কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে পর্ব -১০

কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৯.
আজ রৌদ্রুপের গ্রাম ছাড়ার পালা। গত দুদিনে নৈঋতার স্কুলে গিয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আনা, বাবা-মাকে রাজি করানো হয়ে গেছে রৌদ্রুপের। আফিয়া বেগম এক কথায় রাজি হয়ে গেলেও, সামসুদ্দীন বেপারী অবশ্য একটু দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভু’গছিলেন। কারণ রৌদ্রুপ বলেছে সে নৈঋতাকে নিজের বাড়িতে রাখবে, আবার পড়াশোনাও করাবে। মেয়ের পড়াশোনার খরচ যোগানোর মতো সামর্থ্য সামসুদ্দীন বেপারীর নেই। অন্যের ওপর মেয়ের দায়িত্ব আরোপ করতে তার বিবেকে বাঁধছিল। তাই রৌদ্রুপ তাকে বলেছে ইচ্ছে করলে নৈঋতা ছোটো বাচ্চাদের টিউশন করতে পারবে। আপাতত নৈঋতা তার বাড়িতে থাকবে। তারপর যখন নসিবকে শহরে নিতে পারবে, তখন নৈঋতা আর নসিব আলাদা থাকতে পারবে। অফিয়া বেগম আর রৌদ্রুপ মিলে অনেক বুঝানোর পর মেয়ের ভালোর কথা ভেবেই সামসুদ্দীন বেপারী রাজি হয়েছেন। বলা যায় তাকে বুঝানো অনেকটা কষ্টকর ছিল। রৌদ্রুপ আর নৈঋতা গত রাতেই ব্যাগপত্র সব গুছিয়ে রেখেছিল, যাতে সকালে ঝামেলা না পোহাতে হয়। সকাল সাতটার দিকে তারা রওয়ানা দিলো। বিদায় নেওয়ার মুহুর্তে আফিয়া বেগম আর সামসুদ্দীন বেপারী কেঁদেকে’টে একাকার করেছেন। সঙ্গে নৈঋতা তো আছেই। ছোটো বেলা থেকে মেয়েটা বাবা-মাকে ছেড়ে কোথাও থাকেনি। অথচ এখন তাদের ছেড়ে অজানায় যেতে হচ্ছে। কষ্ট তো হবেই। কুসুমিতারাও এলো বাল্যবন্ধুকে বিদায় জানাতে। সবার মুখই পাংশুবর্ণ ধারণ করেছে।‌ সামসুদ্দীন বেপারী অশ্রুসিক্ত চোখে মেয়ের নিরাপত্তার দায়িত্ব রৌদ্রুপের হাতে আরোপ করলেন। রৌদ্রুপও তাকে ভরসা দিলো সে নৈঋতার দায়িত্ব ঠিকমতোই পালন করবে। বাসস্ট্যান্ড অবধি তাদের যেতে হলো ভ্যানগাড়িতে করে। সাথে গেল নসিব। বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে টিকিট কা’টতে-কা’টতে বাসও এসে গেল। নসিবের মন প্রচন্ড খারাপ। ইতোমধ্যে তার মুখটা চুপসে গেছে। নৈঋতা ভাইকে জড়িয়ে ধরে আরেক দফা কাঁদল। কান্নাভেজা কন্ঠে বলল,
“আব্বারে আর মায়েরে দেইখা রাখিস ভাই। আর তুই কিন্তু ওই ছাইপাঁশ গিলতে যাইস না আবার।”
নসিব চুপসানো মুখে বলল,
“আচ্ছা আপা। তুই নিজের খেয়াল রাখিস।”
রৌদ্রুপ নসিবের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে হাসিমুখে বলল,
“মন খারাপ কোরো না নসিব। আমি গিয়েই তোমার জন্য কাজের খোঁজ করব। তারপর তুমিও ঢাকায় যেতে পারবে। আপাতত ভালো ছেলের মতো থাকো।”
নসিব মাথা দুলিয়ে বলল,
“ভালা থাকবেন ভাইয়া।”
“তুমিও ভালো থেকো।”
“আপারে দেইখা রাইখেন। আব্বা অনেক চিন্তা করে অরে নিয়া।”
“তোমাদের বিশ্বাস আমি ভাঙব না। চিন্তা কোরো না।”
নসিবের থেকে বিদায় নিয়ে রৌদ্রুপ নৈঋতাকে নিয়ে বাসে উঠে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাস ছাড়ল। বাস চোখের আড়াল হতেই, পেছনে পড়ে থাকা এক আকুলিত ভাই অতি সন্তর্পণে চোখের কার্নিশ থেকে দু ফোঁটা অশ্রু কণা আড়াল করার চেষ্টা করল। কারো সামনে আবেগী হতে তার লজ্জা লাগে। কিন্তু শত দোষ করেও যার কাছে তার ঠাঁই মিলত, সেই বোনটা যে আজ থেকে তার থেকে শত মাইল দূরে থাকবে।
রৌদ্রুপ ভেবেছিল নৈঋতা বাস জার্নি সহ্য করতে পারবে না। হয়তো অসুস্থ হয়ে পড়ব। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। পুরো জার্নিটা নৈঋতা বেশ সুস্থ, স্বাভাবিকভাবে উপভোগ করেছে। এর আগে কখনও ঢাকায় না আসায় নৈঋতা দু চোখে বিস্ময় নিয়ে সবকিছু দেখছিল, আর একটার পর একটা প্রশ্ন করেই চলেছিল। তার এ ব্যাপারটা রৌদ্রুপও বেশ উপভোগ করেছে। নৈঋতার চোখভরা বিস্ময় আর নতুন শহরের সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া রৌদ্রুপ বেশ উপভোগ করেছে। তারা যখন গন্তব্যে পৌঁছাল, তখন বিকাল তিনটা। বাস থেকে নেমে রৌদ্রুপ নৈঋতাকে নিয়ে একটা রিকশায় চড়ে বসল। এবার নৈঋতার কেমন যেন ভয়-ভয় লাগতে শুরু করল। নতুন পরিবেশে নতুন মানুষদের সাথে সে মানিয়ে চলবে কীভাবে, তা নিয়েই তার যত দুশ্চিন্তা। রৌদ্রুপ নৈঋতার মনোভাব বুঝতে পেরে তার হাতের ওপর আলতো করে নিজের হাতটা রেখে ভরসা জুগিয়ে বলল,
“আমি আছি তো। এত চিন্তা কোরো না।”
নৈঋতা শুধু একবার মাথা দোলালো। এমন একটা মানুষ পাশে থাকলে তার আর চিন্তা কিসে? এই মানুষের সাথে তো অনায়াসে পুরো জীবনটাই কা’টিয়ে দেওয়া যায়। প্রায় পনেরো মিনিটের মাথায় রৌদ্রুপদের বাড়ির সামনে রিকশা থামল। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে রৌদ্রুপ নৈঋতাকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। রৌদ্রুপ আসছে শুনে তার মা আগে থেকেই বাড়ির গেইট খুলে রেখেছিল। গেইট পেরোনোর সময় নৈঋতা অবাক দৃষ্টিতে রৌদ্রুপদের বাড়ি দেখল। কী সুন্দর দোতলা বাড়ি! বাড়ির বাইরের দিকটাই এত সুন্দর, না জানি ভেতরে কেমন! রৌদ্রুপ কলিংবেলে হাত দিতেই নৈঋতা সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
“এইডারে কী কয়?”
“এটাকে বলে কলিংবেল। এটা চাপলে বাড়ির ভেতরে আওয়াজ হবে। এতে সবাই বুঝবে যে কেউ এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।”
“ডাকলে হুনবো না?”
“বাইরে থেকে ডাকলে শুনবে কীভাবে? দরজার সামনে কি আর কেউ দাঁড়িয়ে থাকে?”
“ও,” মুখ সু’চালো করে উচ্চারণ করল নৈঋতা।
রৌদ্রুপ পরপর দুবার কলিংবেল চাপল। এবার নৈঋতার বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করতে লাগল। অসহায় মুখে বলল,
“হুনেন না, আমার অনেক ডর লাগতাছে।”
“ভয়ের কিচ্ছু নেই পাগলি। আমি থাকতে এত ভয় কিসে তোমার?” মুচকি হেসে বলল রৌদ্রুপ।
শাহানা খানম ছেলের অপেক্ষায় লিভিংরুমে বসে ছিলেন। কলিংবেলের আওয়াজ কানে আসতেই দ্রুত ছুটলেন দরজা খুলতে। দরজা খুলতেই রৌদ্রুপ একগাল হেসে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আম্মা, কেমন আছো?”
শাহানা খানম ছেলের পিঠে হাত বুলিয়ে আহ্লাদী সুরে বললেন,
“রৌদ্রকে ছাড়া আম্মা কবে ভালো থাকে? তুই কেমন আছিস তা বল আগে।”
রৌদ্রুপ মাকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
“একদম ফাটাফাটি আছি।”
শাহানা খানম চোখ দুটো সরু করে বললেন,
“ফাটাফাটি আছিস তাই না? কটা দিনেই কত শুকিয়ে গেছিস! চেহারার রং-ও পালটে গেছে। গিয়েছিলি কেমন, আর এলি কেমন?”
“কদিন দেখোনি বলে তোমার এমন মনে হচ্ছে। আমি একদম ঠিক আছি। আমাকে না হয় পরে দেখো। এখন তোমার ভাগনিকে দেখো তো,” চোখের ইশারায় নৈঋতাকে দেখিয়ে বলল রৌদ্রুপ।
শাহানা খানম ছেলের ইশারা অনুসরণ করে পাশে তাকালেন। নৈঋতা এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে মা-ছেলের আহ্লাদ দেখছিল। বিশেষ করে রৌদ্রুপের মাকে সে অবাক হয়ে দেখছিল। বয়স তার মায়ের মতো হলেও, দুজনের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত। তার মায়ের থেকে এই মহিলার গায়ের রং উজ্জ্বল। তার থেকে বড়ো ব্যাপার হচ্ছে এনার পোশাক পরিচ্ছদেও আধুনিকতার ছোঁয়া। শাহানা খানম তাকাতেই নৈঋতা মৃদু কন্ঠে বলল,
“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম।”
“কেমন আছেন খালাম্মা?”
“আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি। তুমিই নৈঋতা?”
নৈঋতা মাথা দুলিয়ে বলল,
“জি।”
“মা শা আল্লাহ্। কত সুন্দর তুমি! চেহারা দেখে মনেই হয় না তুমি আফিয়ার মেয়ে।”
রৌদ্রুপ নিজের লাগেজ আর নৈঋতার ব্যাগ হাতে তুলে ভেতরে ঢুকতে-ঢুকতে বলল,
“আম্মা, খুব ক্ষুধা পেয়েছে। কথা পরে বোলো। পরে অনেক সময় পাবে।”
শাহানা খানম নৈঋতাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“ভেতরে এসো।”
নৈঋতা ভেতরে ঢুকলে শাহানা খানম দরজা বন্ধ করে দিলেন। রৌদ্রুপকে বললেন,
“যা ফ্রেশ হয়ে আয়, আমি খাবার গরম করছি।”
রৌদ্রুপ বলল,
“হ্যাঁ, যাচ্ছি। ওপরের রুমটা কি পরিষ্কার আছে?”
শাহানা খানম ভ্রু জোড়া খানিক কুঁচকে ফেললেন। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বললেন,
“না, নিচের রুম ফাঁকা আছে তো।”
মায়ের মুখের অভিব্যক্তি লক্ষ্য না করেই রৌদ্রুপ পুনরায় তাড়া দেখিয়ে বলল,
“ওই রুমে তো তেমন আসবাবপত্রই নেই। সমস্যা নেই, আমার রুমের পাশের রুম তো ফাঁকা আছে। ওই রুমেই ও থাকুক। তুমি কাজে যাও, আমি ওকে রুম দেখিয়ে দিচ্ছি। নৈঋ, এসো।”
শাহানা খানমকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রৌদ্রুপ দোতলায় হাঁটা দিলো। অগত্যা নৈঋতাও তার পিছু নিল। শাহানা খানম চরম বিস্ময় নিয়ে কিছুক্ষণ ছেলের চলে যাওয়া পথে কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ ফেলে তাকিয়ে রইলেন। তারপর রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালেন। রৌদ্রুপের সাথে রুমে ঢুকে নৈঋতা অবাক দৃষ্টিতে চারপাশটা দেখতে লাগল। এত বড়ো রুমে সে থাকবে, এ যেন নিছকই কল্পনা মাত্র। রুমটাতে একটা খাট, ড্রেসিং টেবিল, ওয়ারড্রব, পড়ার টেবিল সব আছে; তবে কোনোকিছুই গোছানো নয়। নৈঋতাকে বিস্ময় নিয়ে ঘুরে-ঘুরে রুম দেখতে দেখে রৌদ্রুপ মৃদু হেসে বলল,
“রুমটা ভালো লাগেনি? সমস্যা হবে তোমার কোনো?”
নৈঋতা আমতা-আমতা করে বলল,
“এত বড়ো রুমে আমি থাকমু? অন্য কেউ থাকে না ক্যান?”
“আগে একজন থাকত। এখন ফাঁকা পড়ে থাকে। তুমি একটু গুছিয়ে নিতে পারবে? কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলতে পারো।”
“না, না। কোনো সমস্যা নাই। আপনে যান, গোসল করেন আগে।”
“তুমিও জলদি ফ্রেশ হয়ে নাও। খেয়েদেয়ে তারপর না হয় সব গুছিয়ে নিয়ো। ওহ্, এসো আমি দেখিয়ে দিচ্ছি কীভাবে কী করতে হয়।”
অগত্যা নৈঋতা রৌদ্রুপের সাথে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেল। একে-একে রৌদ্রুপ কীভাবে ট্যাপ কল ব্যবহার করতে হয়, কীভাবে শাওয়ার ট্যাপ ছাড়তে হয় সবটা দেখাল। নৈঋতা দরজায় দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখল। সদ্য পরিচিত জিনিসগুলো তার কাছে একটু অস্বস্তিকর মনে হলো। রৌদ্রুপ চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই নৈঋতা পিছু ডাকল,
“হুনেন।”
রৌদ্রুপ ফিরে তাকিয়ে হেসে বলল,
“অনুপ্রাণিত হয়েছ না কি আমার থেকে?”
“হ, এতদিন ধইরা দেইখা এইটুকুন তো শেখারই কতা।”
“আচ্ছা, তো কিছু বলবে?”
“এইহানে আপনের লগে এই ভাষায় কতা কইলে কি সবাই খারাপ কইব?”
রৌদ্রুপ কিছু একটা ভেবে বলল,
“নিজের ভাষা নিয়ে টেনশন কোরো না। আমি আগেই বলেছি আমার সঙ্গে তুমি আঞ্চলিক ভাষাতেই কথা বলবে। তোমার আঞ্চলিক ভাষাই ভালো লাগে আমার। বাকিদের সঙ্গে কীভাবে কথা বলবে সেটা পুরোপুরি তোমার ইচ্ছে। যার সঙ্গে যেভাবে ভালো লাগবে সেভাবেই কথা বলবে। বাধ্যবাধকতা নেই।”
নৈঋতা প্রশস্ত হেসে মাথা দোলাল।
খাবার টেবিলে নৈঋতাকে নিয়ে পাশাপাশি চেয়ারে বসেছে রৌদ্রুপ। তা দেখে শাহানা খানম আর তার বড়ো ছেলের বউ নিদ্রা একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। রৌদ্রুপ তখন নৈঋতার প্লেটে মাছের বড়ো টুকরা তুলে দিতে ব্যস্ত। নৈঋতা বারণ করলেও সে শুনল না। নতুন মানুষদের সামনে নৈঋতা ভারী অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। ইতস্তত করে মাথা নিচু করে সে খাবার মুখে তুলল। রৌদ্রুপ খেতে-খেতে প্রশ্ন করল,
“ভাবি, তুলি কোথায়? এসে হতে দেখলাম না যে?”
নিদ্রা উত্তর দিলো,
“ও ঘুমাচ্ছে। গ্রামের বাড়ি কেমন কাটল তোমার? একটু শুকিয়ে গেছো।”
“এক কথায় দারুণ কেটেছে। গ্রামের সৌন্দর্য শহরে বসে উপলব্ধি করা যায় না। মনকাড়া সৌন্দর্য! পরেরবার ছবি তুলে এনে দেখাব তোমাদের।”
“পরেরবার মানে? তুমি আবার ওই গ্রামে যাবে কী করতে?” ফট করে প্রশ্ন করে বসল নিদ্রা।
কথাটা কেমন যেন ঠেকল নৈঋতার কানে। রৌদ্রুপ বলল,
“আরে, নৈঋকে নিয়ে কখনও গেলে তখনকার কথা বলেছি। যাইহোক, মামলার কোনো খবর আছে?”
“ওসব ঝামেলা মাটি দেওয়া হয়ে গেছে। তোমাকে আর ভাবতে হবে না। শিক্ষা হলে বন্ধুদের আড্ডা এবার একটু কমিয়ে দিয়ো। নইলে এমন উটকো ঝামেলা অযথাই এসে ঘাড়ে চড়ে বসবে। তোমার ভাই জমিদার না যে একা সবদিক সামলাবে।”
কথাটা বলেই নিদ্রা ব্যস্ত পায়ে প্রস্থান করল। রৌদ্রুপ কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ ফেলে অবাক দৃষ্টিতে ভাবির চলে যাওয়া দেখল। সে চলে যেতেই রৌদ্রুপ প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এখানে জমিদারির কথা এলো কোত্থেকে আম্মা? ভাবি কি কোনো কারণে রেগে আছে?”
শাহানা খানম চুপসানো মুখে বললেন,
“এসব কথা এখন নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে গেছে। নিয়ম করে প্রতিদিন শুনতে হয়।”
“কেন? তোমার সাথে ঝগড়া হয়েছে?”
“না, ওই-”
শাহানা খানম কথা শেষ করার আগেই সেখানে শাম্মী উপস্থিত হলো। সে এসেই শুকনো মুখে বলল,
“মা, এক কাপ চা করে দিবে? মাথাটা ধরেছে।”
শাম্মীর কন্ঠ শুনে রৌদ্রুপ দ্রুত ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। সঙ্গে-সঙ্গেই তার মুখে হাসি ফুটল। বলল,
“শামু? তুই কবে এলি?”
ভাইকে দেখে শাম্মীর যতটা খুশি হওয়ার কথা, মুখ দেখে মনে হলো না সে ততটা খুশি। একটু অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল,
“এই তো দশ-পনেরো দিন হলো।”
“কই? আমাকে তো বললি না। আম্মাও বলেনি।”
শাহানা খানম বলে উঠলেন,
“এসব কথা পরে বলিস। খাওয়ার সময় এত বেশি কথা বলতে নেই। শামু তুই রুমে যা, আমি চা করে দিচ্ছি।”
মায়ের বলতে দেরী হলেও শাম্মীর প্রস্থান করতে সময় লাগল না। সঙ্গে-সঙ্গে শাহানা খানমও ব্যস্ত পায়ে রান্নাঘরে চলে গেলেন। যেন দুজনেই কিছু একটা আড়াল করে পালিয়েছে। ঘটনার আগামাথা কিছু বুঝতে না পেরে রৌদ্রুপ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তার ভ্রু জোড়ার মাঝে কিঞ্চিত ভাঁজ পড়েছে। শাম্মী কখনো তার কথা এড়িয়ে যায় না। বরং সবসময় তার সাথে যেকোনো বিষয় নিয়ে কথা বলতে ভালোবাসে। তার ভাষ্যমতে তার ছোটো ভাইয়া একটা ডায়রি। যার কাছে অনায়াসে মনের সব কথা উগড়ে দেওয়া যায়। নৈঋতা এতক্ষণ শাম্মীকে দেখছিল। মেয়েটা কৃষ্ণবর্ণ। রৌদ্রুপ বা তার মায়ের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।‌ তাহলে কি তার বাবা কৃষ্ণবর্ণের? তবে মেয়েটার চেহারার গঠন সুন্দর। দেখে বেশ পরিপাটি মনে হলো। রৌদ্রুপের মুখের অভিব্যক্তি দেখে নৈঋতা নিচু স্বরে প্রশ্ন করল,
“কী হইছে?”
রৌদ্রুপ অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে মাথা দুলিয়ে বলল,
“কিছু না, খাও। শোনো, আমি এখন একটু বাইরে যাব। ফিরতে হয়তো রাত হবে। তুমি ততক্ষণ রুমে থেকো বা আম্মার সাথে গল্প কোরো। যা ভালো লাগে কোরো। দ্বিধা কোরো না।”
নৈঋতা কাঁচুমাচু মুখে বলল,
“আমার কেমন জানি লাগে।”
“সংকোচ কা’টানোর চেষ্টা করো। নতুন বলে এমন লাগছে। আস্তে-আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।”
তাদের খাওয়া শেষ হতে-হতে শাহানা খানম চা করে শাম্মীর রুমে দিয়ে এলেন। শাম্মীর রুম থেকে ফিরে এসে দেখলেন টেবিলে রৌদ্রুপ বা নৈঋতা কেউই নেই। এঁটো থালাবাটি টেবিলে পড়ে আছে। সেদিকে তাকিয়ে শাহানা খানম খানিক কপাল কুঁচকালেন।

নৈঋতা তার জন্য বরাদ্দকৃত ঘরটা পরিষ্কার করতে ব্যস্ত। তখনই রৌদ্রুপ এলো। তার কোলে পাঁচ বছরের তুলি। নৈঋতা হাতের কাজ রেখে তুলির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
“এইডা তুলি?”
রৌদ্রুপ তুলিকে কোল থেকে নামিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, ঘর গোছানো শেষ হলে তুমি তুলির সাথে সময় কা’টাতে পারবে।”
তুলি এগিয়ে গিয়ে নৈঋতার হাত ধরল। ছোট্ট দুটি কোমল হাতের স্পর্শে নৈঋতা মুচকি হাসল। তুলি প্রশ্ন করল,
“আন্টি, তুমি গ্রাম থেকে এসেছ?”
নৈঋতা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
“হ্যাঁ।”
তুলি চোখ দুটো সরু করে বড়োদের মতো বলল,
“কিন্তু তোমাকে দেখে তো গ্রামের মনে হচ্ছে না। তুমি তো অন্নেক সুন্দর। একদম আমার সুন্দর ডলের মতো। গ্রামের মানুষ এত সুন্দর হয়?”
রৌদ্রুপ এগিয়ে গিয়ে তুলির হাত ধরে বলল,
“কে বলেছে গ্রামের মানুষ সুন্দর হয় না মা? এই তো তোমার এই আন্টিটাকে তুমি সুন্দর বললে না? সে-ও তো গ্রামের মানুষ। তুমি তো কখনও গ্রামে যাওনি, তাই সেখানকার মানুষ সম্পর্কে জানো না। যখন যাবে, তখন সব বুঝতে পারবে।”
তুলি মনোযোগ দিয়ে চাচ্চুর কথা শুনছিল। এবার মাথা দুলিয়ে বলল,
“আচ্ছা।”
“এই আন্টি এখানে নতুন এসেছে তো, কাউকে তেমন চেনে না। তুমি তার সাথে খেলবে। ওকে মা?”
“ওকে। তুমি কোথায় যাচ্ছ?”
“বাইরে যাচ্ছি। আসার সময় তোমার জন্য চকোলেট নিয়ে আসব।”
তুলি এবার প্রশস্ত হাসল। পরক্ষণেই বলল,
“চাচ্চু, আমি এই আন্টিটার মতো ডল নিয়ে আসি?”
“আচ্ছা যাও।”
সঙ্গে-সঙ্গেই তুলি ছুটে চলে গেল। রৌদ্রুপ সেদিকে তাকিয়ে হেসে গলা উঁচিয়ে বলল,
“আস্তে যাও মা। পড়ে যাবে।”
নৈঋতার দিকে দৃষ্টি পড়তেই রৌদ্রুপ ভ্রুকুটি করল। নৈঋতা তখন মনোযোগ দিয়ে তাকে দেখতে ব্যস্ত। ফরমাল ড্রেসে রৌদ্রুপকে তার কাছে ভিন্ন কেউ মনে হলো। এর আগে কখনও রৌদ্রুপকে সে এমন বেশে দেখেনি। রৌদ্রুপ ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“পুতুল সুন্দরী, এভাবে কী দেখেছো?”
নৈঋতা হুড়মুড়িয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। অপ্রস্তুত হয়ে মৃদু কন্ঠে বলল,
“আপনেরে অন্যরকম লাগতাছে।”
“প্রেমে পড়তে ইচ্ছে করছে?”
নৈঋতা চোখ বড়ো করে বলল,
“কী কইতাছেন? কেউ হুনলে? যান তাড়াতাড়ি।”
রৌদ্রুপ মৃদু শব্দে হাসল। নৈঋতার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“আসি। সাবধানে থেকো আমার মিষ্টি পুতুল।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here