কুঁড়েঘর ২ পর্ব -৪১ ও শেষ

#কুঁড়েঘর
#লেখিকা–মার্জিয়া রহমান হিমা
[ দ্বিতীয় পরিচ্ছদ ]
। পর্ব ৪১।

অনেক ভাবনা চিন্তার পর দুই পরিবার রিধিশা আর নিশাদের বিয়ে’টা মেনে নেয়। হৃদ মানতে না চাইলেও জোড় করেই মানানো হয়েছে তাকে। নিশাদের মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ হলেই দুজনের অনুষ্ঠানিক ভাবে বিয়ে দেওয়া হবে আবার।

নিশাদ রিধিশার পাশে বসে পাবজি খেলছিলো। রিধিশা বারবার নিশাদের দিকে তাকাচ্ছে কিন্তু নিশাদের খেয়াল নেই। রিধিশা এবার বিরক্ত গলায় বললো
” অফিস নেই আপনার? এখানে বসে গেইম না খেলে অফিসে যান না!” নিশাদ মুখ তুলে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো
” তোমার সমস্যা কি? আমার যা ইচ্ছে তাই করবো আমি। গতকাল মাত্র বিয়ে করলাম আজই অফিসে চলে যাবো?”

রিধিশা রেগে বললো
” তো কি করবেন আপনি? এখানে কি বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে নাকি যে অফিসের কাজকর্ম রেখে বসে থাকবেন?”
” তো চলে যাওয়ার মতোও পরিস্থিতি না এখন, ওকে?
একে তো তুমি অসুস্থ তার উপর ভেতরে যে গবেষণায় বসেছে কতোক্ষণ হলো কোনো খবর নেই! এখন যদি ভেতরে তোমার ভাই বিয়ে না মানার বদলে খুনাখুনি করে বসে তখন কে দেখবে?”

রিধিশা চোখ বড় বড় করে রাগি গলায় বললো
“এই আপনার সমস্যা কি? আমার ভাইয়া আসার পর থেকে আপনি ওর পেছনে পড়ে আছেন কেনো? আমার ভাইয়া খুনাখুনি করবে কোন দোষে?”
নিশাদ হাই তুলে বললো
” করতেই পারে। আমার সাথে তো দু দণ্ড ভালো করে কথা বললো না।” রিধিশা ভেংচি কাটে। ঠুসঠাস করে দরজা খুলে জোতি, রেহান, সূর্য, সাদি ঢুকে গেলো।

জোতি খুশিতে আত্মহারা হয়ে বললো
” রিধি! তোমাদের বিয়ে সবাই মেনে নিয়েছে। আর তোদের বিয়ে হবে আবার।” রিধিশা চমকে যায়
” আবার বিয়ে মানে?” রেহান হেসে বললো
” নিশাদের মাস্টার্স শেষ হলে তোমাদের বিয়ের প্রোগ্রাম করবে।” রিধিশা নিশাদের দিকে তাকিয়ে বললো
” প্রোগ্রামের কি দরকার? বিয়ে তো হয়েই গিয়েছে।”

জোতি চোখ বড় বড় করে বললো
” প্রোগ্রামের দরকার নেই মানে? তোর বিয়েতে নাচ,গান করবো না? বরযাত্রী যাবো না নাকি? আমার বোন+বান্ধুবির বিয়ে আনন্দ করবো না?”
সাদি সায় দিয়ে বললো
” হ্যা! আমরাও তো অধীর আগ্রহে বসে আছি। আমাদের বিষাদ ভাইয়ের বিয়ের জন্য। প্রোগ্রাম তো হতেই হবে নাকি ভাবি ডাকবো না।” সূর্য হাসতে হাসতে বললো
” তোর ভাবি ডাক শোনার জন্য কেউ বসে নেই। আমরা আছি ভাবি ডাকার জন্য। কিন্তু বিয়ের প্রোগ্রাম হবেই।”

নিশাদ কলার ঠিক করতে করতে গলা ঝেড়ে বললো
” সব আমার বাবার জন্য বুঝলি! কতো সহজে বিষয়টা হেন্ডেল করে নিয়েছে।” জোতি দাঁত কেলিয়ে বললো
” রিধির বাবারও রয়েছে! আংকেল এর বন্ধুর বড় ভাই আপনার বাবা।” নিশাদ অবাক হয়ে যায়। মুখ ভোতা করে নেয়। রিধিশা ঠোঁট চেপে হাসে।

.
সাজেদা বেগম নিজের পরিবারের মতো দেখা শোনা করছে দুই পরিবারের। রিধিশাকে বেশিই আপন করে নিয়েছিলো সাজেদা আন্টি। দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর্ব তাদের বাড়িতেই শেষ করে।
হৃদ নিশাদদের সাথে বাইরে থেকে হেটে এসে বোনের
কাছে বসে। রিধিশা প্রায় ঘুমিয়ে পড়ছিল বসে বসে থাকতে থাকতে। হৃদকে দেখে সোজা হয়ে বসে বিরক্ত হয়ে বললো
” উফফ ভাইয়া, আমার বসে থাকতে ভালো লাগছে না। বারবার ঘুম পাচ্ছে।”

হৃদ হেসে বললো
” আর কি করবি? হাটারও তো উপায় নেই। একটু পর বড় আম্মু আর আম্মু এসে তোর ব্যাগ গুছিয়ে দেবে। তুই আমাদের সাথে যাচ্ছিস। আমি ঢাকা ব্যাবসার জন্য থাকি তাই ফ্ল্যাট নিয়েছিলাম। সুস্থ হওয়া পর্যন্ত তুই আম্মু আর আমার সাথে থাকবি। আব্বু আর
আম্মু’কে বাড়িতে পাঠিয়ে দেবো।” রিধিশা আমতা আমতা করে বললো
” এখানেই থাকি না ভাইয়া! ছোট আম্মু নাহয় আমার সাথে থাকবে।”

হৃদ ভ্রু কুঁচকে বললো
” কেনো আমার সাথে গেলে কি সমস্যা?” রিধিশা হচকচিয়ে বললো
” না না তোমার সাথে যেতে সমস্যা হবে কেনো? আমার বলছিলাম কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না তাই আরকি।” হৃদ গম্ভীর গলায় বললো
” ইচ্ছে না করলেও যেতে হবে। রেস্ট কর আমি আসছি।” হৃদ রুম থেকে চলে যেতেই রিধিশা বিড়বিড় করে বললো
” কোন ঝামেলায় পড়বো আবার কে জানে! নিশাদ যদি যেতে না দেয় তাহলে ভাইয়া রাগ করে বসবে। আর ভাইয়া নিয়ে গেলে নিশাদ কি করবে কে জানে?”

কিছুক্ষণ পর নিশাদ আর তার বাবা আসে। রিধিশা তাকে দেখেই উঠে বসে চট করে। মৃণাল সাহেব বললো
” আরে মা উঠছো কেনো? তুমি শুয়ে থাকো। অসুস্থতার সময় কতো বার উঠবে না বসবে!” রিধিশা মাথা নিচু করে থাকে লজ্জায়। মৃণাল সাহেব হেসে বললো
” ছেলের বউ কে দেখা হয়ে গেলো এবার আমাকে চলে যেতে হবে।” রিধিশা মাথা তুলে বললো
” আজই চলে যাবেন? কয়েকদিন থাকুন!”

“না মা অনেক ব্যস্ততার মাঝে সময় করে এসেছি শুধু ছেলের জন্য। ছেলে যে পাগলামো করে বসে মাঝে মাঝে আমাকেই সামলাতে হয় নাহলে আর কে সামলাবে! আজকে চলে যাবো ব্যস্ততা কাটিয়ে উঠলে আবার আসবো নাহয় তোমার শাশুড়িকে নিয়ে।”
রিধিশা মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো। নিশাদ মৃণাল সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললো
” তোমাকে বলেছিলাম নিহান’কে নিয়ে আসতে।”

” আরে তোর ভাই কি বাড়িতে নাকি? হোস্টেল থেকে কিভাবে নিয়ে আসবো? তাও আবার রাতে সব জানতে পেরে ভোর রাতে রওনা দিয়েছিলাম আমি। আনার কোনো সুযোগই ছিলো না।”
মৃণাক সাহেব উঠে বললো
” চল বেরিয়ে যেতে হবে এখনই। রিধিশা মা, খেয়াল রাখবে নিজের। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাও পরের বার যেকোনো সময়ে আসলে যেনো তোমার হাতের রান্না খেতে পারি।” রিধিশা মিষ্টি হেসে সায় জানায়।
নিশাদ মৃণাল সাহেবকে নিয়ে বেরিয়ে যায়।

.
নিশাদ রেগে বসে আছে কারণ রিধিশাকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছে। হৃদ নাছোড় বান্দা বোনকে নিয়ে যাবে। তার কথা হলো একা এখানে তার বোনকে কে দেখবে? নিশাদ মুখের উপর না করে দিয়ে বসে আছে। রিধিশার বাবা, মা’রাও নিয়ে যেতে চাইছে। অনেক বোঝানোর পরেও নিশাদ রাজি হচ্ছে না। নিশাদ রিধিশাকে তার চোখের আড়াল হতে দেবে না আর যাই হোক।
নিশাদ গমগম স্বরে বললো
” রিধিশা কোথাও যাবে না। বিয়ে যখন করেছি বউ এর সেবাও একা করতে পারবো। তাও সমস্যা হলে মা’কে রেখে যেতে পারেন কিন্তু রিধিশাকে কোথাও যেতে দেবো না।” বলেই উঠে ধুপধাপ পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।

হৃদ বাবার উদ্দেশ্যে বললো
” দেখেছো কেমন নাছোড়বান্দা ছেলে? বড়দের কোথাও শুনছে না।” শফিক উদ্দিন গা ছাড়া ভাবে বললো
” নিশাদ কেমন ছেলে সব খবর নিয়েছি। বউকে একা ছাড়বে না এটাই আসল কথা। তুমিও বিয়ে করলে এমন করবে সমস্যা নেই। ছেলে জাতি’টাই নারীর টানে চলে। বউ প্রতি টান ভালোবাসা থাকলে স্বাভাবিক এসব।” হৃদ আড়চোখে বাবার দিকে তাকালো।
রিধিশার চিন্তায় চুপটি মেরে বসে ছিলো। বাবার কথা শুনে হাসি পায়।
লিমা বেগম আর সাদিয়া বেগমের শফিক উদ্দিনের উদ্দেশ্যে তাকানো দেখেই তিনি চুপ করে গেছেন।

শেষ পর্যন্ত ডিসিশন হয় লিমা বেগম রিধিশার সাথে থাকবে রিধিশা সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত। আর বাকিরা চলে যাবে। নিশাদ আবার আসতেই তাকে জানানো হয়। নিশাদ সস্তির নিশ্বাস ফেলে।

______________

ব্যস্ততার মাঝে দিনগুলো চোখে পলকে মিলিয়ে যায়। ১৫ দিন পেড়িয়ে গিয়েছে এর মাঝেই। রিধিশার এতোদিনে সুস্থ পুরোপুরি। পা কয়েকদিনেই ঠিক হয়ে গিয়েছিলো। ভাঙ্গা হাত ঠিক হতে অনেক দিন লেগেছে। নিশাদ রিধিশার ছুটি নিয়েছিলো অফিস থেকে। ১০ দিন পর থেকে রিধিশা অফিসে গিয়েছে। এক হাত দিয়েই কাজ করার চেষ্টা করেছে আগে কিন্তু এখন হাত ঠিক হয়ে গিয়েছে।
হৃদ দুদিন পর পর এসে দেখে যেতো রিধিশাকে। নিশাদের সাথে সম্পর্কটাও কিছুটা ভালো হয়েছে।
লিমা বেগমের সাথেও নিশাদ আর সূর্যদের সম্পর্ক গাড় হয়েছে। লিমা বেগম আর নিশাদ এখন মা ছেলের মতোই।

আজকে লিমা বেগম চলে যাচ্ছে। তৈরিও হয়ে বসে আছেন রিধিশা তাকে আটকে রেখেছে। যদিও হৃদ আসছে তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
লিমা বেগম রিধিশার মাথা হাত বুলিয়ে বললো
” নিশাদের সাথে ঝগড়া করবি না এতো। তোরা বেশিই ঝগড়া করিস। মিষ্টি মিষ্টি করে ভালোভাবে কথা বলবি। কিছু খেতে চাইলে রেঁধে দিবি। দুটো যেভাবে ঝগড়া করিস মাঝে মাঝে আমি ভয় পেয়ে যাই।”

রিধিশা ফিক করে হেসে দেয়। লিমা বেগম কড়া গলায় বললো
” হাসিস না, সত্যিই বলছি। তবে ছেলেটা কতো ভালো দেখেছিস! তোর সাথে ঝগড়া করে চলে যায় আবার একটু পর এসেই তোর খবর নেই। ঔষধ, খাবার খেয়েছিস কিনা। কতো যত্ন করে।”
” তুমি দেখি নিশাদের গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসেছো। এক কাজ করো নিশাদকে নিয়ে চলে যাও।”
“পারলে তো নিয়ে চলেই যেতাম।” দুজনের কথার মাঝে নিশাদ আর হৃদ আসে। হৃদ ঢুকেই বললো
” মা চলো!” রিধিশা অবাক হয়ে বললো
” চলো মানে কি? ভালো করে তো রুমেও ঢুকলে না। এখনই চলো বলছো!” হৃদ ব্যস্তার সাথে বললো
” বসার সময় নেই। একটু পর আবার আমার মিটিং রয়েছে একটা। সময়ের মধ্যে পৌঁছতে হবে।”

রিধিশা রেগে বললো
” তাহলে আজকে আসার দরকার কি ছিলো? কালকে আসলেই পারতে। এতোদূড় থেকে এসে একটু বসছোও না!” হৃদ এগিয়ে এসে রিধিশাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো
” রাগ করিস না। মিটিং টা কালকে ছিলো কিন্তু ক্লাইন্ট এর একটু সমস্যা হওয়ায় সকালে জানিয়েছে আজকেই হচ্ছে সেটা তাই এতো তাড়া। আমি তো আবার আসবোই। তুই বললেই চলে আসবো। ” হৃদ আর লিমা বেগম বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যেতেই রিধিশা নাক ফুলিয়ে কেঁদে দেয়।

নিশাদ রিধিশাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে। রিধিশা নিশাদের বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে থাকে। নিশাদ রিধিশাকে কান্না থামানোর জন্য সান্তনা দিতে থাকে। নিশাদের নিজেরও মন খারাপ লিমা বেগম চলে যাওয়ায়। রিধিশার কান্না কমার নাম গন্ধ দেখলো না। কাঁদতে কাঁদতে হিচকি উঠিয়ে ফেলেছে। নিশাদ এবার মুখ কুঁচকে বললো
” ইশশ! কি করলে বলো তো! কাঁদতে না করলাম না আমি? অফিসে যাবো একটু পর আর তুমি আমার শার্টটা নষ্ট করে দিলে?”

রিধিশা মুখ তুলে তাকায়। নিশাদের দিকে তাকিয়ে মুখ ফুলিয়ে ধাক্কা দিয়ে দূড়ে সরে গেলো। কান্না ভেজা চোখে রেগে বললো
” আমি কষ্টে কাদছি আর আপনি শার্ট নিয়ে পড়েছেন?” নিশাদ দাঁত কেলিয়ে বললো
” জি ম্যাডাম। আপনার কান্না থামানোর জন্যই।” রিধিশা মুখ ফুলিয়ে নাক টেনে চোখ মুছতে থাকে। নিশাদ কোমড়ে হাত রেখে রাগ দেখিয়ে বললো
” এখন! আমার শার্ট ভিজিয়ে দিয়েছো তোমার চোখের পানিতে। ভেজা শার্ট পড়ে যাবো?’

রিধিশা মুখ বাঁকিয়ে বললো
” কেনো আপনার জ্যাকেট কোথায়? জ্যাকেট পড়েন।” নিশাদ রাগি চোখে তাকিয়ে
” অফিসে জ্যাকেট পড়ে যাবো? বুদ্ধির দরজা বন্ধ করে রেখেছো? স্যার দেখলে বকবে জানো?” রিধিশা বিরক্ত গলায় বললো
” উফফ মহা জ্বালা তো! একদিন জ্যাকেট পড়লে আপনার চাকরি তো আর খেয়ে ফেলবে না! বলবেন আপনার জ্বর উঠেছে, ঠিকাছে।” নিশাদ গলা ঝেড়ে বেরিয়ে গেলো। রিধিশাও রুম লক করে অফিসের জন্য বেরিয়ে গেলো।

চলবে…….#কুঁড়েঘর
#লেখিকা–মার্জিয়া রহমান হিমা
[ দ্বিতীয় পরিচ্ছদ ]
। পর্ব শেষ।

অফিসের কাজ শেষ রিধিশা আর নিশাদ বেরিয়ে পড়ে। নিশাদ বাইক চালাতে চালাতে বারবার রিধিশার দিকে তাকাচ্ছে। রিধিশা মন খারাপ করে বসে আছে। নিশাদ রিধিশার উদ্দেশ্যে বললো
” ফুচকা খাবে?” রিধিশা ভ্রু কুঁচকে বললো
” এখন? রাত হয়ে গিয়েছে এখন ফুচকা খাওয়া ঠিক হবে না।”
” মাঝে মাঝে মাইন্ড ফ্রেশ করতে কতো কিছুই করা লাগে। একদিন ফুচকা খেলে কি এমন হবে?”
রিধিশা নিশ্বাস ফেলে বললো
” আচ্ছা চলুন!”

নিশাদ একটা ফুচকা স্টলের সামনে বাইক থামায়।
স্টলের একপাশে দুটো মেয়ে বসে আছে। রিধিশা বাইক থেকে নেমে অপর পাশে গিয়ে বসে পড়লো। নিশাদ এসে ফুচকা অর্ডার দিয়ে চেয়ার টেনে রিধিশার পাশে বসে গম্ভীর গলায় বললো
” আমাকে রেখেই চলে আসলে?” রিধিশা কোণা চোখে তাকিয়ে বললো
” আপনি বাচ্চা নাকি?” নিশাদ এক ভ্রু উঁচিয়ে বললো
” একসাথে আসার জন্য কি এখন বাচ্চা হওয়া লাগবে?” রিধিশা কিছু না বলে ভেংচি কাটলে।

নিশাদ জ্যাকেট টেনে বললো
” অফিসে তো সবাইকে মিষ্টি খিয়েছিলাম। এখন ভাবছি ভার্সিটিতেও বিয়ের কথাটা জানাবো।” রিধিশা চোখ বড় বড় তাকায়। নিশাদ তার তাকানো দেখে অবুঝ গলায় বললো
” কি এভাবে কি দেখছো? বিয়ে কি লুকানোর জিনিস নাকি? জানালে তোমার কি কোনো সমস্যা হবে? এই তোমার সিক্রেট বয়ফ্রেন্ড নেই তো আবার!”

রিধিশা রেগে দাঁতে দাঁত চেপে বললো
” অসভ্য, বেয়াদব লোক। বয়ফ্রেন্ড থাকলে বিয়ে করতে রাজি হতাম নাকি? বিয়ের কথা বললে তো আপনারই ঝামেলা হবে। মিলি জানতে পারলে কি করবে আপনিই জানেন।”
নিশাদ গম্ভীর গলায় বললো
” কি করবে মিলি? আমি তো কালকেই বলবো। জানার পর যদি একটু ঘাড় থেকে নামে। নিশাদ কাউকে ভয় পায় না ঠিকাছে?” রিধিশা কিছু বললো না। ফুচকা আসতেই রিধিশা ফুচকা খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

নিশাদ হতাশার নিশ্বাস ফেলে ফুচকার প্লেট হাতে নিয়ে। রিধিশা ভ্রু কুঁচকে বললো
” কি হয়েছে বসে আছেন কেনো?”
” খেতে পারবো না মরিচ দেখা যাচ্ছে।” রিধিশা নিশাদের প্লেট হাতে নিয়ে মরিচ ফেলে দিতে থাকে। নিশাদ রিধিশার প্লেট থেকে ফুচকা নিয়ে রিধিশার মুখের সামনে ধরে। রিধিশা চমকে তাকাতেই নিশাদ বললো
” ধরো আমার হাত ঝুলিয়ে রাখবো নাকি তোমার জন্য?” রিধিশা মনে মনে হেসে ফুচকা’টা খেয়ে নেয়। মরিচ গুলো সরিয়ে নিশাদকে তার প্লেট ফিরিয়ে দেয়।
নিশাদ আনন্দে খাওয়া শুরু করে।

রিধিশা গপাগপ করে সব ফুচকা শেষ করে ফেলেছে। বিড়ালের চোখে নিশাদের দিকে একবার তাকিয়ে ফুচকাওয়ালাকে গিয়ে বললো
” আরেক প্লেট আরো ঝাল দিয়ে দিন।” নিশাদ চোখ রাঙ্গিয়ে বললো
” আরেক প্লেট কিসের? বাসায় গিয়ে রাতের খাবার খেতে হবে। ফুচকা খেলে আর খাওয়া হবে না তোমার।” রিধিশা বিড়ালের মতো তাকিয়ে বললো
” হবে খাবো তো গিয়ে।”

নিশাদ ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বললো
” দুই লোকমা ভাত খেলে আর খেতে পারে না আবার দুই প্লেট ফুচকা খেয়ে নাকি রাতের খাবার খাবে।” রিধিশা মুখ ফুলিয়ে ফুচকাওয়ালার উদ্দেশ্যে বলে
” মামা আপনি দিন তো!” ফুচকাওয়ালা মাথা নেড়ে বানানো শুরু করে।
নিশাদ খাওয়া শেষ করে রিধিশা পাশে বসে বললো
” আজকে তুমি আমার বাসায় চলে আসবে। এখন তুমি একদম সুস্থ তাই কোনো অজুহাত দেবে না আমাকে।”

রিধিশা নিশাদের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললো
” বলছিলাম না গেলে হয় না? মানে আপনার বাসায় তো রেহান ভাইয়ারা থাকে। ওরা আমাকে বোনের মতো দেখলে আমি গেলে ওদের সমস্যা হতে পারে। নিজেদের মতো হয়তো থাকতে পারবে না আর আমারও অস্বস্তি লাগবে এতো গুলো ছেলের মাঝে।”
নিশাদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো
” রেহানরা কয়েকদিন আগে বলেছিলো আমাকে তুমি আসলে ওরা আলাদা ভাড়া থাকবে। কিন্তু তুমি আমার স্ত্রী হয়ে আমার ফ্ল্যাটেই থাকতে পারবে না এটা কেমন কথা?
” কি দরকার ওদের আলাদা থাকার? এতো বছর ধরে আপনার সাথে রয়েছে আমার জন্য আলাদা থাকবেন কেনো? আপনার কেনা ফ্ল্যাট বলে আমাকে থাকতেই হবে এমনও তো নয়।”

নিশাদ গলা ঝেড়ে বললো
” ঠিকাছে। কিন্তু আমার সমস্যা আছে একটা। তোমার এই বাসা চেঞ্জ করতে হবে। এক রুমে তোমার অসুবিধা হয় আর আমিও থাকতে পারবো না।” রিধিশা কোণা চোখে তাকিয়ে বললো
” আমার প্রবলেম হয় না। আপনার জন্য ফ্ল্যাট কোথায় পাবো এখন? আর ভাড়া কতো জানেন? ১৫ হাজার টাকার নিচে তো ফ্ল্যাটই পাওয়া যাবে না। আমার বেতনই ১২ হাজার। টিউশনির টাকা তো অন্যান্য খরচেই শেষ হয়ে যাবে।”
নিশাদ বিরক্ত গলায় বললো
” বেয়াদব মেয়ে! তুমি ভুলে গেছো তোমার স্বামী আছে এখন দুজন মিলে সংসার চালাবো।”

রিধিশা ইতস্ততভাবে বললো
” আপনার টাকা নিতে পারবো না। বাবা, ভাইয়ার টাকা নেই না আমি আপনার টাকা তো অনেক দূড়।” নিশাদ রাগি গলায় বললো
” রিধিশা, আমার সামনে একদম এসব জেদ দেখাবে না। তুমি না নিলে তোমার ঘাড় নেবে। এখন তুমি একা থাকবে না। আমিও তোমার সাথে থাকবো, ঠিকাছে? আমার কথার মূল্য দেবে। নতুন ফ্ল্যাট ভাড়া নিবো। মাঝে মাঝে তুমি আমার বাসায় থাকবে আর আমি তোমার বাসায়।” রিধিশা রেগে কিছু বললো না।
ফুচকা আসলে রিধিশা ফুচকা খাওয়া শেষ করতেই দুজন বাসায় চলে আসলো।
নিশাদ রিধিশাজে নামিয়ে দিয়ে বললো
” কালকে ভার্সিটিতে তাড়াতাড়ি যাবে।” রিধিশা কিছু না বলে গাম্ভীর্যপূর্ণ চেহারায় চলে গেলো।

_________

সকালে টিউশনি শেষ করেই রিধিশা ভার্সিটিতে আসে। ক্যাম্পাসে ঢুকতেই অনেকেই তার দিকে তাকিয়ে থাকে। রিধিশা তাদের তাকানোর কারণ বুঝলো না। চুপচাপ ক্লাসে গিয়ে বসে পড়ে জোতির পাশে। জোতির দিকে তাকিয়ে চিন্তিত হয়ে বললো
” সবাই আজকে কেমন করে তাকিয়ে ছিলো আমার দিকে! আমার চেহারায় কিছু লেগেছে নাকি?”
জোতি হেসে বললো
” আরে চেহারায় কি লাগবে? তোদের বিয়ের কথা জেনেছে এতোদিনে সবাই তাই তোকে দেখছে। ভাইয়ার বিয়ের কথা শুনেই তো অনেকের মাথায় বাজ পড়েছে।” রিধিশা নিশ্বাস ফেলে। কালকে নিশাদের বলা কথা ভুলেই গিয়েছিলো।

নিশাদ আর সূর্যরা বটগাছের নিচে বসে আড্ডা দিচ্ছিলো। হুট করে তাদের সামনে মিলি এসে হাজির হয়। মিলি বিচলিত গলায় বললো
” নিশাদ! সবাই কি বলছে শুনেছো? তুমি নাকি বিয়ে করেছো তাও আবার রিধিশাকে।কিছু গিয়ে বলবে না ওদের? মিথ্যা কথা চড়াচ্ছে কেনো?” রেহান হেসে বললো
” মিথ্যা কথা ছড়াবে কেনো? সত্যি কথাই তো বলছে। ওদের যা বলা হয়েছে তাই বলছে।” মিলি অবুঝ গলায় বললো
” মানে? কি বলতে চাও? নিশাদ বিয়ে করেছে? আমাকে বলবে আর আমি বিশ্বাস করে নেবো মনে হয় তোমার?”

নিশাদ শান্ত ভাবে বললো
” বিশ্বাস না করার মতো কি আছে? যদিও বিশ্বাস করা না করা তোমার ব্যাপার। তবে আমি বিয়ে করেছি এটা সত্যি আর এটা আমিই সবাইকে জানিয়েছি।” মিলির মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে।
মিলি অবিশ্বাস্য গলায় বললো
” তুমি মিথ্যা বলছো নিশাদ। তুমি আমাকে ছেড়ে রিধিশার মতো থার্ডক্লাস মেয়েকে কি করে বিয়ে করবে?”
মিলির কথা কর্ণপাত হতেই নিশাদ হুংকার দিয়ে উঠে। মিলির আত্মা কেঁপে উঠে নিশাদের হুংকারে। নিশাদ রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললো
” তোর সাহস কি করে হয় রিধিশাকে থার্ডক্লাস বলার? রিধিশাকে নিয়ে কিছু বললে মাটিতে পুতে রেখে দেবো
তোকে। রিধিশা নাকি তুই থার্ডক্লাস সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে।”

মিলি কাঁদোকাঁদো গলায় বললো
” নিশাদ! রিধিশা তোমার যোগ্য নয়। তোমার যোগ্য আমি। এতোদিন ধরে ভালোবাসি তোমাকে তার কোনো মূল্য নেই তোমার কাছে?” নিশাদ মিলির দিকে দু পা এগিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো
” রিধিশা যোগ্য বলেই আজকে আমার স্ত্রী। আমার আর আমার স্ত্রীর আশেপাশে যেনো তোকে না দেখি।”
মিলি কাঁদতে কাঁদতে চলে যায়।

.
নিশাদ অফিস থেকে এসে ফ্রেশ হয়ে সাজেদা আন্টির বাসায় চলে আসে। সাজেদা আন্টি নিশাদকে বসিয়ে বললো
” রিধিশা কোথায়? অফিস থেকে আসেনি?”
” এসেছে আন্টি। একটা কথা ছিলো তাই আমি বলতে এসেছি। রিধিশা আগে একা থাকতো তাই একটা রুম নিয়ে থাকতো এখন আমিও আছি তাই ফ্ল্যাট ভাড়া নিতে চাইছি। হয়তো বাসাটা ছেড়ে দেবো।”
সাজেদা আন্টি হেসে বললো
” ভালো কথা তো! তোমাদের যেমন ভালো মনে হয় তাই তো করবে, সমস্যা নেই আমার। তোমরা যেই মাসে যাবে তার আগে জানিও দিও আমায়।”

হেনা সাজেদা বেগমকে বললো
” মা তিন তলার বা পাশের ফ্ল্যাটে যে ভাড়াটিয়ারা ছিলো তারা বাসা ছেড়ে দেবে আজকে বলেছে আমাকে। ইতালি স্বামীর কাছে চলে যাবে জানেন তো আপনি।” সাজেদা বেগম মাথা নেড়ে বললো
” হ্যা আগেই বলেছিলো। ভালো হয়েছে, নিশাদ তুমি চাইলে ফ্ল্যাট টা দেখতে পারো পছন্দ হলে সেটাই নিয়ে নিও তাহলে আর দূড়ে যেতে হবে না।” নিশাদ আলতো হেসে বললো
” জি আন্টি আমি দেখবো একদিন এসে, এখন যাই।”

রিধিশার রুমের দরজা নক হতেই রিধিশা খুলে দেখলো নিশাদ এসেছে। রিধিশা রান্নাঘরে যেতে যেতে বললো
” এতো রাতে এসেছেন?” নিশাদ দাঁত কেলিয়ে বললো
” তোমার সাথে থাকবো আজকে তাই।” রিধিশা চমকে নিশাদের দিকে তাকায়। চোখ মুখ শুকিয়ে ঢোক গিলে
বললো
” আ…আমার সা..থে থাকব..বেন মানে?” নিশাদ ঠোঁট চেপে হেসে বললো
” বোঝনা? আজকে তোমার সাথে থাকবো। আমাদের ফার্স্ট নাইট আজকে।”

রিধিশা মুখটা শুকিয়ে ছোট্ট বানিয়ে বললো
” বললেই হলো নাকি? আমাকে আগে জানিয়েছেন আপনি? হুট করে কোথা থেকে চলে আসলেন।” নিশাদ রিধিশার চেহারা দেখে হা হা করে হেসে উঠে। রিধিশা নিশাদের হাসি দেখে বুঝলো মজা করেছে। রিধিশা মুখ ফুলিয়ে চলে গেলো। নিশাদ রান্নাঘরে গিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বললো
” আজকে এখানে খাবো বুঝেছো! আমার জন্যও রান্না করো।” রিধিশা আড়চোখে তাকিয়ে বললো
” না বললেও রাঁধছি।” নিশাদ অবাক গলায় বললো
” বাহ, কি উন্নতি হয়েছে তোমার! আমি তো ভাবলাম বেয়াদব মেয়ের মতো ঘর থেকে বিদায় করে দেবে বুঝি।” রিধিশা অগ্নিদৃষ্টিতে নিক্ষেপ করে। নিশাদ ভ্রু নাচিয়ে হাসতে হাসতে ফ্লায়িং কিস দিলো। রিধিশা চোখ বড় বড় করে মুখ ঘুরিয়ে নেয় লজ্জায়। তারপর কাঠ কাঠ গলায় বললো
” রান্না করছি আমি। এখানে এসে এসব অসভ্যতামি করছেন, ছি!”

নিশাদ রিধিশার পাশে দাঁড়িয়ে বললো
” কিছুই তো করলাম না এখনই এসব বলছো? এখন যদি সেই অপরাধের শাস্তি হিসেবে কিছু করে বসি!”
রিধিশা তাকিয়ে রাগি গলায় বললো
” যাবেন আপনি! নাকি হাত ধরে গরম ভাতের পাতিলে ছেঁকা লাগিয়ে দেবো?” নিশাদ গম্ভীর গলায় বললো
” বজ্জাত মেয়ে স্বামীকে রেসপেক্ট করতে জানো না তুমি, ছি! ভাতের পাতিলের ছেঁকার থেকে বড় ছেঁকা খেয়েছি বউ এর থেকে। বেয়াদব বউ আমার।”

রিধিশা রেগে বললো
” আমি বেয়াদব নাকি আপনি বেয়াদব! খরুশ, বজ্জাত, শয়তান বিষাদ একটা।” নিশাদ পেছনে থেকে রিধিশার গলায় কামড় বসিয়ে দেয়। রিধিশা ভয় পেয়ে কেঁপে উঠে। নিশাদ চলে যেতেই রিধিশা হতভম্ব হয়ে নিশাদের দিকে তাকায়। নিশাদ খাটের উপর বসে ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বললো
” বলেছিলাম না আমাকে বিষাদ বলবে না একদম। বিষাদ বললেও বিষাদের স্বাদ টেস্ট করতে হবে।” রিধিশা গলা ডলতে ডলতে রান্নায় মনোযোগী হয়।

রান্না শেষ করে নিশাদকে খেতে দেয়। নিশাদ বুঝলো সে চলে গেলে রিধিশা খাবে না রাতে তাই বললো
” তুমিও বসো আমার সাথে একসাথে খাবো।”
রিধিশা গলা ঝেড়ে বললো
” আমি পড়ে খেয়ে নেবো আপনি খান।” নিশাদ খাওয়া শুরু করে। রিধিশা মোবাইল হাতে নিতেই নিশাদ রিধিশার মুখ টিপে খাবার ঢুকিয়ে দিলো। রিধিশা মুখে খাবার নিয়েই রেগে বললো
” আরে বললাম না পড়ে খাবো!” নিশাদ আধো আধো বুঝেও বললো
” কি বলছো বুঝতে পারছি না, খেয়ে বলো।” রিধিশা খাবারটা গিলে আবারও বললো কথাটা।

নিশাদ রিধিশাকে খাইয়ে দিয়ে বললো
” আমার সাথেই খাবে তুমি। নাহলে আজকে এখানেই থাকবো আমি। ১৮ দিন পর বিয়ের ফার্স্ট নাইট করবো কি বলো? দারুণ হবে।”
রিধিশা বিষম খেয়ে যায়। নিশাদ দ্রুত পানি এগিয়ে দেয়। রিধিশা পানি খেয়ে চুপ করে খেয়ে নিলো নিশাদের সাথে। নিশাদ খাওয়ার পর্ব শেষ করে বললো
” আচ্ছা ঘুমাও তুমি।” রিধিশা ভ্রু কুঁচকে বললো
” এখনই ঘুমালে পড়বে কে? আপনি পড়ালেখা করেন না?” নিশাদ কেশে বললো
” হ্যা, পড়ি তো। পরীক্ষার আগে পড়ি।” রিধিশা বোকার মতো তাকিয়ে বললো
” আপনি নাকি ফার্স্ট বয়? পরীক্ষার আগের দিন পড়ে ফার্স্ট বয় হন?”
” না তো ফ্রি হলেও মাঝে মাঝে পড়তে বসি। আচ্ছা তুমি পড়ো আমিও গিয়ে পড়তে বসি।” নিশাদ চোরের মতো বেরিয়ে গেলো। রিধিশা দরজা লাগিয়ে হাসলো। নিশাদ কোনো পরীক্ষা ছাড়া পড়তে বসে না জানে সে।

_____________

রিধিশা নতুন ফ্ল্যাটে উঠতেই বাড়ি থেকে না জানিয়ে নতুন ফার্নিচার আসে। জানতে পারলো শশুড় বাড়ি, বাবার বাড়ি দুই বাড়ি থেকেই নাকি পাঠানো হয়েছে।
রিধিশা আর নিশাদ সব কিছু গুছিয়ে নিয়েছে।

নিশাদের জন্মদিন আজকে। নিশাদকে সারপ্রাইজ দেবে বলে রাত বারোটায় এবার রেহানরা কেউ নিশাদকে বার্থডে উইশ করেনি। নিশাদের আড়ালে তার মোবাইলও বন্ধ করে রেখে দিয়েছে। রিধিশা নিশাদের জন্মদিনের কথা জানতো না কিন্তু সূর্যরা তাকে জানিয়েছে। রিধিশা শরীর খারাপ এর বাহানায় অফিস কামাই করেছে।
নিশাদ অফিসে চলে যাওয়ার পর থেকেই সূর্য, রেহান, সাদি রিধিশাদের নতুন ফ্ল্যাট সাজাতে ব্যস্ত। নিশাদের ফ্ল্যাটে বেশি অগোছালো হয়ে রয়েছে তাই এবার সেখানে কিছু করেনি।

বিকেলের পর থেকে রিধিশা জোতিকে নিয়ে রান্না করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সূর্য অনেক আগেই বাজার করে এনে রেখেছে। রিধিশা নিশাদের সব প্রিয় খাবার রান্না করার চেষ্টা করছে। নিশাদ একদিন লিমা বেগমকে তার প্রিয় খাবার গুলোর নাম বলেছিলো সেটা মনে করেই সব রান্না করছে।

.

নিশাদ ফ্ল্যাটের দরজায় হাত রাখতেই শব্দ করে খুলে যায়। নিশাদ ভ্রু কুঁচকে ভেতরে ঢোকে। অন্ধকার দেখে
নিশাদ ভয় পেয়ে যায়। অস্থির গলায় ডেকে উঠে
” রিধিশা! রিধিশা! অন্ধকার করে রেখেছো কেনো? রিধিশা?” কয়েক পা এগোতেই লাইটের সাথে সাথে কতোগুলো মানুষের চিৎকার শুনে নিশাদ বিস্ময়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে।

সূর্য, রেহান, সাদি এগিয়ে এসে স্প্রে দিয়ে দিতেই নিশাদের ঘোর ভাঙ্গে। তিনজন নিশাদকে সাদা বানিয়ে দেয়। নিশাদ মুখ মুছে বললো
” আমি ভুলেই গিয়েছিলাম জন্মদিনের কথা।” রেহান হেসে বললো
” ভুলে যাওয়ার মতোই কাজ করেছি তোকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য। আচ্ছা চল কেক কাটবি।”
নিশাদকে কেকের সামনে নিয়ে যায়। নিশাদের রিধিশার দিকে চোখ পড়ে। রিধিশা তার লেভেন্ডার কালার শাড়ি পড়েছে আজকে। নিশাদ মুচকি হাসে রিধিশার দিকে তাকিয়ে। রেহান রিধিশাকে নিশাদের পাশে দাঁড় করিয়ে বললো কেক কাটতে।
নিশাদ কেক কেটে রিধিশাকে খাইয়ে দিয়ে একে একে সবাইকে খাইয়ে দেয়।

রিধিশা, জোতি সবাইকে খাবার খেতে দেবে বলে রান্নাঘরে যায় হেনাও দুজনের সাথে গেলো। সবাইকে খাবার খেতে দিয়ে রিধিশা রুমে আসে কাজের জন্য। আরো শব্দের উৎস শুনে রিধিশা পেছনে তাকিয়ে দেখে নিশাদ বুকে দুই হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। রিধিশা বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে বললো
” আপনি এখানে কেনো? আপনার খাবার দিয়ে আসলাম তো!” নিশাদ নিঃশব্দে কয়েক পা এগিয়ে আসে রিধিশার দিকে।

রিধিশা নিশাদের হাবভাব দেখে আমতা আমতা করে বললো
” এভাবে এগোচ্ছেন কেনো? পাগল হয়েছেন? সবাই কি ভাববে?” নিশাদ আচমকা রিধিশার কোমড়ে দুই হাত রেখে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। রিধিশা চমকে উঠে নিশাদের স্পর্শে। নিশাদের এক হাত গিয়ে রিধিশার শাড়ির নিচের উন্মুক্ত পেটে স্পর্শ লাগলো। রিধিশা কিছু বলতে গিয়েও গলায় কথা গুলো আটকে গেলো। রিধিশা মাথা নিচু করে নেয়। নিশাদ রিধিশার কানের কাছে ঝুকে ঘোর লাগা কণ্ঠে বলে উঠে
” পাগল হয়েছি তোমাকে দেখে। শাড়িতে আবৃত তুমি’কে দেখে।”

রিধিশা শরীর শিরশিরিয়ে কাটা দিয়ে উঠলো। নিশাদ আলতো করে তার অধর জোড়া রিধিশার গালে ছুঁয়ে দিলো। রিধিশা চোখ বন্ধ করে কেঁপে উঠে আবারও। নিশাদের উষ্ণ ছোঁয়া রিধিশার হৃদপিণ্ড কাঁপিয়ে তুলছে। নিশাদ আবারও রিধিশার অন্য গাল ছুঁয়ে দেয়। রিধিশা শ্বাসকষ্ট রোগীর মতো জোড়ে শ্বাস নিলো।
হঠাৎ বাইরে থেকে নিশাদের ডাক কানে আসতেই নিশাদ আসছি বলে রিধিশাকে ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।
রিধিশা বড় নিশ্বাস নিলো। বুকে হাত রেখে বিড়বিড় করে বললো
” কি হয়েছে নিশাদের?”

নিশাদ সব খাবার আনন্দে চেটেপুটে খেলো। সব তার প্রিয় খাবার। সবাই রিধিশার রান্না খেয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ। নিশাদ চুপচাপ খেয়েছে সবার সামনে কিছুই বলেনি কারণ নিশাদ প্রতিদিনই বলে। নিশাদকে দেখে বুঝলো নিশাদ খুশি হয়েছে।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে সবাই অনেক সময় হাসি মজা করে বেরিয়ে গেলো। নিশাদ সূর্যদের সাথে চলে যায়। রাতে চার বন্ধু একসাথেই থাকবে। জোতি রিধিশার সাথে থাকবে।

.
রাত দেড়টা নাগাল। রিধিশার চোখে ঘুম নেই। রুমে ভেতরে জোতি ঘুমাচ্ছে। রিধিশা ব্যালকনিতে বসে আছে হাটুর উপর মাথা রেখে। আলসেমির কারণে পরনে শাড়ি খোলা হয়ে উঠেনি এখনও। রিধিশা আকাশের দিকে তাকিয়ে নিশাদের কথাই ভাবছিলো। জেগে জেগে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কল্পনা ছল্পনা করছে। হঠাৎ রিধিশার পাশে ফোন বেজে উঠে তীব্র ভাবে। রিধিশা চমকে উঠে সাথে দৌঁড়ে উঠে রুমে গেলো। জোতির ঘুম ভেঙ্গে যেতে পারে তাই। ফোন খুঁজে সাইলেন্ট করে দেখলো নিশাদের কল এসেছে। রিধিশা রিসিভ করতেই নিশাদ বলে উঠে
” নিচে এসো রিধিশা।” রিধিশাকে আর কিছু বলতে না দিয়েই কেটে দিলো। রিধিশা ফোনের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললো
” এত্তো রাতে নিচে যাবো? এই বদ ছেলেটা নির্ঘাত পাগল হয়েছে। রাত দেড়টায় নিচে যাবো?”

রিধিশা অনেকে ভেবে চিনতে বিশ মিনিট লাগিয়ে নিচে গেলো চুপিচুপি। গেট থেকে বের হতেই দেখে নিশাদ জ্যাকেট পড়ে পকেটে হাত গুঁজে পা দিয়ে ছোট ছোট ইট দূড়ে লাথি দিয়ে ছুড়ছে। রিধিশা হনহন করে নিশাদের সামনে গিয়ে বললো
” কি পাগলে রয়েছে? রাত ২টায় আপনি আমাকে রাস্তায় ডাকছেন! বাসায় আসলেও তো হতো তাই বলে রাস্তায়!”
নিশাদ ঢুলু ঢুলু ভাবে রিধিশার দিকে তাকালো। ঘুম ঘুম গলায় বললো
” তোমাকে বিয়ের শাড়িতে দেখা হয়নি এখনও কিন্তু তোমার ল্যাভেন্ডার শাড়ি টা আমার অনেক পছন্দের। এই শাড়িতে তোমাকে অপ্সরীর মতো লাগে। শুধু এই শাড়িতে নয় সব সময় তোমাকে অপ্সরী মনে হয় আমার। তোমাকে আমি আরো শাড়ি গিফট করবো আমি। তুমি আমার সামনে শাড়ি পড়বে, ওকে?”

রিধিশা বোকা আর অবাক মিশ্রিত দৃষ্টির সাথে নিশাদের দিকে তাকিয়ে বললো
” এই কথা বলার জন্য এতো রাতে ডেকেছেন আপনি? Unbelievable! এই আপনি মদ খেয়েছেন?”
নিশাদ জোড়ে জোড়ে মাথা ঝাঁকিয়ে ঘুম ঘুম ভাব ভাঙ্গিয়ে বললো
” আরে না তো। আমি একদম ফিট।”
” তো কি সব কথা বলছেন এতো রাতে?” নিশাদ কোণাচোখে তাকিয়ে বললো
” বোঝনা কি বলেছি?” রিধিশা বিরক্ত হয়ে বললো
” নাহ বুঝিনা।”

নিশাদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে রিধিশার চোখের দিকে তাকিয়ে ধীর গলায় বলে উঠে
” তোমার স্বপ্ন ছিলো না ভালোবাসা দিয়ে ছোট্ট কুঁড়েঘর বানাবে? সেখানে সুখের সংসার করবে?
আমার ভালোবাসা তোমার নামে রইলো। এই ভালোবাসা দিয়ে #কুঁড়েঘর তৈরি করবো দুজন মিলে। আলোকহীন চাঁদের এক ফালি আলো আমাদের ভালোবাসার রঙ হয়ে উঠবে। ছোট কুঁড়েঘরে আমরা সুখের সংসার করবো। মান, অভিমান, রাগ,ঝগড়া, ভালোবাসা সব কিছু করার সুযোগ দেবো। তোমার হৃদয়ে থাকা আমার প্রতি ভালোবাসাকে পূর্ণতা দেবো। স্বামী হিসেবে সেই সব কিছুর অধিকার আর সুযোগ চাই।” রিধিশা অশ্রুভেজা চোখে নিশাদের দিকে তাকালো। টলমল করতে থাকা চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। রিধিশা নিঃশব্দে ঠোঁট ফুলিয়ে খুশির কান্না ঝরিয়ে দিলো।

নিশাদ হাত বাড়িয়ে বললো
” আজকে ল্যাম্পপোস্টের আলোতে রাত কাটাবো আকাশে নিচে। চলো পথ চলা শুরু করি। #কুঁড়েঘর এর ভালোবাসাময় অধ্যায়।” রিধিশা নিশাদের হাত শক্ত করে ধরে হাটতে থাকে দুজন। নিশাদ এক হাতে রিধিশার কোমড় জড়িয়ে নিলো। নিশাদ হাটতে হাটতে বললো
” তুমি মিলির মতো মেকাপ করোনি কেনো?” রিধিশা রেগে নিশাদের হাতে ঘুষি দিয়ে বললো
” আজকেও মিলি! মিলি ছাড়া কিছু দেখেন না তাই না?”
” না ভাবছি সবাই মেকাপ করলো আমার বউ মেকাপ করলো না কেনো?” রিধিশা মুখ বাঁকিয়ে বললো
” এতো ইচ্ছে হলে আপনাকেই করে দেবো আমি।” নিশাদ হেসে দেয় রিধিশার কথায়।

সমাপ্ত

[অনিয়মিত দেওয়ার কারণে গল্প শেষ হতে দেড়ি হয়েছে কুঁড়েঘর গল্প সম্পর্কে সবার মন্তব্য জানাবেন। অপেক্ষায় থাকবো, ধন্যবাদ। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here