#একটু_ভালোবাসা
#পর্ব_৮
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
____________________
প্রিয়ু দৌঁড়ে কলপাড়ে যায়। ট্যাপ ছেড়ে বালতি পূর্ণ করে হাত ডুবিয়ে রাখে। জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে হাত। আমিন চলে যায় আবার। আলেয়া বেগম নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শাস্তি দিতে পেরেছে এতেই তাদের শান্তি। এক ঘণ্টার মতো পানিতেই হাত চুবিয়ে বসে থাকে প্রিয়ু। নিরবে পড়া চোখের পানিটুকুও যোগ হয় ঐ পানিতে। সামান্য জ্বালাপোড়া কমেছে। শরীরের জ্বরটা আরো বেড়েছে। চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসছে। আস্তেধীরে উঠে নিজের রুমে গিয়ে চুপ করে শুয়ে পড়ে। ঝাপসা চোখেই হাতের দিকে একবার তাকিয়ে দেখে হাত ফুলে লাল হয়ে গেছে।
আশা ক্লাস শেষে বাড়িতে আসে। বাড়িতে আসার আগেই মনে মনে ঠিক করে রেখেছে প্রিয়ুকে আচ্ছামতো বকে দেবে। এত সাহস ও’কে কে দেয়? এত রাতে বাইরে বের হওয়ার! কিন্তু প্রিয়ুর ঘুমন্ত মুখটা দেখে মায়া লাগে আশার। শীতে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। অথচ লেপটা গায়ে দেয়নি। টেবিলের ওপর ব্যাগ রেখে গায়ের ওপর লেপ টেনে দেয়। হাত লেপের ভেতর রাখতে গিয়ে আশার চোখ ছানাবড়া। হাতের বিধ্বস্ত অবস্থা! আশা চিৎকার দিয়ে উঠে। সঙ্গে সঙ্গে প্রিয়ুর ঘুম ভেঙে যায়। আলেয়া বেগম দৌঁড়ে আসে আশার চিৎকার শুনে। আমিন আর মনসুর আলী খেতে বসেছিল। ওরাও চলে আসে। আলেয়া বেগম অস্থির হয়ে বলেন,
“কী হলো তোর? চিৎকার করলি কেন?”
আশা কাঁপা কাঁপা হাতে প্রিয়ুর হাতটা ধরে বলে,
“ওর হাতের এই অবস্থা কেন?”
আলেয়া বেগম ব্যাঙ্গ করে বলেন,
“এর জন্য তুই চিল্লাইলি? তুই তো খুব ভালোবাসিস ওরে। ওর খবর রাখোস? তোর আদরের বইন প্রেম কইরা বেড়ায়। আবার পোলার বাড়িতেও যায়। ঐ পোলার লেইগাই হাত কাটছে।”
“শুধু হাত কাটায় তো এমন হওয়ার কথা নয় কখনো।”
“ওর হাতে লবণ লাগাই দিছি। বজ্জাত ছেমড়ির প্রেম-ভালোবাসার খুব শখ না?” গর্ববোধ করে বলে আমিন।
আশা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তিনজন মানুষের দিকে। আশা বলে,
“তুমি কি মানুষ মা? মানুষ হলে তো সামান্য মনুষ্যত্ববোধ থাকে। তুমি ভাইয়াকে আটকাতে পারলে না? অবশ্য তুমিই বা আটকাবে কেন? তুমি তো ওর সৎ মা।”
“আর ভাইয়া তুই! আল্লাহর কসম কইরা বলতেছি, তুই যদি আমার বয়সে ছোট হতি তোরে ইচ্ছেমতো থাপ্রাইতাম আমি। অমানুষ একটা।”
“মুখ সামলাইয়া কথা বল আশা।”
“অমানুষ আমার সামনে থেকে তুই যা। এখন তো মুখ চলতেছে তখন আমার হাতও চলবে।”
আশা এবার মনসুর আলীর সামনে দাঁড়িয়ে অশ্রুশিক্ত চোখে বলে,
“আমার মা আর ভাইয়ের কথা না হয় বাদই দিলাম। কিন্তু তুমি? তুমি তো প্রিয়ুর জন্মদাতা পিতা। তুমি সব জেনেও কীভাবে চুপ করে আছো? কিছু বলতে পারোনি ওদের? এমনকি প্রিয়ুকে ডাক্তারের কাছেও নিয়ে যাওনি।”
“ক্যান যামু? ও ভুল করছে শাস্তি পাইছে।”
এবার প্রিয়ু বলে,
“আমি কোনো ভুল করিনি। তোমাদের মানসিকতা যেমন তোমরা অন্যদেরও ঠিক তেমনই ভাবো। আর শাস্তি? আমি চাইলে এর দ্বিগুণ শাস্তি তোমাদের দিতে পারি। কিন্তু কীসের শাস্তি দেবো আমি? যেখানে নিজের বাবা-ই আমায় বোঝে না।”
“আমারও লজ্জা করে তোরে নিজের মেয়ে বলতে। জন্মের সময়ই তোর মুখে লবণ দিয়ে মেরে ফেলা উচিত ছিল।”
“সেটাই ভালো হতো। সত্যি বলছি। তোমার অমানুষের মতো এই রূপটা তো অন্তত আমায় দেখতে হতো না।”
“প্রিয়ু!” বলে, মনসুর আলী এগিয়ে আসে প্রিয়ুকে মারতে। মাঝখান থেকে আশা বাঁধা দিয়ে বলে,
“আর কত নিচে নামবে? এবার কি সত্যি সত্যিই প্রমাণ করতে চাইছ তুমি অমানুষ?”
সঙ্গে সঙ্গে আশার গালে থাপ্পড় বসান আলেয়া বেগম।
“বেয়াদবের সঙ্গে থেকে বেয়াদবই হইছিস।”
“দূর্ভাগ্য এটাই যে, তোমাদের মতো বেয়াদবের থেকে আদব শেখার মতো বোকামি করেছি।”
“তর্কও করিস? তোরে শ্বশুরবাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করতেছি।” বলে মনসুর আলী ও আমিনের উদ্দেশ্যে বলেন,
“চলেন আপনি। চল আমিন।”
ওরা চলে যাওয়ার পর আশা প্রিয়ুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। সিয়ামের সামনে চুপচাপ বসে আছে প্রিয়ু। চোখে পাপড়িগুলো ভেজা। কিন্তু কাঁদছে না। প্রিয়ুর পাশে বসে আশা অনবরত কাঁদছে। যে কেউ হুট করে দেখলে ভাববে ব্যথা প্রিয়ু নয় আশা-ই পেয়েছে। আশার খোঁজ-খবর নিতে গিয়ে সিয়াম প্রিয়ুর ব্যাপারেও জেনেছে। সৎ বোনের জন্য কারো এত ভালোবাসা থাকতে পারে? এ থেকেই তো বোঝা যায়, সিয়াম নিজের জন্য ভুল মানুষ পছন্দ করেনি। আশার পরিবার নিয়ে সিয়ামের কোনো মাথাব্যথা নেই। ওর পরিবার গোল্লায় যাক। শুধু আশাকে পেলেই হলো। আশা চাইলে বিয়ের পর প্রিয়ুকেও সাথে রাখবে। দু’বোনের হাসিমাখা মুখটা দেখবে। এগুলো এখন সব শুধু সিয়ামের কল্পনা। আর কল্পনাগুলো বাস্তব করা তখনই সম্ভব যদি আশা চায়!
প্রিয়ুর হাত যত্ন করে ওয়াশ করে দেয়। হাতে ব্যান্ডেজ করার সময় আড়চোখে আশার দিকেও তাকায়। টিস্যুবক্স আশার দিকে এগিয়ে দেয়। হাত ব্যান্ডেজ করা শেষ হলে কতগুলো ওষুধ দেয় আর বলে,
“হাতের ক্ষতি বেশ ভালোই হয়েছে। লবণ দেওয়ায় ইনফেকশন হয়ে গেছে। আমি মেডিসিন দিয়ে দিয়েছি। দু’দিন পর আবার আসবেন। হাত দেখে মেডিসিন দেবো আবার নতুন করে ব্যান্ডেজ করে দেবো।”
“ডাক্তার, মনের অসুখ ছাড়ানোর কোনো ওষুধ নেই?”
প্রিয়ুর এমন প্রশ্নে সিয়াম থতমত খেয়ে যায়। আশা প্রিয়ুকে কনুই দিয়ে ধাক্কা দেয়। তারপর ব্যাগ থেকে টাকা বের করে সিয়ামের সামনে দেয়। সিয়াম বলে,
“টাকা লাগবে না।”
আশা ভ্রু কুঁচকে বলে,
“টাকা লাগবে না কেন? আপনি কি ফ্রিতে চিকিৎসা করেন?”
“উড বি শালিকার জন্য তো ফ্রি-ই।” বলে প্রিয়ু।
আশা প্রিয়ুকে ধমক দিয়ে বলে,
“তুই চুপ কর।”
সব মিলিয়ে যেই বিলটা হয়েছে সিয়াম তার অর্ধেক দাম নিয়েছে। চলে যাওয়ার সময় সিয়াম বলে,
“মনের অসুখ শুধু আপনার মনের ডাক্তারই সারাতে পারবে। আমি তো আপনার মনের ডাক্তার নই। তাই ওষুধও আমার কাছে নেই। আপনার মনের ডাক্তার যিনি তার কাছে যান। মনের অসুখ সেড়ে যাবে।”
প্রিয়ু পিছু ফিরে তাকিয়ে বলে,
“যাব। আর সময় থাকতে যার মনের ডাক্তার হবেন বলে ভাবছেন তাকে ঘরের প্লাস মনের পেশেন্ট বানাতে হলে অতি শীঘ্রই বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। মা কিন্তু ছেলে খোঁজা শুরু করে দেবে।”
আশা প্রিয়ুকে টানতে টানতে নিয়ে যায়। মেকি রাগ দেখিয়ে বলে,
“তোকে এত কথা বলতে বলেছে কে রে?”
“বাঃ রে! একটা ভালো মানুষ তোমায় ভালোবাসে। আর তার উপকার আমি করব না?”
“হয়েছে। বড় উপকার করেছিস তুই। এখন বল তো হাত কেন কেটেছিলি?”
“জ্ঞানশূন্য হয়ে। রিশাদ বারবার আমাকে ওর থেকে দূরে সরানোর চেষ্টা করছে। ওর থেকেও নাকি আমি ভালো কাউকে ডিজার্ব করি এসব আবোলতাবোল আমায় বোঝাচ্ছে। কিন্তু রিশাদ এটা কেন বুঝতে চাইছে না, আমার ভালো কাউকে না বরং ও’কেই চাই। ওর মাঝেই আমি আমার সুখের দেখা পাই।”
“কত্ত বড় সাহস তার! আমার বোনকে নাকি ভালোবাসবে না। ওর বাড়ির ঠিকানা দে তো। বাড়িতে গিয়ে কেলিয়ে আসি।”
প্রিয়ু শব্দ করে হাসে। আশা বলে,
“হাসিস কেন?”
“তোমার কথা শুনে। বাচ্চাদের মতো করছ তুমি।”
“তোর সুখের জন্য আমি সব করতে পারি।”
“কিন্তু যার মাঝে আমি সুখ খুঁজি সেই আমায় চায় না।”
“আমি তাকে বোঝাব।”
“লাভ নেই আপু। তুমি তো জানো সিয়াম ডাক্তার তোমায় ভালোবাসে। কিন্তু তুমি কি বাসো? বা বাসলেও কি রাজি হবে? হবে না। কারণ তুমি আগে তোমার জায়গা থেকে সবটা ভাববে। তেমনি রিশাদকে বুঝিয়েও লাভ হবে না। হতে পারে রিশাদও ওর জায়গায় সঠিক। আমি ওর যোগ্য যে নই এটা তো সত্যই।”
“চুপ কর। এত বুঝিস তাহলে ভালোবেসে কষ্ট পাস কেন?”
“রিশাদকে ছাড়া থাকতে পারি না যে।”
আশা প্রিয়ুর গালে হাত রেখে বলে,
“আমার এই পাগলী বোনটার ভালোবাসা কবে বুঝবে রিশাদ?”
“আল্লাহ্ জানে!”
“চল। আজ আমরা ঘুরব। খাব। তারপর বাসায় যাব।”
“আমার ভালো লাগছে না আপু।”
“তোর কোনো বারণ আমি শুনব না।”
দু’বোন মিলে হাত ধরাধরি করে হাঁটছে। এটা, ওটা কিনে খাচ্ছে। গল্প করছে। কে বলবে এখানে কোনো দুঃখী মেয়ে আছে? কেউ বুঝবে না, কেউ বলবেও না। হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকা বিষাদের ছায়া কেউ টেরও পাবে না কখনো। কিছু কষ্ট, বিষাদ একান্ত নিজেরই হয়। যদি বিষাদের মতো রিশাদও একান্ত নিজের একটা মানুষ হতো তবে কি খুব বেশিই চাওয়া হয়ে যেত?
“প্রিয়ু! এই প্রিয়ু। দাঁড়া।”
কারো কণ্ঠে নিজের নাম শুনে প্রিয়ু দাঁড়িয়ে যায়। ঘন কুয়াশার আড়াল থেকে আসতে দেখতে পায় অরণ্যকে। হাঁপাতে হাঁপাতে সামনে দাঁড়ায়।
“তোর পাগলামি কমবে কবে?”
“মানে?”
“হাত কাটছিস কেন?”
“তোমায় কে বলল?”
“রিশাদ।”
“ও’কে পেলে কোথায় তুমি?”
“খুঁজে নিয়েছি। বোন কাকে ভালোবাসে দেখব না? অনেক বুঝালাম ও’কে। বলল ভেবে দেখবে।”
“আশ্চর্য! তুমি আমার কথা বলছ কেন? আমি চাই না, আমার কারণে তোমরা কেউ ছোট হও।”
“ছোট হওয়ার কী আছে? আদরের বোনের জন্য সবকিছুই করা যায়।”
“খুব খারাপ করেছ। আর কখনো এমন করলে আমি আর তোমার সাথে কথা বলব না।”
“ওরে বাবা! রাগ হয়েছে দেখি খুব। চল আইসক্রিম কিনে দেই।”
“না, ভাইয়া। ওর এমনিতেই ঠান্ডা, জ্বর লেগেছে।” বলে আশা।
“আইসক্রিম খেলে ওর জ্বর, ঠান্ডা বাড়বে না। বরং তাড়াতাড়ি কমবে।”
এবার তিন ভাই-বোন মিলে গল্প করতে করতে হাঁটে। অল্প সময়ের জন্য হলেও প্রিয়ুকে হাসি-খুশি রাখার চেষ্টা চালায়। মেয়েটার এত কষ্টের মাঝে অরণ্যর নিজের কষ্টগুলোর কথা আর বলাই হয়ে ওঠে না। তাহলে এই হাসিটুকুও মিলিয়ে যাবে বাতাসে। তিতলি বিয়েতে রাজি হয়েছে। অরণ্যর যে কতটা কষ্ট হচ্ছে সেটাও শেয়ার করতে পারছে না। থাক, দরকার কি নিজের জন্য দুঃখী মেয়েটার দুঃখ আরো বাড়াতে?
.
রিশাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় প্রিয়ু বলে,
“আমি একটু রিশাদের সাথে দেখা করে আসি?”
আশা একবার অরণ্যর দিকে তাকায়। অরণ্য বলে,
“যা। আমরা নিচে আছি।”
প্রিয়ু ভেতরে চলে যায়। আশা আর অরণ্য সালাম চাচার সাথে কথা বলে। সালাম চাচা আফসোস করে বলেন প্রিয়ুর কথা। ভালোবাসার জন্য খুব কাতর যে দুঃখী মেয়েটা।
দু’বার কলিংবেল বাজানোর পর রিশাদ দরজা খুলে দেয়। দরজা খুলেই প্রিয়ুর হাসিমাখা মুখটা দেখতে পায়। প্রিয়ু বলে,
“কী করছিলে?”
“তেমন কিছু না। শুয়ে ছিলাম। ভেতরে আসো।”
“না, ভেতরে যাব না। ভাইয়া আর আপু নিচে দাঁড়িয়ে আছে।”
“তাদেরও নিয়ে আসতে।”
“উঁহু! চলেই যাব।”
“একেবারে?”
“না। কখনো না। আমি তোমায় একেবারের জন্য কখনোই ছাড়ব না।”
রিশাদ মৃদু হেসে বলে,
“আজ যেই কথাগুলো আবেগে বলছ একদিন বাস্তবতায় সব ভুলে যাবে।তুমিও সুখী হবে অন্য কারো সাথে। তখন এই দিনগুলো আর নিজের বোকামির জন্য হাসবে।”
“আবেগকে এত ছোট করে দেখো কেন? ভালোবাসার অপর নাম আবেগ। সেটা কি জানো না? যার মাঝে আবেগ নেই সে কোনোদিনও মানুষ হতে পারে না। আবেগ প্রতিটা মানুষের মাঝেই থাকে। কেউ আবেগকে কন্ট্রোলে রাখতে পারে। আর কেউ পারে না। তফাৎ ব্যাস এতটুকুই। আর কি বললে? বাস্তবতা? এতটুকু বয়সে যতটা বাস্তবতার সম্মুখীন আমি হয়েছি সেটাই কি কম মনে হয় তোমার?
আমি সুখী হলে তোমার সাথেই হব। অন্য কারো সাথে নয়।”
“সময় হলেই দেখা যাবে।”
“দেখে নিও তুমি।”
“বাদ দাও! ভালো লাগে না এসব নিয়ে কথা বলতে।”
“কেন বাদ দেবো সবসময়? কেন বোঝো না তুমি আমার ফিলিংস? তোমায় ছাড়া আমার নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হয় রিশাদ।” একটু চেঁচিয়েই বলে প্রিয়ু।
রিশাদ শান্তস্বরে বলে,
“এখন একটু খারাপ লাগবেই। পরে ঠিক হয়ে যাবে। তাছাড়া যেই কষ্টকে তুমি প্রতিনিয়ত অতিক্রম করে চলেছ তার কাছে এই কষ্ট কিছুই না।”
“ওহ্ আচ্ছা! তুমি তাহলে এটাই ভেবে নিয়েছ যে, যেই মেয়ে এত কষ্ট সহ্য করতে পেরেছে সে এতটুকুও সহ্য করে নেবে? তাই না? এমনটা না ভেবে কি এটা ভাবা যায়নি, মেয়েটাকে নিজের করে নিয়ে সব কষ্ট দূর করে দেই?” রিশাদের জ্যাকেট খামচে ধরে বলে প্রিয়ু। কাঁদতে কাঁদতে মাথা নিচু করে দাঁড়ায়। রিশাদ বলে,
“প্লিজ কান্না থামাও প্রিয়ু।”
“আমি তোমার পায়ে ধরি রিশাদ, একটু তো ভালোবাসো আমায়।”
“প্লিজ প্রিয়ু!”
“আর কত কষ্ট পেলে, আর কত ছোট হলে তুমি আমায় ভালোবাসবে? নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে, ছ্যাচ্রার মতো তোমার পিছনে পড়ে আছি। শুধু একটু ভালোবাসার জন্য! একটুও কি মায়া হয় না তোমার?”
“আমায় ভালোবাসো?”
“আর কীভাবে বোঝাব কতটা ভালোবাসি?”
“তাহলে নিজেকে এত ছোট কেন ভাবো? ভালোবাসা অপরাধ নয়। ভালোবাসার জন্য মানুষ সব রকম পাগালামি করতে পারে। আমি তোমাকে এমন কিছুই ভাবি না। তুমি নিজেই নিজেকে ছোট ভাবো। তোমাকে আমি আগে যেমন সম্মান করতাম, এখনো তেমনই সম্মান করি।”
“শুধু আমায় ভালোবাসতেই তোমার যত সমস্যা!”
“তুমি শান্ত হও!”
“ঠিক আছি। আমি ঠিক আছি।”
হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছতে মুছতে প্রিয়ু নিচে নেমে যায়। রিশাদেরও কষ্ট হয়। কিন্তু কী করবে! ভালোবাসার ওপর যে জোর খাটে না। রিশাদও যে বেঁধে আছে নিজের সীমায়। কখনো কি সম্ভব নয় নিজের সীমা অতিক্রম করে প্রিয়ুকে ভালোবেসে নিজের করে নেওয়া? এর উত্তর কখনো মিলবে?
————————————-
প্রিয়ুর জ্বর ক্রমশ বেড়েই চলেছে। হাতের অবস্থাও ভালো নয়। বিছানা থেকে ওঠার শক্তিটুকুও পর্যন্ত নেই। প্রিয়ুর দেখাশোনা সব আশাই করছে। নিজেও ভার্সিটিতে যাচ্ছে না আর প্রিয়ুকেও যেতে দেয়নি। নিজের যেটুকু জমানো টাকা ছিল তা দিয়েই প্রিয়ুর জন্য ওষুধ এনেছে। মনসুর আলীর কাছে কোনো টাকা চায়নি। বাবা নামক নিষ্ঠুর লোকটার টাকায় প্রিয়ুর চিকিৎসা করাতে আশার বিবেক বাঁধা দিয়েছে। সবচেয়ে অবাক করার বিষয়টি হলো মনসুর আলী একটাবার প্রিয়ুর খোঁজও নেয়নি। মানুষ এতটা নিষ্ঠুর কী করে হতে পারে? প্রিয়ুর পাশে বসে এসবই ভাবছিল আশা। জ্বরের ঘোরে কথাও ঠিকমতো বলতে পারছে না প্রিয়ু। আস্তেধীরে বলে,
“আপু মুখটা খুব তেতো লাগছে।”
“তেঁতুল খাবি?” জিজ্ঞেস করে আশা।
মৃদু হেসে প্রিয়ু বলে,
“খাব।”
আশা বৈয়াম থেকে কিছুটা তেঁতু্ল ছোট একটা বাটিতে নেয়। তিনটা কাঁচা মরিচ কুচিকুচি করে কেঁটে দেয়। পরিমাণমতো লবণ আর অল্পটুকু চিনি দেয়। সাথে অল্প পানি মিশিয়ে মাখা মাখা করে চটকিয়ে দেয়। এভাবে তেঁতুল মাখিয়ে খাওয়া আশা প্রিয়ুর থেকেই শিখেছে। ছোটবেলায় প্রিয়ুর মা মমতা বেগমও নাকি এভাবে তেঁতুল মেখে দিত প্রিয়ুকে। তেঁতু্লের বাটিটা প্রিয়ুর হাতে তুলে দেয় আশা। অল্প একটু মুখে দেওয়ার পরই বাহির থেকে তিতলির কণ্ঠ শোনা যায়। আশা বলে,
“তুই খা। আমি দেখছি।”
আশা বাইরে গিয়ে দেখে সত্যিই তিতলি দাঁড়িয়ে আছে। আশাকে দেখে বলে,
“প্রিয়ু বাসায়?”
“হ্যাঁ। ভেতরে আসো।”
তিতলি আশার সাথে ভেতরে যায়। প্রিয়ুকে দেখে বলে,
“অসুস্থ তুই?”
“হু। জ্বর আর ঠান্ডা।” বলে প্রিয়ু।
তিতলি ধরে আসা গলায় বলে,
“নিজের যত্ন নিস না কেন?”
“নিই তো!”
তিতলির চোখ টলমল করছে। ঠোঁট কামড়ে ধরে রাখছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে। প্রিয়ু জিজ্ঞেস করে,
“কিছু হয়েছে দি?”
তিতলি এদিক-সেদিক তাকিয়ে চোখের পানি আটকানোর চেষ্টা করে। মেকি হেসে বলে,
“না। কী হবে?”
“তাহলে তুমি কাঁদছ কেন?”
“কাঁদছি না।” বলে, আশা ব্যাগ থেকে একটা কার্ড বের করে। লাল খামে সুন্দর নকশা করা বিয়ের কার্ড। প্রিয়ু কার্ডটা হাতে নিয়ে বলে,
“কার বিয়ে?”
“আমার বিয়ে। তোর ভাইকে নিয়ে চলে আসিস।”
“কী বলছ দি? তোমার বিয়ে কার সাথে? তুমি অন্য কাউকে বিয়ে করবে?”
“এসব প্রশ্ন না হয় তোর ভাইকেই করিস।” বলে, হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছতে মুছতে তিতলি দৌঁড়ে চলে যায়। প্রিয়ুর মাথা ঘুরছে। এটা কী করে সম্ভব! এতকিছু হয়ে গেল আর অরণ্য কিছুই বলল না? প্রিয়ু লেপ সরিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
“তুই অসুস্থ শরীর নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?” জিজ্ঞেস করে আশা।
“অরণ্য ভাইয়ার কাছে যাব। আমায় সবকিছু জানতে হবে।”
“এই শরীর নিয়ে কীভাবে যাবি?”
“জানি না আমি। যেতে হবে আমায়।”
“চল। আমিও যাব সাথে।”
.
.
সূর্যের মৃদু আলোতে ছাদের এক কোণায় বসে আছে অরণ্য। দিনের বেশিরভাগ সময়টা এখন ছাদেই কাটে। প্রিয়ু আর আশাকে ছাদে আসতে দেখে অরণ্য বলে,
“কী ব্যাপার? জ্বর নিয়ে এখানে আসলি কেন?”
“তার আগে আমায় তুমি এটা বলো কী লুকিয়েছ আমার থেকে?” জিজ্ঞেস করে প্রিয়ু। অরণ্য অবাক হয়ে বলে,
“কী লুকাব?”
“সেটা তো তুমি জানো। তিতলি দি’র বিয়ে ঠিক হয়েছে।”
“জানি আমি।”
“জানো মানে? জানলে এমন চুপ করে আছো কেন? কিছু করছ না কেন?”
“কী করব আমি? কী করার আছে? কিচ্ছু করার নেই আমার। তিতলির মা আমার কাছে তিতলিকে ভিক্ষা চেয়েছে। ধর্মের দেয়াল যে আমাদের মাঝে। আমার কিছু করার নেই। আমি নিজেই তিতলিকে বাধ্য করিয়েছি বিয়েতে রাজি হতে।” কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে ফেলে অরণ্য।
কাঁদতে কাঁদতেই অরণ্য প্রিয়ুকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“আমি তিতলিকে ছাড়া ভালো থাকব না রে বোন। জীবন্ত লাশ হয়ে যাব আমি।”
অরণ্যর সঙ্গে কাঁদে আশা আর প্রিয়ুও।
একজন একটু ভালোবাসার জন্য সর্বসময় কাঁদে আর অন্যজন ভালোবাসা হারানোর কষ্টে। ধর্মের দেয়ালের দুইপাশে শেষমেশ হারিয়ে যাবেই ওদের ভালোবাসা?
#একটু_ভালোবাসা
#পর্ব_৯
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
____________________
আজ তিতলির বিয়ে। লাল বেনারসী পরে বিছানার ওপর বসে আছে। রাতের অন্ধকারে পুরো বাড়িটা আলোয় আলোকিত করা। শুধু তিতলির মনের দহনটাই সকলের অজানা। কত ইচ্ছে ছিল অরণ্যর সঙ্গে সংসার করবে। নিজেদের সুখের একটা সংসার হবে। যেখানে দুজন ঝগড়া করবে, খুনসুটি করবে। আর দিনেশেষে ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হবে। সেসব স্বপ্ন আজ অধরাই রয়ে গেল। একটু পরই বিয়ের পিড়িতে বসতে হবে। মন বলছে, শুধু একবার যদি অরণ্য এখন এসে বলত চলো আমার সাথে। তাহলে তিতলি আর অন্য কিছুই ভাবত না। অরণ্যর হাত দূরে অনেক অনেক দূরে চলে যেত। অরণ্য এখন কী করছে? অরণ্য কি আসবে না?
“দিদি।”
অশ্রুশিক্ত চোখে তিতলি সামনের পানে তাকায়। প্রিয়ু দাঁড়িয়ে আছে। তিতলি বিছানা থেকে দৌঁড়ে দরজার কাছে যায়। এদিক-সেদিক অরণ্যকে খুঁজে বলে,
“অরণ্য কোথায় প্রিয়ু? অরণ্য আমায় নিতে এসেছে তাই না? বল না ও কোথায়?”
“আসেনি ভাইয়া।”
“আসেনি!”
“না, আসেনি। আমিও আসতাম না। আসলে কী বলো তো যাকে ভাইয়ের বউ হিসেবে কল্পনা করে এসেছি এতদিন তাকে অন্য কারো বউ হতে দেখতে কষ্ট হবে আমার। যেখানে আমি নিজেই সহ্য করতে পারব না সেখানে ভাইয়া কীভাবে সহ্য করবে? কীভাবে ভাবো ভাইয়া আসবে?”
“আমি তো চেয়েছিলাম অরণ্য একবার এসে আমায় বলুক ও আমায় এখনো ভালোবাসে। বিশ্বাস কর, সবকিছু ত্যাগ করে আমি ওর সাথে চলে যেতাম।”
“তুমি বিশ্বাস করো ভাইয়া আর তোমায় ভালোবাসে না?”
পূজা সরকার রুমে প্রবেশ করেন। প্রিয়ুকে দেখে বলেন,
“এত লেট করে এসেছ কেন?”
প্রিয়ু কিছু বলে না। চুপ করে থাকে। ঘরে আরো কয়েকজন ছেলে আসে পিড়ি নিয়ে। তিতলিকে পিড়িতে বসিয়ে নিয়ে যায়। পান পাতা দিয়ে মুখ ঢাকার আগে টলমল করা নয়নে শুধু একবার তাকায় প্রিয়ুর দিকে।
বিয়ের মণ্ডপে যাওয়ার আগেই তিতলি পান পাতা ফেলে দেয়। চিৎকার করে বলে,
“আমায় নামাও।”
উপস্থিত সবাই বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। পূজা সরকার ফিসফিস করে বলেন,
“কী সিনক্রিয়েট শুরু করলে?”
“আমি বিয়ে করব না মা। আমি অরণ্যকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করব না।” কাঁদতে কাঁদতে বলে তিতলি। সবাই তিতলির কথা শুনে কানাঘুষা করছে। লজ্জায় মরে যাওয়ার মতো অবস্থা তিতলির পরিবারের। বরপক্ষরা অনেক কথা শুনিয়েছে তিতলির পরিবারকে। বরপক্ষের সাথে সাথে মেহমানরাও সবাই চলে যাচ্ছে। মেয়ে লগ্নভ্রষ্টা হয়েছে বলে ছিঃ ছিঃ করছে লোকজন। কয়েকজন বেশ কড়া কড়া কথাও বলছেন। রাগে সহ্য করতে না পেরে তিতলির বাবা তিতলিকে মারধোর শুরু করে। আত্মীয়-স্বজনরা তাকে থামান। মার বন্ধ করলেও তিনি তিতলিকে অরণ্যর কাছে যেতে দেন না। ঘরে বন্দি করে রাখেন। একদিক থেকে প্রিয়ুর খারাপ লাগলেও এটা ভেবে ভালো লাগছে যে বিয়েটা শেষ পর্যন্ত হয়নি। তিতলির সাথে অরণ্যর মিল হবে বলেই হয় তো আল্লাহ্ বিয়েটা হতে দেননি। কথায় তো আছে, আল্লাহ্ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। খবরটা অরণ্যকে দেওয়ার জন্য তিতলির বাড়ি থেকে সোজা অরণ্যর বাসায় যাবে বলে ঠিক করে। তিতলির বাড়িতে আসার সময়ও ব্যথিত চোখে একবার রিশাদের ফ্ল্যাটের দিকে তাকিয়েছে। যাওয়ার সময়ও দেখতে হবে। অবাধ্য মন একটা বার চায় রিশাদের দেখা পেতে। রিশাদের দেখা তো পায়নি আর বাড়িতেও যায়নি। রিশাদের সাথে মান-অভিমান সব পরে হবে। আগে অরণ্যকে খবরটা জানাতে হবে। দৌঁড়াতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে রাস্তায় পড়ে যায় প্রিয়ু। লোকজনের সামনে এভাবে পড়ে যাওয়া খুবই লজ্জাজনক। হাঁটুতে বোধ হয় ছিলেও গেছে। রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে রিশাদ আর অনিক বসা ছিল। প্রিয়ুকে দেখেই ওরা এগিয়ে আসে। প্রিয়ু উঠে দাঁড়িয়ে ওদেরকে দেখতে পায়। রিশাদকে দেখে একটু বেশিই লজ্জা লাগে। কী ভাবল কে জানে!
“এভাবে দৌঁড়াচ্ছিলে কেন?” জিজ্ঞেস করে রিশাদ।
“একটু তাড়া আছে তাই।” মাথা নিচু করে বলে প্রিয়ু।
রিশাদ মশকরা করে বলে,
“বয়ফ্রেন্ড অপেক্ষা করছে নাকি?”
প্রিয়ু এবার চোখ রাঙিয়ে বলে,
“আলতু-ফালতু কথা বলবে না একদম। আমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই এটা তুমি ভালো করেই জানো।”
“জানতাম নাকি?”
“ঢং করা হচ্ছে?”
“ঢং তো মেয়েরা করে।”
“তোমার ঢং এর কাছে মেয়েদের ঢং ফেইল।”
“আচ্ছা ঝগড়া পরে করব। কোথায় যাচ্ছ এখন?”
“অরণ্য ভাইয়ার বাসায়।”
“এত রাতে?”
“তিতলি দি’র বিয়ে হবে না। এটাই ভাইয়াকে বলতে যাচ্ছি। তিতলি দি ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড। বেশিকিছু বলার সময় নেই এখন। যেতে হবে আমায়।”
“আমরা কি সাথে আসতে পারি?” জানতে চায় অনিক।
প্রিয়ু একবার রিশাদের দিকে তাকিয়ে বলে,
“পারেন।”
একটা অটো ডেকে তিনজনে অরণ্যর বাসায় চলে যায়। বাড়িতে গিয়ে দেখে দরজায় তালা দেওয়া। রিশাদ বলে,
“বাড়িতে তো কেউই নেই।”
“হু। কিন্তু এত রাতে সবাই গেল কোথায়?”
“সেটা আমি কী করে জানব? এক কাজ করো, তোমার ভাইয়াকে ফোন দাও।”
“আমার তো ফোন নেই। আর ভাইয়ার নাম্বার আপুর ফোনে সেভ করা আছে। মুখস্ত নেই আমার।”
“তাহলে কী করবে?”
“দাঁড়াও, কাউকে জিজ্ঞেস করি।”
পাশের এপার্টমেন্টে গিয়ে অরণ্যদের কথা জিজ্ঞেস করায় তারা জানায় যে অরণ্যকে নিয়ে সবাই হাসপাতালে গেছে। প্রিয়ুর মনে এবার ভয়ের দানা বাঁধতে শুরু করে। অরণ্য কি তাহলে সুইসাইড? না! অরণ্য তো কখনো এমন কিছু করতে পারে না। রিশাদ প্রিয়ুকে শান্তনা দিয়ে বলে,
“রিল্যাক্স! হতে পারে সামান্য কিছু হয়েছে। এত ভয় পাচ্ছ কেন?”
“আমার মন কেমন যেন কু ডাকছে রিশাদ।”
“তুমি দিনদিন বড় হও নাকি ছোট? মাথা ঠান্ডা রাখো আর মনকে শান্ত করো।”
“আমি পারছি না।”
“আচ্ছা কোন হাসপাতালে নিয়ে গেছে তারা বলেছে?”
“জানে না তারা।”
“জানলে হাসপাতালে যাওয়া যেত। চলো তাহলে বাসায় ফিরি। সকালে না হয় এসো আবার।”
“না। আমি এখানেই থাকব। তোমরা যাও।”
“পাগলের মতো কথা বোলো না। রাতে একা একটা মেয়ে বাড়ির সামনে একা থাকবে?”
প্রিয়ু কিছু বলতে যাবে তার আগেই এম্বুলেন্সের শব্দ পায়। দৌঁড়ে একটু সামনে এগিয়ে যেতেই দেখতে পায় এম্বুলেন্সটা এদিকেই আসছে। ঠিক প্রিয়ুর সামনে এসে দাঁড়ায়। কাঁদতে কাঁদতে এম্বুলেন্স থেকে নেমে আসে অরণ্যর বাবা-মা। সাথে আরো দুজন মহিলা আর পুরুষ রয়েছে। মহিলাগুলো অরণ্যর মাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। প্রিয়ু নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। স্ট্রেচারে করে সাদা কাপড়ে ঢেকে কাউকে নামানো হয়। কে সে? লাশ রেখে এম্বুলেন্স চলে যায়। অরণ্যর আত্মীয়-স্বজন, আশেপাশের মানুষজন আসতে থাকে। ভীড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে প্রিয়ু। মাটি যেন পা আঁকড়ে ধরে রেখেছে। অরণ্য ভাইয়া কোথায়? রিশাদ আর অনিক ভীড় ঢেলেই এগিয়ে যায়। অরণ্যর লাশ বুকে জড়িয়ে কাঁদছে অরণ্যর মা। সবার কথায় জানা যায় হার্ট এ্যাটাক করে মারা গেছে অরণ্য। বেশিক্ষণ লাশ দেখার সাহস হয় না রিশাদের। সেখান থেকে চলে আসে। প্রিয়ু রিশাদকে জিজ্ঞেস করে,
“কার লাশ ঐটা?”
রিশাদ নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। রিশাদকে চুপ থাকতে দেখে প্রিয়ু নিজেই সবাইকে সরিয়ে সামনে যায়।এক পলক অরণ্যর মৃত দেহ দেখে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
যখন জ্ঞান ফিরে তখন ভোরের আলো ফুঁটেছে। চারপাশে মানুষের কান্না আর আহাজারি। লাশ কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করছে সবাই। লাশ বেশিক্ষণ এভাবে না রাখাই ভালো। অরণ্যর সামনে বসে হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদছে তিতলি। তিতলিকে মানানোর চেষ্টা করছে পূজা সরকার। তিতলি কাঁদতে কাঁদতে বলছে,
“আমার অরণ্যর মৃত্যুর জন্য একমাত্র তুমিই দায়ী মা! কেন তুমি ও’কে মেনে নিলে না? তুমি যদি আমাদের আলাদা না করতে তাহলে অরণ্যকে হারাতে হতো না।”
প্রিয়ুর বুক ফেঁটে যাচ্ছে কান্নায়। কিন্তু কান্না কেন আসছে না? চোখের পানি ফুরিয়ে গেল? ভাইয়ের জন্য কাঁদবে না প্রিয়ু? দরজার সামনে হাঁটু গেড়ে চুপচাপ বসে থাকে। চারদিকে তাকিয়ে সবার কান্না দেখছে। ওরা সবাই ওদের কষ্টগুলো চোখের পানির মাধ্যমে দূর করতে পারছে। প্রিয়ু সেটাও পারছে না। এত অসহায়বোধ মনে হচ্ছে এত! লাশের খাঁটিয়া যখন তুলতে যাবে তখন প্রিয়ু অরণ্যর বাবার হাত ধরে বলে,
“ভাইয়াকে নিয়ে যেও না বাবা!”
ইশ! কী কষ্ট, কী বেদনা সে কথায়! বাবারও যে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এই কঠিন সত্য উপেক্ষা করার ক্ষমতা যে কারো নেই। লাশ নিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে গলা ফাঁটিয়ে চিৎকার করে কান্না শুরু করে প্রিয়ু।
“ভাইয়া এভাবে যেতে পারে না। কখনো না। ভাইয়া না বলেছিল সারাজীবন পাশে থাকবে?”
অরণ্যর মা এগিয়ে এসে প্রিয়ুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। ঠিক কতটা কষ্ট হচ্ছে তা কেউ কাউকে বোঝাতে পারছে না। কিছু কষ্ট আছে না একান্তই নিজের? এই কষ্টটাও ঠিক তেমন।
.
সময় থেমে থাকেনি। কারো জীবনও থেমে থাকেনি। শুধু থেমে গেছে কিছু মানুষের ভালোবাসা, খুনসুটি, বিশ্বাস। শুধু থেমেই যায়নি বরং হারিয়ে গেছে সারাজীবনের জন্য। এখন আর রাতের আকাশে তারা গুণতে গুণতে ভাই-বোনের দুঃখের গল্প করা হয় না। এখন আর মেইন রাস্তার পাশে ধাবায় বসে আলু কাবলী, চা খাওয়া হয় না। শীত আসলেই এখন আর ভাইয়া আইসক্রিম কিনে দেবে না। মজার মজার কথা বলে হাসাবে না। সারাজীবন ছায়ার মতো পাশে থাকবে এই প্রতিশ্রুতিও রাখল না। এখন যা আছে সব স্মৃতি! এই স্মৃতিগুলোই কষ্ট বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। তিতলি সবার সঙ্গে কথা বলা বাদ দিয়েছে। শুধু অরণ্যর সঙ্গে কথা বলে। অন্ধকার ঘরে একা একা। আলো দেখলেই তিতলি এখন ভীষণ ভয় পায়। অরণ্যর মৃত্যুর পর থেকে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল তিথি। আস্তে আস্তে তা চরম পর্যায়ে এসে পড়েছে। সাইকিয়াট্রিস্ট দেখিয়েও কোনো উপায় হয়নি। একটা সময় তিতলি নিজেই কারো কাছে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। কাউকে সহ্য হয় না ওর। তিতলির অবস্থা এখন পাগল প্রায়। প্রিয়ু আসে মাঝে মাঝে। তখন কত গল্প তিতলির! সব কথায় শুধু অরণ্য অরণ্য আর অরণ্য। প্রিয়ু শোনে। তিতলির সব কয়টা কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে। কখনো কথা বলতে বলতে তিতলি খিলখিল করে হেসে ফেলে। কখনো কেঁদে ফেলে। প্রিয়ুর অনুভূতিগুলো তখন হয় নামহীন। চোখ থেকে পানি পড়লেও ঠোঁট হাসতে চায়। এমন অনুভূতির নাম হয় বুঝি? আজও প্রিয়ু এসেছে তিতলির বাসায়। দরজায় নক করে বলে,
“আসব দি?”
তিতলি গলার স্বর চেনে প্রিয়ুর। বিষাদিতভাবে বলে,
“না! চলে যা। এখন আমি অরণ্যর সাথে কথা বলব।”
প্রিয়ু কথা বাড়ায় না। বুকচিরে কান্না চলে আসে। কাউকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে ইচ্ছে করে। প্রস্থান করে প্রিয়ু সে জায়গা। মমতা বেগমের কবরের কাছে গিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। অভিযোগ করে বলে,
“সবসময় আমার সাথেই কেন এমন হয় মা? আল্লাহ্ আর কত কেড়ে নেবে আমার কাছ থেকে? আমাকে যারা ভালোবাসে কেন তাদের আমার থেকে কেড়ে নেয় বলো? একটু ভালোবাসাও কি আমার ভাগ্যে থাকবে না? আমার না বাঁচতে ইচ্ছে করে না আর! এত দুঃখ আমি আর সইতে পারি না। কেন হয় আমার সাথে এমন? বলো না মা! বলো! আমি তোমার কাছে যাব। তোমার কোলে মাথা রেখে একটু শান্তির ঘুম ঘুমাব। নেবে আমায়? মা!”
মা তো উত্তর দেয় না। কিছুক্ষণ কেঁদে নিজেকে হালকা করে। গুটি গুটি পায়ে হাঁটতে থাকে। কোথায় যাওয়া যায়? কার কাছে গেলে একটু শান্তি পাওয়া যাবে? রিশাদ? হ্যাঁ, ওর কাছেই যাওয়া যায়। রিশাদের বাড়ির সামনে গিয়ে সালাম চাচার সাথে কথা হয়।
“কেমন আছেন চাচা?”
“ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?”
“আল্লাহ্ রেখেছে। রিশাদ বাড়িতে?”
“না মা। তার কাজের ব্যস্ততা অনেক। অনেক রাত করে অফিস থেকে বাড়িতে আসে।”
“ওহ্।”
“তোমার মন খারাপ মা?”
“আর মন খারাপ! আর বাঁচতে ইচ্ছে হয় না চাচা। খুব কষ্ট গো চাচা আমার খুব!”
“দুঃখ কইর না মা। আল্লাহ্ একদিন সুখের দেখা মিলাইব দেইখো।”
“আর কবে? বিশ্বাস করেন চাচা, আমি এবার সত্যিই মরিয়া হয়ে আছি একটু সুখের দেখা পাওয়ার জন্য। আমি হাঁপিয়ে উঠেছি কষ্টের মধ্যে। যাদের আমি ভালোবাসি তারাই আমায় একা করে চলে যায়। আমার মা আমায় ছেড়ে গেছে। বাবা থেকেও নেই। রক্তের সম্পর্ক না থেকেও অরণ্য ভাইয়া আমার মাথার ওপর ছায়া হয়ে ছিল। সেই ছায়াটাও আল্লাহ্ কেড়ে নিল। আপা সুখে নাই আমার। একটু দেখাও পাই না আমি। যেন অনন্তকাল দূরে থাকে আমার বড় আপা।আপন বলতে এখন আমার আশা আপুই আছে। আমার খুব ভয় করে চাচা! এদিকে আমি এমন একজন মানুষকে ভালোবেসে ফেলেছি যার আমার প্রতি সামান্য পরিমাণ ভালোবাসাটুকুও নেই। আমি কখনো ভাবিইনি কাউকে এভাবে ভালোবেসে ফেলব। কিন্তু আমি ভালোবেসে ফেলেছি। আমি জানিনা কবে সে আমার ভালোবাসা বুঝবে বা আদৌ বুঝবে কী না! আমি শুধু জানি আমি তাকে ভালোবাসি। খুব করে চাই আমি তারে।”
সালাম চাচা মর্মাহত হয়ে বলেন,
“আল্লাহ্ যেন তোমার মনের আশা পূরণ করে মা। আমি আল্লাহ্-র কাছে দোয়া করে বলব।”
সালাম চাচার সাথে কথা বলতে বলতে কখন যে সময় কেটে গেছে। বুঝেনি কেউ। অনেকদিন পর মন খুলে কারো সাথে কথা বলা গেল। এর মাঝেই রিশাদ চলে আসে। চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ। তবুও প্রিয়ুকে দেখে হাসে। জিজ্ঞেস করে,
“কখন এসেছ?”
“অনেক আগেই। চাচার সাথে গল্প করছিলাম।”
“বাসায় চলে যাবে নাকি ভেতরে যাবে?”
“বাসায় যাব না এখন।”
“তাহলে ভেতরে চলো।”
“হুম।”
ভেতরে গিয়ে প্রিয়ুকে বসতে বলে রিশাদ ফ্রেশ হতে চলে যায়। সোফার সাথে হেলান দিয়ে বসে থাকে প্রিয়ু।ছোটবেলার কথা, মায়ের কথা, অরণ্য ভাইয়ার কথা খুব মনে পড়ছে। ঠোঁট উল্টে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। রিশাদ গোসল করে এসে ভাত বসিয়ে দেয় চুলোয়। ফ্রিজ থেকে তরকারি বের করে গরম করে নেয়। সেই যে সন্ধ্যায় হালকা নাশতা করেছিল তারপর থেকে আর কিচ্ছু খাওয়া হয়নি। এদিকে রাত ১১টা বাজতে চলল। পেটের ভেতর খিদেয় ইঁদুর দৌঁড়াচ্ছে। এক চুলায় ভাত বসিয়ে অন্য চুলায় চা বসিয়ে দেয়। দুই মগ চা বানিয়ে আনে ড্রয়িংরুমে। এক মগ প্রিয়ুকে দেয়। প্রিয়ু চা হাতে নিয়ে বসে থাকে। চোখের কার্ণিশে পানি চিকচিক করছে।
“মন খারাপ?” জিজ্ঞেস করে রিশাদ।
প্রিয়ু দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে বলে,
“উঁহু।”
“শিওর?”
“হু।”
মগটা টেবিলের ওপর রেখে রিশাদ বলে,
“ভাইয়ার কথা খুব মনে পড়ছে?”
প্রিয়ু এবার ঠোঁট বাঁকিয়ে কেঁদে ফেলে। প্রিয়ুর কষ্ট বুঝতে পারে রিশাদ। কিন্তু এই কষ্ট দূর করার উপায় কী? কেউ কষ্ট পেলে রিশাদেরও যে খুব কষ্ট হয়।
“কেঁদো না প্লিজ!”
প্রিয়ু দু’হাতে চোখের পানি মুছে বলে,
“মানুষের এক জীবনে নাকি সুখ হয়? আমি তো কোনো জীবনেই সুখ পেলাম না রিশাদ!”
“প্লিজ এভাবে বোলো না! কষ্ট হয়।”
“একটু ভালোবাসবে রিশাদ? এই অসহায় মেয়েটাকে ভালোবাসা যায় না?”
রিশাদ কথা ঘুরিয়ে বলে,
“ভাত বোধ হয় হয়ে গেছে।দেখে আসি আমি।”
প্রিয়ু সোফার সাথে মাথা ঢেকিয়ে বলে,
“ভেবেছিলাম তোমায় আঁকরে ধরে সব কষ্ট ভুলে যাব। আমার জীবনেও সুখ আসবে। কিন্তু তুমি তো আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে। একটু ভালোবাসা কি যায় না?”
“নিজেকে সামলাও প্লিজ!”
“একটু আগে বললে আমি কাঁদলে নাকি তোমার কষ্ট হয়। সত্যিই কষ্ট হয়?”
“কষ্ট হয় বলতে খারাপ লাগে।”
“কষ্ট পাওয়া আর খারাপ লাগাটা এক নয় রিশাদ। খারাপ লাগাটা মায়ানুভূতি আর কষ্ট পাওয়াটা ভালোবাসানুভূতি। আমার জন্য স্রেফ তোমার মায়া-ই হয়। কোনো কষ্ট নয়!”
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]