#কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ
|পর্ব ২৪|
দীর্ঘ সময় ধরে বাসে বসে আছি। ব্যস্ত শহরটা আজ বোধহয় একটু বেশিই ব্যস্ত। তাই তো বাস পিপীলিকার চেয়েও স্বল্পগতিতে চলছে। মাঝামাঝির দিকের একটা সিটে বসে আছি। মাথাটা জানালায় ঠেকিয়ে দিতেই মস্তিষ্কে পুরোনো কাহিনির বিচরণ শুরু হলো।
ঘটনা খুব আগের না। এই তো! আমি সে বছরের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী আর কুঞ্জ ভাই দ্বাদশের ছাত্র। বয়সের দিক থেকে দু’জনেই তখন ইমম্যাচিউরিটিতে পিএইচডি করে ফেলেছিলাম। কথায় কথায় মণির কাছে ওঁর নামে অভিযোগের ঝুলি খোলা ছিল নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার। ওদিকে কুঞ্জ ভাইয়েরও যেন এতে কিছুই হতো না। আমি মণির কাছে নালিশের ফাঁকফোকর দিয়ে যখন কুঞ্জ ভাইয়ের দিকে তাকাতাম, তখন তাঁর স্থির-নির্বিকার সেই দৃষ্টি আমার বুকের ঠিক এই বাঁ পাশটায় আঘাত হানত। বোঝাতে পারব না সেই অনুভূতির প্রখরতা।
রাহীর সাথেও তখন আমার তেমন একটা কথা হতো না। একই স্কুল, একই কোচিং, তার উপর মামাতো বোন! তবুও কোনো সখ্য ছিল না। রাহী বরাবরই একটু চুপচাপ প্রকৃতির মেয়ে ছিল, এখনও আছে। তবে আমি আগে অন্যরকম ছিলাম। একটু বেশিই একগুঁয়ে। কেউ নিজ থেকে এগিয়ে আমার সাথে কথা বলতে আসার আগ অবধি আমার মুখ থেকে টু শব্দটি বের করতে পারত না।
কুঞ্জ ভাই ছোটো থেকেই আমাকে পড়াতেন, এদিকে মণি আর মামাও আমাকে ঠিক নিজেদের সন্তানদের মতোই আদর করতেন। তাই তাদের সাথে ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে লাগল নিবিড় সম্পর্ক।
আমার মতো কুঞ্জ ভাইও তখন অন্যরকম ছিলেন। একদম অ-ন্য-র-ক-ম। কখনও আমাকে বকতেন না, কখনই ধমক দিতেন না। একটু রাগী ছিলেন, তবে তা প্রকাশ করতেন না। সবসময় শান্ত থাকতেন। কখনও বিচলিত হতেন না। তাঁর নির্বিকার চাহনি ছিল খুব তীক্ষ্ণ, অসম্ভব রকমের ধারালো। কথা কম বলতেন। খু-ব মেপে মেপে। তবে তা ছিল বেশ গোছানো, পরিপাটি। তাঁর ব্যাক্তিত্ব আমাকে কেমন করে যেন টানত! বলাবাহুল্য, তাঁর অনমনীয় পৌরুষের কাঠিন্যতায়-ই হয়তো আমার মরণ ঘনিয়েছিল!
এমনও হয়েছে, উনি আমাকে লিখতে দিয়ে বসে থাকতেন। লিখতে গিয়ে আমার হাত খুব কাঁপত। কেননা আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তখন অনুভব করত, ওঁর তীর্যক দৃষ্টি যে আমাতেই সীমাবদ্ধ।
বুঝতে পারতাম— আমাকে পড়া-লেখায় ব্যস্ত রাখাটা নিছক এক বাহানা, উনি ভীষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন আমায়; যেন আমি ওঁর এইচএসসি সিলেবাস আর উনি সেই বোর্ড র্যাঙ্ক করা স্টুডেন্ট!
আমি তখন মোটেও তাড়াহুড়ো করতাম না। এক ঘণ্টার জায়গায় দু’ঘণ্টা ধরে লিখতাম। আনমনেই আমাকে তৃপ্তি নিয়ে দেখার সময়সীমা ওঁর জন্য আরও বাড়িয়ে দিতাম।
উনি শত ব্যস্ততার মাঝেও আমাকে পড়াতে আসতে মিস দিতেন না। রোজ ৩ টায় কলেজ শেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে আমাকে পড়াতে আসতেন। আম্মু অবশ্য বলত, এত কষ্টের প্রয়োজন নেই; অন্য টিচার খুঁজে নেবে।
উনি তখন শক্ত কণ্ঠে বলতেন, “আমি আছি। সমস্যা হচ্ছে না আমার।”
ব্যাস! আম্মু এর বিপরীতে কোনো কথা বলার আর সুযোগ পেত না। যখন কলেজের কোনো কাজে আটকে পড়েন, কিংবা খুব বেশিই ব্যস্ততায় জেঁকে বসেন; তখন আম্মুর ফোনে কল দিয়ে আমাকে শুধাতেন, “নবু, শুনছিস?”
বরাবরই বিছানায় কিংবা চেয়ারে পা দুলাতে দুলাতে ছোট্ট করে জবাব নিতাম, “হুঁ?”
তখন রোজকার মতোই ওঁর মুখস্ত প্রত্যুত্তর ছিল, “তোর কুঞ্জ ভাই আজ খুব খু-ব বেশিই বিজি। কাল এক্সট্রা সময় নিয়ে আসব। এখন আলমারিতে দ্যাখ, নতুন শাড়ি রেখেছি। তুই কি একটু সাজবি? এরপর না-হয় পিকগুলো হোয়াটসঅ্যাপ করে দিস। ঠিক আছে?”
কথাটি বলায় আমি অবাক হতাম না। মাঝে মাঝেই আলমারির সাইডের ড্রয়ারটিতে শাড়ি পেতাম। আমি জানতাম, এগুলো কার কীর্তি। দেখে সামান্য হেসে জায়গা মতোই থাকতে দিতাম। এরপর কুঞ্জ ভাই যখন এভাবে, এতটা আবদারের সুরে সেগুলো পরতে বলতেন, আমি তখন খুব যত্ন করে সাজতাম। আমি সেজে অনেকগুলো ছবি তুলতাম। ভালো-খারাপ সবটাই ওঁকে দিতাম।
উনি অনলাইন হয়েই আমার ইনবক্সে আসতেন। এরপর সেগুলোর সাথে কী করতেন, আমি জানতাম। কীভাবে জানতাম— এটা জানা নেই। শুধু জানতাম —উনি ছবিগুলো সেইভ করবেন এবং বাকিটা বিনিদ্র রাত মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখে যাবেন।
আমি এসবের চাক্ষুস সাক্ষী নই, তবুও অকপটে বলতে পারি— উনি তাই করতেন। তবে, তবে, তবে! কখনও প্রকাশ করেননি উনি। অপ্রকাশিত অনুভূতিগুলো চমৎকার হয়, তাই-না?
কিন্তু! সেদিন উনি আসেননি। একা বাসায় অপেক্ষা করেছি সন্ধ্যে অবধি। অথচ, অপেক্ষাকৃত সুখ আমার এলেনই না! সেদিন উনি কল দিয়ে বলেননি, “নবু, তোর কুঞ্জ ভাই আজ খুব বিজি। তুই কি একটু সাজবি?”
কিচ্ছু বলেননি। সেদিন প্রথমবারের মতো নিজে থেকে শাড়ি পরেছি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম, চোখের কাজল চিন্তায়-ঘামে লেপ্টে গেছে। বিনুনি গাঁথা চুলগুচ্ছ সামনে থেকে দু’গাছি বেড়িয়ে গেছে। এভাবে কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে। অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। প্রথমবার কিশোরী নবনীতাকে এই রূপে আবিষ্কার করেছি আমি। খারাপ নয়, কেমন যেন বড়ো বড়ো লাগছে।
আপিকে না বলেই বাসা থেকে বেরিয়ে গেছি। আম্মু বাসায় নেই, জানি না— কোথায়। ডানে-বামে না তাকিয়ে সোজা মামার বাসায় চলে এসেছি। বেশ কয়েকবার থেমে থেমে কলিং বেল বাজানোর পর রাহী দরজা খুলে দিয়েছিল। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রাহীর ফরসা লালচে মুখখানা দেখতে পেলাম। থেকে থেকে ফোঁপাচ্ছিল ও। ওর এই অবস্থা দেখে অজানা এক ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠল। আমি দ্রুত ভেতরে প্রবেশ করে ওকে শুধালাম, “কী হয়েছে, রাহী? কাঁদছ কেন?”
রাহীর ফোঁপানো এবার সত্যি সত্যিই কান্নায় পরিণত হলো। কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল, “জানো? ভাইয়া খুব সিক। আমি ওকে কখনও এভাবে দেখিনি। কেমন করে মাকে জড়িয়ে ধরে ছিল ও! আমার.. আমার খুব কষ্ট হচ্ছে ওর জন্য।”
আমি কী বলব— বুঝতে পারছিলাম না। রাহীর সাথে আমার আবেগ বিনিময়ের সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু মানবতার খাতিরে হলেও তখন আমার কিছু একটা বলা খুব প্রয়োজন ছিল। হয়তো অসুস্থতার খবর অন্য কারো হলে আমি ওর কাঁধে হাত রেখে কিংবা দু’হাতের বেষ্টনীতে ওর মুখটি তুলে ধরে বলতাম, “ইশশ্, পাগলী মেয়ে! কেঁদে কেঁদে এত সুন্দর মুখখানির কী হাল করেছ! চিন্তা কীসের, হুঁ? আমরা দু’জন আছি না? জাদু করে তোমার ভাইটার সব অসুখ দূ-র করে দেব। তুমি একদম কাঁদবে না। কাঁদলে তোমায় কষ্টের দেবী লাগে। তুমি হাসবে। খুব হাসবে। চলো, অসুস্থতাকে বিদায় জানাব, এক্ষুনি। আমার রাহী হাসবে কি এবার?”
কিন্তু এসব কথা বলা হলো না। আমার মন তখন বিষাদে ডুবে গেছে। রাহীর কথাগুলোকে একপ্রকার উপেক্ষাই করলাম, তবে এই মেয়েটিকে করতে পারলাম না। ভরসার হাতটি দিয়ে শক্ত করে ওর হাতটি চেপে ধরে সামনে এগোলাম। সেই হাত কি মেয়েটি ছাড়তে পেরেছিল?
কুঞ্জ ভাইয়ের রুমের সামনে এসে দেখি, মণি ওঁর হাত ধরে মাথা নিচু করে কাঁদছে। আম্মু স্যুপ খাইয়ে দিচ্ছে আর উনি বিছানায় হেলান দিয়ে খেয়ে যাচ্ছেন। রক্তিম চোখ দুটো দেখেই বোঝা যাচ্ছে, জ্বর ১০২° এর উপরেই হবে। মুখটি কেমন শুকনো দেখাচ্ছে! এক দিনের জ্বরেই কী অবস্থা!
কুঞ্জ ভাই হয়তো কিছুক্ষণ আগের বলা কোনো কথার পরিপ্রেক্ষিতেই বলে উঠলেন, “এখন ঠিক আছি আমি। তোমরা শুধু শুধু চিন্তা করছ! মা, কান্না থামাও না রে! ভালো লাগে না তোমার কান্না।”
মণি কান্না থামানোর অযথা চেষ্টা করছে। আম্মু রাগী স্বরে বলল, “এভাবে জ্বর বাঁধিয়ে বলছ, চিন্তা না করতে? সুস্থ হয়ে নাও, আমাদের হাতে মার পাওনা রইলে।”
এরই মাঝে মণি আমাকে দেখে ফেলল। ততক্ষণে মণির ফোঁপানোও প্রায় বন্ধ হয়েছে। আমাকে দেখে মলিন হেসে বলল, “কী রে! নবু, এসেছিস?”
আমি কুঞ্জ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, “হুঁ।”
সেদিকে তাকিয়েই রাহীর হাত ধরে ভেতরে প্রবেশ করলাম। কুঞ্জ ভাই তাঁর আধখোলা গাঢ় বাদামি চোখের ঘোলাটে দৃষ্টি দিয়ে আমার দিকে তাকালেন। অসুস্থ কুঞ্জ ভাইটা যেন আফিমের চেয়েও নেশালো এক নেশাদ্রব্য। আমি দৃষ্টি মেলাতে পারলাম না। লোকটার এই অবস্থা! অথচ কেউ আমাকে জানায়নি! জানাবেই বা কেন? কে আমি? কারোও কেউ না।
তীব্র অভিমানি দৃষ্টি মণির দিকে নিবদ্ধ করে শুধালাম, “তা তোমার গুণধর ছেলের এ-দশা হলো কী করে?”
আম্মু সঙ্গে সঙ্গে ধমক দিয়ে উঠলেন, “আহ, নবনী! হচ্ছেটা কী? বড়োদের সাথে এভাবে কথা বলতে হয়? আর এই সন্ধ্যায় এখানে একা এলে কেন? বারণ করেছি না, সন্ধ্যার পর রাস্তায় একাকী চলতে?”
আমি গাল ফোলালাম। মণি আমাকে এভাবে দেখে হেসে ফেলল। এতক্ষণে নালিশ করার উপযুক্ত কাউকে পেয়ে গেল। অভিযোগের সুরে বলে উঠল, “আর বলিস না! রাতে বৃষ্টিতে ভিজেছিল। এর আবার বৃষ্টি সয় না। কয় ঘণ্টা ভিজে এরকম জ্বর বাঁধিয়েছে, এই গাঁধাটা বলছেই না। কখন ভিজল… জ্বর বাঁধাল— কিচ্ছুটি জানি না। সকালে কলেজের জন্য না উঠায়, এসে দেখি বিছানা নিয়েছে এটা। তারপর গা কাঁপিয়ে জ্বর বাড়ল। সন্ধ্যার পরপর নেমেছে।”
প্রথমবারের মতো আমি অগ্নি ঝরানো চোখে কুঞ্জ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। গতরাতে বৃষ্টি হয়েছিল। ১১টা থেকে ভোর ৬টা অবধি। আমি শুরুর দিকে ছাদে ভিজেছিলাম। এরপর ধোঁয়া ওঠানো কফি নিয়ে ভোর অবধি বৃষ্টি বিলাসে মত্ত ছিলাম। নিকষ কালো অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশে হঠাৎ বজ্রপাত হওয়ায় আলোর একছটা গিয়ে পড়ে পাশের রাস্তাটিতে। সেই আলোতে ভিজে জুবুথুবু হয়ে একদৃষ্টিতে আমার ব্যালকনির দিকে তাকিয়ে থাকা ব্যক্তিকে এক ঝলক দেখে কুঞ্জ ভাই ভেবে বসাটা তবে নিছকই আমার মনের ভুল ছিল না!
চলবে…#কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ
|পর্ব ২৫|
রাত হতেই আম্মু আমাকে রাহীর সাথে এ-বাসায় থাকতে বলে চলে যায়। মামা ব্যবসায়িক কাজে প্রায়শই শহরের বাইরে থাকেন। রাতে খাওয়া শেষে আমি কুঞ্জ ভাইয়ের রুমে এলাম। মণি ওঁকে খাইয়ে দিয়ে মাত্রই উঠে দাঁড়াল। আমাকে এখানে আসতে দেখে বলল, “বোস, নবু। আমি প্লেটটা রেখে আসছি।”
যেতে যেতে রাহীকে উচ্চস্বরে ডেকে গেল, “রাহী, শোন তো! নবুর জন্য তোর এক সেট জামা বের করে দে।”
মণি চলে গেল। আমি পায়ের নখ দিয়ে মেঝে ঘষছিলাম। চরম অস্বস্তিতে ভুগছিলাম। আড়চোখে বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে থাকা কুঞ্জ ভাইয়ের তুখোড় দৃষ্টি পরখ করে নিয়ে মাথা নত করে ফেললাম। বক্ষে কম্পন হচ্ছে। উনি যে আমারই দিকে তাকিয়ে আছেন!
সময়ের কাঁটা মিনিট পেরোনোর আগেই উনি আমাকে ডেকে উঠলেন, “নবু!”
কেন যেন সাড়া দিলাম না। হয়তো রাগ.. উঁহু! অভিমান! নিজেকে ব্যস্ত দেখাতে এদিক-সেদিক তাকালাম। কুঞ্জ ভাই উত্তরের অপেক্ষাও করলেন না। বড্ড কোমল কণ্ঠে শুধালেন, “একটু পাশে বসবি?”
কী নিঃসংকোচে আবেদন! কী বাচ্চামো ভঙ্গিতে আবদার! ফেলা যায় কি? যায় না তো! আমিও পারিনি। এগিয়ে গিয়ে বিছানার কোণ ঘেঁষে বসলাম। বসতেই উনি বললেন, “শাড়ি পরেছিস যে!”
“হুঁ, তো?”
“আমি না বললে তো কখনও পরিসনি!”
“আমাকে না বলে তো কখনো অপেক্ষায়ও রাখেননি!”
“অপেক্ষায় ছিলি?”
“হুঁ, ছিলাম।”
“আমার জন্য?”
“না, আপির দেবরের জন্য। তার জন্যই তো শাড়ি পরেছি!”
“কী!”
তাকিয়ে দেখলাম— কুঞ্জ ভাই চোখ-মুখ শক্ত করে বসে আছেন। আমার রাগটাও নেমে গেল। কী সুন্দর দেখাচ্ছে ওঁকে! একদম অভিমানী একটা বাচ্চার মতো। গাল দুটো খানিকটা ফুলল কি? কী জানি! হয়তো, হ্যাঁ।
আমি খানিকটা কেশে মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করলাম। কুঞ্জ ভাই এতক্ষণ ফ্লোরের দিকে তাকিয়েছিলেন। এবার আমার দিকে তাকালেন। আমি মলিন হেসে বললাম, “অভ্যেস, কুঞ্জ ভাই! অভ্যেস। এই সময়টাতে আপনিই তো বলেছেন— হয়তো পড়তে নয়তো সাজতে। আপনি না হয় আমাকে কল দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি। কিন্তু আমি তো অভ্যস্ত!”
উনি হয়তো বুঝলেন— আগের কথাটি আমার রাগের বহিঃপ্রকাশ ছিল, তাই সামান্য গললেন। আফসোসের সুরে বললেন, “ইশ! কেউ যদি আমাতেও অভ্যস্ত থাকত!”
আমি সূক্ষ্ম নজরে তাকিয়ে বললাম, “তবে?”
জবাবে তাঁর মুচকি হাসি আমার দুনিয়া এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল। তখন সেই হৃৎতান্ডব না হয় বুঝিইনি!
প্রসঙ্গ এড়িয়ে বললাম, “রাত বিরেতে আর কখনও যেন আমার বাসার সামনে আপনাকে না দেখি, কুঞ্জ ভাই। বুঝলেন?”
“বুঝেছি, ম্যাডাম!”
“গুড। মনে থাকে যেন!”
“ইচ্ছে করেই ভুলে বসব।”
আমার এবার ভারি রাগ হলো। জিজ্ঞেস করলাম, “কেন?”
উনি যেন আবৃত্তি করলেন,
“ইচ্ছে করেই ভুলে বসব।
মাঝের সব দেয়ালগুলো,
দেখো,
আমি অদৃশ্য করেই ছাড়ব।
তাকে পাওয়ার স্বপ্ন দেখা
আজন্মকাল চালিয়ে যাব।
শোনো, শোনো, হে বর্ষা! তুমি রইলে সাক্ষী তবে। তোমার বর্ষণকে সাক্ষী রেখেই এই প্রেম থেকে প্রণয় অতঃপর পরিণয় গাঁথব।”
আমি অবাক কণ্ঠে বললাম, “কাকে?”
“সিক্রেট।”
উনি মিটিমিটি হাসতে লাগলেন। আমার ভীষণ জ্বলছে। রাগে কি না ঈর্ষায় —জানা নেই; তবে জ্বলছে আমার। রাগ দেখাতে গিয়েও পারলাম না। কেন যেন এই মানুষটার দিকে তাকালে, আর রাগ আসে না। তবুও আমার মন খারাপ হলো। মিনমিনে কণ্ঠে বললাম, “আপনি এভাবে ভিজবেন না, কুঞ্জ ভাই।”
“তাহলে তোকে দেখব কী করে?”
“এখন যেভাবে দেখছেন।”
“এভাবে হচ্ছে না।”
“তো কীভাবে দেখতে চাইছেন? আপনার মতলব ভালো ঠেকছে না।”
“সাধে কি তোকে ‘বোকা’ বলি?”
“হুহ!”
“শুনবি কি?”
“বলুন, শুনছি।”
“আমি তোকে..”
“হুম, হুম। এরপর?”
“দেখতে চাই।”
“তা-তো বুঝেছি। এরপর কী?”
“এরপর কী— মানে কী?”
“উফফ! কীভাবে দেখতে চান, এটা বলুন।”
“বলছি।”
“শুনছি।”
“নবু, বলতে দে না!”
“মুখ আটকে ধরেছি নাকি?”
“বড্ড জ্বালাচ্ছিস তুই।”
“এ মা! আমি এত নম্র-ভদ্র-সভ্য মেয়ে। আমার ব্যাপারে এসব বলছেন কী করে?”
“তোর বকবকানি দিন দিন বাড়ছে, নবু।”
“আচ্ছা। চুপ করছি। এবার বলুন।”
উনি বেশ কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে বসে আছি। সময় খানিকটা পেরোতেই উনি বললেন, “বৃষ্টি সুন্দর না কি বৃষ্টিতে সজ্জিত স্বয়ং বৃষ্টিবিলাসী নিজে অধিকতর সুন্দর তা দেখার জন্য গিয়েছিলাম। কিন্তু দুটোর সাথে তুলনা করা তো দূর, বৃষ্টিবিলাসী থেকে চোখই ফেরাতে পারিনি।”
আমি এত কঠিন কথাগুলো তখন বুঝিনি। ফ্যালফ্যাল নেত্রে তাকিয়ে ছিলাম। আমাকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে, উনি হেসে ফেলেছিলেন। বলেছিলেন, “কোনো কিছু জানার আগ্রহের চেয়ে বড়ো আগ্রহ কিচ্ছু না, পিচ্চি। আমারও এই জিনিসটা জানার আগ্রহ অ-নে-ক। আর তার জন্য বারবার আমাকে ছুটে যেতে হবে তোর আঙিনায়, বুঝলি?”
দু’পাশে মাথা নেড়ে বললাম, “বুঝিনি আমি। আপনি আসবেন না, ব্যাস! বোঝেন না কেন— আপনাকে অসুস্থ দেখতে, আমার ভালো লাগে না।”
উনি সে-সময় মোহময় হেসে ঘোর লাগানো আওয়াজে বলেছিলেন, “তবে তুই চলে আয় আমার কাছে.. আমার হয়ে।”
তখন আমি খুব ছোটো ছিলাম। ওঁর কথাগুলোর সঠিক মানে —আমি বুঝতাম না। তবুও সেই কথাগুলোকে ভিত্তি করেই এগোনোর সাহস পেয়েছিলাম। এমনি এমনি তো মন ওঁর উপর দুর্বলতা প্রকাশ্যে আনেনি! তবে, আজ! আজ তো আমি সেই কথাগুলো বোঝার মতো বড়ো হয়েছি। উনি সময়ের সাথে পরিবর্তিত হলেও, আমি মোটেও বদলাইনি। উনি আমার বদলে যাওয়ার উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছিলেন যে!
ওঁর প্রতি আমার অনিশ্চিত অনুভূতি নিয়েও সে-সময়ে এতটা এগোতে পেরেছিলাম। আর, এখন তো আমি নিশ্চিত প্রেমরোগে শয্যাশায়ী। এখন তো আমি জানি। আমি জানি, উনিও আমাকে… তবে হেরে যাই কী করে? ছেড়ে দিই কী করে?
আমার অতীতের ধ্যান ভাঙল বাসের কন্ডাকটরের উচ্চ আওয়াজে।
________
আধাঘণ্টা হলো, ঢাবির ক্যাম্পাসে এসেছি। কোনো এক ফাংশন চলছে। আমি এই ‘ভালো রকমের ভিড়’-এর মাঝে কুঞ্জ ভাইকে খুঁজে চলেছি। কোত্থাও পাচ্ছি না। কাউকে জিজ্ঞেস করাটাও সাহসে কুলোচ্ছে না। কিছুটা এগোতেই দাঁড়িয়ে কথা বলতে থাকা দু’টি মেয়ের কথপোকথনের আংশিক কানে এলো—
“ছেলেটা কী করেছিল রে?”
“ভুল করেছিল রে, ভুল। সাংঘাতিক রকমের ভুল।”
“মানে কী? খোলাসা কর, ভাই।”
“বলছি, বলছি। ফাহিম ভাইদের বিরুদ্ধে গেছিল ছেলেটা। খুব সম্ভবত ফার্স্ট ইয়ারের স্টুডেন্ট। ডিপার্টমেন্টের কিছু একটা কাজ দেওয়া হয়েছিল, সে তো করলই না। উলটো বাপের দাপট দেখাল। ফাহিম ভাইকে যা-তা বলল।”
“বলিস কী!”
“হ্যাঁ। এটুকুতেও এত কাহিনি হতো না। ফাহিম ভাইয়ের ধৈর্য থাকলেও অরুণ ভাইয়ের একদমই নেই। তাই ফাহিম ভাইকে নিয়ে আওয়াজ উঠাতেই, সোজা তেতে উঠেছিল। হাতাহাতির এক পর্যায়ে ওই ছেলেটাও অরুণ ভাইয়ের কর্লার চেপে ধরেছিল।”
“ইয়া আল্লাহ! ভুল নয় রে, রিমু। পাপ করেছে, পাপ।”
“একদমই তাই।”
এসব কথা বলতে বলতেই মেয়ে দুটো চলে গেল। নিশ্চয়ই ক্যাম্পাসে কোনো গণ্ডগোল লেগেছে। আপি বলত, ঢাবির ক্যাম্পাসে ৩৬৫ দিনের মাঝে ৩৬৬ দিনই ফাংশন আর ঝামেলা! সে তো অল টাইম লেগেই থাকে। যদিও বা ফান করেই বলত!
মেয়ে দুটো যেদিক থেকে এলো, সেদিকে তাকালাম। ওদিকে যাওয়ার জন্য মনটা নিশপিশ করছে। কেন যেন মনে হচ্ছে, কুঞ্জ ভাইকে ওখানেই পাব। কিন্তু যাওয়াটা কি ঠিক হবে?
ঠিক-বেঠিককে পাত্তা না দিয়ে সেদিকে পা বাড়ালাম। কিছুটা এগোতেই পা থেমে গেল। চোখ দুটো বিস্ফোরিত হয়ে উঠল। কিছুটা দূরেই তিনটে ছেলে মিলে একটি ছেলেকে বেধড়ক পেটাচ্ছে। ছেলেটার অবস্থা মোটেও ভালো নয়। সর্বাঙ্গ রক্তাক্ত। সে বারবারই বলে যাচ্ছে, “মাফ করে দেন আমারে। আর হবে না। সব কথা শুনব।”
কিন্তু কেউ তার কথা শুনছে বলে মনে হচ্ছে না। সব সময় আমার কাছের মানুষজনদের জন্য খুব আগলে আগলে বড়ো হয়েছি। এরকম কিছু চোখে পড়েনি বললেই চলে। তাই এমন দৃশ্য প্রথমবারের মতো দেখতে পেয়ে আমি ভীষণ ভীত হয়ে পড়লাম। কিন্তু বিস্মিত হলাম তখন, যখন সেই তিনটে ছেলের মাঝে একজনকে চিনতে পারলাম। পরে লক্ষ করলাম— তিনজনকেই এর আগে আমার আশেপাশে দেখেছি। যখনই কোনো বিপদে পড়তাম, এই ভাইয়াদেরই কেউ একজন কোত্থেকে যেন আমাকে বিপদমুক্ত করত। আর একজনের সাথে কথাও বলেছি। মাঝে মাঝে দেখতাম— আমার সামনে আসার আগেই কোথাও একটা লুকিয়ে পড়ত; হয়তো খেয়াল করত না, আমি দেখে ফেলেছি। আবার সামনাসামনি দেখা হলে মুচকি হেসে বলত, “কী খবর, বনু? সব ঠিকঠাক? কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাবে। তোমার ‘অরুণ ভাই’ সব ঠিক করে দেবে, বুঝলে?”
ওহ্ হ্যাঁ! অরুণ ভাই! উনিই তো অরুণ ভাই। কী অমায়িক ব্যবহার তাঁর! আমি সর্বদা মুগ্ধ নজরে দেখে যেতাম। আমার ভাই থাকলে, নিশ্চয়ই এমন হতো! মাঝে মাঝে তো প্ল্যান কষতাম— অরুণ ভাইকে আমাদের বাসায় আনার। আম্মু-আব্বুকে দেখিয়ে বলতাম, “দেখুন! আমার ভাই আমি নিজেই খুঁজে এনেছি। আজ থেকে ইনি আপনাদের বড়ো ছেলে, মনে থাকবে? আর অরুণ ভাই! ওঁদের আব্বা-আম্মা ডাকুন। ফাস্ট।”
কিন্তু কখনও হয়ে উঠত না। হঠাৎ মস্তিষ্কে খেলল— ওই আপুরা তো অরুণ ভাইয়ের কথাই বলছিল। আর..
আর কিছু মনে করার আগেই অরুণ ভাই ছেলেটির এক হাত টেনে একজনের সামনে ফেলল। হাতা গোটানো ঘর্মাক্ত কালো শার্টটি পেশিবহুল শরীরের সাথে লেপ্টে, প্রতিটি অঙ্গের ভাঁজকে নিপুণভাবে দৃশ্যায়ন করছে। উদাম বুকের সামনের দুটো বোতাম খোলা। বাঁ হাতে একটা ব্ল্যাক ওয়াচ এবং হাতটি পকেটে। অন্য হাতের দু’আঙ্গুলের ভাঁজে সিগারেট, যা মাঝে সাঝেই ঠোঁট ছুঁয়ে যাচ্ছে। উড়ে যাচ্ছে নিকোটিনের বিষাক্ত ধোঁয়া। মাঝে মাঝে পৌষের হিমশীতল হাওয়া অবাধে বেড়ে ওঠা চুলগুলোর সাথে দারুণভাবে খেলা করে যাচ্ছে।
কুঞ্জ ভাইকে এমন অবস্থায় দেখে আমার মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে পড়ল। পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে গেল। আমার সাথে হেসে-খেলে দুষ্টুমিতে মেতে থাকা মানুষটা তো এত পাষাণ নয়। ছেলেটি কুঞ্জ ভাইয়ের একটি পা জড়িয়ে বলে যাচ্ছে, “ফাহিম ভাই, ভুল হয়ে গেছে। এবারের মতো ছেড়ে দেন।”
কুঞ্জ ভাই নির্বিকার হয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকে যাচ্ছে। অরুণ ভাই আরও দু’টো লাথি মারল। কুঞ্জ ভাইয়ের সিগারেটে শেষ টান দিয়ে বললেন, “শালারে ভাঙ্গা মুখে ‘আব্বা’ ডাকার জন্য ওর বাপের সামনে ছুড়ে আয়। অরুণ, তুই থাক। কাজ আছে।”
বাকি দু’জন ছেলেটিকে নিয়ে চলে গেল। আমি অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। এতক্ষণে কুঞ্জ ভাইয়ের দৃষ্টি আমার উপর পড়ল। ভেবেছিলাম— উনি ঘাবড়ে যাবেন, বিচলিত হবেন। আমাকে অবাক করে দিয়ে উনি নির্লিপ্ত থাকলেন। চোখ-মুখ বড্ড গম্ভীর। সেকেন্ড দুয়েক আমাকে দেখেই উনি দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন; যেন আমাকে চেনেনই না। তারপর অরুণ ভাইকে নিয়ে ওদিকে চলে গেলেন। বুঝতে পারছিলাম না— এটা কী হলো?
চলবে…