#ইচ্ছে_দুপুর
খাদিজা আরুশি আরু
পর্বঃ২
আমি চুপসানো বেলুনের মতো মুখ করে বললাম,
—আপনাকে জোকার না স্যার,আপনাকে হিরো মনে হয়।
আমার কথায় সম্ভবত স্যার বেশ খুশি হলেন।ঠোঁটের কোনের হাসিটা আরও প্রসস্ত করে বললেন,
—তা তোমার নাম জানার জন্য কি এপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে?
আমি মুচকি হেসে বললাম,
—জ্বী না।আমি এমনিতেই বলছি।আমি ইচ্ছেবিলাসী রহমান।না,না ইচ্ছেবিলাসী মাহবুব।
স্যার কিছুটা বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকালেন।আমি ওনার দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে চুপচাপ বসে পড়লাম।
আমি যে বিবাহিত ক্লাসের সবার কাছে সে ব্যাপারটা লুকিয়ে গেলাম।তাছাড়া আমার কি দোষ,আমি তাদের কি বলবো!আমি তো আমার বরের পদবী ছাড়া কিছুই জানি না।সবাই যখন বরের নাম জিজ্ঞেস করবে তখন আমি কিছুই বলতে পারবো না।আর তা দেখে সবাই আমায় নিয়ে হাসবে।কারো হাসির পাত্রী হতে চাই না বলেই ব্যাপারটা কাওকে জানালাম না।
রুদ্র স্যার ছাড়াও আরো একজন স্যারের উপর আমি ক্রাস খেয়েছিলাম।সবাই আমার কান্ডে বেশ অবাক হলো।মিন্নি তো একদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে আঁদুরে গলায় বললো,
—তোকে দেখে আমি অবাক হচ্ছি ইচ্ছে।সবাই যেখানে রুদ্র স্যারের উপর পাগল সেখানে তুই রুদ্র স্যার আর ডিএম দুজনকেই ভালোবাসিস?একত্রে দুজনকে ভালোবাসা যায়?
মিন্নিকে ছাড়িয়ে দিলাম এক রাম ধমক।ধমক খেয়ে একটু নিভলো মিন্নি।তারপর আমি তাকে বললাম,
—আমি রুদ্র স্যার বা ডিএম কাওকেই ভালোবাসি না।আমার ওনাদের ভালো লাগে।ওনারা আমার আইডল।আমি ওনাদের মতো এ কলেজের শিক্ষক হতে চাই।
মুখে এ কথা বললেও আমার কিন্তু পড়ার থেকে এই দুই স্যার কি করে না করে তার দিকেই বেশি ঝোঁক ছিলো।এই দুই স্যারের ক্লাসের দিন আমি একটু বেশিই প্রসাধনী ব্যবহার করতাম।ব্যাপারটা রুদ্র স্যারের ভালো লাগলেও ডিএম সেদিন আমাকে অনেক বকা দিয়েছিলো সবার সামনে।তাই ভয়ে ওনার ক্লাসে সেজে যাওয়া বন্ধ করলাম।আমার কথা শুনে মিন্নি ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো,
—হুহ…আসছে।আরে তুই রুদ্র স্যারের উপর পাগল তা না হয় আমি মানতে পারি কিন্তু ডিএম?উনি কতো রাগী দেখেছিস?তোকেও তো সেদিন সেজে আসার জন্য বকলো।
—তাতে কি হয়েছে?উনি একটু গম্ভীর এই যা।
—এমনভাবে ওকালতি করছিস যেনো তোর বর লাগে।
মিন্নির কথার পিঠে আমি আর কিছু বলতে পারলাম না।কোথাও না কোথাও আমার অপরাদবোধ হচ্ছিলো।সত্যিই তো ডিএম আমার কেউ না।তবে তাকে নিয়ে আমার এতো মাতামাতি কিসের!
সিদ্বান্ত নিলাম রুদ্র স্যার আর ডিএম যাক উচ্ছন্নে…আমি আমার পড়ায় মনোযোগ দেই।কিন্তু তাতেও হলো আরেক বিপত্তি।পড়তে বসলেই স্যারদের কথা মনে পড়ে।শেষমেশ সিদ্বান্ত নিলাম তাদের কথা মনে করে করেই পড়বো।
এর মাঝে ঘটলো এক অদ্ভুত কান্ড।একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে শুনি আমার সঙ্গে দেখা করতে বাড়ি থেকে লোক এসেছে।ভেবেছিলাম বাবা বা মা এসেছে।কিন্তু না,এসেছেন আমার শ্বশুর মশাই আর শ্বাশুড়ি মা।ওনাদের প্রথমে চিনতে না পারায় কেমন যেনো অপ্রস্তুত লাগছিলো নিজের কাছে।আমিই বোধহয় একমাত্র মেয়ে যে কি না তার শ্বশুর শ্বাশুড়ির সঙ্গে প্রথমবার দেখা করার সময় শাড়ীর বদলে টি-শার্ট আর টাউজার পরে গেছে।তার উপর একটা ওড়নাও নেয় নি।
ওনাদের পরিচয় পাবার পর লজ্জায় আমি যখন মাথা নিচু করে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছি তখন আমাকে অবাক করে দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন আমার শ্বাশুড়ি মা।তখন খুশিতে আমার চোখ ভিজে গেলো।কথা বলে বুঝলাম কোনো কারনে ওনারা খুলনা থেকে ঢাকা এসেছেন।তাই আমাকে দেখে যেতে এসেছেন।আজই খুলনা ফিরবেন।একবার ভেবেছিলাম তাদের ছেলের কথা জিজ্ঞেস করবো কিন্তু লজ্জায় আর জিজ্ঞেস করা হলো না।
শ্বাশুড়ি মা আমার জন্য হরেক রকম রান্না করে আনলেন।খাবারগুলো দেখেই জিভে জল এসে গেলো।আর যাই হোক এতোদিন নিজের রান্না করা অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম।মন চাইছিলো খাবারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি।কিন্তু লজ্জায় তাও করতে পারলাম না।নিজেই অবাক হচ্ছিলাম।আমার এতো লজ্জা কোথা থেকে আসে কে জানে।
ওনারা যতোক্ষণ থাকলেন আমাকে মা মা সম্বোধন করে কথা বলছিলেন।বাবা ছাড়া আমাকে কখনো কেউ মা সম্বোধন করে নি।ওনাদের ব্যবহারে আমি মুগ্ধ হচ্ছিলাম।বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে ওনারা আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।ওনারা যাবার পর আমি ঘরে এসে সবক’টা পদ একটু একটু খেয়ে দেখছিলাম।তখনই কোথা থেকে মিতালি আপু এসে উপস্থিত হলো।আশ্চর্য হবার ভঙ্গিতে বললো,
—কি রে ইচ্ছে,তোকে এই রাজভোগ দিয়ে গেলো কে?
—আপু,এভাবে কেনো বলছো বলো তো?আমাকে আমার বাড়ি থেকে দিয়ে গেছে।
—তা কে ছিলো রে ওরা?তোর বাবা তো নন।সত্যি করে বলতো ইচ্ছে কে ওই ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা?
—তারমানে তুমি ওনাদের দেখেছো?
—হ্যাঁ তো,লাইব্রেরীতে যাবার সময়ই দেখেছি দুইজনে তোকে নিয়ে ভিজিটিং রুমে বসে কতো আধিখ্যেতা করছিলেন।
মিতালি আপুর কথায় বড্ড রাগ হলো আমার।রাগে গজগজ করতে করতে বললাম,
—আপু তুমি জানো না যে,কাওকে খাবার সময় বিরক্ত করতে নেই?তবে তাকে হ্যাংলা বলে?তবে তুমি আমার খাবার সময় আমার ঘরে এসেছো কেনো?আর আমার পরিবার আমাকে ভালোবাসলে তা যদি তোমার কাছে আধিখ্যেতা মনে হয় তবে তুমি আমার সঙ্গে আর কথা বলতে এসো না।যে ভালোবাসা আর আধিখ্যেতার পার্থক্য বোঝে না সে আমার চক্ষুশূল।
—হ্যাঁ,এখন আমি চক্ষুশূল। যখন রান্না শিখার দরকার ছিলো তখন তো ঠিকই মিতালি আপু এটা কি করে করবো,ওটা কি করে সব জানতে চাইতি।যেই নিজের কাজ হয়ে গেলো অমনি আমি চক্ষুশুল?যা আসবো না তোর কাছে আর।হুহ…
নিজের ব্যবহারে নিজেই অবাক হচ্ছি যে মানুষগুলোকে কাল অবধি চিনতাম না তাদের জন্য আজ আমি লড়ছি!একবার বাবা বলেছিলো,”সংসারের মায়ায় একবার পড়ে গেলে আর সে মায়া কাটাতে পারবি না রে ইচ্ছে মা”।তবে কি আমি সংসারের মায়ায় পড়ে যাচ্ছি কিন্তু কি করে সম্ভব?আমি তো আজ অবধি সংসারই করি নি।হঠাৎই ফোনে একটা মেসেজ আসলো।মেসেজটা খুলে দেখি একটা অচেনা নাম্বার থেকে এসছে।সেখানে লেখা,”আমার বাবা মায়ের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করার জন্য ধন্যবাদ”।বুঝলাম মেসেজটা আমার বর করেছে।তার নামটা মি.মাহবুব লিখে সেভ করে রাখলাম।তাছাড়া আর কি’ই বা লিখতাম,আমি যে কেবল তার নামের এ অংশটাই জানতাম।সব মিলিয়ে দোটানায় ভুগতে শুরু করলাম আমি।তার দরুন আমার প্রথম সেমিস্টারটা খুব খারাপ হলো।কোনোরকম টেনেটুনে পাসটা হলো আরকি।
এর মধ্যে আরও একটা কান্ড ঘটলো।রুদ্র স্যার একটা মেয়ের সঙ্গে অসভ্যতা করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা খেলেন।সেদিন আমি আমার মাঝে রুদ্র স্যারের প্রতি তীব্র রাগ অনুভব করতে লাগলাম।যে পুরুষ নারীদের সম্মান করতে পারে না সে অন্তত আমার পছন্দের মানুষের তালিকায় থাকতে পারে না।সেদিন মিন্নির গলা জড়িয়ে অনেকক্ষণ কেঁদেছিলাম।মিন্নি বিস্মিত স্বরে বলেছিলো,
—রুদ্র স্যারকে শৌকজ করা হয়েছে বলে তুই কাঁদছিস ইচ্ছে?ওনার ভালো দিকগুলোই দেখবি?খারাপটা দেখবি না?
আমি নাক টেনে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলাম,
—এমন একটা বাজে লোক আমার পছন্দের তালিকায় কি করে এলো রে মিন্নি?আমার পছন্দ কি পঁচে গেলো নাকি রে?
মিন্নি ভেবেছিলো স্যারকে বরখাস্ত করেছে বলে আমি কাঁদছি।আমার কথা শুনে ও চোখদুটো রসগোল্লার মতো বড় বড় করে বললো,
—তবে তুই ওনাকে বের করা হচ্ছে বলে কাঁদছিস না?
—ওই বজ্জাত চরিত্রহীনকে বের করলে আমি কাঁদবো?আমি তো বলি,বেটাকে এক গামলা আলকাত্রায় চুবিয়ে গলায় জুতোর মালা পরিয়ে তবে বিদেয় করুক।আর যাই হোক নারীর অসম্মানকারী ঘোর পাপী।
তার কিছুদিন পর বাবা আমার সঙ্গে দেখা করতে আসলেন।আমার খারাপ রেজাল্ট নিয়ে আমাকে একগাদা কথা শুনিয়ে চলে গেলেন।তার মধ্যে অন্যতম কথা ছিলো, “এমন রেজাল্ট করলে তোর শ্বশুর বাড়িতে আমি মুখ দেখাবো কি করে?তোর বর কতো মেধাবী জানিস?তার বউ হয় তুই কি না টেনেটুনে পাশ করিস”!
সেদিন বাবার উপর আবার অভিমান হলো।বাবা আমার কষ্টগুলো বুঝলো না।আমাকে না বুঝেই কতো কথা শুনালো!তার জামাই’ই তার সব,আমি কেউ না?আমার জীবনে যে অল্প কিছুটা সময়ে এতো পরিবর্তন ঘটলো তা কিছু না বুঝি!
চলবে…