#এক_মুঠো_প্রেম_রঙ্গনা
[২য় পরিচ্ছেদ]
৩৮.
ইরা’দ নওরিকে সাথে নিয়ে ইরা’দদের সদর দরজায় দাঁড়িয়ে। মৌসুমি তাদের বরণ না করে লিভিংরুমে বসে ফুঁসছে। কপালে নওরি লেখা ছিলো কে জানতো? রাগে রীতিমতো জ্বলে পুড়ে জ্ঞান হারানোর উপক্রম তাঁর। সিদ্দীক সাহেব নিজের স্ত্রীকে বারবার তাগাদা দিচ্ছে ছেলে এবং ছেলের বউকে বরণ করে ঘরে তুলতে। এদিকে মৌসুমি তৎক্ষণাৎ খ্যাঁক করে উঠে বলে,
–“কেউ কী আছিস? থাকলে প্রেশারের মেশিনটা নিয়ে আয়। আজকাল তো এই বাড়িতে আমার কোনো দাম-ই নেই! সবাই নিজেদের সিদ্ধান্তে বাদশাহ হয়ে গিয়েছে!”
মৌসুমির এরূপ বিলাপে সিদ্দীক সাহেব বিরক্ত হলেন। বিরক্তিতে নাক-মুখ কুচকে বললেন,
–“আল্লাহ্ কী করতে যে তোমার মতো ঝাল মরিচকে আমার ঘাড়ে চাপাইছে! আজকাল ঝালের প্রকোপ বাড়াতে গিয়ে কান্ড-জ্ঞান সব গিলে ফেলছো!”
মৌসুমি তড়িৎ চোখ গরম করে তাকালেন সিদ্দীক সাহেবের দিকে।
–“কী বললেন আপনি?”
–“শুনতে পাওনি? ছেলের বউকে বরণ করে না তুললে তোমায় তোমার মাকেসহ তোমার ভাইয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দিবো!”
–“ওই মেয়েটার জন্যে তুমি আমাকে বাড়ি থেকে তাড়ানোর হুমকি দিলে?”
–“তাহলে কী করা উচিত? বিয়ে তো হয়ে গেছেই। এখন চাইলেও তো অতীতে গিয়ে সব ঠিক করে আসতে পারবো না। ভাগ্যের লিখন মেনে নাও। এতেই তোমার মঙ্গল!”
–“ওই মেয়েটা কাল আমার ঘাড়ে বসে আমায় আঙুল ঘুরিয়ে নাচাবে না তাঁর গ্যারান্টি কী? মেয়েটার চরিত্রেও তো দোষ আছে। না বাবা, আমি জীবনেও এই মেয়েকে মেনে নিবো না। ভাগ্যের হিসেব তো পরে!”
সিদ্দীক সাহেব এবার গরম চোখে তাকালেন স্ত্রীর দিকে। গম্ভীর গলায় বলে ওঠে,
–“এখন অবধি মেয়েটা বাড়িতেই প্রবেশ করলো না আর তুমি ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করলে? আজিব মহিলা মানুষ তো তুমি!”
ভেতর থেকে বাবা-মায়ের মধ্যে ঝগড়া শুনে নওরি খামচে ধরলো ইরা’দের হাত। ইরা’দ সেই হাত নিজের মুঠোয় আগলে নিয়ে বলে,
–“মা তুমি কী বরণ করবে নাকি বউ নিয়ে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো?”
মৌসুমি তখনই আঁতকে ওঠে ছেলের কথায়। বসা ছেড়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসে ছেলের কাছে। গোল গোল চোখে অবাক সুরে বলে,
–“এই মেয়ের জন্যে তুই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার হুমকি দিচ্ছিস?”
ইরা’দ শান্ত নয়নে মায়ের দিকে তাকালো। লহু কন্ঠে বলে ওঠে,
–“এই মেয়েটি আমার বউ না। আমার অর্ধাঙ্গিনী। তোমার প্রতি আমার যেই দায়িত্ব, সেই একই দায়িত্ব আমার অর্ধাঙ্গিনীর প্রতিও। দুজনকেই আমি সমানভাবে ভালোবাসি। একজনের জন্যে আরেকজনকে ছেড়ে দেয়া মানে স্বার্থপরতা এবং কাপুরুষতা। তুমি তো আমায় এই শিক্ষা দাওনি মা। তোমরা দুজনেই আমার সম্মান। এখন যদি আমার বউয়ের সম্মান রক্ষার ক্ষেত্রে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয় তাহলে আমি বাধ্য। ওর যে আমি ছাড়া কেউ নেই মা।”
মৌসুমি মুখ থমথমে করে ছেলের দিকে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। পরবর্তীকে নওরিকেও লক্ষ্য করলেন। গভীর নয়নে। নওরি ভয়ে গুটিশুটি মে!রে দাঁড়িয়ে ইরা’দের পাশে। মিনিটখানেক কেটে যাবার পর গম্ভীর স্বরে বলে,
–“করছি বরণ! কোথাও যেতে হবে না।”
মৌসুমির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সিদ্দীক সাহেব নৈঃশব্দে হাসলেন। ছেলেকে নিয়ে আজ ভীষণ গর্ববোধ হচ্ছে। তাদের শিক্ষায় যে কোনো ত্রুটি ছিলো না। ইরা’দ এবং নওরির পায়ের পিছে থেকে উঁকি মে!রে ফ্রিশা তখন ইরা’দদের ফ্ল্যাটের ভেতরটা দেখতে ব্যস্ত।
——————-
ইরা’দের মুখে তুষার যখন শুনলো নওরি তাঁর বউ তখন তুষারের চেহারা দেখার মতোন ছিলো। নূরজাহান এবং আফিফা ব্যতীত সকলেই স্তব্ধ ছিলো ইরা’দের বিয়ের কথা শুনে। ইরা’দ বুঝলো তুষার থাকা অবস্থায় তাঁর স্ত্রী নিরাপদ নয়। তাই তখনই সারিফাকে পাঠিয়ে দেয় নওরির রুমে। যাতে নওরির জামা-কাপড়সহ জরুরি সকল জিনিসপত্র প্যাক করে দেয়। এবং ইরা’দ নূরজাহানের কাছে বলে,
–“চাচী, নওরিকে আমি আমার বাড়িতে নিয়ে যেতে চাই। এখন বিয়ের কথা তো সবাই জানে।”
নূরজাহান একপলক নওরির দিকে চেয়ে হাসি-মুখে বলে,
–“তোর-ই বউ। নিয়ে যা। বিয়ের মিষ্টি পাঠাতে ভুলিস না।”
ইরা’দের বাসাতে যাওয়া নিয়ে নওরি কতটুকু খুশি তা জানা নেই। তবে ফ্রিশা দারুণ খুশি। খুশির কারণ ইরা’দের ছাদসম খোলামেলা বারান্দাটি। সেখানে ছুটে বেড়ানো যেন ফ্রিশার কতকালের স্বপ্ন। গাছের ডালে বসে থাকা তাঁর দ্বিতীয় স্বপ্ন। কিন্তু আফসোস ভার সইতে পারবে না ইরা’দের গাছগুলোর কোনো ডাল।
নওরি বর্তমানে বিব্রত হয়ে বসে আছে ইরা’দের ঘরে। এক কাপড়েই বেরিয়ে এসেছে সে শ্বশুরবাড়িতে। এখন ইরা’দের রুমে এসে নতুন একটি জামা পরে নিয়েছে সে। পুরো ঘরে চোখ বুলাতে ব্যস্ত নওরি। রুমের মধ্যে ইরা’দের নিজস্ব একটি ঘ্রাণ বিচরণ করছে। নওরি উঁকি মে!রে বারান্দায় দেখলো। কড়া রোদ উঠেনি এখনো। সময় হয়তো সকাল এগারোটা। ফ্রিশাকে আশেপাশে খুঁজলো সে। কিন্তু পেলো না।
মাজেদা বেগম গরম চোখে বারবার দেখছে ইরা’দকে। চোখ পাকিয়ে ইরা’দের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
–“মা হারা নাতবউ আমি কুনুদিন মাইনা নিতাম না। ওই মাইয়ারে তো একদম না। কেমন ঝিম ধইরা থাকে সবসময়!”
–“তো তুমি কী চাও সারাদিন বকবক করুক? নিজেই তো শান্ত-শিষ্ট, ভদ্র মেয়ে পছন্দ করো।”
–“খেদমতের কথাডা কইলি না যে!”
–“আমি খেদমত আর কাজ করাতে বউ আনি নাই। সকলকে ভালোবাসা দিবে বলেই বউ এনেছি। বউ মানেই সারাদিন রান্নাঘরে পরে থাকা না নানু!”
–“সব মানলাম। তাও আমি ওই মেয়েরে মানতাম না!”
–“না মানলে তোমার পোলার বাড়িত পাঠাই দিবো তোমারে মনে রাইখো। তখন খাইও ছেলের বউগো হাতের চাপড়া!”
বলেই ইরা’দ হনহন করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। মাজেদা বেগম চোখ বড়ো বড়ো করে চেয়ে রইলো ইরা’দের যাওয়ার পানে। অবাক সুরে বললো,
–“সাহস কতো বড়ো! আমারে হুমকি দিয়া গেলো? তোরে আমি ছাড়তাম না। মৌসুমি, ওই মৌসুমি! আমার তলপি তলপা রেডি কর। আমি এহনই যামু গা। থাকতাম না আমি। তুই থাক তোর বউমারে লইয়া!”
———–
–“নানুকে চেতিয়ে দিয়ে আসলেন কেন?”
–“না চেতালে শোধরায় না। তুমি টেনশন করো না। আমি মার্কেট যাচ্ছি!”
–“কেন?”
–“নতুন বউ এনেছি। ভালো শাড়ি, জামা-কাপড়, কসমেটিকস না আনলে চলে? তাঁর উপর আজ আমাদের বাসর রাত! ফুল দিয়ে ঘর সাজানোর ব্যবস্থা করতে হবে না বুঝি?”
বলেই ইরা’দ চোখ টিপ দিলো। ইরা’দের কথাগুলো শুনে নওরির গাল এবং কান গরম হয়ে এলো। সর্বাঙ্গ জউড়ে শিহরণ খেলে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে ফেললো সে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে কথা ঘুরিয়ে বললো,
–“নানুর পায়ে কী ব্যথা আছে?”
–“তা তো সবসময়ই থাকে। কেন?”
–“তেল গরম করে মালিশ করে দিতাম!”
–“পটানোর বুদ্ধি বুঝি?”
নওরি চট করে ইরা’দের দিকে চাইলো। ধীরগলায় বললো,
–“কারো রাগ, ক্ষোভের কারণ হতে চাই না আমি সাহেব। নিজের মধ্যে ভীষণ অস্থিরতা কাজ করে।”
#এক_মুঠো_প্রেম_রঙ্গনা
লাবিবা ওয়াহিদ
৩৯.
নওরিকে হঠাৎ নিজের ঘরে দেখে চমকালো মাজেদা। কিছু মুহূর্তের জন্যে নীরব রইলো। সরু চোখে নওরিকে লক্ষ্য করে বললো,
–“এহানে কী করো তুমি?”
নওরি হাসার চেষ্টা করে বলে,
–“আপনার জন্যে গরম তেল এনেছি নানু। পায়ে মালিশ করলে আরাম লাগবে।”
–“ক্যান ক্যান? এইগুলা করলে ভাবসো তোমারে মাইনা নিমু? কুনুদিনও না!”
নওরি এই ধরণের কথা উপেক্ষা করে মাজেদার পায়ের কাছে বসলো। মাজেদা তখন অনবরত এটা ওটা বলেই চলেছে। নওরি হাতে কিছুটা তেল নিয়ে মাজেদা বেগমের পায়ে খুব যত্নে মালিশ করে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে মাজেদার মুখ থেমে গেলো। আবেশে চোখ বুজে ফেললো সে। পেছনে পিঠ ঠেকিয়ে হেলান দিলো। মুহূর্তের জন্যে ভুলে গেলো সবকিছু। আরামে যেন হালকা হয়ে উড়ছে সে। অস্ফুট স্বরে বললো,
–“শান্তি!”
নওরি চাপা হাসি দিলো। মৌসুমি মায়ের রুমে প্রবেশ করতে নিলে দেখলো নওরি তেল মালিশ করে দিচ্ছে। অবাক হয়ে বলে,
–“ঘটনা কী? এসেই মায়ের খেদমত? মেয়েটা কী আসলেই ভালো? নাকি মা ডেকেছে ওকে? কে জানে?”
এসব ভাবতে ভাবতে মৌসুমি আর ঘরে প্রবেশ করলো না। চলে গেলো। নওরি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
–“আরাম লাগছে নানু?”
নানু আনমনে বলে ফেললো,
–“এত আরাম অনেকদিন পর পাইতেসি!”
হঠাৎ কী মনে করে মাজেদা চোখ মেলে তাকালেন। রুক্ষ স্বরে নওরির উদ্দেশ্যে বললো,
–“এগুলা করে ভাবতাছিস আমার মনে জায়গা করে নিবি? তোর নিয়্যত পূরণ হইবে না বলে দিলুম!”
নওরি পুণরায় মাজেদা বেগমের কথাকে এড়িয়ে গিয়ে বলে,
–“প্রতিদিন আমি মালিশ করে দিবো নানু। আপনি শুধু ডাকবেন। যা চাইবেন তা করার ব্যবস্থা করবো!”
মাজেদা বেগমের এবার মুখ বন্ধ। মুখ ঘুচে চেয়ে রইলো নওরির দিকে। মাথায় ঘোমটা, ব্যবহারে নম্রতা, সুন্দর চেহারা, সব দিক দিয়েই মেয়েটা ভালো। তাও মাজেদা বেগম কেন অপছন্দ করেন নিজেও বুঝতে পারলেন না। থমথমে মুখে ভাবলেন, আরেকটু নাটক চালিয়ে যেতে হবে। বুঝাতে হবে তার প্রয়োজনীয়তা। নয়তো আজকাল তো সবাই তাকে ছেলের বাড়িতে ফেলে আসার হুমকি দিচ্ছে।
রাতে সিদ্দীক সাহেব চা খেতে খেতে ইরা’দের উদ্দেশ্যে বললেন,
–“তা পুণরায় বিয়ে করতে চাচ্ছো নাকি রিসিপশন?”
–“রিসিপশন-ই হোক বাবা। আমার এত মেহমান সামলানোর ধৈর্য নেই। নওরি খুব কষ্টের ফল তো। আবার হারাতে চাই না!”
সিদ্দীক সাহেব অবাক হয়ে বলে,
–“সে কী কথা? নিজের ছেলের বিয়ে দেখব না? কতো ইচ্ছে ছিলো ছেলের বিয়ে ধুমধাম করে দিবো!”
–“রিসিপশনের দিন সব ইচ্ছে পূরণ করে নিও!”
–“কিন্তু নওরির বাবার বাড়ি কী মনে করবেন?”
ইরা’দ থমথমে মুখে বলে,
–“ওনাদের সাথে নওরির সম্পর্ক খুব একটা ভালো নেই বাবা।”
সিদ্দীক সাহেব থমকালেন। কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললেন,
–“সম্পর্ক যেমন-ই হোক, বিয়েতে বউমার পরিবারকে আমার চাই। ফাংশনে দেরী হোক, সমস্যা নেই। তাও কারো অনুপস্থিতি চাই না!”
———-
নওরি বউ সেজে ইরা’দের ফুলে সজ্জিত ঘরে বঁধু বেশে নিশ্চুও হয়ে বসে। ফুলের মন মাতানো ঘ্রাণ ঘরটায় নিমজ্জিত। নওরি ঘন ঘন পলক ফেলে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। ভীষণ অস্থিরতায় ভুগছে সে। “বাসর রাত” শব্দটি-ই যেন নওরির দম আটকে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। হঠাৎ খুব তৃষ্ণা পেলো নওরির। কিন্তু নিজেকে সংবরণ করে রাখলো। হৃদয় ভীষণ ছটফট করছে। হৃদপিন্ড ভীষণ লাফাচ্ছে। ইরা’দের অনুপস্থিতিতেই এই অবস্থা, না জানি ইরা’দ থাকলে তাঁর কী হবে। নওরির ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে ইরা’দ রুমে প্রবেশ করলো। ইরা’দের উপস্থিতি টের পেতেই নওরি নড়েচড়ে বসলো। ইরা’দ নওরিকে বউরূপে দেখে মুচকি হাসলো। আলমারি থেকে একটি ছোট বক্স বের করে নওরির দিকে এগিয়ে আসলো। নওরির কাছাকাছি বসলে নওরি কিছুটা সরে যেতে নিলো। কিন্তু ইরা’দ তাঁর হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে আবার আগের জায়গায় বসিয়ে দিলো। নওরি গোল গোল চোখে চাইলো ইরা’দের পানে। ইরা’দ লহু কন্ঠে বললো,
–“পালাচ্ছো কোথায়? তোমার চারপাশে তো আমার-ই বসবাস!”
নওরি চুপ করে রইলো। ইরা’দ ছোট বক্সটি খুলে হিরের নথটি বের করলো। সেটা এতই চিকচিক করছে যে নওরি অবাকের সাথে ভয়ও পাচ্ছে। ভয়কাতুরে কন্ঠে শুধায়,
–“এটা.. যদি আমার থেকে হারিয়ে যায়? এটা আমি পরবো না। রেখে দিন!”
–“চুপ! হারাবে না। সখ করে কিনেছি তোমাকে পরিহিত দেখার জন্যে। সোকেজে সাজিয়ে রাখতে নয়। এদিকে এসো। নথ পরিয়ে দিচ্ছি!”
নথ পরানো শেষে ইরা’দ নিজের সাথে নওরিকে জড়িয়ে বেশ কয়েকটি ছবি তুলে নিলো। অতঃপর ছবি দেখতে দেখতে ইরা’দ মুচকি হেসে বলে,
–“বাসরের স্মৃতি। সুন্দর!”
হঠাৎ ইরা’দ নওরির দিকে তাকাতেই নওরি লজ্জায় রাঙা হয়ে যায়। দ্রুত নজর লুকালো সে। ইরা’দ নওরির লাজে রাঙা গালে স্পর্শ করে ঘোর লাগা কন্ঠে বলে,
–“এই লজ্জা কী ছোঁয়া যায় না? আমার যে ভীষণ ছুঁতে ইচ্ছে করছে। লজ্জাকে ধরে-বেঁধে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে, এই আমার বউয়ের সাথে তোমার সম্পর্ক কী?”
নওরি হাসলো। লাজুক হাসি। ইরা’দের থেকে পালাতে গেলে ইরা’দ নওরির কোমড় জড়িয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে ফেলে বলে,
–“পালাই পালাই করছো কেন? আমার ব্যাকুলতা দেখছো না? বুঝতে পারছো না আমার চোখের ভাষা?”
নওরি থরথর করে কেঁপে ইরা’দের চোখের দিকে তাকালো। ইরা’দ নওরিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নওরির অধরজোড়া নিজের অধরের দখলে নিয়ে নিলো। নওরির গলায় নিঃশ্বাস আটকে গেলো। সা!পের মতোন মোঁচড়া-মুঁচড়ি করলো কিছুক্ষণ ছাড়া পাবার জন্যে। কিন্তু সে গুড়ে বালি। নওরি ছাড়া পেলো না ইরা’দের থেকে। ইরা’দ যেন নওরিতে ডুব দিতে ব্যস্ত। আর নওরি লাজে লাল থেকে নীল হতে ব্যস্ত। দুজনের ঘনিষ্ঠতা ফ্রিশা বারান্দা থেকে দেখছে। ইরা’দ ফ্রিশাকে বারান্দায় বন্দি করে রেখেছে। কারণ, ফ্রিশা অলরেডি তাঁর একটা ফুলের টব ভেঙে ফেলেছে। যার শা!স্তিস্বরূপ সারারাত সে আকাশের নিচে কাটাবে অর্থাৎ বারান্দায়। ফ্রিশা ওদের বড়ো বড়ো চোখে দেখতে দেখতে হঠাৎ স্ট্যান্ড থেকে ধপ করে পরে গেলো। যার শব্দ দু’জনের কান অবধি পৌঁছালো না।
—————–
সকালে ফোনের রিংটোনে নওরির ঘুম ভেঙে গেলো। পিটপিট করে চোখ মেলতেই দেখতে পেলো সে ইরা’দের উম্মুক্ত বুকে লেপ্টে আছে। এই রূপ দেখে নওরির গত রাতের সকল ঘটনা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। নওরির সর্বাঙ্গ জুড়ে পুণরায় লাজে’রা মেলা বসালো। মাথা তুলে ঘুমন্ত ইরা’দের দিকে তাকালো। ইরা’দ তখনো বেঘোরে ঘুমোচ্ছে প্রিয়তমাকে বুকে নিয়ে। নওরি আলতো হাসলো। কিছুক্ষণ গভীর দৃষ্টিতে ইরা’দের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে, “মা-শা-আল্লাহ্!”
আবারও নওরির ফোন বেজে ওঠে যার ফলে নওরির ধ্যান ভাঙে। ইরা’দের বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বিছানার পাশের ড্রয়ারের উপর থেকে ফোনটা নিয়ে নিলো। ফোন হাতে নিয়ে দেখলো মাহি কল করেছে। নিজের অজান্তেই ভ্রু কুচকে এলো নওরির। এই ভোরবেলায় মাহি কেন কল করলো তাকে? নওরি কিছু না ভেবে কল রিসিভ করলো।
–“মাহি আ…”
নওরিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মাহি উত্তেজিত কন্ঠে বলে ওঠে,
–“নওরি, তোমার বাবা গতকাল রাতে স্ট্রোক করেছেন। ওনাকে হসপিটালে নেয়া হয়েছে!”
#এক_মুঠো_প্রেম_রঙ্গনা
[২য় পরিচ্ছেদ]
৪০.[শেষাংশ]
নিদ্র গুণগুণিয়ে গান গাইছে এবং সিঁড়ি বেয়ে নামছে। তুষারের বিয়ে আগামী মাসে। এ নিয়ে তাঁর খুশির অন্ত নেই। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় নিদ্র দেখলো লতিফা সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। তাকে দেখে রেলিং ধরে চেঁচালো নিদ্র।
–“এই ফটকি বেগম এখানে কী?”
লতিফা চমকে উপরে তাকালো। নিদ্র সন্দিহান নজরে তাঁর দিকে চেয়ে আছে। লতিফা থতমত খেয়ে বলে,
–“তুমারে কমু ক্যা?”
–“আগেরবারের কথা মনে নেই? গোল কী এবারেও খাওয়ার ইচ্ছা আছে নাকি? মৌমাছির কামড় কেমন লাগে বলো তো?”
হতভম্ব চোখে লতিফা চাইলো নিদ্র’র দিকে। শুকনো ঢোঁক গিলে বলে,
–“ও দিয়া কি করবা?”
–“তোমার উপর ছেড়ে দিবো। চেহারা তোমার লাল করে দিবে কামড়ে হিহি!”
লতিফা বিষম খেলো। সাহস জুগিয়ে বললো,
–“মৌমাছি বুঝি এহানে পাইবা?”
–“দেখেছিলাম এক জায়গায়। মৌচাক সহ নিয়ে আসবো তোমার জন্যে।”
–“মানে কী!?”
–“মানে হচ্ছে এখনই কেটে পরো। ওইদিন নিদ্র ভাইয়ার কথা শুনোনি? তোমাকে আবার এ বাড়িতে দেখলে আমি সত্যি এক দলা মৌমাছি এনে তোমার উপর ছেড়ে দিবো!”
–“আমি কিন্তু বড়ো মেডামরে বিচার দিমু!”
–“বিচার দেয়ার আগেই তোমাকে মৌমাছির কামড় খাওয়াবো। জীবন খোয়াতে না চাইলে দ্রুত বের হও, নয়তো আমি এখনই চাক আনতে যাচ্ছি!”
লতিফা কী করবে বুঝে পেলো না। তবে এখানে থাকাটা এখন তাঁর জন্যে ভয়!ঙ্কর ব্যাপার। এই ছেলেকে বিশ্বাস নেই। তাই লতিফা উল্টো পথে হাঁটা ধরলো। নিদ্র পুণরায় গুণগুণিয়ে গান গাইতে গাইতে ইরা’দের ফ্ল্যাটের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। কলিংবেল চাপতেই মৌসুমি খুলে দিলো। নিদ্রকে দেখে ভ্রু কুচকে বলে,
–“এই অসময়ে এখানে কী?”
–“আমার নৌরি ফুলের সাথে দেখা করতে এসেছি চাচী। দেখি সরে দাঁড়াও!”
–“তোমার আপু নেই!”
–“নেই মানে? কোথায় গেছে? কাল-ই তো ইরা’দ ভাইয়া আমার বাসা থেকে ফুলকে নিয়ে এসেছে।”
–“তোর নওরি আপু তাঁর বাবাকে দেখতে গিয়েছে। ফিরবে কিছুদিন পর। এখন তুই বিদায় হ! আমার মেলা কাজ আছে!”
———
নওরি সারা রাস্তা কেঁদেই চলেছে। ইরা’দ তাকে এক হাতের সাহায্যে নিজের হাতে জড়িয়ে রেখেছে। বারংবার নওরিকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।
–“নৌরি ফুল। কাঁদে না। আঙ্কেলের কিচ্ছু হবে না দেখিও!”
নওরির কান দিয়ে যেন কোনো কথা-ই ঢুকছে না। বারবার নিজেকে দোষারোপ করছে। কেন একটিবারের জন্যে বাবার খোঁজ নিলো না সে। কেন একবার সাহস জুগিয়ে কল করলো না? বাবার রাগের সম্মুখীন হতে চাইতো না বিধায় কখনো কল করেনি। কিন্তু বাবাকে প্রতিদিন মনে পরেছে তাঁর। আল্লাহ্’র দরবারে বাবার জন্যে দোয়া করেছে। কিন্তু এমন কেন হলো? এরকমটা তো হওয়ার কথা ছিলো না। বাবার খারাপ তো সে কোনোদিন চায়নি। নওরি কান্নারত অবস্থায় ইরা’দের উদ্দেশ্যে বললো,
–“আর কতদূর?”
–“তোমার শহরে সবে পৌঁছিয়েছি। আর কিছুটা লক্ষীটি। এত কেঁদো না।”
হসপিটালে একপ্রকার ছুটে এলো নওরি। চোখ-মুখ ফুলে আছে তাঁর। গাল এখনো ভেঁজা। হসপিটালে রিসিপশন থেকে কেবিন নাম্বার জেনে সেদিকেই ছুটলো। ইরা’দ ড্রাইভার এবং গার্ডদের তাঁর গাড়ির সামনে রেখে নওরির পিছে ছুটলো। নওরি কেবিনের কাছাকাছি আসতেই প্রিতম এবং তাঁর মায়ের মুখোমুখি হলো! তাদের দেখে নওরির পা জোড়া থেমে যায়। চমকে তাকিয়ে রইলো তাদের দিকে। প্রিতম নওরির দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি দিলো। মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,
–“মা, নওরি যে নিজে থেকে আমায় ধরা দিলো!”
তৎক্ষণাৎ ইরা’দ নওরির পিছে এসে দাঁড়ালো। মুখে গাম্ভীর্য ফুটিয়ে নওরিকে নিজের কাছে টেনে এনে বলে,
–“আমার বউয়ের থেকে দূরে থাকো!”
প্রিতম এবং মহিলা দু’জনেই চমকালো। বউ মানে? ইরা’দ কী-সব বলছে? মহিলা বেশ শান্ত কন্ঠে বলে,
–“তোমার বউ হলো কী করে? ও তো আমার ছেলের হবু বউ!”
–“ছিলো, এখন নেই। আমরা বিয়ে করেছি!”
মহিলা কঠিন চোখে চাইলো নওরির পানে!
–“এত বড়ো ধো!”কা!”
–“এখন আপনারা আসতে পারেন।”
বলেই ইরা’দ নওরির হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে গেলো। প্রিতম রেগে ইরা’দের পেছন যেতে নিলে মহিলা আটকালো। প্রিতম এতে তেঁতে উঠে বলে,
–“আটকালে কেন? সাহস দেখেছো?”
–“বিয়ে হয়ে গেছে। কিছু বলে লাভ নেই। তোর জন্যে আমি আরও সুন্দর মেয়ে এনে দিবো। আমার ছেলের জন্যে কী মেয়ের অভাব পরেছে?”
–“কিন্তু মা…”
–“চুপ! আর যতো যাই হোক, এই মেয়ের তালাক হলেও এই মেয়েকে আমি বউমা হিসেবে মেনে নিবো না। অনেক শুনেছি তোর জেদ। এখন তুই আমার কথা শুনবি। চল!”
বলেই মহিলা প্রিতমকে একপ্রকার জোর করে নিয়ে গেলো।
——————
নওরি তাঁর বাবার হাত ধরে বসে আছে। নওরির সৎ মা নওরির দিকে অনিমেষ চেয়ে আছে। রোগা-পাতলা মেয়েটার স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে। আগের চাইতেও চেহারায় অধিক উজ্জ্বলতা এসেছে। এতক্ষণে হয়তো পালানোর কথা উঠতো। কিন্তু ইরা’দ তাঁর স্বামীর সকল খরচ বহন করছে বিধায় মুখে কুলূপ এঁটেছেন মহিলা। রাফিয়া তাঁর পাশে বসেই বোনকে দেখছে। মনে হচ্ছে নওরির উজ্জ্বলতার কাছে তাঁর উজ্জ্বলতা ফ্যাকাসে। অনেকদিন ধরে নিজের যত্ন না নিলে যা হয় আর কী! রাফিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এই রূপের জন্যে-ই তাদের বোনেদের মধ্যে ভেদাভেদ, বিরহ আসলো। নওরির বাবা এই মুহূর্তে ঘুমোচ্ছে। গতকাল রাতে সঠিক সময়ে হসপিটালে এনেছে বলেই রক্ষা। নয়তো খা!রাপ কিছু হবার সম্ভাবনা ছিলো। রাফিয়া নওরির দিকে গিয়ে তাঁর কাঁধে হাত রাখলো।
বললো,
–“এভাবে কাঁদিস না। বাবাকে ঘুমোতে দে। বাইরে চল!”
–“আমি বাবাকে ছেড়ে যাবো না।”
–“চলে যেতে বলিনি। বাহিরে আসতে বলেছি। ডাক্তার বলেছে বাবাকে একা রাখতে।”
নওরি কিছু বলে না। রাফিয়ার কথা মেনে নিয়ে রাফিয়ার সাথে বাইরে চলে যায়। নওরির সৎমা থেকে যায় ভেতরেই। কেবিন থেকে বের হতেই একজন অচেনা যুবক রাফিয়ার সামনে এসে দাঁড়ায়। যুবকটি ঘুরে ঘুরে নওরিকে দেখছে। রাফিয়া যুবকটির উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
–“জুনাইদ, সুরভী ঠিক আছে তো?”
জুনাইদ একপলক নওরির দিকে চেয়ে বলে,
–“হ্যাঁ। এটা সেটা বুঝিয়ে স্কুলে দিয়ে এসেছি। বন্ধুদের মাঝে থাকলে আঙ্কেলের কথা কম মনে পরবে!”
–“ভালো করেছো!”
বলেই রাফিয়া নওরির দিকে তাকালো। নওরি অবাক চোখে রাফিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
–“উনি কে আপা?”
–“জুনাইদ। তোর দুলাভাই। পনেরো দিন হলো আমাদের বিয়ের!”
নওরি আরও অবাক হলো। চমকে চাইলো জুনাইদের দিকে। বেশ সভ্য দেখাচ্ছে তাকে। রাফিয়া বুঝতে পারলো নওরির আগ্রহ। তাই সে সর্বপ্রথম জুনাইদের সাথে নওরির পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলে,
–“ওদিকে নওরির হাসবেন্ড আছে। তুমি ওনার সাথে আলাপ করো। এখন সময়টা নাহয় হোক আমাদের দু’বোনের।”
জুনাইদ ভ্রু কুচকে রসিক সুরে বলে,
–“ইয়ং পলিটিশিয়ান আমার শালীর হাসবেন্ড? ইশ! আমার শালীর কপাল পুড়লো!”
নওরি ফিক করর হেসে ওঠে। জুনাইদও হাসলো। হেসে আবার বললো,
–“ইয়ে মানে, তোমাকে যে এসব বললাম তা যেন ওনার কানে না যায়। নয়তো তোমার বোনটা অসময়ে বিধবা হয়ে যাবে!”
নওরি চোখে অশ্রু নিয়েই আরেক দফা হেসে বলে,”আচ্ছা বলবো না।”
————-
–“বাবা সম্ভবত তোকে নিয়ে চিন্তায় ছিলো। তুই চলে যাবার পর থেকেই বাবার মধ্যে অদ্ভুত চেঞ্জ এলো। সবসময় অন্যমনস্ক, নিশ্চুপ দেখাতো তাকে। তারপর আমি ভাবশূণ্য হয়ে যেসব কান্ড ঘটালাম..”
বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাফিয়া। আবার বলতে শুরু করে,
–“আমার কারণে বাবা হয়তো তোর ব্যাপার মাথা থেকে কিছুটা ঝেড়ে-ই ফেলেছিলো। এরপর আমি স্বাভাবিক হতেই বাবা প্রতিদিন একবার করে জিজ্ঞেস করতো, “নওরি মা কল করেছে?” যখন বাবা আমার কাছ থেকে কোনো আশানুরূপ উত্তর পেত না তখন বেজার মুখে ফিরে যেত। তোর নিখোঁজ হওয়া নিয়ে বাবা কেসও করতে চেয়েছিলো। কিন্তু মা নানান অযুহাতে বাবাকে আটকে দেয়। এদিকে আমি অনুশোচনায় ভুগছিলাম কারণ, আমার কারণেই তুই বাসা ছেড়ে পালিয়েছিস। আমার অন্ধত্ব আমায় ধ্বং!সের পথে ঠেলেছিলো। সেই আঁধার থেকে আমি ততদিন আসতে পারিনি যতদিন না তোর কোনো খোঁজ পাচ্ছি। এদিকে বাবা মুখে কিছু না বললেও বুঝতাম, মনের মধ্যে অনেক অনুতাপ পুষে রেখেছে। কিন্তু কখনো সেসব জিজ্ঞেস করে বাবাকে বিব্রত করিনি। বরং এইটুকু উপলব্ধি করেছি, তোর উপর আমরা কী জু!লুমুটাই না করেছি। এরপর তোর খোঁজ পেলাম। বাবাকেও জানালাম। বাবার হাসিটা সেদিন ভূবন ভুলানো ছিলো জানিস? তোর সাথে যোগাযোগের পরপর-ই আমার জন্যে এক সমন্ধ আসে। জুনাইদের পক্ষ থেকে। বাবা খোঁজ-খবর নিয়ে বিয়ে করিয়ে দিলো। আমি অবশ্য এত আগ্রহী ছিলাম না। তবে একজন সঙ্গীর প্রয়োজন ছিলো আমার যা জুনাইদের মাধ্যমে পেয়েছি। জানিস আমার নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে হয়, এত পাপ করার পরেও আল্লাহ্ আমায় এমন স্বামী দিবে আমি কখনো ভাবতে পারিনি!”
নওরি মুচকি হেসে বলে,
–“তুমি অনুতপ্ত হয়েছো, বেপথ থেকে ফিরে এসেছো। তাইতো উপহারস্বরূপ আল্লাহ্ তোমায় এমন জীবন্সঙ্গী দিয়েছে!”
–“না রে। খুব অন্যায় করেছি আমি তোর সাথে। সেই পাপের ভার এখনো আমার কাঁধে রয়ে গেছে।”
–“এভাবে বলো না। তুমি আবেগী মানুষ। আবেগে পরে মানুষ ভুল করেই। এতে নিজেকে এভাবে দোষারোপ করো না। তুমি ওরকমটা করেছো বলেই তো আল্লাহ্ আমায় নেতা সাহেবের মতোন একজনকে পাইয়ে দিলো! আল্লাহ্ যাই করেন ভালোর জন্য-ই করেন। তোমার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই!”
–“আচ্ছা ঠিকাছে। এরপর শুন। বিয়ে হয়ে জুনাইদের বাসায় আসার পর মায়ের থেকে জানতে পারি বাবা একা সময় কাটান, মাঝেমধ্যে রাতে উঠলে দেখতে পেতেন পায়চারী করছে। তোর উপর জু!লুমের জন্যে মায়ের সাথে নাকি অনেক রাগারাগিও করেছে। এ নিয়ে অ!শান্তি সৃষ্টি হয়। ঝগড়ার পর বাবা আরও একা হয়ে পরেন। চোখের নিচে কালি পরে। অতঃপর…”
রাফিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নওরির চোখ বেয়ে আবার জল গড়িয়ে পরে।
ঘন্টাখানেক পর সৎ মা জানায় নওরির বাবার জ্ঞান ফিরেছে। নওরি তখনই ছুটে যায় কেবিনের ভেতরে। মেয়েকে চোখের সামনে দেখে বাবার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পরলো। নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলো। নওরি চোখে জল নিয়ে বাবার হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে বলে,
–“কে..কেমন আছো বাবা?”
নওরির বাবা কিছু বললো না। অনিমেষ চেয়ে রইলো মেয়ের দিকে। কত যুগ পর যেন দেখছেন মেয়েকে। নওরির বাবা সময় নিয়ে বললেন,
–“পাপের বোঝা কাঁধে নিয়ে কী করে ভালো থাকি রে মা?”
এবার নওরি নিজেকে সামলে উঠতে পারলো না। বাবার বুকে মাথা রেখে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। নওরির বাবা দুর্বল হাতে মেয়েকে জড়িয়ে নিলো। কেবিনের দরজা থেকে ইরা’দ মুগ্ধ নয়নে বাবা – মেয়েকে দেখছে। কত বিরহের পর এই মিলন। চমৎকার লাগছে ইরা’দের নিকট। প্রাণ জুড়ানো দৃশ্য। কিছুক্ষণ আগেই মৌসুমি ফোন দিয়ে নওরির বাবার খোঁজ নিয়েছে। সাথে নওরির খোঁজ নিতেও ভুলেনি সে। যেন ফোনটা নওরির জন্যেই করেছে সে। মাকে নওরির এত খোঁজ-খবর নিতে দেখে ইরা’দ কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছে। এর মানে কী মৌসুমি ধীরে ধীরে নওরিকে পছন্দ করতে শুরু করেছে? নির্ঘাত সিদ্দীক সাহেব মশলা মাখিয়েছে। শেষে মৌসুমি এও বলেছে যেন ঘরের বউকে নিয়ে শীঘ্রই ফিরে আসে। এতে ইরা’দের খানিক সন্দেহ নিশ্চিতে রূপ নিলো।
নওরির বাবা ভাঙা গলায় বলে,
–“তুই চলে যাওয়ার পর বুঝতে পারলাম আমার মুক্তার শেষ হিরেটাকে আমি হারিয়ে ফেলেছি। যার মাঝে মুক্তার প্রতিচ্ছবি দেখতে পেতাম তাকেই জীবনের সবচেয়ে বড়ো বেদনা দিয়ে ফেলেছি। আমার যে তোর কাছে ক্ষমা চাওয়ার-ও মুখ নেই রে মা। দিন-রাত এই চিন্তা করেছি যে কী করে এত পাপের বোঝা নিয়ে তোর সম্মুখে দাঁড়াবো?”
–“এভাবে বলো না বাবা। মা চলে যাওয়ার পর একমাত্র তুমি-ই আমার সম্বল। ক্ষমা তো আমি চাইবো তোমার কাছে। আমারই তোমাকে ছেড়ে চলে যাওয়া ভুল হয়েছে। খুব বড়ো অন্যায় করে ফেলেছি তোমার সাথে যোগাযোগ না করে। ক্ষমা করে দাও বাবা, আমার জন্যে তুমি এত কষ্ট পাচ্ছো!”
বাবা-মেয়ের কথোপকথন চললো আরও কিছুক্ষণ। কিছুক্ষণ পর সব স্বাভাবিক হয়ে এলো। নওরি ইরা’দকে বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। ইরা’দ সালাম দিতেই বাবা অবাক হয়ে বলে,
–“তুমি সেই ইয়ং পলিটিশিয়ান নও? ইরা’দ?”
–“জ্বী বাবা!”
ইরা’দের মুখে বাবা ডাকটা শুনে হৃদয় কোমল হলো। নওরি নিচু গলায় বলে,
–“দুঃখিত বাবা। তোমার অনুমতি না নিয়ে-ই বিয়ে করে ফেলেছি!”
–“আরে ধুর বোকা! বিয়ে করেছিস তাঁর জন্যে কিসের ক্ষমা? আয় দেখি দুজনে আমার বুকে আয়!”
ইরা’দ এবং নওরি একে অপরের দিকে তাকিয়ে আলতো হাসলো। অতঃপর দুজনে একসাথে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। এত সুখ নওরির হাতে ধরা দিয়েছে তা তো সে ভাবতেও পারছে না। সব আজ স্বপ্নের মতো সুন্দর। বাবা নামক ছায়াটা দেরী করে হলেও ফিরে পেয়েছে সে। সাথে ঢাল হয়ে পাশে পেয়েছে ইরা’দকে। আর কী চাই তাঁর? আজ রব যে পৃথিবীর সমস্ত সুখ তাঁর হাতে তুলে দিয়েছে। এজন্য-ই বুঝি বলে, ধৈর্যের ফল মিঠা হয়?”
——————-
আজ ইরা’দ এবং নওরির রিসিপশন প্রোগ্রাম। এই প্রোগ্রামে আজ সবাই উপস্থিত। নওরির পরিবার, নূরজাহানের পরিবার, মাহি সহ আরও অনেকে। সকলের মুখেই হাসি। আজ বোধহয় সবচেয়ে বেশি খুশি মাজেদা। দিব্যি লাঠিতে ভর দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। তাঁর খুশি একটাই, নতুন নাতবউ তাঁর সমস্ত যত্ন-আত্তি করে। ঘর আলো করে রেখেছে। এমন এক লক্ষী নাতবউ-ই তো তার প্রিয় নাতির জন্যে মাবুদের কাছে চেয়েছিলো। নিদ্রও বেশ হেসে খেলে বেড়াচ্ছে। তাঁর নৌরি ফুল এবং নিদ্র ভাইয়ার বিয়ে। তাঁর একটু ভাবও তো নেয়া প্রয়োজন। নইলে আশেপাশের পিচ্চি মেয়ে’রা যে তাকে বা!ন্দর উপাধি দিবে। তাদের দেখাতে হবে না লিটল নিদ্রও ভের্যি কুল।
এতকিছুর পরেও রিসিপশনে বর-বউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁরা যে বেরিয়েছে নিখিলের বাইক নিয়ে শহর ভ্রমণে। সঙ্গে পিছু গিয়েছে ফ্রিশাও। ইরা’দ নওরি বর, বউ সাজেই বেরিয়েছে। ইরা’দ এবং নওরি দু’জনেই মুখে হেলমেট পরেছে। যার ফলে কেউ-ই তাদের চিনতে পারবে না। ইরা’দ বাইক চালাতে চালাতে হেসে বলে,
–“স্বপ্ন আমার সত্যি হলো। ভাগ্যিস স্বপ্নে দেখেছিলাম। নয়তো ফাংশন ফেলে ঘুরে বেড়ানোর কথা মাথাতেই আসতো না।”
নওরি আলতো হেসে ফ্রিশাকে এক হাতে আরও শক্ত করে আগলে নিলো। আজ ইরা’দের ফ্রিশাকে নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই। বরং আজ সে সবথেকে বেশি খুশি।
তাঁরা ঘুরতে ঘুরতে এতিমখানার সেই জায়গাটায় আসলো, যেখানে ইরা’দ প্রথম ইঙ্গিতে নওরিকে প্রপোজ করেছিলো। এক মুঠো প্রেম রঙ্গনা নিজ বুকপকেটে আগলে নেয়ার আবদার করেছিলো। আজও সেই গাছে ভৃঙ্গরাজের মেলা। ভৃঙ্গরাজে’রাও যেন হাসছে তাদের একসাথে দেখে। নওরি এক গুচ্ছ ফুল ছিঁড়ে নিয়ে সেগুলো ইরা’দের শেরওয়ানির বুকপকেটে রাখলো। এবং সেই ফুলগুলোর দিকে অনিমেষ চেয়ে লাজুক হেসে বলে,
–“এখানেই প্রথম অনুমতি চেয়েছিলেন, ফুলগুলো আপনার বুকপকেটে ছড়িয়ে দেয়ার। আজ অনুমতি দিলাম, এই বুকপকেটে রইবে একান্তই আমার এক মুঠো প্রেম রঙ্গনা। যেই প্রেমের ঘ্রাণে অনুভূতির প্রকাশ, আজ সেই ঘ্রাণে আমাদের পূর্ণতা। আপনি আমার পূর্ণতার বিরাট অধ্যায় নেতা সাহেব। এই ফুলগুলো আমাদের সেই পূর্ণতার প্রতীক।”
ইরা’দ নওরির দিকে চেয়ে মুগ্ধকর হাসি দিলো। অতঃপর সেই ফুলকে সাক্ষী রেখেই নওরির অনামিকা আঙুলে ভৃঙ্গরাজের আংটি পরিয়ে দিলো। লহু কন্ঠে বললো,
–“এই প্রেম রঙ্গনায় সবসময় সাজিয়ে রাখবো তোমায়। ঘ্রাণ নিবে এবং আমাদের পূর্ণতায় উপরওয়ালার কাছে শুকুরিয়া আদায় করবে।”
ইরা’দ এবং নওরি যখন নিজেদের মধ্যে ব্যস্ত, তখন হুট করে গাছের পেছন থেকে একটি বিড়াল এগিয়ে এলো ফ্রিশার কাছে। বিড়ালটি ফ্রিশার কাছাকাছি আসার চেষ্টা করলে ফ্রিশা তাকে পা দিয়ে লা! থি মে! রে দূরে সরে গেলো। সঙ্গে উচ্চশব্দে চিৎকারও দিলো। চোখ পাকিয়ে এমন ভাবে সেই বিড়ালের দিকে তাকালো যে বিড়ালটা দ্রুত পালালো। ফ্রিশা সেদিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে উড়ন্তি প্রজাপতির দিকে চাইতো। ইশ! ওটাকে যদি খোপ করে ধরতে পারতো! আচ্ছা প্রজাপতি খেতে কেমন?”
®লাবিবা ওয়াহিদ
————————–
~সমাপ্ত!❤️