শাশুড়িকে খু*ন করে স্বামীর গায়ে হাত তুলছো এতো সাহস তোর কে দিয়েছে? বাইরে এখনো আমার মায়ের লাশ পড়ে আছে। কেনো করলি বলো? ‘দু’টাকার মেয়ে, তোকে খু*ন করে গুম করতে আমার দু সেকেন্ডও লাগবে না।
স্বামীর মুখে এধরনের কথা শুনতে হবে অধরা কল্পণাও করেনি। লোকটা শান্ত আর ভদ্রলোক। কখনও দরকার ছাড়া অধরার সঙ্গে গত এক বছরে একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি। যখন যা চেয়েছে পেয়েছে। এই বাড়ির সবাইকে ও নিজের মনে করে। তাছাড়া পাঁচ পাঁচটা ননদদের মধ্যে ও নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। ওরা ভূলেও অধরার আশেপাশে ঘেঁষে না শুধু শাশুড়ি মা ছাড়া। সেই শাশুড়িকে ও কিভাবে মারতে পারে অধরার মাথায় আসছে না। আজ সন্ধ্যায় শাশুড়িমা ওকে ছাদে ডেকেছিল। কেনো ডেকেছিল সেগুলো ও কাউকে বলতে পারবে না। শাশুড়ি মা ওর হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল,
> এটা ধরো। এর চাইতে বেশি কিছু বলার অধিকার আমার নেই। এটা গোপন রাখবে। এই বাড়ির কাউকে বিশ্বাস করবে না এমনকি নিজের স্বামীকেও না। নিজের আর তোমার মধ্যে থাকা মহামূল্যবান রত্নের খেয়াল রাখবে। পারলে দ্রুত পালিয়ে যাও। আমার আলমারির ড্রয়ারে কিছু দরকারি জিনিস আছে তোমার কাজে লাগবে। এখন নিচে যাও!দ্রুত।
অধরা কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তু হলো না তাঁর আগেই উনি ধমক দিয়ে ওকে নিচে পাঠিয়ে দিলেন। অধরা নিচে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাইরে হৈচৈ পড়ে গেলো। অধরা দৌড়ে গিয়ে দেখলো ওর শাশুড়ি নিচে পড়ে আছে। চারদিকে রক্তের ছড়াছড়ি। কি ভয়ংকর দৃশ্য। অধরা সেখানেই জ্ঞান হারালো। যখন জ্ঞান ফিরলো দেখতে পেলে ও রুমে শুয়ে আছে আর ওর স্বামী জুবায়ের ফারুকী ওর দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে আছে। ওর চোখ খুঁলতে দেরি হলো কিন্তু লোকটার ওর উপরে ঝাপিয়ে পড়তে দেরি হলো না। গলা আটকে ধরলো। অধরার মনে হলো এখুনি বুঝি মারা যাবে। তাই উপায়ন্তর না পেয়ে লাথি বসিয়ে দিয়েছিল স্বামী নামক লোকটার বুকে। শক্তিশালী জুবায়েরের সঙ্গে ও পারবে কিভাবে। লোকটা পড়ে গিয়েও আবার উঠে আসলো। অধরা ওই সুযোগ দ্রুত বিছানা থেকে নেমে পড়লো কিন্তু জুবায়ের ওকে টেনে দেয়ালের সঙ্গে আটকে ধরে গাল চেপে ধরলো। অধরা বহুকষ্টে বলল,
> আমি এরকম করিনি বিশ্বাস করুন।আপনার মাকে আমি নিজের মা ভেবেছি। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।ছেড়ে দিন।
জুবায়ের হুঙ্কার ছেড়ে বলল,
> ছেঁড়ে দেওয়ার হলে বহু আগেই ছেড়ে দিতাম। তোর ভাগ্য ভালো তোকে দরকার আমার। খুব দরকার। প্রয়োজন শেষ হলে এই পৃথিবী থেকে তোর নাম নিশানা আমি চিরকালের জন্য মুছে দিবো। তুই সুলতান জুবায়ের ফারুকীর নখের যোগ্যও না।
কথাটা বলে জুবায়ের ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে দরজা ধপাস করে বন্ধ করে চলে গেলো। অধরা তাল সামলাতে না পেরে ছুটে গিয়ে ফ্লরে পড়লো। খাটের কোনা লেগে কপালের কিছু অংশ কেঁটে গেলো। অধরা কপালে হাত রেখে উঠে বসলো। ব্যাথা আজ শরীরে না মনে লাগছে। শাশুড়ির মৃত্যুর পরে ওর দুনিয়াটা কেমন বদলে গেলো। এতদিন তো ভালোই ছিল। বিয়েটা হয়েছিল পরিবারিক ভাবে। বিয়ের এক মাসের মাথায় সড়ক দুর্ঘটনাতে ওর বাবা মা মা*রা গিয়েছিল। অধরা বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়ার দরুণ অন্তিম যাত্রার সাক্ষী হতে পারলেও আর কখনও সেখানে ওর পা রাখতে পারেনি। বাবা মাকে ভেবে ও কাঁদবে কষ্ট হবে ভেবে শাশুড়ি ওকে যেতে মানা করতো। আগলে রেখেছিল। যখন যা লেগেছে পেয়েছে। বাড়ির বাইরে যাওয়ার দরকার হয়নি। সুলতান জুবায়ের ফারুকী একজন ভালো ব্যবসায়ী আর বেশ প্রভাবশালী লোক। বাড়িতে কাজের লোকের অভাব নেই কিন্তু সবাই কেমন চুপচাপ। দরকার ছাড়া এই বাড়িতে কোনো শব্দ উচ্চারণ হয়না। পাঁচটা নন্দন সবগুলো বিবাহ উপযুক্ত,এক কথায় আগুন সুন্দরী। যাদের দেখলে মানুষ না ভেবে সবাই পরি ভেবে ভূল করবে। কিন্তু চাঁদেরও কলঙ্ক আছে। এই মেয়েগুলোও তেমনি একটা অভিশাপ বহন করে। এরা বোবা কথা বলতে পারেনা। আধুনিক পোশাক আর চলন ভঙ্গিতে এদের জুড়িমেলা ভার। অধরা এদের রূপের কাছে কিছুই না। কথাগুলো ভেবে অধরা দ্রুত নিজের শাড়ির আচলে থাকা কাগজটা বের করে চোখের সামনে ধরলো। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা আছে,
“বধির বোবা বলবে বাক্য ঝরবে তখন লাল র*ক্ত। ঊষা কালে খুঁলবে দুয়ার শান্ত হবে তিমির দুয়ার”।
একটা ধাঁধা কিন্তু এর মানে কি হতে পারে অধরার জানা নেই। শাশুড়ি মায়ের মুখটা ওর ভীষণ মনে পড়ছে। অধরা কাগজটা দ্রুত লুকিয়ে বেরিয়ে আসলো। এর মধ্যে লা*শ দাফনের সব কাজকর্ম শুরু হয়ে গেছে। বাড়িতে সবাই সাদা পোশাক পরেছে। মেয়েরা মায়ের চারপাশে চুপচাপ বসে আছে। কিন্তু সবাই খুব স্বাভাবিক কারো চেখে কোনো পানি নেই। জুবায়ে বাইরে আছে। পুলিশ এসেছে ঘটনার তদন্ত করতে কিন্তু জুবায়ের দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দিলো। বেশ কিছু টাকা পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ওদেরকে বিদায় জানিয়ে ভেতরে আসলো। অধরা চুপচাপ শাশুড়ির মাথার কাছে গিয়ে বসলো। ছাঁদ থেকে কিভাবে উনি পড়ে গেলেন বিষয়টা নিয়ে ওর চিন্তা হচ্ছে। হঠাৎ মনে হলে উনি ইচ্ছে করে লাফ দিয়েছেন। সুইসাইড করবেন ভেবে ওকে ডেকে এতগুলো কথা বলে গেলেন। কিন্তু সুইসাইড করার কারণটা কি ছিল? কিছুক্ষণের মধ্যে অধরার শশুর এক ভদ্রমহিলাকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকলেন। ভদ্রলোকের দুজন স্ত্রী। উনি ছোট বউয়ের সঙ্গে থাকেন। উনি হন্তদন্ত হয়ে মৃত বউয়ের পাশে বসলেন তারপর অধরার দিকে শীতল নজরে তাঁকালেন। অধরা ভয়ে শিউরে উঠলো। জুবায়ের ওর বাবাকে হয়তো সবটা বলে দিয়েছে। সবাই ওকে ভুল বুঝেছে কিন্তু পুলিশে দিচ্ছে না কেনো? এদের কি দরকারে ও লাগতে পারে? অধরার মনে হাজারো প্রশ্ন ঘুরছে। একমাত্র শাশুড়ি মা ভরসা ছিল যে ওকে সাহায্য করতে পারতো। গভীর কোনো রহস্যের অতলে ও তলিয়ে যাচ্ছে। মাথায় যন্ত্রণা করছে। শাশুড়ি মা শেষবারের মতো বলেছিল ওর মধ্যে কোনো রত্ন আছে কিন্তু রত্নটা কী? এই রত্নটার জন্যই ওকে হয়তো পুলিশে দেওয়া হচ্ছে না। বাড়িতে সিসি ক্যামেরা আছে। যদি খু*ন বলে পুলিশকে জানানো হয় তবে অধরা অনায়াসে ফেঁসে যাবে। জেল বা ফাঁসি নিশ্চিত।
বাবা মা সেই সঙ্গে প্রিয় শাশুড়ি মায়ের এই রহস্যময় মৃত্যু ওকে সম্পূর্ণ একা করে দিলো। অধরা নিজেকে সামলাতে পারছে না। এই নিস্তব্ধ বাড়িতে শব্দ করে কাঁদার মতো অধিকার ওর নেই। কান্নাতে গলা আটকে আসছে। অধরা দ্বিতীয়বারের ন্যায় আবার জ্ঞান হারালো।
__________
মধ্য রাতে আধরার জ্ঞান ফিরলো। মুখের উপরে কারো দীর্ঘ উষ্ণ নিশ্বাস পড়ছে। ভয় ওক আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। আধরা হুট করে চোখ খুলে দেখলো জুবায়ের ওর মুখের উপরে ঝুকে আছে। রুমে আবছা আলো বিরাজ করছে। লোকটার দৃষ্টিতে কোনো রাগ নেই না আছে ঘৃণা। অধরা ডান হাতটা জুবায়ের মুখে রাখতে যেতেই ছেলেটা খপ করে হাতটা ধরে নিয়ে বলল,
> সরি তখন মাথাই কাজ করছিল না।কি বলতে কি বলেছি মনে রেখো না। মৃত্যুতে কারো হাত থাকে না। মায়ের মৃত্যু স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়ে আগে মতো হয়ে যাও।
অধরা ভ্রু কুচকে ফেলল লোকটার কথা শুনে। একজন সন্তান কিভাবে এতো তাড়াতাড়ি নিজের মাকে ভূলে যেতে পারে? অধরা প্রশ্ন করতে চাইলো কিন্তু পারলো না। জুবায়ের ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিলো নিজের সঙ্গে। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলো,
> আমাদের ঘরে খুব তাড়াতাড়ি এক টুকরো রত্ন আসতে চলেছে। আমি ওকে কহিনুর বলে ডাকবো। তুমি কি কিছুই বুঝতে পারছো না? এতো আয়োজন শুধু ওর জন্য।
অধরা চোখ বন্ধ করে কিছু ভাবলো। বিষয়টা সুখের কি দুখের ওর ঠিক মাথায় আসছে না। যেখানে ও মা হয়ে নিজের সন্তানের উপস্থিতি অনুভব করতে পরলো না সেখানে জুবায়ের বাবা হয়ে কিভাবে সব বুঝে গেলো? আর শাশুড়ি মা সেও কিভাবে জানলো? এই গোলক ধাঁধা কিভাবে কাঁটবে কে জানে। জুবায়ের আধা ঘন্টার মধ্যে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো। অধরা সাবধানে উঠে বললো। শাশুড়ির আলমারিটা চেক কার দরকার। কি আছে সেখানে? অধরা সাবধানে উঠে আসলো।পা টিপে টিপে শাশুড়ির রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। সারা বাড়িটা শুনশান নিরব। অধরা সময় নষ্ট করলো না দ্রুত ভেতরে গিয়ে ড্রয়ার চেক করলো। লাল রঙের একটা কাপড়ের মধ্যে কিছু রাখা আছে ও সেটা তুলে নিয়ে দ্রুত নিজের রুমে ফিরে আসলো। সেটা লুকিয়ে জুবায়েরের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো। জুবায়ের ঘুমের মধ্যে পাশ ঘুরে অধরাকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
> পালানোর চেষ্টা করছো বুঝি? এসব করে সময় নষ্ট করোনা। সময় হলে ঠিক মুক্তি পাবে।
অধরার ঢোক গিলল। মনে প্রশ্ন জাগলো জুবায়ের কি সব জেনে গেল?
#কহিনুর
কলমে : লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:১
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।