#কাঁচের_চুড়ি
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৯
সত্যিই কি আমি তিন্নির খু*নিকে খুঁজে বের করতে পারবো না? পুলিশ যেভাবে এগোচ্ছে তাতে তিন্নির কে*স সমাধান হতে অনেক সময় লাগবে। তাছাড়া প্রতিদিন এমন হাজার হাজার ঘটনা ঘটে, কোনটা রেখে কোনটা সমাধান করবে! সময় তো লাগবেই। কিন্তু আমি কি করলাম? নিজের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করেছি, কিন্তু দিন শেষে ব্যর্থ হলাম আমি। যদিও সিরাজুল ধরা পড়েছে, তাঁর অপরাধ স্বীকার করেছে। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য সিরাজুলকে ধরিয়ে দেওয়া নয়। বরং আমি তিন্নির খু*নিকে শাস্তি দিতে চেয়েছি। তবে কি এতোদিনের পরিশ্রম এভাবে নষ্ট হয়ে যাবে!
চোখ বন্ধ করে সোফায় হেলান দিয়ে রইলাম। কিছু সময় পর মনে হলো এখনও খু*নিকে খুঁজে বের করা সম্ভব। আমাকে বসে থাকলে হবে না। বিকেলের দিকে ইফতার বিলি করতে যেতে হবে, তাই দুপুরের আগেই সব কাজ সারতে হবে। যেখানে তিন্নির লা’শ পড়ে ছিলো সেই জায়গাটা আবার দেখতে হবে।
এক দৌড়ে তিন্নিদের বাড়িতে চলে গেলাম। এ-সময় ওঁদের বাড়িতে কাকি মা ছাড়া অন্য কেউ থাকে না, কিন্তু আজ নতুন আপু উঠানের এক কোণে বসে কাঁথা সেলাই করছে। আমাকে দেখে বলে উঠলো,
” কাঁথা এখনও শেষ হয়নি। সেলাই করা শেষ হলে দিয়ে আসবো। ”
” আমি কাঁথা নিতে আসিনি। কাকি মা কোথায়?”
” খালা সকালে খালুর সাথে ক্ষেতে গেছে। কিছু লাগলে আমাকে বলতে পারেন। ”
” সমস্যা নেই, আমি পুকুর পাড়ে যাবো। একটু কাজ আছে। ”
” আচ্ছা ঠিক আছে। ”
কথা শেষ করে পুকুরের ওপাশে চলে গেলাম। পুলিশ খুব ভালো ভাবে সার্চ করেছে এখানে, তেমন কিছু পায়নি। মনে হয় না এখানে কিছু পাবো, তবুও নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়া। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কিছু পেলাম না। আগেরবার মাঠের পাশে বড় গাছটার নিচে চুড়ির টুকরোগুলো পেয়ে ছিলাম। জায়গাটা এখান থেকে বেশ দূরে, সেখানে গেলে কিছু পেলেও পেতে পারি।
গাছের গোড়ায় বা তার আশপাশে তেমন কিছু নেই, বেশ খানিকটা দূরে কিছু একটা রোদের আলোয় জ্বলজ্বল করেছে। সেদিকে এগিয়ে গেলাম, খুব কাজের জিনিস পেয়েছি মনে হয়। পাতার নিচে চাপা পড়ে ছিলো জিনিসটা, সামান্য অংশের উপর রোদ পড়েছে, তাতেই জ্বলজ্বল করছে। সত্য সূর্যের আলোর মতো হাজারও মেঘ চাপা দিয়ে তাকে আড়াল করা যায় না। পড়ে জিনিসটা হাতে নিয়ে মুচকি দিলাম।
আমার কাজ শেষ এখানে বাড়িতে ফিরে মানিকের বাবাকে কল দিলাম।
” আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল। ”
” ওয়ালাইকুম আসসালাম বাবা, কোন সমস্যা হয়েছে নাকি?”
” না কোন সমস্যা হয়নি, তবে একটা অনুরোধ ছিলো। ”
” হ্যাঁ, বলো। ”
” সিরাজুলসহ সকলকে নিয়ে একসাথে বসতে চাই। মনে হচ্ছে আমি কে*সটা সমাধান করে ফেলেছি। ”
” কি বলো! আচ্ছা দেখছি কি করা যায়। তবে সিরাজুল এখন বাইরে যেতে পারবে না। তোমাকেই সবাইকে নিয়ে থানায় আসতে হবে। ”
” আচ্ছা আমি ব্যবস্থা করছি। ”
” ঠিক আছে, তাহলে ইফতারে পরপরই চলে এসো। আমি স্যারকে বলে সবকিছু ব্যবস্থা করছি। ”
মোবাইলটা রেখে মা’য়ের কাছে চলে গেলাম৷ মা তখন ঘরে শুয়ে আছে।
” মা ভিতরে আসবো?”
” হ্যাঁ, আয়। কিছু বলবি?”
” না তেমন কিছু বলবো না। তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছিলো। ”
” পা”গ”ল ছেলে আমার!”
মা’য়ের পাশে গিয়ে বসলাম। কিন্তু কিছু বলার আগে ফুফু ডাক দিলেন। বিরক্ত চোখে মা’য়ের দিকে তাকালাম।
” গিয়ে শুনে আয় কি বলে, তাছাড়া তেমন কিছু তো বলবি না আমাকে। হয়তো কোন গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে ডেকেছে। ”
” আচ্ছা ঠিক আছে। যাচ্ছি আমি। ”
ঘরে গিয়ে দেখলাম ফুফু বসে বসে কাঁদছে। চোখমুখ ফুলে গেছে একদম।
” কিছু বলবেন আমাকে?”
” হ্যাঁ, অনেককিছু বলবো। তবে তোর কথা দিতে হবে এসবের কিছু ভাইয়াকে বলবি না কখনো । এমনকি বাড়ির কাউকেও বলবি না। ”
” কি এমন কথা যে কাউকে বলতে পারবো না?”
” বলছি।”
সন্ধ্যে নেমেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে, আমি আর তিন্নির মা-বাবা অটোরিকশায় বসে আছি। বিকেলে উনাদের সাথে অনেক কথা বলেছি। আজ সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
রাত আটটা নাগাদ থা”নায় পৌঁছালাম। মানিকের বাবাসহ অনেকে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে, সিরাজুল গা*র*দের ভিতরে আছে। মানিকের বাবা আমাকে দেখে বললেন, ” এইতো চলে এসেছ। সময় নষ্ট না করে কাজের কথা বলো। ”
” জ্বি চলুন। ”
সকলে অপেক্ষা করছে, তাই পরিচয় পর্বে সময় নষ্ট করলাম না। সিরাজুলকে একটা আংটি দেখিয়ে বললাম, ” এইটা কার আংটি? ”
” আমার! এটা তুমি কোথায় পেয়েছ?”
” যেখানে তিন্নিকে খু*ন করা হয়েছে সেখানে। তাছাড়া আপনার বিছানার নিচে এই কাঁচের চুড়িটা পেয়েছি, এমন চুড়ির টুকরো তিন্নির লা”শের আশেপাশে ছিলো। ”
” এই ছেলে মন গড়া কথা বলবে না, বললাম তো আমি কাউকে খু”ন করিনি। ”
” মিথ্যা কথা বলবে না একদম। কি প্রমাণ আছে তোমার কাছে? ”
” এই আংটিটা ভালো করে পরীক্ষা করলেই বোঝা যাবে আপনি কতটা সত্যি বলছেন। তাছাড়া আপনার হাতের কাটা জায়গটা কেমন আছে এখন?”
” কিসের কাটা জায়গা? ”
” চুড়ি ঢুকে হাত কেটে গেছিলো, ভুলে গেছেন নাকি?”
” মিথ্যা বলবে না, আমার হাতে কোথাও জ*খ*ম হয়নি। ”
” হাবিলদার সাহেব উনার ডান হাতটা একটু দেখুন তো। কবজির নিচে চুড়ি ঢুকে গেছিলো। ”
হাবিলদার সাহেব সিরাজুলের হাত চেক করলেন, সত্যি কবজির নিচের জায়গাটা কাটা, এখনও বেশ কাঁচা রয়েছে। সকলে সিরাজুলের দিকে কড়া চোখে তাকালো।
” তুমি কি করে জানলে উনার হাত চুড়িতে কেটে গেছে? ”
“ফুফু বলেছে। ”
” কি বলেছে তোমার ফুফু?”
জসিম কাকার প্রশ্নে উনার দিকে তাকালাম। শান্ত গলায় বললাম,” তাহলে প্রথম থেকেই বলতে হবে। ”
আজ দুপুরে,
আমাকে ফুফু ডেকে নিয়ে গেছিলো,
” সিরাজুলকে আমি পছন্দ করতাম। যেদিন উনি প্রথম তিন্নিদের বাড়িতে এসেছিলেন সেদিন আমিও তিন্নিদের বাড়িতে ছিলাম। প্রথম দেখায় উনাকে ভালো লেগে যায় আমার। তারপর থেকে ওঁদের বাড়িতে যাতায়াত বাড়িয়ে দিই।”
” ওহ আচ্ছা, এখন বুঝতে পারলাম কেন আপনি ঈদের শাড়ি ঈদের আগেই পরেছিলেন। যাইহোক তারপর?”
” যেদিন তিন্নি মা*রা গেলো, সেদিন উনার নম্বর নিয়েছি, ফেজবুকে এড হয়েছি, মানে সেদিন থেকে কথা বলা শুরু করেছি। আমিই উনাকে ওই চুড়ির টুকরোগুলোর ব্যাপারে বলেছিলাম, তুই আমাকে সন্দেহ করিস তাও জানিয়েছিলাম। আমার থেকে এসব কথা জানার পর সে বেশ ঘাবড়ে যায়। তোর সাথে আমার সম্পর্ক কেমন জানতে চায়। আমি বলেছিলাম যে আগে খুব ভালো সম্পর্ক ছিলো, এখন তেমন ভালো না। তখন উনি আমাকে বুদ্ধি দিলো চুড়ির টুকরোগুলো নষ্ট করে দেওয়ার জন্য। ওগুলোর জন্য নাকি আমি ফেঁসে যেতে পারি। আমিও বলদের মতো উনার কথা বিশ্বাস করে নিলাম। তারপরের ঘটনা তো তুই জানিসই।”
” আপনি যখন কিছু করেননি তাহলে কেন ওগুলো নষ্ট করতে গেলেন? কত শক্ত প্রমাণ ছিলো। চুড়িতে র*ক্তও লেগে ছিলো! ”
” জানিস বাদশা, সিরাজুলের ডানহাতের কবজির নিচে কে”টে গেছে, কিছু ফুটে গেলে যেমন গর্ত হয় তেমন। ”
” আপনি কি করে জানলেন?”
” আগেরদিন দেখা হয়েছিল তখন দেখেছিলাম, আমাকে দেখে সিরাজুল ক্ষ*তটা লুকিয়ে ফেলেছিল। ”
” এসব ছাড়া অন্য কিছু জানেন?”
” হ্যাঁ হ্যাঁ, তুই যে কানের দূলের কথা বলেছিলি না? ওই যে তিন্নির কানের দূল?”
” হুম, মনে আছে। সিরাজুলের কাছেও দেখেছিলাম। ”
” ঠিক, ওইটা আমাকে সিরাজুল দিয়েছিল, একটা দিয়ে বলে ছিলো যত্ন করে রাখতে বিয়ে হলে অন্যটা দিবে তখন কানে দিবো। ”
” আমি না হয় বিশ্বাস করলাম কিন্তু এসব কথার তো প্রমাণ নেই। প্রমাণ ছাড়া অন্যকেউ এসব বিশ্বাস করবে না। ”
” আমার কাছে চুড়ির ব্যাপারে প্রমাণ আছে। এসব কথা ম্যাসেন্জারে বলেছি। দাঁড়া তোকে দেখাচ্ছি। ”
ফুফু আমাকে সবকিছু দেখালো। তারপর থেকে আমি নিশ্চিত এই সিরাজুল খু*ন করেছে তিন্নিকে। কিন্তু খু*নের কারণটা জানতাম না। তাই বিকালে কাকি মা’র কাছে গেছিলাম।
বিকেলে,
” আসসালামু আলাইকুম কাকিমা। ”
” ওয়ালাইকুম আসসালাম, কিছু বলবে তুমি? ”
” কাকি মা, আপনাদের সোনা গহনা, টাকা-পয়সা কোথায় থাকে? ”
” কেন? আলমারিতে থাকে। ”
” একটু গিয়ে দেখেন তো সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা!”
” ঠিক থাকবে না কেন? ”
” আগে গিয়ে তো দেখেন। ”
কাকিমা সেদিন কোন গহনা খুঁজে পায়নি। এরপর দুইয়ে দুইয়ে চার বানিয়ে ফেললাম, এই সিরাজুলকে চুরি করতে দেখে নিয়েছিল তিন্নি, সেজন্য ওকে মে*রে ফেলেছে।
আমার কথায় সিরাজুল হা হা করে হে হে উঠলো। হাসতে হাসতে বললো, ” পুচকে ছেলে বেশ গোয়েন্দা হয়েছিস দেখি। তবে খুনের কারণ তুই ধরতে পারিসনি। আমার একটা নতুন কবর দরকার ছিলো ড্রা*গ*স রাখার জন্য তাই ওঁকে খু*ন করেছি। হা হা হা। ”
” আপনি তাহলে নিজের দোষ স্বীকার করে নিলেন? যাইহোক ধন্যবাদ। ”
সিরাজুল হকচকিয়ে গেলো। ভুলে এসব কি বলে ফেলেছে সে! পুলিশের একজন সিরাজুলের কাছে সবকিছু জিজ্ঞাসা করলো। কিছু সময় চুপ থাকার পর যখন দেখলো না বলে কোন উপায় নেই তখন সব ঘটনা বলতে আরম্ভ করলো।
” আমি এ শহরে এসেছি কয়েকটা বড় ডিল নিয়ে, বিদেশ থেকে মাল আসবে। তিন্নির মা’কে বেশ আগে থেকেই চিনতাম, ওঁদের ভালোমানুষি সম্পর্কে বেশ ধারণা ছিলো আমার। কিন্তু এখানে ওঁদের থাকার পরিবেশ কেমন তা জানা ছিলো না। সবকিছুর খোঁজ নিতে ওঁদের বাড়িতে এলাম। খোঁজ নেওয়ার পর দেখলাম এর থেকে ভালো আস্তানা আর হতে পারে না। এলাকার কারো সাথে জসিমের বিরোধ নেই, ফলে কেউ সহজে আমাকে সন্দেহ করবে না। শপিং মলের বাহানা দিয়ে ওঁদের বাড়িতে থাকতে শুরু করলাম। এরপর বেশ কিছু মালামাল আদান-প্রদান করেছি। কিন্তু কামনা আমাকে পেয়ে বসলো। সেদিন রাতে তিন্নি আর ও-র মা ঘুমিয়ে ছিলো, তিন্নির মা’য়ের শরীরের হাত দিতে গেলে ওই মেয়েটা দেখে ফেললো। পরেরদিন আবার ড্রা*গ*স লুকাতে দেখে ফেললো, এমনকি চুরি করতেও দেখে নিয়ে ছিলো । তাই ওকে সরানোর খুব দরকার ছিলো আমার। মনে মনে ভাবলাম কেন না ওর ক*ব*র*টাকে গুদাম বানিয়ে নিই। এরপর সুযোগ বুঝে ওঁকে মে*রে ফেললাম।
চলবে