এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব -০২

#এ_শহরে_তুমি_নেমে_এসো 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০২

‘ফেল করলে বিয়ে দিবে, এজন্যই ফেল করি। শীতে জামাই ছাড়া থাকা যায়?’
অপূর্ব ভাই বাচ্চাদের ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকিয়ে ব্যঙ্গ করলেন। পরক্ষণেই চ্যাঁচিয়ে বললেন, “মহান কাজ করেছেন আপনি। পুরস্কার হিসেবে ইচ্ছে করছে ধরে পি/টা/ই। তোর নাম কাজেই গরু। গরুর গোবর থাকে গরুর মূত্রনালীতে আর তোর মাথায়। এই গোবর সবচেয়ে নিম্নমানের। গোবর দিয়ে বায়োগ্যাস উৎপন্ন হয়, গোবর সার হিসেবে ব্যবহার করলে ফসল উৎপাদন হয় ভালো। মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়, মাটিতে চুলায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু তোর মাথার গোবরে মাছি ভনভন করে। কোনো কাজের না।”

কাঁচুমাচু মুখ করে নখ খুঁটতে লাগলাম। অপূর্ব ভাই আঙুল তুলে বললেন, “কথায় কথায় ছাপ্পান্ন পাটির দাঁত রোদে শুকিয়ে দিস। দাঁতের অবস্থা দেখেছিস।”

‘ই’ করার ভঙ্গিতে দাঁত মেলে দিলাম। একত্রিশ পাটির দাঁত আমার। এখনো চারটা বাকি আছে। তিনটাই গজ দাঁত। অপূর্ব ভাই নাক কুঁচকে বললেন, “দাঁত তো চিকচিক করছে, নির্ঘাত টুথপেস্ট ঘসতে ঘসতে শেষ করে ফেলেছিস। বি/শ্রী লাগে দেখতে। দাঁত আর দাঁত। বিয়ে করবে কে তোকে, শুনি? ছাপ্পান্ন পাটির দাঁত আবার ফেলটুসি।”

ভাব নিয়ে বললাম, “আমার জন্য রাজকুমার আসবে। ‘সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারে সে থাকে’ – নানিমা বলেছেন।”

অপূর্ব ভাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। শেফালীও যোগ দিল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিঃশব্দে উচ্চারণ করলাম, ‘শেফালী, মিষ্টি কুমড়ার ফালি। তোকে মিষ্টি কুমড়ার মতো ফালি ফালি করে কা/ট/ব, অপূর্ব ভাই যাক একবার।’

তুর বলে, “আমাদের সবার জোড়া আছে। আরুরও আছে।”

“দক্ষিণ পাড়ার বিশ বিঘার আম বাগানের মালিক কুদ্দুস তালুকদার আছে না? আমারে আরুর জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিছে।” অপূর্ব ভাইয়ের কথা থামার পূর্বেই উত্তেজিত হয়ে পড়লাম। তাহলে সারাদিন আম গাছে চড়ে থাকতে পারব। কী মজা! বিচলিত হয়ে বললাম, “সত্যি? সারাদিন আম খাবো।”

অপূর্ব ভাই বিদ্রুপ করে বললেন, “পুরোটা শুনে নে আগে, কুদ্দুস তালুকদারের ছোটো ভাই। রিকশা চালায়। তার সাথে বিয়ে দিবো। সারাদিন রিকশায় চড়ে ঘুরবি‌।”

“না। আমি বিয়ে করব না।” বলে এক চিৎকার দিয়ে উঠলাম। অপূর্ব ভাই গম্ভীর গলায় বললেন, “কেন? এতক্ষণ তো দিব্যি নাচছিলি।”

“আমি রাজকুমার বিয়ে করে ঘোড়ায় চড়তে চাই, রিকশায় না।”

“রাজকুমার তো অশিক্ষিত কাউকে বিয়ে করবে না।”

“আমি পড়বো এখন থেকে।” বলতেই অপূর্ব ভাই দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলেন। বই খাতাগুলো টেবিলে গুছিয়ে রাখলেন। সকাল নয়টা বাজে তৈরি থাকতে বলে বেরিয়ে গেলেন ধপাধপ পায়ে। আমি বের হলাম। মায়ের ঘরে গিয়ে দেখলাম তিনি ঘুমাচ্ছেন। মা প্যারালাইড হয়েছে আমার তখন চার বছর। মামা বাড়িতেই মানুষ। বাবা নতুন সংসার পেতেছেন। মাকে দেখার জন্য আয়া রেখেছে। নাম তার ফুল। তিনি মায়ের পাশেই ঘুমান। তিস্তা আপুর বিয়ের জন্য ফুলকে বাড়ি পাঠিয়েছেন। আমি মায়ের পাশে শুয়ে পড়লাম।
___
প্লেটে দুটো রুটি। আলু ভাজি দিয়ে আয়েশ করে খাচ্ছি। পরনে আকাশি রঙের ফ্রক। স্কুল ফ্রক টা খুঁজে পাচ্ছিনা। দুমাসের মতো হয়েছে স্কুলে যাই না। কোথায় রেখেছি তা-ও জানি না। নানা নানি এলেন। সকালে পানি দেওয়া পান্তা ভাত খেয়েই তারা প্রশান্তি অনুভব করে। মামুনি ভাতের থালা দিয়ে বলেন, “আম্মা, আব্বা। এই শীতের সকালে পান্তা ভাত না খেলে চলে না। এমনিতেই বয়স হয়েছে‌। কাশতে কাশতে নাজেহাল অবস্থা হলো বলে, গতরাতে পাত্রপক্ষের সামনে উপস্থিত হলেন না।”

নানি মা পান্তা ভাত নিয়ে লঙ্কা ও পেঁয়াজ দিয়ে খেতে লাগলেন। নানাভাই রঙ চায়ের কাপ হাতে নিলেন। টেবিলের উপর রাখা পেপারটা পড়তে পড়তে বললেন, “মান্দাতার আমল থেকে পান্তা খেয়ে আসছি। না খেলে শান্তি পাই না। কী তাই তো?”
আমার দিকে তাকিয়ে বলছেন, ‘কি তাই তো?’ নানাভাই-এর মুদ্রা দোষ আছে। প্রতিটি কথার শেষ ‘কি তাই তো’ বলার। আমি কপাল গুছিয়ে বললাম, “হ্যাঁ তাই তো! তাই তো! তাই তো! আমি তো মান্দাতার আমলে ছিলাম, তুমি যে অন্যের বাড়ির ডাব চু/রি করে বিক্রি করেছ সেটাও দেখেছি। কি তাই তো?”
শেষ কথাটা নানা ভাইকে ব্যঙ্গ করে বললাম। ছোটো মামুনি মধ্যম আওয়াজে হেসে উঠলেন। নানাভাই চোখ গরম করে তাকালেন। মামারা সবাই উপস্থিত হয়েছে।মাকে হুইলচেয়ারে করে ফুল এনেছে। আমার চার মামা। নানি মায়ের আট সন্তান ছিল। সাতজন ছেলে, একজন মেয়ে। তিনজন মা/রা গেছে ছোটো বেলায়। সাত ভাইয়ের এক বোন বলে নাম পারুল। বাড়ির নাম মিলিয়ে রেখেছেন, ‘সাত ভাই চম্পা।’ মামারা সবাই এক এক করে মায়ের কপালে চুমু খেল। মায়ের অসুস্থতার পর আমাদের বাড়ির সবাই অগ্রাহ্য করতে শুরু করে। এক বোন হওয়ার সুবাদে মামারা বোনকে নিজেদের কাছে রাখে। নয়নের মণির একমাত্র মেয়ে হওয়ার সুবাদে আমার অবস্থান সবার উপরে।

‘ছোটো বোন পারুলের হাতে রেখে হাত
সাত ভাই চম্পার কে/টে যাক রাত’

সবাই খেতে বসল। আমাকে দেখে বিস্ময় প্রকাশ করে ছোটো মামা বললেন, “কি-রে বড়ো ময়নাটা, এত সকালে তোর ঘুম ভাঙল কীভাবে?”

‘ঘুম কী সাদে ভেঙেছে? তোমার আদরের ভাইপো ভাঙিয়েছে।’ মনে মনে আওড়ালাম। পরক্ষণে বললাম, “স্কুলে যাবো মামা। অপূর্ব ভাই নিয়ে যাবেন।”

বড়ো মামিমা মামার প্লেটে রুটি তুলে দিতে দিতে বলেন, “তুই না বললি, আর নাইনে পড়বি না।”

অপূর্ব ভাই ততক্ষণে উপস্থিত হলেন ডাইনিং-এ। শহরে একা থাকেন তিনি। বোনের পাত্র দেখার জন্য পরশুদিন রাতে ট্রেনে করে এসেছে। কাপতে কাপতে বসলেন চেয়ার টেনে। টমেটোর চাটনি প্লেটে নিলেন। গোসল করেছেন। ঠান্ডা একটা হাওয়া আমার শরীরে ধাক্কা লাগল। কাঁপতে কাঁপতে শালটা আরেটু আঁকড়ে ধরে বললাম, “অপূর্ব ভাই আপনি ওপাশে যান, আমার শীত করছে।”

রুটি ছিঁড়ে বলেন, “লাগাব এক চ/ড়। চুপচাপ খেয়ে স্কুলের ফ্রক পর। সপ্তাহে একদিনও তো গোসল করতে দেখি না। মানুষের গোসল দেখলেও তোর এলার্জি। মাঝে মাঝে মনে চায় বিচুটি পাতা ঘসে দেই। সারারাত চুলকাতে চুলকাতে দিঘিতে গিয়ে ডুব দিবি। অন্তত গোসল হবে।
মা, গরুর ডাক শুনলাম। গরু কি গোয়ালে?” তিয়াস ও তিস্তা ভাই বোন। মেঝো মামার ছেলেমেয়ে। তিহাস ভাই খেতে খেতে বলেন, “এই শীতে সকাল-সকাল গরু নামালে ঠান্ডা লাগে‌। সবুজেও ঠান্ডা। কাশতে কাশতে নাজেহাল। তাই বলেছি বেলা করে গরু চড়াতে। খড়কুটো গোয়ালে দিয়েছে।”
সবুজ আমাদের গরু চড়ায়, রাখাল।

শিক্ষক মণ্ডলী কক্ষের সামনে নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। পড়নে গতকালের পোশাক। স্কুলের ফ্রক খুঁজে পাইনি। তা-ও পরনের জামার অর্ধেক ছেঁড়া। ওড়না দিয়ে ঢেকে রেখেছি। অপূর্ব ভাই হাতের ইশারায় ডাকলেন কাছে। স্যার গম্ভীর গলায় বললেন, “অপূর্ব আমাদের স্কুলে চেয়ারম্যানের ছেনে নয় বরং পড়াশোনায় সেরা একজন ছাত্র। তার কথাতেই তোমাকে দশম শ্রেণিতে উঠানো হলো। তবে আমাদের কন্ডিশন আছে, ‘প্রথম সেমিস্টারে সব বিষয়ে পাশ ও টেস্ট পরিক্ষায় ৮০+ মার্ক থাকলেই ফাইনালে এলাউ করা হবে।’ আশা করি চেয়ারম্যান বাড়ির মান ডুবাবে না।”

“যদি এক কম থাকে, তাহলে?” অপূর্ব ভাই চোখ রাঙাতেই থেমে গেলাম।
প্রধান শিক্ষক দত্তরিকে আদেশ দিলেন এক সেট নতুন বই দিতে। আগের বইগুলো না পড়েও ছিঁড়ে গেছে, হারিয়ে গেছে কিছু। কাঁচুমাচু করে হাতে নিলাম। প্রচুর পড়তে হবে‌। হাতে নিতেই নতুন বইয়ের মনমাতানো এক সুবাস নাকে ‌প্রবেশ করল। আমি প্রায় সময় বইয়ের মাতায় নাক ডুবিয়ে রাখি এই সুবাস নিতে। আলাদা এক ভালোলাগা কাজ করে। মনমাতানো সুবাস যখন হারিয়ে যায় তখনই হারিয়ে যায়। কোথায় থাকি নিজেও জানিনা। অপূর্ব ভাই পা চালিয়ে বেরিয়ে গেল। দশম শ্রেণির ক্লাসের জানালা দিয়ে উঁকি দিলাম। আমি, তুর ও শেফালী একই ক্লাসে। বইগুলো দেখিয়ে পিছুপিছু হাঁটতে লাগলাম।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here