#কলঙ্কের_ফুল
#পর্ব_৪
#Saji_Afroz
.
.
.
মেহেরীকার রুমের সামনে গিয়ে ভাবতে থাকে আদি দরজায় কড়া নাড়বে নাকি নাড়বেনা।
তিনি কি মাইন্ড করবেন? ভূল বুঝবেন তাকে?
করলে করবে। এতো ভাবার কি আছে! বাইরের একটা মেয়ে। সাহায্য করলে করবে না করলে নাই। এতো ভাবার কিছু নেই।
.
আর না ভেবে দরজায় কড়া নাড়ে আদি।
.
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে স্বাভাবিকভাবে বসে মেহেরীকা উচ্চশব্দে প্রশ্ন করে-
কে?
-আমি আদি। আসবো?
-জ্বী আসুন।
.
আদি ভেতরে এসে আবারো খাটের পাশে থাকা চেয়ারটায় বসে।
মেহেরীকার দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করে তার মুখটা ফ্যাঁকাসে দেখাচ্ছে।
কেনো যেনো এমন ফ্যাঁকাসে মুখটা তাকে মানাচ্ছেনা।
এই মুখে হাসি লেগে থাকলেই বেশি ভালো লাগে।
.
-কিছু বলবেন?
.
মেহেরীকার প্রশ্নে ঘোর কাটে আদির।
তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে-
মন খারাপ আপনার?
.
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে মেহেরীকা বলে….
-নাহ।
-মুখটা এমন ফ্যাঁকাসে লাগছে কেনো?
-শরীর খারাপ তাই হয়তো।
-খুব বেশি খারাপ লাগছে কি?
-তেমন কিছুনা।
-নাস্তা করেছেন?
-হুম।
-কাল রাতে খেয়েছেন কিনা জিজ্ঞাসা করিনি কেউ। আসলে সব হঠাৎ হয়েছেতো…
-আমার ক্ষিদে ছিলোনা কাল। আজ সকালে ক্ষিদে পেয়েছিলো। তাই বৃষ্টি আপু যখন আমাকে পরোটা দিয়েছেন ৩টা পরোটা খেয়ে ফেলেছি আমি।
-বাহ ভালোই তো।
-হু। আপনি খেয়েছেন?
-খেয়েছি। আচ্ছা আপনাকে দেখেতো মনে হয় আমার চেয়ে অনেক ছোট।
-হবো হয়তো।
-পড়াশোনা করেন?
-হুম, অনার্স ৩য় বর্ষে ঈদগাহ ফরিদ আহমেদ কলেজে পড়ি। আপনি?
-আমি ঢাকায় একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি থেকে এম.বি.এ শেষ করেছি।
-আপনার বাসা কোথায়?
-এখানে কাছেই।
-ওহ, না আমি ভেবেছি আমি যেমন ঈদগাহ থেকে পালিয়ে এসেছি আপনিও দূর থেকে এসেছেন।
-নাহ এই ফাতেহ ঘোনাতেই আমার বাসা।
ঢাকায় পড়াশোনা করেছি।
-আচ্ছা।
.
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আদি বলে উঠে-
একটা কথা ছিলো, বলবো?
-জ্বী বলুন।
-আসলে একটা সাহায্য লাগবে।
-আমার কাছে?
-হু।
-আপনি আমাকে সাহায্য করেছেন এখন আমি যদি আপনার জন্য কিছু করতে পারি ধন্য হবো। বলুন কি?
.
মেহেরীকার কথায় আশ্বাস পেলেও আদির কথাটি বলতে মন সাই দিচ্ছেনা। সাহস যা জোগাড় করে সে এসেছিলো মেহেরীকাকে দেখে সব উধাও হয়ে গিয়েছে।
.
আদিকে চুপ থাকতে দেখে মেহেরীকা বলে উঠে-
কি হলো বলুন?
.
আমতাআমতা করে আদি বলে-
আমার বউ হবেন আপনি?
.
আদির বলা কথায় চমকে যায় মেহেরীকা। এতক্ষণ এই ছেলেকে তার ভালোই মনে হয়েছে আর এখন…..
দাঁতে দাঁত চেপে মেহেরীকা বলে উঠে-
কি বলছেন কি আপনি?
.
জ্বিভে কামড় দিয়ে আদি বলে-
সরি নকল বউ।
.
ভ্রু জোড়া কুঁচকে মেহেরীকা বলে-
মানে?
-আসলে আজ বাবা আমাকে জানিয়ে দিয়েছেন আমি বাসায় ফিরলেই ওই সানিয়া মেয়েটার সাথেই আমার বিয়ে করিয়ে দিবেন। কিন্তু আমি যদি একটা বউ নিয়ে যায় তাহলে আমাকে আর বিয়ে কি করে দিবেন! তাই বলছিলাম যে….
-আমি যেনো আপনার বউ সেজে আপনার বাড়িতে যাই?
-জ্বী জ্বী। তার জন্য আমি আপনাকে মোটা অংকের টাকাও দিবো।
.
চোখ জোড়া বন্ধ করে লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে মেহেরীকা বলে-
আমাকে কি আপনার ফালতু মেয়ে মনে হয়?
.
অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আদি বলে-
এমন কেনো বলছেন?
-টাকার লোভ দেখিয়ে আপনি আমাকে আপনার বউ সাজার অভিনয় করতে বলছেন।
আপনাদের মতো ছেলেদের মতলব আমি বুঝিনা ভেবেছেন?
.
মেহেরীকার কথাটি আদির একদমই পছন্দ হয়নি। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে সে বলে উঠে-
দেখুন আমাকে নিয়ে বাজে কথা বলবেন না। হুম মতলব আছে আমার। নিজের মতলবেই নিতে চাইছি আপনাকে। আপনাকে নিয়ে কোনো মতলব নেই। আর কোনো লোভ দেখাচ্ছিনা আমি। বান্ধবীর বাসায় গেলেও কতোদিন থাকতে পারবেন আপনি ওখানে ফ্রিতে? এক সপ্তাহ? বেশি হলে এক মাস? তারপর কি করবেন? ভেবেছেন কিছু? ভাবেন নি। এসব ভেবেই আপনাকে প্রস্তাবটা দেওয়া। আমার কাছে মোটা অংকের টাকা পেলে ওই টাকা নিয়ে বান্ধবীর বাসায় উঠতে পারবেন। আর আপনি কিনা আমাকে উল্টো কথা শুনালেন! এই সাহায্যের দাম দিলেন আপনি আমাকে?
.
মেহেরীকা খেয়াল করে রাগে আদির চোখ, নাক লাল হয়ে আছে। কথাগুলো বলার সময় ঠোঁট কাঁপছে তার।
ইশ….
সে এতোটা কড়াভাবে কথাগুলি না শুনালেও পারতো আদিকে। আদি খারাপ কিছু বলেন নি, আসলেই তো কতোদিন রাখবে তার বান্ধবী তাকে? কিছু টাকা পেলে তার উপকারই হবে।
.
বিছানা ছেড়ে আদির পাশে গিয়ে মেহেরীকা বলে-
সরি।
.
আদির কাছ থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে মেহেরীকা বলে-
আমি সরিতো! এই যে কান ধরলাম।
.
বাচ্চার মতো মেহেরীকার কান ধরা দেখে আদি ফিক করে হেসে দেয়।
আদির মুখে হাসি দেখে সে বলে-
আমি রাজি আপনার নকল বউ হতে।
.
.
.
-বাসায় ঝামেলা চলছে তোমাকে বলেছিনা আমি? এই অবস্থায় আমি কিছুতেই বের হতে পারবোনা। তুমি আর ফোন দিবেনা আমায়। রাখছি আমি এখন।
.
বফ এর সাথে কথা বলছিলো দিবা। একেতো বাসায় ঝামেলা তার উপর বফ এর ঝামেলা।
উফ্ফ অসহ্য।
বফ কে বলেছে সে অন্য আরেকদিন দেখা করবে। না তার আজই দেখা করতে হবে।
কেনো! তার কথাই কেনো সব করতে হবে!
নাহ আজ সে কিছুতেই যাবেনা দেখা করার জন্য।
.
আসবো দিবা?
.
বড় ভাবী মিলির ডাকে ঘোর কাটে দিবার।
মুখে হাসি এনে বলে-
আরে ভাবী আসোনা।
.
ভেতরে এসে দিবার পাশে মিলি বসে বলে-
আমিতো ভেবেছিলাম তুমি পালাবে বাসা ছেড়ে এখন দেখছি আদি পালালো। হাহা।
-মানে? আমি কেনো পালাবো ভাবী?
-ইদানীং তোমার মতিগতি আমার ভালো লাগছেনা। প্রেম করছো তাইনা তুমি?
.
ভাবীর কথা শুনে ঢোক গিলে দিবা বলে….
-কি যে বলোনা ভাবী! এমন কিছু নয়।
-এমন কিছু না হলেই ভালো। তোমার বড় ভাইয়া তোমার জন্য ভালো একটা পাত্র দেখছে।
-আমি এখন বিয়ে করবোনা ভাবী। সবে মাত্র এইস.এস.সি দিয়েছি।
-দেখতে তো সমস্যা নেই। যখন করবে করো।
আমরা শুধু চাই আদির মতো তোমাকে যেনো ঘর ছাড়া হতে না হয়।
-হুম।
.
.
.
আরেকটা রাত পেরিয়ে সকাল চলে আসে।
মেহেরীকা আজ আবার তার বিয়ের লেহেঙ্গা পরেছে। ড্রেসিংটেবিল এর সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে মেহেরীকা।
আজ তার কোনো ভয় নেই তবে আফসোস রয়েছে প্রচুর। রাজীবের সাথে এমন বউ সাজে বিয়ের পিড়িতে বসার জন্য ৩বছর ধরে স্বপ্ন দেখছে সে। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস!
একবার বয়স্ক লোকের জন্য বউ সাজে সাজতে হয়েছে তাকে আর আজ নকল বউ হওয়ার জন্য।
.
-হলো তোমার??
.
বৃষ্টির করা প্রশ্নে মুচকি হেসে জবাব দেয় মেহেরীকা-
হুম আপু।
.
মেহেরীকার দিকে একটা গয়নার বাক্স এগিয়ে দিয়ে বৃষ্টি বলে-
নাও এসব পরে নাও।
-কি আপু?
-পোশাক ছাড়া আর কিছুতো ছিলোনা। পাথরের সেট এনেছি তোমার জন্য। যদি সামর্থ্য থাকতো সোনার গয়না দিয়ে সাজিয়ে দিতাম তোমায়।
.
বৃষ্টির হাত থেকে বাক্সটা নিয়ে ড্রেসিংটেবিল এর উপর রেখে বৃষ্টির দুহাত ধরে মেহেরীকা বলে-
তোমরা যা করেছো আমার জন্য কখনো ভূলবোনা আপু আমি। ২টা দিনেই আপন করে নিয়েছো আমাকে। অনেক মিস করবো তোমাদের আর তোমার এই উপহারটা অনেক যত্ন করে রাখবো আমি।
-হেহে ঠিক আছে।
-এবার বলো তোমার জন্য কি করতে পারি আমি?
-দোয়া করো, একটা সুস্থ সন্তানের জন্ম দিতে পারি মতো।
-তুমি কি প্রেগন্যান্ট আপু?
-হু।
-ওয়াও! দোয়া মানে….!
আমি অনেক অনেক দোয়া করবো।
.
.
.
-আন্টি? আন্টি…..
.
কোনো মেয়ের গলার আওয়াজ শুনে ড্রয়িংরুমে আসে সালেহা চৌধুরী। কিন্তু এতো সকালে সানিয়াকে দেখে তার মুখটা মলিন হয়ে যায়। এখন আদি কোথায় জানতে চাইলে কি বলবে তাকে?
.
সানিয়া দৌড়ে এসে সালেহা চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে বলে-
আন্টি,, আন্টি….. আমি যে কি খুশি বলতে পারবোনা।
-কেনো?
.
সালেহা চৌধুরীর কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বলে সানিয়া-
আমি তোমার ঘরের বউ হতে পারবো আন্টি।
খুশির কথা না বলো?
-হুম।
-আজতো আমাদের আকদ হওয়ার কথা ছিলো বাট আব্বু বললো যে একেবারে ধুমধাম করে বিয়ে হবে আমাদের।
-এরশাদ ভাই বলেছে এমন?
-হুম। তাই ভাবলাম আজ আমি আদির সাথে বাইরে কোথাও থেকে ঘুরে আসি। ওকে সারপ্রাইজ দিবো বলে সকাল ৮টাই চলে এসেছি।
-ভালো করেছিস মা। কিন্তু….
-কি?
-আদিতো বাসায় নেই।
-বাসায় নেই মানে! এতো সকালে কোথায় গিয়েছে?
-কাল রাতেই একটা বন্ধুর বাসায় গিয়েছে, ওখানে থাকবে বলেছিলো রাতে।
-ওহ তাহলে আমি ওকে একটা ফোন দেয়। চলে আসতে বলি।
-থাক না আজ।
-না আন্টি। আমি আজই ওর সাথে লং ড্রাইভ এ যাবো। দাঁড়াও ফোন দেয় আদিকে।
.
ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে ডায়াল করে আদির নাম্বারে সানিয়া।
কিন্তু ফোন বন্ধ শুনে মন খারাপ হয়ে যায়।
হতাশ হয়ে সালেহা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলে-
বন্ধ ফোন!
.
সালেহা চৌধুরী খুশি হন কথাটি শুনে। আদি যে পালিয়েছে এটা সানিয়ার অজানা থাকতে হবে। নাহলে মেয়েটার মন ছোট হয়ে যাবে।
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে সালেহা চৌধুরী বলেন-
তুই আমাদের সাথে সময় কাটা আজ? আদির সাথে না হয় আরেকদিন যাবি।
-উম্ম…
আইডিয়া মন্দ না আন্টি।
ঠিক আছে।
.
.
.
ড্রয়িংরুমে পায়চারি করছে আদি। বউ নিয়ে বাসায় যাওয়ার পর কি হবে ভেবে হাত পা কাঁপছে তার। বাবা কিভাবে নিবে ব্যাপারটা?
আর সানিয়া…..
কোনো ঝামেলা করবে নাতো?
উফফ এতো চাপ নিয়ে কি বাঁচা যায়!
.
শুনছেন?
.
মেয়েলী কণ্ঠ শুনে পেছনে ফিরেই চমকে যায় আদি।
সেই লেহেঙ্গা পরিহিত মেহের….
তবে আজ অন্যরকম সুন্দর লাগছে তাকে।
ইচ্ছে করছে অপলক দৃষ্টিতে এভাবে অনন্তকাল তাকিয়ে থাকতে। এতো সুন্দরী, এতো মায়াবী কেনো এই মেহের নামক মেয়েটা!
.
-এই যে?
.
মেহেরীকার ডাকে ঘোর কাটে আদির।
মৃদু হাসি দিয়ে বলে-
জ্বী বলেন?
-আমরা কখন রওনা হবো?
-এইতো এখুনি।
-আচ্ছা।
.
.
এতক্ষণ নানারকম চিন্তায় আদির মন অস্থির থাকলেও মেহেরীকাকে দেখে তার ভয় কেটে যায়। মনে হচ্ছে এই মেয়েটা পাশে থাকলে সে সব বিপদ সহজেই কাটাতে পারবে। কেনো এতো ভালোলাগা কাজ করছে তার ২দিনের পরিচিত এই মেয়ের জন্য!
.
.
সিরাজ আর বৃষ্টিকে বিদায় দিয়ে আদিরা বেড়িয়ে পড়ে চৌধুরী ভবনের উদ্দেশ্যে। সানিয়া নামক আপদটিকে আদির জীবন থেকে
দূরে সরানোর জন্য
শুরু হবে আজ থেকে নতুন নাটক।
.
.
(চলবে)
.
.