একটুখানি ভালোবাসা পর্ব -০৮+৯

#একটুখানি_ভালোবাসা
#পর্ব_৮
#লেখনীতে_মুগ্ধ_ইসলাম_স্পর্শ
লোকটা যখন আমার গলা বরাবর ছুরি চালিয়ে দিল সঙ্গে সঙ্গেই মাথা নিচু করে নিলাম। আশ্চর্য! ওরা আমাকে মারতে চাইছে কেন? লোকটা পুনরায় আমাকে আক্রমন করতে আসছে। নাহ, একে না থামালে তো হবে না। তাই সে আবারো ছুরি চালানোর আগেই তার হাত ধরে আমি হাত মুঠো করে তার কপাল বরাবর একটা ঘুষি মেরে দিলাম।
আবারও একজন এগিয়ে আসছে হাতে লাঠি নিয়ে। আমি চিৎকার করে বললাম, ‘- আরে থামুন! মারতে কেনো চাইছেন আমায়? আমি এখানে মারামারি করতে আসিনি। অকারণে কেনো আমাকে মারতে চাইছেন আপনারা?
একজন দাড়িওয়ালা মুরুব্বি লোক আমার সামনে এসে দাঁড়ালো।
সবাইকে থামিয়ে দিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘- তুমি জমিদার বাড়ির ছেলে না?
আমি শুধু মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলাম।
‘- ঠিক এই কারণেই আমার লোকেরা তোমাকে মারতে চাইছিলো। কিন্তু আমি তোমার পরিবারের লোকজনদের মত এতটাও নির্দয় না। বলো! কি বলতে এসেছ তুমি?
‘- আমার পরিবারের লোকজনেরা নির্দয় মানে? আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন?
‘- বলছি এটাই যে, আজ যেমন আমার লোকজনেরা তোমাকে মারতে চাইছিলো ঠিক এভাবেই কয়েকদিন আগে আমার ছেলেটাকে মেরে রক্তাক্ত করে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিল তোমার বাড়ির লোকজনেরা। অপরাধ ছিল এটাই, যে আমার ছেলে তাদের বাড়ির মেয়েকে ভালোবেসেছিল। সেই ভালোবাসার ফলস্বরূপ আজ আমার ছেলেটা বিছানায় পড়ে রয়েছে।
‘- আঙ্কেল আপনার ছেলের সাথে আমার পরিবার যে অন্যায়টা করেছে তার জন্য আমি খুবই দুঃখিত। তবে আমি চাই আমার বোনের সাথে আপনার ছেলের বিয়ে দিতে।
‘- না বাবা! আমি চাইনা আমার ছেলে নতুন করে আবার কোনে বিপদের মুখে পড়ুক। তুমি বরং ফিরে যাও।
আমি আঙ্কেলের হাত ধরে শীতল কণ্ঠে বললাম,
‘- দেখুন আঙ্কেল আপনার ছেলে আমার বোনকে যতটা ভালোবাসে ঠিক ততটাই ভালো কিন্তু আমার বোনও আপনার ছেলেকে বাসে। আর দেখুন না! আপনার হবু বউ’মা আপনার ছেলের জন্য কান্নাকাটি করে কেমন বাড়ি মাথায় তুলছে।
‘- কিন্তু তোমার পরিবারের লোকজন তো আমার ছেলেকে পছন্দ করে না। আর তারা ওর সাথে বিয়ে দিতেও রাজি নয়। আমি গিয়েছিলাম একবার বিয়ের কথা বলতে। কিন্তু তোমার বড় মামা আমাকে যা নয় তাই বলে অপমান করে তাড়িয়ে দেয়। এরপরও তোমার মনে হয় আমার ছেলের সাথে ওই বাড়ির মেয়ের বিয়ে দেওয়া উচিৎ?
‘- আপনি আমার উপর বিশ্বাস রাখুন। আমার উপর কথা বলার মতো সাহস এখনো কারো হয়নি আমার পরিবারের মধ্যে। আর মামাকে বুঝানোর দায়িত্ব আমার। আর সে যদি না-ও বুঝে তাহলে আমি আমার বোনকে বিয়ে দেবো আপনার ছেলের সাথে। আপনার ছেলে কোথায়?
‘- ও ভিতরে আছে।
আমি কোনো কথা না বলে সোজা বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করি। ছেলেকে বললাম আমার সাথে চলতে। সে প্রশ্ন করে,
‘- আপনি কে?
‘- আমি মিথিলার বড় ভাই।
সঙ্গে সঙ্গে সে দাঁড়িয়ে সালাম দিল। সালামের জবাব দিয়ে বলি,
‘- মিথিলার সঙ্গে তোমার বিয়ে দেবো চলো।
সে তার বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো।
‘- ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তুমি চলো আমার সাথে।
ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে আসছিলাম।
ওর বাবা পিছন থেকে বলে,
‘- আরে ওকে এভাবে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?
‘- আপনারাও আসুন আমার সাথে।
সবাইকে নিয়ে আমি আমাদের বাড়িতে এলাম।
বাড়িতে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই কতগুলো নতুন মুখ দেখতে পেলাম। মনে হয় ছেলেপক্ষের লোকেরা চলে এসেছে।
সবার সামনে গিয়ে মিথিলাকে ডাকলাম। মিথিলা নানুর ঘর থেকে একপ্রকার ছুটে এলো। প্রহর’কে দেখে মিথিলার মলিন হয়ে যাওয়া মুখটা হাস্যজ্বল হয়ে ওঠে।
প্রহর আর মিথিলাকে একসাথে দাঁড় করিয়ে দিলাম।
এবার ছেলেপক্ষের লোকদের বললাম,
‘- দেখুন তো ওদের মানিয়েছে কি-না?
মামা রেগে গিয়ে বলল,
‘- গুড্ড এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।
‘- বাড়াবাড়ি কে করছে সেটা নাহয় তুমি নিজেকেই জিজ্ঞেস করো।
ছেলেপক্ষকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
‘- দেখুন আঙ্কেল ওরা একে-অপরকে ভালোবাসে। মিথিলা কোনোমতেই এই বিয়েতে রাজি নয়। আর বিয়ের পরে আমার একমাত্র ছোট বোন নিজের জীবন কষ্টে কাটাবে এটা আমি একদমই মেনে নেবো না। আপনারা অতিথি। এসেছেন যখন, তখন দু’টো ডালভাত হলেও খেয়ে যাবেন।
ছেলের বাবা উঠে দাঁড়িয়ে মামাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘- এভাবে ডেকে অপমান না করলেও পারতে। আমিও দেখবো এবারের ইলেকশনে তুমি কিভাবে মাঠে লড়াই করো আমাকে ছাড়া।
এই বলে তিনি সবাইকে নিয়ে চলে গেলো।
এবার বুঝতে পারলাম মামার স্বার্থ ঠিক কোথায়।
মামা আর সেখানে না থেকে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।
‘- মামা?
আমার ডাক শুনে দাঁড়িয়ে গেলো।
‘- আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই।
‘- আমি তোর কোনো কথা শুনতে চাই না। আমি গুটিগুটি পায়ে মামার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
‘- যত জ্ঞানী ব্যক্তিই হোক না কেনো! রেগে গেলে বেশিরভাগ সময়ই তারা কোনটা ভুল আর কোনটা সঠিক তা ভুলে যায়। একটু স্থীর হয়ে বসুন। কয়েকটা কথা বলব। তারপর যদি আপনার মনে ইচ্ছে জাগে যে আপনার এই বেয়াদব ভাগ্নেটাকে মারবেন। তাহলে তাই করবেন নাহয়।
মামা আর কিছু না বলে সোফায় গিয়ে বসে।
‘- আপনি তো একজন বাবা? তাহলে কী করে পারেন নিজের সেই কোলেপিঠে করে মানুষ করা মেয়েটির সাথে এতবড় অন্যায়? ধরেও নিলাম আপনি মিথিলার সুখের কথা ভেবে বেশ ভালো ঘরেই ওর বিয়ে দিচ্ছেন। মানলাম ছেলেটাও অনেক ভালো। মামা মিথিলা সেখানে সুখী হতো। তবে যদি সে প্রহরের সঙ্গে সম্পর্কে না জড়াতো। ওরা দুজন দু’জনকে অনেকটাই ভালোবাসে। কী করে পারবে তারা আলাদা হয়ে সুখে থাকতে? মিথিলা এটা ধরেই নিয়েছে সে প্রহরের কাছে সুখী হবে। তারা দু’জন দু’জনকে নিয়ে ভালো থাকবে। মা বাবারা কী চায়? তার সন্তানের সুখ। আর যদি ওই ছেলের সঙ্গে বিয়েও দেন। তাহলে মিথিলার মন সবসময়ই প্রহরের অভাব অনুভব করবে।
যেখানে আপনার মেয়েটা নিজের ভালো থাকার জায়গা খুঁজে নিয়েছে সেখানে তাকে বিয়ে দিতে আপনার আপত্তি কেনো?
আর বাকি রইলো ইলেকশন। আপনি সাধারণ মানুষদের পাশে থাকুন সবসময়। তাদের বিপদের সময় এগিয়ে আসুন। তাহলেই দেখবেন আপনার মাথার উপরে কোনো বড় মাপের মানুষের ছায়ার প্রয়োজন হবে না। বরং ছায়া হয়ে দাঁড়াবে সেই গরীব দুঃখী মানুষগুলো। যাদের পাশে একসময় আপনি দাঁড়িয়েছেন। সৎ পথে থেকে সত্যের সঙ্গ নিয়ে লড়াই করুন।
আমি আর কিছু বলব তার আগেই মামা বলে ওঠে,
‘- কিন্তু আমি তার পিছনে অনেক টাকা ঢেলেছি। তুমি কী বুঝতে টাকা আর ক্ষমতার মূল্য। তুই এটাই বুঝতে পারিস নি যে, এই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সত্যি না হয়ে থাকে অন্তরাত্মা, না আদর্শ। বরং সবথেকে বড় সত্যি হলো টাকা আর ক্ষমতা। চোখের সামনে দিয়ে বড় বড় লোকেরা পুরো সমাজ কিনে নিয়ে যায়। তুই তোর আদর্শের পতাকা নাড়াতে থাকবি আর ক্ষমতাধর লোকেরা সবার সামনে টাকা ও ক্ষমতা দিয়ে পুরো সমাজকে কিনে নিয়ে যাবে। তুই কিচ্ছু করতে পারবি না। এবার তো বুঝ টাকার মূল্য।
আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠি,
‘- আচ্ছা? কীরকম মূল্য? লক্ষ-কোটি মানুষের কাছ থেকে লক্ষ-কোটি টাকা পাওয়া যায়। কিন্তু সত্য আর সততা পাওয়া যায় ক’টা মানুষের মাঝে? যে বস্তুটা সত্যি ও সততা দিয়ে পাওয়া যায় সেটা টাকা দিয়ে কেনা যায় না। ন্যায় দণ্ডের সাহায্যে যদি মাপা যায়,তাহলে সত্য ও সততার ওজন টাকার থেকে অনেক বেশি। আপনি একটা গরীবের মুখে দু’মুঠো খাবার তুলে দিন। দেখবেন সে সারাজীবন আপনার কথা মনে রাখবে। আপনার জন্য তার মনে মায়া, ভালোবাসা তৈরি হবে। কখনো পারবেন কারো মনে টাকা দিয়ে ভালোবাসা তৈরি করে নিতে?
এই লড়াই আপনি জিতবেন। আপনার টাকা আর ক্ষমতার জোরে নয়৷ সততার সাহায্যে। নিজের উপর ভরসা রাখুন। আপনি পারবেন। আমরা সবাই রয়েছি আপনার সাথে।
মামার আর সেই রাগী দৃষ্টিটা নেই। ভাবুক নয়নে তাকিয়ে রয়েছে মাটির দিকে। হয়তো বুঝতে পেরেছে নিজের ভুলটা।
এবার মামার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলাম। মামার হাতদুটো শক্ত করে ধরে বললাম,
‘- মা বাবা মরে যাওয়ার পর তোমরাই আমাকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছো। বিশেষ করে তোমার স্নেহ ভালোবাসা পেয়েছি সবচেয়ে বেশি। আর আজ সেই তোমার সাথেই আমি উচ্চস্বরে কথা বলেছি। কিন্তু আমি কী করব বলো? নিজের বোনটাকে হারানোর ব্যথা আজও আমার মনে আঘাত হানে। ওর কথা ভাববে বুকটা ছ্যাত করে ওঠে। বুড়ীটাকে হারানোর পর মিথিলাকে ওর আসনে বসিয়েছি। আর আজ সেই বোনের চোখের পানি আমি সহ্য করি কী করে মামা? তোমারও তো বোন হারিয়েছো? তোমার কী এতটুকুও কষ্ট হয় না নিজের ছোট্ট, কলিজার টুকরা একমাত্র বোনটার জন্য? মামা তোমার মনে পড়ে সেই দিনগুলোর কথা? একদিন সিড়ি থেকে পড়ে গিয়ে কিছুক্ষণের জন্য জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। আর তখন তুমি কতটা ব্যাকুল হয়ে ওকে কোলে নিয়ে ছুটেছিলে হাসপাতালে পথে! যখন ওর জ্ঞান ফের তখন সারারাত ওকে বুকে জড়িয়ে রেখেছিলে। একমুহূর্তের জন্যেও ওকে কোলছাড়া করোনি। মিথিলা খেতো না বলে যখন মামি ওকে মারতো। আর ওর চোখের পানি দেখে আপনি মামিকে কতশত বকে দিতেন। রেগে গিয়ে বলতেন,
‘- তুমি আমার মা’কে এভাবে মারো কেনো?
আর মামি আপনার ধমক শুনে ভয় পেয়ে যখন চলে যেতো তখন মিথিলা হাততালি দিয়ে খিলখিল করে হাসতো। আর ওর সেই ভুবন ভোলানো হাসি দেখে আপনার মনে বয়ে যেতো শান্তির ঢেউ। সেদিন যদি তার হাসির জন্য এতকিছু করতে পারতেন তাহলে আজ কেনো আপনার ধমকের সুরে মিথিলার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে মামা?
আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলেন না। আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অঝোর ধারায় ফেলতে লাগলেন চোখের পানি। বাড়ির সকলেই চোখের কার্নিশ ঘেঁষে বাসা বেঁধেছে অশ্রু। মামার অশ্রুজলে ভিজে গেছে শার্টের দু’দিক। আমি আবারও মামাকে বলি,
‘- তোমার যদি মনে হয় আমি ভুল করেছি। তাহলে যা শাস্তি দেবে আমি মাথা পেতে নেবো। শুধু আমার বোনটার সাথে অন্যায় কোরো না।
মামা আমার কপালে চুমু দিয়ে বলে,
‘- না বাবা তুই কোনো ভুল করিসনি। আমি চাকচিক্যের শহরে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। তুই আমাকে আমার ভুলটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিস।
মামার কানে কানে বললাম,
‘- তাহলে এবার যাও! গিয়ে নিজের মেয়ের চোখের পানি মুছে দাও। মেয়েটা তোমার উপর তার মনে এক আকাশ সমান অভিমান জমিয়ে রেখেছে।
মামা এবার আমাকে ছেড়ে দিয়ে মিথিলার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ওর দিকে দু’হাত বাড়িয়ে শুধু বলল, ‘- মা,,,
আর কিছু বলার আগেই মিথিলা ঝড়ের বেগে এসে মামার বুকে মাথা রেখে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে।
এদিকে বাড়ির সকলে এসে আমাকে এত্ত এত্ত আদর দিতে লাগলো।
অবশেষে মানঅভিমান সব শেষ হয়ে গেলো। সবার অগোচরে চোখ দুটো একজনকেই খুঁজছে। মাধবীলতা।
চারিদিকে চোখ বুলিয়ে দেখলাম মাধবীলতা এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখেও অশ্রু। সে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। ইশারা দিয়ে বুঝিয়ে দিলাম চোখের পানি মুছে নিতে আর মিষ্টি করে হাসি দিতে। মাধবীলতাও তাই করল। বড়ো চমৎকার লাগে দেখতে মাধবীলতার মিষ্টি মুখের সুমিষ্ট হাসিটা।
অবশেষে মামা প্রহরকে মেনে নিলো।
বিয়েও ঠিক হয়েছে। আমি বাড়ির বাইরে বাগানের পাশে এসে দাঁড়ালাম।
পিছন থেকে কাঁধে কেউ হাত রাখে।
প্রহরের বাবা।
‘- আঙ্কেল কিছু বলবেন?
‘- কিছু বলতে আসিনি বাবা। তবে একটা কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে।
‘- বলে ফেলুন। পেটের মধ্যে কথা চেপে রাখলে মনের অসুখ হয়।
‘- যেই মা তোমাকে জন্ম দিয়েছে তাকে নিয়ে আমার বেশ গর্ব হচ্ছে। তোমার মতো দৃঢ়বিশ্বাসী মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি। অকাট্য যুক্তি মানুষকে হার মানিয়ে দিতে বাধ্য। কতটা সুনিপুণ ভাবে বুঝালে তোমার মামাকে। বেঁচে থাকো বাবা।
তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন৷
আরও কিছুটা মুহূর্ত কাটিয়ে বাড়ির দিকে যাওয়ার জন্য ফিরতেই কারো সাথে ধাক্কা লাগে। মাধবীলতা।
‘- আরে আপনার লাগে নি তো?
সে মাথা নাড়িয়ে না সূচক উত্তর দেয়।
মাধবীলতা আমাকে একটা কাগজ দেয়,
‘- আপনাকে দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। শক্ত একটা পাথরকে কতটা নিপুণ কৌশলে গলিয়ে ফেললেন।
‘- ভালোবাসা, মায়া, স্নেহ এসব নিজের মাঝে দৃঢ় থাকলে সবকিছু জয় করা খুব কঠিন হয় না। দেখলেন, আমি যখন মামার সঙ্গে রেগে চিৎকার করে কথা বলছিলাম, তখন কিন্তু তিনিও অনেকটাই রেগে ছিলেন আমার উপর। আর যখন শীতল কণ্ঠে, ভালোবেসে তাকে বুঝালাম তখন ঠিকই বুঝলো আর বুকেও জড়িয়ে নিল। #একটুখানি_ভালোবাসা
#পর্ব_৯
#লেখনীতে_মুগ্ধ_ইসলাম_স্পর্শ
বেশ ধুমধাম করেই বিয়ে হয় প্রহর আর মিথিলার। বিয়েতে “তোমরা দেখো গো আসিয়া! কমলায় নৃত্য করে থমকিয়া থমকিয়া” গানের সঙ্গে মাধবীলতা এক অসাধারণ নৃত্য পরিবেশন করে। মাধবীলতা যে এত সুন্দর নাচতে পারে তা আমার জানা ছিল না। এক পলকে তাকিয়ে ছিলাম পুরোটা সময়। তাকালে যেন তাকিয়ে থাকতেই ইচ্ছে করে অনন্তকাল। আমাদের জীবনে মাঝে মাঝে এমন কিছু রোমাঞ্চকর মুহূর্ত আসে। তখন মন বলে ওঠে, ইশ এই মুহূর্তে যদি থমকে যেত জীবনটা। আমিও এই মুহূর্তটা অনুভব করেছি মাধবীলতা’কে দেখার পর। বুঝতে আর বাকি রইলো না যে আমি মাধবীলতার মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে দিন দিন। যেটা সুন্দরী রমণীরা করতে পারেনি সেটা আমাদের মাধবীলতা-ই করে দেখিয়েছে।
বিদায়ের সময় মিথিলার চোখে আর পানি দেখা যায়নি। কারণ সে যে আমায় কথা দিয়েছে আর কখনো চোখের পানি ফেলবে না। তবে প্রহর আমার হাত দুটো শক্ত করে ধরে বারবার বলছিল,
‘-ধন্যবাদ! এত কিছু করার জন্য। আজ আপনার জন্যই আমাদের সম্পর্কটা পূর্ণতা পেয়েছে।
‘- আরে পাগল এতে ধন্যবাদ দেওয়ার মতো কিছু হয়নি। শুধু বোনটার সুখের জন্য এতকিছু। আর হ্যাঁ যদি কখনো শুনেছি যে আমার বোন তোমার জন্য চোখের এক ফোঁটা পানি ফেলেছে তাহলে দেখে নিও তোমার অবস্থা কি হয়!
আমার কথা শুনে সেখানে উপস্থিত থাকা সবাই হেঁসে দেয়। মিথিলা আমাদের থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। এদিকে বাড়ির সবার চোখের কার্নিশে অশ্রু লেপ্টে রয়েছে। বাড়ির একমাত্র মেয়ে বলে কথা। বিশেষ করে মামি একটু বেশিই কাঁদছে।
মামির কাছে গিয়ে শান্তনা দিয়ে বলি,
‘- মামি এত কান্না করার কি হয়েছে বলো তো? এইতো কাছেই বাড়ি! তোমার যখন ইচ্ছে তখনই গিয়ে দেখে আসবে তোমার মেয়েকে। এখন সবাই ভিতরে যাও।
পরদিন সকালে নামাজ শেষে সকালের প্রকৃতি দেখতে বেরিয়ে পড়লাম মেঠোপথ ধরে। সারারাত শীতের আবরণে মেঠোপথের ঘাসগুলো প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। এসময়ে প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে খালি পায়ে হাঁটার মজাই আলাদা। কিছুটা পথ পেরিয়ে আসতেই সামনে পড়ল বিশাল এক খোলা মাঠ। এই মাঠ পেরোলেই দেখা মিলবে সেই চিরচেনা প্রাণবন্ত নদীর। যে নদীতে মিশে রয়েছে শৈশবের হারিয়ে যাওয়া হাজারো স্মৃতি।
দু’কদম এগোতেই কোথাও থেকে নূপুরের ধ্বনি ভেসে আসছে কানে। বেশ কৌতূহল জাগে মনে। এত সকালে কোথা থেকে আসবে কোনো নারী? কৌতূহল মেটাতে আশেপাশে তাকালাম। কিন্তু কাউকেই দেখতে পেলাম না। তাই আপন’মনে আবারও হাঁটা ধরলাম। কিছুটা এগোতেই নূপুরের ধ্বনি যেন আরো প্রখর হতে লাগলো। নুপুরের রিমঝিম ধ্বনি টা পিছন থেকে আসছে। একদম আমার পিছনে এসে শব্দটা বন্ধ হয়ে গেল। তৎক্ষণাৎ আমি পিছন ফিরে তাকাই। তাকিয়ে অনেকটাই অবাক হয়ে গেলাম। মাধবীলতা আমার পিছু নিয়ে আসছিল এতক্ষণ। অবাক নয়নে তাকিয়ে রইলাম মাধবীলতার মুখপানে। কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করলাম,
‘-আপনি? তাও আবার এত সকালে আমার পিছনে কী করছেন?
সে হাতের ইশারায় বুঝিয়ে দিল,
‘- আমিও আপনার সাথে হাঁটতে বেরিয়েছি।
‘- তাই বলে এভাবে কোনো সাড়াশব্দ ছাড়াই নিশ্বব্দে পিছনে আসে কেউ?
মাধবীলতা কিছু না বলে শুধু কান ধরলো।
মাধবীলতাকে নিয়ে আবারও হাঁটা শুরু করলাম। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছি আর কানে ভেসে আসছে মাধবীলতার পায়ের একযোগে বাজতে থাকা নুপুরের ধ্বনি।
‘- আপনি তো বেশ চমৎকার নৃত্য করতে পারেন!
‘- এই আরকি!
‘- আমি তো পুরোটা সময় নিষ্পলক দৃষ্টিতে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম।
‘- কেনো এতটা মুগ্ধ হয়ে তাকাতে হবে?
‘- বা’রে! সুন্দর কোনোকিছুর দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকা কী অস্বাভাবিক কিছু?
মাধবীলতা মাথা নাড়িয়ে না সূচক উত্তর দেয়।
‘- আপনি এতো সুন্দর নাচতে জানেন জানলে অনেক আগেই আবদার করে বসতাম নাচ চেখতে।
‘- উহহ, আমি কেনো আপনাকে নাচ দেখাবো।
‘- হুম সেই তো! আপনি কেনো আমাকে নাচ দেখাবেন? আচ্ছা চলুন সামনে এগোনো যাক তাহলে।
হঠাৎই মাধবীলতার মুখ দিয়ে অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এলো। আচমকা খোলা মাঠে বসে পড়ে।
‘- কী হলো এভাবে বসে পড়লেন কেনো?
মাধবীলতা কিছু বলছে না। লক্ষ্য করলাম মাধবীলতা পা চেপে ধরে আছে। রক্তও পরছে।
বিচলিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,
‘- এ’কি কীভাবে কেটে গেলো। কে বলেছে খালি পায়ে আসতে? যেটা পারেন না সেটা কেনো করেন বলুন তো? একটু দেখে তো হাঁটবেন নাকি?
মাধবীলতা পিছনে ইশারা করে দেখিয়ে দিল। ভাঙা কাঁচের টুকরো দিয়ে পা কেটে গেছে। আমি দ্রুতই পকেট থেকে রুমাল বের করে পায়ে বেঁধে দিলাম। মাধবীলতাকে ধরে দাঁড় করিয়ে দিলাম।
‘- আমাকে শক্ত করে ধরুন। বাড়িতে যাব। আর ঘুরে কাজ নেই।
মাধবীলতা জিদ ধরলো। সে বাড়ি যাবে না। এভাবেই নদীর তীরে যাবে।
শত চেষ্টা করেও লাভ হলো না৷ একটু ঝাঁজালো কণ্ঠে বললাম,
‘- মেয়েদের এতো জিদ কোথা থেকে আসে বুঝি না? আমাকে শক্ত ধরে হাঁটা শুরু করুন।
সে গাল ফুলিয়ে ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো৷
‘- কী হলো এভাবে আবার বসে পড়লেন কেনো?
মাধবীলতা নাক টেনে টেনে মিছেকান্না করতে লাগলো।
‘- আশ্চর্য! আপনি এভাবে কাঁদছেন কেনো?
মাধবীলতা ইশারা দিয়ে বলল,
‘- আমার পা কেটে গেছে আর আমি ঘুরতে চাইছি বলে আপনি আমাকে বকা দিলেন!
‘- ও’মা আমি আপনাকে কখন বকলাম? আচ্ছা বলছি তো চলুন।
‘- আমি হাঁটতে পারবো না।
নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম’- হাঁটতে না পারলে ঘুরবে কীভাবে? জাদুর জুতো আছে নাকি? উড়ে বেড়াবে!
‘- এই আপনার কী জাদুর জুতো আছে যেটাতে করে উড়ে বেড়ানো যায়।
‘- আপনার কী মাথা একেবারে গেছে? এমন গাট্টাগোট্টা শরীর কেনো বানিয়েছেন হ্যাঁ? একটা অসহায়, অবলা, নিষ্পাপ মেয়েকে এভাবে ফেলে রেখেছেন। লজ্জা করে না আপনার।
যাহ আমি আবার কী করলাম 😦😦?
আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। তারপর কোনোকিছু না ভেবেই মাধবীলতাকে কোলে তুলে নিলাম। আচমকা আমি এমন কাণ্ড ঘটিয়ে বসবো তা মাধবীলতার ভাবনার বাইরে। মাধবীলতা এক’হাত দিয়ে শক্ত করে আমার গলা জড়িয়ে ধরেছে। আমি আনমনে হাঁটছি। আর এদিকে মাধবীলতা একমনে তাকিয়ে রয়েছে আমার মুখের দিকে।
‘- এভাবে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকাবেন না। প্রেমে পড়ে যাবেন।
‘- প্রেমে পড়লে আমি পড়বো। তাতে আপনার কী হুহ?।
‘- বা’রে! আমার প্রেমে পড়বেন আর আমারই কিছু না বলছেন?
‘- না আপনার কিছু না। এবার চুপচাপ চলুন। খালি বেশি কথা বলেন আপনি।
এভাবেই সে তার ইশারায় কথা বলছে।
কিছুটা পথ হাঁটার পর নদীর তীরে এসে পৌঁছালাম। সামনেই দেখতে পেলাম সেই বড় গাছটি। যেটার মগডালে উঠে লাফ দিতাম নদীতে। সেই গাছের নিচে গিয়ে মাধবীলতাকে নামিয়ে দিলাম কোল থেকে।
‘- আচ্ছা শুনুন! আমার একটু ক্লান্তি লাগছে। গাছের নিচে বসে জিরিয়ে নিই?
মাধবীলতা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দেয়। ভেজা ঘাসের উপর বসে গাছের গায়ে হেলান দিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে নিলাম। নদীর উপরে বইসে মিষ্টি বাতাস। মনটা যেন ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। মাধবীলতাও আমার পাশেও বলে রইলো। জানি না কখন চোখদুটো লেগে এসেছে। ওভারে কতক্ষণ ছিলাম জানি না। তবে যখন ঘুম ভাঙে তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে চারিদিক সূর্যের মিষ্টি কিরণে চকচক করছে।
হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি প্রায় দুপুর হয়ে গেছে। শীতকাল হওয়ায় সূর্যের তাপ টা সেই আগের মতো আর প্রখর নেই। হঠাৎ বুকের মাঝে ভারি কিছু অনুভব করি।
চোখ দুটো নিচু করে চাইলাম। মাধবীলতা ছোট বাচ্চাদের মতো গুটিসুটি মেরে বুকে মুখ গুঁজে ঘুমিয়েছে। এদিকে ফুরফুরে বাতাসে মাধবীলতার লম্বা চুলগুলো দোল খাচ্ছে৷ আহ নয়ন জুড়ানো দৃশ্য। অপরদিকে আমার বুকটা ধুকপুক করে উঠছে। মনে হচ্ছে মনের ভিতর কেউ হাতুড়ি দিয়ে বারি মারছে। মাধবীলতার গরম নিঃশ্বাস আমার বুকে বারি ঘর্ষণ দিচ্ছে। মনের ভিতর এক অন্যরকম অনুভূতির সৃষ্টি হচ্ছে। মন আমাকে বলে উঠছে ‘- ইশ এভাবেই যদি কেটে যেত সময় টা।
কয়েকটা চুল বারবার মাধবীলতার মুখের উপর এসে বারি খাচ্ছে। আলতো করে চুলগুলোকে কানের নিচে গুঁজে দিলাম। আবারও তাকিয়ে রইলাম। এমন মায়াবী চেহারা। তাকালে শুধু তাকিয়ে থাকতেই ইচ্ছে করে। এবার কয়েকটা চুল আমার মুখের উপর এসে লাফালাফি শুরু করেছে। নাকের ডগায় এসে আটকে রয়েছে চুলগুলো। অদ্ভুত একটা ঘ্রাণ পাচ্ছি। (মেয়েদের চুল থেকে আসলেই অন্যরকম ঘ্রাণ পাওয়া যায়। যখন আপুর চুলে তেল দিয়ে দিই তখন একরকম ঘ্রাণ পাই, আবার আম্মুর চুলে তেল দিয়ে দিলে আরেকরকমের ঘ্রাণ আসে নাকে! এর কাহিনী কী?)
পকেট থেকে মুঠোফোনটি বের করে এই মূহূর্তটাকে মুঠোফোনে আবদ্ধ করে নিলাম। আমার হাতটা আপনাআপনি মাধবীলতার মাথার উপরে চলে যায়। মাধবীলতার মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছি আর প্রাণভরে প্রকৃতির পবিত্র বাতাসে শ্বাস নিচ্ছি। একটা সময় হঠাৎ মাধবীলতা নড়েচড়ে উঠলো। চোখ খুলে তাকালো। নিজেকে আমার বুকে আবিষ্কার করে অনেকটাই অবাক হয়। পরে তার মনে পড়লো সে তো নিজেই আমার বুকে শুয়েছিল। কিন্তু মাধবীলতা সেটা বুঝতে দিল না। মাধবীলতা একটু সরে বসে।
‘- আপনি আমায় ডাকেন নি কেনো?
সামান্য হেসে বললাম,
‘- ডেকে দিলে কী আর এতো সুন্দর একটা মুহূর্ত কাটাতে পারতাম?
‘- আপনি একটা অসভ্য ছেলে!
‘- নিজে আমার বুকে ঘুমোলে সমস্যা নাই। কিন্তু আমি ঘুমোতে দিলেই যত সমস্যা। এইজন্যই কারো উপকার করতে নেই।
মাধবীলতা একটা মুখ ভেংচি দিল।
‘- আচ্ছা এখন এটা বলুন যে আমার বুকে আপনার ঘুম কেমন হলো?
মাধবীলতা খুশিতে গদগদ হয়ে ওঠে, হাত দুটো মেলে দিয়ে বুঝিয়ে দিল,
‘- অনেক বেশি ভালো ঘুম হয়েছে। ইচ্ছে করছে আবার ঘুমাতে।
‘- উহুম। সেটা আর করা যাবে না। জানি না কেউ দেখে ফেলেছে কি-না। কপাল ভালো যে এইদিকে তেমন কেউ আসে না। এদিকে না আছে ফসলের মাঠ, আর না আসে জেলেরা মাছ ধরতে। এখন বাড়ি যেতে হবে। পায়ে কী এখনো ব্যথা করছে? হাঁটতে পারবেন?
মাধবীলতা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। অগত্যা মাধবীলতাকে পুনরায় কোলে তুলে নিলাম। কিছুটা পথ এগিয়ে মাধবীলতাকে বললাম,
‘- শুনুন? অনেকদিন হলো আমরা এখানে এসেছি। অনেক তো ঘুরলাম। এবার ফিরে যেতে হবে।
মাধবীলতা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল।
যাক কপাল ভালো রাস্তায় কেউ ছিল না। গ্রামাঞ্চল এরকমই হয়ে থাকে। ভরদুপুরে লোকজন একটু কমই থাকে। সবাই যের যার কাজে ব্যস্ত থাকে সবসময়।
বাড়ির সামনে এসে নামিয়ে দিলাম মাধবীলতাকে। তারপর শক্ত করে ধরে ভিতরে নিয়ে গেলাম। নিজ হাতে রক্ত পরিষ্কার করে দিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলাম। সবাই মাধবীলতার কাটা পা দেখে আমার উপরই রেগে গেছে। তাদের বক্তব্য, – তুই দেখে চলতে পারিস না। তোর চোখ-কান খোলা থাকলে কী এরকম হতো?
বুঝো ঠ্যালা। পা কাটলো কার? আর দেখেশুনে চলতে বলে কাকে😕?
আমি গেলাম গোসল করতে। এদিকে মাধবীলতা গোসল সেরে খাওয়ার টেবিলে এলো। সবাই একসঙ্গে খেয়ে নিলাম। আমি ঘরে গিয়ে শুয়ে রইলাম।
এদিকে মাধবীলতা যখন ঘরে যাবে তখন নানু ভাই মাধবীলতাকে পিছুডাক দেয়।
‘- একটু এদিকে আয় তো বুড়ী।
মাধবীলতা আস্তে আস্তে নানুর কাছে যায়।
‘- বড় বউমা? ওর মাথায় তেল দিয়ে দাও তো। দেখেছো কী অবস্থা করে রেখেছে নিজের চুলের। একদম উসকোখুসকো।
বড় মামি মাধবীলতাকে ডাক দেয়,
‘- এদিকে আয় মা। নিচে বসে পড় আমি সুন্দর করে তেল দিয়ে দিচ্ছি।
মাধবীলতাও বাধ্য মেয়ের মতো তাই করল। মেঝেতে বসে পড়ে। আর মামি সোফায় বসে মাধবীলতার মাথায় তেল দিতে থাকে।
‘- হ্যাঁ’রে মা! তোর তো এখনো বিয়েই হয়নি। আর এখুনি এতো অনিয়ম নিজের প্রতি! বিয়ের পরে কী করবি বল তো শুনি? কী অবস্থা করে রেখেছিস নিজের? মানুষ তো পাগলি ভাববে তোকে! গুড্ডু বাবা বলল তোরা নাকি কাল চলে যাবি। আমরা তো আর সেখানে থাকবো না। তাই এখনি বলে দিচ্ছি, সেখানে গিয়ে নিজের খেয়াল রাখিস, সময়মতো ঠিক করে খাবার খাবি কিন্তু। একদম নিজের প্রতি অনিয়ম চলবে না এই আমি বলে দিলাম। মনে থাকে যেন।
মাধবীলতা মামির কথা শুনে আবেগময় হয়ে ওঠে। এভাবেই তার মা তাকে শাসন করতো৷
মামির দিকে ঘুরে মামির গালদুটো টেনে দিয়ে ইশারা করে বলে,
‘- সব মনে থাকবে মিষ্টি মা।
সন্ধ্যায় ড্রয়িং রুমে বসে সবাই গল্প করছিলাম। সেই সময় মামা উঠে ছাদে গেলো এবং আমাকে ডাকলো। আমি দেরি না করে ছাদে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি দুই মামা-ই উপস্থিত রয়েছে।
‘- কী ব্যাপার মামা? হঠাৎ সবার সামনে থেকে এখানে নিয়ে এলে? কোনো সমস্যা হয়েছে?
‘- না বাবা কোনো সমস্যা হয়নি। আসলে আমি বলতে চাচ্ছি কী,,,!
‘- উফফ মামা আমার সামনে তোমার আবার কিসের ভনিতা বলো তো? ছেলেমেয়ের সামনে বাবারা ভয় পেয়ে কথা বলে কখনো? তুমি নিশ্চিন্তে বলে ফেলো কী বলবে!
বড় মামা ছোট মামাকে বলে,
‘- ছোট তুই বল তো।
ছোট মামা আমার সামনে এসে বলল,
‘- গুড্ডু! তোমরা দু’জন যখন সকালে বাইরে গেছিলে। তখন আমরা বাড়ির সকলে মিলে তোমাকে না বলে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।
‘- সিদ্ধান্ত? কিসের সিদ্ধান্ত?
‘- দেখো এটা বাবা মায়ের বুদ্ধি ছিল।
‘- কিন্তু আসল ঘটনা কী সেটা তো বলবে আমায়?
‘- মা বাবা ঠিক করেছে যে মাধবীলতা মায়ের সঙ্গে তোমার বিয়ে দিতে।
মামার কথা শুনে প্রচণ্ড অবাক হয়ে গেলাম।
‘- মাথা ঠিক আছে তোমাদের? এভাবে তোমরা কীভাবে বিয়ে ঠিক করতে পারো? বলা নেই কওয়া নেই হুট করে বলে দিলে বিয়ে দিতে চাও। ঠিক আছে মানলাম তোমাদের ইচ্ছে হয়েছে তোমাদের ছেলের বিয়ে দেবে। কিন্তু মাধবীলতার তো রাজি হতে হবে। সে যদি এসব শুনে কষ্ট পায় তখন কী হবে? মেয়েটার তো অনুমতি থাকতে হবে।
‘- সেসব নিয়ে তোকে চিন্তা করতে হবে না। মা আছে কী করতে? মা যেভাবেই হোক মাধবী মা’কে রাজি করাবেন?
‘- জোর করে রাজি করাবে তোমরা?
‘- কী আশ্চর্য বল তো! জোর কেনো করতে যাবে? দেখ মেয়েটার তো পৃথিবীতে কেউ নেই। আমরা যখন ওকে চিরজীবনের জন্য আপন করে নিতে চাইছি তখন সে কেনো না করবে বল? বরং তার তো কৃতজ্ঞ হওয়া উচিৎ!
‘- কী বলতে চাও তুমি? আমি ওকে রাস্তা থেকে তুলে এনেছি বলে ও আমাকে বিয়ে করতে বাধ্য? এটাই কী ওর দায়বদ্ধতা? তোমরা বোধহয় ভুলে যাচ্ছো, যে আমি কখনোই প্রতিদানের জন্য কোনো কাজ করি না। হ্যাঁ মেয়েটা অনেক ভালো, দেখতে মাশা-আল্লাহ। অবশ্যই চাইবো তাকে বউ হিসেবে পেতে। তবে তার মতের বিরুদ্ধে নয়।
‘- আরে পাগল আমরা এখনি বিয়ের কথা বলছি না। শুধু চাচ্ছে আংটি পড়িয়ে রাখতে।
‘- একটু আগেই তো বললে বিয়ের কথা?
‘- ওটা কথার কথা বললাম আরকি।
—–
এদিকে নানু আর মামিরা বসেছে মাধবীলতাকে নিয়ে!
‘- দাদু ভাই আমরা একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
মাধবীলতা হাতের ইশারায় বলে,
‘- কী সিদ্ধান্ত নানু?
নানু মাধবীলতার হাতদুটো ধরে বুকের কাছে নিয়ে শীতল কণ্ঠে বলল,
‘- দেখ দাদু ভাই তোর তো এই পৃথিবীতে কেউ নেই। আল্লাহ তোর কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। এই ক’দিনে আমরা তোকে অনেকটাই ভালোবেসে ফেলেছি। আগে তো বাড়িটা কেমন খালি খালি লাগতো। কিন্তু তোরা যবে থেকে এসেছিস তবে থেকেই বাড়িটা যেন প্রাণ ফিরে পেলো। আমি জানি তুই আমার কথা ফেলবি না। এতটুকু বিশ্বাস তোর উপর আছে। ( এটা বয়স্কদের একটা নিনজা টেকটিক। আগেই তেল মেরে বসে থাকে, আমি জানি তুই আমার কথা ফেলবি না 😕🤢)
‘- কী কথা নানু ভাই!
‘- আগে কথা দে আমি যেটা বলবো তুই সেটা রাখবি।
মাধবীলতা কোনোকিছু না ভেবেই কথা দিয়ে বসে।
‘- আমি চাই তোকে চিরকালের জন্য আমাদের কাছে রেখে দিতে। আমি চাই তুই আমার নাতবউ হয়ে থাকবি।
মাধবীলতা বেশ চিন্তিত হয়ে যায়। কী বলবে বুঝতে পারছে না। একবার ভাবছে না বলে দেবে, আরেকবার ভাবছে এই কয়েকদিনে অনেক ভালোবাসা পেয়েছে সে। নানুর মুখের উপর যদি বা বলে দেয় তাহলে হয়তো সে অনেক কষ্ট পাবে। কিন্তু কোনোভাবেই সে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।
হঠাৎ মাধবীলতা একটা উত্তর দিয়ে ফেলে। এতক্ষণ আমি সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ওদের কথোপকথন শুনছিলাম। মাধবীলতার উত্তর শুনে বেশ অবাক হয়ে গেলাম।
চলবে ইনশাআল্লাহ,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here