#এ_শহরে_তুমি_নেমে_এসো 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০৩
“অপূর্ব ভাই, আমরা এদিকে কোথায় যাচ্ছি? বাড়ির রাস্তা তো রেখে এসেছি।” বলতে বলতে পা চালালাম। অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছি ইতোমধ্যে।
আমাদের বড়ো একটা দিঘির আছে। দিঘির চারদিকে বড়ো বড়ো নারিকেল গাছ ও তাল গাছ। তাল আমার প্রিয় ফল। দুই নারিকেল গাছের দূরত্বের মাঝে টমেটো গাছ। অদূরে সারিবদ্ধভাবে কলা বাগান। অপূর্ব ভাই দাঁতের সহায়তায় কলার পাতা ছিঁড়ে আনলেন। আমার হাতে দিয়ে বললেন, “টমেটো বেশি পেকে লেওয়া হয়ে গেছে। যা দ্রুত টমেটো গুলো তুলে নে।”
“অপূর্ব ভাই আমার মনে হয়, কিছু টক বেগুন পচে গেছে। কেমন বিশ্রী গন্ধ আসছে।” বলতে বলতে আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। কথার সমাপ্তি টেনে আমি দ্রুত হাতে টমেটো সংগ্রহ করতে লাগলাম। দিঘিতে আমাদের রাজা হাঁস, চিনা হাঁস সাঁতার দিয়ে বেড়াচ্ছে। অথচ দিঘির পানিতে কুয়াশা ভেসে বেড়াচ্ছে। এজন্যই বলে হাঁসের শীত নেই। অথচ বিড়ালকে জীবনে একবার পানিতে ফেললে মনে হয়, শীতে সে বাঁচবে না।
“অপূর্ব ভাই, সবগুলো টক বেগুন এই বরকে আঁটবে না।” পরক্ষণেই অপূর্ব ভাই দিলেন এক রাম ধমক, “গরু এটা টমেটো, নট টক বেগুন। কলা পাতা, বরক নয়। শুদ্ধ ভাবে উচ্চারণ কর।”
কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম, “ছিঃ অপূর্ব ভাই, ছিঃ। টক বেগুন আমাদের ভাষা। বাংলা ভাষা। এই ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে আমার ভাই। তার বোন হয়ে আমি ইংরেজি বলতে পারি না।”
অপূর্ব ভাই নাক কুঁচকে বললেন, “তোর ভাই এলো কোথা থেকে? পৃথিবীতে আসার আগেই জীবন দিয়েছে, না-কি তোর সৎ ভাই দিয়েছে? শুনেছি তোর বাবার একটা ছেলে হয়েছে।”
টমেটোগুলো পেঁচিয়ে হাঁটতে লাগলাম। আমার সাধ্যমতো সংগ্রহ করেছি। হাঁটতে হাঁটতে বললাম, “শুনেন, শহীদেরা তো আমার ভাই হয়। আমি কবিতায় পড়েছি, ‘বাংলা আমার মায়ের ভাষা শহীদ ছেলের দান, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙা ফেব্রুয়ারির গান।’ কী তাই তো?”
অপূর্ব ভাই হাত থেকে টমেটোগুলো কেড়ে নিয়ে বললেন, “হ্যাঁ! তাই তো! তাই তো!” পরক্ষণেই কোমর দিয়ে স্বজোরে দিল এক ধাক্কা। হুমড়ি খেয়ে পড়লাম দিঘির জলে। মাটি স্পর্শ করে উপরে ভেসে উঠলাম। শীতে কাঁপতে কাঁপতে পাড়ে আসার প্রচেষ্টা করলাম। পানি এতো ভেজা কেন? পরতে ভিজিয়ে দিল। বাবারে বাবা, কে এই দিঘিতে বরফ ভিজিয়ে রেখে গেছে? সাঁতরে সাঁতরে সিঁড়িতে গিয়ে উঠলাম। অপূর্ব ভাই ততক্ষণে পৌঁছে গেছে সেখান। পকেট থেকে সাবান বের করে বলে, “যা, সাবান মেখে টুস করে আরেকটা ডুব দিয়ে আয়। শরীর থেকে মোরগ পঁচা গন্ধ আসছে।”
দ্বিগুন তেজ নিয়ে বললাম, “আপনার শরীর থেকেও আসে। দামী দামী সুগন্ধি মেখে গন্ধ আড়াল করেন।”
“তোর সুগন্ধি নেই, তুই গোসল করবি। যা দ্রুত।”
আমি সাবান মেখে দু সিঁড়ি নেমে কচু পাতার মতো ডুব দিলাম। কচু পাতা যেমন ভিজে না, আমিও ভিজলাম না বোধহয়। উঠে পৌঁছে ঘরে চলে গেলাম। কী শীত! কী শীত! দৌড়ে অপূর্ব ভাইয়ের ওয়াশরুমে। আমাদের বাড়িতে একমাত্র অপূর্ব ভাইয়ের ঘরেই ওয়াশরুম আছে। আর আছে মায়ের ঘরে।
কাঁথার ভেতরে ঢুকে কাঁপছি খকখক করে। টিনের ঘরে শো শো করে বাতাস বইছে। কেঁপে কেঁপে উঠছি। দুপুর পেরিয়েছে এসেছে। ঠান্ডায় পেট ভরা। আমাদের স্কুল দশটা থেকে চারটা। তুর ও শেফালী স্কুল থেকে ফিরে গোসল সেরেছে। ছোটো মামার মেয়ে শেফালী। লেফালী তাড়া দিয়ে বলে, “বড়ো চাচি তোকে খুঁজছে, দ্রুত যা। দুপুরে খানসি শুনলাম।”
তেজ দেখিয়ে বললাম, “একদম দরদ দেখাবি না তুই। অপূর্ব ভাই আমাকে জোর করে গোসল করিয়েছে। আমি কিছুতেই তার মায়ের হাতে খাবো না। খাবো না মানে খাবো না।”
দরজা খোলার শব্দ পেলাম। কাঁথার ভেতর থেকে উঁকি দেওয়ার স্পৃহা নেই। কণ্ঠস্বর শ্রবণ হওয়ার দরুন বুঝলাম, বড়ো মামি খাবার নিয়ে হাজির। আদুরে গলায় ডাকলেন, “আরুসোনা কোথায়? খেয়ে নে সোনা পাখি আমার।”
মুখ ঘুড়িয়ে অন্যদিকে ফিরে রইলাম। কিছুতেই খাবো না। মামি আমাকে সামলাতে লাগলেন। তৎক্ষণাৎ উপস্থিত হলো তুর। দৌড়াতে দৌড়াতে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, “তিয়াস ভাই কড়ইগাছে উঠেছে। বড়ো একটা কলাগাছ দিয়ে দোলনা বানাচ্ছে। আমরা ছয় ভাইবোন একসাথে দোলনায় চড়তে পারব। কী মজা। দেখবি আয়।”
আমি কাঁথা থেকে মুখ বের করলাম। কাঁথা না সরিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। ছুটলাম সেদিকে। কিন্তু হায়। কাঁথাসহ মুখ থুবড়ে পড়লাম মাটিতে। গতরাতের ক্ষতটা পুনরায় তাজা হয়ে উঠল। মামি এসে ধরলেন আমায়। কাঁচুমাচু করে কাঁথা উঁচু করে ধরে ছুটে গেলাম বাইরে। বাড়ির সামনেই বড়ো কড়ই গাছ। ইয়া-বড়ো একটা কলাগাছ দিয়ে দোলনা করছেন। তিয়াস ভাই গাছে উঠেছে আর অপূর্ব ভাই নিচ থেকে বলছেন কীভাবে করতে হবে। আমি খুশিতে নেচে ফেললাম। অপূর্ব ভাই আমাকে দেখে বিরক্ত হয়েছে বেজায়। সন্দিহান গলায় বলেন, “সমস্যা কী তোর? এখানে কী, ঘরে যা।”
“আমি দোলনায় চড়ব।” আমার কথায় অপূর্ব ভাই জানায়, “দোলনা আমার। তাই আমি যাকে চাইব, তাকেই উঠতে দিবো। যে আমার কথা শুনবে আমি তাকেই উঠতে দিবো।”
‘ছলছল নয়নে হাসিমাখা বদনে’ – অনুভূতি নিয়ে তাকিয়ে রইলাম। ঠোঁট উল্টে বললাম, “আমি আপনার সব কথা শুনি। আপনি আমাকে স্কুলে ভর্তি করতে নিয়ে গেছেন, যাই নি? গোসলে সাবান মেখে ডুব দিতে বলেছেন, দেইনি? তাহলে..
উপর থেকে দড়ি ফেললেন তিয়াস ভাই। অপূর্ব ভাই দড়ির সাথে বাঁধলেন কলাগাছ। বললেন, “দুপুরে খেয়েছিস? না খেয়ে দোলনায় উঠলে যদি পড়ে যাস, তার দায় কে নিবে? আমি তোকে উঠতে দিতে পারি না।”
মামি পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। অপূর্ব ভাইকে ধমকের বললেন, “এখনই তোর দোলনা বানাতে হবে? সবে আরুকে খাওয়াতে গেছিলাম।”
অপূর্ব ভাই আমার দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে হাসলেন। আমি মামির কাছে গেলাম। কলাগাছের পাতাগুলো মাটিতে রেখে বসার জায়গা করে নিলাম। মামিকে বসিয়ে হা করলাম। উত্তেজিত হয়ে বললাম, “তাড়াতাড়ি খাইয়ে দাও। ওরা দোলনায় উঠে যাবে।”
মামি অপূর্ব ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। মনে মনে ধন্যবাদ জানালেন। আমাকে সবসময় শর্ত দেয়। খেয়ে উঠে বসলাম দোলনায়। তিস্তা আপুর মন অজানা কারণে ভালো নেই। কাল থেকে ঘরে বসে আছে। যদি মন ভালো হতো একসাথে ছয়জনে চড়তাম। এখন আমরা পাঁচজনে একসাথে উঠেছে। ‘ছোপ, ছোপ’ করে দিঘির জলে কিছু পড়ার শব্দ পেলাম। মাঝখানে বসা আমি কৌতুহল নিয়ে বললাম, “এই সন্ধ্যায় কে গোসল করতে গেল? মনে হয় সে ‘হাঁসের বংশের’ বংশধর।”
তিয়াস ভাই বললেন, “মনে হয় তাল পড়েছে।”
অপূর্ব ভাই তাল মিলিয়ে বলেন, “হ্যাঁ। টমেটো তুলতে গিয়েছিলাম, তখন গাছে পাকা তাল দেখেছি।”
“দোলনা থামাও দোলনা থামাও।” বলে চ্যাঁচিয়ে উঠলাম। থামতেই ছুটে গেলাম সেদিন। তালের পিঠা, তালের রস, তালের বিচি সব আমার প্রিয়। কী মজা লাগে। পেছন থেকে শুনতে পেলাম তুর বলছে, “কী একটা ফল পেয়েছে মেয়েটা। তালের জন্য কেউ এমন পা/গ/ল হয়?”
শেফালী বিদ্রুপ করে বলে, “গরু বলে কথা। তবে গরুর চারটা পা। আরুর চারটা পা হলে ঘোড়ার মতো ছুটতো।”
অপূর্ব ভাই চুপ থেকে ছড়ার সুরে বলেন,
‘আরু, আমাদের বোন গরু
গরুর হচ্ছে চারটা পা,
আরুর কেন দুইটা পা?
কেন! কেন!’
চলবে.. ইন শা আল্লাহ