এক খণ্ড কালো মেঘ পর্ব -৪৫

#এক_খণ্ড_কালো_মেঘ
#পর্ব_৪৫
#নিশাত_জাহান_নিশি

“হায়রে পাগলী এটাও বুঝলে না? জ্বর থেকে জ্বর ঠোঁসা ফুটেছে তোমার ঠোঁটে! আদারওয়াইজ আর কিছু হয়নি আমাদের মধ্যে। এত বোকা কেন তুমি হ্যাঁ?”

অবিলম্বেই রাফায়াতের শার্টের কলার ছেড়ে দাঁড়ালো অয়ন্তী। দ্বিধা-দ্বন্ধে জর্জরিত হয়ে সে রাফায়াতকে ডিঙিয়ে ড্রেসিং টেবিলের মুখোমুখি দাঁড়ালো। রাফায়াতের কথা কতটা সত্যি তা যাচাই করতে গেল। যদিও রাফায়াতের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস আছে তার তবুও মনের খচখচানি থেকে বাছবিচার করতে যাওয়া। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ঠোঁসাটিকে দেখল অয়ন্তী। আসলে-ই ভুল কিছু বলেনি রাফায়াত! সত্যিই জ্বর ঠোঁসা ফুটেছে তার। জায়গাটা কেমন পানি পানি হয়ে আছে। ঈষৎ লালও হয়ে আছে। কেমন যেন বিচিত্র দেখাচ্ছে তাকে! দেখেই মুখ ফিরিয়ে নিতে ইচ্ছে করছে। দ্বিতীয়বার আর আয়নার দিকে তাকাতে ইচ্ছে করলনা তার! ঠোঁটে হাত রেখে সে ঘুরে দাঁড়ালো রাফায়াতের দিকে। অবুঝের মত নাকমুখ কুঁচকে নাটকীয় কান্নায় ভেঙে পড়ল। ঠোঁট উল্টে বলল,,

“কেমন উইয়ার্ড দেখাচ্ছে আমাকে! এই ফেইস নিয়ে আজ আর বাড়ি থেকে বের হওয়া যাবেনা!”

অদ্ভুত মুখভঙ্গিতে রাফায়াত অয়ন্তীর দিকে তাকালো। কোমড়ে হাত গুজে সে ভ্রু যুগল বেশ খরতর ভাবে কুঁচকালো। নির্বোধ গলায় অয়ন্তীকে বলল,,

“উইয়ার্ড দেখাচ্ছে কোথায়? একটু আগেই তো ভার্সিটি থেকে ঘুরে এলে! তখনও তো ঠোঁটের এই অবস্থা-ই ছিল। এখন হঠাৎ এই কথা? ঘন ঘন মুড অন অফ হয় কেন?”

“তখন তো এতটা ফোলা ছিলনা। দেখে কেউ বুঝতেও পারেনি আমার জ্বর ঠোঁসা ফুটেছিল। কিন্তু এখন তো ফোলে ফেঁপে ঢোল হয়ে গেছে ঠোঁটটা! আপনার সামনে দাঁড়াতেও আমার কেমন আনইজি লাগছে! অদ্ভুত লাগছে নিজেকে।”

কথাগুলো বলেই অয়ন্তী দু’হাত দ্বারা পাকাপোক্ত ভাবে তার ঠোঁসাযুক্ত ঠোঁটটি ঢেকে নিলো। অপ্রস্তুত দৃষ্টিতে সে রাফায়াতের দিকে তাকালো। লজ্জা করছে তার ঠোঁটের এই করুন দশা নিয়ে রাফায়াতের মুখোমুখি দাঁড়াতে! তব্ধ শ্বাস ফেলে রাফায়াত কোমড় থেকে তার হাত দুটি সরালো। এক’পা দু’পা করে অয়ন্তীর দিকে এগিয়ে এলো। অয়ন্তীর সম্মুখস্থ হয়েই সে ঝট করে অয়ন্তীর ঠোঁট থেকে হাতটি সরিয়ে নিলো! ভাবশূণ্য দৃষ্টিতে অয়ন্তীর ফোলা ঠোঁটের দিকে তাকালো। মুহূর্তেই অয়ন্তীর ঠোঁসাযুক্ত ঠোঁটে সে ছোটো করে চু’মু খেয়ে দিলো। ঘটনার আকস্মিকতায় অয়ন্তী ভড়কে উঠল৷ অমনি রাফায়াত অয়ন্তীর কোমড় প্যাঁচিয়ে ধরল। স্নিগ্ধ চাহনিতে অয়ন্তীর নির্বোধ দৃষ্টিতে তাকালো। শিথিল স্বরে বলল,,

“তুমি হয়ত ভাবছ ঠোঁটে সামান্য ঠোঁসা ফুটেছে বলে তোমাকে বড্ড অসুন্দর দেখাচ্ছে, বিশ্রী দেখাচ্ছে, তোমাকে এই অবস্থায় দেখলে বুঝি আমি মুখ ফিরিয়ে নিব! আমার ভালোলাগা, ভালোবাসা কমে যাবে, মুগ্ধতা কেটে যাবে। তুমি হয়ত ভুলে যাচ্ছ অয়ন্তী, আমি তোমার সৌন্দর্যের প্রেমে পড়িনি। দিন কী দিন তোমার আশেপাশে থাকতে থাকতে যে এক অদ্ভুত মায়ার সৃষ্টি হয়েছে না? আমি সেই অতি রঞ্জিত মায়ার প্রেমে পড়েছি! বড়ো অদ্ভুত অভেদ্য এই মায়া। শত জনমেও কাটবেনা। তোমার মুখের দিকে তাকালে আমি যে প্রশান্তি খুঁজে পাই না? তা কোনো ধলা চামড়ার মেয়ের দিকে তাকালেও পাইনা! ঐ যে, মায়া! তোমার মায়ায় আমি আজীবনের জন্য জড়িয়ে পড়েছি। তাই বলছি, তোমার মুখের সৌন্দর্য পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেলেও তোমার প্রতি মায়া আমার একরত্তিও কমবেনা। মানুষ ম’রে গেলেও কিন্তু মায়া থেকে যায়। তখন কিন্তু মনে থাকেনা ইশশ! মানুষটা কত সুন্দর ছিল, কতটা নিঁখুত দেখতে ছিল। তখন শুধু এটাই মনে পড়ে মানুষটার প্রতি আমার বড্ড মায়া ছিল! সেই মায়াবোধ থেকেই মানুষটাকে আমার প্রতিনিয়ত মনে পড়ে। জনে জনে তার কথা বলে বেড়াই। খুব সহজে আমরা তাকে ভুলতে পারিনা। মনের গহীনে থেকে যায়। তাই সবসময় মনে রাখবে যারা সত্যিকারের ভালোবাসবে তারা কখনো তোমার চেহারার সৌন্দর্য্য কমল না-কী বাড়ল সেদিকে মনযোগ রাখবেনা বরং তাদের মনোযোগ থাকবে শুধু তোমার শরীর, স্বাস্থ্য মিলিয়ে শুধু তুমিটার দিকে! তুমি ভালো আছো, সুস্থ্য আছো, নিরাপদে আছো, তার চোখের সামনে আছো, হেসেখেলে দিব্যি বেঁচে আছো শুধুমাত্র তোমার প্রয়োজনীয় দিকগুলোর দিকে তার মনোযোগ থাকবে। পরের বার থেকে এসব উদ্ভট চিন্তাভাবনা মনের ভুলেও মাথায় আনবে না। তুমি যেমন আমি তোমাকে ঠিক তেমনই ভালোবেসেছি। যদি সত্যিই সৌন্দর্যের প্রেমে পড়তে হত তাহলে কিন্তু পৃথিবীতে সুন্দরী মেয়ের অভাব ছিলনা।”

নিশ্চল দৃষ্টিতে অয়ন্তী কেবল রাফায়াতের নির্মল মুখশ্রীতে তাকিয়ে রইল। কথাগুলো যখন রাফায়াত বলছিল তখন কেমন যেন অদ্ভুত এক জ্যোতি কাজ করছিল রাফায়াতের সমস্ত মুখমণ্ডল জুড়ে! তার মুখের দিকে তাকিয়ে স্বস্তি খুঁজে পাচ্ছিল অয়ন্তী। ভালোবাসার মিনিংটাই যেন তার কাছে বদলে গেল! সাথে বিশ্বাসটাও দৃঢ় হলো যে রাফায়াত তাকে ছেড়ে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরি মেয়েটাও যদি আসে না? তার কাছেও যাবেনা। বরং অয়ন্তীর মায়া আঁকড়ে ধরে-ই আজীবন পাড় করে দিবে। অতি আবেগি হয়ে উঠল অয়ন্তী। চোখের কোণে অবাধ্য জলেরা চিকচিক করে উঠল তার। শান্ত রাফায়াতকে শক্ত বাহুডোরে জড়িয়ে ধরল সে। ক্রন্দনরত গলায় বলল,,

“আপনার প্রতিও আমার অতিরিক্ত মায়া কাজ করে রাদিফ। অতিরিক্ত বলতে অতিরিক্ত। আপনি আশেপাশে থাকলেও এক অদ্ভুত ধরণের শূণ্যতা কাজ করে! এ আবার কেমন অদ্ভুত মায়া বলুন? পাশে তো আপনি আছেনই তবুও কেন হৃদয়ে এত শূণ্যতা? নিদারুণ এক হাহাকার। উফফ। আমাকে ভেতর থেকে মে’রে দেয় এই হাহাকার।”

প্যান্টের পকেট থেকে তখনই রাফায়াতের ফোনটা সাইলেন্ট মোডে বেজে উঠল। এত রোমাঞ্চিত একটা মুহূর্তেও রাফায়াত বাধ্য হলো অয়ন্তীকে ছেড়ে ফোন কলসটিকে প্রাধান্য দিতে। ব্যাপারটায় বেশ বিরক্তবোধ করল অয়ন্তী। তার থেকে ফোন বেশি ইম্পর্টেন্ট হয়ে গেল? স্ক্রীণে অয়ন্তীর বাবার নাম্বারটি জ্বলজ্বল করে উঠল। দ্রুত রাফায়াত কলটি তুলল। ব্যস্ত গলায় সালাম জানিয়ে বলল,,

“আঙ্কেল আমি আসছি। জাস্ট টেন মিনিটস সময় দিন আমায়।”

“হারি আপ রাফায়াত। আধ ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছাতে হবে তোমাকে। মোটামুটি ভাইভার একটা প্রিপারেশন নিয়ে এসো। বাই অ্যানি চান্স যদি ভাইভা নেওয়া হয় তাই।”

“আলহামদুলিল্লাহ্ মোটামুটি প্রিপারেশন আছে আঙ্কেল। বাকিটা কাজে ক্ষেত্রে দেখা যাবে। আপনি চিন্তা করবেন না আমি আসছি।”

দ্রুত বেগে কলটি কেটে দিলো রাফায়াত। কান থেকে ফোনটি সরিয়ে সে অশান্ত চিত্তে পকেটে ফোনটি রাখল। কৌতূহলী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অয়ন্তীর দিকে সে হম্বিতম্বি দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। খানিক কুঁচকে যাওয়া শার্টের কলারটি ঠিক করে ঝটপট গলায় অয়ন্তীকে বলল,,

“ভাইভা আছে আমার। তোমার বাবা হঠাৎ ফোন করে বললেন। আল্লাহ্ চাইলে হয়ত চাকরীটা হয়েও যেতে পারে। তাই খবরটা তোমাকে জানাতে আসা। বাই দ্যা ওয়ে, প্রে ফর মি ওকে? বাই।”

ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে রাফায়াত অয়ন্তীকে উপেক্ষা করে দরোজার দিকে অগ্রসর হতেই অয়ন্তী দৌঁড়ে এসে রাফায়াতের মুখোমুখি দাঁড়ালো! যাত্রা পথে রাফায়াতকে আটকে দিলো। মুহূর্তেই ভুবন ভুলানো হাসি দিয়ে সে টাইট করে রাফায়াতের কপালে গভীর এক চু’মু এঁকে দিলো! তৎক্ষনাৎ রাফায়াতকে জড়িয়ে ধরে প্রেমেসিক্ত নিবিড় গলায় বলল,,

“অল দ্যা বেস্ট পরাণ। টু বি কনফিডেন্ট ওকে?”

স্মিত হাসল রাফায়াত। ঈষৎ ঝুঁকে অয়ন্তীর মাথায় উষ্ণ চু’মু এঁকে দিলো। অয়ন্তীর দুষ্টু মিষ্টি আচরণে খুশি হয়ে সে আচ্ছন্ন গলায় বলল,,

“আই উইল বি ট্রাই মাই বেস্ট পরাণ। জাস্ট প্রে ফর মি।”

রাফায়াতকে ছেড়ে দাঁড়ালো অয়ন্তী। শেষবারের মত অয়ন্তীর দিকে একবার প্রেমময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাফায়াত অয়ন্তীর রুম থেকে প্রস্থান নিলো। বেশ খুশি মনেই অয়ন্তী রাফায়াতকে বিদায় দিলো। সিঁড়ি বেয়ে রাফায়াত নিচে নামতেই আপত্তি থাকা সত্ত্বেও অয়ন্তীর মায়ের অনুরোধে একটুখানি মিষ্টি মুখ করতে বাধ্য হলো। তড়িঘড়ি করে আবারও অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। বাসে ওঠে সে প্রতিটা মুহূর্তে প্রতিটা সেকেন্ডে প্রাণ ভরে আল্লাহ্’র নাম যপ করেছে। চাকুরীটা সে মন থেকে চাইছে। যেনো তেনো প্রকারেই হোক চাকুরীটা যেন তার হয়ে যায়। অন্তত এবার যেন একটুখানি সুখের দেখা পায় সে।

প্রায় দশ মিনিট পর বাস থেকে নেমে পড়ল রাফায়াত। রাস্তার এদিক ওদিক সর্তক দৃষ্টি ফেলে রিকশা খুঁজতে লাগল। তাড়াহুড়োর জন্য দুই থেকে তিন মিনিটের রাস্তাও সে রিকশায় চেপে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো! যদিও তার হাতে আরও পনেরো মিনিটের মত সময় আছে। তবুও সে চাইছে পাংচুয়াল থাকতে। সময়ের অনেক আগেই অফিসে পৌঁছাতে। অচিরে সেই চাওয়াটাই যেন তার কাল হয়ে দাঁড়ালো। কোথা থেকে যেন সাইক্লোনের বেগে ইতি ছুটে এলো! হাতে তার মাখোঁ মাখোঁ র*ক্ত! সাদা জামার কিছু কিছু অংশেও র*ক্তের দাগ স্পষ্ট। দেখতে কেমন যেন বি’ক্ষি’প্ত দেখাচ্ছে তাকে। ভীষণ ঘাবড়ে আছে এমন মনে হচ্ছে। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেই রাফায়াত উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে ইতির দিকে তাকালো। উদগ্রীব গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“হোয়াট হেপেন্ড?”

পর পর রুদ্ধশ্বাস ফেলতে লাগল ইতি। রাফায়াতের দিকে বিশৃঙ্খল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। হাঁপিয়ে ওঠা গলায় বলল,,

“প্লিজ হেল্প মি প্লিজ।”

“কী হেল্প? কীসের হেল্প? কী হয়েছে আপনার?”

“আমার কিছু হয়নি। হয়েছে আমার ফ্রেন্ডের। এ’ক্সি’ডে’ন্ট করেছে সে। প্লিজ হেল্প মি।”

“কোথায় আপনার ফ্রেন্ড? কীভাবে এ’ক্সি’ডে’ন্ট হয়েছে?”

“রিকশা থেকে হঠাৎ পড়ে গেছে। প্লিজ আমাকে হেল্প তাকে হসপিটালে নিয়ে যেতে।”

দোটানায় পড়ে গেল রাফায়াত! মাথায় হাত চলে গেল তার। দুঃশ্চিন্তা ক্রমশ বাড়তে লাগল। এখন কী করবে সে? স্বার্থপরের মত নিজের কাজে চলে যাবে না-কী ইতিকে হেল্প করবে? তবে এখানেও একটা কথা আছে। রাস্তায় এত শত শত লোকজন থাকতে ইতি কেন বেছে বেছে তার কাছেই হেল্পের জন্য দৌঁড়ে এলো? কিংবা আশেপাশে তো কোথাও তার ফ্রেন্ডতে দেখা যাচ্ছেনা? তার মানে কী ইতি মিথ্যা বলছে? ছলনা করছে তার সাথে? শুভ কাজে তাকে আটকে দেওয়ার জন্য ষ’ড়য’ন্ত্র করছে? যাই হোক, ইতিকে একবার বাজিয়ে দেখা যাক। এমনি এমনি ছেড়ে দেওয়া যাবেনা ইতিকে। দুঃশ্চিন্তা কাটিয়ে রাফায়াত স্বাভাবিক ভাব নিলো। কপাল কুঁচকে ইতির দিকে সূচালো দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ঝেড়ে কেশে সংকীর্ণ গলায় বলল,,

“কোথায় আপনার ফ্রেন্ড? তাকে তো কোথাও দেখছিনা।”

ইতি করুন দৃষ্টিতে রাফায়াতের দিকে তাকালো। চোখে ভরাট জল নিয়ে কাতর গলায় বলল,,

“সামনের গলিতেই আছে। প্লিজ হেল্প আস।”

“রাস্তায় এত এত মানুষ থাকতে আপনি আমার কাছেই কেন হেল্প চাইতে এলেন? মতলবটা কী আপনার?”

“আমার কোনো মতলব নেই প্লিজ বিশ্বাস করুন। রাস্তায় কোনো লোক আমাদের হেল্প করতে চাইছেনা। সবাই নিজেদের কাজে ব্যস্ত। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু রঙ দেখছে। বিশ্বাস না হলে আমার সাথে আসুন প্লিজ।”

ইতির এসব মন ভুলানো কথা যদিও রাফায়াত বিশ্বাস করছিলনা তবুও সে সন্দেহ এবং কৌতূহল থেকে ইতির পেছনে পেছনে গেল সামনের গলিতে। সত্যিই তার ফ্রেন্ড রাস্তার একপাশে পড়ে পায়ের ব্য’থায় কা’তরা’চ্ছে! আশেপাশের লোকজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছে কিন্তু কেউ তাকে হেল্প করতে আসছেনা! কেউ কেউ আবার তাকে ডিঙিয়ে নিজেদের কাজেকর্মে ছুটে যাচ্ছে! টাকনুর উপরের অনেকখানি অংশ কে’টে গেছে মেয়েটির। মনে হচ্ছে চার থেকে পাঁচটি সে’লাই লাগবে! র*ক্তে হাত-পা ভেসে গেছে মেয়েটির। অবস্থা প্রায় সূচনীয়। এভাবে ব্লা’ডিং হতে থাকলে খারাপ কিছু ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। স্বার্থপর হতে পারল না রাফায়াত! মায়া কাজ করতে লাগল তার। বিবেকে বাঁধতে লাগল। নিজের আপন বোন হলে নিশ্চয়ই রাফায়াত তাকে এভাবে রাস্তাঘাটে কু’কু’রের মত ফেলে দিয়ে যেত না! বিপদে পাশে দাঁড়াত। অটো ডেকে সে মেয়েটিকে নিয়ে এবং ইতিকে নিয়ে সামনের হসপিটালে গেল।

এদিকে অয়ন্তীর বাবা অনবরত কল করে চলছে রাফায়াতকে! উনার পরিচিত অফিসাররা সব বসে আছেন রাফায়াতের ভাইভা নিতে! অয়ন্তীর বাবা চেয়েছিলেন উনার হবু মেয়ে জামাইকে উনার কোম্পানিতেই ভালো কোনো পোস্টে রাখতে। কিন্তু রাফায়াত চাইছিল তার নিজের চেষ্টায়, নিজের উদ্যোগে কিছু করতে! কেউ যেন বলতে না পারে সে শ্বশুড়ের আশ্রয়ে, শ্বশুড়ের টাকায় কিংবা শ্বশুড়ের ভরসায় বেঁচে আছে! তাই রাফায়াতের আত্নসম্মানের দিকটা বিচার করেই অয়ন্তীর বাবা উনার প্রতিবেশী কোম্পানিতে রাফায়াতকে চাকুরী দেওয়ার চেষ্টা করছেন। স্বল্প পরিসরে হলেও রাফায়াতের পাশে থাকার চেষ্টা করছেন।

মেয়েটিকে হসপিটালে নেওয়ার পর ধরাধরি করে ডক্টরের চেম্বারে নেওয়া হলো। সত্যিই তার কাঁটা জায়গাটিতে পাঁচটি সেলাই লাগল! আধঘণ্টা সময় এখানেই ব্যয় হয়ে গেল। এরমধ্যেই রাফায়াত প্রায় অনেকবার খেয়াল করল মেয়েটি যেন ইতিকে সহ্যই করতে পারছেনা! ইতির ছোঁয়া বরাবরই তার কাছে বিরক্তিকর লাগছে! ব্যাপারটি সন্দেহজনক মনে হতেই রাফায়াত মেয়েটিকে নিয়ে চেম্বার থেকে বের হয়ে চেম্বারের বাইরে বসল। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ইতির দিকে একবার ভাবলেশ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে ব্য’থায় কাতরাতে থাকা মেয়েটির দিকে স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। নমনীয় গলায় শুধালো,,

“সুস্থ আছেন এখন?”

আ’হ’ত গলায় মেয়েটি প্রত্যত্তুরে বলল,,

“ব্য’থা তো কমছেই না। প্লিজ আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিন।”

“আগে বলুন এ’ক্সি’ডে’ন্ট’টা হলো কীভাবে আপনার?”

প্রত্যত্তুরে মেয়েটি রুঢ় গলায় কিছু বলার পূর্বেই ইতি উদ্যমী হয়ে থামিয়ে দিলো মেয়েটিকে! কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠল সে। আমতা আমতা করতে লাগল। প্রসঙ্গ পাল্টে হিবিজিবি গলায় সে রাফায়াতকে বলল,,

“এএমনি। রিকশা থেকে পড়ে গেছে। বাই দ্যা ওয়ে রাফায়াত, আপনি এবার যেতে পারেন। আমি রিথিকে বাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়ে আসব।”

সঙ্গে সঙ্গেই রিথি খু্ব বাজেভাবে রিয়েক্ট করে উঠল! হিংস্র দৃষ্টিতে ইতির দিকে তাকালো। তিরিক্ষিপূর্ণ গলায় ইতির দিকে আঙুল তুলে বলল,,

“তুই আমাকে রিকশা থেকে ধা’ক্কা মে’রে ফেলে দিয়েছিস ইতি! রাস্তার লোকজন যখন আমাকে হেল্প করতে এলো তখন তুই তাদেরও কোনো হেল্প করতে দিলিনা! বললি আমাদের কোন রিলেটিভস এসে আমাকে হসপিটালে নিয়ে যাবে। এরপর তুই এই ছেলেটিকে কোথা থেকে সাথে করে নিয়ে এলি!”

মাথায় হাত চলে গেল রাফায়াতের! রাগে রঙিন হয়ে উঠল। মাথা গরম হয়ে উঠতেই সে ভ’য়ে সিটিয়ে থাকা ইতির গালে ঠা’স করে জোরে এক চ’ড় মেরে দিলো! উচ্চশব্দে চিৎকার করে বলল,,

“এটা হসপিটাল না হলে এখন তোকে আমি ঠিক গ’লা টি’পে ধরতাম! ইউ ব্লা*ডি, বি*চ! না তোর কারো ভালো ফ্রেন্ড হওয়ার অধিকার আছে না কারো কাছ থেকে স্যাম্পেথি, দয়ামায়া বা ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার আছে। থুঃ মে’রে গেলাম আমি তোর মুখে!”

উগ্র মেজাজে শার্টের কলার ঝেড়ে রাফায়াত হসপিটাল থেকে প্রস্থান নিলো। যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে তার। এক থেকে দেড় ঘণ্টা এই ফা’ল’তু মেয়েটার পেছনে নষ্ট হয়ে গেল তার। তবুও এখন অফিসে গিয়ে দেখা যাক কোনোভাবে সবকিছু ঠিক করা যায় কী-না! কোনোভাবেই হাল ছেড়ে দেওয়া চলবেনা। এত সহজে হার মেনে নিলে সফলতা আসবে কীভাবে? যেখানে রাফায়াতের উদ্দেশ্য সৎ সেখানে অশুভ শক্তিরাও কিছু করতে পারবেনা। আল্লাহ্’র উপর ভরসা রেখে রাফায়াত রিকশা ধরে অফিসের উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু করল। ইতোমধ্যোই অয়ন্তীর নাম্বার থেকে ফোন এলো! ব্যস্ত হয়ে রাফায়াত ফোনটি কানে তুলতেই অয়ন্তী ফোনের ঐ পাশ থেকে ঝাঁজালো গলায় বলল,,

“এই কোথায় আপনি?”

“অফিসেই যাচ্ছি অয়ন্তী। সরি টু সে, একটু দেরি হয়ে গেল।”

“তোর আর যাওয়া লাগবেনা অফিসে! আমার বাপের মানসম্মান যা ছিল সব বেচে খেয়ে এখন অফিস যাওয়া হচ্ছে?”

“মানে? কী বলছ তুমি?”

“এক থেকে দেড় ঘণ্টা তারা আপনার জন্য অপেক্ষা করেছে৷ বাবা তো খুব বড়ো মুখ করে বলেছিল আমার মেয়ে জামাই খুব পাংচুয়াল। ঠিক সময় মত পৌঁছে যাবে। ব্রেন ভালো ভাইভাতেও টিকে যাবে! চাকরী তার কনফার্ম! অথচ কাজের বেলায় কী হলো? বড়ো মুখ নিচু হয়ে গেল আমার বাবার। সময় মত কী পৌঁছাবেন আপনি ফোনেই তো পাওয়া যাচ্ছিলনা আপনাকে! আপনার জন্য অপেক্ষা করতে করতে সবাই এখন বিরক্ত হয়ে চলেই গেল!”

ব্য’র্থতায় ভেঙে পড়ল রাফায়াত। কলটি সঙ্গে সঙ্গেই কেটে সে মাথা নুইয়ে ভাগ্যকে দো’ষা’তে লাগল! ইতির প্রতিও ক্ষোভ ক্রমশ বাড়তে লাগল! চোখের কোটর যেন জলে ভরাট হতে লাগল। সব আশা তার নিরাশ হয়ে গেল। এই মুখ সে তার পরিবারকে দেখাবে কীভাবে? অয়ন্তীর বাবার কাছেও ছোটো হয়ে গেল। এরমধ্যেই অয়ন্তীর নাম্বার থেকে প্রায় তিন থেকে চারটা কল চলে এলো। একবারের জন্যও রাফায়াত কলটি তোলার প্রয়োজনটুকুনিও বোধ করলনা!

________________________________

রাত বেড়ে তখন দশটা প্রায়। হাউমাউ করে কাঁদছে অয়ন্তী। ভাবছে ঐসময় রাফায়াতের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে বিধায় রাফায়াত সেই যে দুপুরে বের হয়েছিল এখনো বাসায় ফিরে এলো না! তবে কী রাফায়াত তার সাথে রাগ করে তার চোখের আড়াল হয়ে গেল?

#চলবে…?

[রি-চেক করা হয়নি। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here