এক খণ্ড কালো মেঘ পর্ব -০৬+৭

#এক_খণ্ড_কালো_মেঘ
#পর্ব_৬
#নিশাত_জাহান_নিশি

অয়ন্তী এবং আলিজার তোপের মুখে পড়ে পুরোপুরি কথা না শুনেই রাফায়াত বাধ্য হলো পার্ক থেকে বের হতে। আলিজা এবং অয়ন্তীকে নিয়ে সে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। এসবের মাঝে রাফায়াত একটা জিনিস লক্ষ্য করল, অয়ন্তী কিছুটা হলেও তার সাথে স্বাভাবিক হচ্ছে! রাফায়াতকে নিয়ে বেশ ভাবুক মনে হচ্ছে!

আলিজাদের এলাকা পাড় হয়ে ঠিক পরের এলাকাতেই অয়ন্তীদের বাড়ি। আলিজাদের এলাকায় বাস থামতেই আলিজা বাস থেকে নামার প্রস্তুতি নিলো। পাশের সিটে নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকা অয়ন্তীকে শুধালো,,

“কী রে? তুই একা যেতে পারবি তো? নাকি সামনের স্টপ পর্যন্ত আমরা তোকে এগিয়ে দিয়ে আসব? কী বলিস?”

চট করে রেগে বসল অয়ন্তী! বিক্ষুব্ধ চাহনিতে আলিজার দিকে ঘুরে তাকালো৷ নাক ফুলিয়ে রূঢ় গলায় বলল,,

“হাউ স্ট্রেঞ্জ আলিজা! আমি কী এখন নিজের বাড়ি অবধিও একা একা যেতে পারব না? তাও আবার এই দিনে-দুপুরে? কী পেয়েছিসটা কী তোরা আমাকে বল তো?”

চুপসে গেল আলিজা। অবিন্যস্ত দৃষ্টিযুগল ফেলল আলিজার দিকে। টিমটিমে স্বরে বলল,,

“না। তুই তো ঐসময় আরিফকে ভয় পাচ্ছিলি তাই বললাম।”

চোখ লাল করে অয়ন্তী আলিজার দিকে তাকালো। আলিজা কীভাবে তার মজা উড়ালো! এতই ভীতু নাকি সে? সঙ্গে সঙ্গেই আলিজা ঠোঁট চেপে হেসে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। অয়ন্তীকে কিছু বলার সময়টাও অবধি দিলো না। অন্তত বাসের মধ্যে সে অয়ন্তীর সাথে ঝগড়া করতে পারবেনা। বাসের দরজা থেকে রাফায়াত আলিজাকে ইশারা করে বলল সামনে এগিয়ে আসতে। ইশারা বুঝে আলিজা রাফায়াতের দিকে এগিয়ে গেল। হুডির টুপিটা সরিয়ে রাফায়াত আলিজার জিজ্ঞাসু মুখমণ্ডলে তাকালো। কর্ণতলে ফিসফিসিয়ে বলল,,

“আমি অয়ন্তীকে এগিয়ে দিয়ে আসছি ওকে? তুমি বাড়ি যাও।”

দ্বিমত পোষণ করল আলিজা। দ্রুত গলায় বলল,,

“এই না না ভাইয়া। অয়ন্তী রাগ করবে। এমনিতেই সে আমার উপর প্রচুর ক্ষেপে গেছে। এখন আবার আপনাকে দেখলে আরও বেশী ক্ষেপে যাবে।”

“আরে ধূর। রাখো তোমার ক্ষেপাক্ষেপি! ঐ ক্ষেপিকে আমি সামলে নিব! এভাবে একা তাকে একা ছেড়ে দেওয়াটা আমার ঠিক মনে হচ্ছেনা। তাছাড়া তোমরা দুজন আমার দায়িত্বেই বের হয়েছ। রাস্তাঘাটে অপ্রীতিকর কিছু একটা ঘটে গেলে এতে পরে আমার নিজেরই খারাপ লাগবে। একচুয়েলি আমি রিস্ক নিতে চাইছিনা।”

“ঠিক বলেছেন ভাইয়া। আরিফের সাথে বিশ্বাস নেই। সে হয়তো এতক্ষণে আমাদের ফলো করা শুরু করেছে। যা অসভ্য এই ছেলে! আপনি এক কাজ করুন ভাইয়া। অয়ন্তীকে বাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়ে আসুন। আমি বরং এখানেই নেমে যাচ্ছি।”

বাস থেকে নেমে পড়ল আলিজা। রাফায়াত উঁকি মেরে বাঁকা চাহনিতে অয়ন্তীর দিকে তাকালো। আড়চোখে বাসের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা রাফায়াতের দিকে তাকালো অয়ন্তী। রাফায়াতের চোখে চোখ পড়তেই অয়ন্তী দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো! চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে বিড়বিড়িয়ে বলল,,

“ধ্যাত। এই মা’স্তা’নটা কেন নামছে না গাড়ি থেকে হ্যাঁ? আলিজা তো নেমে গেল। এর তাকানোর লক্ষ্মণও তো ভালো ঠেকেনি আমার! আবার কী ব্ল্যা”কমে”ইল করতে আসবে আমাকে?”

ভাবতেই গাঁ টা ছমছম করে উঠল অয়ন্তীর! দম নেওয়ারও কিঞ্চিৎ সময় পেলনা অয়ন্তী। ঝড়ের বেগে তেড়ে এসে রাফায়াত অয়ন্তীর পাশের সিটে বসে পড়ল! ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে অয়ন্তী রাফায়াতের ভাবশূণ্য মুখের দিকে তাকালো। অমনি রাফায়াত অয়ন্তীকে চোখ মেরে দিলো! যাত্রীরা নামার সাথে সাথেই ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিলো। আচমকাই গাড়িটা কেমন ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই অয়ন্তী এসে ছিটকে পড়ল রাফায়াতের গাঁয়ের উপর! ঘটনাগুলো এত দ্রুত ঘটে গেল যে অয়ন্তী কিছু বুঝে উঠতে পারলনা। কেমন যেন বেকুব বনে রইল। ব্যগ্র হাসল রাফায়াত। অয়ন্তীর হঠকারী মুখমণ্ডলে কদাকার দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। দুষ্টু গলায় বলল,,

“কী ম্যাম? সহ্য হচ্ছিলনা না? কখন আমার মত একটা হ্যান্ডসাম ছেলের গাঁয়ের উপর এসে এভাবে হামলে পড়বেন অস্থির হয়ে উঠেছিলেন তাইনা?”

“শাট ইউর মাউথ ওকে? আমি ইচ্ছে করে আপনার গাঁয়ের উপর পড়িনি। ড্রাইভার হঠাৎ করেই গাড়িটা ব্রেক নেওয়াতেই এই অঘটনটা ঘটে গেছে।”

“আরে হইছে হইছে। আসল ঘটনাটা যে আসলে কী তা তো আমি বেশ ভালোভাবেই বুঝে গেছি! উফফফস! এখনো গাঁয়ের সাথে লেগে আছে। কেমন হট হট ফিলিংস হচ্ছে!”

ঝট করে রাফায়াতের গাঁ থেকে সরে এলো অয়ন্তী। মুখের সামনে পড়ে থাকা এলোমেলো চুলগুলোকে দু’হাত দিয়ে সরিয়ে হিংস্র দৃষ্টিতে তাকালো রাফায়াতের দিকে। ওড়নাটাকে ভালো করে বুকে জড়িয়ে নিলো। চোয়াল উঁচিয়ে বলল,,

“এই? আপনি এত অসভ্য কেন হ্যাঁ? এত হট হট করছেন কেন?”

“আপনি দেখতে হট তাই! উফফফস! আবারও হট হট লাগছে!”

“ইশশ! কী বিচ্ছিরি কথাবার্তা।”

“কে বলল বিচ্ছিরি এটা বিচ্ছিরি কথা? হট আবার বিচ্ছিরি ভাষা হয় কীভাবে? আমি তো জানি হট খুবই কমন ভাষা। আমার মত হ্যান্ডসাম ছেলের কাছে খুবই কমন! আমাকে দেখার পর সব মেয়েদের মুখে শুধু হট শব্দটা উঠেই থাকে!”

“কথায় কথায় শুধু হ্যান্ডসাম আর হ্যান্ডসাম করছেন কেন? আপনি জানেন? আমার অনিক ভাই আপনার চেয়ে কতটা হ্যান্ডসাম?”

“ওহ্ আই সি! তো বলো কতটা হ্যান্ডসাম?”

“ওয়েট ছবি দেখাচ্ছি!”

পার্স থেকে অয়ন্তী তার সেলফোনটি বের করল। গ্যালারী ঘেঁটে অনিকের ফরমাল লুকের একটি সুন্দর ছবি বের করল। রাফায়াতের মুখের কাছে ফোনটি ধরে বেশ অহংকার নিয়ে কড়া গলায় বলল,,

“দেখুন দেখুন। আমার বফ কতটা হ্যান্ডসাম! আপনার চেয়ে দ্বিগুন হ্যান্ডসাম।”

অয়ন্তীর হাত থেকে ফোনটি ছোঁ মেরে কেড়ে নিলো রাফায়াত। শান্তশিষ্ট মুখমণ্ডল তার মুহূর্তের মধ্যেই অশান্ত হয়ে উঠল৷ চোখে-মুখে অঢেল রাগ ফুটে উঠল। নাকের ডগা ক্রমশ লাল হতে লাগল। হাত-পা কচলাতে লাগল। অনিকের হাসোজ্জল ছবিটির দিকে তাকিয়ে ক্ষোভ ঝেড়ে বলল,,

“অতিরিক্ত হ্যান্ডসাম ছেলেরা যে অতিরিক্ত রকমের ক্যারেক্টারলেস হয় জানো তুমি?”

রাগে বিক্ষুব্ধ হয়ে অয়ন্তী রাফায়াতের হাত থেকে ফোনটি কেড়ে নিলো। রাগে গজগজ করে বলল,,

“কে বলল আমার অনিক ক্যারেক্টারলেস হ্যাঁ? শুনুন? মেপে ঝেপে কথা বলবেন আমার সাথে। অনিকের নামে উল্টো পাল্টা কথা তো ভুলেও নয়। আমারই ভুল হয়েছে! অনিকের ছবিটা আপনাকে দেখানো। জেলাসী থেকে আপনি এমন করছেন। আজ বুঝতে পারলাম ছেলেরাও জেলাসী হয়।”

অয়ন্তীর কথার মধ্যে হুট করেই বাস থেমে গেল। তিনজন মাঝবয়সী ছেলে তাড়াহুড়ো করে বাসে উঠে পড়ল। বাসে উঠেই তারা সিট খুঁজতে আরম্ভ করল। তাদের আড়চোখে দেখামাত্রই ঘাবড়ে উঠল রাফায়াত! হুডির টুপিটা যদিও তার মাথায় তবুও সে বাড়তি নিরাপত্তার জন্য অয়ন্তীর পারমিশন ছাড়াই অয়ন্তীর ওড়নার আঁচলটি তার মুখের উপর মেলে ধরল! ছেলেগুলো রাফায়াতের সিটের সামনে আসতেই অয়ন্তী অতিষ্ট হয়ে রাফায়াতের মুখ থেকে ওড়নাটি সরিয়ে নেওয়ার পূর্বেই রাফায়াত অয়ন্তীর হাত টেনে ধরে অয়ন্তীকে তার বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো! ঘটনার আকস্মিকতায় ভড়কে উঠল অয়ন্তী। আর কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার পরিস্থিতিতে রইলনা। অজানা ভয়ে রাফায়াতের হার্ট দ্রুত গতিতে বিট করতে লাগল! অয়ন্তী কান পেতে সেই হার্টবিটের আওয়াজ শুনছিল। ছেলেগুলো একবার অয়ন্তী এবং রাফায়াতের দিকে চোখ ঘুরিয়ে তাকালো। দুজনকে চিপকু অবস্থায় দেখে মিটিমিটি হেসে তারা পেছনের দিকে চলে গেল। পেছনের ফাঁকা সিট গুলোতে তিনজন চাপাচাপি করে বসল। গাড়ি ছেড়ে দিতেই রাফায়াত তাড়াহুড়ো করে অয়ন্তীকে তার বুক থেকে ঠেলে সরিয়ে দিলো! অপমানিত বোধ করল অয়ন্তী। মৃদু চিৎকার করার পূর্বেই রাফায়াত মুখ থেকে ওড়নাটি সরিয়ে অয়ন্তীর মুখটি হালকা ভাবে চেপে ধরল। কর্ণতলে ঠোঁট ঠেকিয়ে গুঞ্জন তুলে বলল,,

“একটু চুপ থাকো প্লিজ। এতে যেমন তোমারও ভালো হবে, তেমনি আমারও।”

চোখ দুটো প্রকাণ্ড করে অয়ন্তী উম উম করতে লাগল। ইশারায় বুঝাতে লাগল তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। হাতটা সরিয়ে নিতে। পাশের সিট থেকে লোকজন কটু দৃষ্টিতে রাফায়তের দিকে তাকাচ্ছিল। ঝামেলা বাড়তে পারে সেই ভয়ে রাফায়াত চট করে অয়ন্তীর মুখ থেকে হাতটি সরিয়ে নিলো। গলা খাঁকিয়ে কিঞ্চিৎ নড়েচড়ে বসল। বিড়বিড় করে কাশতে থাকা অয়ন্তীকে বলল,,

“বাস থামলেই কিন্তু আমার পেছনে পেছনে হাঁটা ধরবে। মুখ থেকে একটা টু শব্দও বের করবেনা।”

অয়ন্তী কী বলবে ভেবে পাচ্ছিলনা। কেবল আক্রোশিত দৃষ্টিতে রাফায়াতের অস্থির মুখমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে রইল। এই মুহূর্তকে রাফায়াতকে খু”ন করতে ইচ্ছে করছিল তার। তবে ব্ল্যা”ক”মোইলিংয়ের ভয়ে চুপ হয়ে রইল! পাঁচ থেকে দশ মিনিটের মধ্যে বাস এসে অয়ন্তীদের এলাকায় থামল। হুডির টুপিটা ভালো করে মাথায় পড়ে রাফায়াত চ্যালচ্যালিয়ে হেঁটে বাস থেকে নেমে গেল। জানালার কাঁচ দ্বারা ঐ তিনটি ছেলেকে রাফায়াত আড়চোখে দেখল। অস্ফুটে সুরে বলল,,

“ড্যাম ইট। ইয়াদের কাজিনরা এখানে কী করছে? অনিক আবার তাদের হায়ার করলনা তো? এমন কিছু হলে তো অয়ন্তীকে একটা ছেলের পাশে দেখলে ওরা অভেয়সলি রিয়েক্ট করত। আই থিংক অয়ন্তীকে তারা চিনতে পারেনি! যাই হোক, আমাকে এবার থেকে সতর্ক থাকতে হবে। আমি যে অনিকের এলাকাতেই আছি তা কাউকে বুঝতে দেওয়া যাবেনা!”

রাফায়াতের পিছু পিছু বাস থেকে নেমে পড়ল অয়ন্তী। রাফায়াতের ঠিক পেছনের দিকটায় দাঁড়িয়ে সে রণরঙ্গিণী ভাব নিলো। কোঁমড়ে দুহাত গুজে মুখের আদল যতটা সম্ভব কুঁচকে নিলো। খরতর গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“এই আপনার সমস্যাটা কী হ্যাঁ? সমস্যাটা কী? বাসের মধ্যে ওভাবে আমার মুখ চেপে ধরেছিলেন কেন? কেনই বা আমার ওড়নার আঁচল আপনার মুখের উপর ধরে রেখেছিলেন? কারণ কী এসবের হ্যাঁ? কারণটা কী? এমন একটা ভাব নিচ্ছিলেন মনে হচ্ছিল যেন আমি আপনার গার্লফ্রেন্ড!”

“ইশশশ! হবে নাকি আমার গার্লফ্রেন্ড?”

ঠোঁট কামড়ে রাফায়াত কথাটা অয়ন্তীকে জিজ্ঞেস করল! মুখমণ্ডলে ফুটিয়ে তুলল দুশ্চরিত্রের ছাপ! প্রচণ্ড রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল অয়ন্তী। গিজগিজিয়ে ওঠে রাফায়াতের একদম মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। রূঢ় স্বরে বলল,,

“এই আপনি এত লু’চ্চা কেন হ্যাঁ? এত লু’চ্চা কেন? আমার বয়ফ্রেন্ড আছে জানা সত্ত্বেও আমার সাথে লুচ্চামি করছেন।”

মুহূর্তের মধ্যেই রাফায়াতের দুষ্টু মুখে অস্থিরতার ছাপ ফুটে উঠল। অধীর দৃষ্টিতে সে এদিক-ওদিক তাকিয়ে হুট করেই অয়ন্তীর সামনে থেকে সরে দাঁড়ালো। কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই সে দৌঁড়ে কোথায় যেন একটা হারিয়ে গেল! অয়ন্তী রাফায়াতকে তার দৃষ্টির সীমানায় আর ঠাওড় করতে পারলনা। ইতোমধ্যেই পেছন থেকে হঠাৎ অনিকের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো! অয়ন্তীর বুকটা কেমন যেন ধড়ফড়িয়ে উঠল। কোনো দিকে কালক্ষেপণ না করেই সে পিছু ঘুরে তাকালো। হাসতে হাসতে অনিক অয়ন্তীর দিকে এগিয়ে এলো! তাজ্জব বনে দাঁড়িয়ে থাকা অয়ন্তীর মুখপানে তাকিয়ে হাসি হাসি গলায় বলল,,

“হেই অয়ন্তী! তুমি এখানে কী করছ? চাচীমনি তো বলল তুমি বাসায় আছো!”

থতমত খেয়ে গেল অয়ন্তী। অবিলম্বেই মাথা নুইয়ে নিলো৷ আমতা আমতা স্বরে বলল,,

“ঐ তো অনিক বাড়িতেই যাচ্ছিলাম।”

“আচ্ছা চলো। আমরা বরং একসাথেই বাসায় যাই।”

অয়ন্তীর হাত টেনে ধরে অনিক পায়ে হেঁটে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। এইতো সামনেই অয়ন্তীদের বাড়ির মেইন গেট। অস্থির দৃষ্টিতে অয়ন্তী দৃষ্টি ঘুরিয়ে কেবল আশেপাশে তাকাচ্ছিল। রাফায়াত কোথায় গেল তাই তাকে গভীর চিন্তায় ডুবিয়ে দিলো!

,
,

আধভাঙা পুরোনো একটি গ্যারেজে আপাতত রাফায়াত পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে! একহাতে সিগারেট তার অন্যহাতে আরিফের শার্টের কলার! কপাল থেকে টপটপ করে র’ক্ত গড়িয়ে পড়ছে তার। আরিফের নাক থেকেও র’ক্ত পড়ে ফ্লোর ভেসে যাচ্ছে। সিগারেটটিতে সানন্দে একটি ফুঁক দিয়ে রাফায়াত শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল আরিফের দিকে। সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“এই? তুই জানিস না অয়ন্তী অনিকের গার্লফ্রেন্ড?”

আরিফ আধমরা অবস্থাতেই খুকখুক করে কেশে বলল,,

“জাজাজানি।”

“তাহলে ডিস্টার্ব করছিস কেন অয়ন্তীকে? কেন ফলো করছিলি আমাদের?”

“ধূর! অনিক সিরিয়াস নাকি অয়ন্তীকে নিয়ে! অনিকের তো এক মেয়েতে হয়না! তার প্রতিদিন নতুন নতুন মেয়ে চাই। কিছুদিন আগেও তো শুনলাম একটা মেয়েকে এবর্শন করানো হয়েছে। মেয়েটির নাম সম্ভবত প্রিয়া!”
#এক_খণ্ড_কালো_মেঘ
#পর্ব_৭
#নিশাত_জাহান_নিশি

“ধূর! অনিক সিরিয়াস নাকি অয়ন্তীকে নিয়ে! অনিকের তো এক মেয়েতে হয়না! তার প্রতিদিন নতুন নতুন মেয়ে চাই। কিছুদিন আগেও তো শুনলাম একটা মেয়েকে এবর্শন করানো হয়েছে। মেয়েটির নাম সম্ভবত প্রিয়া!”

অবিলম্বেই আরিফের শার্টের কলারটি ছেড়ে দিলো রাফায়াত। সিগারেটের জ্বলন্ত বাকী অংশটুকু নির্দ্বিধায় তার বাঁ হাতের তালুতে চেপে ধরল! মাথা নুইয়ে সে জংলী সাপের ন্যায় ফোঁস ফোঁস শব্দে গোঙাতে লাগল। গাঁ থেকে দরদরিয়ে ঘাম ঝাড়তে লাগল তার। মুখের আদলে যদিও ব্যথার ছাপ গাঢ়ভাবে স্পষ্ট নয় তবে ভেতরের অকথিত যন্ত্রণা গুলো যেন প্রগাঢ়ভাবে স্পষ্ট হতে লাগল। এই যন্ত্রণা ঠকে যাওয়ার যন্ত্রণা! এই যন্ত্রণা নিজের প্রতি নিজের জমতে থাকা ঘৃণার যন্ত্রণা! কাছের মানুষরা বেইমানি করলে তখন ম’রা আর বাঁচার মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকেনা! নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে জোর করে যখন একটা সম্পর্কে যাওয়ার পর এভাবে ঠকে যেতে হয় তখন সেই ঠকে যাওয়াটা মানুষকে আর বাঁচতে দেয়না!

আরিফ তাজ্জব বনে গেল। আহত শরীর নিয়ে সে হকচকিয়ে রাফায়াতের দ্বিখণ্ডিত মুখের পানে তাকিয়ে রইল। ক্ষুধার্ত বাঘের হিংস্র থাবা থেকে ছাড়া পেয়ে এই মুহূর্তে তার তো এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু না। সে তো হতবিহ্বল দৃষ্টিতে কেবল রাফায়াতকেই দেখছে! গোঙানির শব্দগুলো যেন গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। আরিফের কান দুটো সেই গভীর শব্দের আওয়াজ সইতে পারছেনা। ফেটেফুটে যাচ্ছে। বেশিক্ষণ শরীরের অস্থিরতা চেপে রাখতে পারলনা আরিফ। কানে দু’হাত চেপে তাৎক্ষণিক সে মুখ খুলল। মৃদু আওয়াজে শুধালো,,

“কী হয়েছে ভাই? আপনি হঠাৎ এভাবে গোঙাচ্ছেন কেন?”

মুহূর্তের মধ্যেই মাথাটা ঝাঁকিয়ে তুলল রাফায়াত। ঘামে লেপ্টে থাকা মাথার চুলগুলো পোঁড়া হাতটি দ্বারা সুশৃঙ্খলভাবে গুছিয়ে নিলো। নাক টেনে শ্বাস -প্রশ্বাস ছাড়ল। রক্তিম চক্ষুজোড়া অচিরেই স্বাভাবিক করে তুলল। পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে নিজেকে যতখানি শান্ত করা প্রয়োজন রাফায়াত নিজেকে ঠিক ততখানিই শান্ত করল। স্থির দৃষ্টিতে আরিফের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল৷ ভাবশূণ্য গলায় আরিফকে শুধালো,,

“আচ্ছা? তুই আমার একটা হেল্প করতে পারবি?”

“কী হেল্প?”

“অনিক সম্পর্কে সব ডিটেইলস আমাকে দিতে পারবি?”

“কিন্তু কেন? অনিক সম্পর্কে আমি কেন আপনাকে সব ডিটেইলস দিতে যাব? কে হন আপনি অনিকের?”

“কেউ নাহ্! জাস্ট আগ্রহ থেকে বললাম। যদি তুই আমার শর্ত মেনে নি তো আমিও এক্ষণি এই মুহূর্তে তোকে ছেড়ে দিব।”

“ধরলেন কই? ছেড়েই তো দিলেন। আমি এখন দৌঁড়ে এখান থেকে পালাব!”

চোখের পলকেই আরিফ যেইনা স্থান পরিত্যাগ করে দৌঁড়ে পালাতে যাবে অমনি রাফায়াত পেছন থেকে আরিফের কোমড় পেঁচিয়ে ধরল! দাঁতে দাঁত চেপে হুড়মুড়িয়ে বলল,,

“এবার পালিয়ে দেখা! রাফায়াত যাকে ধরে তাকে ছাড়তে জানেনা।”

রাফায়াতের দানবীয় শক্তির কাছে আরিফ অতি তুচ্ছ! খামোশ খেয়ে গেল আরিফ। প্রাণপনে যদিও চেষ্টা করছিল রাফায়াতের কবল থেকে ছাড়া পাওয়ার তবে সেই সব চেষ্টা তার বৃথা ঠেকছিল। উপায় বুদ্ধি খুঁজে না পেয়ে আরিফ ভয়ার্ত গলায় হিংস্র রাফায়াতকে বলল,,

“ভাই ভাই। আমি আপনার শর্তে রাজি। প্লিজ বলুন অনিক সম্পর্কে আপনার কী কী ডিটেইলস চাই?”

পৈশাচিক হাসল রাফায়াত! আরিফকে টানতে টানতে গ্যারেজের একটি কোণায় এনে বসালো। রাফায়াত নিজেও আরিফের কাঁধে হাত ঝুলিয়ে আরিফের পাশে আরামচে বসল। শান্ত স্বরে বলল,,

“সব বল। অনিক সম্পর্কে যা যা জানিস সব বল। আর শুন? রাস্তাঘাটে এসব সস্তা ইভটিজিং করা বন্ধ কর। তোর মত হ্যান্ডসাম একটা ছেলেকে এসব করা মানায় না!”

নিশ্চল দৃষ্টিতে আরিফ শান্ত রাফায়াতের দিকে তাকালো। এই প্রথম কারো উপদেশ আরিফের কাছে এতটা ভালো লাগল! রাফায়াতকে তার আপন মনে হতে লাগল। এই বুঝি তার আপন কেউ তার পাশে বসে রইল!

,
,

বাড়ি ফিরেই অনিক প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করতে লাগল অয়ন্তীকে। মাথা নুইয়ে অয়ন্তী কেবল হু হা করতে লাগল। অনিকের এসব কড়া কড়া প্রশ্নের ভঙ্গিতেই বুঝা যাচ্ছে অনিক বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে আছে অয়ন্তীর প্রতি! তাই চুপচাপ বসে এখন হ্যাঁ বা না তেই প্রশ্নের উত্তর সীমাবদ্ধ রাখা শ্রেয়। শেষবারের মত অনিক অয়ন্তীর দিকে কঠিন এক প্রশ্ন ছুড়ল। ঠাণ্ডা মাথায় শুধালো,,

“কাল রাতে স্টোর রুমে তোমার সাথে কে ছিল?”

ভড়কে উঠল অয়ন্তী। ওড়নার আঁচল পেঁচানো বন্ধ করে সে বিস্ফোরিত দৃষ্টি ফেলল অনিকের আগ্রাসী চোখের দিকে। শুকনো ঢোঁক গিলে জবাবে বলল,,

“মামানে?”

“হোয়াটস ইউর প্রবলেম হ্যাঁ? এভাবে সাডেন আঁতকে উঠলে কেন? স্টোররুমে তো তোমার একা থাকার কথা নয়। তাও আবার একটি অপরিত্যক্ত, অপরিচ্ছন্ন, অন্ধকার রুমে। সাথে কে ছিল বলো?”

রাগে গাঁ রি রি করে উঠল অয়ন্তীর। তৎক্ষনাৎ সে জায়গা ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালো। অনিকের প্রশ্নবিদ্ধ চোখে গরম দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। গলা উঁচিয়ে বলল,,

“শাট ইউর মাউথ অনিক ভাই। তোমার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে বলে যে তুমি যখন তখন আমার চরিত্র সস্পর্কে যা তা বলবে তা কিন্তু হবেনা! সিরিয়াসলি আমি মানব না এসব। স্টোর রুমে আমি কোনো কারণে আটকা পড়ে গিয়েছিলাম ঠিকই তবে আমার ন্যাচার এতটাও খারাপ নয় যে আমি অন্য কারো সাথে একা একটা রুমে রাত কাটাব! নেক্সট টাইম তুমি আমার সম্পর্কে এসব ফাউল কথা তুলেছ তো এর ফল কিন্তু খারাপ হবেনা এই বলে দিলাম!”

হনহনিয়ে রুম থেকে প্রস্থান নিলো অয়ন্তী। অনিক চোঁয়াল উঁচিয়ে অয়ন্তীর যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। সামনে থাকা টি-টেবিলটিতে সজোরে এক লাথ মারল! দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল,,

“এর অহংকার ভাঙতে হবে আমার! ডে বাই ডে মুখের উপর কথা বলা শিখে যাচ্ছে। যত আর্লি পসিবল এর দফারফা করতে হবে।!”

,
,

সন্ধ্যা গড়িয়ে আসতেই অনিক আবারও চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। মূলত এক লক্ষ টাকার একটি চেক সাইন করাতেই অনিক ঢাকায় এসেছিল! তার স্বার্থ হাসিলের জন্যই অয়ন্তীর কাছে এসেছিল। অয়ন্তীও কিছু না বুঝে শুনেই সেই চেকে নির্বোধের মত সাইন করে দিয়েছিল। অতিরিক্ত বিশ্বাসের ফল এসব! যা এখনও অবধি অয়ন্তী এবং তার পরিবার টের পায়নি! অনিকের বের হওয়ার পর পরই আলিজা এবং রাফায়াত অপ্রত্যাশিতভাবেই অয়ন্তীদের বাড়িতে ঢুকে! মূলত আলিজার জোরাজুরিতেই রাফায়াতের এই বাড়িতে আসা। যদিও রাফায়াত সুযোগ খুঁজছিল কখন এই বাড়িতে আসবে! পুরোনো কিছু হিসাব নিকাশ বাকি আছে তার! সন্ধ্যার পর আলিজা একা বাড়ি থেকে তেমন বের হয়না। যেহেতু রাফায়াত আছে তাই এই ভর সন্ধ্যায় তার বাড়ি থেকে বের হওয়া।

ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করতেই অয়ন্তীর মা আলিজা এবং রাফায়াতকে দেখে বেশ ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। ট্রে ভর্তি চা নাশতা সাজিয়ে দিলেন। আলিজা এবং রাফায়াতের সাথে বসে জমিয়ে অনেকক্ষণ আড্ডা দিলেন। আলিজার এবং রাফায়াতের আসার খবরটা অয়ন্তী এখনো পায়নি! অতিরিক্ত ঘুমে বুদ হয়ে আছে সে! কিছুক্ষণ গল্প-গুজবের পর অয়ন্তীর মা অয়ন্তীকে ঘুম থেকে ডেকে দিলেন। আলিজা এবং রাফায়াতকে দেখে যেন অয়ন্তী আকাশ থেকে পড়ল! খুশিতে প্রায় আত্মহারা হয়ে উঠল।

অয়ন্তীর রুমে ঢুকেই রাফায়াত প্রথমে পুরো রুমটিতে শকুনের দৃষ্টি নিক্ষেপ করল! দৃষ্টি ঘুরিয়ে আবার সর্তক দৃষ্টি ফেলল অয়ন্তীর দিকে। হুট করেই অয়ন্তীর বাঁ গালের দিকে নজর পড়ল তার। কেমন যেন কালসিটে দাগ পড়ে গেছে তার বাঁ গালটিতে! ব্যস্ত হয়ে উঠল রাফায়াত। বুকের ভেতর প্রলয়ঙ্করী ঝড় বইতে লাগল! আলিজার কাছ থেকে রাফায়াত অয়ন্তীকে টেনে আনল। স্বচ্ছ দৃষ্টি ফেলল অয়ন্তীর সমস্ত মুখমণ্ডলে। ধক করে উঠল বুকটা তার। পুরোনো ক্ষত জমাট বাঁধতে লাগল। বাঁ গালের কাছটিতে তৎপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে উত্তেজিত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কী হয়েছে তোমার গালে হ্যাঁ? কালসিটে দাগ কেন?”

বিষয়টিকে খুব নিঁখুতভাবে এড়িয়ে যেতে চাইল অয়ন্তী। উল্টোদিকে ঘুরে দাঁড়ালো সে। মাথা নুইয়ে স্তব্ধ গলায় বলল,,

“কোথায় কীসের দাগ? কী যা তা বলছেন আপনি? তাছাড়া আমার দিকে এভাবে ঘুরে তাকানোর অধিকার নেই আপনার। এমন হুটহাট হাত ধরে টানাটানিরও অধিকার নেই।”

অয়ন্তীর নিষেধ শুনলনা রাফায়াত! পুনরায় অয়ন্তীকে হেঁচকা টানে তার দিকে ঘুরিয়ে নিলো। চোখের গরম যেন কমছিলই না তার! বেগতিক বাড়ছিল। ভেতরটাও কেমন নিগূঢ়ভাবে খাঁ খাঁ করছিল। বিষাদে আর্বতিত হয়ে উঠছিল মনের শহর। দু’বছর আগের জমানো গভীর অনুভূতি গুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠছিল! উত্তেজিত গলায় অয়ন্তীকে শুধালো,,

“অনিক তোমার গাঁয়ে হাত তুলেছে?”

অতিমাত্রায় অবাক হলো অয়ন্তী। কেন যেন রাফায়াতকে তার পূর্ব পরিচিত বলে মনে হচ্ছিল! এই যে চোখে-মুখে আকাশ সমান অস্থিরতা তা যেন তার অনেক আগে থেকেই চেনা! তৎক্ষণাৎ মাথাটা ঝাঁকালো অয়ন্তী। শুষ্ক গলায় বলল,,

“এটা আমাদের পার্সোনাল ম্যাটার। আপনি কে হ্যাঁ নাক গলানোর?”

“আমি অনেককিছু হই নাক গলানোর! অনেক কিছুই হই। অনিক আমাকে বলেছিল সে তোমাকে অনেক ভালোবাসে। তার চোখে-মুখে আমি সেই ভালোবাসা দেখেছিলাম। ট্রাস্ট করেছিলাম আমি তাকে। নিজের থেকেও বেশী। আজ সবকিছু জানতে পেরে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে অয়ন্তী! খুব বেশী অপরাধী মনে হচ্ছে!”

#চলবে…?
#চলবে???

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here