#উমা [কপি করা নিষেধ]
#৬ষ্ঠ_পর্ব
রুদ্রের অস্থিরতা ক্রমশ বাড়ছে। এক অজানা ভয়ে হিম ধরছে তার। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়ছে সে। তখনই ছাঁদের সিড়ি বেয়ে নেমে এলো শাশ্বত। সে উমাকে পাজাকোলে নামাচ্ছে। উমা তখন অচেতন। উমার নিথর শরীরটাকে সাবধানে নামালো শাশ্বত। নিচে উপস্থিত সকলের চক্ষু ছানাবড়া। মালিনী দেবী পুত্রের এমন ধারা কাজে খানিকটা অখুশী হলেন। রুদ্র স্থির, তার রক্তচক্ষু চেয়ে রয়েছে শুধু শাশ্বতের দিকে। চোয়াল জোড়া শক্ত। বুকের যেনো আগুন জ্বলছে। রুদ্রের নামের মতো তার স্বভাব ও প্রচন্ড ক্রুদ্ধ। নিজস্ব সত্তার অমতে কিছু ঘটলেই তার মাথায় আগুন জ্বলে উঠে। কেউ যদি তার পছন্দের জিনিসে হাত দেয় সেই মানুষটি তার চক্ষুশুল হয়ে উঠে। যেমনটি এখন হচ্ছে, রুদ্রের ইচ্ছে হচ্ছে শাশ্বতকে খুন করতে। এতো বড় স্পর্ধা হয় কি করে, তার বউ এর দিকে নজর দেবার। রুদ্রের রোষাগ্নিকে পরোয়া না করে শাশ্বত উমাকে তার ঘরে শুইয়ে দেয়। এরপর রুদ্রের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রয়োগ করে। শীতল কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়,
“বিয়ে করলেই স্বামী হওয়া যায় না রুদ্র। এবার তো একটু শুধরা। গায়ে হাত দিয়ে দেখ, জ্বরে রীতিমতো পুড়ছে। না জানি কখন থেকে অচেতন হয়ে পড়ে ছিলো ছাঁদে। নিজের প্রয়োজন মিটিয়েই ছুড়ে ফেলাটা বন্ধ কর। আমি না দেখলে, না জানি কতো সময় এভাবেই পড়ে থাকতো।”
সত্যি, শাশ্বত না দেখলে হয়তো ওভাবেই পড়ে থাকতো উমা। শেষ রাতের দিকে ছাঁদে আশ্রয় নেয় উমা। হাটু গেড়ে এক কোনায় বসে থাকে। নির্ঘুম ক্লান্ত অশ্রুসিক্ত চোখ জোড়া চেয়ে থাকে কালো আকাশের দিকে। আমাবস্যার কালো আকাশে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পারে উমা। নিগাঢ় কালো আধার একটু একটু করে তাকে গ্রাস করছে। আজ কেনো যেনো মরে যেতে ইচ্ছে করছে তার। একটা মানুষের নিজস্ব ইচ্ছাকে যেখানে গলা টিপে হত্যা করা হয় সেখানে বাঁচার বিন্দুমাত্র সাহস থাকে না মানুষের। কিন্তু ওই যে আত্নহত্যা মহাপাপ। আচ্ছা এবাড়ি থেকে পালিয়ে যাবার কি কোনো উপায় নেই? পরমূহুর্তে রাজশ্বী আর গোপালের মুখখানা ভেসে উঠে উমার চোখে। উমার পালিয়ে মুক্তি পেলেও রুদ্র তার পরিবারকে ছাড়বে না। সর্বনিকৃষ্ট শাস্তি পেতে হবে তাদের। এই বিষাক্ত যন্ত্রণা ভোগ করার বদৌলতে যদি চারটি জীবন সুখে থাকে ক্ষতি কি! মাথাটা ভারী ভারী লাগছে উমার। অতিরিক্ত সময় পানির ভেতর থাকার কারণে চোখজোড়াও লাল হয়ে এসেছে। উপরন্তু অক্টোবর মাস, সাতক্ষীরার দিকে এই সময় ঠান্ডা বাতাস বয়। উমা কোনো ভারী কাপড় ও আনে নি সাথে। সেই তো সুতির শাড়ি। তা কি আর এই শীতল হাড়কাপানো হাওয়াকে সামলাতে পারে! রাত ঘন হবার সাথে সাথে ঠান্ডার প্রকোপ বাড়ছে। সাথে মাথাব্যথাটাও। তীক্ষ্ণ সূচলো ব্যাথার সাথে শরীরের উত্তাপটাও বাড়ে। এক পর্যায়ে অচেতন হয়ে পড়ে উমা। প্রাতঃকালে হাটাহাটির স্বভাবটা শাশ্বতের বেশ পুরোনো স্বভাব। অভিনব সিংহের এই ছাঁদটা তার অতি পছন্দের। সকাল সকাল খালিপায়ে ভেজা ছাঁদে হাটতে বেশ ভালো লাগে তার। মস্তিষ্ক গভীরভাবে চিন্তা করতে সাহায্য করে। যেমন এখন তার চিন্তা রুদ্রকে কেন্দ্র করে, যে মামা সকাল অবধি ছেলের চিন্তা করছিলো সেই মামা দুপুরে কেনো এতো চিন্তামুক্ত হয়ে পড়লেন। আর শহরেই বা ছুটলেন কেনো? চিন্তার মাঝেই একজোড়া পা নজরে পড়লো শাশ্বতের। পা জোড়া দেখতেই সে ছুটে গেলো সেখানে; সেখানে গিয়ে চোখজোড়া বিস্ফোরিত হবার যোগাড়। উমা অচেতন অবস্থায় লুটিয়ে আছে মাটিতে। তাকে ডাকতে গিয়ে খেয়াল করলো মেয়েটির প্রচন্ড জ্বর। মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে আছে, ঠোঁটজোড়া শুকনো। উমার প্রতি যতটা না দয়া হলো শাশ্বতের দ্বিগুন রাগ হলো রুদ্রের উপর। বেশ কিছুবার ডাকার পরও যখন সাড়া মিললো না তখন উপায়ন্তর না পেয়ে উমাকে কোলে করে নিচে নেমে গেলো শাশ্বত। শাশ্বতের কিছুক্ষণ পূর্বের সূঁচালো কথাগুলো যেনো আরোও রাগ বাড়িয়ে দিলো রুদ্রের। ক্রোধে অন্ধ রুদ্র শাশ্বতের কলার চেপে ধরলো, তীব্র স্বরে বললো,
“আমার কি তোর জ্ঞান শুনতে হবে? কে তুই? ছোটলোক একটা! খাস তো আমার বাপের টাই। আবার জ্ঞান দিচ্ছোস? আমার বউ, আমার সম্পত্তি। আমি যা ইচ্ছা করবো, তুই বলার কে?”
রুদ্রের রাগ সম্পর্কে বেশ ভালো করেই অবগত মালিনী। ছুটে এসে তাকে বারংবার থামার জন্য বলতে লাগলেন,
“বাবা, ছেড়ে দাও শাশ্বতকে। ও সেভাবে বলে নি।”
কিন্তু শাশ্বত দমে যাবার পাত্র নয়। তীর্যক দৃষ্টিতে চোখে চোখ রেখে কড়া কন্ঠে বললো,
“অর্ধাঙ্গিনী কখনো সম্পত্তি হয় না, হয় সম্পদ৷ রবীঠাকুরের গল্পের এই বাক্যটির মর্মার্থ বোঝার ক্ষমতা তোর নেই। বলেও লাভ নেই। বিদ্যে গিললেই বিজ্ঞ হওয়া যায় না। সেটাকে অনুধাবন করতে হয়। যাক গে, রহিম ডাক্তারকে ডাক। অন্তত ঔষধ দেক মেয়েটাকে।”
অন্যায় শাশ্বতের একেবারেই সহ্য হয় না। তাই রুদ্রের মতো মানুষকে একেবারেই ভয় পায় না সে। শক্ত হস্তে রুদ্রের হাতজোড়া কলার থেকে ছাড়িয়ে নেয় সে। ঘর ছাড়ার আগে একটা কথাই বলে শাশ্বত,
“মানুষ হ রুদ্র। মানুষ হতে পয়সা লাগে না।”
মালিনী দেবী ছোটেন পুত্রের পিছুপিছু। লক্ষী দেবী মুখ বাকিয়ে তীক্ষ্ণ স্বরে বলেন,
“বেলা গড়ালেই জ্বর সেরে যাবে। এই ঘরে এই প্রথম তো কারোর জ্বর বাধলো না। এতো আদিক্ষেতার কোনো প্রয়োজন আমি বোধ করছি না রুদ্র”
মায়ের কথার মর্মার্থ বুঝতে কষ্ট হলো না রুদ্রের। সত্যি ই তো, মায়ের ও জ্বর হয়। কই বাবা তো একটি বার ও ডাক্তার বদ্যি আনেন না। তিনি মাকে সেভাবেই ছেড়ে দেন। তাহলে উমার এতোকিছু লাগবে কেনো? একেই শাশ্বতের উপর ক্রোধ এখনো শান্ত হয় নি তার। সেকারণে উমার নিথর শরীরটার দিকে একটি বার চাইতেও মন চাইলো না তার। রুদ্র এক মূহুর্ত অপেক্ষা না করে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। লক্ষী দেবী একটিবার উমার দিকে তাকিয়ে ফুলির মাকে বললেন,
“দেখো, মহারানী কি সত্যই মূর্ছা গেছে! নাকি ঢং করছে!”
বলেই ঘর থেকে প্রস্থান করলেন তিনি। ফুলির মায়ের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি। ঘরের কুকুরের সাথেও এর চেয়ে ভালো আচারণ করা হয়। অথচ উমা একজন জ্বলজ্যান্ত মানুষ। ফুলির মা উমার কাছে গিয়ে বসে, কপালে হাত ছোঁয়ায়। জ্বরের তাপে কপাল পুড়ছে। উজ্জ্বল মুখখানা তার ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। চুলগুলো এখনো ভেজা। চোখজোড়া গর্তে চলে গেছে এক দিবসেই। ফুলির মা ব্যাঙ্গাত্বক স্বরে বলেন,
“এ তো কেবল শুরু রে মাইয়্যা। এই বাড়িতে কতো কিছু দেখতে হবে রে! এখনই মূর্ছা গেলে চলবে?”
৫.
শাশ্বত শহরের জন্য প্রস্থান করেছে। মালিনী দেবী যেনো হাফ ছেড়ে বেঁচেছেন। এখানে থাকলে একটা না একটা ঝামেলা বাধতোই রুদ্রের সাথে। আর নিজের ছেলের উমার প্রতি এতো সংবেদনা একেবারের পছন্দ হচ্ছিলো না তার। উমার শরীরটা আগের চেয়ে কিঞ্চিত ভালো, জ্বর সারলেও কাশিটা যায় নি। তবে সেদিনের ঝাল তাকে বয়ে চলতে হচ্ছে। উঠতে বসতে খোটা শুনতে হচ্ছে তার। যতই হোক পরপুরুষের কোলে চড়ে ঘরে আসার জন্য কথা শুনতেই হবে। রুদ্রের ক্রোধও কমে নি, শাশ্বতের ক্রোধ সে উমার উপর মিটায়। গত দশ বারো দিনে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে সে। এখন আর নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে না। জড়ো বস্তুর ন্যায় বিচরণ করে সে এই চেয়ারম্যান বাড়িতে। এটাই তার নিয়তি, যতদ্রুত মেনে নিবে ততই মঙ্গল।
রাত ৯টা,
নিজের ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে উমা। আজকাল ভাইবোনের কথা খুব মনে পড়ে তার। কত দিন কেটে গেছে কারোর সাথে মন খুলে কথা বলে হয় না। সখীরাও কেউ তার সাথে দেখা করতে আসে না। রুদ্রের কড়া নির্দেশ সেদিনের শাস্তি স্বরুপ উমা এই বাড়ির বাহিরে যাবে না। তাই তো দ্বিরাগমনেও যাওয়া হয় নি তার। উমা কোনো কালে প্রতিবাদী ছিলো না, ছিলো একজন ভীতু নারী। তাই তো এবারেও সে প্রতিবাদ করলো না। মাথা নিচু করে মেনে নিলো তার শাস্তি। কিন্তু মানুষ তো, অনুভুতি গুলো এখনো সচল। আজ মনটা বারেবারে হু হু করে উঠছে, ছটফট করছে এক চিলতে মুক্তির জন্য। বুকজুড়ে হাহাকার শুরু হয়েছে। চোখের কোনায় নোনাজলের ভিড় জমেছে শুধু একটু মুক্তির জন্য। কষ্ট চেপে রাখা কি এতোটা সহজ! এর মাঝেই কাঠের জং ধরা দরজাটি ঠেলে ঘরে আসে রুদ্র। রুদ্রের আগমনের আভাষ পেতেই ঘরে যায় উমা। ঘরে প্রবেশ করতেই যা দেখলো তাতে গা শিউরে উঠলো উমার। রুদ্র যেনো রক্তস্নান করে এসেছে………
চলবে
[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। পরবর্তী পর্ব ইনশাআল্লাহ আজ রাতে দিবো।]