আষাঢ়ে শ্রাবণের বর্ষণ পর্ব -২১+২২+২৩

#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব-২১]

রাত্রির দ্বিপ্রহর! গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন পরিবেশ। রাস্তাঘাট জনমানবহীন। সবকিছু একদম নিস্থব্ধ। সন্ধ্যার পর ভারি বর্ষণের কারণে পরিবেশ এখন শীতল। ছিমছাম গোমট বাধা অনুকূল। গাছের কড়া সবুজ পাতা গুলো ভিজে আছে। কিয়ৎক্ষণ পরপর চুইয়ে চুইয়ে পানি ঝড়ছে। বিশাল অম্বরে খানিক্ষণ পর পর বিদুৎ চমকাচ্ছে। আকাশের আড়ম্বরের ধ্বনিতে চারপাশ মুখরিত। পাখিরা তাদের আপন নীড়ে ঘামটি বেধে বসে আছে। দরজার টুকা পরার আওয়াজে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্নভাব কাটলো দীবার। পিটপিট করে তাকিয়ে দেয়াল ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে সময় দেখে নিলো। এখন অনেক রাত! এতো রাতে কে এলো? বিরক্ত হলো কিছুটা। তবুও ঘুমুঘুমু চোখে বিছানা থেকে নেমে দরজা খুললো। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটি দেখে মুহূর্তেই চোখের ঘুম গায়েব হয়ে গেলো তার। চোখে মুখে বিস্ময়কর রেখে বলে উঠলো, ‘আপনি এখানে?’

আবরার আড়ষ্ট চোখে দীবার দিকে তাকালো। চুল গুলো এলোমেলো হয়ে কপালে পরে আছে আবরারের। উষ্কখুষ্ক মলিন চেহারা তার। চুপচাপ এগিয়ে দীবার পাশ কেটে বিছানায় গিয়ে বসলো। দীবা চটজলদি দরজা লাগিয়ে দিলো নিঃশব্দে। তারপর আবরারের কাছে এসে অস্থির কন্ঠে বলতে লাগলো, ‘এখানে এসেছেন কেন? কেউ দেখে ফেলবে। বের হোন এখুনি। আপনার রুমে যান। তাড়াতাড়ি উঠুন!’

আবরার দীবার কথা গুরুত্ব দিলো না। সেই বিকেলে যে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে ছিলো এই মাত্র ফিরলো। পুরোটা সময় একা হাতে ড্রাইভ করে চট্টগ্রামের অলিগলি ঘুরেছে। রাতে বৃষ্টি নামার পর গাড়ি একপাশে থামিয়ে বৃষ্টি ভিজেছে সে। যার ধরন এখন চোখ দুটো তার অস্বাভাবিক লাল হয়ে আছে। গায়ের তাপমাত্রাও স্বাভাবিকের তুলনায় অধিক। বৃষ্টিতে ভিজার কারণে মাথা প্রচন্ড রকমের ব্যাথা করছে। তীব্র ব্যাথায় চোখ মুখ খিঁচলো আবরার। দীবা এতোক্ষণে ভালোভাবে আবরারকে দেখলো। আবরারের এই অবস্থা দেখে মায়া হলো কিছুটা। একটু এগিয়ে শান্ত গলায় বললো, ‘বৃষ্টিতে ভিজেছেন? শার্ট ভিজে আছে। চেঞ্জ করে নেন নাহলে জ্বর আসবে।’

আবরার মলিন চোখে তাকালো দীবার দিকে। নির্বিকার ভাবে দীবার রুমের ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানি দিয়ে আসলো। দীবা এখনো হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার বুঝে আসছে না আবরারের নিজের রুম থাকতে এতো রাতে এখানে এলো কেন? উনার ওয়াশরুমে পানি ছিলো না নাকি? তাছাড়া এতোক্ষণ কোথায় ছিলো উনি? ভাবলো না আর। সন্ধ্যার পর থেকে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার কারণে এখনো মাথাটা ঝিমঝিম করছে। আবরার ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে ভিজে যাওয়া শার্ট টা খোলে চেয়ারের উপর স্বযত্নে রাখলো। পাশে থাকা টাওয়াল দিয়ে হাত মুখ মুছে নিলো। টাওয়াল টা স্টাডি টেবিলের উপর ছুঁড়ে মে-রে বিছানার দিকে এগিয়ে গেলো। টাওয়াল ছুঁড়ে মা’রা’য় দীবার দাঁতে দাঁত লেগে আসলো। কটমট চোখে আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘এটা এখানে ছুঁড়ে ফেলার জিনিস ছিলো? এমনিতেই মাঝ রাতে একটা মেয়ের রুমে আসলেন আবার তারই টাওয়াল ছুঁড়ে মা’র’ছেন। সমস্যা কি আপনার?’

বিছানার হেডসাইডে হেলান দিয়ে দুই হাঁটু হাল্কা ভাজ করে বসলো আবরার। তীক্ষ্ণ চোখে দীবার দিকে তাকিয়ে শুধাল, ‘বিকেলে এমনিতেই বেশি কথা বলেছো। এখন আরেকটা উল্টা পাল্টা কথা বললে ধরে থা প্রা বো।’

আবরারের ঠান্ডা গলার ধ’ম’ক শুনে নিভলো দীবা। ভয়ে শুকনো ঢুক গিললো একটা। আসলেই বিকেলে মুখের উপর এতো গুলো কথা বলেছিলো। এখন রুমে একা পেয়ে যদি সত্যি সত্যি থা প্প ড় লাগিয়ে দেয় তো? কিংবা বারান্দা দিয়ে বাহিরে ফেলে দেয়? ম্লান চোখে তাকালো দীবা। আবরার ডান হাতের তর্জুনী আর মধ্যমা আঙুল উঠিয়ে ইশারায় দীবাকে কাছে ডাকলো। দীবার হৃদপিন্ড এবার অস্বাভাবিক ভাবে দৌড়াচ্ছে। এগিয়ে যাবে কিনা তা নিয়ে বহুত খুব দ্বিধায় আছে সে। এগিয়ে গেলে যদি থা প্প ড় দিয়ে দেয়? এইসব ভেবে জায়গা থেকে একটুও নড়লো না। দীবাকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ধ’ম’কে উঠলো আবরার। ভয়ে মৃদু কেঁপে উঠলো দীবা। ধীর পায়ে এগিয়ে বিছানার কাছে যেতেই আবরার এক হাত ধরে টান দিয়ে বিছানায় ফেলে দিলো তাকে। আকর্স্মিক ঘটনায় হকচকিয়ে গেলো দীবা। কিছু বুঝে উঠার আগেই আবরার দীবাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পরলো। দীবা হতভম্ব হয়ে গেলো। হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনার কারণে প্রতিক্রিয়াহীন হয়ে পরেছে সে। আবরার দীবার ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে চোখ বন্ধ করলো। কানের পাশে ছোট করে একটা চুমু খেলো। মৃদু কেঁপে উঠলো দীবা। আবরারের তপ্ত শ্বাস তার ঘাড়ে গলায় পরছে। বরফের ন্যায় জমে গেছে সে। নিজেকে ছাড়ানোর জন্য প্রচেষ্টা চালালো। আবরার দীবার ঘাড়ে আবারো গভীর চুমু একে মৃদু কন্ঠে বললো, ‘সিরিয়াসলি থা প্প ড় খেতে না চাইলে চুপচাপ শুয়ে থাকো।’

চুপ হলো না দীবা। আরো অস্থির হয়ে উঠলো। আবরারের বলিষ্ঠ হাত সরানোর বৃথা চেষ্টা করতে করতে চেঁচিয়ে বললো, ‘সমস্যা কি আপনার? ছাড়ুন বলছি নির্লজ্জ লোক কোথাকার। দূরে সরেন এখুনি।’

নিঃশব্দে হাসলো আবরার। দীবাকে আরো আষ্টেপৃষ্ঠে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। ঘাড়ে ঠোঁট বুলিয়ে বললো, ‘উহুম ছাড়বো না। বউ আমার মারাত্তক সুন্দরী। ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। আগে জানলে প্রথম রাত টাকেই কাজে লাগাতাম।’

দীবার চোখ চড়কগাছের ন্যায় প্রায়। নির্লজ্জের মতো এমন কথা শুনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলো। বিরক্ত হলো বেশ। বিড়বিড় করে ‘অসভ্য’ বললো। আবরার কে সরানোর বৃথা চেষ্টা পুর্ণরায় চালালো। যতোবার সরানোর চেষ্টা করেছে ততোবার আবরার আরো নিবিড় হয়েছে। এক পর্যায়ে দীবা হাঁপিয়ে উঠলো। আবরারের শক্তির কাছে হার মানলো সে। বড়বড় কয়েকটা নিশ্বাস ফেলে আশাহত হয়ে বিড়বিড় করতে লাগলো, ‘এতো শক্তি এই লোকের শরিরে। কি খায় আল্লাহ জানে। আমার অর্ধেক এনার্জি শেষ। ভাই একটু আস্তে ধর না আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।’ আরো কিছুক্ষন বিড়বিড় করে আবরার কে বকলো দীবা। অতঃপর কখন ঘুমিয়ে গেছে সে নিজেও জানে না। আবরার চোখ বন্ধ রেখেই দীবার প্রত্যেক টা কথা শুনলো। নিঃশব্দে হাসলো শুধু দীবার বাচ্ছামোতে। মাথা তুলে দীবার ঘুমন্ত মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকালো সে। এগিয়ে দীবার কপালে গভীর ভাবে চুমু দিলো একটা। তারপর আবারো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পরলো। শুধাল,

‘এই বক্ষস্থলের মাঝে সারাজীবন বন্ধি থাকবে তুমি। ছাড়বো না তোমায়। ভালোবেসে ধরে রাখবো আমি।’
______________

প্রভাতের স্নিগ্ধ কিরণ। অম্বরের পূর্ব পাশে দিবাকর তার হলুদ লালচে আভা ফুটিয়ে উঁকি দিয়েছে। সদ্য ফোটা কচি বৃক্ষপত্রের উপর কিরণতরঙ্গ পরায় মুক্তের ন্যায় উজ্জীবিত হয়ে উঠেছে। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে পক্ষীদের ব্যস্ত জীবনের সূত্রপাত। তাদের কোলাহলে মুখরিত হলো চারপাশ। সূর্যের তীব্র আলো থাইগ্লাসের পুরু কাচ বেদ করে এসে পরল দীবার মুখশ্রীতে। নিদ্রায় ব্যাহাত ঘটায় মুহূর্তেই চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো দীবা। পিটপিট করে তাকিয়ে আড়মোড় ভাঙ্গার সময় নিজেকে আবরারের বাহুডোরের মাঝে আবিষ্কার করলো সে। আবরারের বুকে মাথা রেখে তাকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে ছিলো দীবা। নিজের একদম কাছে আবরার কে দেখে মুহূর্তেই একরাশ লজ্জা এসে হানা দিলো তার মাঝে। ঘুমন্ত আবরারকে গভীর ভাবে প্রখর করলো দীবা। উজ্জ্বল ফরসা গায়ের রঙ, গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ভ্রুঁ জোড়া একটু মোটা। গালের বাম পাশে ছোট একটা তিল। সব মিলিয়ে মোহে পরে যাবার মতো। এই প্রথম কোনো পুরুষ মানুষকে সে এতো কাছ থেকে দেখছে। তাও আবার অন্য কেউ না তার আপন কেউ। তার স্বামী। আবরারের গালের বাম পাশের তিল টাতে যদি একটা কামড় বসিয়ে দেই? হঠাৎ নিজের এমন ইচ্ছায় হকচকিয়ে গেলো দীবা। নিজেকে ছাড়িয়ে উঠতে চাইলে আবরার চোখ খোলে তাকালো। দীবার কপালে চুমু দিয়ে মুচকি হেসে বলে উঠলো, ‘গুড মর্নিং বউজান।’

দীবা লজ্জায় চোখ সরিয়ে নিলো। গালে হাল্কা ব্লাশিং হলো তার। আবরারের অনেক আগেই ঘুম ভেঙ্গে গেছে। এতোক্ষণ চেয়ে চেয়ে শুধু মাত্র দীবার ঘুমন্ত মুখটি দেখছিলো। যেই দীবার ঘুম ভাঙ্গলো সে ঘুমানোর নাটক করলো। এখন দীবার লজ্জা মাখা মুখশ্রী দেখে মৃদু হাসলো আবরার। দীবার গালে আলতো ভাবে আরেকটা চুমু দিয়ে বললো, ‘লজ্জা পেলে তোমাকে অতিরিক্ত সুন্দর লাগে দীবা।’

ধাতস্থ হলো দীবা। লজ্জায় নত হয়ে চোখমুখ খিঁচে ফেললো। নিশ্বাস ভারি হয়ে আসলো তার। ভয়, জড়তা, অস্থিরতা,লজ্জা সব এক সাথে কাজ করতে লাগলো। আবরার এখনো তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। প্রথম কোনো পুরুষ মানুষ তাকে নিবিড় ভাবে স্পর্শ করলো। আড়ষ্টতার সঙ্গে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো, ‘ছাড়ুন আমাকে।’

আবরার আরেকটু নিবিড় হয়ে দীবার গালে নিজের নাক ঘেঁষে মোলায়েম কন্ঠে বললো, ‘উহুম ছাড়বো না।’

দীবা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো, ‘দেখুন দেরি হয়ে যাচ্ছে। সবাই চায়ের জন্য অপেক্ষা করবে। ছাড়ুন। এমনিতেও, লজ্জা নেই আপনার? কিভাবে চিপকে শুয়ে আছেন। ছিঃ! ছাড়ুন বলছি।’

আবরার ছাড়লো না। বরঞ্চ দীবাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। এক হাতে দুই গাল চেঁপে ধরলো। যার কারনে দীবার উষ্ঠধয় ফুলে গোল হয়ে গেছে। মৃদু হাসলো আবরার। এগিয়ে দীবার ঠোঁট দুটোতে আলতো করে চুমু খেলো। দীবা নাকমুখ কুঁচকে আবরারের থেকে নিজেকে সরানোর চেষ্টা করলো। বারবার ব্যর্থ হতে হচ্ছে সে। পরোক্ষনে উপায় না পেয়ে আবরারের হাতে বড়সড় একটা কামড় বসালো। ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠলো আবরার। বাঁধন হালকা হতেই দীবাকে আবরারের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো। বড় বড় নিশ্বাস নিলো কয়েকবার। রাগে কিড়মিড় করে বলতে লাগলো, ‘নি’র্ল’জ্জ, বে হা য়া, অ’সভ্য লোক কোথাকার। বের হন আমার রুম থেকে। উঠেন বলছি।’

আবরার কপাল কুঁচকে কামড়ের ফলে জখম হয়ে যাওয়া জায়গায় হাত বুলাতে লাগলো। বিরক্ত হয়ে কর্কষ কন্ঠে বলে উঠলো, ‘তুমি তো আস্তো নে ক ড়ে বিড়াল।’

দীবা পাশ থেকে বালিশ তুলে ছুঁড়ে মা’রলো তার দিকে। বালিশটা আবরারের মুখের উপর এসে পরলো। হাসলো আবরার। দীবা এগিয়ে আবরারের হাত টেনে বিছানা থাকে নামিয়ে দিলো। অতঃপর ঠেলতে ঠেলতে রুমের বাহিরে নিয়ে যেতে লাগলো। প্রত্যুত্তরে আবরার হেসে বললো, ‘আজকে ঘুম ভালো হয়েছে। রাতে আবার আসবো।’

দীবা আবরারকে ঠেলে রুম থেকে বের করে দিয়ে কটমট চোখে ‘অসভ্য’ বলে দরজা লাগিয়ে দিলো। শব্দ করে হেসে ফেললো আবরার। এক হাতে কপালে পরে থাকা অগুছালো চুল গুলো পিছে ঠেলে ঘুড়ে দাঁড়ালো। সামনে রোশানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার চোখমুখ শক্ত হয়ে এলো আপনা আপনি। রোশান মূলত দীবার খোঁজে এসেছিলো। প্রতিদিন সকালে দীবা নিয়ম করে চা দিয়ে যায় অথচ আজ এলো না। তাই ভেবেছে হয়তো শরির খারাপ। হাঁটতে হাঁটতে দীবার রুমের সামনে এসে আবরারকে এভাবে দেখে দাঁড়িয়ে পরলো। বাবা ছেলের মাঝে নিরবে চক্ষু যুদ্ধ চলছে। গতকালকের ঘটনায় রুক্ষ আবরার। দীবা তার স্ত্রী সেটা বললো না কেন? আবরারের পুরনো ক্রোধ যেনো আবারো জাগ্রত হলো। নিরবে দাঁতে দাঁত পিষে বাবা কে পাশ কাটিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো সে। রোশান তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে অস্পষ্ট ভাবে পরিতৃপ্তির হাসি দিলো। গতকাল সে ইচ্ছে করেই দীবার বিয়ের কথা লুকিয়েছে। আবরারকে রাগানো তার মূল উদ্দেশ্য ছিলো। ইদানীং দীবার প্রতি আবরারের আগ্রহ দেখে তার মন প্রফুল্লিত। খুশী মনে বাড়ির লনের দিকে পা বাঁড়ালো।

চলমান…#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব-২২]

সকালে নাস্তার টেবিলে আবরারকে দেখতে না পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো দীবা। কাল রাতের ঘটনার পর আজ আবরারের সামনে থাকার কোনো প্রশ্নই উঠে না। লজ্জায় শেষ হয়ে যাবে সে। তবে মনে মনে আবরারকে লু চু পদবি দিতে ভুলেনি দীবা। এক এক করে বাড়ির সদস্যরা টেবিলে বসে খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। আরিয়ান, সাবিত, অভ্র এক পাশে। রিমি, নুরা, দীবা ও রাইমা এক পাশে। টেবিলের মাঝে বিভিন্ন আইটেমের নাস্তা, ফ্রুটস, কফি। কিছুসময় পর আবরার বেশ ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে আরিয়ানের পাশে এসে বসলো। আবরারের হাসিমুখ দেখে আরিয়ান প্রশ্ন করলো, ‘ কি ব্যাপার? আজ এতো খুশি খুশি লাগছে কেন?

আবরার হাত বাঁড়িয়ে স্যান্ডউইচ আর কফির কাপ হাতে নিলো। স্যান্ডউইচে গপাগপ একটা কামড় বসিয়ে উত্তর দিলো, ‘কাল রাতে ভালো ঘুম হয়েছে।’

আরিয়ান আর সাবিত বিস্মিত চোখে তাকালো আবরারের দিকে। কালকে আবরার যেভাবে রেগে গিয়েছিলো সেখানে রাতে ভালো ঘুম হবার কোনো প্রশ্নই আসে না। আজ তার স্বাভাবিক ব্যাবহারটা কারোর হজম হচ্ছে না। সাবিত বিড়বিড় করে বলে উঠল, ‘কালকের ঘটনার পরেও ভালো ঘুম তাও আবার তোর? এটা আবার শুনতে হচ্ছে তোর মুখ থেকে?’

আরিয়ান ভ্রু কুঁচকালো। আবরারকে প্রশ্ন করলো, ‘কেন কাল রাতে কি এমন স্পেশাল ছিলো? এতো ফুরফুরে মেজাজ কেন জানতে ইচ্ছে করতেছে।’

আবরার দীবার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বললো, ‘কিছু হট টাইপ এক্সপেরিয়েন্স ছিলো।’

কথাটা শুনে বিষম খেলো দীবা। খুকখুক করে কাশতে লাগলো সে। রাইমা তড়িঘড়ি করে পানি এগিয়ে দিলো। তারপর দীবার পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। দীবা গ্লাস হাতে নিয়ে ঢকঢক করে পুরো গ্লাসের পানি এক চুমুকে শেষ করে ফেললো। ধপ করে টেবিলে গ্লাসটা রেখে কটমট চোখে আবরারের দিকে তাকালো সে। প্রত্যুত্তরে আবরার মুচকি হাসি দিলো একটা। আরিয়ান এখনো কিছু বুঝতে পারে নি। তাই আবরারকে পাল্টা প্রশ্ন করে বসলো, ‘হট এক্সপেরিয়েন্স মানে? এটা আবার কেমন? আগে তো শুনি নি।’

আবরার কফির কাপ হাতে বললো, ‘মানে কফিটা অনেক গরম। তুই বুঝবি না। খেতে থাক।’

দীবা মনে মনে আবরারকে শ’খানেক গা লি দিচ্ছে। ইচ্ছে করছে আবরারকে পঁচা পানিতে চু/বা/তে। লুচুগিরির জন্য আবরারকে অস্কার দেওয়ার জন্য নমনিকেশন দেওয়া উচিত। সাবিত আবরারের ইঙ্গিত, দীবার বিষম খাওয়া দেখে তার বুঝতে বাকি নেই। মনে মনে হাসলো সে। আরিয়ান একদম তাজ্জব বনে গেলো। কিছু বলতে যাবে তার আগে অভ্র চোখের ইশারা করে কিছু বললো তাকে। আরিয়ান চোখ ছোট ছোট করে বুঝার চেষ্টা করলো। বুঝার পর আপেলের পিসে কামড় বসিয়ে বললো, ‘বাহ আজ সিঙ্গেল বলে এইসব বুঝি না।’

একসাথে হেসে ফেললো চারজন ছেলে। ওদের কথোপকথনের কিছুই বুঝতে না পেরে রিমি, নুরা ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। রাইমা বুঝতে পেরে মিটমিট করে হাসলো। অন্যদিকে দীবা রাগে কিড়মিড় করে আবরারের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাতে লাগলো বারংবার!
__________________

কলেজে যাবার জন্য ব্যাগ কাধে নিয়ে বের হলো তিনজন। দীবা বুকে হাত গুঁজে বিরক্তিকর মুখে হাঁটছে। পিছনে নুরা আর রিমি ঠোঁটে ঠোট চেপে হাসছে। দীবা বাড়ির বাহিরে এসে দেখলো আবরার গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মোবাইল টিপছে। তাকে এখানে দেখে ভ্রুঁ কুঁচকালো দীবা। কপালে পরলো সূক্ষ্ম চিন্তার ভাজ। আজও কি কলেজে নিয়ে যাবে? নুরা ও রিমি তার কাছাকাছি আসতেই প্রশ্ন করে বসলো দীবা, ‘এই লোক এখানে কি করছে?’

নুরা ব্যাগের ফিতা ধরে টেনে টেনে বললো, ‘তোকে কলেজে দিয়ে আসবে।’

দীবা কিছুটা ক্ষুব্ধ মনে অপ্রসন্ন কন্ঠে বলে উঠলো, ‘এই লোকের কি আর কোনো কাজ নেই? রহমত আঙ্কেল তো আছে কলেজে দিয়ে আসার জন্য। এই লোকের কি দরকার ওখানে যাবার। আশ্চর্য!’

দীবা কথাটা বলে থামতে দেরি ; রিমি তার মাথায় গা ট্টা মা’রতে দেরি হয়নি। হঠাৎ এমন হওয়ায় হকচকিয়ে গেলো দীবা। মুখখানি কালো করে মাথায় হাত দিয়ে বুলাতে লাগলো। বলল, ‘মা র লি কেন?’

রিমি বলল, ‘স্বামী মহাশয় কে সম্মান করতে শিখ। এই লোক কি রে? বলবি ‘আমার উনি, আমার সোয়ামী। তা না বলে বলছিস এই লোক।’

দীবা রিমিকে ব্যঙ্গ্য করে অনুকরণ করার চেষ্টা করে বলল, ‘ওগো শুনছো? তুমি এখানে দাঁড়িয়ে কি করছো গো?’

হেসে উঠলো নুরা। দীবার বাহুতে আলতো ভাবে একটা চাপড় দিলো। তখুনি কানে আসলো আবরারের উত্তর,

‘হ্যাঁ গো, তোমার অপেক্ষায় আছি। তাড়াতাড়ি আসো বউ।’

আবরারের এমন কথা শুনে চোখ বড় বড় করে তাকালো দীবা। তার কথাটা আবরার শুনতে পাবে তা কল্পনাতীত ছিলো। লোকটার কান এতো পাতলা??? রিমি ও নুরা উল্লাসিত নয়নে দৌড়ে আবরারের কাছে এসে গাড়িতে উঠে বসলো। আবরার দীবাকে ইশারায় ডাকতেই এগিয়ে আসলো সে। দীবার মুখখানা বিবর্ণ! আবরার গাড়ির সামনের সিটের দরজাটা খুলে দিলো । দীবা গাড়িতে উঠার সময় আবরার তার কানের কাছে ফিশফিশ করে বলল, ‘কলেজ ড্রেসে তোমাকে মারাত্মক লাগে দীবা। ইচ্ছে করে একদম খেয়ে ফেলি।’

আবরারের এমন কথা শুনে দীবার চোখ কোটর বেড়িয়ে আসার উপক্রম। বিস্ময়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে সে। রাগে কিড়মিড় করে কটমট গলায় ‘নির্লজ্জ লোক!’ বলে গাড়িতে উঠে বসলো। আবরার নিঃশব্দে হেসে ফেললো। অতঃপর সে নিজেও গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিলো।
__________________

নভোমণ্ডলের মধ্যভাগে সূর্য তার তীব্রতর আলোকরশ্মি ছড়ালো। স্বচ্ছ অন্তরিক্ষ, কিয়ৎক্ষণ পর পর অদূরে উড়ন্ত বাজপাখির নিনাদ ভেসে আসছে। কড়া রোদ থাকলেও চারপাশের বৃক্ষ নাড়িয়ে ছুটছে শীতল বাতাস। গমগমে পরিবেশ। কোলাহলপূর্ণ আগ্রাবাদ কলেজ। শিক্ষার্থীরা আবরারকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। প্রত্যেকের মাঝে টান টান উত্তেজনা। কেউ কেউ কণ্ঠশিল্পী আবরার জুহায়েরের সঙ্গে ছবি তুলতে ক্যামেরার শাটার বাটনে ক্লিক করছে। কেউ আবার কাগজে কলমে এগিয়ে দিচ্ছে অটোগ্রাফ নিতে। এতোজনের মাঝে আবরার একা ভালোই বিপাকে ফেঁসে গেলো। পাশে না আছে অভ্র, না আছে কোনো গার্ড। এদের একা সামাল দিতে বেশ হিমশিম খাচ্ছে সে। অসহায় মুখে কলেজ গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রিমি, দীবা আর নুরার দিকে তাকালো। আবরারের এমন করুণ অবস্থা দেখে দীবার হাসিতে প্রায় লুটোপুটি খাওয়ার অবস্থা। আবরারের এবার আফসোস হচ্ছে কেন সে তাদের কলেজে দিতে আসলো? এসেছেই যখন গার্ড নিয়ে আসার দরকার ছিলো। দীবাদের কলেজে নামিয়ে নিজেও গাড়ি থেকে নেমেছিল। ভুলবশত মাক্স, ক্যাপ পড়তে ভুলে গেছে। যার ফলস্বরুপ তাকে চিনতে পেরে আশেপাশে থাকা সকল শিক্ষার্থী, মানুষজন ঘিরে ধরেছে। কোনো রকমে কয়েকজনকে অটোগ্রাফ আর কিছু সেলফি তুলে গাড়িতে উঠে বসলো আবরার। গাড়ি স্টার্ট দেওয়া শত্বেও এগোতে পারছে না। ধীরে ধীরে গাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে গেলো এই এরিয়া থেকে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো যেনো। আবরার যেতেই দীবারা কলেজে ঢুকে ক্লাসে আসলো। নুরা হাই-ব্যাঞ্চে ব্যাগ রেখে বলে উঠলো, ‘ভাইরে ভাই, আরব ভাইয়ের অবস্থা দেখে আমি তো শে ষ। সেলেব্রিটি রা তো দেখছি বাহিরেই বের হতে পারেনা। থাকে কিভাবে ওরা??’

দীবা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে লো ব্যাঞ্চে বসে বললো, ‘বেশ হয়েছে। কে বলেছিলো আমাদের কলেজে নিয়ে আসতে? এবার উচিত শিক্ষা হয়েছে। নেক্সট টাইম আর আসবে না।’

রিমি হাই ব্যাঞ্চের উপর বসে ছিলো। সে দীবার মাথায় গা ট্টা মে’রে বললো, ‘চুপ কর। কলেজে নিয়ে আসে তো তোর জন্যই। নি*র্দয়, পা/ষা/ণ মাইয়া। তোরে দিতে এসে ভাই বিপদে পরলো। আর তুই খুশীতে লাফাচ্ছিস?’

দীবা প্রত্যুত্তরে বললো, ‘আমি বলেছি নাকি নিয়ে আসতে? তোর ভাই থাকলে আমার কেমন আনইজি লাগে।’

নুরা ভ্রুঁ নাঁচিয়ে বললো, ‘বাব্বাহ্ কাল রাতে যখন একসাথে ছিলা তখন আনইজি লাগে নাই?’

রিমি উচ্চস্বরে হেসে ফেললো। দীবা চোখ বড়বড় করে তাকালো নুরার দিকে। চোখ তার কোটড় বেরিয়ে আসা উপক্রম। কিছুটা বিস্মিত হয়ে নুরাকে বলে উঠলো, ‘তুই জানলি কিভাবে?’

নুরা ভাব নিয়ে ঝুটি করা চুল নাঁচিয়ে বললো, ‘দেয়ালের কান থাকলে বাতাসেরও মুখ আছে। আমাদের থেকে লুকানো পসিবল না বেব।’

দীবা আহাম্মকের মতো তাকিয়ে আছে শুধু। রিমি বললো, ‘তোকে ডাকার জন্য সকালে এসেছিলাম না? তখন তোর রুমে ভাইয়ার শার্ট দেখেছি। আর ব্রেকফাস্টের সময় আরব ভাইয়ার হট এক্সপেরিমেন্ট। বুঝি বুঝি! সবই বুঝি।’

দীবা তার কন্ঠস্বর ত্যাঁছড়া করে বলে উঠলো, ‘বা/ল বুঝো তুমি।’

নুরা দীবার দিকে এগিয়ে অধিক আগ্রহ নিয়ে বলে, ‘দোস্ত কাল রাতের সম্পর্কে আমাদেরও কিছু বল।’

বিরক্ত হলো দীবা। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে শুধাল, ‘তোর ভাই আস্তো একটা লু/ই/চ্চা নাম্বার ওয়ান।’

নুরা দাঁত কেলিয়ে বললো, ‘লু চু না হলে তো খালাম্মা ডাক শুনতে পারবো না।’

চোখ বড়বড় করে তাকালো দীবা। মুখ তার আপনাআপনি কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে গেছে। আহাম্মকের মতো তাকিয়ে কটমট করে বললো, ‘তুই আসলেই একটা শ’য়’তান।’

উচ্চ শব্দে হাসলো নুরা। রিমি হাই-ব্যাঞ্চ থেকে নেমে দীবাকে জড়িয়ে ধরলো। ন্যাকা ন্যাকা সুরে বললো, ‘ইয়ার তোদের সম্পর্ক ঠিক হয়ে গেছে ভেবে অনেক খুশী লাগছে।’

প্রত্যুত্তরে দীবা মলিন হাসলো শুধু। সম্পর্ক নিয়ে দ্বিধায় আছে সে। মনে জমে রয়েছে আবরারের প্রতি অভিমান। আবরার কেন সেই দিন তার উপর সব দোষ চাপিয়ে দিলো? কেন এতোদিন এভাবে অবহেলায় ফেলে রেখেছিল? তাহলে এখনই বা কেন অধিকার ফলাতে আসলো? ভাবলো না আর। নিরবে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
______________

আষাঢ়মাসের মানেই এখুনি অম্বর কালো করে তীব্র কাদম্বিনীর ধ্বনিতে ঝাঁপিয়ে ভারি বর্ষণ। আবার বর্ষণ শেষে ঘোলাটে অম্বর পরিষ্কার করে সূর্য উঁকি দেওয়ার দৃশ্য। বাড়ির পাশে বিশাল বড় কৃষ্ণচূড়া গাছের রক্তিম ফুল গুলো মাটিকে বানিয়েছে শয়নস্থান। বর্ষণের ভারি ফোটার সাথে না পেরেই তাদের অকাল ঝরে পরা। চিকন চিকন পাতা গুলো বৃষ্টির পানিতে ভিজে টুইটুম্বুর। সবুজ ঘন দুর্বা ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে পানি ঢুকে পরিপূর্ণ। সকালে রোদ থাকলেও কিছুসময় আগে বৃষ্টি হয়েছে। বাড়ির সামনে বাগানে বেতের সোফায় বসে আছে অভ্র ও আরিয়ান। দুজনের মাঝে বেশ ভালো সখ্যতা হয়েছে বটে। প্রায় সময় এক সাথে কাটায় দুজন। কাজুবাদাম চিবুচ্ছে আর মোবাইলে গেমস খেলছে দুজন। এমন সময় আবরার ব্যস্ততার সাথে এসে পাশের সোফায় বসতে বসতে বললো, ‘হেই গাইস কি অবস্থা?’

আরিয়ান মোবাইলের দিকে দৃষ্টি রেখে উত্তর দিলো, ‘অস্থির যাচ্ছে ভাইই।’

হাসলো আবরার। সোফায় হেলান দিয়ে বললো, ‘আজ বড়জোর বেঁচে গেছি অভ্র।’

অভ্র কারণ জিজ্ঞেস করতেই আবরার সব খোলে বললো তাদের। তার এই অবস্থা দেখে আরিয়ান ও অভ্র দুজনই হেসে ফেললো। আবরার কপালে ভাঁজ ফেলে বলে, ‘হাসছিস কেন? হাসার কি হলো এখানে?’

আরিয়ান উত্তর দিলো, ‘তোমাদের মতো সেলেব্রিটিদের এই একটা প্যা রা। কোথাও ইচ্ছে মতো যেতে পারো না। আমাদের দেখো? যেখানে খুশি সেখানে যেতে পারি। ইচ্ছে হলে চায়ের দোকানে বসে আপন মনে চা খেয়ে বন্ধুদের সাথে জমিয়ে আড্ডা দিতে পারি। একদম সাধারন মানুষ। আমাদের কোনো প্যা রা নাই। নিজ ইচ্ছায় চলতে পারি।’

প্রত্যুত্তরে আবরার নিরবে হাসলো। মলিন কন্ঠে বললো, ‘আসলেই অনেক দিন হয়েছে টঙে বসে চা খাওয়া হয় না।’

আরিয়ান ভাইকে খুশি করতে বললো, ‘তোমাকে তাহলে একদিন নিয়ে যাবো। জায়গাটা নিরব সেখানে এই ফ্যান ফলোয়ারদের চিন্তা থাকবে না।’

আবরার সম্মতি দিলো। অভ্র আবরার কে প্রশ্ন করলো, ‘স্যার এখানে আপনার কোনো ফ্রেন্ড নেই? এসেছেন তো অনেক দিন হলো এখনো কাউকে দেখলাম না।’

আবরার বাটি থেকে এক মুঠো কাজুবাদাম হাতে নিয়ে সোফায় হেলান দিয়ে শুধাল, ‘আসলে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গিয়েছিলাম ছোট থাকতে। তখন তেমন কোনো আপন বন্ধু ছিলো না। ঢাকা তে আসার পর ওখানেই সকল বন্ধুদের সাথে পরিচয়। তাদের তো তুমি চিনোই। এখানে কোনো বন্ধু নেই।’

অতঃপর নিজেদের আলাপে মশগুল হলো তিনজন।

চলমান…

টাইপোগ্রাফি ক্রেডিট : ইসতিয়াক ভাই ❤️#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব-২৩]

বৃষ্টি না হলেও পরিবেশ টা আজ শীতল। আকাশ স্বচ্ছ, পরিষ্কার। সূর্য তার কোমল আলোতে পরিবেশ মুখরিত করেছে। এমন পরিবেশে ক্লাস করার মজায় আলাদা। খুবই গম্ভীরতার মাধ্যমে ফিজিক্স ক্লাস শেষ করলো মুনতাসির রাজ। তার ক্লাসে অতিরিক্ত কথা বলা থেকে বিরত থাকে সবাই। স্বেচ্ছায় তো কেউ ধ*ম*কানি খেতে চায় না। ক্লাস শেষে বেরিয়ে যাবার আগে দীবাকে উদ্দেশ্যে করে বললো রাজ, ‘ক্লাস শেষে আমার সাথে দেখা করবে। কথা আছে।’

রাজ বেড়িয়ে যাবার পর দীবা খুব সাবলীল ভাবে তার পিছু পিছু গেলো। রাজের কেবিনের কাছে এসে দরজায় নক করলো দীবা। ভিতর থেকে পারমিশন আসলে সে নিরবে রুমে ঢুকে পরলো। রাজ তখন টেবিলে নিজের ফাইল গুলো গুছিয়ে রাখছিল। সে ইশারায় দীবাকে বসতে বললো। দীবা এগিয়ে চেয়ার টেনে বসলো। ফাইল গুছানো শেষে রাজ দীবার দিকে ফিরে পকেটে দুই হাত গুঁজে সটান দাঁড়িয়ে থেকে বললো, ‘আমি তোমার মার্কশিট দেখেছি। ক্লাসের টপার তুমি। এমন স্টুডেন্ট আমি খুবই কম দেখেছি। তোমার ছোট একটা হেল্প লাগবে আমার।”

দীবা খুব বিনয়ীর সাথে জানতে চাইলো, ‘কি হেল্প স্যার?’

‘তোমাদের এক্সাম বেশী দিন নেই। এক্সামের জন্য নোট বানাতে হবে। এখন থেকে আমি ক্লাসে যে টপিক গুলো পড়াবো তুমি তা নোট করে নিবে। আর সেগুলো আমি পরবর্তী ক্লাসে পড়াবো।’

দীবা খুব মিনমিনে গলায় শুধাল, ‘কিন্তু স্যার যদি ভুল হয়?’

‘চিন্তা করো না। ক্লাস করানোর সময়ই নোট করে নিবে তাহলে সহজ হবে। নোট গুলো তুমি ক্লাস শেষে কিংবা ছুটির পর আমাকে দেখাবে। ভুল থাকলে আমি সংশোধন করে দিবো। আর সুন্দর করে লিখে নির্ভুল ভাবে নোট গুলো করতে হবে। আমি ক্লাসে এই নোট গুলো দিয়ে বাকি স্টুডেন্টদের পড়াবো।’

দীবা নিরব থাকলো কিছুক্ষণ। চুপচাপ ভাবতে লাগলো সে। ভালোই হবে এই সুযোগে সেও স্যারের কাছ থেকে সহযোগীতা পাবে। খুশি হলো দীবা। ঠোঁট প্রসারিত করে মুচকি হেসে বলল, ‘ঠিক আছে স্যার। হয়ে যাবে।’

রাজ দীবার হাসিখুশি মুখের দিকে তাকালো। এতো মায়াবী কেন এই মুখখানি? দীবা হাসলে গোলগাল চেহারা ফুটে উঠে। রাজ আবারো দীবার উপর মুগ্ধ হলো। মনে মনে ভাবলো দীবার পরিক্ষা শেষে তাকে নিজের করে নিবে। আপাতত অপেক্ষা মাত্র। যদিও সে জানে না দীবা বিবাহিত। কারণ আবরার আর দীবার বিয়ের কথা এখনো গোপন রয়েছে। রাজ মুগ্ধতা ভিতরে রেখে উপরে গম্ভীর ভাবে বললো, ‘এবার তুমি যেতে পারো। এই ব্যাপারে পরে কথা হবে তোমার সাথে।’

অনুমতি পাবার পরপরই দীবা বিলম্ব না করে বেড়িয়ে গেলো। বারান্দা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাহিরে তাকালো। বৃষ্টিতে ভিজে আছে ক্যাম্পাস। মাঠে থাকা সবুজ দুর্বা ঘাস গুলো চকচক করছে। বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়ালো দীবা। আনমনে মৃদু হেসে বাহিরে তাকিয়ে রইলো এক মনে। ভাবলো সে আবরার কে নিয়ে। লোকটা ভারি অদ্ভুত। কাল রাতের কথা মনে পরলো তার। মুহূর্তেই লাল আভা ছড়িয়ে এলো তার গালে। কান লাল হলো তার। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে মুচকি হাসলো।

‘কিরে? একা একা দাঁড়িয়ে লজ্জা পাচ্ছিস কেন?’

হকচকিয়ে গেলো দীবা। পিছু ঘুরে দেখলো রিমি নুরার কাধে এক হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। নুরা বুকে হাত গুঁজে ভ্রুঁ নাচিয়ে বললো, ‘লজ্জা পাচ্ছিলে কেন বাবু?’

চোখ পাকিয়ে তাকালো দীবা। এই মেয়ে দুটোর তো লজ্জা শরম নেই ; আবার অন্য কাউকে লজ্জা পেতেও দিবে না। চোখ সরিয়ে আবারো সামনের মাঠের দিকে দৃষ্টি রাখলো দীবা। রিমি এসে দীবার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ভ্রুঁ নাচালো। বললো, ‘বেব তোমার গাল দুটো ব্লাশিং করছে। তুমি কি জানো? ভাই তোমাকে দেখলে এখন কন্ট্রোললেস হয়ে যাবে।’

‘ছিঃ তোরা এতো খারাপ। সর এখান থেকে।’ নাক মুখ কুঁচকে বললো দীবা। তাদের সামনে আর থাকলো না। দ্রুততার সঙ্গে স্থান প্রত্যাখ্যান করলো দীবা। সে যেতেই রিমি ও নুরা উচ্চস্বরে হাসিতে মেতে উঠলো।
_________________

বাহিরে শীতল মৃদু বাতাস প্রভাহমান। ঝিরঝির হাল্কা বৃষ্টিতে ভিজে আছে আগ্রাবাদ শহর। প্রভঞ্জনের শীতলতা গায়ের পশম কাটা দিয়ে উঠার উপক্রম। তারপরেও ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল খানা শেষ করলো আবরার। থ্রি-কোয়াটার প্যান্টের সাথে পাতলা কালো টি-শার্ট পরনে তার। টাওয়াল দিয়ে চুল গুলো মুছতে মুছতে মোবাইল হাতে নিলো। কিছুসময় মোবাইলে মেইল চেক করে অভ্রের রুমের উদ্দেশ্যে বের হলো। অভ্রের রুম যেহেতু শেষের রুমটা তাই সামনে থাকা সকল রুম পেরিয়ে যেতে হয়। দীবার রুমের সামনে আসার পর খেয়াল করে রুমের দরজা হালকা ভিড়ানো। কৌতুহল বশত উঁকি দিয়ে দেখলো দীবা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভিজা চুল টাওয়াল দিয়ে মুচ্ছে। আবরারের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি আসলো। কোনো প্রকার শব্দ না করে নিরবে রুমে ঢুকে পরলো। দীবা বিন্দুমাত্র টের পেলো না। দুই হাত উঠিয়ে চুল মুছচ্ছে আর আপন মনে গুনগুন করে গান গাইছে!

আমার প্রান ধরিয়া মারো টান,
মনটা করে আনচান।
আমার প্রাণ ধরিয়া মারো টান,
মনটা করে আনচান।
জোয়ার নদীর উতল বুকে,
প্রেমের নৌকা উজান বায়।
বারে বারে বন্ধু তোমায়,
দেখিতে মন চায়।
বারে বারে বন্ধু তোমায়,
দেখিতে মন চায়।

দীবার গুনগুন করে গাওয়া সম্পূর্ণ গানটা আবরার স্পষ্ট শুনতে পেরেছে। পকেটে দুই হাত গুঁজে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ালো সে। হঠাৎ-ই দীবাকে থামিয়ে আবরার গানের শেষাংশ বলে উঠলো,

‘বারে বারে বন্ধু তোমায়,
দেখিতে মন চায়।’

দীবা চমকে উঠলো। ভড়কে হাত থেকে টাওয়াল পরে গেলো তাৎক্ষনাৎ। বুকে এক হাত রেখে জোরে জোরে দু’বার নিশ্বাস নিলো। বললো, ‘আপনি এখানে? ম্যানারস জানেন না? রুমে আসার আগে পারমিশন নিতে হয় ভুলে গেছেন?’

ম্যানারসের কথা বলায় কপাল কুঁচকালো আবরার। ফিচেল গলায় গা-ছাড়া ভাব নিয়ে বলে উঠলো, ‘আমার বউ যখন খুশী তার কাছে আসবো। পারমিশন নিতে যাবো কেন?’

দীবা বিরক্তি মিশ্রিত চোখে তাকালো আবরারের দিকে। ঝুকে গিয়ে ফ্লোরে পরে থাকা টাওয়াল তুলে নিলো। তারপর শক্ত গলায় বললো, ‘বের হোন এখুনি। নেক্সট টাইম আমার রুমে পারমিশন ছাড়া আসবেন না।’

আবরার বাঁকা হেসে দীবার দিকে এগোতে এগোতে বলল, ‘আসলে কি করবে?’

তাকে এগোতে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেলো দীবা। শুকনো ঢোক গিলে বললো, ‘আবার চলে যেতে বলবো।’

আবরার একদম তার সামনে চলে আসলো। দীবা কিছুটা পিছুতে গেলে ডেসিংটেবিলের সাথে ধাক্কা খেলো। নিঃশব্দে হাসলো আবরার। জিভ দিয়ে উষ্ঠধয় ভিজিয়ে দুই হাতে দীবার কোমড় ধরলো। কেঁপে উঠলো দীবা। তার কাঁপনিতে আবরার মৃদু হাসলো। কোমড় ধরে উঠিয়ে ডেসিংটেবিলের উপর বসালো দীবাকে। টেবিলে থাকা প্রসাধনী গুলো দীবার শরিরে ধাক্কায় এলোমেলো হয়ে পরে গেছে। আবরার একটু এগিয়ে দীবার সাথে নিবিড় হলো। দীবার কপালে পরে থাকা ভিজে চুল গুলো কানের পিছনে গুঁজে বললো, ‘তোমার প্রেমে ভয়ানক ভাবে ফেঁসে গেছি দীবা। এর থেকে পরিত্রাণ পাবার উপায় নেই।’

আবরারের চোখে চোখ রাখলো দীবা। হৃদপিন্ড কাঁপছে তার। অস্বাভাবিক ভাবে দৌড়াচ্ছে। আবরারের প্রতিটি স্পর্শে ইষৎ কেঁপে উঠছে সে। আবরার দীবার ঘাড়ের চুল গুলো সরিয়ে উন্মুক্ত করলো গলা। নিজের মুখ এগিয়ে দীবার গলার উঁচু হারটার মাঝে আলতো করে চুমু খেলো। তারপর দীবার কানের কাছে নিজের মুখটা এনে আলতো গলায় আবারো গায়লো,

‘বারে বারে বন্ধু তোমায়,
দেখিতে মন চায়।’

আবরারের ফিশফিশ কন্ঠের গান টা শুনে মৃদু কম্পিত হয়ে উঠলো দীবার শরির। আবরারের শার্টটা খামচে ধরলো। ইষৎ শরির কাঁপছে তার। আবরার এক হাতে দীবার কোমড় জড়িয়ে অন্য হাতে দীবার গাল পরম যত্নে ধরলো। চোখ বন্ধ করে উষ্ঠধয়ের দিকে এগোতে থাকলো। তখনি দরজা ঠেলে রুমে ঢুকলো নুরা। নুরার আগমনে ছিটকে সরে গেলো আবরার। দীবা ভিষণ রকমের লজ্জা পেলো। নুরা ভ্যাবাচ্যাকা খেলো। রুমে এসে আহাম্মক হয়ে গেলো সে। অপ্রস্তুত গলায় বলে উঠলো, ‘স্যরি! আমি কিছু দেখি নি। টেনশন নিও না। কন্টিনিউ! ‘

বলেই তড়িঘড়ি করে তাৎক্ষনাৎ রুম প্রত্যাখ্যান করলো নুরা। আবরার দীবার লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া মুখ দেখে হেসে ফেললো। রাগে দাঁত চি বিয়ে আবরারকে ধা ক্কা দিয়ে সরিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো দীবা। দরজা লাগানোর আগে চোখ পাকিয়ে আবরারকে ‘অ’সভ্য’ বলে দরজা লাগিয়ে দিলো। আবরার হাসতে হাসতে অভ্রের রুমের দিকে অগ্রসর হলো।
________________

সন্ধ্যার আকাশ স্বচ্ছ, পরিবেশ সিক্ত। বৃষ্টিময় সন্ধ্যায় ছিমছাম গোমট বাধানো কোলাহলমুক্ত পরিধি। সূর্যিমামা পশ্চিমাকাশে ডুব দিয়ে পরিবেশ করেছে অন্ধকার, নির্জন। অভ্র ফার্ন গ্রিন কালার শার্টের হাতা কুনই পর্যন্ত ভাজ করতে করতে আবরারের রুমের দিকে এগিয়ে আসছে। রিমি দূর থেকে অভ্রকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলো। লোকটা দেখতে বেশ সুন্দর। কিন্তু তার সাথে কেন জানি ঝগড়া করতে প্রচুর ভালোলাগে। কথায় কথায় লোকটার ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার চেহারাটা দেখলে হাসি পায়। এখন এমন কিছুই করতে ইচ্ছে করছে রিমির। ভেবে চিন্তে হঠাৎ মাথায় দু ষ্টু ফ:ন্দী আটকালো। অভ্র তার কাছাকাছি এগিয়ে আসতেই সে বলে উঠলো, ‘আরে অভ্র ভাইয়া? আপনি এখানে?’

রিমির কন্ঠস্বর কর্ণকুহর হতেই পা থামালো অভ্র। কপালে সরু ভাজ ফেলে রিমির দিকে সন্দেহপ্রবন দৃষ্টি মেলে তাকালো। রিমি তার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে আছে। এখানে আসার পর থেকে এমন কোনো দিন বাদ নেই যে দিন রিমির সাথে তার ঝ’গ’ড়া হয় নি। রিমি উঠে পরে লাগতো ঝ’গ’ড়ার জন্য। আজ তার মুখ থেকে এতো সুন্দর সম্মোধন অভ্র সহজ ভাবে নিতে পারছে না। যেই মেয়ে কথায় কথায় ইটের বস্তা, কারেন্ট গাছ ডাকে সেই মেয়ের মুখে অভ্র ভাই? না ব্যাপার টা ভালো টিকছে না।

রিমি হাস্যউজ্জল মুখে অভ্রের সামনে দাঁড়িয়ে বললো, ‘আপনি এখানে? আমি তো আপনাকে বাড়ির আনাচে কানাচে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে গেছি।’

অভ্র জিজ্ঞেস করলো, ‘কারণ কি?’

রিমি দাঁত কেলিয়ে প্রত্যুত্তর করলো, ‘আরব ভাই আপনাকে বাড়ির পিছনের লনে যেতে বলছে। কি জানি জরুরি কাজ আছে বললো। আর ভাইয়া অনেক তাড়াহুড়োতে ছিলো। যান যান অপেক্ষা করছে আপনার জন্য।’

ব্যাপার টা এতোক্ষণে বুঝে আসলো অভ্রের। তাকে অপদস্থ করতে কি মিথ্যে কথা বলছে এই মেয়ে। মনে মনে হাসলো অভ্র। পকেটে দুই হাত গুঁজে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো, ‘মিথ্যে বলাও এক ধরনের আর্ট। যা সবাই পারে না। যেমন তুমি।’

বুঝতে না পেরে রিমি ভ্রুঁ উঁচিয়ে কপাল কুঁচকালো। অভ্র ঠোঁটে মৃদু হেসে বললো, ‘তোমার শ্রদ্ধেয় বড় ভাই আমার রুমে বসে চিল করছে। এই মাত্র তার সাথে আমার কথা হয়েছে।’

রিমি চোখ বড়বড় করে অভ্রের দিকে তাকালো। ইশ মিথ্যে বলতে এসে এভাবে হাতে নাতে ধরা খাবে ভাবতে পারেনি। ঠোঁট টেনে প্রসারিত করে বোকা বোকা টাইপ হাসি দিলো একটা। অভ্র রিমির দিকে এক কদম এগিয়ে কিছুটা ঝুকে দাঁড়ালো। রিমি না পিছিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে অভ্রের চোখে চোখ রাখলো। অভ্র শীতল চাহনীতে শান্ত কন্ঠে শুধাল, ‘এখন থেকে মিথ্যে বললে আরেকটু চতুরতার সাথে বলবে। আর এইসব লেইম কথাবার্তা নেক্সট টাইম থেকে অভ্র হাসানের সাথে ট্রাই করবে না। গট ইট?’

রিমিকে পাশ কাটিয়ে আবরারের রুমে গেলো আইপড আনতে। মূলত আবরার অভ্রের রুমে বসে কাজ করছিলো। আবরারের আইপড আনতেই বেড়িয়ে ছিলো অভ্র। সে যেতেই রিমি দাঁতে দাঁত পিষে গটগট পায়ে রুমে এসে দরজা ঠাস করে লাগিয়ে দিলো।
__________________

গানের তালে তালে মাথা-পা দুলাচ্ছে রাইমা। পাশাপাশি সাদা কাগজে কেমিস্ট্রির ম্যাথ করছে। কানে তার কালো ওয়্যারলেস ব্লুটুথ হেডফোন। ঢিলেঢালা কালো টি-শার্ট। লেয়ার কাটের চুলগুলো পিঠ ছেড়ে কোমড় পর্যন্ত ছুঁই ছুঁই। মন যখন তার পুরো দমে অঙ্ক করতে ব্যস্থ তখনই মোবাইলে ব্রাইভেশনের ঝিম ধ্বনি বেজে উঠলো। অপরিচিত নাম্বার দেখে ভ্রুঁ কুঁচকালো রাইমা। কল রিসিভ করে খুব সাবলীল ভাবে বললো,

‘কে?’
‘আমি রাজিব!’
‘ওহ, আসসালামু আলাইকুম।’
‘ওয়ালাইকুম সালাম। কেমন আছেন?’
‘আলহামদুলিল্লাহ, আপনি?
‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো।’

নিশ্চুপ হয়ে গেলো দুজন। নিরবতা নেমে এলো তাদের মাঝে। রাইমা লজ্জায় কথা বলতে পারছে না। আর রাজিব কি বলবে খুঁজে পাচ্ছে না। আসলে সেদিনের পর রাজিবের সাথে রাইমার প্রথম ফোনালাপ হচ্ছে। তাই লজ্জা, অস্বস্তি ও জড়তা কাজ করছে দুজনের মনে। দীর্ঘ সময় পর লম্বা দম ফেলে রাজিব বললো, ‘আসলে মা নাম্বার দিয়ে বলেছে কল দিতে তাই দিলাম। ডিস্টার্ব করলাম নাকি?’

‘না তেমন কিছু না। আসলে আমি ম্যাথ করছিলাম।’

‘ওহ! আমি এখনো কানফিউজড তাই একটু আনইজি লাগছে।’

রাইমা জানতে চাইলো ‘কোন ব্যাপারে?’

‘আপনি আসলেই নিজ ইচ্ছায় বিয়েতে মত দিয়েছেন তো নাকি কোনো রকম’…

কিছুটা মিনমিনে গলায় বললো রাজিব। তাৎক্ষনাৎ রাইমার কপালে ভাজ পরলো। বললো, ‘কি মনে হয় আপনার?’

রাজিব ইতস্ততবোধ করে বললো, ‘মানে এখনকার যুগের মেয়েরা এমনি হয়। এক জায়গায় সম্পর্ক করে পরিবারের চাপে বিয়ে করে। আর আমি চাই না কারোর মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করতে। এখনো সময় আছে আপনি বলতে পারেন। আমি সামলে নিবো আপনাকে কেউ কিছু বলবে না। তবুও নিজ ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করবেন না। সারাজীবনের ব্যাপার এটা।’

রাইমা মুগ্ধ হলো রাজিবের কথা শুনে। তারপরেও মজা নিতে কন্ঠস্বর নামিয়ে বললো, ‘আসলেই। আমার দশ বছরের রিলেশন। কিন্তু পরিবার মানছে না। বয়ফ্রেন্ড বেচারা আমার টেনশনে চুল পাকিয়ে ফেলছে।’

রাইমার কথায় হতভম্ব হলো রাজিব। বিস্মিত কন্ঠে বললো, ‘দশ বছরের রিলেশন? আপনার বয়স কতো তাহলে?’

হাসি পেলো রাইমার। বললো, ‘বিশ্বাস হচ্ছে না?’

রাজিব কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বলল, ‘একটুও না।’

রাইমা হাই তুলে বলল, ‘কি আর করবো। আপনার তো আমার সত্যি কথা বিশ্বাস করছেন না তাই ভাবলাম মিথ্যে বলে দেখি।’

প্রসন্ন হলো রাজিব। সে মনে মনে চেয়েছে রাইমা যেনো মন থেকেই রাজি হয়। হলোও তাই। এতোক্ষণ রাইমা মজা নিয়েছে। রাজিব খুশি মনে বলে উঠলো, ‘তাহলে আপনি সত্যি বিয়েতে রাজি?’

‘আবার জিজ্ঞেস করছেন?’

রাজিব হেসে ফেললো। হাস্যউজ্জল কন্ঠে বললো, ‘তাহলে আর আপনি বলছি না। কিছু দিন পর তো বউ হবেই। তুমি ডাকটাই পারফেক্ট। কি তাই না?’

লজ্জা পেলো রাইমা। গাল লাল হয়ে এলো তার। প্রত্যুত্তরে বলার মতো কিছু পেলো না। রাজিব আবারো বল ‘তুমিও কিন্তু আমাকে তুমি করে ডাকবে।’

রাইমা লাজুক হাসলো। মুচকি হেসে উত্তর দিলো, ‘আচ্ছা!’

রাজিব এবার এমন ভাবে খুশি মনে কথা বলছে যেনো তাদের কতো বছরের সম্পর্ক পূর্ণতা পাচ্ছে।

চলমান..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here