এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব -০৯+১০

#এ_শহরে_তুমি_নেমে_এসো 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০৯

মাথানত করে রইলাম। অপূর্ব ভাই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন, “ইচ্ছে হলে ঘরে গিয়ে পোশাক বদলে নিস। নাহলে না। আর মাত্র কিছু ঘণ্টা।”

বলেই অপূর্ব ভাই চলে গেলেন। ঠান্ডায় কাঁপুনি এবার গভীরভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হলাম। মাথা নিচু করে ঘরে গেলাম। তুর শেফালী আমার জায়গা দখল করে ফেলেছে। এখানে শোবার মতো জায়গা অবশিষ্ট নেই। ড্রয়ার থেকে পোশাক বের করে পরিধান করলাম। ভেজা জামা কাপড় সেভাবে রেখে বিছানার কাছে গিয়ে বললাম, “তুর শেফু ঠিক করে শো।”

বিনিময়ে আরও ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে পরল। বিরক্ত হলাম অনেকটা। অগ্রসর হলাম তিস্তা আপুর ঘরের দিকে। দরজা খোলা, তবে ঈষৎ ভিরিয়ে রাখা। কাঁপতে কাঁপতে লেপের নিচে ঢুকে গেলাম। তিস্তা আপুর উষ্ণ পায়ের উপর আমার আর্দ্র পা পড়তেই ধরফরিয়ে উঠে বসল। ঘুমু ঘুমু চোখে তাকিয়ে বলে, “সমস্যা কী তোর? এখানে কী করছিস? পা সরা। বরফের ভেতরে ছিলি এতক্ষণ?”

তিস্তা আপু নিজ হতেই সরলেন। কাঁপতে কাঁপতে বললাম, “আপু তুমি কি ঘুমিওছ? একটা কথা বলব?”

“ঘুম তো চান্দে পাঠিয়েছিস। তাড়াতাড়ি বল কি‌ বলবি?” চোখ বন্ধ করে বলে। আমিও ইঙিয়ে বিঙিয়ে বললাম, “ধরো, শেফালীর হবু বর মাঝরাস্তায় বৃষ্টির কারণে আটকে গেছে। ফোন করে বিষয়টা তুরকে বলেছে। তুর কি বাড়ির কাউকে না জানিয়ে মাঝরাতে যেতে পারে তাকে আনতে?”

তিস্তা আপু চোখ বড়ো বড়ো করে বললেন, “পা/গ/ল নাকি তুই। মাঝরাতে বেরিয়ে যাওয়ার অসম্ভব। বিপদের হাত পা নেই। যদি লোক জানাজানি হয়। ভাবতে পারছিস কী হবে? তুরের নামে তবে বাজে কথা রটাবে।
এমন কিছু কখনো ঘটলে অবশ্যই আগে বড়দের জানবি। হুট করে সিদ্ধান্ত নিবি না। তোর মতো সহজ-সরল কিন্তু গ্ৰামের লোক নয়।”

মাথা নেড়ে কম্বলের নিচে ঢুকলাম। খুশ খুশ করছে ভেতরটা। ইচ্ছে করে ছুটে যাই অপূর্ব ভাইয়ের নিকট। দু’জনের মাঝে প্রয়াস ভাই নামক অদৃশ্য বাঁধা। ঠান্ডায় অবিলম্বে ঘুমে নিমজ্জিত হলাম।

ছয়টা নাগাদ ঘুম ভাঙল আমার। ওড়নাটা বালিশের পাশ থেকে নিয়ে হাঁটা দিলাম। বৃষ্টির পর আকাশ পরিচ্ছন্ন। নিমের ডাল নিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে বের হলাম উঠানে। মোরগ ডাকছে। অপূর্ব ভাইকে দেখতে পেলাম উঠানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ব্যায়াম করছে। আগে কখনো দেখিনি। অবশ্য এত সকালে ঘুম ভাঙে না। তার সাথে কথা বলা জরুরি। থু থু ফেলে নম্র ভদ্র গলায় বললাম, “অপূর্ব ভাই, আমি স্যরি।”

অপূর্ব ভাই আমাকে না দেখার ভঙ্গিতে একটু দূরত্ব বজায় রাখলেন। দু’হাতে ভারী ভারী যন্ত্রপাতি নিয়ে ব্যায়াম করছে। গ্ৰামে থাকি বিধায় নাম জানি না। যন্ত্রটা কেড়ে নিয়ে বললাম, “আমি বুঝতে পারিনি। আর এমন হবে না। রাগ করে থাকবেন না। বাড়ির কাউকে কিছু বলবেন না। নানি মা বকবে।”

অপূর্ব ভাই হাতটা পুশ আপ করতে করতে বলেন, “আমি কেন রাগ করব? আমি রাগ করি না।”

কোমরে হাত দিয়ে বললাম, “কানা মানুষকে ল্যাট্রিনের সামনে নিয়ে হাইকোর্ট বোঝাবেন না। আমি অবুঝ নই, তবে মাঝে মাঝে অবুঝের মতো কাজ করে ফেলি।”

“ল্যাট্রিন? ইয়াক থু। এগুলোও ভাষা? শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে বলছি। ওয়াশরুম বলবি।”

“ল্যাট্রিন শব্দটা আগের মানুষ ব্যবহার করত। তারা যখন খোলা জায়গায় প্রাকৃতিক কাজ সম্পন্ন করত। নানি মা বলেছেন আগে কমড ছিল না। সবাই গাছে উঠে প্রাকৃতিক কাজ করত। সেখানে বস্তা দিয়ে আড়াল করত। কত কত মানুষ গাছের ডালে বসে করত। বৃষ্টির সময় গাছ পিচ্ছিল হয়ে যেত না? তখন পা পিছলে উল্টে পরত। গলা পর্যন্ত ডুবে যেত পটিতে। দেখতে কেমন লাগত, বুঝতে পারছেন?”

“ইয়াক থু! থু! তোর চিন্তা ভাবনা ইদানীং খুব বাজে হচ্ছে। তোরও পরতে ইচ্ছে করছে?”

কালো কাক উড়ে গাছের ডালে বসল। কর্কট‌ গলায় কা কা করে দু ডাক দিল। সবুজ পাতা থেকে উষ্ণ এক ফোঁটা জল গালে পরল আমার। বামহাত দিয়ে লেপ্টে গাল ভরিয়ে ফেললাম। আর্দ্র হাওয়ার বিপরীতে উষ্ণ হাওয়া। অপূর্ব ভাই ঘাড় কাত করে বললেন, “ধর তুই আদিম যুগে। পটি করতে গাছের উপর উঠে গেলি। বৃষ্টি ছিল। পিচ্ছিল হয়ে গেছে। প্রাকৃতিক কাজ সম্পন্ন করে নেমে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হচ্ছিলি। আচমকা পিছলে গেল পা। মুখ থুবড়ে পরলি পটির ভেতরে। ডুবে গেলি পুরোপুরি। শ্বাস নিতে পারলি না। দম বন্ধ হয়ে মা/রা গেলি। ভাবতে পারছিস কী হতো?
‘প্রথমবার মানুষের পটির ভেতরে পরে প্রাণ গেল এক কিশোরীর’ এটাই নিউজ হবে। সংবাদপত্রে বের হবে।”

অক্ষরে অক্ষরে কল্পনা করে আঁতকে উঠলাম আমি। মধ্যম আওয়াজে বললাম, “নাহহহ। আমি পরব না। তলিয়ে যাবো না। আমি লিলিপুট নই।”

“আমি যদি বলি তুই বেঁটে তখন? ছাপ্পান্ন পাটির দাঁত বলেছি বলে দাঁত টেনে তুলে ফেলেছিস। লম্বা বললে নিশ্চয়ই নিজেকে কে/টে ছোটো করবি।
তাই বেঁটে বলেছি। এবার কী করবি?”

ভাব নিয়ে বললাম, “আমি মোটেও বেঁটে নই। তাছাড়া আমি পরব না।”

অপূর্ব ভাই একটু ঝুঁকে বললেন, “গালে হাত দিয়ে দেখ। অর্ধেক পরেছিস।”

গালে হাত দিলাম। তরল পদার্থটি দৃষ্টিগোচর হলো সাদা বর্ণের। কাকটি তার প্রাকৃতিক কাজটি সমাপ্ত করেছে আমার উপর। ছুটে গেলাম ঘরের দিকে। পা গেল পিছলে। কাঁদায় মাখামাখি হলাম বিলম্বে। অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন অপূর্ব ভাই। কিছুটা বিদ্রুপ করে বললেন, “দেখছিস। ইতোমধ্যে আমার ধারণা সত্যি হতে চলেছে।”

কোমরে ব্যথা পেলাম বেশ। নড়াচড়া করে বললাম, “দাঁত রোদে দিয়েন না। ধরুন। ব্যথা পেয়েছি।”

অপূর্ব ভাই এগিয়ে এলেন। হাত এগিয়ে দিয়েন। ধরলাম না। জখমটা একটু জোয়াল। নড়তে বেগ পেতে হচ্ছে‌। অপূর্ব ভাই আশেপাশে পর্যবেক্ষণ করলেন। কাক ডাকা ভোর, কেউ নেই। হুট করে কোলে তুলে নিলেন আমায়। এগিয়ে গেলেন বাড়ির ভেতরে। গালে থাকা সাদা বর্ণের পদার্থটি ঘসে ঘসে অপূর্ব ভাইয়ের শার্টে লাগিয়ে দিলাম। সোফার উপর রেখে বললেন, “মা, দেখো তো কোথায় ব্যথা পেয়েছে? তেল দিয়ে মালিশ করে দিও। ঠিক হয়ে যাবে।”

অপূর্ব ভাই চলে গেলেন। মামিরা ব্যস্ত হলেন আমায় নিয়ে।
___
ক্লাস চলাকালীন সময়ে গালে হাত রেখে অশান্ত মন নিয়ে বসে আছি। প্রয়াস ভাইয়ের কথাটা সবার থেকে লুকিয়েছেন অপূর্ব ভাই। সবাই জানে অপূর্ব ভাই রাতে তাকে এনেছে। তিনি যে মুখ ভার করে আছেন, এতে সন্দেহের অবকাশ নেই।

তিনজন মেয়ে ও একজন স্যার ম্যাম ঢুকলেন ক্লাসে। সালাম বিনিময় করলাম। তারা সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে বললেন, “আগামীকাল থেকে তোমাদের স্পোর্ট শুরু। তিনটি ধাপে অনুষ্ঠিত হবে। প্রতিটি রিচ্যুয়ালের সাথে তোমরা পূর্ব পরিচিত। যারা যারা অংশগ্রহণ করতে চাও। নাম লেখিয়ে দিও।”

অতঃপর চলে গেল। দিনের বেলাতেও মশার উপদ্রব ঘটেছে। মশা মা/রার উদ্দেশ্যে চ/ড় দিয়ে বললাম, “অপূর্ব ভাইকে কীভাবে মানাই বলতো?”

শেফালী পড়তে পড়তে বলে, “স্পোর্টে নাম দে। প্রথম হয়ে পুরষ্কার নিয়ে আয়। দেখবি ভাই কত খুশি।”

তুর তাল মিলিয়ে বলে, “ঠিক বলেছিস। ভাইয়া অনেক খুশি হবে।
মাঠের তিনটা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ১. গোলক নিক্ষেপ, ২. একশ মিটার গোল দৌড়। ৩. মার্বেল দৌড় ৪. নাচ ৫. গান।
সবগুলোতেই চেষ্টা করবি। দেখবি একটা না একটা ঠিক পাবিই। একবার না পারিলে দেখো শতবার।”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]#এ_শহরে_তুমি_নেমে_এসো 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১০

“অপূর্ব ভাই, আপনি আমার উপর অভিমান করে থাকতে পারবেন না। আপনার অভিমান ভাঙানোর ওষুধ আমার হাতে।” নিভৃতে যতনে কথাগুলো আওড়াতে আওড়াতে অগ্ৰসর হলাম অপূর্ব ভাইয়ের কক্ষের দিকে। শান্ত শিষ্ট সবকিছু। তারা ছায়াটিও অনুপস্থিত। গতরাতে গোছানো ট্রাভেলিং ব্যাগ তার জায়গায় অনুপস্থিত। চলে যায় নি তো?

বইখাতা বিছানায় রেখে ছুটে গেলাম বাইরে। উঠানে বসে কথার ঝুলি খুলেছে চার মামি ও নানি মা। হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, “অপূর্ব ভাই কোথায় বড়ো মামি?”

“ও তো চলে গেছে। ঘণ্টা খানেক আগে। পাঁচটায় ট্রেন।” বলেই সবাই খোশগল্পে মেতে উঠল। স্কুল ছুটি হয় চারটা নাগাদ।দ্রুতি গতিতে বাড়িতে ফিরতে সময় লেগেছে মিনিট বিশেক। পাঁচটা বাজতে ঢের বাকি। সবাইকে ফেলে স্টেশনের দিকে ছুটে গেলাম সর্বশক্তিতে। মামি চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, “আরু, কোথায় যাচ্ছিস? আস্তে মা, পরে যাবি।”

পায়ের গতি বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, “স্টেশনে মামি।”

ছুটে গেলাম স্টেশনের দিকে। মিনিট ত্রিশ লাগল পৌঁছাতে। ভিড় চারিদিকে। ট্রেন এসেছে। গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার পূর্বে দেওয়া সংক্ষেত বাজছে। যাত্রীরা ব্যস্ত ট্রেনে উঠতে। ছুটে গেলাম দরজার কাছাকাছি। ভিড় ঠেলে উঠে গেলাম ট্রেনে। আশেপাশে গভীর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। অপূর্ব ভাই নেই। আরও কিছুদূর এগিয়ে যেতেই কু সংক্ষেত মনে হানা দিল। ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার কথা? জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেই হতবুদ্ধ হলাম তৎক্ষণাৎ। ট্রেন ছুটে চলেছে গন্তব্যে। আশেপাশে গাছপালা পিছনের দিকে দৌড়ে চলেছে। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম মাটিতে। কী করে ফেলেছি আমি। ভেতর থেকে অশ্রুধারা ঝরে পরল। একজন মধ্যবয়সী পুরুষ আমাকে দেখে এগিয়ে এলেন। আগ বাড়িয়ে বললেন, “কী হয়েছে মা? এভাবে কাঁদছিস কেন?”

নুয়ে গেলাম। ভীত হয়ে বললাম, “চাচা ট্রেন থামিয়ে দিন না, আমি ভুলে ট্রেনে উঠে গেছি।”

“ভুলে কেউ ট্রেনে উঠে?”

“অপূর্ব ভাইকে খুঁজতে ট্রেনে উঠেছি। কখন যে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে।” বলেই ফুঁপিয়ে উঠলাম। লোকটার আমার প্রতি মায়া বাড়ল বৈ-কি। মাথায় হাত দিয়ে শান্তনার ভঙ্গিতে বললেন, “এখন ট্রেন থামানো সম্ভব। কিন্তু বিপদ বাড়ানো ঠিক হবেনা। ট্রেন থেকে নেমে কোথায় যাবে? ইতোমধ্যে অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। রাত হয়ে যাবে।”

ট্রেনে এক লেখার দিকে নজরবন্দি হলো, ‘অপরিচিত কারো খাবার খাবেন না। কথা বলা, সখ্যতা থেকে বিরত থাকুন। শুভ যাত্রা।’ কিছুটা দূরত্বে লেখা, ‘বিনা টিকেটে ভ্রমণ দণ্ডনীয় অপরাধ।‌’ নত গলায় বললাম, “তাহলে এখন কী করব?”

তিনি উত্তম সমাধান দিলেন, “ঢাকায় পৌঁছাতে পাঁচ ঘণ্টা লাগবে। কাল ছাড়া আর ট্রেন ছাড়বে না। তুমি আমার সাথে আমার বোনের বাড়িতে চলো। আমি সকালে তোমাকে ট্রেনে তুলে দিবো। চাইলে কয়েক দিন বেড়াতেও পারবে।”

“না। আমি কালকেই ফিরব।”

তার বুকিং করা কেবিনে গেলাম। দুটো বেড ও অগোছালো জিনিস পত্র দিয়ে ভর্তি। বোনের বাড়ি যাচ্ছে বলে কথা। হাঁস মুরগি, শাক সবজি, ডাল, চালতা, কাঠালি কলা ইত্যাদি। আমি বসলাম। হেলান দিয়ে বসলাম। পা’য়ে প্রচুর ব্যথা করছে। চোখের পলক বন্ধ হলো। ধীরে ধীরে তলিয়ে গেলাম ঘুমে। ঘুম ভাঙল সকালে। নিভু নিভু দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলাম লোকটিকে। আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। ডাকছেন। ঠান্ডায় নাক‌ আঁটকে রয়েছে। তিনি তাড়া দিয়ে বললেন, “চলো মেয়ে। রাতে ট্রেন স্টেশনে এসেছে। এখন সকাল সবাই নেমে ট্রেন ফাঁকা হয়েছে। কিছুক্ষণের ভেতরে ফিরতি ট্রেন ছেড়ে যাবে। চলো তোমাকে কিছু খাইয়ে দেই। অতঃপর ট্রেনে চড়ে সোজা বাড়িতে যাবে।”

আমিও রাজি হলাম। গতকাল সকালে খেয়েছি। ক্ষুধায় কাতর। বাড়ির সবার কথা মনে পরছে। নিশ্চয়ই চিন্তা করছে। ল্যান্ড ফোন কিংবা অপূর্ব ভাইয়ের ফোন নাম্বার জানা নেই। মেঘমুক্ত আকাশের পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলাম। বিপদ যখন আসে চারদিক থেকেই ঘিরে ধরে। ফিরতি ট্রেনও মিস্ করলাম। উপায়হীন হয়ে চললাম লোকটির সাথে।

সবুজ রঙের তিন চাকা গাড়িতে জীবনে প্রথমবার চড়লাম। পেছনে বড়ো বড়ো করে লেখা সিএনজি। প্রথমবার দেখলাম ভ্যান ছাড়াও গাড়ি আছে। অনেক ধরনের গাড়ি। বড়ো বড়ো রাস্তা। রাস্তার দু’পাশে সারিবদ্ধভাবে গাছ লাগানো। বড়ো বড়ো ইট পাথরের বিল্ডিং। আচ্ছা এগুলো আমার মাথায় ভেঙে পড়বে না-তো? আমার ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে লোকটি বললেন, “মেয়ে তোমার নাম কী?”

“অপরিচিতদের মামি নাম বলতে বারণ করেছে।” কথাটা বলে নিজেই খা/রা/প লাগল। আদৌ তিনি আমার অপরিচিত আছে? এক গাল হেসে বলে, “পাগলী মেয়ের কথা শুনো। তুই করে বলছি। তোর নাহয় নিজের নাম বলতে বারণ আছে। কিন্তু আমার নেই। আমার নাম শুনতে বারণ আছে কি?”

“না।”

“আমার নাম ইমদাদুল হোসেন মৃধা।”

বুকের ভেতরে ধুক করে উঠল। অতি চেনা নাম যে। আমার বাবার নাম। গাড়ি থামল। ভাড়া মিটিয়ে নামলেন তিনি। আমিও নামলাম। এক পা ফেলছি তো অন্য পা পিছিয়ে যাচ্ছে। বড়ো একটা বিল্ডিং। কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম, “আমি যাবো না। বিল্ডিং ভেঙে আমার মাথায় পরলে ম/রেই যাবো। বাড়ির কেউ জানবে না, আরু বিল্ডিং-এ চাপা পরে ম/রেছে।”

তিনি আমার হাত চেপে ধরলেন। আমি চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। চারপাশে ভিড় জমে গেল। ঘিরে ধরল তাকে। লোকটা কুপোকাত হলো। বলে, “মেয়েটাকে জোর করে কোথায় নিতাছেন ভাই?”

“ভাই দেখুন কী জ্বালা। আমার মেয়ে। প্রথমবার ঢাকায় এসেছে। বিল্ডিং দেখে ভয় পাচ্ছে। যদি ওর মাথায় পরে।” ইমদাদুল সাহেব থামতেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল সবাই। রাগ লাগল শরীরে। ইমদাদুল সাহেবের ব্যাগ নিয়ে বললাম, “আপনি আগে আগে যাবেন, পরে আমি। বিল্ডিং ভেঙে আগে আপনার গায়ে পরুক।”

তিনি হাসলেন। আমি পিছুপিছু অগ্ৰসর হলাম। পেছন থেকে খামচে ধরলাম তার শার্ট। বিল্ডিং ভেঙে তার মাথায় পরুক।
__
গোসল সেরে জানালার পাশে বসলাম। ঠান্ডা লাগছে প্রচুর। গরম পানিতে গোসল সেরেছি। এই বাড়ির সবাই খুব ভালো। ইমদাদুল সাহেবের বোন, স্বামী ও ছেলে মেয়ে নিয়ে সংসার। সবার সাথে পরিচয় হলেও ছেলেটির সাথে হলো না। মেয়েটির নাম মিহি। তার ঘরেই বসে আছি। মুখে ক্রিম মাখতে মাখতে বলে, “আরু, চিন্তা করছ কেন?”

শ্বাস নিয়ে বললাম, “বাড়ির সবাই চিন্তা করছে।”

“তবে তুমি চিন্তা কোরো না, কেমন? আমি মায়ের কাছে যাচ্ছি। একটু পর ডাক্তার আসবেন।”

“ফুফুকে সুস্থ দেখেছি। কখন অসুস্থ হয়েছেন?”

“আরে মনের অসুখ। মায়ের মন খা/রা/প থাকে সবসময়। তাই একজন ডাক্তার ঠিক করা আছে। তিনি সপ্তাহে একবার আসেন। গত সপ্তাহে হুট করে গ্ৰামে গেছেন। বলেছেন আজ গ্রাম থেকে ফিরে আসবেন। দেখি আসে কি-না?”

তার কথায় দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলাম। অপূর্ব ভাইও মনের ডাক্তার। তারমানে মনেরও অসুখ হয়। কিন্তু আমাদের গ্ৰামে কারো হয়না। কারণ তারা যৌথ পরিবার ও প্রকৃতির মাঝে বেড়ে উঠে।
টাওয়াল দেখিয়ে বললাম, “কোথায় রোদে দিবো? আমাদের পোশাক ক্ষেতে খড়কুটোতে মেলে দেই। তাছাড়া রসিতে।”

“এসো।” বলে মেয়েকে আমায় নিয়ে গেল ছোটো বারান্দায়। কী সুন্দর ঠান্ডা হাওয়া! এতক্ষণ ‘এসি’ নামক যন্ত্রের ভেতরে অবস্থান করছিলাম। গ্ৰিল বিহীন বারান্দা দিয়ে উঁকি দিতেই নজরবন্দি হলো ‘মাটি থেকে উপরের দূরত্ব’ – এত উঁচু। লাফ দিয়ে কাঁধে চড়ে গেলাম মিহির। চুলগুলো চেপে ধরে বললাম, “বাঁচাও, পরে গেলাম। ম/রে গেলাম। মামা-মামি..

মিহি ছাড়াতে চেষ্টা করে বলে, “আরে চুল ছাড়ো। ছিঁ/ড়ে যাচ্ছে, ব্যথা পাচ্ছি। আজব তো! নামো। এই মেয়ে।”

ছাড়াতে ছাড়াতে ছিঁ/ড়ল কিছু চুল। দু’জনেই মুখ থুবড়ে নিচে। মেয়েটিকে রেখে ঘরে গেলাম। জানালার গ্ৰিলে উঠে ঝুলে রইলাম টিকটিকির মতো। মনে মনে আওড়ালাম, “মামি, তোমার ছেলেকে কোথায় পাঠিয়েছ? যখন তখন উঁচু উঁচু বিল্ডিং-এ চাপা পরে প্রাণ চলে যাবে। দশের উপকার করতে গিয়ে নিজের ক্ষ/তি করে ফেলল গো।”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

[রেসপন্স করার অনুরোধ রইল]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here