ও চোখে বৃষ্টি এলে
২.
এক পা দু পা করে নিজের বিয়ের মণ্ডপের দিকে এগিয়ে গেলো সাম্য। চারিদিকে কতো মানুষ উপস্থিত, পুরোটাই এই বিয়েটাকে কেন্দ্র করে। মণ্ডপের এক দিকে ওর বাবা মৈত্রীর বাবার সঙ্গে কথা বলছেন।
-” চিন্তা করবেন না, আপনার মেয়ে আমার মেয়ে হয়েই থাকবে। আর এমন মিষ্টি মেয়েকে ভালো না বেসে কী থাকা যায়! ”
নিজের বাবার কথায় থমকে দাঁড়ালো সাম্য। অবিশ্বাস্য চোখে নিজের বাবার দিকে তাকালো। ভাবতেও অবাক লাগে মানুষ এতো নিষ্ঠুর কিভাবে হয়। শুধু মাত্র নিজেদের একটা ছোট্ট বাচ্চাদের মতো জেদের বশবর্তী হয়ে নিজের সন্তানের জীবনে আঁধার নিয়ে আসছে। কেনো সেই মেয়েটা কী পারতো না তার মেয়ে হয়ে উঠতে! সেও তো ওই মানুষটাকে নিজের বাবা ভাবতো।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাম্য সামনে তাকালো। সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সাম্যের কিছু বন্ধু। তাদের দেখে সাম্য মুখে মিথ্যে হাসি ফোঁটাল। কিন্তু তারা হাসলো না, করুণ দৃষ্টিতে সাম্যের দিকে তাকালো। সাম্য ওদের কাছে এগিয়ে যেতেই ওর এক বন্ধু সোহেল ওকে ফোন এগিয়ে দিলো।
-” নে অ্যান্টির সঙ্গে কথা বল। ”
এখানে অ্যান্টি বলতে যে সোহেল সাম্যের মা কে বুঝিয়েছে তা সাম্য জানে। তাই চোখ মুখ শক্ত করে বললো, ” এখন ফোন করার কি আছে, তাকে বলে দে, আমি তার বৌমাকে নিয়ে বাড়ি ফিরবো। তাকে চিন্তা করতে হবে না আমি পালাবনা।”
সব কটা বন্ধু মিলে ওর দিকে তাকিয়ে জোর করলো
ফোনটা ধরার জন্যে। অবশেষে ফোনটা ধরলো সাম্য। ফোনের ওপাশে ওর মা বেশ শান্ত গলায় বলল, ” তোর ঘরের ড্রয়ারে এতো গুলো ঘুমের ঔষুধ কী করছে সাম্য? তুই কি তবে!”
নিজের মায়ের ভয়ের ব্যাপারটা বেশ বুঝলো সাম্য, এতো যথারীতি ছেলেকে হারানোর ভয়। তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বেশ ভদ্র গলায় সাম্য বলে উঠলো,” আরে আপনি ভয় পাবেন না, আমি ওই গুলো সুইসাইড করার জন্য রাখি নি। মরে গেলে তো সব শেষ, স্টোরি ইস ক্লিয়ার্ড। তখন কেউ বলবে কোথা কার একটা মেয়ের জন্যে চৌধুরী বাড়ির ছেলে কিনা সুইসাইড করেছে, এমনকি কাজটা করার আগে নিজের মা, বাবার কথাও ভাবেনি। আবার অপরদিকে আপনাদের বিশ্বাস নেই। হয়তো আপনারা পিয়ালকেই দোষ দেবেন। দেখা যাবে ও কে হয়তো বাঁচতেও দেবেন না।”
-” এই সব কি বলছিস বাবু?”
-” হ্যাঁ ঠিকই তো বলেছি। আর আমি মরে গেলে তো মুক্তি পেয়ে যাবো। কিন্তু পিয়াল, ও যদি জানতে পারে আমার কিছু হয়েছে, তাহলে তো ও নিজেকে শেষই করে দেবে। তার থেকে একই শহরে দুজনেই বেঁচে থাকবো। আর ওই গুলো তো নিজেকে সামলাতে কাজে লাগে। গত একমাসে হুটহাট করে যখনই মনে হয়েছে মরে যাবো, ওই খান থেকে ঔষধ নিয়ে খেয়ে ঘুমিয়েছি। ”
-” তা বলে এত টেবলেট?”
-” আরে ভবিষ্যতের জন্যে রেখে দিয়েছি। বোঝেন না কেনো! ”
-” সাম্য!”
-” আপনি ফোন রাখুন দেখি। এক্ষুনি আমার বিয়ে শুরু হবে, দেরি হচ্ছে তো।”
-” সাম্য বাবা, আমার কথাটা একবার শোন!”
না সাম্য শুনলো না, ফোনটা সামনের দেওয়ালে ছুঁড়ে মারলো। ফোনটা কয়েক খণ্ড হয়ে ভেঙে পরে গেলো। আর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে সামনে পা বাড়ালো সাম্য, তার আগেই ওর বন্ধু গুলো ওকে জড়িয়ে ধরলো,
-” আমরা তোর পাশে আছি সাম্য, যা করবি ভেবে করিস।”
ততক্ষনে কিছু মেয়ে এসে সাম্য কে ভিতরের একটি ঘরে নিয়ে গেল। অপরদিকে সাম্যের বন্ধুরা চিন্তিত হয়ে বারবার কাউকে কল করতে লাগলো।
¶¶¶¶¶
ঝড় এতক্ষণে থেমে গিয়েছে, চারিদিকে শীতল বাতাস বইছে। ছাদের রেলিঙের নীচে এখনও বসে রয়েছে পিয়াল। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। এতো কষ্ট কেনো ও পাচ্ছে? থেকে থেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছে, জোরে জোরে নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করেও বিফল হয়েছে সে।
কিছুক্ষণ পর আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবলো। পরক্ষনেই কতকটা উন্মাদের মতো নিজের চোখের জল গুলো মুছতে লাগলো।
-” এ কী করছিস পিয়াল, একদম কাঁদবি না। আজ তোর ভালোবাসার মানুষটার বিয়ে, তুই আজ হাসবি, কিছুতেই কাঁদবি না। কেবলই তার জন্যে হাসবি। তোর চোখের জলে যদি সাম্যের ক্ষতি হয়, একদম না। তোর জন্যে সাম্যের ক্ষতি কিছুতেই হবে না। তোর কষ্টের তিল পরিমাণ আঘাতও যেনো সাম্যের গায়ে না লাগে। ”
পিয়ালের এই কথায় যেনো প্রকৃতি ও কেঁদে উঠলো। ঝম ঝম করে বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিয়ে গেল পিয়ালকে, আর ওর চোখের জলকে। যা এতক্ষণ মুছে ফেলার বৃথা চেষ্টা করছিল ও।
-” ইস, এটা কি হলো! আমি তো ভিজে গেলাম। আজ তো আমাকে দেখতে আসবে। যাই তাড়াতাড়ি নীচে যাই। আজ থেকে সাম্য অন্যকারো হবে, আর আমিও অন্য কারোর জীবনে জড়িয়ে যাবো। আমিও খুশি থাকার চেষ্টা করবো। তাহলে সাম্যের জীবনে আমার আর কোনো ভূমিকাই থাকবে না। তাইতো সেই দিন ক্যাফে আমি হাসি মুখে ওকে বিদায় দিয়েছি। শেষ বেলা প্রিয়কে আমি হাসি মুখে বিদায় দিয়েছি, চোখের জলে না। ”
সাম্যকে নিয়ে নানা কথা বিরবির করতে করতে পিয়াল নীচের দিকে পা বাড়ালো। কয়েক পা নামার পরেই শাড়িতে পা জড়িয়ে পড়ে যেতে গেল, কিন্তু রেলিং ধরে নিজেকে আটকে নিলো। কানে ভেসে উঠলো সেই পরিচিত কণ্ঠ,
-” একা একা চলতে শেখো প্রাণায়নী। সবসময় আমি তোমার কাছে থাকবো না।”
পুরোনো এই কথার সাপেক্ষে বেশ রাগী গলায় পিয়াল বলে উঠলো, ” কেনো থাকবে না! সবসময় থাকবে।”
কথাটা বলার পর চমকে উঠলো পিয়াল, এখানে তো সে নেই তাহলে কেই বা কথাটা বললো? আর কাকেই বা আপন ভেবে পিয়াল প্রশ্ন করলো।
¶¶¶¶
ভিতরের দিকের একটা ঘরে সাম্য গিয়ে দাঁড়ালো। সামনের একটা সোফায় বধূ বেশে বসে রয়েছে মৈত্রী। মৈত্রীর বধূবেশটাই দেখলো সাম্য। কিন্তু তার সাজের মধ্যে মিশে থাকা প্রিয় মানুষটাকে আপন করে নেবার লজ্জা সাম্যের চোখে ধরা পড়লো না।
সাম্যের মন তখন ভেবে চলেছে অন্য কিছু। আজ এখানে বধূবেশে যদি পিয়াল থাকতো, তাহলে কি খুব ক্ষতি হতো। ওউ কতো আশা নিয়ে সাম্যের অপেক্ষা করতো। ওর মুখে ফুটে উঠতো – আনন্দ, লজ্জা। আর সাম্য, ওর মুখেও থাকতো এক বহু আকাঙ্খিত খুশি, প্রিয়কে পাওয়ার এক চিলতে হাসি। কিন্তু এখন, এখন তো ওর মুখে ফুটে উঠছে তীব্র হাহাকার মিশ্রিত দুঃখ, কষ্ট। এই কষ্টের সমাপ্তি তো তার প্রাণায়নী পর্যন্ত গিয়েই মিশেছে।
-” আরে সাম্য দাঁড়িয়ে রইলি যে, চল! ”
পিছন ফিরে নিজের বাবাকে দেখে গত এক মাসের রাগ ভুলে কতো আশায় তাকালো। ওর বাবা কী ওর চোখের তীব্র হাহাকার বুঝবে না! কিন্তু সত্যিটা এটাই সাম্যের বাবা ছেলের চোখের কষ্ট যেনো নজরেই ফেললেন না। ছেলের কাঁধে হাত রেখে সেই কথাটাই বললো, যেটা সাম্যের মস্তিষ্ক বলছিল।
-” চল বিয়েটা করে নে। দেখবি বিয়ের পর পরই ওই মেয়েকে ভুলে যাবি। বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে।”
সাম্য হেরে যাওয়া মন নিয়ে ওর বাবাকে একবার দেখে, বললো,
– ” আর যদি বিয়ের পর কিছু ঠিক না হয়, তখন কী করবেন?”
সাম্য আর দাঁড়ালো না সোজা সবাইকে অগ্রাহ্য করে মৈত্রীর পাশে গিয়ে বসে পড়লো। সাম্যের বাবার মতোই অনেকে বলে সব ঠিক হয়ে যাবে। হ্যাঁ ঠিক তো হয়, কিন্তু যারা সাফার করে তারা ছাড়া এই কষ্ট কেউ বোঝে না।
লজ্জায় রাঙা মৈত্রী, সাম্যের দিকে একবার তাকিয়ে বললো, ” কী বলেছিলাম, বিয়ে তো তোমায় আমাকেই করতে হচ্ছে।”
সাম্য কিচ্ছু বললো না, হাত শক্ত করে মুঠো করে বসে রইল। এই মেয়েটাকে অন্য কোথাও হলে যে ও কী করতো নিজেও জানে না।
সাম্যকে চুপ করে থাকতে দেখে মৈত্রী আবারও বলে উঠলো, ” শোনো আজকের পর ওই মেয়ের নাম ও মুখে আনবে না, তাহলে আমি যে কী করবো নিজেও জানি না। শয়তান মেয়েটাকে কতবার বললাম তোমাকে ছেড়ে দিতে, কিন্তু ওই শুনলো না। ভাগ্যিস আমার শ্বশুর রাজি হলো বিয়েতে, নাহলে যে ওই মেয়ের কী করতাম আমি!”
মৈত্রীর কথায় সাম্য রক্ত লাল চোখে ওর দিকে তাকালো। যার ফলে মৈত্রীর চোখে মুখে ভয় ফুটে উঠলো, ঢোক গিলে ও অন্য দিকে তাকালো।
-” নিন এই খানে সাইন করুন।”
উকিলের কথায় মৈত্রী ঝট করে পেন নিয়ে সাইন করে দিলো। পেপারটা পড়ার ও সময় তার নেই। মৈত্রীর কাজে সবাই হেসে উঠলো ঠিকই, তবে সব থেকে বেশি কেউ যদি হেসে থাকে তবে সেটা সাম্যের বন্ধুরা। সোহেল তো সিটি পর্যন্ত বাজিয়ে দিলো।
মৈত্রী পেপারটা সাম্যের দিকে এগিয়ে দিল। কিন্তু সাম্যের তো সেইদিকে মন নেই, ও তো ওর ভাবনায় ব্যস্ত। কিন্তু মৈত্রীর ঠেলায় না চাইতেও পেপারের দিকে চোখ পড়লো। পাশ থেকে ওর বাবা ওকে পেনটা এগিয়ে দিল।
কাঁপা কাঁপা হাতে পেনটা হাতে তুলে নিলো সাম্য। কিন্তু সাইন করতে পারলো না। এখন তো ওর মনের মধ্যে ঝড় বয়ে চলেছে। যেই ঝড়ের সূচনাও ওর হাতে, আর সমাপ্তিও।
(চলবে)
#গল্পঃ_ও_চোখে_বৃষ্টি_এলে
#পর্ব: দ্বিতীয়
# তুহিনা পাকিরা