#কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ
|পর্ব ৩৩+৩৪|
“জি, কে আপনি?”
নৌশি থেমে গেল। কথা বলছে না। আমরা কথা বলার জন্য তাগিদ দিচ্ছি, সে তারও পাত্তা দিচ্ছে না। ওপাশ থেকে আকিব ভাই ‘হ্যালো, হ্যালো’ করেই যাচ্ছেন। আমি একটা হালকা করে ধাক্কা দিলাম নৌশিকে। সে সংবিৎ ফিরে পেয়েই বলে উঠল, “আকিব?”
কণ্ঠে একরাশ মায়া। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। নৌশির এমন মলিন আওয়াজের সাথে আমরা পরিচিত নই। ঘটনাটা অবশ্যই ভারি বিস্ময়কর!
ওপাশ থেকে আকিব ভাই বললেন, “জি, আকিব বলছি। আপনি কে?”
“আ-আমায়.. আমায় চিনতে পারছ না?”
ওপাশেও কথা থেমে গেল এবার। মিনিট খানেক যেতেই বলল, “কেমন আছ?”
“আল্লাহ ভালো রেখেছেন। তুমি বলো… কেমন আছ?”
“তোমার মতো চোখে চোখ রেখে, অকম্পিত গলায় মিথ্যে বলার অভ্যেস আমার নেই। ভালো নেই আমি।”
নৌশি চুপ মেরে গেল। ব্যাপারটা আমাদের কারোরই বোধগম্য হলো না। নৌশিকে চুপ থাকতে দেখে ওপাশ থেকে আকিব ভাই আবারও বলে উঠলেন, “কই আছ?”
“আছি কোনো এক জায়গায়।”
“ভণিতা কোরো না। কই আছ– বলো। কম খুঁজিনি তোমায়।”
“হাসিও না। তুমি, আর আমায় খুঁজবে?”
“আছ কই?”
“বনানীতে আছি।”
“ওখানে?”
“বাবার ট্রান্সফার হয়েছে।”
“একটাবার বলে গেলে কি খুব ক্ষতি হতো? জানো– সিলেটের এমন কোনো জায়গা বাদ নেই, যেখানে তোমায় আমি খুঁজিনি।”
“সিলেট ছেড়েছি আরও বছর তিনেক আগেই।”
“সে তো আমি জানতাম না। তবে, তোমাকে আজও খুঁজি।”
“সিলেটেই আছ?”
“না, ডিএমসিতে পড়ছি এখন। এইচএসসি দেওয়ার পরই চান্স পেয়ে চলে এসেছিলাম। মেডিকেলের হলেই থাকি। তবে, তোমার খোঁজে এখনও সিলেট যাওয়া হয়।”
“কেন যাও?”
“যদি একটাবার পাই।”
“পেয়ে?”
“প্রশ্ন করব।”
“কী প্রশ্ন?”
“তোমাকে ভালোবাসাটা কি আমার ভুল ছিল?”
“এর উত্তর আমার কাছে নেই।”
“নেই না কি দিতে চাও না?”
“বাধ্য নই।”
“তবে কল করলে যে?”
এতক্ষণে নৌশি আমাদের দিকে তাকাল। আমরা তিনজনই অসীম কৌতুহল নিয়ে চেয়ে আছি। শতভাগ নিশ্চিত, এরা পূর্বপরিচিত। আর দুজনের মাঝে কোনো এক সম্পর্ক ছিল; যা আমাদের অজানা। নৌশি আমাদের দিকে একবার তাকিয়েই আকিব ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলল, “তাহলে বিয়ে করছ কেন?”
“বিয়ে! কে?”
আকিব ভাইয়ের কণ্ঠে চমক। একদম অপ্রত্যাশিত কোনো কথা শুনতে পাবার দরুন বিস্ময়।
নৌশি হেসে বলল, “বুঝতেই পারছ না? তুমি কি এতটাই অবুঝ নাকি?”
“আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না।”
“তোমার বাবাকে জিজ্ঞেস করো।”
“আজব, নূর! কথা ঘুরিয়ে বলার স্বভাবটা যাবে কবে তোমার?”
আমরা এবার তিনজনে সমস্বরে চিৎকার করে উঠলাম, “নূর!”
আকিব ভাইয়া ভড়কে গেলেন। শুধালেন, “কে? হ্যালো, নূর?”
“আমি তোমাকে রাতে কল দেব”– বলেই নৌশি কল কেটে দিলো। এরপর নম্বরটা ফট করে নিজের ফোনে টুকে নিল। তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে শুধাল, “আমার পুরো নাম কী?”
আমি উত্তর দিলাম, “নূরহানা ইসলাম নৌশি।”
নৌশি শ্বাস ফেলে বলল, “ওই তো, নূরহানা থেকে নূর।”
চিত্রা জিজ্ঞেস করল, “সম্পর্ক আছে?”
রাহী জিজ্ঞেস করল, “কী সম্পর্ক?”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কতদিনের সম্পর্ক?”
নৌশি লম্বা শ্বাস টেনে মলিন হেসে বলল, “আমি তো তোদের স্কুলে টেনে ভর্তি হই। ক্লাস ফোর-নাইন অবধি সিলেটে ছিলাম, বাবার জবের জন্য। নাইনে পড়ার চাপে, টিউশনি শুরু করি; আকিবের কাছেই পড়ি। আকিব আমাদের পাশের বিল্ডিংয়েই, ওর মামার বাসায় থাকত, এটা পরে জানতে পারি। ও রোজ দু’ঘণ্টা করে পড়িয়ে যেত। শুরুর দিকেই ওর কথা-বার্তা, চাল-চলন, ড্রেসআপ, বাচনভঙ্গির উপর দুর্বল হতে থাকি। আমাদের ব্যালকনি আড়াআড়িভাবে ছিল বলে, প্রায়ই দেখা হতো। এমনিতেও, বয়ঃসন্ধির সময় ছিল। যা দেখতাম, তা-ই ভালো লাগত। তার উপর, আকিব সত্যিই হ্যান্ডসাম ছিল। অ্যাটিটিউড অন্য লেভেলের ছিল। এক সময়, ছ্যাচড়ামি শুরু করে দিই। তাকেও বোঝাতে শুরু করি, আমি তাকে পছন্দ করি। সে বুঝেও, পাত্তা দিত না। কিন্তু…”
তিনজন একসাথে বলে উঠলাম, “কী?”
“কিন্তু, সে চাইলেই আমাকে পড়ানো বন্ধ করে দিতে পারত। কম জ্বালাইনি। পড়ানোর সময় ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতাম। একদিনও পড়া কম্পলিট করতাম না। পড়াশোনা বাদে– সাজুগুজু করতাম, তার জন্য রান্নাবান্না করতাম, চিরকুট দিতাম, তার সাথে ফ্লার্ট করতাম। সব করতাম, কেবল পড়াটা বাদে।”
নৌশি তাকাল। এরপর আবারও হেসে দিলো। বলল, “আমার পড়াশোনা নিয়ে ভারি দুশ্চিন্তা করত। আমার এতশত দুষ্টুমি মুখ বুজে সহ্য করে পড়িয়ে যেত। প্রথম প্রথমে বুঝতে না পারলেও, পরে এসে বুঝতে পারি– হি অলসো লাভ’স মি।”
ছোটোখাটো একটা বিস্ফোরণ! চার শব্দের একটি বাক্য, আর মাঝের ‘অলসো’ শব্দটি, বাক্যের রূপই পালটে দিলো। নৌশিও কাউকে ভালোবেসেছে! প্রথমে নিতান্তই বয়ঃসন্ধির দোষ ভেবেছিলাম, কিন্তু এটা যে আদতেই ভালোবাসা!
আমি শুধালাম, “এরপর?”
“এরপর আমিও বাড়াবাড়ি শুরু করি। আমি তখন থেকেই ওকে ‘তুমি’ করে বলতাম। প্রাইভেট না, যেন নতুন বউ সেজে বরের বাড়ি ফেরার অপেক্ষা করতাম। আমাদের মাঝে অব্যক্ত প্রেম চলছিল। অলিখিত চুক্তি হয়ে গিয়েছিল, একে অপরের হয়ে যাবার। আমি সবসময় সিম্প্যাথি পাবার চেষ্টা করতাম। সেজন্য মিথ্যেও বলতাম। এই ধর, বারান্দায় চিরকুট ছুঁড়ে মারতাম– আমি খুব অসুস্থ, আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করছে, ছাদে আসুন/বারান্দায় আসুন। এখানে, আমার অসুখের ‘অ’-ও ছিল না।
এরপর একদিন ওর বাবার অসুখ করে, এজন্য গ্রামের বাড়ি যাবে। বলেই যায়, সামনের মাস থেকে পড়াবে। আমাকেও আলাদা করে বলে যায়, ‘ঠিকমতো পড়াশোনা কোরো, আর আমার জন্য অপেক্ষা কোরো।’
আমি তখন মুচকি হেসে বলেছিলাম, ‘করব তো। চাঁদরাতে জেগে ইদ পাবার মতো করে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব।’
এরপর চলে গেল! এমনিতেও নাইনের ফাইনাল হলো তো, ক্লাস হচ্ছিল না; ছুটি চলছিল। যেহেতু আমার পড়াশোনার প্রেশার ছিল না, তাই বাবাও আপত্তি করল না।
কিন্তু হুট করেই বাবার ট্রান্সফার অ্যাপ্লিকেশন আসে। অফিসে আগেই জানানো ছিল– মেয়েরা স্টুডেন্ট; বছরের মাঝামাঝিতে ট্রান্সফার হলে, পড়াশোনায় ইফেক্ট পড়বে। তাই-ই বছরের শেষেই এলো, দুই সপ্তাহেই ঢাকার নতুন ব্রাঞ্চে ম্যানেজার পোস্টে জয়েন করতে হবে।
ওদিকে আকিবও ফিরছিল না। চলে যাবার সময় ঘনিয়ে এসেছিল। যাবার আগের দিন, মা আকিবের মামির সাথে কথা বলেছিল। ট্রান্সফারের ব্যাপারে বলেছিল, কিন্তু কোথায় হচ্ছে– তা বলেনি। সেই ফাঁকে, আমিও আকিবের রুমে একটা চিরকুট রেখে এসেছিলাম। ছোট্টো চিরকুট..”
রাহী জিজ্ঞেস করল, “কী লেখা ছিল?”
“লেখা ছিল– আকিব! যদি হারিয়ে যাই, তবে খুঁজবে কি? না কি পরবর্তীতে ফিরে আসার পথও বন্ধ পাব?”
আমি কিছুটা অবুঝ ভঙ্গিতে শুধালাম, “ছেলেখেলা নাকি? এত সহজে কী করে একটা সম্পর্কে জড়ানো হয়? আর জড়িয়েই যেহেতু পড়েছিলি, তবে এভাবে কীভাবে ছাড়লি?”
নৌশি হেসে বলল, “ছাড়িনি। আমি জানতাম– ও ঢাকায় চলে আসবে। ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিল কি না! টার্গেট ছিল ডিএমসি। যখন ছেড়ে এলাম, তখন সেকেন্ড ইয়ারে ছিল ও। মেডিকেলের প্রিপারেশন নিচ্ছিল। আমি শতভাগ নিশ্চিত ছিলাম, ডিএমসিতে হয়ে যাবে ওর। তাই আর তখন বিষয়টা এত সিরিয়াসলি নিইনি। তখন আমার নিজের ফোনও ছিল না, এজন্য নম্বরটাও নেওয়া হয়নি। আর আমি এত বলদ ছিলাম যে, নম্বরটা কালেক্ট করেও রাখিনি। যোগাযোগ করার আর কোনো ওয়ে-ই ছিল না। বছর খানেক আশা রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম– আমার কাছে ওর নম্বর নেই বলে কী হয়েছে? ও কি কোনোভাবে আমাকে খুঁজে নিতে পারবে না?বাবার নম্বর তো আছেই ওর কাছে। কিন্তু, এসএসসির পর সে-আশাতেও কবর দিই। আর কত অপেক্ষা করব?তাছাড়া বড়োও হচ্ছিলাম। তাই বাচ্চাকালের প্রেম ভুলে এগোলাম। এই তো!”
“রাই! এই মহিলারে থাপ্রা। আমি থাপ্রাইলে ওরে লাত্থিও খেতে হবে।”
আমার কথায় রাহীও রেগে এগিয়ে গেল। রাশভারী কণ্ঠে শুধাল, “আগে বলিসনি কেন?”
নৌশি দুই হাত তুলে স্যারেন্ডার করার ভঙ্গিতে বলল, “আরে আরে! যা থেকে বেরিয়ে এসেছি, তাতে আবার ঝেঁকে কী করব? তাছাড়া দ্যা পাস্ট ইজ দ্যা পাস্ট। ইট শ্যুড বি ইন দ্যা পাস্ট।”
_____
বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হলো। দুপুরের খাবারটা বাইরেই খেয়ে এসেছি। আপাতত আকিব ভাইকে নিয়ে কিছুই করার প্রয়োজন বোধ করছি না। কথা শুনে যতদূর বুঝলাম– আকিব ভাই বিয়ের ব্যাপারটা কিছুই জানে না। সবটা তার বাবার পক্ষ থেকেই হচ্ছে। সে তো নৌশিকে নিয়ে ভারি ডেস্পারেট। এখন যেহেতু জানল, তবে নিশ্চয়ই বিয়েতে মত দেবে না। আর দিলেও সমস্যা নেই, আমার বাসা থেকে এসব নিয়ে কখনই আমাকে প্যারা দেওয়া হবে না, এ-আমার জানা আছে।
রুমে ঢুকতেই আপি এলো। পাশে বসে মাথার চুল টান দিলো। আমি বিরক্ত হয়ে সরে বসে বললাম, “মেজাজ খারাপ করছ কেন, আপি? তোমার কোন বাড়া ভাতে নুন ঢাললাম?”
“গাঁধী! ওটা নুন না, ছাঁই হবে।”
“আমি নুন-ই বলেছি। ভাতে তো নুন খাও না, তাই।”
“ওরে সেয়ানা! তা বল, কী করলি?”
“কী করার?”
“আকিবকে হাদা বলছিলি কেন?”
“আরে! ছোটো থাকতে দেখেছিলাম। চেহারা যা মনে আছে– মুখের চেয়েও বড়ো চশমা পরে ঘুরত, তা থেকেই বললাম।”
“কী করলি রে ওর সাথে?”
আমি বিনুনি গাঁথা চুলগুলো খুলতে খুলতে বললাম, “ভাবলাম, ফ্লার্টিং করে একটা ফেক একাউন্টের সাথে প্রেম করিয়ে ঝুলিয়ে দেব। কিন্তু তা আর হলো কই? আগেই সব ক্লিয়ার।”
“সে-কী! কীভাবে?”
“সেটা তোমার জেনে কাজ নেই, সুইটহার্ট!”
“বলবি না?”
“আরে, রাগছ কেন? বলছি, বলছি। নৌশির সাথে আকিব ভাইয়ের একটা পুরোনো হিসেব-নিকেশ বাকি আছে। আপাতত ও-রেখে আমার কাছে আসবে না। সো, রেস্ট আস্যুয়োর্ড।”
“ওকে, ওকে। এবার নিজের ফোনের দিকে একটু খেয়াল দে।”
“কেন? কী হয়েছে?”
আমি ফোন হাতে নিয়ে দেখলাম, সুইচ অফ হয়ে আছে। অন করতে গিয়ে বুঝলাম, চার্জ ওভার। ওমা! এটা কখন হলো? জলদি চার্জে দিয়ে অন করলাম। আপি রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ফোন অন হতেই নোটিফিকেশনে ১৭টা মিসড কল ভেসে এলো বিগত ৪ঘণ্টায়! লাস্ট কলটা মিনিট পাঁচেক আগের। কুঞ্জ ভাইয়ের!
আমি জলদি কল ব্যাক করলাম। অথচ কল ঢোকার আগেই আবারও ফোনে সেম নম্বর থেকে কল এলো। জলদি রিসিভ করে বললাম, “স্যরি স্যরি স্যরি! ফোন কখন অফ হয়ে গিয়েছিল– বুঝতেই পারিনি। একদম স্যরি।”
“রাগ করেছি খুব, রাগ ভাঙাও।”
“আরে! ভাইটা আমার! এত রাগ আসে কোত্থেকে? ভাবি খুঁজব কি, হুঁ?”
সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে কিছু অশ্লীল স্ল্যাং কানে আসতেই আমি ফোনটা দূরে সরিয়ে সম্পূর্ণ চোখ কুঁচকে ফেললাম। মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, “আস্তাগফিরুল্লাহ!”
কিছুক্ষণ পর, স্বাভাবিক হয়েও যেন স্বাভাবিক হলাম না। বিস্মিত কণ্ঠে শুধালাম, “গালিও জানেন?”
“আরও কয়েকটা বলার জন্য মুখটা নিশপিশ করছে রে। সামনে পেলে কয়টা যে থাপ্পড় খেতিস!”
“উফ! বকছেন কেন?”
“বুঝিস না?”
“নাহ!”
“আমি তোর কোন জন্মের ভাই?”
পাগলা ক্ষেপছে তবে! মজা নেওয়ার উদ্দেশ্যে আমিও বললাম, “কেন? এই জন্মেরই!”
“আরে বলদ!”
“জেনডার ভুল! গাভী হবে, জান। বলদের স্ত্রীলিঙ্গ হচ্ছে– গাভী। বলদ তো আপনি। আর আমি আপনার গাভী। হেহে।”
“*** লাগি তোর।”
“ছি! ছি!”
“এখন ছি! ছি! কেন করছিস?”
“এসব কেউ বলে মুখ খারাপ করে?”
“আমাকে ভাই ডেকে তুই মুখ খারাপ করিস কেন?”
“তাই বলে গালি দেবেন! কেমন শোনায়!”
“তোর মুখে ভাই ডাকটাও আমার কাছে কেমন যেন শোনায়!”
হেসে ফেললাম। তারপর শুধালাম, “এতগুলো কল দিলেন যে!”
“কাল একসাথে এত সময় থাকার পর, এখন প্রতি মোমেন্টে তোমাকে ভীষণ মনে পড়ছে। মনে হচ্ছে, আবারও তোমার কাছে ছুটে যাই। কিন্তু তা পসিবল তো নয়, এজন্য ভাবলাম ভয়েস শুনে আত্মা শান্ত করি।”
“তাই বলে এত কল!”
“তো?”
“কিচ্ছুউউ না। কী করছেন?”
“মিটিং রুম থেকে কিছুক্ষণ আগেই সবগুলোকে বিদায় করে টেবিলের উপর উঠে বসে আছি।”
“ওও, এজন্যই ভয়েস এমন শোনাচ্ছে!”
“জি, ম্যাম!”
“হুহ!”
“তা আজ কোচিং মিস কেন?”
“কলেজ ক্যাম্পাসে ছিলাম চারজন। গপ্প-সপ্প করলাম।”
“সামনে যে এক্সাম, তার খেয়াল আছে? পড়তে হবে যে!”
“হুহ! পড়তে ভাল্লাগে নাহ। তা-ও প্রচুউউউউর পড়ছি। কেন জানেন?”
“কারণ– আমার কঙ্কার এপ্রোন-স্টেথোস্কোপ ভীষণ প্রিয়।”
“জি, ঠিক ধরেছেন।”
“আচ্ছা, নবনী! একটা কথা ছিল।”
“বলুন, শুনছি তো!”
“আমি তোমাকে খুব চাই।”
“জানি তো!”
“কিন্তু, মোটেও ভালোবাসি না…”
আমি শব্দ করে হেসে উঠলাম। কী ছেলেমানুষী কথাবার্তা! লোকটা বলে কি না– ভালোবাসে না! বললেই বুঝি এত এত ভালোবাসা ‘নাই’ হয়ে যায়!
“কী হলো! কিছু বলছ না যে!”
ওঁর কথার উত্তরে আমি সুর করে গেয়ে উঠলাম,
“দুরত্ব কি ভালোবাসা বাড়ায়?
না কি চলে যাওয়ার বাহানা বানায়?
দূরের আকাশ নীল থেকে লাল
গল্পটা পুরনো
ডুবে ডুবে ভালোবাসি,
তুমি না বাসলেও আমি বাসি।”
“এই মেয়ে!”
“কী?”
“সত্যিই বাসো?”
মুচকি হেসে বললাম, “বাসি না। একটুও বাসি না।”
উনিও হেসে দিয়ে বললেন, “আমিও না।”
এভাবে কথা হলো অনেকটা সময়। প্রথমে যখন বলেছিলেন, মনে পড়লে মিসড কল দিতে। আমি তখন বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম– বোধহয় শান্তিতে কথাটাও হয়ে উঠবে না। কিন্তু, না! তেমনটা হলো না। আমার কল দেওয়ার আগেই ওঁর কল আসত। প্রতি রাতেই আমাদের প্রেমালাপ হতো গভীর রাত অবধি। পড়াশোনা নিয়েও ভীষণ স্ট্রিক্ট হলেন, ঠিক আগের মতো। আমার সবকিছুতেই ওঁর শতভাগ নজরদারি চলে। ইতোমধ্যে নৌশি আর আকিব ভাইয়াও নিজেদের মাঝে সবটা ঠিক করে নিয়েছে। মাঝে মাঝেই কোচিং মিস দিয়ে আমরা ওর সাথে শাহবাগে চলে যাই। রাহী আর চিত্রা নিজেদের মতো ঘুরতে থাকে। নৌশি– আদিব ভাইয়ার সাথে ঘোরে। এদিকে আমি যে কই যাই, তার ইয়াত্তা থাকে না।
কখনও ঢাবির বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট কিংবা হলের চারদিক ঘুরি, কখনও বকুল তলায় হাঁটি, কখনও গ্রন্থাগারে যাই, কখনও বা গ্রিন ক্যাফেতে যাওয়া হয়, কখনও জিরো পয়েন্টে গিয়ে বসে থাকি, কখনও টিএসসিতে হাঁটতে থাকি, কখনও দোয়েল চত্বরে একটা রিকশা নিয়ে চক্কর লাগাই; দারুণ মজা লাগে তখন। শহীদুল্লাহ্ হল গ্রাউন্ডেও বেশ শান্তি পাই। গ্রাউন্ড থেকে পুকুর পাড়ে গিয়েও বসে থাকা হয়। মাঝে মাঝে কুঞ্জ ভাইয়ের কড়া দৃষ্টিতে পড়ে গিয়ে সিক্কাটুলি পার্কে বসে থাকি। এভাবেই দিন এগোচ্ছে। এইচএসসির মাঝেও আমার ঘোরাঘুরি কমেনি। কুঞ্জ ভাইয়ের হাজার বকা-ঝকার সত্ত্বেও আমার এসব চলছিলই। এভাবেই এক্সামটাও যায়।
মেডিক্যালের প্রিপারেশন চলছে আমাদের চারজনেরই। রোজ কোচিং-বাসা-ঘোরাঘুরি, আর রাতে আমার প্রেমিকপুরুষটার সাথে দীর্ঘক্ষণের প্রেমালাপ। এরকমটাই চলছিল।
সেদিন কোচিং শেষে ঢাবিতে গিয়েছিলাম। বোটানিক্যাল গার্ডেনে গিয়ে কুঞ্জ ভাইকে দেখতে পাই। প্রথম দিনের মতোই ইগনোর করলেন, সাথে অনেক মানুষ ছিল কি না! আমি লক্ষ করলাম, কুঞ্জ ভাই আজ ভারি রেগে আছেন। অরুণ ভাইকে কিছু একটা বলতেই, সে-ও ক্ষোভে ফেটে পড়ে। কিছুক্ষণ পর কুঞ্জ ভাই আমার দিকে এগিয়ে আসেন।
আমি ভড়কে যাই। ঢোক গিলে বলি, “কী?”
“সোজা বাসায় যা। ৩ দিন বাসা থেকে বেরোবি না। খবরদার নবু, ভুলেও না।”
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, “আ-আচ্ছা!”
সোজা বাসায় চলে এলাম। আড়চোখে দেখতে পেলাম, অরুণ ভাই একটা ছেলেকে টেনে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে। ছেলেটা চিৎকার চেঁচামেচি করেও কোনো লাভ করতে পারল না। আমি সেসবে আর না ভেবে প্রস্থান ঘটালাম। কুঞ্জ ভাইয়ের কথা মতো সোজা বাসায় ফিরলাম। ড্রইং রুম পেরিয়ে নিজের রুমে যেতে নিলেই আমার পা থমকে গেল। টিভিতে নিউজ চলছে।
কানে এলো, “নারী ও বিভিন্ন মাদকদ্রব্য পাচার করতে গিয়ে ধরা পড়ল দেশের বিভিন্ন স্বনামধন্য নেতৃবৃন্দ। এই পাচারকারী দলটি বিগত ১১ বছর ধরে গোপনে এ-অবধি আড়াই লক্ষাধিক নারীকে চাকরির লোভ দেখিয়ে কিংবা তুলে এনে চড়া দামে বিক্রি করেছে বিদেশি ক্রেতাদের কাছে। জানা গেছে, নারীদের মাঝে সত্তর শতাংশই শিশু অর্থাৎ আন্ডার এইটিন ছিল। কাল রাতে রেডকিন পয়েন্ট থেকে ৩০০ জন নারীকে পাচারের সময় বাংলাদেশ পুলিশ তাদের সবাইকেই আটক করে, পালানোর সুযোগ পায়নি। নারীদের পৌঁছে দেয় নিজ বাসস্থানে। ১৭ জন নারীর ঠিকানা জানা যায়নি বিধায়, পুলিশ প্রশাসক তাদের কোয়ার্টারে থাকার সুব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আইজিপি জানিয়েছেন, তদন্ত কমিটি বিগত দুই বছর ধরে এই চক্রের তল্লাশি চালাচ্ছিল। কিন্তু, ভাগ্য সহায় ছিল না বলে, কিংবা বলা যায়– সঠিক তথ্যের অভাবে প্রতিবারই খালি হাতে ফিরতে হতো। কিন্তু অগ্যাত এক নম্বর থেকে কাল সন্ধ্যায় ডিআইজিকে কল করে জানানো হয়, পাচারের সময় ও স্থান…”
চলবে…