#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ ❤️
#মাইশাতুল_মিহির
[পর্ব-১৩]
কোলাহলপূর্ণ আগ্রাবাদ মহিলা কলেজ। স্টুডেন্টরা যে যার প্রিয় বান্ধুবান্ধবের সাথে গল্প গুজবে ব্যস্ত। কলেজ ভবনের সামনে সবুজ দুর্বা ঘাসের উপর আসন পেতে আড্ডা দিচ্ছে দীবা, রিমি, নুরা ও আরো কয়েকজন সহপাঠী। বান্ধুবীরা মিলে কথোপকথনে হাস্যউজ্জল করে রেখেছে পরিবেশ। ইউনিফর্ম পরিহিত দীবার সোজা সিল্কি চুল গুলো উঁচু করে জুটি বাধা। কথা বলার ধরনের সাথে সাথে তাল মিলিয়ে চুল দুলছে। অদূরের দ্বিতীয় তলা থেকে একজোড়া মুগ্ধ হওয়া চোখ একমনে দেখছে দীবাকে। দীবার এই সৌন্দর্য, মায়াবী মুখশ্রীতে বরাবরই গায়েল হয় রাজ। পকেটে দুই হাত গুঁজে দেয়ালে হেলান দিয়ে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। পাশ থেকে রাজের বন্ধু রোহান বললো, ‘দূর থেকে আর কত ভাই? বলে দে না এবার।’
রাজ দীবার দিকে একদৃষ্টি রেখে উত্তর দিল, ‘উহুম, দূর থেকে ভালোবাসার এক অন্যরকম ভালো লাগা আছে। সানজু আরেকটু বড় হোক তারপর লিখিত ভাবে আমার করে নিবো।’
রোহান চেহারায় চিন্তার ভাব এনে বললো, ‘তার আগেই যদি অন্য কেউ নিয়ে যায়?’
রাজ কিছুটা দৃঢ়বদ্ধ গলায় বলে উঠলো, ‘হবে না। সানজু শুধু মাত্র আমার।’
রোহান হেসে বললো, ‘ভাই তোরে বুঝা আসলেই মুশকিল।’
প্রত্যত্তরে নিঃশব্দে হাসলো রাজ। মনে পরলো তার সেই দিনের কথা। দীবাকে সে প্রথম বৈশাখী মেলায় লাল শাড়িতে দেখেছিলো। তখন দীবা কেবল মাত্র ক্লাস এইটে পড়তো আর রাজ অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে। দীবারা তখন চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলায় তাদের নিজস্ব বাড়িতে থাকতো। রাজরাও সেই এলাকায় থাকতো। একই এলাকায় হওয়ায় সুবিধে ছিলো বেশ। শুরু হয় রাজের লুকিয়ে দীবাকে দেখা। প্রতিদিন সকালে বিকেলে রোজ নিয়ম করে দীবা স্কুল থেকে আসা যাবার সময় রাজ দূর থেকে এক পলক দেখতো। দীবা ক্লাস নাইনে উঠার পর দীবার পরিবার আগ্রাবাদ চলে আসে। রাজ অনেক খোঁজাখুঁজি করেছে কিন্তু ব্যর্থ। তবুও হাল ছাড়েনি সে। তার ঠিক এক বছর পর রাজ খোঁজ নিয়ে জানতে পারে দীবারা আগ্রাবাদ থাকে। সেও ট্রান্সফার নিয়ে আগ্রাবাদ চলে আসে। দূর থেকেই দীবার পাশাপাশি থাকতো সে। কখনো সামনে আসেনি। এসএসসির পর দীবার বাবা এ*ক্সি*ডে*ন্টে মা*রা গেলে দীবা আর তার মা রোশান পরিবারে থাকা শুরু করে। রাজ দূর থেকেই সব দেখেছে। দীবা কলেজে উঠার পর রাজ অনেক কষ্টে সেই কলেজের সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ হয়েছে। যদিও এই জন্য অনেক কাঠখড় পুড়াতে হয়েছে রাজের। এতো বছর দীবাকে সে দূর থেকে ভালোবেসে এসেছে। এখনো প্রথমের মতোই ভালোবাসে। প্রকাশ না করে ভালোবাসা আসলেই অনেক সুন্দর। দূর থেকেও ভালোবাসা যায়। দূর থেকেও আগলে রাখা যায়। রাজের জন্য হয়তো এই ভালোবাসার অনুভূতি টাই সব চেয়ে সেরা!
‘দূর হতে আমি তারে সাধিব,
গোপনে বিরহ ডোরে বাধিব!’
________________________
পশ্চিম আকাশে সূর্য ডুবুডুবু প্রায়। তার হলুদ লালচে আভা ছড়িয়ে আছে চারপাশে। গোধূলির এই সন্ধ্যায় কুহু পাখির ডাক, শীতল সতেজ হাওয়া মনের আনাচে কানাচে মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। মাগরিবের নামাজ পরে দীবা রান্না আসলো চা বানাতে। প্রয়োজনীয় সকল মশলা দিয়ে চা বানালো। তারপর এক এক করে সবার রুমে চা দিয়ে আসলো দীবা। কিন্তু আবরারকে দেয়নি। তবে অভ্রকে অন্যদের মতোই নিয়ম করেই চা দিয়েছে। এই কয়দিনে অভ্রের সাথেও তার সম্পর্ক বেশ ভালোই বন্ধুশোভল হয়েছে। সেই সুবাদে অভ্র প্রতিদিনই দীবার হাতের চা খাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। আজও তাই। সবাইকে চা দিয়ে অভ্রের রুমে আসলো চা দিতে। কিন্তু রুমের দরজার কাছে এসে দেখলো আবরার অভ্রের রুমে বসে কথা বলছে। দীবা ভিতরে না গিয়ে দাঁড়িয়ে পরলো দরজার কাছে। চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ানোর আগেই অভ্র তাকে দেখে বলে উঠলো, ‘আরেহ চলে যাচ্ছেন কেন? ভিতরে আসেন।’
দীবা ইতস্ততবোধ করতে লাগলো। ঠোঁট টেনে বোকা বোকা টাইপ হাসি দিলো একটা। ধীর পায়ে চা কাপ হাতে নিয়ে রুমে ঢুকলো সে। চায়ের কাপটা এগিয়ে অভ্রের হাতে দিলো। অভ্র চা কাপ হাতে নিয়ে চুমুক বসালো তাৎক্ষনাৎ। মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বললো, ‘বাহ্! আপনার চা বরাবরই পারফেক্ট হয়।’
এতোক্ষণ আবিরার চুপচাপ বসে থেকে দেখছিলো সব। অভ্রের কথাটা শুনে ভ্রুঁ জোড়া তাৎক্ষনাৎ কুঁচকে এলো তার। দীবার চা পারফেক্ট হয় তা অভ্র কিভাবে জানে? কপালে চিন্তাজনক ভাজ পরলো আবরারের। জানার জন্য অভ্রকে প্রশ্ন করলো, ‘ পারফেক্ট হয় সেটা তুমি জানো কিভাবে?’
অভ্রের সহজ সরল স্বীকারুক্তি, ‘প্রতিদিন সকালে তো ভাবির হাতের চা মানে দীবার হাতের চা খাওয়া হয়। খুব ভালো চা বানায় উনি। মাশাআল্লাহ!’
আবরার চোখ ছোট ছোট করে দীবার দিকে তাকালো। বাড়িতে এসেছে আজ প্রায় অনেক দিন হলো। কিন্তু এখন অব্ধি দীবা তাকে চা দেয় নি। অথচ অভ্রকে রোজ নিয়ম করে সকালে চা দিয়ে যায়? হিংসে হলো আবরারের। বাড়ির প্রত্যেক সদস্য যদি চা পায় তাহলে সে কেন পাবে না? তার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হবে কেন? মাত্রারিক্ত রাগান্বিত হলো আবরার। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তার। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে দীবার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। তারপর কিছুটা শক্ত, কিছুটা তেজি গলায় বললো, ‘আমার রুমে আসো। এখুনি।’
হতভম্ব হয়ে গেলো দীবা। ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থেকে ভড়াট কন্ঠে বলল, ‘মানে?’
আবরার প্রত্যত্তরে রুক্ষ কণ্ঠস্বরে শুধালো, ‘রুমে আসতে বলেছি মানে এখুনি আসো। দেড়ি করবে না।’
আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না আবরার। বেরিয়ে গেলো অভ্রের রুম থেকে। দীবা তব্দা খেয়ে আছে একদম। বিস্মিত চোখে অভ্রের দিকে তাকালো। তার চোখের চাহনীর মানে হলো হঠাৎ হয়েছে টা কি? অভ্র না-বুঝের মতো কাধ নাড়িয়ে বললো, ‘আমি কিছু জানি না।’
চিন্তিত হলো দীবা। কপালে সূক্ষ ভাজ পরলো তার। এ কেমন মহা বিপদ। এই লোকটা আসলে অনেক অদ্ভুত। কপালে ভিড়াট চিন্তার ভাজ ফেলে আবরারের রুমের সামনে আসলো। এক হাত কোমড়ে রেখে আরেক হাতের নখ কামড়ে ভাবতে লাগলো। ভিতরে যাবে কি যাবে না তা নিয়ে দ্বিধায় আছে সে। বেশকিছু সময় দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকার পর হঠাৎ রুমের ভিতর থেকে ধমকে উঠলো আবরার।
‘তোমাকে কি বাহিরে দাঁড়িয়ে ঘোড়ার ঘাস কাটতে বলেছি আমি?’
আবরারের কথা শুনে হকচকিয়ে গেলো দীবা। সে এখানে দাঁড়িয়ে আছে সেটা কিভাবে জানে এই লোক? আশ্চর্য! কিছুটা অপমানবোধ করলো সে। মুখটা একটুখানি হয়ে গেলো তার। চুপচাপ দরজা ঠেলে ভিতরে আসলো। আবরারকে ডিভানের উপর বসে থাকতে দেখলো। মনে মনে কয়েক’শো গালি দিতে ভুললো না দীবা। বিরক্তিতে অন্য দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বললো, ‘ডেকেছেন কেন?’
আবরার প্রথমের মতোই দুই হাঁটুতে কনুইয়ের ভর দিয়ে বসে ল্যাপটপে আঙ্গুল চালাতে চালাতে উত্তরে বললো, ‘নিশ্চয় ঘোড়ার ঘাস কাটতে ডাকি নি। দরকার আছে তাই ডেকেছি। এইদিকে আসো।’
নিরবে দাঁতে দাঁত পিষলো দীবা। আবরারের দিকে ক্রোধান্বিত চোখে তাকিয়ে থেকে অনিচ্ছা থাকা শত্বেও এগিয়ে আসলো। সামনে দাঁড়িয়ে কিছুটা ঝাঁঝ মেশালো গলায় বললো, ‘এবার বলেন কি দরকার।’
আবরারের মাঝে কোনো প্রকার হেলদুল নেই। প্রথমের ন্যায় ল্যাপটপ মনোযোগ সহকারে দেখছে। প্রত্যত্তর করলো না। কিছুক্ষণ উত্তরের আশায় দাঁড়িয়ে থেকে বিরক্ত হয়ে গেলো দীবা। হচ্ছে টা কি ভাই? ডেকেছিস কেন বলে দে। নাহলে আমি যাই। এভাবে হাম্বার মতো দাঁড় করিয়ে রেখেছিস কেন? বিরক্তি আর সইতে পারলো না। অপ্রসন্ন গলায় বলে উঠলো, ‘আপনি বলবেন নাকি আমি যাবো?’
আবরার ল্যাপটপ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দীবার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। তার এমন চাহনী দেখে আড়ষ্ট হলো দীবা। কিছুক্ষণ আগে নিজের মাঝে থাকা রাগ ও বিরক্তি মুহূর্তেই ভয়ে গায়েব হয়ে গেলো। এতো দিনে যতোটুকু জানতে পেরেছে তার থেকেই বুঝে গেছে এই লোকটা ঠিক কতোটা ভয়ংকর। এর সাথে রাগ দেখানো মানে ঘুমন্ত বাঘ কে জাগিয়ে দেওয়া। মনে মনে ভয়ে শুকনো ঢুক গিলল। আবরার দীবার দিকে তাকিয়ে থেকেই ইশারা করে বললো, ‘এখানে বসো।’
বিস্মিত হলো দীবা। ভয়ে অসাড় হয়ে এলো শরির। পাশে বসতে বললো কেন লোকটা? চ:ড় থা:প্প:ড় দিবে নাকি? দীবা নিজের জায়গা থেকে এক চুলও নড়লো না। আবরার শক্ত গলায় আবারো বললো, ‘কানে শুনতে পাও না? বসো বলছি।’
ধমক শুনে চমকে উঠলো দীবা। চটজলদি আবরারের পাশে ডিভানের একদম কার্নিশ ঘেঁষে বসে পরলো। আবরার আবারো ল্যাপটপে মশগুল হলো। দীবা এবার মহা বিরক্ত। কিন্তু প্রকাশ করলো না। এখানে তাকে পুতুলের মতো বসিয়ে রেখে নিজে কাজে ব্যস্ত। বিড়বিড় করে শ’খানেক গালি দিতে লাগলো। হঠাৎ আবরার দীবার দিকে ফিরে দীবার দুই দিকে দুই হাত রেখে ঝুকে বসলো। দীবার একদম মুখ মুখি। আকর্ষিক ঘটনায় ভরকে গেলো দীবা। চোখ বড়বড় করে তাকালো আবরারের দিকে। আবরার দীবার একদম কাছে এসে চোখে চোখ রাখলো। মৃদু গলায় বললো, ‘শুনলাম তুমি নাকি খুব ভালো চা বানাও? আবার সবাইকে চা সার্ভও করে দাও?’
দীবা শুকনো ঢুক গিললো। কাঁপাকাঁপা গলায় বললো, ‘এই কথাটা দূরে বসেও বলতে পারবেন। সোফাটা যথেষ্ট বড়।’
ঠোঁট বাঁকিয়ে বাঁকা হাসলো আবরার। আরেকটু ঝুকে আসলো দীবার দিকে। আলতো গলায় শুধাল, ‘ভ্রমরকে কখনো দূর থেকে ফুলের মধু আহরণ করতে দেখেছো? দেখ নি! আমিও আমার নিষ্পাপ ফুলের কাছাকাছি এসে মিষ্টি ঘ্রাণ নিচ্ছি। এই মিষ্টি ঘ্রাণ দূর থেকে পাওয়া মুশকিল।’
দীবা প্রত্যত্তরে নিরব রইলো। আবরারের দিকে তাকিয়ে থাকার মতো সাধ্য তার নেই। তাই চোখ ফিরিয়ে নিলো তাৎক্ষনাৎ। হৃদযন্ত্রটা দ্রুত গতিতে চলছে তার। এভাবে আবরারের কাছাকাছি থাকতে বেশ অস্বস্তি লাগছে। আবরার নতজাত দীবাকে পূর্ণদৃষ্টি মেলে দেখলো। চোখের বা পাশে ছোট একটা কালো তিল। চিকন চিকন উষ্ঠধয় ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। মুগ্ধ হলো আবরার। নরম কন্ঠে বললো, ‘এখন থেকে রোজ নিয়ম করে আমার রুমে তোমার হাতের চা কিংবা কফি চাই। মনে থাকবে?’
দীবা তাৎক্ষনাৎ মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ সম্মতি দিল। ভয়ে তার শরির মৃদু কাঁপছে। ভয়, জড়তা, অস্থিরতা আর ভালোলাগা সব কিছু যেন এক সাথে কাজ করছে তার মনে। আবরার এক হাত উঠিয়ে দীবার মুখের উপর পরে থাকা ছোট ছোট চুল গুলো সরিয়ে কানের পিছে গুঁজলো। মৃদু গলায় বললো, ‘সবাই প্রতিদিন সকালে চা পেলে আমি পাই না কেন?’
প্রত্যত্তর করলো না দীবা। শুকিয়ে যাওয়া উষ্ঠধয় জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিলো। চোখের দৃষ্টি এক স্থানে স্থির নেই তার। কোনো রকমে মনে সাহস জুগিয়ে কাঁপাকাঁপা গলায় বললো, ‘একটু সরে বসে প্লিজ।’
নিঃশব্দে হাসলো আবরার। সরে যাবার বদলে এগিয়ে আরেকটু নিবিড় হলো সে। দীবা ভয়ে চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো। আবরারের তপ্ত শ্বাস আচঁড়ে পরছে দীবার মুখশ্রী তে। আবরার কিছুসময় দীবার দিকে তাকিয়ে থেকে আদেশ সুরে বলে উঠল, ‘এখন এক কাপ কফি নিয়ে আসো যাও।’
বলেই সোজা হয়ে বসলো আবরার। দীবা নিজেকে ছাড়া পেতেই চটজলদি উঠে দাঁড়ালো। এক দৌড়ে রুমের বাহিরে চলে গেলো। তার এমন কান্ডে হেসে ফেললো আবরার। অপেক্ষা করতে লাগলো কফি নিয়ে আসার। কিন্তু দীবার পরিবর্তে নুরা এসে কফি দিয়ে গেলো। আবরার কিছুটা অবাক হলেও পরে হেসে ফেললো এই ভেবে যে দীবা লজ্জা পেয়েছে।
চলমান…#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির
[পর্ব-১৪]
রাতের ঘড়ির কাটা নয়টা ত্রিশ ছুঁই ছুঁই। রিমি নুরার রুমের যাওয়ার জন্য নিজের রুম থেকে বেরিয়েছিল। রুমের বাহিরে এসে অভ্রকে আবরারের রুম থেকে বের হতে দেখে তাৎক্ষনাৎ দাঁড়িয়ে পরলো সে। লোকটাকে দেখেই রাগ উঠলো তার। এই বদ লোকের জন্য মায়ের বকা শুনতে হয়েছে। এই বদ লোকটাকে নাকি রিমি জুবাইরা স্যরি বলবে? জীবনেও না! অভ্রকে দেখেই মনে মনে শয়তানী বুদ্ধি বের করলো সে। কাল বিকেলে তো তাকে হাতি মশার সাথে তুলনা করেছে। আজ ওকে মজা দেখানো যাক। যেই ভাবা সেই কাজ। অভ্রকে না দেখার ভান ধরে হাঁটতে লাগলো রিমি। অভ্র রিমিকে খেয়াল করেছে ঠিকই কিন্তু রিমির দিকে তেমন ধ্যান দেয়নি। নিজের মতোই চলতে লাগলো। অভ্র রিমি পাশাপাশি আসতেই রিমি ইচ্ছে করে ধাক্কা দিলো অভ্রকে। হঠাৎ ধাক্কা লাগায় অভ্র হকচকিয়ে গেলো। রিমির ইচ্ছে ছিলো অভ্রকে ফেলে দেবার কিন্তু তা আর হয়নি। উল্টো নিজেই ব্যাথা পেলো বাহুতে। এক হাতে বাহু ধরে আর্তনাদ করে উঠলো, ‘ওরে আল্লাহ রে! ইটের বস্তার মতো শরির আমাকে চ্যাপ্টা বানিয়ে ফেললো রে।’
রিমির সাথে ধাক্কা খাওয়ার পর হতভম্ব হয়ে গেলো অভ্র। পরোক্ষনে রিমির চিৎকার শুনে ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকে তাকালো। রিমির নাটক বুঝতে বাকি নেই তার। হাসি পেলো ভীষণ। তাই তাচ্ছিল্য করে বলে উঠলো, ‘একেই বলে নিজের পায়ে নিজেই কু*ড়া*ল মা*রা। আমাকে ধা*ক্কা দিতে এসে নিজেই চিৎপটাং।’
রেগে গেলো রিমি। আসলেই সে অভ্রকে ব্যাথা দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু অভ্রের মতো শরিরের সাথে তার এইটুকু শরিলের তুলনা হয় না। হুদাই নিজেই ব্যাথা পেলো। তবুও নিজের দোষ স্বীকার করতে নাজার। তাই উলটো রাগ দেখিয়ে ঝাঁঝালো গলায় বলল, ‘আমি না আপনি নিজে ধা*ক্কা দিছেন।’
‘মিথ্যে বলবে না একদম। তুমি ইচ্ছে করেই ধা*ক্কা দিয়েছো।’
‘এহ আমার তো খেয়ে বসে আর কোনো কাজ নেই যে একটা বস্তার সাথে স্বেচ্ছায় ধা*ক্কা খাবো। চোখ কি আকাশে রেখে হাঁটেন?’
রিমির ঝগড়া দেখে বিরক্ত হলো অভ্র। কপালে সূক্ষ্ম ভাজ ফেলে বিরক্তি মাখা কন্ঠে বলল, ‘এই মেয়ে সমস্যা কি হ্যাঁ? নিজেই ধাক্কা দিয়ে আবার কোমড় বেধে ঝ*গ*ড়া করছো?’
রাগান্বিত কন্ঠে বলে উঠলো রিমি, ‘ঝগড়া করছি মানে? আমাকে আপনি ইনডাইরেক্টলি ঝ’গ’ড়াটে বললেন?’
হাসি পেলো অভ্রের। সে কখন রিমিকে ঝ’গ’ড়াটে বললো? এক লাইন বাড়িয়ে বলে নিজ ইচ্ছায় ঝগড়া করছে মেয়েটা। হাসি মনে দমিয়ে রেখে ত্যাঁছড়া ভাবে বলল, ‘বাহ, পাশের বাসার আন্টিদের মতো ক কে টেনে টুনে কলকাতা বানানোর স্বাভাব টা তোমার ভালোই আছে দেখছি।’
রিমির কাটা গায়ে নুনের ছিটা পরলো। রাগ শরিরে রিরি করে বেড়ে গেলো। মাত্রারিক্ত রেগে আঙুল তুলে বলে উঠলো, ‘হুয়াট ডু ইউ মিন বাই পাশের বাসার আন্টি? আমাকে আন্টি দের মতো লাগে আপনার? আপনার সাহস তো কম না আমাকে আন্টি বলেন।’
‘সাহসের কি দেখলে তুমি? এখনো তো কিছু বলি নি। করিও নি।’
রিমি চোখ ছোট ছোট করে কুৎসামূলক ভাবে বললো, ‘আর কি-ই বা করবেন? মেয়ে মানুষ দেখলে ইচ্ছে করে ধাক্কা দিতে পারবেন। বাঁজে লোক কোথাকার।’
রিমির কথাটা ও কথা বলার ধরণ দুটোই অভ্রের গায়ে লাগলো খুব। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তার। মুখশ্রী তে স্পষ্ট ক্রোধের ছাপ ভেসে উঠলো। চোখমুখ শক্ত করে বললো, ‘ঠিক করে কথা বলো রিমি।’
অভ্রের চেহারা দেখে ও রাগি গলা শুনে শুকনো ঢুক গিললো রিমি। মন ভয়ার্ত হলেও প্রকাশ করলো না। কিছুটা ফিচেল গলায় বললো, ‘ঠিকই বলেছি। আপনি ধাক্কা দিয়েছেন। স্বীকার করে নেন। এন্ড স্যরি বলেন।’
অভ্র একটা ভ্রুঁ বাঁকা করে বললো, ‘আমি কেন স্যরি বললো? কোন দুঃখে স্যরি বলতে যাবো? পাগল নাকি?’
রিমি চোখ বড় বড় করে তাকালো। কিছুটা আর্তনাদ করে চেঁচিয়ে বলে উঠলো, ‘কি? আমাকে আপনি পাগল বলেছেন? এই মিয়া সমস্যা কি আপনার? আমাকে পাগল বললেন কেন? আপনি নিজে কি? আপনি পাবনা হতে পালাতক পুরনো পাগল।’
অভ্র এবার বেজায় বিরক্ত। অপ্রসন্ন চোখেমুখে তাকালো রিমির দিকে। বিরক্ত হয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই কানে আসলো অন্য কথা।
‘স্টপ গাইস! ঝগড়া করছো কেন তোমরা?’
আরিয়ানের কথা কর্ণগোচর হতেই থেমে গেলো দুজন। অভ্র ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রিমির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। রিমি ঠোঁট কামড়ে ভাবছে কিভাবে নিজের দোষ ঢাকতে পারবে। আরিয়ান বিজ্ঞব্যক্তিদের মতো ভ্রুঁ বাঁকিয়ে দেখছে দুজনকে। মাথায় আসছে না এরা দুজন ঝগড়া করছে কেন? তার বোনই বা এতো ঝগড়াটে হলো কবে থেকে? আরিয়ান কিছু বলতে যাবে তার আগেই রিমি ন্যাকা কান্না শুরু করে বলে উঠলো,
‘ভাইই দেখো এই লোকটা আমাকে বুড়ি বলছে। আমাকে নাকি আন্টি আন্টি লাগে। আবার পাগল বলছে।’
অভ্র বিস্মিত হয়ে তাৎক্ষনাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে রিমির দিকে তাকালো। সে কখন এই কথা বললো? কপালে সূক্ষ্ম ভাজ ফেলে বলে উঠলো, ‘ওই মেয়ে, মিথ্যে বলছো কেন?’
রিমি অভ্রের দিকে আড় চোখে তাকালো। তারপর এক হাত অভ্রের দিকে তুলে আরিয়ানের কাছে অভিযোগ করলো, ‘দেখছো ভাইয়া আমাকে মিথ্যাবাদী বলছে।’
আরিয়ান রিমির উপর বিরক্ত হলো। কথা ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে কোথায় লাগাতে হয় তা রিমির থেকে কেউ ভালো পারে না। সে তার বোনের স্বাভাব সম্পর্কে অবগত। কিন্তু বাড়ির মেহমানের সাথে ঝগড়া করাটা একদম বেয়াদবি। এতো বড় মেয়েকে এই কথা কে বুঝাবে? তাছাড়া আরব ভাই যদি ঘূর্ণাক্ষরেও জানতে পারে তাহলে প্রচন্ড ক্ষেপে যাবে। সে রিমিকে কপাট শাসনের মাধ্যমে বললো, ‘রিমি? অভ্র ভাই তোর বড়। উনার সাথে ঝগড়া করার মানে কি?’
রিমির মাত্রারিক্ত ন্যাকামি আর মিথ্যে বলাতে অভ্র আরিয়ানকে বলে উঠলো, ‘তোমার বোন তো দেখছি ভালোই ঝগ’ড়া জানে। কেমন পায়ে পরে ঝ’গ’ড়া করছে এখন।’
ঝটপট চোখে অভ্রের দিকে তাকালো রিমি। রাগে গিজগিজ করতে করতে বললো, ‘ওহ আচ্ছা আচ্ছা। ঝগড়া একা আমি করেছি? আপনি দুধে ধোয়া তুলসি পাতা ছিলেন? এখানে তো চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। কিছুই বুঝেন না কচি খোকা আপনি। ফিডার খাওয়ানো উচিত! এক হাতে তালি বাজে তাই না?’
আরিয়ান রিমিকে ধমকে উঠলো, ”চুপ করবি তুই।’
রিমির কথায় চোখে হাসলো অভ্র। এই কিছুদিনে আরিয়ানের সাথে তার বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে। যতোটুকু চিনেছে তার থেকে এটা অনুমান করতে পেরেছে রিমি আর আরিয়ান সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাচের মানুষ। ভাই বোন হলেও দুজনের মাঝে কোনো মিল নেই। অভ্র এক হাতে কপাল চুলকে বললো, ‘এটা আসলেই তোমার বোন?’
রিমি ভ্যাবাচ্যাকা খেলো অভ্রের এমন প্রশ্ন শুনে। অবাক কন্ঠে বললো, ‘মানে?’
অভ্র রিমির দিকে ঘুরে পকেটে দুই হাত গুঁজে দাঁড়ালো। রিমির চোখে চোখ রেখে আরিয়ানের উদ্দেশ্যে কণ্ঠস্বরে ফাজলামি প্রকাশ করে বললো ‘আরিয়ান, আমার মনে হয় তোমাদের ডিএনএ টেস্ট করানো উচিত।’
গটগট করে পায়ের কদম ফেলে রুমে চলে গেলো অভ্র। রিমি হা হয়ে আছে অভ্রের কথায়। অতঃপর রেগে দ্বিগুণ চেঁচিয়ে উঠলো। এক হাতে অভ্রের রুমের দিকে তুলে আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো,
‘কি বললো ওই? ডিএনএ টেস্ট মানে? আমাকে নিয়ে সন্দেহ করলো? এতো বড় সাহস ওর? এরে তো আমি আজকে মে’রেই ফেলবো। এত্ত বড় সাহস কই রাখে দেখেই ছাড়বো। তুই এই রিমির হাত থেকে বাঁচবি না অভ্রের বাচ্ছা। তোকে আমি..!!’ অভ্রের রুমের দিকে তেড়ে যেতে নিলে আরিয়ান রিমির হাত ধরে আটকে ফেললো। রিমিকে টেনে রুমে নিয়ে যেতে যেতে বললো, ‘থাম বোইন, রুমে যা।’
____________________
আজকের সকালটা মুগ্ধকর। আকাশটা বেশ স্বচ্ছ। নীল আকাশের আনাচে-কানাচে সাদা মেঘ ভাসছে। মৃদু বাতাসে শীতলতা ছড়িয়ে আছে। দীবা বারান্দায় অনেকক্ষণ কাটালো। রিমি ও নুরার ডাকে বারান্দা ছেড়ে রুম থেকে বেরুলো। প্রথম দিনের মতো নাস্তার টেবিলে না যাবার জন্য শত বাহানা দেখালো না আজ। একই বাড়িতে থেকে কতোদিনই বা লুকিয়ে থাকবে সে? তকদিরে যা ছিলো তাই হয়েছে। এবারো তকদিরে যা লিখা আছে, তাই ঘটবে। তাই কোনো প্রকার ঝামেলা না করে চুপচাপ নাস্তার টেবিলে আসলো। এক পাশে চেয়ার টেনে বসে পরলো দীবা। ঠিকঠাক ভাবে বসে সামনে তাকাতেই আবরারের চোখে চোখ পরলো তার। আশ্চর্য হলো দীবা। লোকটা কি সারাদিন তারই দিকে তাকিয়ে থাকে নাকি? আজিব! চোখ ফিরিয়ে নিলো দীবা। কিছুটা বিব্রতবোধ করলো সে। কিন্তু চোখ ফিরালো না আবরার। কফির কাপে ছোট ছোট চুমুক বসাচ্ছে আর দীবাকে প্রখর করছে। দিন দিন মেয়েটা সুন্দরী হচ্ছে। দেখতে এতো কিউট লাগে! চোখ ফিরানো কষ্টকর হয়ে যায়। আবরারের এবার আফসোস হচ্ছে! ভীষণ ভাবে আফসোস হচ্ছে। কেন সে বিয়ের দিন রাতেই চলে গেলো? কেন আরো আগেই বাড়িতে আসলো না। যদি আগে আসতো তাহলে দীবাকে আরো আগে থেকেই দেখার সুযোগ পেতো।
রিমি নুরার হাতে নিজের কনুই দিয়ে ধাক্কা দিলো। নুরা তার দিকে তাকাতেই ইশারায় আবরারের দিকে তাকাতে বললো। নুরা রিমির ইশারা অনুসরণ করে আবরারের দিকে তাকাতেই ঠোঁট টিপে হাসলো। তারপর রিমির দিকে একটু ঝুকে ফিশফিশ করে বললো, ‘জমে একদম ক্ষীর বোইন।’
রিমিও ফিশফিশ করে বললো, ‘আজকে আমরা আগে চলে যাই। দীবা ভাইয়ার সাথে আসবে। তাহলে তারা একা আলাদা সময় পাবে। এতে ওদের সম্পর্ক যদি আরেকটু মিষ্টি হয়। কি বলিস?’
নুরা মাথা দুলালো। তারপর স্যান্ডউইচে বড়বড় কয়েকটা কামড় দিয়ে শেষ করে পানি খেয়ে নিলো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘আমার শেষ।’
বলেই টেবিল ছেড়ে চলে গেলো। নুরা যাবার কিছু সময় পর রিমিও উঠে গেলো। দীবা ব্যাপারটা নরমালি নিলো। ভেবেছে হয়তো খাওয়া শেষ তাই। কিন্তু তাকে ফেলে চলে যাওয়ার জন্য যে তারা দুইজন প্ল্যান করেছে তা একটুও ভাবেনি!
চলমান…