আষাঢ়ে শ্রাবণের বর্ষণ পর্ব -১৮+১৯+২০

#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব-১৮]

প্রাতঃকালে এক পলাশ বৃষ্টির পর দুপুরের মধ্যভাগে ভ্যাঁপসা গরম ছড়ালো। অসহনীয় সূর্যের তপ্ত তাপ। ভেঁজা মাটির ঘ্রাণে চারপাশ আচ্ছন্ন। শান্তিনিবাসের প্রত্যকটা সদ্যস তুমুল ব্যস্ত। চলছে অনুষ্ঠানের উদ্যোগ। শুক্রবার হওয়ায় স্কুল, কলেজ ও অফিস বন্ধ। তাই সবাই নিজ বাড়িতে অবস্থান করছে। বড়রা রান্না ঘরে বসে গুলপট্টি বাধাচ্ছে কি কি আইটেম করা যায় তা নিয়ে। রাইমা কে দেখার জন্য মেহমান আসবে বাড়িতে। তাই এতো ঘটা করে আয়োজন। এসবের মাঝে আবরারের কোনো হেলদুল নেই। সে তার মতো নির্বিকার ভাবে রুমে ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে। অন্যদিকে অভ্র আন্তরিকতার সাথে আরিয়ান ও সাবিতকে সাহায্য করছে। সে প্রসন্ন মনেই সবার সাথে হাতে হাত লাগিয়ে দায়িত্ব সহকারে কাজ করছে। বাড়ির মেয়েরা কে কি পরবে তা নিয়ে তাদের মাঝে ভাবান্তর চলছে। বহুত ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিলো তারা তিনজন সেম ডিজাইনের চুড়িদার জামা পরবে। রাইমা কে পরানোর জন্য নিশিতা লাল জামদানি শাড়ি দিয়ে গেলো। রাইমাকে সাজিয়ে দিয়ে তারা তিনজন তৈরি হয়ে নিলো। দুপুরের মধ্যভাগ প্রায় শেষ পর্যায়ে মেহমানদের আগমন ঘটলো বাড়িতে। রোশান ও হোসেন খুব আন্তরিকতার সাথে মোঃ আফজাল শরিফকে স্বাগতম জানালো। আফজালের সাথে মূলত তার পরিচয় ব্যবসার মাধ্যমে। প্রথমে শুধু পরিচিত হলেও আস্তে আস্তে সম্পর্ক নিবিড় হয়ে বন্ধুত্বের রূপ ধারন করলো। আফজালের দুই ছেলে। এখন মূলত বড় ছেলে রাজিবের জন্য রাইমা কে দেখতে এসেছে তারা। যদিও রাইমাকে তারা আগে থেকে চিনে। কিন্তু এখন আন্টি বদল করাবে। আফজাল জানায় তার ছোট ছেলে কোনো এক কারণে আসতে পারেনি। তবে পরে তাদের সাথে দেখা করবে নিশ্চিত। প্রসন্ন মনে রোশান তাদের আপ্যায়ন করলো। দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষে সবাই ড্রয়িংরুমে বসে গল্পগুজব করছে। এক পর্যায়ে আফজাল রাইমাকে দেখার ইচ্ছা পোষণ করলো। তখন দীবা, নুরা আর রিমি মিলে রাইমাকে নিয়ে আসে তাদের সামনে। রাইমা সবাইকে সালাম দিল। রাজিবের মা রাইমার সাথে খুব বন্ধুশোভল আচরনে এটা সেটা জিজ্ঞেস করতে লাগলো। রাইমা নম্রতার সাথে সকল প্রশ্নের জবাব দিলো। রাজিবের মা এক পর্যায়ে আয়েশার কাছে অনুমিত চাইলো, ‘বেয়াইন যদি কিছু মনে না করেন তাহলে রাজিব আর রাইমা কি আলাদা কথা বলতে পারবে?’

আয়েশা সম্মতি দিলেন, ‘জি অবশ্যই।’

রাইমা আর রাজিবকে রিমি আলাদা রুমে দিয়ে বাহিরে দাঁড়িয়ে রইলো। ইতিমধ্যে রাইমাকে রাজিবের মন্দ লাগে নি। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ গায়ের রঙে হালকা পাতলা ছিমছাম গরনের মেয়ে। হাসিটাও সুন্দর লেগেছে তার। চেহারায় মিষ্টি মিষ্টি একটা ভাব আছে। তবে এই মুহূর্তে এমন কি প্রশ্ন করা যায় ভেবে পাচ্ছে না রাজিব। নিজেকে খুব নার্ভাস লাগছে। কেটে গেছে অনেক সময়। রাইমা চুপচাপ বিছানার এক পাশে মাথা নিচু করে বসে আছে। বুক তার ধুরুধুরু করছে। রাজিব হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করে নিলো। তারপর বললো, ‘এই বিয়েতে কি আপনার সম্মতি আছে? নাকি পারিবারিক কোনো চাপ?’

রাইমা তার কাজল কালো আঁখি যুগল তুলে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সুদর্শন পুরুষটির দিকে তাকালো। মেদহীন শরিরে লম্বা ফর্সা গায়ের রঙ। রাইমা চোখে চোখ রেখেই শুধাল, ‘তেমন কিছুই না।’

‘আপনার যদি অন্য কোথাও সম্পর্ক থেকে থাকে তাহলে নির্ধিদায় আমাকে বলতে পারেন। আমি বিয়েতে না বলে দিবো। আপনার উপর চাপ আসবে না।’

রাইমা তাৎক্ষনাৎ অস্থির কন্ঠে বলতে লাগলো, ‘না না। বিয়েতে অবশ্যই আমার মত আছে। আমি কোনো সম্পর্কের মাঝে নেই।’

রাজিবের মন প্রসন্ন হলো। সে চোখে হেসে মুখে বললো, ‘তাহলে নিচে গিয়ে হ্যাঁ সম্মতি দিতে পারি?’

লজ্জা পেলো রাইমা। চোখ সরিয়ে হাল্কা করে মাথা দুলালো। রাজিব তার মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে ঠোঁট প্রসারিত করে মৃদু হাসলো। তারপর কিছু না বলে বাহিরে চলে আসে দুজন। সবাই মতামত জানতে চাইলে দুজনই হ্যাঁ বললো। আবরার নিচে এসে সবার সাথে কুষলবিনীময় করলো। দীবা, রিমি ও নুরা প্রচন্ড রকমের খুশী কারন রাজিবকে তাদের দুলাভাই হিসেবে পছন্দ হয়েছে। রাজিব আর রাইমার আন্টি বদল হলো। বিয়ের দিন তারিখ এই মাসের শেষের দিকে ঠিক করা হলো। অতঃপর রাইমাকে নিয়ে তিনজন রুমে চলে গেলো। আফজাল দীবার সম্পর্কে জানতে চাইলো। বললো, ‘আমার ছোট ছেলের জন্য দীবাকে পছন্দ হয়েছে রোশান। অনেক মিষ্টি মেয়ে দীবা। তোমার কি মতামত?’

আফজালের কথা শুনে চমকে উঠলো উপস্থিত সবাই। আরিয়ান মুখের সামনে হাত নিয়ে খুকখুক করে কেশে উঠলো। আবরার চুপচাপ তার বাবার প্রত্যত্তরের অপেক্ষা করছে। রোশান গম্ভীর ভাবে উত্তর দিলো, ‘দীবা এখনো ছোট আফজাল। ওর বিয়ে নিয়ে ভাবি নি আমরা।’

আফজাল বলল, ‘এখন তো আর বিয়ে হবে না। আমি আংটি বদল করেই রাখতে চাই। সময় হলে না হয় ঘটা করে বিয়ে দেওয়া হবে।’

রোশান চোখ তুলে আবরারের দিকে তাকালো। তারপর শুধালো, ‘দেখা যাক। ছেলের সাথে আগে তো পরিচয় হোক আমাদের। তারপর না হয় ভাবা যাবে।’

প্রশন্ন হলো আফজাল। কিন্তু ক্রো*ধান্বিত হলো আবরার। চোখ মুখ শক্ত করে রোশানের দিকে তাকিয়ে রইলো। দীবা তার স্ত্রী এই কথাটা বললো না কেন? রোশানের উপর প্রচন্ড রকমের রাগ হলো তার। রাগ দমিয়ে চুপচাপ স্থান প্রত্যাখ্যান করলো। নিশিতা ঝাঁঝ মেশানো চক্ষু দৃষ্টি ফেললো রোশানের উপর। বাবা ছেলের এমন মন রে*শা-রে*শিতে মোটেও প্রসন্ন নয় তার মন। কবে শেষ হবে এই ক্রো*ধ??
____________________

‘মাথার তার ছিঁ*ড়ে গেছে তোর? আব্বু এমন কথা কখনোই বলবে না।’

নুরার কথায় কন্ঠস্বরে বিরক্তি প্রকাশ করে বললো রিমি। তার পাশেই দীবা আহাম্মকের মতো বসে আছে। দুতলার সামনে বড় ছাউনি যুক্ত বারান্দা। রেলিং এর পাশে বিভিন্ন ফুলের টপ ঝুলানো। দেয়াল ঘেঁষে রয়েছে ফ্লোর বেড। পার্পল কালার চাদড়ে মুড়ানো বেডের উপর রয়েছে কয়েকটি কুশন।এখান থেকে বাহিরের দৃশ্য স্পষ্ট বুঝা যায়। তিমিরাচ্ছন্ন পরিবেশে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ফোটা পরছে। শীতল হাওয়া প্রভাহমান। ভেজা মাটির ঘ্রাণেন্দ্রিয় স্পষ্ট। নুরা হাতের মোবাইলটা ফ্লোর বেডে উপর ছুঁড়ে ফেললো। অতঃপর উঠে দাঁড়িয়ে কোমড়ে এক হাত রেখে দুজনের উদ্দেশ্যে শুধাল, ‘বিশ্বাস কর বোইনে-রা। দুলাভাইয়ের একটা ছোট ভাই আছে। তার জন্যই দীবাকে পছন্দ করেছে আঙ্কেল। কাকা বলছে ছেলের সাথে পরিচয় হলে কথা বলবে।’

রিমি আবারো কন্ঠে ঝাঁঝ মিশিয়ে বললো, ‘এটা কিভাবে পসিবল? দীবা তো ম্যারিড। আব্বু এমন বলবে কেন?’ নুরা ক্ষুন্ন মনে ভাবুক কন্ঠে বললো, ‘জানি না।

‘তাহলে আমি রাজি!’ দীবার ভাবলেশহীন প্রত্যত্তর শুনে রিমি নুরা হতবাক হয়ে গেলো। নুরা ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকে প্রশ্ন করলো, ‘কি বললি তুই?’

দীবা দেয়ালে হেলান দেওয়া অবস্থা পরিবর্তন করে সোজা হয়ে বসলো। তারপর কিছুটা রশিকতার ছলে বললো, ‘রাজিব ভাই যেহেতু সুন্দর তার ছোট ভাইও নিশ্চয় সুন্দর হবে তাই না? ছেলে সুন্দর হলে আমি রাজি। তাছাড়া রোশান আঙ্কেল মতামত দিলে তো কোনো কথাই নেই।’

রিমি কুশন তুলে দীবার দিকে ছুঁড়ে মৃদু গলায় চেঁচিয়ে উঠলো, ‘তুই অলরেডি বিবাহিত। আমার ভাইয়ের বউ। আমার ভাবি। ভুলে গেছিস নাকি?’

হাসলো দীবা। দাঁত কেলিয়ে বললো, ‘অবশ্যই মনে আছে। তোমার ভাইয়ার জীবনে যদি লামিয়া সামিয়া থাকে তাহলে আমার থাকবে না কেন? তাছাড়া আমাদের মাঝে নামে মাত্র স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক। এটা কোনো ফ্যাক্ট না।’

নুরা অসন্তোষজনক ভাবে বললো, ‘ধুরু, সব সময় ফাজলামো ভালো লাগে না।’

দীবার একরোখা বক্তব্য, ‘আমি মজা করছি না। ছেলে সুন্দর হলে আমি রাজি।’ রিমি বিরক্তি মাখা চোখে এক বার তাকিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে আকাশে দৃষ্টি রাখলো। দীবার বলা সম্পূর্ণ কথা গুলোই কর্ণপাত হলো আবরারের। সে দীবাকে খুঁজতেই এই দিকে এসেছিলো। অতঃপর তিন জনের কথোপকথন কানে পৌঁছালো। রাগান্বিত হলো দীবার শেষের কথাটায়। রোশানের উপর থাকা চাপা রাগ। তার উপর দীবার এমন মতপ্রকাশে ক্রোধ তার তীব্র হলো। শক্ত গলায় বলে উঠলো, ‘কি বললে তুমি?’

কণ্ঠস্বর অনুসন করে বারান্দার দরজার এক পাশে চোখ তুলে তাকালো তিনজন। আবরার পকেটে দুই হাত গুঁজে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে দীবার দিকে। তার এমন চাহনীতে দীবা ভয়ে শুকনো ঢুক গিললো। সে তো এইসব মজা করে বলেছে। লোকটা শুনলো কিভাবে? উফফ! ভিতরে ভিতরে ভয়ার্ত হলেও বাহিরে প্রকাশ করলো না। আবরার এগিয়ে দীবার সামনে দাঁড়িয়ে আবার প্রশ্ন করলো, ‘চুপ আছো কেন? বিয়ে করার শখ জেগেছে আবার?’

আবরারের এমন কথায় অপমান লাগলো দীবার। রাগে শরির রিনরিন করে উঠলো। বসা থেকে উঠে আবরারের মুখোমুখি দাঁড়ালো একদম। তাদের দুজনের মাঝে মাত্র চার পাঁচ হাত দূরত্ব। আবরারের এমন কথায় দীবার আগে জমানো অভিমান, ক্রোধ বেড়ে গেলো। চোয়াল শক্ত হলো তার। শুধাল,’তাতে আপনার কি?’

আবরার কিছুটা ধমকে উঠলো, ‘আমার অনেক কিছু। আমি তোমার হাসবেন্ড। তার পরেও কেন রাজি হবে তুমি?’

দীবা কিছুটা তাচ্ছিল্য কন্ঠে বললো, ‘হাসবেন্ড? তিন মাস পর মনে হলো আপনি কারোর হাসবেন্ড হোন? যাক তাও তো মনে আছে। আমি ভেবেছি ভুলে গিয়ে বুঝি লামিয়াকে নিয়ে আছেন।’

দীবার প্রত্যত্তর শুনে আবরার নিভলো। কণ্ঠস্বর নরম করে বললো, ‘আমি লামিয়া নামে কাউকে চিনি না। তখন তোমাকে রাগাতে মজা করে বলেছিলাম।’

আবরারের কথায় পাত্তা দিলো না দীবা। প্রথমের ন্যায় রুক্ষ কন্ঠে বলতে লাগলো, ‘ওই দিন সম্পূর্ণ দোষ আমার উপর দিয়েছিলেন আপনি। যেখানে আমি-আপনি দুজনই নির্দোষ ছিলাম। রাতে বাজে একটা পরিস্থিতি ক্রিয়েট করে চলে গিয়েছিলেন। এতো দিন একবারো জানতে চাননি আমার অবস্থা কেমন ছিলো। বিয়ের রাতে বর বউকে ছেড়ে চলে গেছে বলে আত্মীয়পরিজন আমাকে কতো কথা শুনালো। কেউ তো আমাকে বাপ ম*রা অপায়া মেয়ে বলেছিলো। মেন্টালি ডিপ্রেশডে চলে গিয়েছিলাম আমি। আর এতো দিন পর এসে বলছেন আপনি আমার হাসবেন্ড? এই শব্দটা উচ্চারণ করতে একটুও লজ্জা করলো না? কোন অধিকারে বলছেন এই কথাটা?’

এক নাগাড়ে এতো গুলো কথা বলে থামলো দীবা। জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগলো। হৃদপিন্ড তার দ্রুতগতিতে চলছে। রিমি নুরা নিরবে এক পাশে দাঁড়িয়ে থেকে শুনছে সব। আবরার স্থব্ধ হয়ে আছে। সত্যি সে কখনো দীবার জায়গা থেকে ভাবে নি। হঠাৎ বিয়ে হওয়ায় একটা মেয়ের মনে ঠিক কতটুকু প্রভাব ফেলে তা কেবলমাত্র সেই মেয়েটি বলতে পারবে। আবরার বাকশূন্য প্রায়। শুকিয়ে যাওয়া উষ্ঠ জোড়া জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নরম গলায় বললো, ‘তখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন ছিলো। বিয়েটা মানতে পারিনি আমি।’

আবরারকে থামিয়ে দীবা কথার পিঠে বলে উঠলো, ‘তখন মানেন নি তো এখন কোন হিসেবে মানছেন? কোন হিসেবে হাসবেন্ড বলছেন? এতো দিন পর এসবের কোনো মানেই হয় না। ভুলে গেছি আমি সব। আর এখন আমি যা খুশি তা করবো। একদম অধিকার দেখাতে আসবেন না।’

আর এক মুহূর্তও দেরি না করে তাৎক্ষনাৎ স্থান প্রত্যাখ্যান করলো দীবা। আবরার এখনো আগের ন্যায় নিশ্চুপ। রাগ হলো তার! তবে নিজের উপর। দীবা তো ভুল কিছু বলেনি। ওই দিন দীবাকেই দোষারোপ করেছিলো সে। এতো গুলো দিন খোঁজ খবর না নিয়ে হঠাৎ করে কিসের ভিত্তিতে সে অধিকার ফলাবে? ভাবলো না আর। চুপচাপ বারান্দা থেকে চলে গেলো। গাড়ি নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো আবরার। রিমি আর নুরা একে অপরের দিকে ক্ষুন্ন মনে তাকালো। নুরা উদাস মনে বললো, ‘ওরা তো ঝগড়া করলো। এবার কি হবে?’

রিমি আশ্বাস দিয়ে বলে উঠলো, ‘ওদের ব্যাপার ওরাই সামলাবে। কিন্তু আব্বু যেনো দীবার বিয়ে নিয়ে কিছু করে সেটা আমাদের দেখতে হবে।’

‘কিন্তু কিভাবে?’

উত্তর দিলো না রিমি। আপাতত চিন্তিত সে। ভাই আর দীবার সম্পর্ক নিয়ে চিন্তিত। দুজন মিলে গেলে দুশ্চিন্তা দূর হবে। কিন্তু কিভাবে ওদের সম্পর্ক ঠিক করবে??
_____________________

রুমের এসে দরজা লাগিয়ে বিছানায় বসলো দীবা। এতোক্ষণ আবরারকে তরতর করে এতো গুলো কথা শুনিয়ে দিলেও এখন তার মন বিষণ্ণবদন। ভয় লাগছে তার। মুখের উপর কথা গুলো বলা একদম উচিত হয়নি তার। বিছানার হেডসাইডে পিঠ ঠেকিয়ে বসলো দীবা। চোখের পাতা ভিজে এলো আপনা আপনি। মনে পরলো সেই দিনের কথা! কান্না পেলো প্রচুর। নাক টেনে শুকনো ঢুক গিললো সে। দুই হাটু উঁচু করে তাতে মাথা ঠেকিয়ে কেঁদে ফেললো।….

চলমান…#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব – ১৯]

রুমের এসে দরজা লাগিয়ে বিছানায় বসলো দীবা। এতোক্ষণ আবরারকে তরতর করে এতোগুলো কথা শুনিয়ে দিলেও এখন তার মন বিষণ্ণবদন। ভয় লাগছে তার। মুখের উপর কথা গুলো বলা একদম উচিত হয়নি। বিছানার হেডসাইডে পিঠ ঠেকিয়ে বসলো দীবা। চোখের পাতা ভিজে এলো আপনা আপনি। মনে পরলো সেই দিনের কথা! কান্না পেলো প্রচুর। নাক টেনে শুকনো ঢোক গিললো সে। দুই হাঁটু উঁচু করে তাতে মাথা রেখে কেঁদে ফেললো।
~
তিন মাস আগে। দিনটি ছিলো বৃহঃস্পতিবার! যেদিন আবরার ঠিক বারো বছর পর শান্তি নিবাস এসেছিলো। ঈদের আনন্দ নেমে এসেছিলো পরিবারে। এতো বছর পর বাড়ির বড়ো ছেলে বাড়ি ফিরেছে। তৃতীয় ঈদের আমেজ যেন শান্তি নিবাসের পরিবারের প্রতিটি মানুষের মনে। আবরারের সাথে এসেছিলো তারই এসিস্ট্যান্ট অভ্র হাসান। আবরার আসার পর ড্রয়িংরুমে সবাই যখন খুশিতে আত্মহারা ; তখন এক পাশে দাঁড়িয়ে নিরবে সব দেখছিলো দীবা। তখন দীবা ও তার মা রোহানা এই পরিবারে এসেছে প্রায় নয় মাস হবে। আবরার সাধারন ভাবে শুধু একবার তাকিয়ে ছিলো দীবার দিকে। এতোদিন পর পরিবারকে কাছে পেয়ে মেয়েটি কে এই প্রশ্ন মাথায় আসেনি।

পরেরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে রোশান জানায় তার খালা অসুস্থ। তিনি রোশান, হোসেন এবং তাদের ছেলেমেয়ে কে দেখতে চাইছে। বৃদ্ধ মানুষ! কখন কি ঘটে যাবে তা বলা মুশকিল। তাই রোশান নাস্তার টেবিলে সবাইকে জানালো যে দুপুরেই তারা বেড়িয়ে পরবে গ্রামের উদ্দেশ্যে। আবরারের প্রথমে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু তার ছোট নানু তাকে অনেক আদর করেছে। নানু বাড়িতে অনেকবার থেকেছে সে। কিছুটা টান রয়েছে তাদের প্রতি। তাই এক কথায় রাজি হয়ে গেলো। দুপুর হলো। সবাই তৈরি হতে হতে প্রায় বিকেল ঘনিয়ে এলো। অতঃপর এক রাতের জন্য গ্রামে যাবার জন্য বের হলো!

চকরিয়া বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার অন্তর্গত একটি উপজেলা। আগ্রাবাদ থেকে চকরিয়া উপজেলার দূরত্ব প্রায় ১০২.১ কিলোমিটার। গাড়ি করে গেলে সর্বমোট তিন ঘন্টা সাত মিনিট সময় লাগবে। চট্টগ্রাম শহরে এতোটা রাস্তা যেতে কেউ কখনো অনুরাগশূন্য হবে না।গাড়িতে বসে প্রাকৃতিক পরিবেশ দেখার মাঝেও রয়েছে অদ্ভুত রকমের প্রশান্তি। এই প্রশান্তি কেবল প্রকৃতি প্রেমীদের জন্য উপভোগ্য। অবশেষে দীর্ঘপথ অতিক্রম করে চকরিয়া উপজেলার আওতাধীন লক্ষ্যারচর ইউনিয়ন পরিষদে রোশানদের গাড়ি ঢুকে। যেহেতু পরিবার বৃহৎ ; সেহেতু একটা গাড়ি যথেষ্ট ছিলো না তাদের। মোট তিনটে গাড়ি দরকার পরেছে। এতোক্ষণ পিচ ঢালা রাস্তা পার করে গাড়ি নামলো মাটির তৈরিকৃত কাঁচা রাস্তায়। আষাঢ় মাস হওয়ায় প্রতিটা অঞ্চলেই তুমুল রুপে বর্ষণ হয়েছে। যার ধরণ মাটির রাস্তা বৃষ্টির পানিতে একদম কর্দমাক্ত! রোশানের খালার বাড়ি লক্ষ্যারচর ইউনিয়নের একদম ভিতরে। চিপা রাস্তায় গাড়ি যাওয়া দুষ্কর হয়ে পরেছে। তবুও যতোটুকু সম্ভব গাড়ি এগিয়ে নিয়েছে ড্রাইভার। অবশেষে সামনের দিকে আর অগ্রসর হতে না পেরে ব্যর্থ হলেন তিনি। রাস্তার এক পাশে গাড়ি পার্ক করলো। হতাশ হলো সবাই। না জানি এই কাদাযুক্ত মাটিতে কতক্ষণ পায়ে হাঁটতে হবে। রোশান কল দিয়ে তার খালাতো ভাইকে জানিয়ে দিলে তারা এসে এগিয়ে নিয়ে গেলো সবাইকে। ভাগ্যক্রমে মিনিট পাঁচেক পরেই কাঙ্ক্ষিত বাড়িতে এসে পৌঁছেছে তারা।

জেনারেশন বদলেছে। বদলেছে পরিবেশ। রোশান ছোটবেলায় যাদের দেখেছে তাদের মাঝে কেউ এখানে নেই। তারা যার যার ব্যস্ত জীবনের কারণে শহরমুখী হয়েছে কিংবা কেউ দেশের বাহিরে অবস্থান করছে। পরিচিত শুধু খালাতো ভাই ও তার পরিবারসহ পেয়েছে রোশান। এতো বছর পর এসে সব কিছুই বড্ড অপরিচিত লাগছে তার। এসেই প্রথমে খালার ঘরে গিয়েছে রোশান। নিজের আপন খালাকে মৃত্যুশয্যায় শয়ন অবস্থায় দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারে নি। এগিয়ে এসে খালার হাত ধরে কেঁদে ফেললো রোশান!
.
আবরার জুহায়ের কে চিনে না এমন কোনো মানুষ নেই। যেহেতু সে বাংলাদেশের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী ; সেহেতু তাকে প্রতিটা অঞ্চলের মানুষজন চিনে। তাই তার আপ্যায়ন একটু আলাদা ভাবে হলো। গ্রামের বাড়ি! এখানে শহরের মতো এতো বিলাসিতা না থাকলেও যথেষ্ট আড়াম দায়ক পরিবেশ রয়েছে। কাঠ ও বাঁশ দিয়ে তৈরিকৃত বাড়িটি দুই তলা। উপরের তলায় রয়েছে দুইটা রুম। একটাতে আবরার, অভ্র, সাবিত ও আরিয়ান। অপর রুমে দীবা, রিমি, নুরা ও রাইমা। নিচের তিনটা রুম। সেখানে থাকবে রোশান ও হোসেন! উঠানের অপর পাশে দুইটা টিনের ঘর। সেখানে রোশানের খালা ও খালাতো ভাই জাবেদ। এভাবেই থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

পরদিন সকালে রোশানের খালার শ্বাসকষ্ট উঠলো। অবস্থা খুবই বেগতিক! চারপাশে শোরগোল পাকিয়ে গেলো। গ্রামের মানুষ একে একে আসতে লাগলো মৃত্যুশয্যায় শায়িত বৃদ্ধাকে দেখতে। পুরো বাড়ি মানুষে পরিপূর্ণ! দুতলার ঘরে মেয়েরা বসে আছে। দীবা জানালার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গ্রামের দৃশ্যপট দেখছে। হঠাৎ-ই বাড়ির পিছনে নজর গেলো তার। ঝোপঝাড়ের মাঝে ছোট একটা সাদা বিড়ালের বাচ্চা! মায়া হলো দীবার। রাইমাকে বলে দ্রুত পা চালিয়ে বাড়ির পিছনের দিকে আসলো। এখানটায় মানুষদের যাতায়াত খুব কম। তাই গাছগাছালি তে জঙ্গল হয়ে আছে। এক পাশে ছোট একটা ভাঙ্গা কুঁড়েঘর দেখলো দীবা। বিড়ালটার দিকে এগিয়ে গেলে বিড়ালটা দূরে সরে গেলো। দীবা আবারো বিড়াল ধরার প্রয়াস করলো। এক পর্যায়ে বিড়ালটা ভাঙ্গা ঘরটায় ঢুকে গেলো। হাসলো দীবা। কারণ ঘর থেকে খুব সহজেই বিড়ালটা ধরতে পারবে। চুপিসারে পিটপিট পায়ে ঘরের ভিতরে ঢুকলো সে। এক পাশে বিড়ালটা দেখলো। সেদিকে এগিয়ে যেতেই পিছন থেকে কারোর উপস্থিতি টের পেলো। ঘাড় ঘুরিয়ে পিছু ফিরে তাকাতেই আবরাকে দেখে হকচকিয়ে গেলো দীবা। আবরার এখানে আগে থেকেই দাঁড়িয়ে ছিলো। বাড়িতে এতো এতো মানুষের মাঝে আবরারের অস্বস্তি লাগছিলো। তাই বাড়ির পিছনে এই ঘরটার মাঝে দাঁড়িয়ে সময় অতিবাহিত করছিলো সে। তখুনি দীবা সেখানে আসে। আবরার তাকে দেখে ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। দীবা অপ্রস্তুত হয়ে কোনো রকমে, ‘স্যরি!’ বলে ঘর থেকে বেড়িয়ে আসলো। বিড়াল জাহান্নামে যাক! এমন অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে আগে কখনো পরেনি দীবা। ঘর থেকে বেড়িয়েই দ্রুত পা চালিয়ে দুতলায় চলে গেলো। দীবা যাবার কিছুসময় পর আবরার কুঁড়েঘর থেকে বেড়িয়ে উপরে চলে আসলো।
.
দুপুরে আবরারকে বসার ঘরে জরুরি তলবে ডেকেছে রোশান। আবরার সেখানে উপস্থিত হয়ে দেখলো গ্রামের বেশ কয়েকজন বৃদ্ধ, অর্ধবয়স্ক লোক সেখানে উপস্থিত। রোশানের মুখখানি গম্ভীর। আবরার সেখানে হাজির হওয়ার কিছুক্ষণ পর রোশান গম্ভীর কন্ঠে প্রশ্ন করে বসলো, ‘দীবার সাথে তোমার কিসের সম্পর্ক?’

এমন উদ্ভট প্রশ্ন শুনে কপাল কুঁচকালো আবরার। প্রশ্নটা বুঝতে না পারে পালটা প্রশ্ন করলো, ‘দীবা কে? আর কোন সম্পর্কের কথা বলা হচ্ছে?’

আবরারের কথা শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো উপস্থিত সকলে। একজন বৃদ্ধা কর্কষ কন্ঠে বলেই উঠলো, ‘এহন কিল্লাই ফুস গইত্যে লাইগ্যু দিবা হন? এহালা গরত ফষ্টিনষ্টি গরিবার আগে মনত ন’আছিল মাইয়্যে ইবে হন?’ (এখন জিজ্ঞেস করছো দীবা কে? একা ঘরে ফষ্টিনষ্টি করার আগে মনে ছিলো না কে এই মেয়ে?)

আবরার ভ্রুঁ কিঞ্চিৎ বাঁকা করে লোকটার দিকে তাকালো। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তার। দাঁতে দাঁত লাগিয়ে কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল, ‘হুয়াট ডু ইউ মিন বাই ফষ্টিনষ্টি? ঠিক কি বলতে চাইছেন সরাসরি বলুন।’

আরেকজন লোক রুক্ষতার সাথে বলল, ‘সেলিব্রেটি অক্কল বেয়াগিনর একি অবস্থা ৷ সাম্যে গব সাজি বিতুরে বিতুরে হাছারামি গরে ৷’ (সেলেব্রিটিদের এই একই অবস্থা। মিডিয়ার সামনে ভালো সেজে গোপনে গোপনে নোংরামি করে।)

চোয়াল দ্বিগুণ শক্ত হয়ে এলো আবরারের। লোকটার দিকে আঙ্গুল তুলে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘মুখ সামলে কথা বলবেন। নয়তো আপনি আমার বড় সেটা ভুলে যাবো।’

তারপর হোসেনের দিকে তাকিয়ে রাগি গলায় বলল, ‘কি হয়েছে বলবে প্লিজ?’

হোসেন আবরারের দিকে চোখ তুলে তাকালো। চিন্তিত তার চেহারা! বিবর্ণ মুখশ্রী! হোসেন কিছু বলার আগেই গ্রাম প্রধান পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক অর্ধবয়স্ক লোকের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলো, ‘তুমি ঠিক দেখেছো তো?’

লোকটা দৃঢ়তার সাথে অশুদ্ধ ভাষায় উত্তর দিলো, ‘জি মালিক। আমি ঠিক দেখছি। এই পোলা আর ওই মাইয়া বাড়ির পিছনের ভাঙ্গা ঘর থেইক্কা বাইর হইছে। আগে মাইয়া ডা বাইর হইছে। এর পরে পোলাডা।’

লোকটার এমন কথা শুনে প্রকাণ্ড রকমের বিস্মিত হলো আবরার। ঘটনার মূল কেন্দ্রবিন্দু বুঝে আসলো তার। সকালের দিকে সে বাড়ির পিছনের কুঁড়েঘরে দাঁড়িয়ে সময় কাটাচ্ছিলো। তখুনি একটা মেয়ে সেখানে চলে আসে। আবার দেরি না করে মুহূর্তেই মেয়েটি বেড়িয়ে গিয়েছিলো। মেয়েটির পরেই আবরার বের হয়েছে। তখুনি বোধহয় এই লোক দেখেছিলো তাদের। আর এমন কুৎসিত কাহিনী রটিয়েছে! রাগে শরির মৃদু কেঁপে উঠলো আবরারের। চোখমুখ শক্ত করে কন্ঠস্বরে ক্রোধ প্রকাশ করে বললো, ‘না জেনে, না দেখে অনুমানে কোনো কথা বলবেন না। আপনাদের মাইন্ড এমন কুৎসিত জানা ছিলো না! ওই মেয়েকে আমি চিনি-ই না।…’

অতঃপর শুরু হলো তর্কাতর্কি। আবরার নিজের সবটা দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু বসার ঘরে উপস্থিত লোকজন বুঝতে চাইছে না। গ্রামপ্রধান তার সিদ্ধান্ত জানালো অবৈধ সম্পর্ক থেকে বৈধ সম্পর্কে আবদ্ধ করতে! তাদের এমন সিদ্ধান্ত শুনে রাগান্বিত হলো আবরার। ক্ষেপে উঠলো সে। পরিস্থিতি হাতের নাগালের বাইরে। তখন রোশানও জানালো এই সিদ্ধান্তে সে রাজি। বাবার উপরে থাকা পূর্বের ক্ষোভ আবারো গভীর হলো আবরারের মনে।

চলমান..#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব-২০]

হতভম্ব হয়ে দুতলার ঘরে আসলো রোহানা! চেহারায় তার স্পষ্ট রাগের ছাপ। ঘরে এসে দেখলো দীবা বিছানায় বসে হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদছে। তাকে জড়িয়ে ধরে শান্ত্বনা দিচ্ছে রাইমা। সামনেই বসে আছে রিমি ও নুরা। রোহানাকে আটকাতে পিছু পিছু আসলো নিশিতা। কিন্তু পিছু ডাক শুনলো না রোহানা। মেয়ের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে রইলো। মাকে এভাবে ঘরে আসতে দেখে দীবা বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো। কান্নাকাটি করার কারণে চোখমুখ তার অসম্ভব লাল হয়ে আছে। সেসবে তোয়াক্কা করলো না রোহানা। মেয়ের দিকে তেড়ে এসে গালে স্বজোড়ে একটা থা প্প ড় বসালো। আঘাতের পরিমান এতোটাই প্রগাঢ় ছিলো যে দীবা পিছিয়ে পরে যাওয়ার উপক্রম হলে রাইমা ধরে সামলে নিলো। রোহানা দীবাকে রাগি গলায় বলে উঠলো, ‘তোকে আমরা এই শিক্ষা দিয়েছিলাম?’

দীবা গালে হাত দিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। নিশিতা এগিয়ে এসে দীবাকে আঁকড়ে ধরে রোহানাকে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বললো, ‘কি হচ্ছে টা কি রোহানা? এতো বড় মেয়ের গায়ে কেউ হাত তুলে? আগে সত্যি টা তো জেনে নিবে নাকি।’

রোহানা মেয়ের দিকে তাকিয়ে ক্রোধান্তিত কন্ঠে বললো, ‘সত্যি করে বল। তোর উপরে আমার বিশ্বাস আছে। আমি জামি তুই আমার বিশ্বাস ভাঙ্গবি না। সত্যিটা বল।’

দীবা কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি মুছলো। কান্না ভাঙ্গা গলায় প্রত্যুত্তর করলো, ‘আমি জানালা দিয়ে বাড়ির পিছনে একটা বিড়াল দেখেছিলাম। সেটা আনতে বাহিরে গিয়েছি। বিড়াল টা ওই ঘরে ঢুকেছিল তাই আমিও তার পিছু সেখানে ঢুকি। ঘরে গিয়ে দেখি উনি ওখানে আগে থেকেই দাঁড়িয়ে আছে। বিশ্বাস করো আম্মু! আমি তখুনি ঘর থেকে বেড়িয়ে এসেছি। উনার সাথে আমার খারাপ সম্পর্ক নেই। আমাদের কখনো কথাও হয়নি। সত্যি বলছি।’

রোহানার বিশ্বাস ছিলো যে তার মেয়ে কখনো এমন নোং-রা কাজকারবার করবে না! এবং তার বিশ্বাস অনুযায়ী তাই হলো। তবুও মেয়ের নামে এমন কুৎ-সিত কথাবার্তা শুনে নিজেকে ঠিক রাখতে পারলেন না। ল-জ্জা, অপমান ও দ্বিধায় গ্রাস করলো তার মন। অসাড় হয়ে বসে পরলো বিছানায়। নিশিতা তাকে বুঝানোর জন্য বলে উঠলো, ‘আমাদের ছেলে মেয়ের উপর আমাদের বিশ্বাস আছে। ওরা এমন জ-ঘন্য কাজ কখনোই করবে না। তাছাড়া আবরার বাড়িতে এসেছেই বারো বছর পর। এর মধ্যে এমন সম্পর্কের কোনো প্রশ্নই আসে না। গ্রামের কিছু মানুষের ম্যা ন্টা লি অনেক খারা-প থাকে। সেটাই আজ প্রমান হলো। টেনশন নিও না রোহানা। তোমার মেয়েকে কেউ কখনো অসম্মান করবে না।’

রোহানা প্রত্যুত্তর করলো না। নিরবে বসে রইলো শুধু। নিচে থেকে আবরারের কন্ঠ শুনে নিশিতা ঘর থেকে বের হলো। দ্রুত পায়ে নিচে এসে হোসেনের কাছ থেকে জানতে চাইলো বাকি ঘটনা। হোসেন সব খুলে বললে নিশিতা দ্বিরুক্তি করেনি। রোশানের কথামতো আবরারকে অন্য ঘরে নিয়ে বুঝাতে লাগলো। কিন্তু আবরার মানতে নারাজ। যার সাথে আজ অব্ধি দেখা তো দূর কথাও বলেনি, তাকে কি না গ্রামের কয়েকটা মানুষের কথায় বিয়ে করতে হবে? কখনোই না! তবুও থামলো না নিশিতা। নিজের মতো আবরারকে বুঝাতে লাগলোই। বাহিরে গ্রামপ্রধান ও রোশানের মতামতের ভিত্তিতে কাজি ডেকে আনা হলো। বসার ঘরে বয়স্ক কয়েকজন উপস্থিত কেবল। দীবার পরনে লাল কুর্তি ছিলো বিধায় শাড়ি পরানোর ব্যবস্থা করা হয়নি। ওড়না টেনে ভালো করে ঘোমটা টেনে দিলো এক বৃদ্ধা! দরজার সামনে পর্দা টেনে দিয়ে দুইজনকে দুই ঘরে বসানো হলো। পর্দা টাঙ্গানো থাকায় কেউ কাউকে দেখেনি। কাজি বিয়ে পড়ানো শুরু করলো। আবরারকে কবুল বলতে বেশ কয়েকবার বলা হলো। কিন্তু আবরার চোয়াল শক্ত করে বসে রইলো। আরো কয়েকবার বলার পরেও যখন আবরার কবুল বললো না তখন গ্রামপ্রধান ক্ষেপে গেলেন। পরিস্থিতি হাতের বাহিরে যাবার আগে নিশিতা ছেলের পাশে বসে বুঝাতে লাগলেন। অতঃপর আবরার মায়ের কথা রাখতে কবুল বলে ফেললো।

আবরারের কবুল বলা শুনে ঘরের অপর পাশে থাকা দীবার কলিজা ধক করে উঠলো। চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝাড়তে লাগলো তার। এখন তাকেও কবুল বলতে বলা হলো। অনেকক্ষণ পর দীবাও বাধ্য হয়ে কবুল বললো। বিয়ে হলো দুজনের। যারা আজ অব্ধি কেউ কারোর সম্পর্কে জানে না! চিনেও না!

বিয়ের এই সম্পূর্ণ ঘটনায় কেবল অল্পসংখ্যক বয়স্ত জ্ঞানী লোক উপস্থিত ছিলো। রোশানের কাছে আবরারের ক্যারিয়ার সম্পর্কে কথা শুনে সিদ্ধান্ত নিলো একটা। সেটা হচ্ছে এই বিয়ের ব্যাপার তারা ব্যতিত অন্য কেউ যেন ভুলেও জানতে না পারে। বিশেষ করে মিডিয়ার লোকজন। উপস্থিত সকলে এই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো। নিশ্চিন্ত হলো রোশান। অতঃপর বিয়ের পর রোশান এখানে এক মুহূর্তও দেরি করে নি। খালা ও খালাতো ভাইয়ের কাছে বিদায় নিয়ে আগ্রাবাদ যাবার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরলো। পুরোটা রাস্তা দীবা কাঁদতে কাঁদতে পার করেছে। আবরারও কোনো প্রকার শব্দ করেনি। তার এই নিরবতা বলে দিয়েছে সে ভিতরে ভিতরে প্রচন্ড রাগান্বিত! শান্তিনিবাস আসার পর গাড়ি থেকে নেমেই নিজের রুমে এসে দরজা লাগিয়ে কাঁদতে লাগলো দীবা। বেশ কিছুক্ষণ কান্না করার পর ড্রয়িংরুম থেকে চেঁচামিচির শব্দ কানে আসলো তার। দেখার জন্য রুম থেকে বেড়িয়ে সিঁড়ির উপরে রেলিং ধরে দাঁড়ালো। তখন-ই কানে আসলো রোশানের রাগি কণ্ঠস্বর,

‘তুমি কিন্তু এবার একটু বেশি বাড়াবাড়ি করছো আবরার।’

রোশানের কথায় আবরার কিছুটা তুচ্ছজ্ঞান করে বলল, ‘ওহহো সিরিয়াসলি? আমি বাড়াবাড়ি করছি? আপনারা কি করলেন? থার্ডক্লাস লোকদের কথা শুনে এমন একটা কাজ করলেন। অথচ যেখানে মেয়েটাকে আমি ভালো করে দেখিনি অব্ধি। জানিও না মেয়েটা কে।’

রোশান দুই হাত পিছনে নিয়ে গম্ভীর চোখেমুখে বলল, ‘আজ নয়তো কাল দীবার সাথে তোমার বিয়ে দিতাম আমি। যেহেতু পরিস্থিতি পালটে বিয়ে হয়েই গেছে। সেহেতু মেনে নাও। তোমার জন্যই ভালো হবে।’

আবরার রাগে ড্রয়িংরুমে সোফার সামনে থাকা কাচের টি-টেবিলে স্বজোড়ে লা থি দিলো একটা। টি-টেবিল টা উলটে কাচটা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। কাচ ভাঙ্গায় কেঁপে উঠলো দীবা। সঙ্গে ড্রয়িংরুমে উপস্থিত সবাই বিস্মিত হলো। আবরার রেগে দ্বিগুণ চেঁচিয়ে বলে উঠলো, ‘কি পেয়েছেন টা আপনি আমাকে? যা ইচ্ছে হবে তাই আমার উপর চাপিয়ে দিবেন? ছোট থেকেই এমন হয়ে এসেছে। আমি আগের সেই ছোট আবরার নই বুঝতে হবে মিঃ রোশান।’

ভাইয়ের নাম নেওয়ায় ধমকে উঠলো হোসেন, ‘আবরার? বাবার সাথে এটা কেমন ব্যবহার? তখন যা ঘটার ঘটে গেছেই। এতে ভাইয়ের দোষ নেই। যা হয়েছিল তা তোদের ভুলের কারণেই।’

হোসেনের শেষ কথাটা শুনে যেন আবরারের রাগ আরো দ্বিগুণ হলো। বলল, ‘এখানে আমার কোনো দোষ নেই। ওই মেয়েটা কোথায়? নাম কি জানি তার? সব দোষ তার। মেয়েটা ইচ্ছে ওই ঘরে গিয়েছে আমি জানি। মেয়েটা জানতো আমি সেখানে আছি। কি ভেবেছে হ্যাঁ? প্ল্যান করে এমন করবে আর আমি মেনে নিবো? ইম্পসিবল। এই বিয়ে আমি মানি না। কিছুতেই না।’ বলেই পাশের ফ্লাওয়ার বেজ ছুঁড়ে ফেললো।

দীবাকে নিয়ে কথা বলায় রোশান রাগলো এবার। কন্ঠে ক্রোধ প্রকাশ করে গলার আওয়াজ উঁচু করে বললো, ‘এখানে তুমি যেমন নির্দোষ, তেমন দীবাও নির্দোষ। একার উপর দোষ চাপাবে না আবরার।’

আবরারের সাথে কথা কাটাকাটি হতে লাগলো রোশানের। আবরার রাগে আশেপাশে বেশ কিছু জিনিস ভাঙ্গচুর করলো। তাকে এভাবে রাগারাগি করতে দেখে ভয়ে রুমে চলে আসলো দীবা। সহ দোষ তার উপর দিল? সে তো কিছুই জানতো না। কান্না পেলো ভীষণ। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। অপরদিকে রাগে আবরার বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাবে বলে মনস্থির করলো। বের হবার আগে অভ্রকে তার প্রয়োজনীয় জিনিসপাতি নিয়ে যাবার জন্য বলে গেলো।

আবিরারের এই ভয়ংকর রাগ আজও দীবার মনে ভয় গভীর ভাবে পরেছে। তখন দীবাকে দোষারোপ করার কারণে একরাশ রাগ, বিতৃষ্ণা ও অশ্রদ্ধা আসে আবরারের প্রতি। মনে পরলে কান্না পায়। এতোদিন পর আজকেও সব মনে পরলো। কান্না পেল ভীষণ। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেল কখন টেরও পেলো না।
_______________

রোহানার ডাকে নিদ্রা ভেঙ্গে জাগ্রত হলো দীবা। ফোলা ফোলা চোখ মেলে পিট পিট করে তাকালো মায়ের দিকে। দীবার চোখ দুটো দেখে রোহানার বুঝতে বাকি নেই মেয়ে তার কেঁদে ঘুমিয়েছে। কারণ জানতে চাইলেন, ‘কান্না করেছিস? কি হয়েছে? মাথা ব্যাথ্যা করছে আবার?’

এতোক্ষণ কান্না করার ফলে মাথা প্রচন্ড ব্যাথ্যা করছে দীবার। কিন্তু স্বীকার করলো না। পক্ষান্তরে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার প্রয়াস করলো। বিছানা থেকে নেমে চুল গুলো হাত খোঁপা করতে করতে বলল, ‘এখানে এসেছ কেন? কোনো দরকারে?’

রোহানা বললো, ‘নিচে আয় খেতে।’

‘ঠিক আছে। তুমি যাও আমি আসছি।’ ব্যস্ত ভঙ্গিতে কথাটা বলে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো দীবা। মেয়ের এমন কান্ডে বিস্মিত হলো রোহানা। কারণ বুঝতে না পেরে নিরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেলো।

দীবা ভীতিগ্রস্ত হয়ে আছে। বিকেলে লোকটার মুখের উপর যা নয় তা বলে দিয়েছে। এখন লোকটার মুখোমুখি দাঁড়াবে কিভাবে? বহু কষ্টে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে নিচে আসলো। ডাইনিং টেবিলের কাছে গিয়ে দেখলো আবরার সেখানে অনুপস্থিত। প্রথমে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেও পরে চিন্তিত হলো। লোকটার যা ভয়ানক রাগ; এখন যদি দীবার উপর রেগে বাড়ি থেকে চলে যায়? ভয়ে জমে এলো দীবার শরির। হাজারটা চিন্তা নিয়ে খাবার শেষ হলো। ঘুমানোর সময় হলো। কিন্তু আবরারের দেখা এখনো মিললো না। ঠোঁট কামড়ে রুমে পায়চারি করতে করতে ভাবতে লাগলো দীবা। ভয়ে ঘেমে গেলো দীবা। লোকটা কি সত্যি সত্যি চলে গেলো?

চলমান…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here