কুড়িয়ে পাওয়া ধন পর্ব -২৫

#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_২৫
জাওয়াদ জামী

আকলিমা খানমের মন বেশ কয়েকদিন থেকে ভালো নেই। আজকাল শুভ সারারাত বাইরে কাটায়। ফজরের আজানের পর ও বাসায় আসে। এ নিয়ে আকলিমা খানমের তার ছেলের সাথে প্রায়শই কথা-কাটাকাটি হয়। কিন্তু শুভ শোধরাবার ছেলে নয়। আজ সে বাসায় ফিরেইনি। সকাল দশটা বাজে, অথচ এখনও সে শুভর খোঁজ পায়নি। বিষয়টি সে এখন পর্যন্ত শহিদ আহমেদকে জানায়নি। এদিকে শ্রীজাও বাসায় নেই। ও থাকলে শুভর খোঁজ যেভাবেই হোক বের করত। তার এখন শ্রীজার ওপর ভিষণ রা’গ হচ্ছে। নিজের এই প্রাসাদসম বাড়ি ছেড়ে তার মেয়ে আরেকজনের ছোট ফ্ল্যাটে যেয়ে পরে আছে। নিজের ভাইয়ের থেকেও সৎভাইয়ের ওপর দরদ বেশি! আজ আসুক ও।
এদিকে শহিদ আহমেদও আজ বাসায় আছে। কখন যেন সে শুভর কথা জিজ্ঞেস করে। ভয়ে আকলিমা জুবুথুবু হয়ে গেছে।
রাজিয়া খানমের অবস্থাও তাই। শুভর চিন্তায় সে-ও অস্থির। তারউপর আজকে তার ছেলে বাসায় আছে।

আকলিমা খানম উপায় না পেয়ে তার ভাই রশিদ বেগকে ডাকে কথা বলার জন্য।

” ভাই, শুভ এখনও বাসায় ফিরেনি। তুমি একটু খোঁজ নিয়ে দেখবে? কিন্তু ওর বাবাকে কিছু জানিওনা। ”

” তুই এসব কি বলছিস, আকলিমা? শুভ বাসায় ফিরেনি, এটা আমি শহিদ ভাইকে জানাবনা! সবার আগে জানার অধিকার তার। কোথায় তুই ছেলেটাকে শাসন করবি। কিন্তু সেটা না করে তুই ওকে সব সময়ই প্রশ্রয় দিস। এটা একদমই ঠিক নয়। তাছাড়া শহিদ ভাই জানলে, তাকে কি জবাব দিবি? ”

” আমি তোমার কাছে সাহায্য চাইছি, কিন্তু তুমি সেটা না করে, আমাকেই দোষারোপ করছ! পারলে সাহায্য কর না পারলে চুপ থাক। ” আকলিমা খানম রে’গে গেছে।

” ঠিক আছে। আমি দেখছি ও কোথায় আছে। তুই চিন্তা করিসনা। ” রশিদ বেগ শুভর খোঁজে বেরিয়ে যায়।

রশিদ বেগ বেরিয়ে যেতেই আকলিমা তার মেয়েকে ফোন করে। দুইবার রিং হতেই শ্রীজা ফোন রিসিভ করে।

” হ্যাঁ, মা, বলো। তুমি এখন ফোন দিলে যে? তোমরা সবাই ঠিকঠাক আছো? ”

” আমরা ঠিক আছি কিনা সেটা দেখার সময় তোর আছে? নিজের বাবার বাড়ি রেখে, তুই পরে আছিস দরদের ভাইয়ের খুপড়ি ঘরে। আমাদের থেকে সে-ই তোর কাছে সব সময়ই আপন, সেটা আমি ভালো করেই বুঝি। কিন্তু যখন বিপদের সময় তোর পাশে তোর দরদের ভাই থাকবেনা, সেদিন বুঝবি কে তোর আপন ছিল। তুই কখন আসবি? তারাতারি বাসায় আয়। এত ঘনঘন সেখানে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আর তাদের সাথে তোর এত পিরিত কিসের তা আমি বুঝিনা। ”

” মা, তুমি আর দাদিমা সারাজীবন মানুষকে খুঁ’চি’য়ে শান্তি খোঁজ। কিন্তু এতে কি আদৌ শান্তি মেলে? আমি ভাইয়ার বাসায় এসেছি, তাতেও তোমার সমস্যা! তুমি কি চাও বলতো? ভাইয়ার ঐ বাড়িতে থাকা নিয়ে তোমার সমস্যা ছিল। আবার যখন সে সবকিছু ছেড়েছে, এখানেও তোমার সমস্যা? আমি আমার ভাইয়ের কাছে আসতেই পারি। এখানে তোমার কাছে জবাবদিহিতার কিছু নেই। তাই তোমার কথায় আমি এখান থেকে যাচ্ছিনা। আমি বাবার কাছ থেকে হুকুম নিয়ে এখানে আসি এবং কালকেও তা-ই করেছি। তাই তুমি বললেও আমি যাবনা। এখন রাখছি। ”
শ্রীজা ভেবে পায়না ওর মা ভাইয়ার ওপর কেন এতটা হিং’স্র মনোভাব পোষণ করে।

গতরাতের পর থেকে কান্তা আরমানের সামনে যেতে লজ্জা পাচ্ছে। কাল রাতে লোকটা কিভাবে ওকে লজ্জা দিল! অথচ তাকে দেখে মনে হয়, ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানেনা। কিন্তু এ-তো দেখা যায় মাছ ভাজায় সিদ্ধহস্ত!

আরমান সকাল থেকেই লক্ষ্য করছে কান্তা ওর আশেপাশে ভিড়ছেনা। এমনকি ওর দিকে তাকাচ্ছেনা পর্যন্ত। ও ঠিক বুঝে গেছে কান্তা কেন এমন করছে।

আরমানকে বাইরে যেতে দেখে কান্তা রুমে আসে টুকটাক কাজ করতে। আরমান বলেছে, টুকিটাকি জিনিসপত্র তাকে দিতে। আজ যতটা পারে কাপড়চোপড় ও হালকা কিছু জিনিস সে নিয়ে যাবে। এরপর সামনের মাসে এসে একবারে ওদেরকে নিয়ে যাবে। সে মতই কান্তা ব্যাগ গোছাচ্ছে।

” এইযে, লজ্জাবতী রমনী, সকাল থেকেই এত পালাই পালাই করছ কেন? এখনই এত লজ্জা পেওনা। কিছুটা লজ্জা বাকি রাখ আগামীদিনের জন্য। লজ্জা ছাড়া বউ আমার আবার ভালো লাগেনা। ” আরামানের ঠোঁটে দুষ্টু হাসির ঝিলিক।

আরমান হঠাৎ রুমে আসায় অপ্রস্তুত হয়ে গেছে কান্তা। এই মানুষটা সব সময় এমনভাবে কথা বলে কেন! একে আর ছাড় দিলে হবেনা। কান্তা তেজী চোখে আরমানের দিকে তাকায়।

” লজ্জা আমার, তাই আমিই বুঝব কখন তাকে সামনে আনব আর কখনইবা ভেতরে রাখব। এতে আপনার কোন সমস্যা? বদ লোক একটা। ”

” উঁহু আমার কোনই সমস্যা নেই। তবে আমার মুড বুঝে তোমার লজ্জা সামনে এনো, কিংবা ভেতরে রেখ। তোমার লজ্জা দেখলে আমি রোমান্টিক মুডে যেমন তোমার লজ্জা হরণ করার ক্ষমতা রাখি, তেমনি নিরামিষ মুডেও অনায়াসে তোমার সর্বাঙ্গে প্রেমের বর্ষন বইয়ে দিতে পারি। অপশন তোমার। তুমি আমার কোন মুডে আমাকে কাছে ডাকবে। আমি আবার এসব বিষয়ে ভিষণ দয়ালু। ”

” আবার শুরু করেছেন? আপনি রুম থেকে এক্ষুণি বের হন। বাইরে যেয়ে শ্রীজাপুর সাথে গল্প করেন। ফাজিল একটা। মুখের কোন লাগাম নেই। ” কান্তার গলায় তেজস্বীভাব আবার ফিরে এসেছে। সে কটমট চোখে তাকিয়ে আছে আরমানের দিকে।

” এই মুহূর্তে আমার বাইরে যাওয়ার কোন ইচ্ছেই নেই। ভিষণ ঘুম পেয়েছে। এখন একটু ঘুমাব। আমাকে একলা পেয়ে তুমি আবার আমার দিকে নজর দিওনা। ” আরমান হাই তুলে বিছানায় ধপাস করে শোয়।

” আমার বয়েই গেছে আপনার দিকে নজর দিতে। আমার খেয়েদেয়ে কাজ নেই, তার দিকে নজর দিতে বসে থাকব। ” মুখ ঝামটা দিয়ে কান্তা অন্যদিকে ঘুরে কাজে মনোনিবেশ করে।

সেইদিন বিকেলে শুভ বাসায় ফিরে। রশিদ বেগ ওকে অনেক জায়গায় খুঁজেছে, কিন্তু ওর দেখা মেলেনি। সে এসে আকলিমাকে জানায়, শুভকে সে পায়নি।
চিন্তায় অস্থির আকলিমা খানম ছেলেকে দেখে হাঁফ ছাড়ে।
শুভ ঢুলতে ঢুলতে বাসায় প্রবেশ করে। ওকে দেখে আকলিমা খানম সেদিকে এগিয়ে যায়।

” শুভ, তুই কোথায় ছিলি? গতকাল সকালে তুই বাসা থেকে বের হয়েছিলি, আসলি এখন! তুই ঠিক আছিসতো? এভাবে হাঁটছিস কেন? ” আকলিমা খানমের গলায় নিখাদ উৎকন্ঠা।

” উফ্ মম। এভাবে ঝামেলা করছ কেন! তোমার প্রশ্নের উত্তর পরে দিলেও তো হবে নাকি? সব সময় তোমার এমন ঘ্যানঘ্যান ভালো লাগেনা। এসব করে কি প্রমান করতে চাও? নিজেকে আদর্শ মা ভাব নাকি! এসব ফালতু সেন্টিমেন্ট আমাকে দেখাবেনা। সামনে থেকে সর। আমাকে রুমে যেতে দাও। ” আকলিমা খানমকে ঠেলে
সরিয়ে দিয়ে, শুভ টলোমলো পায়ে নিজের রুমে যায়।

এদিকে ছেলের এমন আচরনে আকলিমা খানম স্তব্ধ। এতদিন শুভ তাকে টুকটাক কথা শোনালেও আজ সে সীমা ছাড়িয়েছে। এসব কথা তার স্বামীকে না জানালেই নয়।

সন্ধ্যার পর আরমান কান্তা ও খালার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসা থেকে বের হয়। ওর সাথে শ্রীজা আছে। শ্রীজাকে বাসার সামনে ছেড়ে দিয়ে তবেই ও চিটাগংয়ের পথে রওনা দিবে।

প্রতিবারের ন্যায় এবারও কান্তা চোখের পানিতে আরমানকে বিদায় দিয়েছে। মেয়েটার এমন কান্না আরমান সহ্য করতে পারেনা। তাই এবার ও সব ব্যবস্থা করেই এসেছে। বাড়িওয়ালাকে জানিয়ে দিয়েছে, সামনের মাসেই ওরা বাসা ছাড়বে।
মেয়েটাকে আর এভাবে দূরে রাখতে চায়না আরমান। সে নিজেও মেয়েটার মায়ায় গভীরভাবে ডু’বে’ছে। এ মায়ার কোন তল নেই। একটা দিন মেয়েটাকে না দেখতে পেলে, এক ঘন্টা তার সাথে কথা বলতে না পারলে, নিজেকে কেমন যেন পাগল পাগল লাগে। এ যেন গভীর সমুদ্রে ডু’বে থাকার মত অবস্থা। যেখানে কোন অক্সিজেন নেই, নেই কোন আলো। আলো আর অক্সিজেন বিহীন প্রতিটা দিন কাটাতে হয় আরমানকে। ঠিক তেমনই মেয়েটাকে দেখার সাথে সাথে মনে হয়, এইমাত্রই গভীর সমুদ্র থেকে উপরে ভেসে উঠেছে সে। সেখানে অফুরান আলো, বাতাস। যার ছোঁয়ায় নিমেষেই উবে যায় সকল অপ্রাপ্তি।

আজকাল জাবেদের বাড়িতে শান্তি লাগেনা। মন টিকেনা বাড়ির চৌকাঠে। শিখার আবদারের শেষ নেই। আজ এটা নিব , কাল ওটা নিব, এভাবেই চলছে। নিষেধ করলেও কিছুতেই শুনছেনা।
আবার ওর ছোট দুই ভাই-বোনের যাবতীয় খরচ আবার শিখার বাবা-মা’র সকল খরচ জাবেদকে বইতে হচ্ছে।
এদিকে ওর ছোট ভাই তার সকল সম্পত্তির ভাগ নিয়ে আলাদা হয়ে গেছে। সে আগে সংসারে টুকিটাকি খরচ দিত। কিন্তু এখন সে আলাদা হয়ে যাওয়ায় সেই টাকা আর দিচ্ছেনা। তাই শিখার আবদার আর ভাই-বোনের খরচ মেটাতে জাবেদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। শিখার বড় বোন তার বাবা-মা, ভাই-বোনের কোন খরচই দেয়না। একা একটা মানুষ দুই-দুইটা সংসার চালাতে যেয়ে কিছুতেই কুলিয়ে উঠতে পারছেনা। এ নিয়ে শিখাকে কিছু বললেই শুরু হয়ে যায় অশান্তি।
তাই সে বাড়িতে খুব একটা সময় কাটায়না। স্কুল থেকে ফিরে কোচিং করিয়ে রাত এগারোটার দিকে বাড়িতে আসে। তখনও তার শান্তি নেই। এটা লাগবে, ওটা লাগবে বলে শিখা কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করতে থাকে।
বেশ কয়েকদিন থেকেই বোনটার কথা মনে হচ্ছে। কিন্তু ফোন দেয়ার সাহস পাচ্ছেনা। শেষবার মেয়েটার সাথে কথা বলে, ওকে অনেক কটু কথা শুনিয়েছিল। তাই আরেকবার বোনের কাছে ফোন দিতে ওর সংকোচ হচ্ছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here