কুয়াশায় ঘেরা পর্ব -০২

#কুয়াশায়_ঘেরা
#পর্ব_০২
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

প্রকৃতিতে মৃদু ঠান্ডা বাতাসের অস্তিত্ব। বিশাল দানবের মতো দাঁড়িয়ে আছে অট্টালিকা। সেদিক থেকে দৃষ্টি ফেরালো প্রভাতি। গাড়ি থেকে নেমে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো গন্তব্যে। ভাবিদের বাসায় পা ফেলার পর চারিদিকে ধূ ধূ শূন্য দেখতে পেলো। আশেপাশে কোনো মানুষজন নেই। ঢিপঢিপ হৃদকম্পন নিয়ে সামনে পা বাড়ালো। হঠাৎ ভাবির তীব্র ঝংকারের সুর তোলা হাসির শব্দ পেলো প্রভাতি। কৌতুহলে চোখজোড়া তীক্ষ্ণ হয়ে এলো। কাল যা হলো, তাতে করে ভাবির এতটা হাসিখুশি থাকার কথা নয়। ভাবির রুমে পা বাড়াতেই প্রচন্ড রকম শকড হলো। তার ভাবি আর ভাই দুজনে একইসাথে বসে হাসিঠাট্টা করছে। আশরাফুল সাইফার অল্প বেড়ে ওঠা পেটে কান লাগিয়ে বাবুর সাথে কথা বলছে। যেনো সত্যি সত্যি বাবু উত্তর দিতে পারছে।

মাথা ঘুরছে প্রভাতির। গতকাল থেকে কি হচ্ছে, কিছুই তার বোধগম্য হচ্ছে না। ভাইয়া কতটা রুক্ষ, খসখসে মেজাজে থাকলে ভাবিকে সোজা তার বাবার বাড়ি দিয়ে যেতে পারে, সেটা প্রভাতির অজানা নয়।তবে কোথায় গেলো সেই রা’গ? ভাবুক হয়ে দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে রইলো প্রভাতি। হুট করেই সাইফার নজর পড়ে প্রভাতির ওপর। ঠোঁট প্রসারিত করে বলল,

-“প্রভাতি, দাঁড়িয়ে আছো কেনো? ভেতরে এসো।”

আশরাফুল অদ্ভুতভাবে হাসলো। প্রভাতিকে এখানে দেখে সে চমকায়নি, বরং সে যেনো জানতো প্রভাতি এখানে আসবে। তাই সকালে বের হওয়ার সময় গাড়ি নিয়ে আসেনি। ড্রাইভারকে বলে দিয়েছে ‘প্রভাতি কোথাও যেতে চাইলে নিয়ে যাবেন”। আশরাফুল মোটা কন্ঠে বলে উঠলো,

-“দুজনে মিলে গল্প কর। আমার একবার ফ্যাক্ট্রিতে যাওয়া দরকার।”
কথা শেষ করে আর বসলোনা আশরাফুল। দুজনকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়লো।

-“আমি দু’কাপ চা বানিয়ে আনছি।”
সাইফাকে খপ করে ধরলো প্রভাতি। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,

-“আমার আর অস্থিরতা ভালো লাগছেনা। কি হয়েছে বলো তো? মাথাটা ভীষণ জট পাকিয়ে আছে। এই মুহূর্তে সব কিছু জানা প্রয়োজন।”

সাইফা মৃদু হেসে বলল,
-“চা হলে ব্যাপারটা বেশ এনজয় করতে পারবে। প্রথমে তোমার মতো আমিও প্রচুর ভ*য় পেয়েছিলাম।”

প্রভাতি ঠোঁট চোখা করে শ্বাস ছাড়লো। মাথা হেলিয়ে বলল,
-“আচ্ছা, তবে চা নিয়ে এসো। কিন্তু তোমাদের বাসা খালি কেনো? সবাই কোথায়?”

সাইফা মেয়েটা যেনো হাসতে ভালোবাসে। এবার ও তার ব্যতিক্রম হলোনা। একগাল হেসে বলল,
-“সবাই সকালেই ভাইয়ার শশুর বাড়ী গিয়েছে। ভালোলাগছিলো না বলে আমি যাইনি।”

প্রভাতি ফিক করে হেসে ওঠে বলল,
-“সবাই তোমার ভাইয়ের শশুর বাড়ি আর আমি আমার ভাইয়ের শশুর বাড়ি এসে বসে আছি।”

সাইফা দু’কাপ চা নিয়ে ফিরলো। প্রভাতির চায়ে চিনি একটু বেশি লাগে। এককাপ চায়ে দেড় চামুচ চিনি না হলে জমেনা।
চায়ের কাপে ঠোঁট ছুঁইয়ে কানের পাশে কয়েক গাছি এলোমেলো চুল গুঁজে দিয়ে প্রভাতি বলল,
-” এবার অন্তত সবটা আমায় বলো। আমি কিন্তু হাঁপিয়ে উঠেছি।”

সাইফা আর সময় নিলোনা। মিষ্টি করে হাসলো।
-“তুমি তো জানো কয়েকদিন যাবত আমাদের বাসায় আসার জন্য আমি কেমন ছটফট করেছি। কিন্তু মা আসতে দিলেন না। কাল হুট করেই তোমার ভাইয়ার টাকার বান্ডিল থেকে টাকা মিসিং। মা ব্যাপারটা জানতেই হৈচৈ শুরু করলেন। উনার ধারণা টাকা আমিই সরিয়েছি। আমার ভীষণ খা’রাপ লেগেছিলো, যখন দেখলাম তোমার ভাইয়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।
কিছুই বলছেনা। ফের আমাকে বলল বাবার বাড়ি চলে আসতে।
রুমে ফিরে আমার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বোঝালেন ব্যাপারটা আমি যেমন ভাবছি ঠিক তেমনটা নয়। ভিন্ন একটা ব্যাপার। আমাকে সেইফ রাখার জন্য উনি মায়ের কথার জবাবে কিছু বলতে পারেননি। কিছু বললে হিতে বিপরীত হবে। মা আরো উত্তেজিত হয়ে পড়বেন। তাই মায়ের সামনে কিছুটা কঠোর ছিলেন।”

সাইফা একটু থেমে আবার বলল,
তুমি নিশ্চয়ই বুঝেছো আমি কিসের কথা বলছি। বাবু আর আমার সেইফ থাকার জন্যই তোমার ভাইয়া আমাকে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে। মোদ্দাকথা সে সুযোগ খুঁজছিলো আমাকে এখানে পাঠানোর। মায়ের ব্যাপারটা তুমিই বেশ ভালো জানো।”

ভাবির কথায় লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল প্রভাতি। বাবা থাকলে আজ সবকিছুই ঠিক থাকতো। প্রভাতি আর বেশিক্ষণ বসতে চাইলোনা। হাতের চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে বিদায়ের সুরে বলল,
-“অনেকটা সময় ছিলাম। এতক্ষণে হয়তো তোমার বাবা মা এসে পড়বে। আমি আসছি। সময় পেলেই হুটহাট তোমাকে আর আমার প্রিন্স না প্রিন্সেস জানিনা তাকে দেখতে চলে আসবো।”

সাইফা হাসিমুখে বিদায় দিলো প্রভাতিকে। দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গেলো। প্রভাতি যখন গেট পেরিয়ে গেলো, তার সবুজ ওড়নার কিছু অংশ অস্পষ্ট দেখা গেলো।

-“তোমার জন্য সামনে দারুণ কিছু অপেক্ষা করছে ননদিনী।”
বলেই চোখে হাসলো সাইফা। যেনো ব্যাপারটা দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে তৃষ্ণার্ত চোখজোড়া। অধর জোড়া সূক্ষ্ম হাসিতে তাল মেলালো।

পশ্চিমাকাশ কালো রং এ সেজেছে। গুড়ুম গুড়ুম শব্দে কেঁপে উঠছে গতর। অপেক্ষা ঝুমবৃষ্টির। শরীরের সাদা রং এর শাড়িটি এখনো বদলায়নি প্রভাতি। নিজেকে সবসময় পরিপাটি রাখতে পছন্দ করে। একটু আগেই নিজেকে কৃত্রিম রূপে সজ্জিত করে দেখা করে এসেছে একটা ছেলের সাথে। মা অনেকদিন যাবত ছেলেটার সাথে দেখা করার জন্য তাগাদা দিচ্ছিলেন। আজ দেখা করেই আসলো। খা*রা*প*না, বরং তার নিজের তুলনায় ছেলেটাকে একটু বেশিই সুন্দর মনে হচ্ছিলো। কিন্তু কেনো জানেনা বিয়েতে এগোনোর মতো সেরকম কথাবার্তা বলতে পারেনি প্রভাতি। ভালোলাগেনি।

বসার ঘর থেকে ইলানের মা ইরতিজার কথা শোনা যাচ্ছে। প্রায় বারো-তেরো বছর ধরে পাশাপাশি ফ্ল্যাট কিনে থাকছে আশরাফুল আর ইলানের পরিবার। ওদের দুজনের বন্ধুত্বের পাশাপাশি পারিবারিক সম্পর্কটা ও বেশ মজবুত হয়েছে। ইলানের মা এসেছেন আনোয়ারা জাহানের সাথে গল্প করে সময় কা’টাতে। তখনই আনোয়ারা জাহান প্রভাতির বিয়ের কথা তুললেন।

বৃষ্টির পর সতেজ নির্মল পরিবেশ। পাতায় পাতায় জমে থাকা বৃষ্টিকণা বড় ফোঁটা হয়ে টুপ করে গলে পড়ছে। ঘড়ির কা’টা দশ এর ঘর অতিক্রম করেছে। মুঠোফোন ”বিপ’ শব্দে কেঁপে উঠলো। পাওয়ার বাটনে ক্লিক করে স্ক্রিন অন করতেই এক টুকরো মেসেজ ভেসে উঠলো।

“ছাদে আসো। কথা আছে। ত্যাড়ামো করবেনা।
আজ ভালোয় ভালোয় না আসলে কাল তোমার নিস্তার নেই।”

ওড়নাটুকু শক্ত করে চেপে ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো দরজায় দিকে। একবার মায়ের রুমে উঁকি দিয়ে দেখলো মায়ের জহুরি নজর তার দিকেই আটকে আছে। মায়ের প্রশ্নবিদ্ধ চোখজোড়া দেখে প্রভাতি বলল,

-“মোহনা ডেকেছে। যাবো আর কাজ সেরে চলে আসবো।”

আনোয়ারা জাহানের মত পেয়েই প্রভাতি ছাদে পা বাড়ালো। মোহনা নিচতলার একটা মেয়ের নাম।
কচ্ছপের গতিতে শব্দহীন পায়ে ছাদে এসে পৌঁছালো।
ইলান ছাদের দরজার দিকে মুখ ফিরিয়ে বুকের উপর দুহাত গুঁজে বুক টা’ন টা’ন করে দাঁড়িয়ে রইলো।

প্রভাতি তাড়া দেখিয়ে প্রশ্ন করলো,
-“কি বলার আছে বলো। আমাকে বাসায় ফিরতে হবে।”

-“সিরিয়াসলি? আমাকে তাড়া দেখাচ্ছো তুমি? দুদিনের পিচ্চি মেয়ে আমায় তাড়া দেখায়?”

ইলানের কথায় তাচ্ছিল্য হাসলো প্রভাতি,
-” ইশ! তোমার কি কঠিন ব্যক্তিত্ব। দুদিনের পিচ্চির পেছনে পড়ে আছো।”

ভেতরে জ্বলুনি হলেও ইলান নিজেকে শক্ত দেখানোর চেষ্টা করলো।
-“প্রবলেম কি তোমার? আমার কোথায় সমস্যা? সবার আমাকে পছন্দ, কিন্তু তোমার না।”

প্রভাতি শান্ত চোখে তাকালো। ইলানের চেহারা দেখে তার ভেতরের অস্থিরতা অনুমান করা যাচ্ছেনা বিন্দুমাত্র। প্রভাতির কন্ঠে তেজ নেই। তবে দৃঢ়তা আছে।

-“আমি তো বলিনি, আমি তোমাকে পছন্দ করিনা। আমি তোমাকে পছন্দ করতাম এবং এখনো পছন্দ করি। কিন্তু তুমি যেমনটা চাইছো, সেটা মনের ব্যাপার, সময়ের ব্যাপার।”

তাচ্ছিল্য হাসলো ইলান।
-“আর আজ যার সাথে দেখা করে এসেছো, মন তাকে সায় দিয়েছে নিশ্চয়ই। বিয়েটা করে নিও। ভালো ছেলে, ভালো প্রফেশন। সবচেয়ে বড় কথা হ্যান্ডসাম।”

ইলানের পি’ঞ্চ করে কথা বলাটা ঠিকই টের পেলো প্রভাতি। আড়ালে মুখ লুকিয়ে দুর্বোধ্য হাসলো। কারো নজরে পড়লেও বোঝার উপায় নেই সে হেসেছে কিনা!
-“বিয়ে অবশ্যই করবো। খুব তাড়াতাড়ি কার্ড পেয়ে যাবে। ওহহো! কার্ডের কথা কেনো বলছি বলোতো? নিজেদের মানুষকে কেউ কার্ড দেয় নাকি? বিয়েতে সব দায়িত্ব ভাইয়ার পাশাপাশি তোমার ঘাড়েই পড়বে।আসছি আমি। মাকে মি’থ্যে বলে এসেছি।”

ফোনের ফ্ল্যাস অন করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে পড়লো প্রভাতি।
ইলান মনে মনে এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিলো। আর নয়, সে আর পিছু ফিরবেনা। তার প্রফেশনাল লাইফের কঠোর, বিচক্ষণ মানুষে ফিরে যাবে সে। পরিবার, বন্ধুবান্ধব, আপনমানুষ গুলোর কাছে সে সর্বদাই নরম। কথায় আছেনা? “লেবু বেশি চিপলে তেঁতো হয়ে যায়”।
অনুভূতিগুলো প্রকাশিত হয়ে গেলে অবহেলার মাত্রা ও বেড়ে যায়।
সেদিনের পর ইলান প্রভাতির সামনে আগের মতো খুব স্বাভাবিক ব্যবহার করলো। কিন্তু প্রভাতির কাছে ব্যাপারগুলো কেমন অস্বাভাবিক লাগলো।

—————
আশরাফুলের বাবার একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্ট্রি আছে। উনার মৃ’ত্যুর পর আশরাফুল সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেয়। একঘন্টা পূর্বে প্রভাতি জানালো সে শপিং এ এসেছে তাকে যেনো সাথে নিয়ে বাসায় ফেরে আশরাফুল। আশরাফুল গাড়ি শপিংমলের দিকে ঘোরালো।
নিস্তব্ধ, শুনশান রাস্তা। দু’পাশে ঘন গাছগাছালি। একা একাই গাড়ি ড্রাইভ করছে। আচানক গাড়ির সামনে কিছু একটা পড়লো। পাশ থেকে একটা গাড়ি শাঁই শাঁই করে ছুটে চলে গেলো। গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়লো আশরাফুল। চমকে উঠলো সে। শিরদাঁড়া বেয়ে বয়ে গেলো শীতল শ্রোত। গলা শুকিয়ে কাঠ। ঠান্ডাভাব কে’টে গিয়ে দরদরিয়ে ঘাম ছুটেছে। গাড়ির সামনে একটি ন’গ্ন নিথর নারীদেহ। অতিপরিচিত এই মুখ। নৃশং’স, বি’ধ্বস্ত রূপে পড়ে রইলো। ভেতরটা মুচড়ে আসলো। চোখ ফিরিয়ে নিলো আশরাফুল। দেহ অসাড় হয়ে আসছে। তখনই তার মুঠোফোন তীব্র শব্দে কেঁপে উঠলো।

#চলবে……..
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here