#কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ
|পর্ব ২৬|
লোকে বলে– প্রেম করবে আর প্রেমে মরবে না.. তা কি হয়? এ তো হলো তেমন– সাঁতার কাটবে, তবে জলে না নামবে!
মরণ তো নিশ্চিত, যদি তুমি কোনো কঠোর-শক্তপোক্ত-একরোখা-জেদী-গম্ভীর-অনমনীয় ব্যক্তিত্বের কোনো পুরুষের মায়ায় আটকে যাও.. তার প্রেমেতে ডুবে যাও।
নবনী! হুমায়ূন আহমেদের ‘নবনী’ উপন্যাসের মুখ্যচরিত্র ছিল স্বয়ং নবনী নিজেই। সে ছিল পোড়া কপালি। মায়ের কাছে জেনেছি, আমার জন্মের বেশ কিছুদিন আগেই মা এই উপন্যাসটি পড়েছিল। এর রেশটা এতটাই গভীরভাবে ছেয়ে গিয়েছিল তার মাঝে যে, আমার নাম নবনী রেখেই শান্তি পেল। অথচ, মা আমার বুঝল না। বুঝল না, আমার কপালেও ওমন কিছুই আছে।
আবার, হুমায়ূন আহমেদের ‘তেতুঁল বনে জোছনা’ উপন্যাসটিতেও নবনী ছিল। সেখানে নবনী তার ডাক্তার সাহেবকে বলেছিল, ‘ডাক্তার সাহেব, তুমি আমার জন্য দু‘ ফোঁটা চোখের জল ফেলেছ, তার প্রতিদানে আমি জনম জনম কাঁদিব।’
আচ্ছা! নবনীদের ভাগ্যে কি কেবলই কান্না? এত শোক কেন নবনীদের জন্যই?
টিএসসিতে বসে বসে ভেবে চলেছি, বিগত ঘটনাগুলো। বুকের মাঝে অদ্ভুত এক পীড়া হচ্ছে। সব কিছু কেমন যেন আওলিয়ে যাচ্ছে। বড্ড হাঁসফাঁস লাগছে। অস্থিরতা তীব্র হতে তীব্রতর হচ্ছে। হয়তো চোখের কোণ বেয়ে মাটি স্পর্শ করল বেশ কিছু মুক্তোর মতোন জলকণা। অনুভূতির প্রখরতা দিনকে দিন আমাকে যেন বদ্ধ উন্মাদ করে তুলছে। আলগোছে ডান হাতের তর্জনী আঙ্গুলের এপিঠ-ওপিঠ দিয়ে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রুটুকু মুছে নিলাম। লম্বা একটা শ্বাস টেনে নিজেকে শেষবারের জন্য আবারও সামলে নিলাম। আমার কৈফিয়ত লাগবে। ওঁকে জবাবদিহিতা করতেই হবে।
এর মাঝে আমার ফোনে লাগাতার কল এসে চলেছে, রাহীর কল। মস্তিষ্কের এই বিশাল দ্বন্দ্বে আমি বারংবার হেরে যাই। এই যে, কল রিসিভ করব কি করব না, এটা ভাবারও ফুরসৎ মিলছে না। পরপর দুই বার লম্বা করে শ্বাস টেনে নিজেকে ধাতস্ত করে কল রিসিভ করব বলে তৎক্ষণাৎ একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। রাহী সচরাচর আমাকে এভাবে কল করে না!
আমি দ্রুত কল রিসিভ করেই ব্যস্ত স্বরে বলে উঠলাম, “হ্যালো!”
“কই তুই?”
ওপাশ থেকে রাহীর রাগী স্বরের স্থির ও গম্ভীর কথাটায় আমি নড়েচড়ে বসলাম। এতক্ষণের মন খারাপ ভাব না কাটলেও, বিরহে কাতর আমার দেবদাসী ভাবটা যেন মুহূর্তেই ওই আকাশে উড়ে গেল। সে-যাক! ওসব গোনার সময় কই? সময় এখন রাহীর এমন আওয়াজের কারণ জানা। কোমল রাহী এমন রণচন্ডী রূপ ধারণ করল কীসের প্রেক্ষিতে? বুঝলাম না। তবুও অপরাধীর মতো মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বললাম, “কেন? কী হয়েছে?”
“কই আছিস? টেক দ্যা নেইম অব্ দ্যাট প্লেস।”
রাহীর তীক্ষ্ণ, ধারালো আওয়াজের পরিপ্রেক্ষিতে আমি না ভেবে বলে দিলাম, “টিএসসির মোড়ে…”
ওপাশে রাহী থামল। বেরিয়ে আসা তীব্র রাগ যেন গভীরভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস টেনে দমিয়ে আনল। সে-শব্দ আমি পেলাম।
এরপর নরম গলায় বলে উঠল, “আমি চিত্রা আর নৌশির সাথে আমাদের কলেজ ক্যাম্পাসে আছি। এখানে চলে আয়।”
“কোচিং-এ থাকার কথা ছিল না তোদের?”
“হুম, যাইনি। আর..”
“আর?”
“তোর বাসায় গণ্ডগোল বাঁধল বলে।”
“মানে?”
“ওখানে আর এক সেকেন্ড দাঁড়াবে না, নবনী। জলদি এসো।”
রাহী খুব রেগে গেলে আমাকে ‘তুমি’ সম্বোধন করে। আমি আর কথা না বাড়িয়ে ‘আসছি’ বলে, ফোন কেটে দিলাম। বিপদ চারদিক দিয়েই আসে। ভাই-বোন, দুটো বোধহয় মিলিত ষড়যন্ত্র করেছে, আমাকে চিন্তার চাপে পিষে মারার।
প্রস্থান ঘটানোর আগেই একটা বাচ্চা মেয়ে আমার কাছে এলো। আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। সে ভুবন ভোলানো এক হাসি দিলো। কী স্নিগ্ধ সেই হাসি! আমি একটু এগিয়ে ওর মুখোমুখি হয়ে সামান্য ঝুঁকে নিচু স্বরে শুধালাম, “কিছু বলবে?”
সে উপর-নিচ জোরেশোরে মাথা নাড়ল। খিলখিল করে হাসছে, কখনও বা মুচকি হাসছে। হাসি যেন সরছেই না। সে আমার দিকে একটা কালো গোলাপ এগিয়ে দিয়ে বলল, “আপা, আপনারে দিছে এইটা।”
আমি ফুলটা হাতে নিয়ে বললাম, “কে দিয়েছে?”
সে আবারও হেসে বলল, “ভাইয়ে কইতে না করছে।”
আমি চুপ করে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। বয়স ১০ কি ১২ হবে! এরই মাঝে মেয়েটি আবারও বলল, “আপা, আরেকটা কথা কই?”
“বলো।”
“আপনে দেখতে ম্যালা সুন্দর।”
আমি বিস্মিত চোখে মেয়েটির দিকে তাকালাম। সে আমার বিস্ময় আরও বাড়িয়ে দিতে হাতে একটা কাগজের টুকরো দিয়ে বলল, “এইটাও ভাই কইছে। আপনে কিন্তু আসলেই সুন্দর।”
তারপর এক দৌঁড়ে যেদিক থেকে এসেছিল, সেদিকেই চলে গেল। আমি কিছুক্ষণ হা করে মাত্র ঘটা ঘটনাটি পর্যেক্ষণ করলাম। এরপরই তড়িৎ বেগে হাতে থাকা কাগজটি খুলতেই গুটি গুটি অক্ষরে সামান্য কয়েকটা শব্দ পেলাম। তাতে লেখা আছে, “তোমার জানার পরিসীমা বাড়ছে তবে, প্রিয় কঙ্কা!”
____________
ক্যাম্পাসের পেছনের দিকে রাখা দুটো হাই বেঞ্চে মুখোমুখি বসে আছি আমি-রাহী ও নৌশি-চিত্রা। তিনজনেই উৎসুক নেত্রে আমার পানে চেয়ে আছে, এদিকে আমি নির্বিকার। আধাঘণ্টা ধরে এভাবেই বসে আছি। চোখের সামনে এখনও সকালের ঘটনাটা হুবহু ভেসে উঠছে। এর আগে কুঞ্জ ভাইকে কখনও স্মোক করতে দেখিনি। বাদামি চোখের এমন জ্বলজ্বলে দৃষ্টি চোখে পড়েনি। আচ্ছা! ওটা আমারই কুঞ্জ ভাই তো!
নিরবতা ভেঙে রাহী বলে উঠল, “ওখানে কেন গিয়েছিলি?”
আমি আমার শান্ত দৃষ্টি ডানে ঘুরিয়ে রাহীর পানে নিবদ্ধ করে শীতল কণ্ঠে বললাম, “জানিস না?”
রাহী হতাশা মিশ্রিত শ্বাস ফেলে বলল, “ভাইয়া তোকে ওখানে যেতে মানা করেছিল। করেনি কি?”
আমার ঠোঁটের কোণে তেরছা হাসি ফুটে উঠল। এদিক-সেদিক চোখ ঘুরিয়ে বললাম, “সে তো প্রেমে পড়াতেও তীব্র নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। অবাধ্য মনটা শুনল কই? তাঁর প্রেমেতেই মজল!”
“তবুও..”, রাহী থামল। কিছুক্ষণ ভেবে ইতস্তত করে বলল, “ওখানে কিছু হয়েছে… ঘটেছে? না মানে, ভাইয়াকে দেখেছিস?”
আমি শব্দ করে হেসে উঠলাম। চাপা হাসি ঠোঁট কামড়ে থামিয়ে বললাম, “কী দেখার কথা মিন করছিস? স্পেসিফিক কিছু? তোর ভাইকে না কি তোর ভাইয়ের অন্য রূপকে?”
রাহী আমতা আমতা করতে লাগল। আমি হাসি থামিয়ে ফেললাম। ধরা গলায় বললাম, “তুই জানতিস?”
রাহী মাথা নিচু করে ফেলল। চিত্রা নাক ফুলিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোরা দু‘জন কী ফুসুরফুসুর করছিস? আরও দু‘জন আছি আমরা এখানে। আমাদেরও বল!”
নৌশি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সে আজ বড্ড চুপচাপ। আমি আবারও সামান্য হাসলাম। যে বেঞ্চে বসে আছি, তার দুই পাশে হাতের ভর দিয়ে সামান্য পিছে ঝুঁকলাম।
আকাশের মাঝে ঘুরে বেড়ানো অশান্ত ঢেউয়ের ন্যায় অস্থির হৃদয় আমার শুধিয়ে উঠল, “শালার কোন দুনিয়ায় বাস আমার? হে, প্রকৃতি! তোমরা বলতে পারো, কেন আমি এত অবুঝ? যাকে নিজের গোটা পৃথিবী ভাবি; আমি বাদে তোমাদের পৃথিবীর সবাই জানে, আমার পৃথিবীর আসল পরিচয়। আমিই এত অবুঝ কেন? কোথায় ছিলাম আমি? দর্পণের ওপারে? যা সম্মুখে রাখা থাকবে, তা ছাড়া গোটাটাই আমার অজানা থাকবে!”
আমার মনের অবস্থা বুঝেই চিত্রা আর নৌশি দ্বিতীয় কোনো প্রশ্ন শুধাল না। এরই মাঝে চিত্রার ফোনে কল এলো, ওর মায়ের কল। মাকে কিছু একটা বুঝিয়ে আমাদের বলল, “অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। চল, বাসায় যাই।”
আমি বড্ড ঠান্ডা আওয়াজে বললাম, “যেতে ইচ্ছে করছে না। তোরা যা।”
নৌশি বলল, “আমারও যেতে হবে। তুই রাইয়ের সাথে ফিরিস। এ্যাই, রাই! ওর সাথে থাক।”
চিত্রা আর নৌশি চলে গেল। আমি বেশ কিছুক্ষণ পর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রাহীকে বললাম, “বাসায় কী হয়েছে?”
“ফুপার ছোটোবেলার কোন বন্ধু যেন নিজের ছেলের জন্য বিয়ের প্রপোজাল পাঠিয়েছে।”
“ওহ্, আচ্ছা! এরপর? তা তোর ফুপা রাজি?”
“কী যে বলিস না! ফুপা বা ফুপি, কেউ রাজি না।”
“তো ঝামেলা কীসে?”
“তারা না-ও করতে পারছে না। হেসিটেট ফিল করছে। তাই তাদেরকে বলেছে, ‘মেয়েতো ছোটো, এখন ওসব ভাবছি না। তাছাড়া বড়ো মেয়ের আগে ছোটোটাকে কী করে দিই?’ তারা ইন্ডিরেকটলি এই রিফিউজটা বুঝেও না বোঝার ভান করে বলল, ‘সমস্যা নাই। ছেলেও কমবয়সী। অপেক্ষা করবে।’ ফুপা আর কিছু বলতে পারেনি। দুপুরে তোদের বাসায় খাওয়া-দাওয়া করবে। ফুপি তোকে খুঁজছিল সকালে। আমার বাসার কথা বলে এসেছিস, এটা আমাকে জানাবি না? তোর কথা জিজ্ঞেস করতেই, আমি ফুপিকে বলে দিয়েছি, ‘ও নেই’। ভাবতে পারছিস?”
“এরপর?”
“এরপর আবার কী? ম্যানেজ করতে বড্ড কাঠখড় পোহাতে হয়েছে।”
“কীভাবে করলি ম্যানেজ?”
“বলেছি, তুই চিত্রার বাসায়। সকালে আমিই কল দিয়ে ওখানে যেতে বলেছি। এরপর চিত্রাকে ম্যাসেজ করে জানিয়ে দিয়েছিলাম; যাতে ফুপি কল দিয়ে বাহানা দেয়, তুই ওয়াশরুমে। ফুপি ঘণ্টাখানেক পর চিত্রাকে কল দিয়েছিল। ও নার্ভাস ছিল। বলেছে, তুই ঘুমাচ্ছিস। অ্যান্ড আ’ম্ ড্যাম শিউর– ফুপি বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করেনি। তুই বাড়ি যা। গেলেই ধরবে তোকে।”
“বাসায় তোর ভাইয়ের ব্যাপারে জানে?”
“কী? কোনটা?”
“আজ যা দেখলাম!”
“জানে। আবছা জানে।”
“আর আমার সাথে তোর ভাইয়ের ব্যাপারটা?”
“জানে।”
“আপি?”
“সবার আগে জানে।”
“আম্মু-আব্বু?”
“জানে তারা।”
“মামা-মণি?”
“জানে।”
“তুই কবে জানলি?”
“এসবে খেয়াল রাখতাম না। ভাইয়া তোকে পছন্দ করে– এইটা জানতাম। কিন্তু তোর জন্য যে এত পাগলামিও করে, তাও তোর সামনেই! এটা অজানা ছিল। আনএক্সপেকটেড ছিল।”
আমি রাহীর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ও কেমন মিইয়ে রয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, “তোর ভাইয়ের সাথে মামার ঝগড়ার কারণ কি এই নিয়েই হয়েছে?”
রাহী আমার দিকে তাকাল। আমি তৎক্ষণাৎ বললাম, “এটা বলিস না যে, তুই জানিস না।”
“জানি।”
“এটাই কারণ?”
“আংশিক।”
“হুঁ?”
“কিছুটা। বাকিটা তুই।”
“মানে?”
আমি অবাক হয়ে রাহীর দিকে তাকিয়ে রইলাম। রাহী বলল, “বাকিটা পরে বলব। এখন এটা বল, আকিব নামের ছেলেটাকে কী করবি?”
“আকিব কে?”
“ফুপার বন্ধুর ছেলেটা; যার জন্য তোর কাছে বিয়ের প্রপোজাল এলো।”
“ওহ্!”
“ওহ?”
“হুম। তোর ভাইয়ের বিষয়টাকে হজম করে নিতে দে। তারপর, এই নয়া মালটাকে পরে দেখছি।”
রাহী পিটপিট করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি ওর দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। কিচ্ছুটি ভালো লাগছে না আমার। কিচ্ছু না। নবনীদের অনেক দুঃখ থাকে.. অনেক দুঃখ। কিন্তু তাদের আশা ছাড়তে নেই।
চলবে…#কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ
|পর্ব ২৭|
রাহীর সাথে সন্ধ্যের আগ দিয়েই মামার বাসায় চলে এসেছিলাম। আজ আর বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না, এখানে কাজ আছে। আম্মুকে কল দিয়ে বলে দিয়েছি; আজ রাহীর সাথেই থাকব। কেন যেন, মানা করেনি। আমার অনুমান শক্তি বলছে, বাসায় আমাকে দেখতে আসা লোকেরা এখনও আছে বিধায়ই আম্মু বাসায় ফেরার তাগিদ দেখায়নি।
ফ্রেশ হয়ে বেরোতেই দেখলাম, মণি বিছানায় বসে আছে। রাহী পড়তে বসেছে। মণি আমাকে দেখেই মলিন হেসে বলল, “কতদিন পর এলি!”
আমিও প্রত্যুত্তরে সামান্য হাসলাম। এগিয়ে গিয়ে মনির পাশে বসলাম। মণি আবারও বলল, “ছেলেটাও এমুখো হয় না কত মাস হয়ে গেল!”
আমি হেসে শুধালাম, “তা কেন আসে না?”
মণি আমতা আমতা করতে লাগল, “ওই যে! ভার্সিটিতে কীসব কাজ আছে। আমি বাবা অতসব বুঝি না। তোদের আজকালকার ছেলেপুলেদের কত ব্যস্ততা! মা-বাপকে মনে রাখার সময় কই?”
মণির শেষোক্ত কথাটিতে তীব্র অভিমানের ছাপ। আমি মুচকি হেসে অভয় দিলাম, “সব ঠিক হয়ে যাবে, দেখে নিয়ো।”
মণি আমার দিক থেকে দৃষ্টি সরাল। মায়েদের নিজের চোখের জল দেখাতে নেই। তাদের লুকোতে শিখতে হয়। সংসারের চরম দুর্ভোগেও তাদের নিরাশ হতে নেই। বরং ঠোঁটে ভরসার হাসি টেনে বলতে জানতে হয়, ‘চিন্তা কোরো না। আল্লাহ চাইলে, সব ঠিক হয়ে যাবে।’
আমি তাই মণিকে ঘাঁটালাম না। আমার মণি এখনও স্ট্রং হতে পারেনি। স্বান্তনা বাণী শেখেনি। সে তীব্র অভিমান বুকে বসত করতে জানে। স্বল্প অভিমানেই অভিযোগের ঝুলি খুলে ফোঁপাতে জানে। এই যে, মণি এখন এখান থেকে উঠে গিয়ে কুঞ্জ ভাইকে কল দেবে। কল ধরতেই আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদবে।
কুঞ্জ ভাই তখন নরম স্বরে বলবে, “মা! আমি ঠিক আছি। একদম ফিট অ্যান্ড ফাইন। কেঁদো না, মা। আচ্ছা! তোমরা তিনজনেই যদি এভাবে কান্নাকাটি করার অভ্যাস পোষো; তবে যখন তিনজন একসাথে অশ্রুবিলাশে মত্ত হবে, আমি একাকী পুরুষ কাকে রেখে কাকে সামলাব? বোনটার জন্য না হয় পরে কেউ আসবে.. কিন্তু এখন তো আমি ছাড়া কেউ নেই। আর তোমার বর তো বিশাল ব্যস্ত মাপের মানুষ; বউয়ের চোখের জল মোছার তার সময় কই? আচ্ছা, মা! সুখে থাকতে ভূতে কিলিয়েছিল তোমাকে? দুনিয়াতে আমার জন্য আর বাপ খুঁজে পাওনি?”
মণি তখন পুরোপুরি কান্না থামিয়ে কুঞ্জ ভাইকে এক রামধমক দেবে। আমি এটা রাহীর কাছে শুনেছি। আবার কুঞ্জ ভাইকে বলতেও শুনেছি। আমি ডানে মণির দিকে তাকালাম। বললাম, “মেডিসিন নিয়েছ?”
“উঁহু।”
“তোমার রুমের বেডসাইড টেবিলের উপর রেখে এসেছি, গিয়ে খাবে।”
“ঠিক আছে।”
“দশটা বেজে গেছে। এক্ষুনি ঘুমিয়ে যাবে। ঠিক আছে?”
“ওরে, বাবা! আমার মা সাজছেন!”
“হুঁহ! প্রয়োজন পড়লে, তাই-ই।”
“আচ্ছা, আচ্ছা!”
“হুম। মামা কবে আসবে?”
“কালই তো গেল। সামনের সপ্তাহে আসবে।”
“আচ্ছা। তবে যাও এখন। ওষুধ নিয়ে ঘুমাবে।”
মণি ডানে বাঁয়ে মাথা নেড়ে রুমে চলে গেল। আমি চাপা শ্বাস ছেড়ে বাঁয়ে মুড়তেই রাহীকে তীক্ষ্ণ নজরে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখলাম।
রাগ দেখিয়ে বললাম, “এমনিতেই তোর ভাইয়ের কারণে মেজাজ তুঙ্গে উঠে আছে। খুলে বল– কাহিনি কী।”
রাহী বই ভাঁজ করে চেয়ারটা আমার দিকে ঘুরিয়ে বসল। লম্বা একটা শ্বাস টেনে বলতে শুরু করল, “বাবা যখন জানতে পারে, ভাইয়ের বিষয় নিয়ে; তখন একটা ঝামেলা হয়েছিল। মিটেও গিয়েছিল। এরপর তোকে নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়। বেশ দূর পর্যন্ত যায়। আমি তোদের বাসায় ছিলাম বিধায় পুরোটা জানি না। কেবল জানি– এই ঝামেলাতেই ভাইয়া বাড়ি ছাড়ে। তবুও বাবা বিজনেস ট্রিপে গেলে, মাঝে মাঝে ভাইয়া বাসায় আসত। লাস্ট টাইম আরও এক ঝামেলা হওয়ায় পুরোপুরি বাসা ত্যাগ করেছে আমার গুণধর ভাই।”
“আরে ভাই! আমাকে নিয়ে কী জন্য ঝগড়া লেগেছিল, সেইটা খুলে বল! ঝামেলা তো অনেক ধরনের হতে পারে। এই ধর, ঘন ঘন তোদের বাসায় যাওয়া আসা নিয়ে হলো! কিন্তু এটা হওয়ার নয়।”
“এরকম না।”
“আবার ধর, মামা বা মণি, কেউ আমার সাথে তোর ভাইয়ের বিয়ে দিতে চাইছে; কিন্তু তোর ভাই সন্যাস ব্রতে আছে, রাজি না।”
“আরে!”
“আরে, শোন! আবার এরকমও হতে পারে, আমি বারবার মণির কাছে জেই অভিযোগগুলো করি, সেগুলো মামা জেনে গেল। তারপর বকা-ঝকা করল। কিন্তু এটাতো সিরিয়াস লেভেলে বাড়ি ছাড়ার মতো না। আচ্ছা! আমি যে এত এত অভিশাপ দিতাম তোর ভাইকে, সেগুলো লেগে যায়নি তো?”
“এএএ ভাই, থাম তুই। সাধে তো আর আমার ভাই তোকে গাঁধী বলে না!”
রাহীর কপাল চাপড়ে বলা শেষ কথাটি বেশ মিনমিনে কণ্ঠে ছিল, তবুও আমার কানে এলো। তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম, “কী বললি?”
___________
গভীর রাতে পা টিপে টিপে কুঞ্জ ভাইয়ের রুমের দিকে এগোচ্ছি। নিজ লক্ষ্যের দিকে এগোতে এগোতে আমি বারবার ডানে বাঁয়ে তাকাচ্ছি; পাছে না কেউ দেখে ফেলে। যদিও দেখার মতো কেউ নেই। ঘড়িতে বাজে মধ্যরাতের ১টা। রাহী পড়া রিভাইস করে ঘণ্টা খানেক আগেই ঘুমোল। মণিও ওষুধ খেয়ে ঘুম। উঠবে আযানের শব্দেই। কাজেই ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। তবুও…
রুমে পৌঁছেই আমি আস্তে করে কাঠের দরজাটা সামান্য ঠেলে দিলাম। নিকষ কালো অন্ধকারে নিজের ছায়াটাও চোখে পড়া দায়। আমি এতক্ষণে ফোনের টর্চ অন করলাম। খুঁজতে লাগলাম কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি, সেই ডায়েরিটি।
ডায়েরি! একটা মানুষের আত্মকথন। রহস্যময় কিংবা ইন্ট্রোভার্ট মানব-মানবীদের স্বভাবতই ডায়েরি লেখার অভ্যেস থাকে। তারা দুনিয়ার সামনে নিজেকে উপস্থাপন করে না কিংবা করতে পারে না। গোপন বিষয়াদির সব না হলেও আংশিক নিজের ডায়েরিতে প্রকাশ করে।
কুঞ্জ ভাইয়ের ডায়েরি লেখার অভ্যেস আছে। কিছু না কিছু নিশ্চয়ই সেখানে পাওয়া যেতে পারে। কথায় আছে– ‘যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখিও তাই। পাইলেও পাইতে পারো, অমূল্য রতন।’
আমিও তাই সেই আশাতেই এ-বাড়িতে ডায়েরির সন্ধ্যানে থেকে গেলাম।
বেশ কিছুক্ষণ ধরে ডায়েরিটা খুঁজে চলেছি। গতবার যেখানে দেখেছিলাম, সেখানে পাচ্ছি না। অনেকটা সময় এই পুরোনো নীল ডায়েরি খোঁজার পেছনে ব্যয় করে, অবশেষে বুকশেলফের একদম নিচে পেলাম। জায়গা চেঞ্জ হওয়া স্বাভাবিকই বটে। লাস্ট টাইম, ডায়েরিটা জায়গামতো রাখার পর কুঞ্জ ভাই আরও দু’বার এসেছিলেন।
ডায়েরিটা নিয়ে টেবিলে রেখে, চেয়ার টেনে বসলাম। টর্চ বন্ধ করে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালালাম। ডায়েরি খুলতেই প্রথম পেইজে কুঞ্জ ভাইয়ের পরিষ্কার হাতের লেখায় সেই মেয়েকে নিয়ে লেখা দেখলাম। আরও একবার পড়লাম।
– “আমার হৃদয়হরণী, কোমল এক রমণী সে। তাকে দেখলেই শুধু দেখে যেতে ইচ্ছে হয় এই দু’চোখ ভরে। তার চোখের উপচে পড়া মায়ায় আমি তলিয়ে পাচ্ছি না কুল। বড্ড অদ্ভুত নারী সে। তার আশেপাশে না থাকলে নিজেকে ছন্নছাড়া লাগে, দিন-দুনিয়া হারিয়ে ফেলি। অথচ, সেই নারীটি পাশে থাকলে আমি গোটা নিজেকেই হারিয়ে ফেলি। প্রখর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন আমিটা তার সান্নিধ্যে পালটে যাই, পুরোই বিপরীতধর্মী এক সত্তা আমাকে কাবু করতে থাকে। আমার সবচেয়ে প্রিয়! সবচেয়ে প্রিয়– তার কোমল শরীরের মিষ্টি সেই পদ্ম পাপড়ির সুবাস। পাগল করে দেয়। কখনও কোনো নারীর প্রতি আমার এমন অনুভূতি আসেনি। তবে তার প্রতি কেন? কারণ একটাই– সে যে ভিন্ন, আমার কঙ্কাবতী ভিন্ন। তাকে আমি নিজের অস্তিত্বের সাথেই মিশিয়ে ফেলেছি। এখন সে ছাড়া আমার আর গতি নেই। পুরো পৃথিবীর সবকিছুর বিনিময়ে হলেও আমার তাকে চাই। মোহময়ী কঙ্কা আমার, তোমাকে চাই।”
এখানে কঙ্কা ও কঙ্কাবতী সম্বোধনে আমার মাথায় তড়িৎ বেগে খেলল– আজ সকালে পাওয়া সেই চিরকুটেও আমাকে কঙ্কা সম্বোধন করা হয়েছে। কুঞ্জ ভাইয়ের মতিগতি বুঝতে আমার সময় লাগল না। মনটা কেমন আনচান করতে লাগল কেবল। ব্যাপারটি নিয়ে আর না ঘাটিয়ে দুটো শ্বাস ছাড়লাম। এরপর ডায়েরির পরের পেইজ উলটালাম। উপরে তারিখে দেওয়া।
-“০৩-০৪-২০১৬
আমার ১৭তম জন্মদিন। জন্মদিনের ব্যাপারে আমি কোনোকালেই ইন্টারেস্টেড ছিলাম না, হবও না। তবে, আজ দারুণ একটা ঘটনা ঘটল। পিচ্চিটা টিফিনের টাকা জমিয়ে আমার জন্য গিফট এনেছে। এখন রাত ১টা। ঠিক রাত ১০টায় সে হলদেটে হাঁটু লম্বা ফ্রক পড়ে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে আমাদের বাসায় চলে আসে। ঘনকালো চুলগুলো দুই বেনুনি করা। একদম হলুদ পাখি বেশে সে দাঁড়িয়েছিল বটে। তবে, চাঞ্চল্যের ছিটেফোঁটাও ছিল না। কেমন যেন ইতস্তত করছিল। ব্যাপারটা সচরাচর দেখা যায় না। আনমনেই ভ্রু-কুঁচকে এলো।
আমাকে এভাবে তাকাতে দেখে পেছনে লুকোনো গিফটটি আমার সামনে এগিয়ে চটপটে ভঙ্গিতে বলল, ‘কুঞ্জ ভাই! একদম ভুলে গেছিলাম। কাল সকালেও মনে ছিল। কিন্তু আজ! সে যাক-গে! সন্ধ্যের পর মনে পড়ায় আব্বুর চোখ এড়িয়ে বাসা থেকে বেড়িয়েছিলাম। জানেনই তো, আব্বু একা বেরোতে দেয় না। এই নিন। আশে-পাশে পছন্দ মতো কিছুই পাচ্ছিলাম না। তাই ওই স্টেশনারি থেকে এই ডায়েরিটা নিয়েছি। এরপর এতক্ষণ ধরে ডিজাইন করলাম। ঘুম পাচ্ছে, কুঞ্জ ভাই! এটা ধরুন। গেলাম আমি। ঘুমাব।’
পিচ্চিটা এখন নিশ্চয়ই ঘুমোচ্ছে! আমি র্যাপিং পেপার খুলে এই ডায়েরিটি পেলাম। কী সুন্দর ভাবে বাচ্চা হাতে সাজিয়েছে! রাতে ডায়েরিটা হাতে দিয়ে যখন চলে যেতে নিচ্ছিল, পিছু পিছু আমিও গেলাম। ওকে বাসা অবধি এগিয়ে দেওয়ার জন্য। তা দেখে পিচ্চিটা কী চমৎকার হাসল!
এরপর বলল, ‘কুঞ্জ ভাই, শুনুন। আপনি বড্ড কম কথা বলেন। আর আমার এই ব্যাপারটা জোস লাগে। কিন্তু, আপনি কি জানেন, আপনার চোখ কখনই নির্বাক থাকে না; প্রচুর বকবক করে। সারাটাক্ষণ কীভাবে কীভাবে যেন আমায় শাসিয়ে যায়। দেখুন, মেইন টপিকে আসি। চোখে চোখে কথপোকথন কমিয়ে এই যে ডায়েরি, এতে লিখুন। আমিও শান্তি পাব। আর, হ্যাঁ! ২য় পেইজ থেকে লিখবেন। প্রথম পেইজে সবচেয়ে দামী কিছু লিখবেন। এই এই এই! দামী মানে কিন্তু মুহূর্ত বোঝাচ্ছি। আপনার এসব ব্র্যান্ডেড জিনিসাদি নয়! জীবনের সেরা অব্যক্ত অনুভূতি এখানে লিখবেন। বাসা চলে এসেছে। আচ্ছা, গেলাম আমি।’
আমি তার কথা ভুলিনি, ভুলব না। ভেবেছিলাম– প্রথম পেইজে পিচ্চির দেওয়া এই প্রথম উপহারের কথাই লিখব। কেন যেন এই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, ‘এর চেয়ে সেরা অনুভূতি আমার জিবনে দ্বিতীয়টি নেই।’
পরক্ষণেই আমি থামলাম। দ্বিতীয় পেইজ থেকে লেখা শুরু করলাম।”
এই পেইজে এটুকুই লেখা। আমি পরের পেইজে যাওয়ার আগে ভালোভাবে ডায়েরিটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলাম। তখন আমার বয়স মনে করার চেষ্টা করলাম। উমম.. ভালোই ছোটো ছিলাম। পুরোনো সেসব দিনের কথা মনে পড়তেই মুচকি হাসি যেন ঠোঁটে আঁটে না। তখনই আমার ফোনে কল এলো। ভাইব্রেট করে উঠল ফোনটি। হাতে তুলে দেখলাম– কুঞ্জ ভাইয়ের কল।
চলবে..