#এ_তুমি_কেমন_তুমি
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্ব-০৩
❌কপি করা নিষেধ❌
মা আমি এই বিয়ে করতে পারবো না।
লিজার কথায় তার মা লাবণির মাথায় যেনো বাজ পড়লো। তার কত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে এই বিয়ে ঠিক করার জন্য। সেলিনা চৌধুরী নিজের বোনের মেয়েকে ছেলের বউ করতে চেয়েছিলেন। লাবণি বরাবরই নিজের মেয়েকে তানিশার থেকে উপরে রাখতে চায়। অনামিকা এমনই লিজার থেকে কম সুন্দরী, তাই তার সাথে কোনো সমস্যা নেই। এমনিতেই কথায় কথায় অনুকে সে ছোট করতে পারে। কিন্তু রুপে গুণে সবদিক থেকে তানিশা লিজার থেকে এগিয়ে। এটাই সহ্য হয় না লাবণির। সে চায় তার মেয়েকে সবার উপরে রাখতে। ফারহানের মতো যোগ্য পাত্র তানিশা পাবে সেটা সহ্য হয়নি তার। তিনি সেলিনাকে বুঝিয়েছে ফারহানের জন্য তানিশার থেকে লিজা ভালো হবে। সেলিনা চৌধুরী প্রচন্ড অহংকারী মানুষ। বাবার বাড়ি, স্বামী সন্তান সব নিয়ে তার খুব অহংকার। যখন ভেবে দেখলেন বোনঝি তানিশার চাইতে ভাইঝি লিজা বেশি স্মার্ট, আর বয়সের পার্থক্যও কম। তখন তার মনে হলো ছেলের পাশে লিজাকেই ভালো মানাবে।
লাবণি রাগী গলায় বললো, “কী যা তা বলছিস তুই? সামনের শুক্রবার এনগেজমেন্ট আর আগামী মাসের এক তারিখ বিয়ে। এখন এসব বলে কোনো লাভ নেই।”
লাবণি কথা শেষ করে হনহনিয়ে মেয়ের রুম থেকে বের হয়ে গেলো। লিজা পড়ে গেলো মহা ঝামেলায়। ফারহানকে তার অপছন্দ বিষয়টা তেমন নয়। ফারহানকে অপছন্দ করার কোনো কারণ নেই বরং পছন্দ করার অনেক কারণ আছে। কিন্তু লিজা এখনই বিয়ে করতে চায় না। সবে মেডিকেল প্রথম বর্ষে পড়ছে। নিজের বাবার মতো ভালো ডাক্তার হতে চায়। লিজা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো বেডে।
লাবণি নিজের রুমে গিয়ে বকবক করতে লাগলো, “এত কষ্ট করে সব গুছিয়ে আনলাম এখন মহারানী বলছে বিয়ে করবে না।”
জুনায়েদ চৌধুরী অবাক কণ্ঠে বললো, “কে বিয়ে করবে না?”
লাবণি কোনোকিছু না ভেবেই বলে দিলো, “কে আবার তোমার নবাবজাদি?”
তুমি না বললে লিজা ফারহানকে পছন্দ করে? তাই তো এতো তাড়াতাড়ি মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি হলাম আমি।
এতক্ষণে হুঁশ ফিরলো লাবণির। সে সবাইকে বলেছে লিজা ফারহানকে পছন্দ করে আর এতেই সবাই রাজি হয়েছে। এখন যদি জানে লিজা নিজেই এই বিয়েতে রাজি নয় তাহলে তার খবর আছে।
লাবণির উত্তর না পেয়ে জুনায়েদ ধমক দিয়ে বললো, “কী হলো কথা বলছো না কেনো?”
লাবণি আমতা আমতা করে বললো, “আসলে লিজা এখনই বিয়ে করতে চাচ্ছে না। ফারহানকে পছন্দ করে তো কিন্তু পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে করতে চাইছে।”
জুনায়েদ চৌধুরী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো, “ওহ তাই বলো। ঠিক আছে আমি মেয়ের সাথে কথা বলবো। আমি বুঝিয়ে বলবো বিয়ের পরেও সে পড়াশোনা করতে পারবে, কোনো সমস্যা হবে না।”
লাবণি প্রায় চিৎকার করেই বললো, ” না।”
জুনায়েদ অবাক হয়ে বললো, “কী না?”
না মানে, তোমাকে বুঝাতে হবে না। আমি তো ওর মা, আমি ওকে ভালো করে বুঝিয়ে বলবো।
আচ্ছা ঠিক আছে তুমিই বুঝিয়ে বলো।
জুনায়েদ নিজের কাজে মনোযোগ দিলে লাবণি হাফ ছেড়ে বাঁচলো যেনো। আবার ছুটলো মেয়ের রুমের দিকে, মেয়েকে বুঝাতে হবে তো।
৫.
বিয়েতে তুই রাজি তো ফারহান?
ফারহান বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে বললো, “রাজি না হওয়ার কী আছে? লিজা যথেষ্ট সুন্দরী আর স্মার্ট একটা মেয়ে। আমার সাথে ভালো মানাবে।”
কিন্তু অনু?
ফারহান এবার চোখ তুলে তাকালো নিজের বেস্ট ফ্রেন্ডের মতো বড় ভাই ইরফানের দিকে। যার দৃষ্টি এখনো ফারহানের দিকে উত্তরের অপেক্ষায়।
ফারহান মলিন হেসে বললো, “জীবনের একটা সময় আসে পৃথিবীটা রঙিন লাগে। চোখের সামনে যা আসে তাই ভালো লাগে। আমার সেই রঙিন পৃথিবীর একটা পৃষ্ঠার নাম অনামিকা। একটা পৃষ্ঠা নিয়ে তো আর সম্পূর্ণ জীবনটা কাটানো সম্ভব নয়, অনামিকা নামক পৃষ্ঠা আমি অনেক পেছনে ফেলে এসেছি।
অনুকে তুই ভালোবাসতি ফারহান, সেটা কেনো স্বীকার করছিস না?
ফারহান রেগে বললো, “ভালোবাসা বলতে কিছু হয় না। সবই ক্ষনিকের মোহ আর একটা সময় সেটা কেটে যায়, রয়ে যায় এক রাশ তিক্ততা। আমার জীবনে আমি তিক্ততা চাই না।
ইরফান হতাশ হয়ে বললো, ” আমার জীবন দিয়ে তুই পুরো পৃথিবীটা যাচাই করতে পারিস না ফারহান।”
ফারহান তাচ্ছিল্য হাসলো, “ভালোবেসেই তো বিয়ে করেছিলে না? আজ ভালোবাসাটা ঠিক কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে?”
আমি না হই কিন্তু অনেকেই ভালোবেসে বিয়ে করে সুখে আছে ফারহান।
আমি কাউকে ভালোবাসি না আর না কখনো ভালোবাসবো। বিয়ে একটা সামাজিক প্রথা আর মা চাইছে তাই করছি। নিজের দ্বায়িত্ব পালন করবো শুধু।
ফারহান কথা শেষ করে দাঁড়ালো না। ইরফান কেবল দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। ইরফান ভালোবেসে বিয়ে করেছে তামান্নাকে। তামান্না ইরফানের ক্লাসমেট ছিল। ফারহান প্রথম থেকেই সবটা জানতো। দুই ভাইয়ের সম্পর্ক অনেকটাই বন্ধুর মতো। তামান্নার পরিবার বিয়ের জন্য চাপ দিলে পড়াশোনার মাঝেই বিয়ে করতে বাঁধ্য হয় ইরফান। বিয়ের পর ইরফান নিজের পড়াশোনা কমপ্লিট করতে পারলেও তামান্না পারেনি। তার জন্য অবশ্য সেলিনা চৌধুরী অনেকটাই দায়ী। সংসারের যাঁতাকলে ইরফান আর তামান্নার সেই ভালোবাসা আজ কোথায় যেনো হারিয়ে গেছে। সংসার করতে হবে বলেই হয়তো দু’জন এক সাথে আছে, দরকার হলে কথাও বলছে। ফারহানের এসব দেখে ধীরে ধীরে ভালোবাসার উপর থেকে বিশ্বাস উঠে গেছে।ইরফান দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। কলেজ লাইফের সেই সময়টা যদি আবার ফিরে পাওয়া যেত।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, “যাকে ভালোবাসো তাকে কখনো বিয়ে করো না।”
ইরফানের কাছে মনে হচ্ছে কথাটা সঠিক। তামান্নাকে বিয়ে না করলে ভালোবাসাটা সারাজীবন মিষ্টি অনুভূতি হয়েই থাকতো। হয়তো না পাওয়ার যন্ত্রণাটা মাঝে মাঝে পোড়াতো তবু সেই মিষ্টি অনুভূতিগুলো এমন তিক্ত হতো না। ইরফান রুমে গিয়ে দেখলো তামান্না তাদের চার বছরের ছেলে তানভীরকে বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। কী মায়া ঐ মুখটায়, ডিম লাইটের আলোয় আরো মায়াবী লাগছে। ইরফান এগিয়ে গিয়ে তামান্নার পাশে বসলো। গালে পরে থাকা চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিলো। ইচ্ছে করলো কপালে ভালোবাসার পরশ দিতে কিন্তু কোথায়ও একটু বাঁধা অনুভব করলো। এতোটাই দুরত্ব এসে গেছে দু’জনের মাঝে।
ইরফান দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, “আবার কখনো কী আমাদের জীবনটা আগের মতো হবে?”
ফারহান নিজের বেলকনিতে ইজি চেয়ারে বসে আছে চোখ বন্ধ করে। তার বয়স যখন ছয় বছর তখন অনুর জন্ম। তাদের কাজিনদের মধ্যে প্রথম মেয়ে অনামিকা। ইরফান, ফারহান, আহির আর মাহির তারা তখন চার ভাই ছিল। অনামিকাকে পেয়ে সবাই তখন অনেক খুশি। সবার চোখের মণি হয়ে উঠেছিলো অনামিকা। লিজা, তানিশা ওদের পেয়ে ধীরে ধীরে অনামিকার গুরুত্ব সবার কাছে কিছুটা কমে এলেও ফারহানের কাছে কমেনি। ধীরে ধীরে ফারহান বুঝতে পারে শ্যামবর্ণ মেয়েটাকে তার ভালো লাগে কিন্তু সেটা বোন হিসাবে নয়। সেই ভালোলাগা ভালোবাসায় রুপ নিয়েছিলো কিনা জানে না ফারহান। তার আগেই ভালোবাসার উপর থেকেই বিশ্বাস উঠে গেছে। একটু একটু করে তারও দুরত্ব বেড়েছে অনামিকার সাথে।
ফারহান বিড়বিড় করে বললো, “আমি চাই না অনামিকা আমার জীবনে আসুক। আবারও ভালোবাসার অপমান হোক।”
৬.
পরদিন সবাই এনগেজমেন্টের শপিং করার সিদ্ধান্ত নিলো।
অনুকে যেতে বললে সে রেডি হতে হতে বললো, “আমার ভার্সিটি যেতে হবে, সামনে এক্সাম।”
তানিশা তুই এখনো শুয়ে আছিস কেনো? তোর তো আর কোনো কাজ নেই তুই চল।
আমার শরীর খারাপ লাগছে মা।
মোমেনা ব্যস্ত হয়ে বললো, “কী হয়েছে?”
এমনই রাতে ঘুম হয়নি, আমি ঘুমাবো।
তোরা কেউ না গেলে, লিজার একা একা কেমন লাগবে?
তানিশা তাচ্ছিল্য হেসে বললো, “কাবাবের হাড্ডি করে আমাদের নেওয়ার কী প্রয়োজন? দুজনেই যাক সময় কাটাতে পারবে।”
মোমেনা কিছু একটা ভেবে বললো, “এটা তো ভেবে দেখিনি। সেটাই ভালো হবে। আজ বরং ওরা দু’জনে যাক, যা বাকি থাকে আমরা পরদিন গিয়ে নিয়ে আসবো।”
মোমেনা রুম থেকে বের হয়ে যেতেই তানিশার মুখটা মেঘে ঢাকা পড়লো। গাল ভিজে উঠলে অনু হাত বাড়িয়ে মুছে দিলো।
তানিশার গালে হাত রেখে বললো, “আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।”
তানিশা মলিন হেসে বললো, “দেখেছো আপু এনগেজমেন্টের খুশিতে সকালবেলায় শপিংয়ে যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছে একেক জন।”
তানিশা আরেক দিকে ঘুরে শুয়ে পড়লো। অনু দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে রুম থেকে বের হলো ভার্সিটি যাওয়ার জন্য। রুমের বাইরে আসতেই লিজার সাথে দেখা হয়ে গেলো।
অনুকে দেখে লিজা বললো, “তানিশা কোথায় আপু?”
আমার রুমে আছে।
লিজা ওহ্ বলে অনুর রুমের দিকে যেতে নিলে অনু লিজার হাত ধরে ফেললো। লিজা প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকালো অনুর দিকে।
অনু অবাক কণ্ঠে বললো, “তোর গালে থাপ্পড়ের দাগ কেনো?”
চলবে,,,,