#কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ
|পর্ব ২২|
রাজধানীতে হাড়-কাঁপানো শীত পড়েছে। এই তো! ক’দিন আগেও ফেসবুকে ধুমসে পোস্ট হচ্ছিল, ‘ঢাকা শহরে মানুষ শখ করে সোয়েটার পরে।’
বোধহয় শীত-বাবাজি তা সিরিয়াসলি নিয়ে ফেলেছে। নয়তো উত্তপ্ত শহরে হুট করে এরকম শীত বর্ষণ নামে?
ঘুম থেকে জেগেছি মিনিট পাঁচেক হয়েছে। তবুও চোখ খুলিনি। বন্ধ দু’চোখেও বুঝতে পারছি, বেলা হয়েছে। উম… সাড়ে বারোটা বাজবে হয়তো! অভ্যেসবশত জাগ্রত আমিটা বেশ কিছুক্ষণ ওভাবেই পড়ে রইলাম। সময় খানিকটা যেতেই আস্তে-ধীরে বেডে হেলান দিয়ে উঠে বসলাম। মাথাটা ঠেকিয়ে দিলাম ওয়ালে। উফফ! এত ভার হয়ে আছে! কাল সারারাত মাথা-ব্যথায় কাতরিয়েছি। সে নতুন না! প্রতি বছরের শেষ রাতেই এমনটা হয়ে থাকে। তখন আমি আলাদা রুমে, দরজা-জানালা বন্ধ করে পড়ে থাকি।
আমার মতো মানুষ এই শহরে দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন। থার্টিফাস্ট নাইটে সবাই যেখানে আনন্দ-উল্লাসে মত্ত থাকে; এই বাসার ছোটো মেয়েটি তখন এত শব্দে বিরক্ত হয়, মাথা ব্যথায় ছটফট করে, একা রুমবন্দী হয়ে থাকে। তার সাথে এই মুহূর্তে কথা বলার সাধ্যি কেবল একজনেরই আছে, কিন্তু সে যে থেকেও বহুদূরে।
নতুন বছর, নতুন দিন, নতুন শুরু! উঠে জানালাটা খুলে দিলাম। চোখের সামনে দৃশ্যায়িত সমগ্র কোলাহলপূর্ণ শহরটির যতটুকু পর্যন্ত দৃষ্টি যায়, বড্ড সূক্ষ্ম নজরে অবলোকন করে নিলাম। নাহ! নতুন ক্যালেন্ডার বাদে আর কোনো নতুনত্ব নেই। সব আগের মতোই আছে। কিন্তু… কিছু তো পরিবর্তন দরকার ছিল! এই যে, কতগুলো মাস ধরে যে এই চোখজোড়া তৃষ্ণার্ত! তৃপ্তি পাওয়ার যে খুব দরকার ছিল!
বুক চিরে বেরিয়ে এলো প্রিয়তমের নামে একটা দীর্ঘশ্বাস। দিদির বিয়ে হয়েছে, বহু মাস পেরিয়েছে। মেহেদী ভাইয়ের সাথে এখন সে চুটিয়ে সংসার করায় ব্যস্ত। বিয়ের পরপরই আমার ইয়ার চেঞ্জ এক্সামের রুটিন দেওয়া হলো। কিছুটা তড়িঘড়ির মাঝেই ঢাকা ফিরতে হয়েছিল। সেই যে, আমার আর তাঁর একসাথে থাকা, সেটা একসাথে ফেরা অবধিই ছিল। কত্ত বকবক করেছি! উনি হয়ে গিয়েছিলেন, আমার একমাত্র মনোযোগী শ্রোতা! কী তার মনোযোগ! কখনও ভুল করেও যেন দৃষ্টি সরাতেন না।
সে ঘটনার আজ অনেক মাস হয়েছে। ক’মাস পর আমার এইচএসসি। উনিও ভার্সিটিতে ফিরেছেন। ওঁর স্নাতক শেষ, মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছেন। কতগুলো মাস চলে গেল! কিন্তু ভদ্রলোক আর আমার মুখোমুখি হননি। শুরুরদিকে একবার বাসায় এসেছিলেন, তাও আবার রাতে থাকেননি। অজ্ঞাত সেই কারণটার জন্য আবারও মামার সাথে তুমুল ঝগড়া বাঁধিয়েছেন। রাহী আর আমি তখন এক্সামের প্রিপারেশনের জন্য আমাদের বাসায় ছিলাম বিধায়, সেই ঝগড়ার আংশিক কারণও জানতে পারিনি।
শুরুরদিকে মাঝে মাঝে ফোনে কথা হতো, ইদানিং উনি ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। কেন যেন আমার ফোনটাও পিক করার সময় পান না। নারী-হৃদয় বড্ড কোমল। উনি যে না চাইতেও বার বার এখানে আঘাত হানছেন, তা ওঁকে কীভাবে জানাব?
মুহূর্তেই মনটা বিষিয়ে গেল। চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। তাঁকে মনে পড়তেই কেন এত কষ্ট লাগে? কই! মনে ধরতে তো কেবল সুখ লেগেছিল!
পাতা ঝাপটিয়ে অশ্রুকণা শুষে নিলাম। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে নিলাম, একটা বেজে গেছে। ৩টায় নৌশির বাসায় যাব, গ্রুপ স্টাডিজ-এর জন্য।
_______
ইদানিং খাওয়া-দাওয়ায় ভীষণ অনিয়ম করছি। শুধু যে, খাওয়ায়, তা নয়। ঘুমও আসি শেষরাত্রিতে। আমার সহস্র বিনিদ্র রাত অপেক্ষারত হয়ে কাটার একমাত্র কারণ আপনিই, কুঞ্জ ভাই! মুখ ফুটে তা বলা হয় না ওঁকে।
শাওয়ার নিয়ে কিছুটা খেলাম, আম্মুর জোরাজুরিতে। বেরোনোর সময়ই আমার ফোনটা বেজে উঠল। বুকটা ধুক করে উঠল। চটজলদি ফোনটা বের করলাম। বিগত ক’মাসে এরকম ঘটনা অহরহ ঘটেছে। কল কিংবা ম্যাসেজ টিউন শোনা মাত্রই ফোন বের করেছি, ভেবেছি— এই বুঝি সে আমার নিল খোঁজ!
কিন্তু আফসোস! বরাবরের মতোই এবারও হলো সেটাই।
কান্না গিলে কলটা রিসিভ করে বললাম, “হ্যাঁ, রাহী! বল।”
“বাসায় তুই?”
“না, অ্যাপার্টমেন্টের নিচে। তোদের বাসার দিকে যাব না কি তুই আসবি?”
“এই! না-না! আসতে হবে না। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, মাত্রই উঠলাম।”
“তো, অপেক্ষা করব?”
“না, তুই এক কাজ কর। মিনিট সাতেকের রাস্তা তো! তুই চলে যা। আমি ঘণ্টাখানেক বাদেই আসছি।”
“এতক্ষণ?”
ওপাশ থেকে মেকি হাসার আওয়াজ এলো। পরপরই রাহী বলল, “শাওয়ার নেব, খাব, রেডি হব। এক ঘণ্টায় যে হচ্ছে, এ-ই অনেক!”
“আচ্ছা, আমি যাচ্ছি।”
“হুম, যা।”
হাঁটতে হাঁটতে বাসার কাছাকাছি চলে এসেছি। সামনের গলিটাতেই নৌশির বাসা। রোড ক্রস করছিলাম। হঠাৎ চেনা, বড্ড চেনা একটা স্মেল আমার ঘ্রাণেন্দ্রিয়ে এসে ঠেকল। সেই ম্যানলি স্মেলটা! মাঝ-রাস্তায় তৎক্ষনাৎ দাঁড়িয়ে পড়লাম। এদিক-ওদিক ক্রমাগত চোখ বোলাচ্ছি। গাড়ির হর্নের সাথে সাথে আশেপাশের মানুষজনের ধমকানো স্বরও কানে এসে বেজে যাচ্ছে। কিন্তু সেদিকে খেয়াল দেওয়ার সময় নেই। আমার চোখ তাঁকে খুঁজে যাচ্ছে, হাই স্পিডে বিট করতে থাকা হৃৎপিণ্ড তো তার নামেই কম্পিত হচ্ছে, বারংবার!
হঠাৎ এক রিকশা আমার খুব কাছ দিয়ে গেল, কনুইয়ে হালকা লাগল বোধহয়। পাশাপাশি একটা শক্তপোক্ত হাত আমাকে টেনে রাস্তার ওপাশে নিয়ে গেল। চোখ দুটো খিচে বন্ধ করে রেখেছি। শরীর থরথর করে কাঁপছে। বুঝতে সময় লাগল, পেশিবহুল হাতটা আমাকে এপাশে দাঁড় করিয়েই ছেড়ে দিয়েছে। তীব্রতর হওয়া সেই স্মেলটা ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গেই সামনে তাকালাম। বিস্ফোরিত নেত্রে ভিড়ের মাঝে মিশে যাওয়া ব্ল্যাকহুডি পরিহিত লোকটিকে একঝলক দেখতেই পেয়েই আনমনে আওড়ালাম, “কুঞ্জ ভাই!”
________
নৌশির বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। শরীরটা কেমন কাঁপছে। বাঁ হাত দিয়ে ডান হাতের কনুইয়ের উপরিভাগ চেপে ধরে আছি। পরনের শালটা খানিক উপরে উঠিয়ে দেখলাম, ফুল স্লিভসের গোলজামাটির কনুইয়ের এদিকে ছিঁড়ে গেছে, শরীরের চামড়ার কিছুটা অংশ ছিঁলে গেছে। তা থেকে নির্গত লাল তরল আমার বাঁ হাত ভিজিয়ে দিচ্ছে। সামান্য ক্ষত, তবুও রক্তপাতে মনে হচ্ছে— বড়ো-সড়ো কোনো অ্যাক্সিডেন্ট ঘটিয়েছি। জ্বলছেও প্রচুর! তবে হৃদ-দহনের বেশি নয়!
পরপর কতগুলো চাপাশ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করে নিলাম। কলিং বেল চাপার মিনিট তিনেকের মাঝেই দরজা খুলে গেল। চিত্রা দাঁড়িয়ে।
আমাকে দেখেই কোমরের দু’পাশে হাত গুঁজে বলল, “এত দেরি করলি কেন, হারামি! তোদের জন্য আমি আর নৌশি অপেক্ষা করছিলাম। আমি যে কীভাবে নিজের ঘুম চেপে রেখেছি, আল্লাহ নৌ’জ! আর ওদিকে নৌশি গালি দিতে দিতে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলেছে। ইউটিউব দেখে ১০টি ভিন্ন কৌশলে মারার উপায়ও শিখে রেখেছে, তোদের উপর অ্যাপ্লাই করবে বলে।”
চিত্রার কথায় আমি ব্যথা ভুলে হেসে দিলাম। ও এদিক-ওদিক চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞেস করল, “রাই কই রে? ওকে কোন চিপায় লুকিয়ে রেখেছিস?”
আমি ওকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললাম, “একটু আটকা পড়ে গেছে, ৪টার দিকে আসবে। আন্টিরা কই?”
চিত্রাও আমার পিছু পিছু আসতে লাগল। উত্তর দেওয়ার খাতিরে বলে উঠল, “আঙ্কেল অফিসে, আন্টি তার বোনের বাসায়। আর নৌশির বোন, মৌশি স্কুলে।”
“এই টাইমে?”
“স্কুলে ফাংশন আছে। এজন্য দেরি হচ্ছে।”
“মানে, বাসায় শুধু আমরা। তাই তো?”
“হ্যাঁ, তাই। এই তোর হাতে কী হয়েছে?”
শেষ বাক্যটি বলতে গিয়ে চিত্রার গলা কিছুটা উঁচু হয়ে গেছে। আমরা নৌশির রুমের সামনেই দাঁড়িয়ে। আওয়াজের উৎস পেয়ে নৌশি আমাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
আমি রুমে ঢুকে বললাম, “ফার্স্ট-এইড বক্সটা বের কর তো!”
এবার চিত্রা আর নৌশি একত্রেই বলে উঠল, “কী হয়েছে?”
আমি দু’জনের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসার চেষ্টা করলাম। ওদের চোখে রাশভারি চিন্তা, কথায় প্রবল উৎকণ্ঠা। আমি আশ্বাসবাণী দিলাম, “তেমন কিছু না। ইট’স অ্যা… অ্যা স্মল এক্সিডেন্ট।”
দু’জনের কেউই মানল না— এটা ছোটো কোনো অ্যাক্সিডেন্ট। চেপে ধরায় আমি কুঞ্জ ভাইকে স্কিপ করে পুরো ঘটনা খুলে বললাম। নৌশি এতে বেশ রাগারাগী করল। চিত্রা আমার ডানহাতের তালুটি নিজের মুঠোয় নিয়ে রেখেছে। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ক্ষতের দিকে। হয়তো দেখতে পেলাম তার টলমল চোখে আমার ব্যথায় ব্যথিত হওয়ার সেই দৃশ্যটি।
নৌশি উঠে গিয়ে ফার্স্ট-এইড বক্সটি নিয়ে এলো। আলতো হাতে যখন তুলোতে স্যাভলন মিশিয়ে ক্লিন করতে লাগল, আমি মৃদু কেঁপে উঠলাম। ঠোঁট দিয়ে বেরিয়ে এলো তীব্র ব্যথার অস্ফুট কিছু স্বর।
সঙ্গে সঙ্গে নৌশি হাত সরিয়ে নিয়ে অসহায় চোখে আমার দিকে তাকাল। তালুবন্দি করা হাতটিতে চিত্রা আরও জোর প্রয়োগ করে চেপে ধরল। এখানে রাহী থাকলে নিশ্চয়ই ফোঁপাতে ফোপাঁতে কেঁদে দিত। কুঞ্জ ভাইকে দোষারোপ করে বলত, ‘ওই হাদাটা করছে কী? ওর জন্যই হচ্ছে। ভাই থাকলে এরকম কিছুই হতো না। এবার আসুক, কাজী ডেকে তোর সাথে বিয়ে পড়িয়ে দেব। এরপর দেখব, বউ রেখে যায় কই!’
আমি ওদের দু’জনের দিকে পালাক্রমে তাকিয়ে হেসে দিলাম। ইহজনমে আর সৃষ্টিকর্তার কাছে অভিযোগ করার সুযোগ নেই। এদের পেয়েছি যে!
_________
বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ৯টা বেজে গেল। রাহীকে ওর বাসার সামনে রেখে নিজের বাসায় চলে এলাম। রাত হবার সাথে সাথেই হাতের ব্যথা তিরতির করে বেড়ে চলেছে। উফফ! কলিং বেল না বাজিয়ে এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলাম। ডানে বামে না তাকিয়ে সোজা কুঞ্জ ভাইয়ের রুমে চলে গেলাম। মাস চারেক আগেই এই রুমে শিফট হয়েছি। বুকের ব্যথা এতই বেশি যে, এখন আর একা ঘুমোতে ভয় লাগে না। খট করে দরজা লাগিয়ে লাইট অন করতেই সামনে আপিকে দেখে আমি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম।
মেকি হেসে জিজ্ঞেস করলাম, “ত…তুমি? এখানে কী করছ?”
আপি কিছু বলল না। কড়া চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি ডান হাতটি পেছনে লুকোনোর আগেই আপির তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তা ধরে ফেলল। আহত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইল। মনে মনে বাহানা সাজাতে লাগলাম। কিন্তু তা কাজে লাগল না। আপি আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, “ফ্রেশ হয়ে আয়।”
আমি হতবাক হয়ে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। চেঞ্জ করার সময় সাদা ব্যান্ডেজ ভেদ করে রক্ত এলো। কী যন্ত্রণা! কোনোমতে ফ্রেশ হয়ে বেরোলাম। আপি কোনো শব্দ ব্যয় না করে ড্রেসিং করে দিল। নিষ্ঠুর আপি! ব্যথা পাচ্ছি, দেখছেই না। এত পাষাণ কেউ হয়?
ড্রেসিং শেষে আপি বেরোনোর আগে আমার হাতের ভাজে একটা চিরকুট দিয়ে গেল। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তো হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল।
আপির যাবার পর আমি চিরকুটটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। বুকটা ঢিপঢিপ করছে। এটা কি তাঁরই চিরকুট?
সময় নিয়ে চিরকুটটি খুলতেই বেরিয়ে এলো কাঙ্ক্ষিত সেই শব্দগুচ্ছ, “ওখানে আমার একমাত্র আমানত তুমি। মেয়ে, নিজের প্রতি এত রাগ কীসের? তোমার না হলেও আমার একমাত্র আমানতের খেয়াল রেখো। যেভাবে রেখে এসেছিলাম, সেভাবেই আমার চাই। আর বেশি সময় না। একটু। একটু নিজের খেয়াল রেখো। তারপর তো তুমি আমারই। সম্পূর্ণরূপে, সমগ্র অধিকারে…”
#কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ
|পর্ব ২৩|
“ওখানে আমার একমাত্র আমানত তুমি। মেয়ে, নিজের প্রতি এত রাগ কীসের? তোমার না হলেও আমার একমাত্র আমানতের খেয়াল রেখো। যেভাবে রেখে এসেছিলাম, সেভাবেই আমার চাই। আর বেশি সময় না। একটু। একটু নিজের খেয়াল রেখো। তারপর তো তুমি আমারই। সম্পূর্ণরূপে, সমগ্র অধিকারে…”
অগণিত-বার চিরকুটটি পড়লাম। কতবার যে কাগজের পৃষ্ঠে অধর ছুঁইয়েছি, তার ইয়াত্তা নেই। আপি রাতের খাবার খাইয়েই কিছু মেডিসিন দিয়েছিল। হয়তো তারই প্রভাবে ঘুমেরা এই অশ্রুসজল নেত্রে বাসা বেঁধেছে, অনেক আগেই। তবুও জোরপূর্বক চোখ মেলে রেখেছি। এই চিরকুটটি যে আমায় পড়তে হবে আরও অনেকবার। স্পেসিফিকালি বলা যাবে না— ঠিক কতবার! কিছু জিনিস থাকুক না, অনির্দিষ্ট… অসঙ্গায়িত!
_________
পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, সে খেয়াল আমার নেই। শেষবার ঘড়িতে দেখেছিলাম, তিনটে বিশ বাজে। সেই হিসেবে ঘুম ভাঙার কথা বেলা এগারোটার পর। কিন্তু না! তার বেশ আগেই, ফোনের কলিং টিউনে ঘুম আমার উবে গেল। প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে ডান হাত দিয়ে ফোন খুঁজতে গেলেই ব্যথায় মৃদু চিৎকার করে উঠলাম। ভুলেই গেছিলাম এর কথা। গোপনে নিজেকে শাসাতে লাগলাম। কার হতে গোপন করতে— তা জানা নেই।
ওদিকে মুঠোফোনটা বাঁজখাঁই আওয়াজে ননস্টপ বেজে চলেছে। থামার কোনো নামগন্ধও নেই। ইচ্ছে করছে, ফোনের ভেতরে ঢুকে ওপাশের ব্যক্তিটির গলা চেপে দেয়ালে ঠেসে ধরে আলে-গালে চার-পাঁচটা চড়-থাপ্পড় বসিয়ে সিংহী আওয়াজে বড্ড বিনম্র ভঙ্গিতে চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে, “ওহে ভদ্রলোক/ভদ্রমহিলা! আপনাকে যদি আদা-জিরার সাথে ব্লেন্ড করি, আপনি কি কিছু মনে করবেন? কিছু মনে করবেন না, প্লিজ! আমি আপনার পেস্ট তরকারিতে দিয়ে সুস্বাদু করে রান্না করে বড্ড আয়েশের সাথে চিবাব। আপনাকে ভোজ করতে পেরে আমি হব আনন্দিত অ্যান্ড দ্যি গ্রেট নবুর ভোজন হতে পেরে ইউ শ্যুড বি গর্বিত, ভদ্রলোক/ভদ্রমহিলা। নিন, আরেক থাপ্পড়।”
উফফ! এখনও বেজেই চলেছে। বিরক্তিকর ভঙ্গিমায় বাঁ হাতটি বিছানায় হাতড়িয়ে ফোনটা পেলাম। কলার আইডি চেক না করেই কল রিসিভ করলাম। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বললাম, “হ্যালো! পাবনা থেকে বলছি, স্যার, শুধু আপনার জন্য না কি আপনার হোল ফ্যামিলির জন্য সিটের বুকিং দিতে হবে? স্যার, কাইন্ডলি জানাবেন— আপনার ফ্যামিলি মেম্বার্স ক’জন। ধন্যবাদ।”
প্রতিটি শব্দের মাঝে আমার কঠোর বিরক্তিভাব প্রকাশ পেয়েছে। ওপাশ থেকে সেকেন্ড পাঁচেকের নিরবতার পরপর চাপা হাসির শব্দ ভেসে এলো। যা শুনতেই আমার সর্বাঙ্গ বয়ে কিছু একটা উঠল। পুরোপুরি ভাবে ঘুম আমার চোখ থেকে নিমিষেই কোথাও একটা উধাও হয়ে গেল। শরীরের প্রতিটি লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেল। চোখ দু’টো কাঁটাকাঁটা লাগছে, কেমন যেন জ্বলছে। ঠোঁট দু’টো সামান্য প্রসারিত হয়েছে। অস্ফুট স্বরে বলে উঠলাম, “কুঞ্জ ভাই!”
ওপাশের হাসির শব্দ থেমে গেল। কেউ কোনো কথা বলছি না। কথা খুঁজে পাচ্ছি না। ভাবলাম— হয়তো আর কথাই হবে না। বরাবরের মতোই দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন কাটার জন্য উদ্যত হলাম।
কিন্তু, নাহ! উনি কথা বললেন, “কেমন আছ?”
আমি ফোনটা স্পিকারে দিয়ে রেখেছিলাম আগেই। আমি সবসময় ইয়ারফোন নিয়ে কিংবা স্পিকারে দিয়ে কথা বলি। ফোন কানে নিয়ে কথা বলার অভ্যেস আমার নেই। তাই স্পিকারে রাখা ছিল। ওপাশের কথা শুনতেই আমি হাত থেকে ফোনটা খানিকটা দূরে বিছানার উপর রেখে দু’হাতে মুখ চেপে ডুকরে উঠলাম, যাতে কান্নার আওয়াজ উনি না শুনতে পারেন। এত এত অশান্তির মাঝে রেখে আবার জিজ্ঞেস করা হচ্ছে— কেমন আছ! উনি কি জানেন না নাকি– তাঁকে ছাড়া আমি কেমন থাকতে পারি? জানেন না? আমি প্রাণপণে চেষ্টা করছি, এই ব্যথা ওঁকে না দেখানোর।
নিজেকে খানিকটা সামলে নিতেই ওপাশ থেকে কুঞ্জ ভাই আবারও বলে উঠলেন, “কাঁদবে না, নবনী।”
আমি নাক টানতে টানতে বললাম, “হুহ! মোটেও না। কে কাঁদছে, হ্যাঁ?”
“ব্যথা করছে?”
“কীসের ব্যথা? কোনো ব্যথা নেই। দিব্যি আছি।”
“হুম, বুঝলাম।”
“কী?”
“শরীরের ব্যথার চেয়ে মনের অভিমানটা তীব্র।”
“ছাই বুঝেছেন।”
“তোমাকে বুঝেছি।”
“হাসালেন।”
“তাচ্ছিল্যের?”
“আদৌ বুঝেছেন?”
“তোমার আগা-গোড়া আমি মুখস্ত করে নিয়েছিলাম।”
“তাই তো ভুলে গেছেন। বুঝে নিতেন আমাকে, আজন্ম আমি আপনার হয়ে থাকতাম।”
“এখন বুঝি অন্য কারো?”
“এক পুরুষের প্রেমে কাতর রমনী অন্যত্র সুখ পায় না।”
“সেই পুরুষের কাছে আরও বেশি অসুখী সে, যুগে যুগে।”
“প্রিয় পুরুষটির দেওয়া অসুখও হাজার সুখের চেয়ে দামি।”
“যদি সে সাক্ষাৎ মরণঘাতি কোনো অসুখ হয়?”
“আমি মরতে রাজি সহস্রবার।”
“জেনেশুনে?”
হাসলাম আমি। কিছুটা সুর করেই বলে উঠলাম, “জানিয়া-শুনিয়া আমি বিষ করিয়াছি পান। বিষের তরে শপিয়াছি প্রাণ।”
“সবটা জানো না তুমি।”
“জানি না?”
“উঁহু।”
“বেশ। তবে আরও ভালো।”
“ভালো?”
“হু…”
“কী করে?”
“তাঁকে জানার ইচ্ছে বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আকর্ষণও প্রত্যহ বেড়ে চলবে। সেই সাথে বাড়বে জিবনভর একসঙ্গে কাটানোর ইচ্ছে। আর, জিবনের শেষদিনে গিয়েও দেখব— আগ্রহ কমেনি। বুঝলেন?”
“হুম… বুঝলাম।”
“কচু বুঝেছেন।”
“একবার ছাই, একবার কচু। তুমিবাদে কি আমি পুরো দুনিয়ার বাকি সব কিছু বুঝে ফেলেছি?”
খিলখিল করে হেসে বললাম, “তবে তাদের সাথেই সংসার পাতুন।”
“তারা অভিমান করতে জানে না যে!”
“এটা তো সুবিধা।”
“তবে কার অভিমানী দৃষ্টিতে আমার বক্ষ কম্পিত হবে? কার জন্য ভোরবেলা শহর খুঁজে বেলি ফুলের মালা খুঁজব? সবাইকে ফাঁকি দিয়ে কার বাসার ছাদে উঠব? কাকে খুশি করার জন্য, ছাদ থেকে তার ব্যালকনিতে ফুলের মালার ছোড়াছুড়ি করব?”
“মানে?”
“অভিমানীনির অভিমান আমার বড্ড প্রিয়, সাথে স্বয়ং অভিমানীনিও। বারান্দায় গিয়ে দেখো, দুটো মালা আছে। তিনটে কিনেছিলাম। কিন্তু… যাই হোক।”
হঠাৎ কী যেন হলো, আমি কাঁপতে লাগলাম। ভেজা সুরে শুধালাম, “আ.. আপনি এসেছিলেন?”
মুহূর্তেই ওপাশ থেকে হট্টগোলের আওয়াজ এলো। উনি ফোন কেটে দিলেন। ফোনটার দিকে তাকিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলাম। খুব ইচ্ছে করছে, তাঁকে একটুখানি জড়িয়ে ধরতে।
তখনই ফোনে একটা ম্যাসেজ এলো। চোখের পানি মুছে ফোনটা হাতে তুলে নিলাম। সেখানে লেখা,
“আমাকে যে আসতেই হতো। সে যে জেনেশুনে বিষ পান করেছে। মরণযন্ত্রণা ভোগ করবে না?”
___________
ঘড়িতে বাজে সকাল ৮টা। কুঞ্জ ভাই ফোন করেছিলেন ৭টায়। ফোন রাখার ২০ মিনিট পর উঠে ফ্রেশ হয়ে নিয়েছি। পরনের পোশাকও পরিবর্তন করে নিয়েছি। রুম থেকে বেরোতেই ডাইনিংয়ে আব্বুকে দেখে এগিয়ে গেলাম। আম্মু খাবার বেড়ে দিচ্ছে। আমাকে দেখেই আব্বু বলে উঠলেন, “এই যে! শুভ সকাল, মা।”
আমি মুচকি হেসে বললাম, “শুভ সকাল, আব্বু। শুভ সকাল, আম্মু।”
আব্বু ভ্রু-কুঁচকে বললেন, “এত আগে তৈরি হয়েছেন যে! কোথায় যাবেন? কোচিং তো ১০টা থেকে।”
“আসলে একেবারেই রেডি হয়ে নিলাম। খেয়ে মামার বাসায় যাব। এরপর কোচিং।”
“ওহ্! আচ্ছা। বসুন পাশে।”
আমাকে এটুকু বলেই আম্মুকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “মেয়েকে পরোটা দাও তো।”
আম্মু পরোটা দিতে দিতে জিজ্ঞেস করল, “রজনী কই? এখনও ওঠেনি?”
আমি রুমের দরজার দিকে তাকিয়ে বললাম, “না মনে হয়।”
“আচ্ছা, খেতে থাকো। আমি ডেকে আনছি।”
আম্মু যেতেই আব্বু বলে উঠলেন, “মন খারাপ আমার মায়ের?”
আমি জোরপূর্বক হেসে বলে উঠলাম, “না-না! বেশ আছি। পড়ালেখার একটু প্রেশ্যার, এই যা!”
আব্বু সামান্য হাসলেন। বললেন, “আমাকে মিথ্যা বলার চেষ্টা করছেন?”
আমি মাথা নিচু করে ফেললাম। আব্বু আবারও কিছুটা হাসলেন। এই হাসতে হাসতেই চমৎকার এক উপদেশ দিয়ে ফেললেন। আমি অবাক হয়ে আব্বুর দিকে তাকিয়ে রইলাম।
কানে শুধু আব্বুর কথাটিই বেজে চলেছে, “প্রতিটি মানুষের জিবনে প্রবলেম’স আসে। কেউ কেউ তা সইতে পারে না, ডিপ্রেশনে চলে যায়। কিন্তু, মা! আমি আপনাকে খুব স্ট্রং করে মানুষ করেছি। আপনাকে বিপদের মোকাবিলা করতে শিখিয়েছি। সমস্যাগুলোকে ফেইস করতে হবে। বুঝলেন? ইউ হ্যাভ টু ফেইস ইট।”
আব্বুর কথাটি আমি বুঝলাম কি না জানি না। তবে এটুকু বুঝেছি যে, আই হ্যাভ টু ফেইস হিম। উনি আমার কাছে না-ই বা আসলেন। আমি তো যেতেই পারি!
________
বাসা থেকে বেরিয়েছি। ব্যাগ থেকে বেলিফুলের মালা দুটো বের করে বা হাতে জড়িয়ে নিলাম। ওঁর সাথে সকালে কথা শেষে ছুটে ব্যালকনিতে গেছিলাম। গ্রিলে একটা মালা, আরেকটা ফ্লোরে পড়ে ছিল। দুটো বুকে চেপে যে কতক্ষণ বসে ছিলাম! খুব, খু-ব অনুভব করছিলাম ওঁকে।
এগারো নম্বর রোডটির এপাশে মানুষের আনাগোনা বড্ড কম। এর ডান দিকে মামার বাসা। আমি বাঁ দিকে গেলাম। তিন কদম এগোতেই সামনে একটা বেলি ফুলের মালা ধুলোমাখা রাস্তার কিনারায় পড়ে থাকতে দেখলাম। সামান্য হেসে এটাও তুলে ব্যাগে পুরে নিলাম। এটা ঠিক আমার ব্যালকনির নিচ বরাবর রাস্তা। যৌক্তিক হিসেবে, যখন কুঞ্জ ভাই ছাদ থেকে আমার ব্যালকনিতে ফুলের মালা ছুড়ছিলেন, এটা বাতাসের ভূমিকায় অন্যদিকে পড়ে গেছিল।
হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা এগিয়েই বাসে উঠে পড়লাম আমি। গন্তব্য হচ্ছে আমার মি.প্রবলেম…
চলবে…
[