একটি বৃষ্টির রাত – ১
_____________________
‘বৃষ্টি পছন্দ অনেক ?’
ভদ্রলোকের হঠাৎ প্রশ্নে খানিক চমকে উঠলো খুশবু । বৃষ্টি আবার কার না পছন্দ ? আকাশপথ পারি দিয়ে জমিন ঘেষে যায় যে জল , তাকে পছন্দ না করে থাকা যায় নাকি ? অদ্ভুত! কিন্তু এখন ভদ্রলোককে জবাব দিবে কী দিবেনা, সেই বিষয়ে দ্বিধাজড়িত অবস্থার সম্মুখীন হয়ে পড়লো। আঁড়চোখে লোকটাকে মাথা থেকে পা অবদি দেখে নিলো। হুম, ভদ্রসমাজের ভদ্র নাগরিক মনে হচ্ছে। তবুও একটা কথা আছে না , উপর দিয়ে ফিটফাট নিচ দিয়ে সদরঘাট। মনে যদি লোকের ভেজাল থাকে ? চেহারা আর পোষক দিয়ে কী আজকাল মানুষ চেনা যায় নাকি ? তারপরও যেহেতু তার পছন্দের বৃষ্টি নিয়ে প্রসঙ্গ উঠেছে, জবাব না দিয়ে আর থাকা যাবে না৷ ভেবেচিন্তে ইতস্তত অনুভূতি নিয়ে জবাব দিলো,
‘বৃষ্টি কার না পছন্দ?’
‘আমার পছন্দ নয়।’
খুশবু ভীষন অবাক হলো যেমন ,
‘কেনো ?’
‘বাহ রে! এইযে আটকে রেখেছে স্টেশনের সামনে। না পেয়েছি বাস, আর না পেয়েছি সিএনজি । রাত ঘনিয়ে এসেছে, মিস। বাড়ি যেতে হবে তো। সারারাত তো আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়৷ ‘
মনের ভেতরকার ভয় খানিকটা কমে আসলো খুশবুর।ভদ্রলোক বেশ মিষ্টি কথা জানে তো। কীভাবে কথার জালে ফেলে জবাব আদায় করে নিলো । সাথে তার ভয়টাও অনেকাংশে কমিয়ে দিতে সাহায্য করলো। একটা স্বস্তির নিশ্বাস নিয়ে সে স্টেশনের আশেপাশে আবারও নজর রাখল৷ এই একটি মাত্র দোকান খোলা। আর এখানটাই জোড়াল অবস্থায় চার-পাঁচজন পুরুষ রয়েছে। আর তাদের লোভাতুর কুদৃষ্টি খুশবুর পানে কখন থেকে৷ বারবার তার শরীরে আপ-ডাউন করছে একেকজনের নজর৷ ব্যাপারটা বেশ নার্ভাস করে তুলছে তাকে। তুমুল বৃষ্টির মধ্যেই যে হাঁটা ধরবে তার উপায় ও নেই।কারণ পরনে শাড়ী। তাও আবার জর্জটের। এই শাড়ী পরে কী বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া সম্ভব ? উঁহু, অসম্ভব । দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া উপায় না পাওয়া খুশবুর দিক তাকিয়ে , সাথে দাঁড়ানো ভদ্রলোক হেসে বলল৷
‘একটি সাজেশন দিব মিস ?’
‘হু ?’
‘আপনি এদিকটায় আসুন। আমি ওখানটায় দাঁড়াই। ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড!’
প্রখর বৃষ্টির মাঝে দোটানায় ভুগতে থাকা সে , ভদ্রলোকের জায়গায় দাঁড়ালো। আর ভদ্রলোক তার জায়গায়। এবার সেই কুদৃষ্টি গুলো আর তার নাগাল পাচ্ছে না। একটু সন্তুষ্ট অনুভব করে সে বলল,
‘ধন্যবাদ মিষ্টার।’
ভদ্রলোক শব্দ করে হাসলো ,
‘ মিষ্টার, বিভোর আহমেদ।’
ভদ্রলোক নিজের নাম বলল। ভদ্রতার খাতিরে তারও তো নিজের নাম বলা দরকার তাই না ? বলবে কী ? বললেই বা কী হবে ? খুশবুর দ্বিধাগ্রস্ত মুখমণ্ডল দেখে তার নারাজি বিভোর বুঝে ফেললো যেমন ,
‘আমি নিজের নাম বলেছি বলে আপনার নামও যে বলতেই হবে তার কোনো কারণ নেই কিন্তু।’
‘ তাহমিনা হোসেন খুশবু।’
‘খুশবু। বেশ সুন্দর নাম। ‘
‘ ধন্যবাদ৷ ‘
বিভোর হাত ঘড়িতে চোখ বোলালো। ঘড়িতে সময় এগারো পঁয়তাল্লিশ। অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে । আর খুব সম্ভবত, আজ বৃষ্টি থামবে বলে মনে হচ্ছে না। ভিজে যে চলে যাবে সেই বিবেকও তার নেই। সামনে একটি মেয়ে এতরাতে একা দাঁড়িয়ে আর সে চলে যাবে? বিবেকহীন হবে ব্যাপারটা।
‘এগারোটা পঁয়তাল্লিশ বাজছে। আপাতত বৃষ্টি থামবে বলে মনে হয়না।’
চোখমুখে চিন্তার ছাপ চলে এলো খুশবুরও। ঠিক কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। সকলে বাড়িতে নিশ্চয়ই চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে আছে। একটা কল করবে যে, সেই উপায় ও নেই কারণ ফোনে চার্জ নেই। আনচান মন নিয়ে সে ভয় পেতে শুরু করলো। এই ভদ্রলোক চলে গেলে তার কী পরিণতি হতে পারে ভাবতেই শরীর শিউরে উঠছে। আপাতত একদম সেইফটি নেই এখানে বিভোর ছাড়া। আনমনে বলল,
‘আমার পরিবার ভিষণ টেনশন করছে হয়তো।’
‘একটা ফোনকল করে জানিয়ে দিন।’
‘ফোন বন্ধ হয়ে আছে। চার্জ নেই।’
‘আমারটা ব্যবহার করতে পারেন , ইফ ইউ ওয়ান্ট।’
একটু সংকোচ হচ্ছে তার। তবুও পরিস্থিতির শিকার হয়ে বিভোরের সেলফোন নিলো। ছোট ‘ ধন্যবাদ ‘ জানিয়ে বাড়িতে কল লাগালো। হয়তো তার মা ফিরোজা বেগম ফোন হাতে নিয়ে বসেছিলেন। মিনিটে কল রিসিভ হলো ,
‘ ঠিক আছিস তো আম্মা ? কোথায় তুই ? কখন থেকে কল দিয়ে যাচ্ছি।’
‘ফোনে চার্জ নেই মা। এইতো স্টেশনের সামনে দাঁড়িয়ে। আশেপাশে গাড়ি দেখছি না কোনো। তার ওপর বৃষ্টি। বৃষ্টি খানিকটা কমলেই ফিরবো। চিন্তা করোনা।’
‘তুই দাঁড়া । তোর বাবা আসছে নিতে তোকে।’
‘পাগল হলে নাকি। ঘন্টা খানেকের রাস্তা। বাবাকে বেরোতে না করে দাও। বরং আমার জন্য খিচুড়ি পাকাতে পারো। ওয়েদার ডিমান্ড , আর আমারো।’
পরপর তার বাবা আশরাফুল আলমের অশান্ত এবং গম্ভীর কন্ঠের স্বর শোনা গেলো,
‘রাত কয়টা বাজে? এই বন্ধুর পার্টি জয়েন করার ধরন ? বাবার অবাধ্যতা করে চলে গেলে। এখন কোথায় ?’
‘ স্টেশনের সামনে। ‘
‘এতরাতে এই প্রখর বৃষ্টির মধ্যে কতটা ভয়ংকর ওখানটা জানো ? সাবধানে থাকো আমি আসছি।’
‘ বাবা তুমি আসতে আসতে অনেক দেরি হবে। আমি বেরোচ্ছি। রাখি এটা অন্যের ফোন।’
আশরাফুল সাহেবকে পাল্টা কথা বলবার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দিলো৷ বিভোরের ফোন ফেরত দিয়ে সে লক্ষ্য করলো বৃষ্টি কমছে না বরং বাড়ছে। হঠাৎ ওখানকার কটুদৃষ্টি নিক্ষেপ করা পেটুলোক সামনে চলে এলো বিভোরকে ডেঙিয়ে। খুশবুর মাথা থেকে পা অবদি চোখ বোলাতে গিয়ে বিশ্রী ভঙ্গিমা নিয়ে বলল,
‘কই যাবা ? আমার গাড়ি আছে। আহো না দিয়া আহি।’
খুশবুর চোখ জোড়া কপালে উঠে এলো। চমকে বিভোরের দিক ঠেলে আসলো। এক অস্বাভাবিক ভয়ে তার শরীর কেঁপে উঠলো৷ বিভোরের সুন্দর ভ্রু জোড়া তখন কুঞ্চন হয়ে আছে,
‘আপনাকে কী সে বলেছে সাহায্য লাগবে ?’
সাবলীল ভঙ্গিতে পেটুলোক বিভোরকে একবার দেখে আবারো খুশবুর দিক নজর রাখলো।
‘ ওয় ছাইড়া দিব ভাবছো ? না খাইয়া ছাড়বো না। কথায় আছে না ? উপর দিয়া ফিটফাট নিচে দিয়া সদরঘাট। দেখা যাইবো , খাইয়া আবার বন্ধুদের কাছে দিব। এর তে ভালো আমার লগে আহো। আমি একাই….’
বিভোর মুহূর্তে কাঁপতে থাকা খুশবুর সামনে চলে এলো।মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচু করে ধরল লোকটার সামনে।
‘গেট লস্ট !! নাহলে নারী নির্যাতন কেশ দিয়ে সারাজীবনের জন্য জেলে ভোরে আসবো। থার্ডক্লাশ!’
খুশবু দুহাত পেঁচিয়ে নিজেকে আঁকড়ে ধরে আছে। বাবার কথা না মেনে এসে বিরাট ভুল করে বসেছে , তা অনুমান করছে। মনের মধ্যে বড় আশংকা জন্মেছে যদি তার সাথে কিছু একটা হয়ে যায়? আর এক টিসেকেন্ড ও এখানে দাঁড়ানোর সাহস বা শক্তি কিছুই পাচ্ছেনা। এদিকে , বিভোরের রাগ এখনো সপ্তমে উঠে। হিংশ্র বাঘের ন্যায়ে পেটুলোকের দিক দৃষ্টি ছুড়ে , খুশবুর দিক ফিরলো। নিজের শরীরের কোর্ট খুলে তার সামনে ধরলো,
‘বিশ্বাস করবেন আমায় ? ঠকবেন না উপর আল্লাহ্র কসম। এটা পরে নিন। বৃষ্টির মাঝেই চলুন। এখানে থাকাটা আপনার জন্য সেইফ নয়।’
বিভোরের দৃঢ় কন্ঠের একেকটি শব্দ খুশবুর কানে বাজতে লাগলো। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করলো সামনের অজানা লোকটিকে। ভয়ের রেশ ছেড়ে বিভোরের বাড়িয়ে ধরা কোর্ট পরে নিলো। এই লোভহীন দৃষ্টি কখনওই খারাপ লোকের হতে পারেনা। বাজে চিন্তাভাবনা সরিয়ে মনকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। এদিকে বিভোর ততক্ষণে চার-পাঁচ পলিথিন সঞ্চয় করে নিজের হাত ঘড়ি , মানিব্যাগ , সেলফোন গুঁছিয়ে নিয়েছে। খুশবু সংকোচ কন্ঠে বলল,
‘আমার ব্যাগে রাখতে পারেন। ‘
বিভোরের কোনো দ্বিধা নেই। সে সহজসরল ভঙ্গিতে এগিয়ে দিলো। তারপর এক সেকেন্ড ও অপেক্ষা করেনি দুজন। প্রখর বৃষ্টির মধ্যেই হাঁটা ধরলো। এবং চপচপে ভিজে গেলো মুহূর্তেই। পেছন থেকে কুৎসিত হাসাহাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। কিন্তু তাদের দ্রুত পায়ের গতিতে, ধীরেসুস্থে হাসির শব্দ বিলীন হয়ে আসছে।
চলবে–
নাবিলা ইষ্ক!