগে।’
‘আমি তোমাকে কখনো শাড়িতে দেখিনি।’
আবরারের কথা শুনে চোখ তুলে তাকালো দীবা। মেহেদী রাঙ্গা হাত তুলে আবরারের ডান গাল টিপে দিয়ে মিষ্টি হেসে বললো, ‘একদিন পড়ে দেখাবো।’
দীবার প্রত্যুত্তর শুনে প্রফুল্লিত হয়ে হাসলো আবরার। দীবার সঙ্গে আরো নিবিড় হতে চাইলে দীবা অস্থির কন্ঠে বলে উঠলো, ‘দেরি হয়ে যাচ্ছে। অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাবে। আমি যাই ছাড়ুন।’
কে শুনে কার কথা! আবরার তো একদম নির্বিকার। নিজের মতোই দীবার কাছাকাছি থেকে আলতোভাবে বললো, ‘যাবার আগে একটু আদর দাও।’
হতভম্ব হয়ে গেলো দীবা। চোখ বড়বড় করে আবরারের দিকে তাকালো। তাকে এভাবে তাকাতে দেখে আবরার আবারো বলে উঠলো, ‘আশ্চর্য আমি কোনো পাহাড় পর্বত এনে দিয়ে বলি নাই। এভাবে তাকানোর কি আছে? জাস্ট একটু আদর চেয়েছি। কিপটামি করছো কেন? জামাইটার প্রতি মায়া নেই তোমার? নির্দয় মেয়ে!’
দীবা একদম কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলো। ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থেকে কয়েকবার চোখের পলক ফেললো। বিস্মিত হয়ে অস্ফুটিত কন্ঠে বলে উঠলো, ‘আমি কি একবারো বলেছি আদর দিবো না?’
নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসি দিলো আবরার। মাথাটা দীবার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘তাহলে দাও।’
আবরারের মাথা এগুতেই দীবা নিজের মাথা পিছালো। ভ্রুঁ কুঁচকে ত্যাছড়া ভাবে বললো, ‘দিবো বলেছি নাকি?’
মুহূর্তে হাসি খানা মুখ থেকে গায়েব হয়ে গেলো আবরারের। ক্রোধ বাড়লো দীবার উপর। চোয়াল শক্ত করে দীবাকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। তীক্ষ্ণ চোখে দীবার তাকিয়ে রাগ দেখিয়ে বলে উঠলো, ‘লাগবে না আমার।’
দাঁড়ালো না আর। গটগট পায়ে বেড়িয়ে গেলো রুম থেকে। আবরার যেতেই উচ্চস্বরে হেসে উঠলো দীবা। ভদ্রলোক কে রাগাতে ভীষণ ভালো লাগে। ইশ! রেগে গেলে নাক লাল হয়ে যায়। ভাবতেই আবারো হাসি পেলো। নিজেও দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
__________________
বাড়ির সামনে বিশাল আঙ্গিনায় হলুদ স্টেজ করা হয়েছে। চারপাশে জ্বলছে রঙবেরঙের বাত্তি। সম্পূর্ণ স্টেজটা করা হয়েছে কাচা ফুল দিয়ে। ফুলের সৌরভে চারপাশ মু-মু করছে। অবশ্য ডেকুরেশনের আইডিয়াটা অভ্রের। তার এই আইডিয়াটা বরাবরই প্রশংসা যোগ্য।
স্টেজের মাঝে বসে আছে রাইমা। পরনে তার হলুদ শাড়ি। গাঁদাফুল ও গোলাপ ফুলের সংমিলিত গয়না রাঙ্গিয়ে রেখেছে তাকে। ঠোঁটে তার মিষ্টি আমোদিত হাসি। আশেপাশের আত্মীয়, কাজিন সবাই উল্লাসিত। হাসি আনন্দের সঙ্গে শুরু হলো রাইমার ইয়েলো নাইট। মেয়েরা একই ডিজাইনের লেহেঙ্গা আর ছেলেরা একই ডিজাইনের পাঞ্জাবি পরলো। হলুদে হলুদে একদম পারফেক্ট কম্বিনেশন!
সবার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে দীবা ও রিমি। নুরার বিষণ্ণ মনের কারণটা দীবাকে বললো রিমি। তবে রাজ যে দীবাকে পছন্দ করে, দীবার জন্য যে রাজ আর আবরারের মাঝে ঝামেলা হয়েছে তা লুকিয়ে রেখেছে। সম্পূর্ণ ঘটনা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলো দীবা। রাজ অন্য একটা মেয়েকে ভালোবাসে শুনে মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পরলো। রাজের জন্য নুরার এমন অবস্থা? রাজের জন্য নুরা কষ্ট পাচ্ছে। ভাবতেই রাজের প্রতি ক্ষোভ জন্মালো তার মনে। বিরক্ত হয়ে রাজের প্রতি ক্ষোভ নিয়ে বলে উঠলো, ‘ইচ্ছে করছে রাজের মাথাটা দেয়ালে টোকা খাওয়াতে।’
সিরিয়াস মুহূর্তে এমন মন্তব্য শুনে কিংকর্তব্য রিমি। হাসি পেলো তার। বললো, ‘কেন?’
দীবা চেহারায় বিরক্তি নিয়ে বললো, ‘বাংলা সিনেমার মতো স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ব্যাটা তার পুরনো প্রেমিকা কে ভুলে যেতো। তারপর নুরার সঙ্গে লাইন ক্লিয়ার হয়ে যেতো। ভালো হতো না?’
হেসে ফেললো রিমি। দীবার বাহুতে আলতোভাবে থা’প্প’ড় মে’রে বললো, ‘সিরিয়াস মুহূর্তেও তোর দুষ্টুমি যায় না? কি করবি তা ভাব আগে। রাজের সঙ্গে নুরার রিলেশন সেট করবি নাকি নুরাকে মুভ অন করতে বলবি?’
দীবা হঠাৎ-ই ক্ষেপে উঠলো। কপাট রাগ দেখিয়ে বলে উঠলো, ‘আশ্চর্য নুরা মুভ অন করবে কেন? মুভ অন ওই শ’য়’তা’ন রাজকে করতে হবে। পুরনো প্রেমিকা কে ভুলে গিয়ে নুরার কাছেই আসতে হবে। ব্যাটা ইচ্ছে করে আসলে আসবে নাহলে ধরে বেধে নিয়ে আসবো। হাহ্!!’
আরো কিছু বলতে যাবে দুজন তখুনি ডাক আসলো তাদের। বরপক্ষ থেকে হলুদের তথ্য এসেছে। চিন্তাভাবনা সব এক পাশে রেখে দুইজন উল্লাসিত হয়ে গেল সবাইকে আমন্ত্রণ জানাতে। বরের বাড়ি থেকে আসা কাচা হলুদ ভাটা স্টেজের সামনে রাখা হলো। এবার কনের গায়ে হলুদ লাগানোর পালা। প্রথমে স্টেজে গেলো রোশান ও নিশিতা। রাইমাকে হলুদ লাগিয়ে দিয়ে নিশিতা তার হাতের চুড়ি খুলে রাইমাকে পরিয়ে দিয়ে স্টেজ থেকে নেমে গেলো। তারপর আসলো হোসেন ও আয়েশা। দুজন মেয়ের গালে হলুদ লাগিয়ে দিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পরলো। আয়েশা মেয়ের গলায় নিজের প্রিয় হারটা পরিয়ে দিয়ে প্রাণ ভরে দোয়া করলো। নিজেদের সামলে স্টেজ থেকে নেমে গেলো। তারপর নিশিতা সাবিত ও আবরারকে বললো হলুদ দিতে। দুইজন হাসি হাসি চেহারায় স্টেজে উঠলো। সাবিত রাইমার পাশে বসলেও আবরার বসলো না। সামনে দাঁড়িয়ে থেকেই তর্জনী আঙ্গুলে অল্প করে হলুদ নিলো। সাবিত আর আবরার দুজন একইসঙ্গে রাইমার দুই গালে হলুদ লাগালো। রাইমার ঠোঁটে মিষ্টি হাসি। চোখ লাল হয়ে এলো তার। ঠোঁট ভেঙ্গে কেঁদে ফেললো রাইমা। তাকে কাঁদতে দেখে দুই ভাইয়ের বুক ভার হয়ে এলো। আবরার এগিয়ে এসে রাইমার পাশে বসে মাথায় হাত বুলাতে লাগলো। শান্ত্বনা দিতে লাগলো সাবিত। রাইমাকে নিয়ে শৈশবে কতশত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। সেই ছোট রাইমার আজ গায়ের হলুদ। কাল যাবে শ্বশুর বাড়ি। দুইজন রাইমাকে জড়িয়ে ধরে শান্ত্বনা দিতে লাগলো। তিন ভাই বোনের এই সুন্দর মুহূর্ত গুলো ফ্রেমে বন্দি করে নিলো ক্যামেরা ম্যান।
.
নুরা এক পাশে দাঁড়িয়ে রাইমাকে দেখছে। রাইমার হাসির সঙ্গে সঙ্গে মাঝে মাঝে নিজেও খিলখিলিয়ে হাসছে। রাইমার থেকে চোখ সরিয়ে অন্যত্র তাকাতেই রাজকে দেখে বুকটা ধক করে উঠলো। অসাড় হয়ে এলো শরির। এতোদিন পর মানুষটাকে স্বচক্ষে দেখতে পেলো। অশান্ত মনে প্রশান্তির ভেলা ভাসতে লাগলো। প্রথমের মতোই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। রাজ এগিয়ে এলো তার দিকে। নুরার সামনে দাঁড়িয়ে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বললো, ‘কেমন আছো?’
প্রত্যুত্তরে নুরাও হাসলো। সাবলীল ভাবে জবাব দিলো, ‘এইতো ভালো। আপনি?’
‘ভালো।’
‘কখন এসেছেন? দেখলাম না তো আপনাকে।’
রাজ হাত ঘড়িতে সময় দেখতে দেখতে বলে উঠলো, ‘হলুদ নিয়েই এসেছি। আসলে আসতে চাইনি আম্মু জোর করে পাঠিয়েছে। বলে একমাত্র ভাই তুই যাবি না তো কে যাবে। তাই বাধ্য হয়েই এলাম।’
ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকে এলো নুরার। কারণ জানতে চাইলে রাজ মাথা চুলকে বললো, ‘আসলে বেশি মানুষজনের মাঝে আমার কেমন জানি লাগে। এইসব থেকে আমি সবসময় দূরে থাকি।’
রাজের কথা শুনে হেসে ফেললো নুরা। ঠোঁটে হাসি রেখেই বললো, ‘আপনি তাহলে একঘেয়ে মানুষ।’
‘হ্যাঁ!’ এইটুকু বলেই থেমে গেলো রাজ। কি বলবে বুঝে পেলো না সে। কিংবা নুরার কাছে কেন এসেছে সেটাও জানে না সে। আড় চোখে নুরার দিকে তাকালো একবার। হালকা সাজে ভীষণ মিষ্টি লাগছে মেয়েটাকে। কেন জানি নুরার প্রশংসা করতে ইচ্ছে করলো তার। তাই নুরার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘তোমাকে আজ সুন্দর লাগছে।’
লজ্জা পেলো নুরা।রাজের থেকে চোখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। নুরার লজ্জা মাখা মুখ দেখে রাজও স্মিতি হাসলো। তখুনি সেখানে আবরারের আগমন ঘটলো। তীক্ষ্ণ চোখে রাজের দিকে তাকালো আবরার। তার চোখের চাহনি দেখে ভয় পেয়ে গেলো নুরা। দুজনের মাঝে যদি এখন ঝামেলা বেধে যায়? ভাবতেই আত্মা কেঁপে উঠলো তার। ভয়ে শুকনো ঢোক গিললো নুরা। মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলো।
চলমান…#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির
[পর্ব-৪৯]
ভয়ার্ত নুরাকে অবাক করে দিয়ে আবরার রাজের দিকে হাত বাড়ালো হ্যান্ডসেক করার জন্য। বিস্মিত হলো নুরা। ঝড় আসার পূর্বাভাস এটাই। আরব ভাইয়ের মাথায় যে অন্য কিছু ঘুরছে সেটা বুঝতে বাকি রইলো না নুরার। ভয়ে ভয়ে এগিয়ে আবরারের বাহু জড়িয়ে ধরলো। বুঝাতে চাইলো আবরার যেন কোনো প্রকার সিনক্রিয়েট না করে। হাসলো আবরার। ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে নুরার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো, ‘রিলেক্স! আমি তো জাস্ট আলাপ করতে এসেছি। আফটার অল হি ইজ আওয়ার নিউ রিলেটিভ। তো ভাই। কি অবস্থা? দিনকাল কেমন যায়?’
তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো রাজ। আবরারের মতিগতি বুঝার চেষ্টা করলো। মনে হাসলো কেবল। নিজেও হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডসেক করে উত্তর দিলো, ‘এযাবৎ ভালোই যাচ্ছিলো। আপাতত কেমন চলছে বলতে পারবো না।’
চোয়াল শক্ত করে ফেললো আবরার। পরোক্ষনে রাগ দমিয়ে এক গাল হেসে উঠলো যেন দুজনের মাঝে বেশ বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্ক। উগ্র চোখে তাকিয়ে গলার স্বর নামিয়ে বলল, ‘ভালো না চলার ব্যবস্থা করতেই ইচ্ছে করে। কিন্তু আফসোস, আমি আবার ভালো মানুষ। অন্যের সম্পদে নজর দেই না।’
আবরারের কথা শুনে হেসে উঠলো রাজ। বিদ্রোপ মাখা কন্ঠে বললো, ‘অর্ধাঙ্গিনী কে যেই লোক সম্পদ ভাবে সেই লোক ঠিক কতটা ভালো সেটা সবাই জানে।’
মুহূর্তেই ক্রোধান্তিত হলো আবরারের চেহারা। চোখমুখ শক্ত করে রাজের দিকে এগিয়ে আসতে চাইলে নুরা দুজনের মাঝে দাঁড়িয়ে বাধা দিলো আবরারকে। রাজ আগের জায়গায় ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে আছে আবরারের দিকে।
দূর থেকে রাজ ও আবরারকে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে উঠলো রিমি। ভয়ে চোখ বড়বড় করে তাকালো। এখন কি ওইদিনের মতো মা’রা’মা’রি শুরু করবে নাকি আবার? ভাবতেই গা শিউরে উঠলো। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দীবার হাত টেনে বললো, ‘বোইন ওই দেখ আবরার ভাই। নিশ্চয় রেগে আছে কোনো কারণে। তুই ভাইকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যা। তাড়াতাড়ি!’
রিমির কথা শুনে আবরারের দিকে তাকাতেই ভ্রুঁ কুঁচকে এলো দীবার। এই লোক এখনো রেগে আছে? তার উপরের রাগ আবার অন্য কারোর উপরে ঝাড়ছে নাকি? ভাবতেই কপাল চাপড়ালো দীবা। বিরক্ত হয়ে রিমিকে বললো, ‘তোর ভাই যে কি আল্লাহ ভালো জানে।’
‘তুই অন্য কোথাও নিয়ে যা জলদি।’ দীবাকে তাড়া দিয়ে বলে উঠলো রিমি। দীবা বিলম্ব না করে দ্রুত আবরারের কাছে আসলো। আবরারের সামনে রাজকে দেখে হাসি দিয়ে সালাম দিলো। রাজ সালামের উত্তর নিলে দীবা বললো, ‘আপনি এখানে একা দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ওখানে যান। সবাই সেখানেই আছে।’
রাজকে কথাটা বলেই আবরারের বাহু ধরে বললো, ‘আপনি আমার সাথে আসুন। একটা কাজ আছে।’
এমনিরেই দীবার উপরে রেগে আছে আবরার। তার উপর আবার এখন রাজের উপর। তাই সে মারাত্মক রাগান্বিত। দীবার হাত নিজের বাহু থেকে ছাড়িয়ে বললো, ‘আমি যাবো না।’
অবাধ্য দীবা ছাড়লো না আবরারকে। আবরারের ডান হাত শক্ত করে ধরে টানতে টানতে বললো, ‘আশ্চর্য ভাই আমার তো আপনাকেই লাগবে। আসুন জলদি।’
আবরাকে কিছু বলতে না দিয়ে তাকে নিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো নুরা। রাজের দিকে তাকাতেই স্তব্ধ হয়ে গেলো। রাজের চেহারা একদম নির্বিকার। তার চোখ দুটো দেখে নুরা অনায়াসে বুঝে গেলো সে ভীষণ বিব্রত। হয়তো দীবা ও আবরারকে পাশাপাশি দেখে। নুরা কিছু বলতে যাবে তার আগেই রাজ হাত ঘড়িতে সময় দেখে বলে উঠলো, ‘আমার দেরি হয়ে যাবে নুরা। আমি আসি। ভালো থেকো।’
কথাটা বলেই মুহূর্তেই চলে গেলো রাজ। পিছু দাঁড়িয়ে থেকে রাজের চলে যাওয়া দেখলো। আজ রাজকে অদ্ভুত ভাবেই ভীষণ সুন্দর লাগলো। এই প্রথম রাজকে সে পাঞ্জাবিতে দেখেছে। মুগ্ধ হলো নুরা। মনে মনে ঠোঁট নাড়িয়ে বললো,
”You are my beautiful secret, and I hope someday you realize it, because I do not have the courage to admit it just now, I am scared that I would lose you.”
____________________
বাড়ির ভিতরে যেতেই আবরার দীবার হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। চেহারায় বিরক্তি ও অসন্তুষ্টি এনে বললো, ‘কি সমস্যা তোমার? এখানে এনেছো কেন?’
দীবা চোখ ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকালো। আবারো আবরারের কথা অমান্য করে আবরারের হাত ধরে সামনে হাঁটতে হাঁটতে বললো, ‘এখানে বলবো না। আমার সাথে আসুন।’
আবরার এবার প্রচুর বিরক্ত হয়ে বললো, ‘কি দীবা?’
উত্তর দিলো না দীবা। আবরারকে নিয়ে একটা রুমে চলে আসলো। দরজা লাগিয়ে দিয়ে দিয়ে পিছু ফিরে দাঁড়ালো। কোমড়ে দুই হাত রেখে কটমট চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘এবার বলুন আপনার সমস্যা কোথায়?’
ভ্রুঁ কুঁচকে এলো আবরারের। তাকে এখানে জোরপূর্বক আনা হয়েছে আবার তাকেই জিজ্ঞেস করছে কি সমস্যা তার? দীবার এই ছেলেমানুষিতে অন্যান্য সময় হাসলেও এখন রাগ বাড়লো। ধমক দিয়ে বলে উঠলো, ‘দীবা? এখানে এনেছো কেন বলো।’
ধমক শুনে ভয়ে থমথমে খেলো দীবা। হাস্যউজ্জ্বল মুখটা মুহূর্তেই ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো। চোখমুখ কালো করে মিনমিনে গলায় বললো, ‘আপনি রেগে আছেন তাই রাগ ভাঙ্গাতে এনেছিলাম।’
কথাটা বলেই মন খারাপ করে মাথা নিচু করে ফেললো দীবা। এবার তার রাগ লাগছে। আবরারের উপর না বরং রিমির উপর। আবরারকে হুদাই এখানে আনার কথা বলল্প কেন? না রিমি তাকে এই কথা বলতো, আর না সে এই কাজ করে ধমক খেতো। ইচ্ছে করছে রিমির চুল ছিঁ’ড়’তে। মনে মনে ভাবতেই দাঁতে দাঁত কিড়মিড় করলো দীবা। রুম থেকে বেড়িয়ে যেতে চাইলে আবরার তার হাতের কব্জি ধরে নিজের দিকে টান দিলো। দীবা আবরারের বুকে এসে পরল। হকচকিয়ে গেলো দীবা। ফ্যালফ্যাল চোখে আবরারের দিকে তাকাতেই আবরার দুষ্টু হেসে বলে উঠলো,
‘তাহলে রাগ না ভাঙ্গিয়ে চলে যাচ্ছো কেন?’
লজ্জা পেলো দীবা। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে অভিমানি গলায় বললো, ‘আপনি অনেক খারাপ। আমাকে ধমক দিয়েছেন। রাগ ভাঙ্গাবো না।’
শব্দ করে হেসে ফেললো আবরার। দীবার উন্মুক্ত চুল গুলো কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে বললো, ‘আচ্ছা তখনের জন্য সরি। আর ধমক দিবো না।’
অভিমান ভাঙ্গলো না দীবার। অন্যদিকেই মুখ ঘুরিয়ে রাখলো। তাকালো না ফিরে। আবরার দীবার গালে ছোট করে একটা চুমু দিয়ে আহ্লাদী গলায় বললো, ‘মিষ্টি বউ? আর হবে না বললাম তো। এবার ফিরে তাকাও।’
আবরারের আহ্লাদী কণ্ঠস্বর শুনে অভিমানি দীবা হেসে ফেললো। মুখ ফিরিয়ে আবরারের কপালের সঙ্গে নিজের কপাল মিশালো। ঠোঁটে হাসি রেখেই বললো, ‘আপনি অনেক ঢং জানেন।’
আবরার নিশ্চুপ। দীবার ঠোঁটের দিকে এগুতে চাইলেই মোবাইলের বিরক্তিকর রিংটোন বেজে উঠলো। মনোযোগের ব্যাঘাত ঘটায় চোয়াল শক্ত করে পকেট থেকে মোবাইল বের করলো আবরার। কল রিসিভ করার পরপরই অপর পাশ থেকে সাবিতের অস্থির কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো, ‘ইডিয়ট কই তুই? মিডিয়ার লোক এসেছে। তাড়াতাড়ি নিচে আয়।’
সুন্দর একটা মুহূর্ত নষ্ট করার জন্য সাবিতের একটা কল-ই যথেষ্ট ছিলো। আবরারের মুখখানি দেখে মনে হলো সে ভিষণ অসন্তুষ্ট। নিজের হাসি ধরে রাখতে না পেরে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো দীবা। তাকে হাসতে দেখে আবরার মুখ কালো করে বললো, ‘হাসো হাসো। ইচ্ছে মতো হাসো। হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি খাও।’
কোনো রকমের হাসির মাত্রা কমালো দীবা। এগিয়ে এসে আবরারের গালে ছোট করে একটা চুমু দিয়ে বললো, ‘তাড়াতাড়ি যান।’
খুশি মনে মিষ্টি একটা হাসি দিলো আবরার। তারপর নিচে যাবার জন্য রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো দুজন। আবরার মিডিয়ার লোকদের সঙ্গে আলাপ করে বিদায় দিলো। কারণ সে নিজে সেলেব্রিটি হলেও তার পরিবারের লোকদের প্রাইভেসি আছে। আবরার চায় না বাড়ির কোনো মেয়েরা মিডিয়ার সামনে আসুক। ছোট এই ঝামেলা টা আবরার, অভ্র ও সাবিত মিলে খুব সহজেই সমাধান করে নিলো। অতঃপর আবারো শুরু হলো হলুদের অনুষ্ঠান। রাইমাকে স্টেজের মাঝে বসিয়ে সামনে তার কাজিনরা নিত্য পরিবেশন করে আনন্দ করছে। অন্যদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে হাত তালি দিচ্ছে নুরা ও দীবা। তারা তিনজনও নাচার পরিকল্পনা করেছিলো কিন্তু সাবিতের চোখ রাঙ্গানোর কারণে তা সেখানেই স্থগিত হয়েছে। যদিও এই জন্য মন খারাপ করেছিলো তিনজন। কিন্তু পরে সাবিত ফুচকা খাইয়ে দিয়ে মন ভালো করে দিয়েছে। এখন অন্যদের নাচ দেখে উপভোগ করছে দুজন। যদিও এখানে রিমি অনুপস্থিত। এখানেই কোথাও আছে ভেবে দুইজন তেমন গুরুত্ব দেয় নি। নিজেদের মতো পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। তখুনি পিছন থেকে সাবিত ডেকে আনলো। দুইজনকে নিজের রুম থেকে ওয়ালেট আনতে বললো। বিরক্ত হলো নুরা। চোখমুখ কালো করে বললো, ‘নাচতে দিলে না এখন আবার নাচ দেখতেও দিবে না?’
সাবিত ব্যস্ততা দেখিয়ে বললো, ‘তাড়াতাড়ি যা! ওয়ালেটে একটা কার্ড আছে এখন দরকার। নিয়ে আয়।’
অনিচ্ছা থাকার পরেও দুইজন বাড়ির ভিতরে গেলো। দুতলার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে করিডোর দিয়ে হাঁটতে লাগলো। দীবাকে বাইরে রেখে নুরা সাবিতের রুমে গেল। সাবিতের দেওয়া লোকেশন অনুযায়ী আলমারি খুলে কাঙ্ক্ষিত জায়গা থেকে ওয়ালেট হাতে নিলো। তারপর রুম থেকে বেড়িয়ে দীবাকে সাথে নিয়ে নিচে যাবার উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরলো। করিডোরের মধ্য দিয়ে হাঁটার সময় হঠাৎ-ই দীবা দাঁড়িয়ে পরলো। তাকে দাঁড়াতে দেখে নুরাও দাঁড়ালো। বিরক্ত হয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই দীবা ইশারায় না করল। নুরার হাত ধরে নিঃশব্দে করিডোরের মাঝে থাকা খোলা বারান্দার দিকে এগিয়ে এলো। বারান্দার দরজার আড়াল থেকে বারান্দায় তাকালো। তার চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকাতেই চোখ দুটো ছানাবড়া নুরার। দীবার চোখও বিস্ময়ে কোটর বেড়িয়ে আসার উপক্রম। মুখ হা হয়ে গেল তাদের। অভ্র আর রিমিকে পাশাপাশি জড়িয়ে ধরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেছে দুজন।বিস্মিত হয়ে একে অপরের দিকে তাকালো একবার। নুরা কন্ঠ নামিয়ে অস্ফুটিত কন্ঠে বলে উঠলো, ‘এটা কিভাবে সম্ভব?’
দীবা অবাক চোখে সামনে তাকিয়ে বললো, ‘বোইন আমার মাথাটা দেয়ালে মা/র। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।
নুরা চেহারা কাদুকাদু ভাব এনে বললো, ‘আমাদের না জানিয়ে এতো বড় আকাম কেমনে করলো রিমি?’ চুপ হয়ে দুইজন তাদের দেখতে লাগলো।
_____________________
Baby, I’m dancing in the dark
With you between my arms
Barefoot on the grass
Listening to our favourite song
I have faith in what I see
Now I know I have met an angel in person
And she looks perfect
I don’t deserve this
You look perfect tonight. (Ed Sheeran-Perfect)
রেলিংয়ে পিঠ গেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রিমি। তার দুই পাশে দুই হাত রেখে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে অভ্র। দুজন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, কপালে কপাল ঠেকানো। অভ্রের মোবাইলে হেডফোন লাগিয়ে দুইজন এই গানটা শুনছে। চোখ বন্ধ করে সুন্দর মুহূর্ত টা অনুভব করছে। গানের প্রতিটা লাইন উপলব্ধি করছে। নির্জন জায়গায় দুটো প্রণয় একে অপরের ভালোবাসা প্রকাশ করছে। অনেকক্ষণ যাবত দুজন নিশ্চুপ থেকে অভ্র চোখ খুলে মৃদু গলায় রিমিকে ডাকলো, ‘রিমি?’
চোখ বন্ধ রেখেই রিমি অল্পশব্দে করলো, ‘হুম?’
রিমির কপাল থেকে নিজের কপাল সরিয়ে রিমির মুখের দিকে গভীর চোখে তাকালো অভ্র। কপালে পরে থাকা চুল গুলো কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে মৃদু গলায় জানতে চাইলো, ‘ভালোবাসো?’
চোখ বন্ধ রেখেই স্মিতি হাসলো রিমি। দুই হাতে অভ্রকে জড়িয়ে ধরে খুশি মনে বললো, ‘ভীষণ!’
‘যদি কেউ না মানে?’
চট করে চোখ দুটো খুললো রিমি। মাথা তুলে অভ্রের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘মানবে না কেন? হঠাৎ এই প্রশ্ন?’
অভ্র নির্বিকার ভাবে ঠোঁট উলটে ঘাড় নাচিয়ে বললো, ‘এমনি মনে হলো।’
দাঁতে দাঁত পিষে অভ্রের পেটে আলতো হাতে ধা’ক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলো রিমি। চোখ পাকিয়ে কপাট রাগ দেখিয়ে বলে উঠলো, ‘কখন কি বলতে হয় জানো না? আশ্চর্য, ভেবেছিলাম এখন রোমান্টিক রোমান্টিক কথা বলবে।’
দাঁত কেলিয়ে হাসলো অভ্র। রিমির দিকে এগিয়ে আরেকটু নিবিড় হয়ে কানের কাছে ফিশফিশ করে বললো, ‘রোমান্টিক কথা গুলো তো বাসর রাতের জন্য তুলে রেখেছিলাম। তুই যদি চাও তাহলে এখন থেকেই বলা শুরু করে পারি।’
অভ্রের বাহুতে চিমটি কেটে রাগ দেখিয়ে বললো রিমি, ‘অসভ্য ছেলে সারাদিন খালি বাসর বাসর করে।’
ভীষণ রকমের আশ্চর্য হলো অভ্র। কণ্ঠস্বর অবাক করে বললো, ‘সারাদিন কোথায় করলাম? রিলেশনের প্রথম এই শব্দটা তুলেছি আমি। বানিয়ে বানিয়ে ভালোই কথা বলতে পারো।’
রিমি রাগে কটমট করতে করতে বললো, ‘কি বললে রুমি? আমি বানিয়ে বানিয়ে কথা বলি?’
চরম লেভেলের হতাশ হয়ে কপাল নিজের চাপড়ালো অভ্র। রিমির এক গাল টেনে আহ্লাদী গলায় বললো, ‘থাক আজকে ঝগড়া করে সুন্দর মুহূর্তটাকে নষ্ট না করি। এইদিকে আসো।’
বলেই রিমিকে সামনের দিকে ঘুরালো অভ্র। পিছন থেকে রিমিকে জড়িয়ে ধরে রিমির কাধে চিবুক রেখে চোখ বন্ধ করলো। মুচকি হাসলো রিমি অভ্রের হাতের উপর নিজের হাত দুটো রেখে চোখ বন্ধ করলো। আবারো দুজন হারিয়ে গেলো নিজেদের মাঝে। অনুভব করতে লাগলো একে অপরকে।
_____________________
হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দীবা ও নুরা। এমন একটা দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছে যেন তারা আকাশ থেকে পরপর কয়েকবার ধপাস করে আ/ছা/ড় পরেছে। দুজন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না। দীবা নুরার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে হতভম্ব হয়ে বলে উঠলো, ‘চিমটি কাট তো। স্বপ্ন দেখছি বোধহয়।’
নুরা জোরে একটা চিমটি কাটতেই ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠলো দীবা। যদিও এই আর্তনাদের ধ্বনি দুজনের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিলো।ব্যাথা পাওয়ায় নুরার দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে বললো, ‘এতো জোরে দিতে বলেছি তোকে?’
দীবার কথার পাত্তা দিলো না নুরা। বিস্ময়ের রেশ এখনো কাটেনি তার। অবাক কন্ঠে বললো, ‘দুইজন না সারাদিন ঝগড়া করতো? তাহলে এতো প্রেম আসলো কোথায় থেকে?’
‘আমিও সেটাই ভাবছি।’ ঠোঁট কামড়ে বললো দীবা। নুরা তার হাতের দিকে তাকাতেই জিহ্বায় কামড় দিলো। বিরক্ত কন্ঠে বলে উঠলো, ‘সাবুদানা মনে হয় ওয়ালেটের জন্য অপেক্ষা করছে। তাড়াতাড়ি নিচে আয়।’
বলেই দুজন দ্রুত পা চালালো নিচে যাবার জন্য। সিঁড়ির কাছাকাছি আসতেই নুরার মোবাইলে টুংটাং ম্যাসেজের শব্দ ভেসে আসলো। নুরা মোবাইল অন করে দেখলো রাজের ম্যাসেজ। ম্যাসেজ টা ওপেন করতেই স্তব্ধ হয়ে গেলো সে। দাঁড়িয়ে পরলো তাৎক্ষনাৎ। পা দুটো একদম অচল হয়ে পরেছে যেন। তাকে দাঁড়িয়ে পরতে দেখে দীবাও দাঁড়িয়ে ডাক দিলো, ‘কিরে দাঁড়ালি কেন? তাড়াতাড়ি আয়।’
নুরা নির্বিকার। চোখে পানি জমে এলো তার। দীবার দিকে তাকিয়ে মোবাইলটা এগিয়ে দিলে দীবা ম্যাসেজটা পড়লো।
– ”আমি এয়ারপোর্ট আছি। ২ টায় ফ্লাইট। ভালো থেকো নুরা।”
নিঃশব্দে কেঁদে ফেললো নুরা। চোখ দিয়ে আপনাআপনি পানি গড়িয়ে পরতে লাগলো। দীবা বিস্মিত হয়ে বলে উঠলো, ‘একটু আগেই না হলুদে এসেছিলো? এতো তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছে স্যার?’
নুরা দীবার হাত ধরে ব্যাকুল কন্ঠে বললো, ‘রাজ চলে যাচ্ছে। কি করবো আমি এখন? বল না প্লিজ।’
দীবা ঠোঁট কামড়ে ভাবলো কিছুক্ষণ। কিছু একটা মাথায় আসতেই বলে উঠলো, ‘তুই এয়ারপোর্ট যা। এখুনি বেড়িয়ে পর। ফ্লাইট যেহেতু দুইটায় দেখা পাবি। তাড়াতাড়ি যা। আমি এইদিকটা ম্যানেজ করবো।’
নুরাকে তাড়া দিয়ে বললো দীবা। নুরা কিছু ভাবলো না আর। লেহেঙ্গা ধরে দৌড় লাগালো। সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত বেয়ে নেমে দৌড়ে বাড়ির গেইটের বাহিরে চলে গেলো। হলুদের স্টেজটা করা হয়ে দক্ষিণ পাশের খোলা আঙ্গিনায়। তাই বাড়ির সামনের জায়গাটা খালি। তাই নুরা অনায়াসে বেড়িয়ে গেলো সকলের অগোচরে।
ভয়ে দীবার হাত পা জমে এলো। বহু কষ্টে নিজেকে স্বাভাবিক করে স্টেজের কাছে গেলো। তাকে দেখেই সাবিত এগিয়ে এসে বললো, ‘এতো দেরি করলি কেন তোরা?’
দীবা ওয়ালেট এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘ওয়ালেট খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এই নাও।’
‘ওহ্! নুরা কোথায়?’
সাবিতের প্রশ্ন শুনে চমকে গেলো দীবা। টের পেয়ে গেলো নাকি? কি বলবে সে? চটজলদি তেমন কিছু ভাবতে পারলো না। তাই মাথা যা আসলো তাই বলে ফেললো, ‘আসলে নুরার একটু প্রবলেম হয়েছে। তাই রুমে গেছে। চলে আসবে পরে।’
‘আচ্ছা।’ বলেই সাবিত তার কাজে চলে গেলো। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো দীবা। মোবাইলে সময় দেখল এখন সাড়ে নয়টা বাজে মাত্র। এখান থেকে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর যেতে এক ঘন্টার মতো সময় লাগে। নুরা যেন সাবধানে সময় মতো সেখানে পৌঁছাতে পারে। সেই দোয়া-ই মনে মনে করতে লাগলো দীবা।
রাইমা স্টেজ থেকে দীবাকে ডাক দিলো। দীবা এগিয়ে রাইমার কাছে যেতেই রাইমা বলে উঠলো, ‘কোথায় হারিয়ে গেলি তোরা? রিমি নুরা কোথায়? একসাথে ছবি তুলবো না?’
অপ্রস্তুত হয়ে কোনো রকমে ঠোঁট টেনে হাসলো দীবা। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে রাইমার কানে কানে বললো, ‘আসলে নুরার প্রবলেম হয়েছে তাই রুমে। আর আসতে পারবে না।’
মন খারাপ করে ফেললো রাইমা। কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললো, ‘এখুনি সমস্যা হওয়ার ছিল? ধ্যাৎ! আচ্ছা তাহলে রিমি কোথায়? তাকেও তো দেখছি না।’
‘দেখবে কি করে? মহারানী তো লুতুপুতু করতে ব্যস্ত।’ কথাটা মনে মনে বললেও মুখে বললো, ‘এখানেই আছে মনে হয়। এসে যাবে। আসো ছবি তুলি?’
রিমি ও নুরার ব্যাপারটা এতোটাও গুরুত্ব সহকারে ভাবলো না রাইমা। স্বাভাবিক ভাবে নিয়ে দীবার সঙ্গে ছবি তুলতে লাগলো। দীবা যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। তবে মনে মনে একটুও স্বস্তি পাচ্ছে না দীবা। নুরা একা বেড়িয়েছে। ভাবতেই কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছে তার। বারবার মোবাইলের দিকে তাকাতে লাগলো। গাড়ি পেয়েছে তো মেয়েটা?
___________________
রাতের আধারে ঢেকে থাকা রাস্তা সোডিয়ামের কৃতিম আলোতে আলোকিত হয়ে আছে। চারপাশ একদম নিশ্চুপ। রাস্তাঘাট ফাঁকা। কোনো গাড়ির আনাগোনা নেই। চিন্তিত নুরা ভীষণ রকমের বিরক্ত হলো। আশ্চর্য! আজই গাড়ির অভাব পরলো রাস্তায়? তবুও থামলো না নুরা। লেহেঙ্গা ধরে দ্রুত সামনের দিকে এগুতে লাগলো। ভাগ্য করে একটা সিএনজি পেয়েই গেলো নুরা। এক হাত উঠিয়ে গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভারে কাছে এগিয়ে গিয়ে দেখলো পরিচিত লোকটা। তাই নুরা বিলম্ব না করে গাড়িতে উঠেই তাড়া দিলো, ‘আব্দুল চাচা আমাকে তাড়াতাড়ি এয়ারপোর্ট নিয়ে যান। বেশি সময় নেই হাতে।’
বৃদ্ধ লোক পান চিবুতে চিবুতে বললো, ‘আইজকা আবার কেডা আইবো? তোমাগোর বাড়িতে না অনুষ্ঠান চলে? কই যাও একলা?’
‘চাচা আমার বান্ধুবি আসবে ইউকে থেকে। দেরি হয়ে গেছে আমার। অপেক্ষা করছে নিশ্চয়। তাড়াতাড়ি চলুন প্লিজ।’
ড্রাইভার গাড়ি চালাতে চালাতে বললো, ‘তোমার বোইনের বিয়া খাইতে আইবো নাকি?’
‘হ চাচা। তাড়াতাড়ি চালান।’
অস্থির কণ্ঠে বললো নুরা। এক হাতে ঘামে ভিজে যাওয়া কপাল মুছে সিটে হেলান দিলো। মোবাইলে টুংটাং শব্দ বাজতেই ম্যাসেজ চেক করে দেখলো দীবা ম্যাসেজ দিয়েছে, ‘কোথায় তুই? গাড়ি পেয়েছিস?’
‘হ্যাঁ, আব্দুল চাচার গাড়িতে আছি।’
‘পৌঁছে জানাবি প্লিজ। টেনশন লাগছে আমার।’
‘আচ্ছা।’
ছোট করে উত্তর দিয়ে মোবাইল রাখলো নুরা। অতিরিক্ত উত্তেজনায় হৃদযন্ত্রটা তার ঢিপঢিপ শব্দ তুলে বাজছে। বারবার মোবাইলে সময় দেখছে আর ভাবছে রাজের দেখা পাবে তো সে? রাজকে আটকাতে পারবে? রাজ কি তার কথা শুনবে? কিভাবে বুঝাবে রাজকে? সব কিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে নুরার। উত্তেজনার কারণে মাথা কাজ করছে না। গলা শুকিয়ে গেছে একদম। বারবার শুকনো ঢোক গিলছে।
চলমান…