#আষাঢ়ে_প্রেমের_গল্প
#নুজহাত_আদিবা
#পর্ব ১৯
এরপর আমরা মেয়ে কাজিনরা মিলে শুরু করলাম ডান্স রিহার্সাল করা। ডান্স রিহার্সাল করার সময় একেকজন একেক রকম ভাবে গানের সাথে নাচানাচি শুরু করেছিল। পরে রিহা সবাইকে বকে আবার নতুন করে শিখিয়েছে। আসলে কাজিনরা সব একসঙ্গে থাকলে এমনটা হর-হামেশা-ই হয়।
ডান্স প্র্যাকটিসের মাঝখানে দুপুরে একটু ব্রেক ছিল সবার। এরপর দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ করে আবার ডান্স প্র্যাকটিস শুরু।
পরের দিন বড় ফুপির বড় মেয়ে নিহা আপুর হলুদের অনুষ্ঠানে। আমরা সবাই আগের দিনের ডান্স রিহার্সাল অনুযায়ী ডান্স করলাম। সবাই এই ডান্সের দৃশ্যটুকু ভিডিওতে ধারণ করলো। হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর বাসায় গিয়ে সবাই নিজ নিজ আইডিতে ডান্সের ভিডিওটা পোস্ট করলো। রিহা ওর আইডিতে ডান্সের ভিডিওটা পোস্ট করে আমাকে ট্যাগ করলো। আমি এজন্য আর পরে আলাদা করে ভিডিওটা পোস্ট করিনি।
রাতের বেলা আমরা কাজিনরা সব একসাথে শুয়েছি। ওপর-নিচে ঢালাই বিছানা আরকি। বর্ণের সাথে ফোনে কথা বলা তো সম্ভব না এখন। তাই, ম্যাসেজেই কথা বলছিলাম। বর্ণ আমাদের ডান্সের ভিডিওটা দেখেছেন। এরপর ভিডিও দেখা শেষ করে আমাকে ইনবক্সে এসে বললেন,
— তুমি বেশ ভালো ডান্স করতে পারো মেহুলিকা। আমাদের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে তুমি কিন্তু ডান্স করবে বলে দিলাম।
— হুম আমি ডান্স করি আর আম্মা আৃাকে এসে ঝাড়ু দিয়ে পিটাক আরকি। আম্মা আব্বা দুজনের কেউই এসব পছন্দ করেন না। অনেক রিকুয়েষ্ট করার পরে এবার একটু কাজিনদের সাথে ডান্স করতে দিয়েছে। তাও বলে দিয়েছে শুধু মেয়ে কাজিনদের সাথে যেন ডান্স করি।
— তো? আমার বউ আমার সাথে ডান্স করবে তাতে কার কী? নিষেধ করলেই যে শুনতে হবে এমন কোনো কথা আছে?
— আপনার যুক্তির সাথে কেউ পারবে না। হুহ!
— পারার চেষ্টা করেও লাভ নেই। আমিই জিতবো।
— হয়েছে হয়েছে অনেক হয়েছে। এখন এই টপিক বাদ দিন। আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল।
— হুম বলো।
— আজকে আপনার প্রোফাইলে দেখলাম কয়েকটা মেয়ের সাথে ছবি তুলে আপলোড করেছেন। কে এগুলো?
— আমার কলিগ, ফ্রেন্ডস।
— আপনার কলিগ আর ফ্রেন্ডসরা কী শুধু মেয়েরাই হয়? ছেলেরা কী দোষ করেছে? মেয়েদের পেছনে পেছনে এত বেশি ঘুরাঘুরি করবেন না বলে দিলাম।
— আচ্ছা, এরপর থেকে আর ঘোরাঘুরি করবো না। সরাসরি রুম ডেটে চলে যাবো।
— ছিহ্ বর্ণ!
— হুম, কোনো মেয়ের সাথে কথাই বলবো না। কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবো ডেটে যাবেন?
— বর্ণ!
— তোমার কেন জ্বলেরে বন্ধু? তোমার কেন জ্বলে?
— আমার মোটেও জ্বলে না। আমি তো আর লাইট না যে জ্বলবো।
— হুম, হুম না জ্বললেই ভালো।
— হুহ্।
— আচ্ছা মেহুলিকা তোমার হাত খরচ লাগে না?
— হুম কিন্তু বাসা থেকে আমাকে দেওয়া হয় তো।
— যতই দেওয়া হোক। তোমার যা কিছু লাগবে আমাকে বলবে তুমি।
— আমার কিছু লাগবে না বর্ণ। যতটুকু যা আছে সেটাই যথেষ্ট আমার জন্য।
— তবুও। কিছু যদি লাগে তাহলে বলবে আমাকে।
— হুম।
— তুমি হাতে মেহেদী দাওনি মেহুলিকা?
🤧– হুম দিয়েছি, কিন্তু কেন?
— তোমার মেহেদী রাঙা হাতের একটা ছবি পাঠালেও তো পারো।
— ওহ, এই ব্যাপার? আচ্ছা, আপনি অপেক্ষা করুন। আমি ছবি তুলে পাঠাচ্ছি।
আমি আমার দু’হাতের মেহেদীর ছবি তুলে পাঠালাম বর্ণকে। হাতের ছবিটা অবশ্য রিহা তুলে দিয়েছে।
আমি বর্ণকে আমার হাতের মেহেদীর ছবি পাঠানোর সাথে সাথেই বর্ণ ছবিটা সিন করলেন।
— পরে না চোখের পলক। কী তোমার হাতের ঝলক।
— আবার শুরু করেছেন বর্ণ আপনি?
— আমার কী দোষ? এত সুন্দর করে মেহেদী হাতে দিয়ে ছবি পাঠালে আমার মনটা আনচান আনচান করে। কবে যে তোমাকে বিয়ে করে আমার ঘরে তুলবো!
— আপনার মাথায় কী শুধু বিয়ে আর বিয়েই ঘোরে?
— হুম, তুমি তো আমার বউ। তোমাকে বিয়ে করবো না তো আর কাকে বিয়ে করার চিন্তা করবো?
— বাজে কথা বন্ধ করুন। চুপ একদম চুপ।
— আচ্ছা, আংকেল আন্টি তোমাকে বিয়ে দিবে না? মানে এই ব্যাপারে কিছু বলে না তোমাকে?
— হুম, এজন্যই তো পাত্র দেখা হচ্ছে আমার জন্য।
— তুমি আমাকে এটা আগে কেন বললে না?
— আগে বললে কী হতো?
— অনেককিছুই হতো। আমাকে বাসা থেকে বলা হচ্ছে বাংলাদেশে এসে তাড়াতাড়ি যেন বিয়ে করে নেই। আমি তো আগেই বলেছিলাম যে আমার একটা পছন্দ আছে। তাই আমার জন্য কেউ মেয়েও দেখছে না। তুমি এই ব্যাপারটা আমাকে আরও কিছুদিন আগে বললে ভালো হতো।
— আমি তো এতকিছু জানতাম না। জানলে অবশ্যই জানাতাম।
— আচ্ছা, দেখছি আমি কী করা যায়। তবে মনে রেখো খুব জলদি দেশে আসছি৷ তোমাকে বউ করে নিয়ে আসবো কথা দিলাম।
— ও বাবা তাই না কি? তা কবে আসছেন?
— ডেটটা আরও কিছুদিন পরে জানাচ্ছি। একেবারে শিওর হয়ে তারপর জানাবো আমি।
— আচ্ছা।
এর মাঝখানে আমার কাজিনের বিয়ে বউভাতের অনুষ্ঠানের ঝামেলা সব শেষ হলো। সব ঝামেলা মিটিয়ে বাসায় আসতে আসতে মোটামুটি একটু রাত হয়ে গেল। বাসায় এসে রুমের দরজা বন্ধ করে যখন ফ্রেস হবো তখন দেখি বর্ণ কল দিচ্ছে। শরীরটা খুব ক্লান্ত ছিল। ভেবেছিলাম, বর্ণের কল আজকে আর ধরবো না। কালকে কথা বলবো একেবারে। কিন্তু, আমার মন সেটা মানলো না। আমি বর্ণের ফোন কেটে সরাসরি ভিডিও কল দিলাম।
বর্ণ কল রিসিভ করেই আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
— হা করে আছেন কেন? কী হলো আবার? নেটে প্রবলেম না কি? একটু পরে কল দিবো?
— আরে ধুর, ওইসব নেট -ফেটের কথা বাদ দাও। তোমাকে তো আজকে আমার বউ লাগছে পুরো।
— সাজলে মানুষকে সুন্দর লাগে। বউ বউ লাগে তা তো জানতাম না।
— হুম সাজলে সবাইকে সুন্দর লাগে কিন্তু আমার মেহুলিকা সাজলে তাঁকে বউ বউ লাগে।
— হুম বুঝলাম। আপনার দেশে আসার ব্যাপারটার কী হলো? কবে আসছেন?
— সামনের মাসের ১৭ তারিখ বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওনা দিবো। আজকে তো ১ তারিখ মাসের। খুব বেশিদিন সময় নেই।
— বাহ্ তাহলে তো ভালোই। এখন আল্লাহর রহমতে ঠিকঠাক ভাবে বাংলাদেশে এসে পড়ুন। অপেক্ষা করছি আমি।
— হুম তাতো আসবোই। বলো তোমার জন্য কী আনবো? তোমাকে আমার সেভাবে কিছুই দেয়া হয়নি।
— আমার বেশি কিছু লাগবে না। আমার জন্য শুধু একটা বর্ণ কিনে নিয়ে আসবেন। আমার শুধু বর্ণ-ই লাগবে। অন্যকিছু হলে চলবে না বলে দিলাম।
–হাহা, বর্ণ শুধু একটাই। কিন্তু বর্ণ তাঁর মেহুলিকার জন্য। তাই দুঃখিত আমি তোমাকে কোনো বর্ণকে দিতে পারবো না।
— আমার বর্ণই লাগবে। ওই মেহুলিকা টেহুলিকাকে চিনি না আমি। আমাকে বর্ণ কিনে দিতে হবে।
— হাহা, নিয়ো তুমি বর্ণকে। কিন্তু তোমার একটা সতীন আছে। তাঁর নাম মেহুলিকা।
— ওইসব সতীন-টতীন মানি না আমি। বর্ণকে আমিই নিবো।
বর্ণ হেসে ফোনে একটা চুমু খেলেন। বর্ণের এমন কান্ড দেখে আমিও বর্ণকে চমকে দেওয়ার জন্য;ফোনের ক্যামেরাতে একটা চুমু খেলাম। হুম, কাছে থেকে না হোক দূর থেকেই নাহয় হোক ভালোবাসা বিনিময়।
বর্ণের দেশে আসতে আসতে মোটামুটি একটু দেরিই হলো। ডেট কিছুদিন পিছিয়ে গেল। প্রথমে ডেট পিছিয়ে যাওয়ার কথা শুনে মন খারাপ হয়েছিল খুব। কিন্তু, পরে বর্ণ ঠিকঠাক বাংলাদেশে এসে পৌঁছানোর পর মনটা ভালো হয়ে গিয়েছে। আজকে সকাল সাতটায় বাংলাদেশে এসেছে বর্ণ। বর্ণকে রিসিভ করতে বর্ণের সব কাজিনরা এয়ারপোর্টে গিয়েছিল। আমারও ইচ্ছে ছিল অবশ্য এয়ারপোর্টে বর্ণকে গিয়ে রিসিভ করার। কিন্তু সেটা সম্ভব না।
বর্ণ সকালে আসলেও আমার সাথে বর্ণের এখনও দেখা হয়নি। বর্ণ জার্নি করেছে ক্লান্ত তাই হয়ত রেস্ট নিচ্ছে। আমিও সেজন্য বর্ণকে আর বিরক্ত করিনি।
#আষাঢ়ে_প্রেমের_গল্প
#নুজহাত_আদিবা
#পর্ব ২০
বর্ণের সাথে দেখা হলো পরেরদিন ভোরবেলা। ভোরবেলা ছাঁদে গিয়েছিলাম গাছে পানি দেওয়ার বাহানায়। কিন্তু, আসলে আমি বর্ণকেই দেখতে গিয়েছিলাম। আমি জানি বর্ণ ভোরবেলা ছাঁদে উঠে পায়রা নিয়ে মগ্ন থাকবে। আর আমি সেই সুযোগে আমার বর্ণকে একটু দেখবো। কতদিন সামনাসামনি দেখি না ওনাকে।
বর্ণ ছাঁদে উঠে পায়রাদের খাওয়াচ্ছে। ছাঁদে বর্ণের পাশে পায়রাগুলো শুধু উড়াউড়ি করছে। বর্ণ আমাকে দেখেননি। আমি ছাঁদের সাইডে দাঁড়িয়ে আছি তাই দেখা যাচ্ছে না হয়তো। কিন্তু, কিছুক্ষন পরে মনে হলো না আমার বর্ণের সামনে যাওয়া উচিত। সে তো আমারই বর্ণ। তাঁর সামনে তো যাওয়াই যায়। এরপর আমি পা টিপে টিপে বর্ণের সামনে গেলাম। বর্ণ আমাকে দেখেই একগাল হাসলো। আমার দেখেই খুব মায়া লাগলো। এরপর বর্ণ আমার দিকে তাকিয়ে ওনার হাতে থাকা পায়রা-টা আকাশের দিকে ছুঁড়ে মারলেন।পায়রাটা বর্ণের হাত থেকে ছাড়া পেয়েই উড়ে গেল। বর্ণ হাসতে হাসতে গান ধরলেন,
— ও আমার উড়াল পঙ্খীরে যা যা তুই উড়াল দিয়া যা।
আমি এবার লজ্জা পেয়ে নিচে চলে এলাম। বর্ণ পেছন থেকে মেহুলিকা মেহুলিকা বলে ডাকছে। কিন্তু আমার তাতে কী? আমি এখন বর্ণের সামনে যেতেও পারবো না। আমার তো এখন লজ্জা লাগছে।
দুপুর বেলা খাওয়া দাওয়া শেষ করার পর বিকালে আব্বা নামাজ পড়ে হাঁটতে বের হোন। আজকে ও বের হয়েছিলেন। কিন্তু, বাড়িতে যখন আসলেন তখন খুব হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন। আমি কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছি যে আপনার কী হয়েছে আব্বা? শরীর খারাপ লাগছে? কিন্তু, আব্বা কিছুই বলেননি। কী হয়েছে কেন হয়েছে কিছুই বলেননি। কিন্তু আমি জানি আব্বার কিছু একটা হয়েছে। কী হতে পারে সেটা?
রাতে বর্ণ মেসেজ দিয়ে বললো সবাই ঘুমিয়ে পড়লে বারান্দায় যাই যেন। রাতে আব্বা আম্মা খেয়েদেয়ে শোয়ার পরে আমি বারান্দায় গেলাম। বর্ণ বারান্দায় বসে বসে ফোন গুতাচ্ছে। আমি গিয়ে হালকা করে একটা কাশি দিলাম। বর্ণ এরপর ফোন রেখে আমার দিকে ঘুরে তাকালো। আমি বারান্দায় চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললাম,
— কী অবস্থা? কেমন আছেন?
— বউ বিহীন একটা মানুষ যেমন থাকে তেমনই আছি।
— সোজা কথাকে না প্যাঁচালে হয় না?
— হুহ্, তোমার আব্বুর কী অবস্থা? উনি কেমন আছেন?
— এই আছেন আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু বিকালে স্বাভাবিক হয়ে হাঁটতে বের হলো। আর বাসায় আসলে অন্যমনস্ক হয়ে। আমি এখন বুঝতে পারছি না কিছু। কী যে হলো আব্বার!
— মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব শুনে আনন্দে এই অবস্থা ওনার।
— মানে!
— আমার দিকে এভাবে তাকাচ্ছো কেন? আমি কী করেছি?
— যা করার আপনিই করেছেন। জলদি বলুন তো এতকিছু হলো কীভাবে?
— আমি কিছু করিনি। আমি শুধু তোমার আমার বিয়ের জন্য প্রস্তাব পাঠিয়েছি।
— আল্লাহ্ বলেন কী! তারপর কী হলো?
— বললো পরে জানাচ্ছেন।
— প্রস্তাব কী সরাসরি আপনি দিয়েছেন?
— না, আব্বু আর দুলাভাই দু’জনে মিলে দিয়েছে।
— আমাকে টেনশনে না ফেললে হতো না? এখনি সবকিছু করা লাগলো?
— এখন করবো না তো কখন করবো? আমার হাতে সময়ই আছে শুধু একমাস। এরমধ্যেই সবকিছু শেষ করতে চাচ্ছি।
— তাও ঠিক। কিন্তু, কী যে হবে এখন!
— তোমার আব্বু না দিলেও তোমাকে তুলে নিয়ে বিয়ে করবো আমি। বর্ণ মিথ্যা কথা বলে না কখনো।
— চুপ একদম চুপ। দোয়া করুন সবকিছু যেন ঠিকঠাক ভাবে হয়। দোয়া বাদ দিয়ে উনি বিয়ে বিয়ে করছে। মনে কত রং!
— হুহ্ ঠিক মতোই হবে সব। পাত্র তো আর যে-ই সে-ই পাত্র না। একেবারে যোগ্য পাত্র।
— আহারে আমার যোগ্য এলেন রে।
— হুহ্, তোমার জন্য কিছু জিনিস এনেছি। কীভাবে দিবো বলো?
— আপনাকে কে বলেছিল আনতে? আমি বাসা থেকে বেরই বা হবো কীভাবে? আপনি সব ঝামেলা একসঙ্গে ঘাড়ে নিয়ে ফেলেন। ভালো লাগে না আমার।
— ও মেহুলিকা।
— কী?
— কিছু না।
— তো ডাকলেন কেন শুধু শুধু?
— এমনি ডেকেছি। তোমার নাম বার বার উচ্চারণ করতে ভালো লাগে আমার।
এরপর বর্ণ আর আমি কিছুক্ষন গল্প করার পরে ঘুমাতে চলে গেলাম। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর দেখি অমালিকা আপা আর দুলাভাই এসেছেন। আব্বা আর দুলাভাই ড্রয়িংরুমে বসে কথা বলছে। আম্মা আর অমালিকা আপা রান্নাঘরে। আমি রান্নাঘরে ঢোকা মাত্রই আম্মা আমার হাতে চায়ের ট্রে দিয়ে বললেন, আব্বা আর দুলাভাইকে চা দিয়ে আসতে।
ড্রয়িংরুমে গিয়ে আব্বা আর দুলাভাইকে চা দিয়ে যখন চলে আসছিলাম তখন শুনলাম আব্বা বলছেন,
— ছেলেটা অত্যাধিক ভালো আর ভদ্র। কিন্তু সমস্যা একটা জায়গাতেই। ছেলে কানাডা থাকে। বিয়ে হলে আমাদের মেহুলিকাকেও নিয়ে যাবে সঙ্গে করে। এটা আমার ছোট মেয়ে। ওকে যদি এতদূরে বিয়ে দেই তাহলে আমি থাকবো কী নিয়ে? তুমি তো সবকিছুই জানো বাবা। বলো তো কী করি?
আমি এটুকু শুনেই বুঝলাম আমার আর বর্ণের কথা-ই হচ্ছে এখানে। আচ্ছা, শেষ অবধি আব্বা কী করবেন? তুলে দেবেন আমাকে বর্ণের হাতে? না কি এখানেই আমাদের গল্পের সমাপ্তি? আমাদের এত সুন্দর প্রেমের গল্পের পরিণতি কী হবে?
দুপুরে এসবের উপর মাত্রাধিক চিন্তায় আমি বর্ণকে ফোন দিলাম। বর্ণ ঘুমাচ্ছিল তাই ফোন ধরতে একটু সময় লাগলো। বর্ণ ফোন ধরেই হাই তুলতে তুলতে বললো,
— হ্যাঁ বলো মেহুলিকা।
— আব্বা হয়তো আমাদের বিয়ে দেবেন না বর্ণ।
— হুহ, কী বলছো এসব?
— বাসার পরিস্থিতি যতটুকু বুঝলাম তাতে এটাই মনে হলো। আব্বা আমাদের বিয়ে দেবেন না।
— কেন? আমি নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি। আমার ফ্যামিলি ব্যাক গাউন্ড সবই তো ঠিকঠাক। তাহলে না করার কারণ কী?
— আপনি দেশের বাইরে থাকেন এটাই কারণ। আব্বা চান আমাকে তাঁর কাছে কাছে রাখতে। আপনার সাথে বিয়ে হওয়ার পর হয়তো আমাকেও কানাডা চলে যেতে হবে। তখন আব্বা আম্মাকে কে দেখবে?
— হুম, এটা সত্যি কিন্তু আমি একবার তোমাকে নিয়ে যেতে পারলে আংকেল আন্টিকেও নিয়ে যেতে পারতাম।
— হুম, কিন্তু এখন শেষ উপায় আছে একটা। দেখি কিছু করতে পারি কি না।
— কী করবে?
— আব্বা যেকোনো কাজেই দুলাভাইয়ের পরামর্শ নেন। আমি দেখি দুলাভাইকে কিছু বুঝিয়ে বলতে পারি কি না।
— তুমি এসবে জড়িয়ো না মেহুলিকা। তোমার দুলাভাইকে যা বলার আমি বলবো। তোমার দুলাভাই কী এখন তোমাদের বাসায়?
— হুম।
— বাসা থেকে বের হবে কয়টায় আনুমানিকভাবে বলতে পারবে?
— আসরের আজান দিলে ভাইয়া নামাজ পড়তে বের হবে। তখন বলতে পারেন।
— আচ্ছা দেখছি আমি।
আসরের আজান যখন দিলো ভাইয়া বাসা থেকে বের হয়ে গেল৷ ভাইয়ার সাথে আব্বাও বের হলেন। দু’জনে একসাথে নামাজ পড়বেন। আমিও টেনশনে অজু করে নামাজ পড়তে বসে গেলাম। মনটা খুব খারাপ লাগছে। কী যে হবে!
দুলাভাই যখন নামাজ পরে বাড়িতে আসলেন আমি গেট খুলে দিলাম। দুলাভাই আব্বার পরে বাসায় এসেছেন। হয়তো বর্ণের সাথে কথা বলছিলেন তাই দেরি হয়েছে। আমি গেট খুলে দেওয়ার পর দুলাভাই ঘরে ঢুকে বললেন,
— মেহুলিকা আমি আসছি। তুমি একটু বসো তো কথা আছে আমার তোমার সঙ্গে।
এরপর ভাইয়া চলে গেলেন। আমি ড্রয়িংরুমে ভাইয়ার অপেক্ষায় বসে রইলাম। কী বলবেন ভাইয়া আমাকে? খুব খারাপ কোনো সংবাদ দেবেন? খুব খারাপ?
ভাইয়া ড্রয়িংরুমে এসে টেবিলের সামনের সোফাটায় বসে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— তো তোমাকে যা বলতে চাচ্ছিলাম আরকি।
— হুম, ভাইয়া বলুন কী বলবেন।
— খুব টেনশনে আছো দেখছি।
— কই না তো।
— আমার থেকে কিছু লুকিয়ে রেখো না মেহুলিকা। আজকে আসার সময় একটা ছেলের সাথে দেখা হয়েছে আমার। শুধু দেখা না অনেক কথাও হয়েছে বলতে পারো। বর্ণ নাম মনে হয় ছেলেটার।
আমি প্রচন্ড চমকে ভাইয়াট দিকে তাকালাম। ভাইয়া হেসে বললো,
— এত চমকে উঠলে যে! ভয় পেলে না কি?
— কই না তো।
— বাদ দাও এত কথা। সোজাসাপটা ভাবে বলতে গেলে আমি কিন্তু সব জানি মেহুলিকা। তোমার যে ওই বর্ণ নামের ছেলেটার সাথে সম্পর্ক রয়েছে এটাও জানি।
— আসলে..
— থাক বলতে হবে না কিছু। ছেলেটা কিন্তু এত ও খারাপ না। তোমাদের মানাবে ভালো।
আমি এবার পিলে চমকে ভাইয়ার দিকে তাকালাম। কারণ এটা কী বললো ভাইয়া মাত্র।
— চমকাচ্ছো কেন?
— সত্যিই তো বললাম। ছেলেটা কিন্তু ভালো ওকে কষ্ট দিও না কখনো।
— আব্বাকে কীভাবে বোঝাবো বলুন। আমার হাতে কিছু নেই তো।
— আমি দেখছি, এত চাপ নিও না তুমি। এইটুকু একটা মেয়ে আবার বিয়ের জন্য এত চিন্তা করে। তোমার এখানেই বিয়ে হবে দেখে নিও। আমিও বলে দিলাম।
— আপনি আমাকে চিন্তা থেকে বাঁচালেন ভাইয়া। দেখুন না কী করা যায়। আব্বাকে তো চেনেনই।
— আমি বলেছি না শুধু শুধু চিন্তা করতে না। তোমার আব্বু তাঁর মেয়ের ভালোটাই চাইবে। আর ওই ছেলেটাও এত খারাপ না। সুখেই রাখবে তোমাকে।
— হুম।
চলবে….
চলবে…