#কাঁচের_চুড়ি
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -২
ফুফুর কথায় আমি হতভম্ব হয়ে গেছি৷ মা দূরে দাঁড়িয়ে চুপচাপ সবকিছু শুনছে । হয়তো চোখের কোণে অশ্রুকণা জমেছে। আব্বা কিছু বলছে না গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
” বাবা তুই এর বিচার কর। মেয়েটার নতুন শাড়িটা কে এমন করলো! আল্লাহ গো!”
“আম্মা ছোটর শাড়ি কে ছিঁড়েছে তা দেখিনি আমি। না দেখে কিছু বলতে পারবো না। আপাতত এসব বাদ দেন। সকালে দেখা যাবে। ”
কথাগুলো বলে আব্বা হনহন করে নিজের রুমে চলে গেলেন। ফুফু তখনও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে । দাদি বিলাপ করতে করতে ঘরে চলে গেলেন, আমিও নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিলাম৷ এসব অশান্তি একদম ভালো লাগে না আমার। নতুন করে এ কেমন ঝামেলা শুরু হলো আল্লাহ জানে! মা কখনো এমন কাজ করবেন না, এতটুকু আমি নিশ্চিত। তাহলে শাড়িটা ছিঁড়ল কে?
রাতে খাওয়া শেষ করে বিছানায় আসলাম মাত্র। কিন্তু ঘুম আসছে না। খাওয়ার সময় কেউ কোন কথা বলেনি, ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত লেগেছে। এক হাত দিয়ে কপাল চেপে ধরলাম৷ এই শাড়ির চিন্তা করে আমার কোন লাভ নেই, আমাকে যেভাবেই হোক মা’য়ের জন্য ঈদের উপহার কিনতে হবে। খুব সুন্দর দেখতে একটা শাড়ি কিনে দিবো আর একটা মেহেদী। মা মেহেদী লাগাতে খুব পছন্দ করে। কিন্তু টাকা কোথায় পাবো? বাড়ি থেকে হাত ধরচের জন্য খুব বেশি টাকা দেয় না , কোন টাকা জমানোও নেই আমার কাছে। আর আব্বুর কাছে টাকা চাওয়ার কোন মানে হয় না। আমি নিজের রোজগারের টাকায় মা’কে উপহার দিবো।
নানান কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি নিজেও জানি না। মা’য়ের ডাকে ঘুম ভেঙে দেখি সেহেরির সময় হয়ে গেছে। তড়িঘড়ি করে উঠে গেলাম। হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসলাম। সবাই একসাথে বসে খাচ্ছে।
” বাবা মেয়েটার শাড়ির ব্যাপারে কিছু বললে না তো?”
“সকাল পর্যন্ত বেঁচে থাকলে কাল সকালে দেখবো। আপাতত খাওয়া শেষ করি। ”
দাদি কিছু বললেন না, ফুফুও চুপচাপ খাচ্ছে। মা কার কি লাগবে না লাগবে সেদিকে খেয়াল রাখছে। আমি মা’য়ের পাশে বসে খাচ্ছি।
” মা সবকিছু টেবিলে রাখা আছে। কারো কিছু দরকার হলে সে নিজেই নিতে পারবে। তুমি খাওয়া শেষ করো তো!”
মা মুচকি হাসলেন। হয়তো তাঁর ছেলে বড় হয়ে গেছে এই আনন্দে। আজ-কাল ফজরের নামাজ পরে আমাদের বাড়িটা কেমন নিস্তব্ধ হয়ে যায়। সবাই ঘুমিয়ে থাকে। শুধু আমি কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্যারের বাড়িতে যাই। স্যারের কাছে পড়বো বলে কয়েকজন মিলে ব্যাচ করে নিয়েছি । ব্যাচে পড়লে কম টাকা লাগে।
রোজকার মতো আজও সাইকেল নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছি। হেঁটে গেলে আমাদের বাড়ি থেকে স্যারের বাড়ি যেতে ঘন্টা খানেক সময় লাগে৷ সাইকেল আছে বলে যাতায়াতে তেমন সমস্যা হয় না আমার। স্যারের বাড়িতে গিয়ে দেখলাম, কেউ এসে পৌঁছায়নি। অগত্যা একা একা বসে রইলাম। সকলের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া অন্য উপায় নেই আমার। সবাই না আসলে স্যার পড়ানো শুরু করে না। সহপাঠীদের বাড়ি স্যারের বাড়ি আশেপাশেই, তবুও তাঁরা প্রতিদিন দেরি করে আসে। কথায় বলে না স্টেশনের কাছের লোকরা ট্রেন ফেল করে অনেকটা তেমন। আমরা যেখানে পড়ি তাঁর পাশে কিছু জিনিসপত্র সাজিয়ে রাখা। এগুলো আগে পরে চোখে পড়েনি। আজই প্রথম দেখলাম। মিনিট পাঁচেক পর একটা লোক এসে জিনিসগুলো ব্যাগে ভরতে লাগলেন। আমাকে দেখে মুচকি হেসে বললেন,
” পাশের রুমটা ভাড়া নিয়েছি গতকাল থেকে। এসব আমার জিনিসপত্র, কাল রাতে এসেছি, সবকিছু গুছিয়ে উঠতে পারিনি বলে এখানে রেখেছিলাম। তোমার কোন অসুবিধা হবে না তো?”
” না, আমার কোন অসুবিধা নেই৷ ”
” তা বাবা তোমাকে তো কাল রাতে দেখলাম না। কোথায় ছিলে?”
” রাতে এখানে দেখা পাবেন না আমার, আমি এখানে থাকি না। স্যারের কাছে পড়তে এসেছি। রোজ সকালবেলা আসি, ঘন্টা দুয়েক পড়ে বাড়িতে ফিরে যাই। ”
” তা বেশ! তা বেশ! তা বাবা একটা কথা বলবো তোমাকে?”
” জ্বি বলুন। ”
” তোমার জানাশোনা এমন লোক আছে যে এই আশেপাশের চার পাঁচ এলাকা খুব ভালো করে চেনে, জানে?”
” তা আছ কয়েকজন, আপনার কি দরকাবে লাগবে এমন মানুষ? ”
” আসলে আমার একটা ব্যবসা আছে, সেসব খাবার ডেলিভারির জন্য লোক লাগবে। যেহেতু খাবারের ব্যাপার তাই চেনা-জানা লোক থাকবে। ”
” কিসের ব্যবসা আপনার? আর খাবারের ব্যবসা বলে চেনা-জানা লোক কেন লাগবে?”
” বেশ প্রশ্ন করো তো তুমি! জানার আগ্রহ আছে। ওই নিজে রান্না করে লোকের বাড়িতে খাবার পৌঁছে দিই। রান্না করা খাবার কি বেশি সময় ভালো থাকে বলো? সকালে রান্না করলে রাত হতে হতে বাসি হয়ে যায়। তাই একটু তাড়াতাড়ি করেই সবার কাছে পৌঁছে দিতে হয়। আজ-কাল একা পেরে উঠছি না। তাছাড়া এলাকায় নতুন, সবকিছু চিনিও না। তাই তোমাকে বললাম। এলাকা চেনা থাকলে দূত যাওয়া যায়। না হলে ঠিকানা খুঁজতে খুঁজতেই দিন শেষ। ”
কয়েক মুহুর্তের জন্য চোখ দু’টো জ্বলজ্বল করে উঠলো আমার। এই কাজটা করলেই তো টাকার ব্যবস্থা হয়ে যায়। এখানেই কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে আমার।
” আপনার হয়ে কাজ করলে কত টাকা বেতন দিবেন?”
” সঠিকভাবে একটা ডেলিভারি দিতে পারলে তিরিশ টাকা। আছে নাকি এমন লোক? ”
পারিশ্রমিকের পরিমাণ শুনে মনটা একটু খারাপ হলে গেলো। তবে কাজটা হাতছাড়া করতে চাই না। আমি পড়াশোনা বাদ দিয়ে এসব কাজ করে বেড়াচ্ছি জানলে মা -বাবা কেউই আমাকে আস্ত রাখবে না।
” দিনে কয়টা ডেলিভারি দিতে হয় কাকা?”
” এই দুই-চারটা। ”
হিসাব করে দেখলাম, একদিনে দুইটা ডেলিভারি দিতে পারলে মোট ৬০ টাকা পাবো। ঈদের এখনও ১৫ দিন বাকি। তাহলে মাস শেষে দাঁড়ালো ৯০০ টাকা। টাকার পরিমাণ খুব বেশি না হলেও এটা দিয়ে একটা শাড়ি কেনা যাবে। আর শাড়ি কিনতে না পারলে একটা থ্রি-পিস কিনে দিবো। আর কিছু চিন্তা করলাম না। বলেলেই দিলাম কাজটা আমি করতে চাই।
” তা বাবা এলাকাটা তোমার কেমন চেনা? ”
” হাতের তালুর মতো। ”
” এইতো সাবাস! তাহলে আজ থেকে কাজে লেগে পড়ো। দুইটা কেক ডেলিভারি দিতে হবে। আমি ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি। ”
আমি কিছু বলবো তার আগে স্যার চলে এলো। পড়া শেষ করে উনার সাথে দেখা করবো এটা বলে উনাকে আস্বস্ত করলাম।
পড়া শেষ হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। সকালের লোকটার কোন পাত্তা নেই। কোথায় আছে কে জানে! কিছু সময় দাঁড়ানোর পর হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলেন তিনি।
” যাক বাঁচা গেলো। আমি ভাবলাম তুমি চলে গিয়েছো! তা কি নাম তোমার?”
“বাদশা। ”
” আচ্ছা ভালো কথা। এই নাও, এখানে দুইটা কেক আছে। এই ঠিকানায় ডেলিভারি দিয়ে দিবে। তোমার মোবাইল আছে নাকি?”
” না তবে বাড়িতে আছে। আপনার নম্বরটা দিন। আমি বাড়ি গিয়ে কল দিবো আপনাকে। ”
” এই বয়সে তোমাকে এখনও মোবাইল দেয়নি?”
” মা’য়ের সন্দেহ হয় আমি মোবাইলে আসক্ত হয়ে যাবো, তাই দেয় না। মা’য়ের মোবাইল আছে, ওইটা দিয়েই কাজ চালাই। ”
” তা বেশ ভালো করেছেন, আজ-কাল ছেলে-মেয়েরা মোবাইল মোবাইল করে পড়াশোনা থেকে মন উঠিয়ে নিচ্ছে। ”
উনার থেকে ব্যাগ দুইটা আর ঠিকানা লেখা কাগজটা নিয়ে রওনা দিলাম। উনি জানালেন কাজ শেষ হলে টাকা দিবেন। দুইটা জায়গাই আমার চেনা ছিল। তাই ডেলিভারিতে কোন সমস্যা হলো না। বাড়িতে আসার পথে বলে তেমন সময়ও লাগেনি।
কাজ শেষ করে আস্তে আস্তে সাইকেল চালাচ্ছি। বাড়িতে ফেরার তেমন তাড়া নেই। কেমন নাটকীয় ভাবে কাজটা পেয়ে গেলাম আমি। এখনও মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি। কখনো ভাবিনি ডেলিভারি ম্যানের কাজ করবো। কোন কাজকেই আমি ছোট বলে মনে করি না। সৎ ভাবে সামান্য কিছু ইনকাম করাও সম্মানের। কত লোক অল্প কিছু টাকা রোজগারের আশায় সারাদিন কাজ করে। সত্যিই আমাদের কাছে যা তুচ্ছ কোন মানুষের কাছে হয়তো সেটাই স্বপ্ন।
বাড়িতে ফিরে দেখলাম ফুফু আর দাদি সোফায় বসে আছে। বাবা ওঁদের সামনে একটা চেয়ারে। মা’কে আশেপাশে কোথাও দেখতে পারলাম না।
“আচ্ছা ছোট তুই কখন দেখলি শাড়ি ছিঁড়ে গেছে?”
” যখন তোমাদের কাছে নিয়ে এসেছিলাম তখন। দেখেই দৌড়ে এসেছি। ”
” শাড়ি কোথায় রেখেছিলে?”
” বিছানার পাশে। ”
দাদির চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে উনি প্রচন্ড বিরক্ত। এ-সব প্রশ্ন উত্তর উনার ভালো লাগছে না। বিরক্ত গলায় বললেন, ” মেয়েটাকে এভাবে প্রশ্ন না করে তোর বউকে কয়েক ঘা লাগিয়ে দিলেই সব কথা বের হয়ে যায়। ”
” যদি সত্যি বাদশার মা কিছু করে তাহলে নিশ্চয়ই আপনার মনের ইচ্ছে পূরণ করবো আম্মা। তবে আপনার মেয়ের যেন আপনার মতো শাশুড়ি না হয়!”
দাদি কেমন যেন চুপসে গেলেন। দরজার কাছে একটা বাচ্চা মেয়ের গলা শোনা যাচ্ছে। আমার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে বাড়ির ভিতর আসছে। মেয়েটা পাশের বাড়ির তিন্নি। সবে ছয় বছর বয়স ও-র। আমার সাথে খুব ভাব। আমি বাড়ি থাকলে প্রায়ই আসে। এছাড়া বাড়ির সবাইও ওঁকে খুব ভালোবাসে। কি সুন্দর পাকা পাকা কথা বলে। একদম খই ফোটে ওর মুখে।
তিন্নি বাড়িতে এসে প্রথমে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর ফুফুর দিকে তাকিয়ে বললো, ” ফুপি, তোমার শাড়ি সেলাই করেছো?”
ফুফু ওর কথায় চমকে উঠলো। ভীতু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, কোন শাড়ি? ”
তিন্নি দৌড়ে গিয়ে ফুফুর কোলের উপর রাখা শাড়িটা হাতে নিয়ে বললো, ” আরে এইটা, কাল বিকালে আমাদের বাড়ি শাড়ি পরে গেছিলে না তুমি। বললে যে তোমার ঈদের জামদানী। তখনই তো ঘরের লোহায় বেঁধে শাড়ি ছিঁড়ে গেলো। ”
ফুফুর চোখেমুখে ভয় ছেয়ে গেছে, দাদিও হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। তিন্নি নিজের মতো কথা বলে যাচ্ছে। আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললো, ” জানো ভাইয়া শাড়ি ছিঁড়ে গেলে ফুপি কাঁদছিলো। একদম আমার মতো করে। ”
শাড়ির ব্যাপারটা একদম পরিষ্কার হয়ে গেছে তিন্নির কথায়৷ বাবা ফুফুকে সজোরে একটা থাপ্পড় মারলেন৷ ফুফু কিছুটা পিছিয়ে গেলো। তারপর কড়া গলায় বললেন, ” নিজের দোষ অন্যের উপর চাপাতে লজ্জা করে না তোর? শাড়িটা তুই ছিঁড়েছিস যখন তাহলে কেন অন্যদের উপর দোষ চাপাতে চাস?”
কিছু কিছু না বলে গালে হাত দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘরে চলে গেলো, সেই সাথে দাদিও। ভেবেছিলাম ঘটনা এই পর্যন্ত শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু না, মাগরিবের আজান দিতে মিনিট পাঁচেক বাকি এমন সময় জানতে পারলাম তিন্নিকে কেউ খু’ন করেছে। আমি দৌড়ে ওঁদের বাড়িতে গেলাম৷ একটা কাপড়ের উপর নিষ্পাপ বাচ্চা নিথর হয়ে পড়ে আছে। চোখে মুখে সারা শরীরে আঁচড়ের দাগ। হয়তো কেউ অনেক কষ্ট দিয়ে মে’রে’ছে ওকে!
চলবে