কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে পর্ব -১৩

কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৩.
তখন প্রকৃতির আবছা অন্ধকার গাঢ় হয়েছে। উঠানে নসিব টর্চ লাইট হাতে দাঁড়িয়ে ছিল। নৈঋতা-রৌদ্রুপকে দেখে একগাল হেসে এগিয়ে এল। রৌদ্রুপ তার পিঠ চাপড়ে বলল,
“কী খবর, নসিব? ভালো আছো তো?”
নসিব হাসিমুখেই উত্তর দিলো,
“আইজকের দিনেও কি খারাপ থাহা যায়, ভাইয়া?”
পরক্ষণেই নৈঋতার দিকে তাকিয়ে শুধাল,
“কেমন আছোস আপা?”
নৈঋতা রৌদ্রুপের আগের কথাটা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। বলল,
“ভালা আছি। আইজকা কী?”
নসিব তার প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে রৌদ্রুপকে বলল,
“ব্যাগটা আমার কাছে দেন, আমি ঘরে রাইখা আহি। আপনে আব্বা-আম্মার লগে দেহা কইরা আহেন।”
রৌদ্রুপের থেকে ব্যাগ নিয়ে নসিব রৌদ্রুপের জন্য বরাদ্দকৃত ঘরটার দিকে চলে গেল। নসিবের আচরণে নৈঋতা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। ঘরে গিয়ে সে যেন আকাশ থেকে পড়ল। সামসুদ্দীন বেপারী আর আফিয়া বেগম যেভাবে হাসিমুখে রৌদ্রুপের সাথে কথা বলছেন, তাতে নৈঋতা নিশ্চিত হলো যে তাদের আসার খবর আগে থেকেই সবাই জানত। নইলে হঠাৎ করে দেখলে তো অবাক হবার কথা ছিল। কিন্তু জানল কীভাবে? নিশ্চয়ই রৌদ্রুপ জানিয়েছে। তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার কথা বলার পরও আব্বা-আম্মা এত খুশি কীভাবে? নৈঋতার দাদিও ছিল এ ঘরে। সবার সাথেই একটু-আধটু কথা হলো রৌদ্রুপের। খুব বেশি কথা বলল না। নিজের ঘরে চলে গেল। সে চলে যেতেই আফিয়া বেগম নৈঋতাকে তাড়া দেখিয়ে বললেন,
“যা, হাতমুখ ধুইয়া আয়।”
নৈঋতা তাকে প্রশ্ন করল,
“তোমরা কি জানতা আমগো আওয়ার কতা?”
“ক্যান?” পালটা প্রশ্ন করলেন সামসুদ্দীন বেপারী।
“তোমাগো কতা হুইনা তো মনে হইতাছে আগে থিকাই জানতা। উনি ফোন কইরা কইছিল না কি?”
আফিয়া বেগম আবার তাড়া দেখিয়ে বললেন,
“হ। অহন ইসকাফ খুইলা ভালা কইরা হাতমুখ ধুইয়া আয়। কতা পরে কইস।‌ যা, যা।”
নৈঋতা একটু অবাক হলো। বিছানায় পা ঝুলিয়ে আরামসে বসে বলল,
“কেলান্ত লাগতাছে, মা। একটু পর যাই।”
আফিয়া বেগম নৈঋতার কথা শুনলেন না। জোর করে পাঠালেন হাত-মুখ ধুতে। নৈঋতা বাইরে থেকে হাত-মুখ ধুয়ে এসে দেখল আফিয়া বেগম সামসুদ্দীন বেপারীর সাথে ফিসফিস করে কোনো বিষয়ে কথা বলছেন। নৈঋতাকে দেখে তাকে কাছে ডাকলেন সামসুদ্দীন বেপারী। নৈঋতা মাথায় কাপড় টেনে এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়াল। সামসুদ্দীন বেপারী মেয়ের মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিয়ে ধরা গলায় বললেন,
“আম্মা গো, ছোডোকাল থিকা বাপের সংসারে অভাব আর কষ্ট ছাড়া কিছু পাওনায়। আমি বাপ হইয়া তোমারে সুখে রাখতে পারিনাই। পারলে আমারে মাপ কইরা দিয়ো।”
বাবার এহেন আচরণে নৈঋতা ভীষণ অবাক হলো। মায়ের দিকে এক পলক তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
“হঠাৎ এমন কতা কইতাছ ক্যান, আব্বা?”
সামসুদ্দীন বেপারী বেশ তৃপ্ত স্বরে বললেন,
“তোমারে নিয়া আমার চিন্তার শ্যাষ আছিল না। কয়েসের থিকা তোমারে কেমনে বাঁচামু, কেমনে ভালা একখান জামাই দেইখা বিয়া দিমু, এইসব নিয়া আমি সবসময় চিন্তায় থাকতাম। আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনাই যে, তোমার লাইগা আমি এমন রাজপুত্তুর পামু। আল্লায় মুখ তুইলা চাইছে, আমার ডাক হুনছে। তোমার লাইগা রাজপুত্তুর পাডাইছে। তুমি অনেক সুখে থাকবা, আম্মা। বাপের সংসারের সব কষ্ট জামাইর সংসারে গিয়া ভুইলা যাইবা।”
নৈঝতা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বাবার এসব কথার অর্থ বের করতে গিয়ে সে বুঝে নিল, তার জন্য বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। পাত্র হয়তো বাবার পছন্দ হয়েছে, সেজন্যই এসব কথা বলছে। নৈঋতা আমতা-আমতা করে জিজ্ঞেস করল,
“কী অইছে, আব্বা?”
পাশ থেকে আফিয়া বেগম বললেন,
“তোর বাপে আসল কতাই কয়নায়। আমি কইতাছি। ওই রৌদ্র আছে না? বাজান তোরে বিয়া করতে চায়।”
নৈঋতা চমকে উঠে বলল,
“এইসব কী কও?”
“হ, ঠিকই কইছি। আইজকা সকালে তোর বাপেরে ফোন করছিল। কইল আমরা রাজি থাকলে হে তোরে আইজকাই বিয়া করব। তোর বাপে প্রথমে ওর বাপ-মার কতা জিগাইছিল। পরে কইল অহন ওর মায় বিয়া মানব না। কিন্তু বিয়া না করলে তোরে আবার গেরামে রাইখা যাইতে অইব। অয় চায় তোরে বিয়া কইরা আলাদা সংসার করতে, আর নসিবের লাইগাও কাম ঠিক করছে। নসিবেরেও তোগো লগে রাখব। ওর মায় মানব না হুইনা তোর বাপ রাজি হইতে চায়নায়। কিন্তু অর বাপ আছে না? দুলাভাইরে অয় রাজি করাইছে। দুলাভাই নিজে ফোন কইরা আগমো লগে কতাও কইছে। তোরে পোলার বউ করতে ওনার আপত্তি নাই।”
“খালু কেমনে রাজি হইল! আর উনি কইছে দেইখাই তোমরা রাজি হইয়া যাইবা? খালাম্মা ওনার মা। মায়ের অমতে উনি আমারে বিয়া করলে উনি নিজেও ভালো থাকব না।”
“বেশি বুঝিস না। এমন সুযোগ হাতছাড়া করা কি ঠিক হইব? তোর বাপেরে আমি বুঝাইছি। এই গেরামে থাকলে তোর জীবন কষ্টে-কষ্টে শ্যাষ হইয়া যাইব। এই অভাবের সংসার থিকা ভালা পোলা পামু কই তোর লাইগা? রাজপুত্তুর নিজেই তোরে বিয়া করতে চাইছে। তুই তো জানোস না, এই পোলা তোরে না জানাইয়া তোর বাপের লাইগা টেকাও পাডাইছে, যাতে আমগো কষ্ট না অয়। আবার আমগোরে কইছে তোরে যাতে না জানাই। এমন সোনার টুকরা পোলারে কেমনে ফিরাইয়া দেওয়া যায়? সব ভাইবাই তো তোর বাপ রাজি অইছে। অর মায় পরে মানবই। দুলাভাইর মতামত হইছে আগে দরকার। উনি তো নিজেই অনুমতি দিয়া দিছে। এইসব নিয়া আমগোরে চিন্তা করতে না কইছে। ওনাগো কতা মতো খালি কাজি আর হুজুররে ডাইকা আনছে নসিবে। ঘরেই চুপচাপ বিয়া হইব। হেরপর কাইলকা তোরে লইয়া আবার শহরে যাইবগা। বুঝছস?”
“না, না, মা। এইডা একদম ঠিক হয়নায়। উনি আমার জীবনের কতা ভাইবা এমন সিদ্ধান্ত নিলেও আমি এমন কাম করতে পারমু না।”
আফিয়া বেগম নিচু স্বরে ধমকে উঠলেন,
“সব ব্যবস্তা করা হইয়া গেছে। অতিরিক্ত পাকনামি করবি না। তোর কতা ভাইবা আমরা সবাই এমন সিদ্ধান্ত নিছি, অহন তুই নিজেই বাগড়া দেস? ভালা মাইনষের মতো চুপ থাকবি কইলাম। আর নইলে নিজে এমন জামাই খুঁইজা আনবি। এই আকালের সংসারে ভোগার শখ না থাকলে, আর কায়েসের থিকা দূরে থাকতে চাইলে আমি যা কইতাছি তা কর।”
নৈঋতা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একবার বাবার দিকে, তো একবার মায়ের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। দুজনের চোখেই জল। এদিকে নৈঋতা বলার মতো কোনো কথাই খুঁজে পাচ্ছে না। তাকে না জানিয়ে রৌদ্রুপ এতকিছু করে বসে আছে, এমনটা সে এখনও ভাবতে পারছে না। সারাটা রাস্তা একসঙ্গে এসেও তো সে কিছু আঁচ করতে পারল না। হঠাৎ নৈঋতার বিবেক বাঁধ সেধে দাঁড়াল। সে জানে রৌদ্রুপের পরিবার তার ওপর রেগে থাকলেও, তারা ছেলেকে খুব ভালোবাসে। রৌদ্রুপের পথ চেয়ে বসে থাকবে তার মা। অথচ রৌদ্রুপ তাকে নিয়ে আলাদা সংসার করতে চায়! এমনটা হলে তো তার পরিবারের মানুষগুলো মনে খুব কষ্ট পাবে। জেনেশুনে নৈঋতা কীভাবে পারবে রৌদ্রুপকে তার পরিবার থেকে আলাদা করতে? এমনটা সে কখনোই চায় না। কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে নৈঋতা বাবা-মায়ের সাথে এ বিষয়ে কথা না বাড়িয়ে সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিলো,
“আমি ওনার লগে একটু কতা কমু, আব্বা।”
সামসুদ্দীন বেপারীর আগে আফিয়া বেগম বলে উঠলেন,
“অহন আর কী কতা কইবি? ওই ঘরে কাজি আর হুজুরে বইয়া রইছে। তোরে লইয়া গেলেই বিয়া পড়াইব। আর কতা কওয়ার দরকার নাই।”
“আমার দরকার আছে, আম্মা। ওনারে একবার ডাইকা আনো।”
তাদের কথার মাঝেই নসিব ঘরে এল। তাড়া দেখিয়ে বলল,
“অহনও তোমরা কতা কইতাছ? কাজি সাবের কাম আছে। তাড়াতাড়ি যাইতে কইতাছে।”
সামসুদ্দীন বেপারী বললেন,
“তোর বইন তো রৌদ্রের লগে কতা কইতে চাইতাছে।”
নসিব ভ্রুকুটি করে নৈঋতার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আর কী কইবি আপা? ভাইয়া তোরে পছন্দ করে, তা তো মনে হয় তুই জানোস। আর ভাইয়া কেমন মানুষ, তা-ও জানোস। তোরে অনেক সুখে রাখব। যা কতা আছে, পরে কইস।”
নৈঋতা বিরক্ত হয়ে বলল,
“তুই আগে ওনারে ডাইকা আন। আমি বেশিক্ষণ কতা কমু না। বিয়ার পর কতা কইয়া কী করুম আমি? আমার অহন দরকার, অহনই কমু।”
আফিয়া বেগম রেগে গেলেন। কিন্তু সামসুদ্দীন বেপারী নসিবকে বললেন রৌদ্রুপকে উঠানে ডেকে আনতে। বাবার আদেশ পেয়ে নসিবও আর দ্বিরুক্তি করল না। মাথা দুলিয়ে চলে গেল রৌদ্রুপকে ডাকতে। নৈঋতা চাপা অস্থিরতা নিয়ে চৌকিতে পা ঝুলিয়ে বসে পড়ল। দুই মিনিটের মাথায় নসিব ফিরে এসে জানাল রৌদ্রুপ উঠানে অপেক্ষা করছে। নৈঋতা একবার বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রৌদ্রুপ উঠানের পাশের মাচায় বসে ছিল। অন্ধকারে চারপাশে চোখ বুলিয়ে রৌদ্রুপকে দেখে নৈঋতা এগিয়ে গেল। কিন্তু রৌদ্রুপের সামনে দাঁড়াতেই যেন সে সব কথা ভুলে গেল। বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করতে লাগল। কিছু বলতে না পেরে সে নত হয়ে দাঁড়িয়ে দুহাত কচলাচ্ছে। রৌদ্রুপ অন্ধকারে নৈঋতার মুখের অভিব্যক্তি বুঝার চেষ্টা করে বলল,
“বলো।”
নৈঋতা খানিক চমকে ছোট্ট একটা শব্দ করল,
“হুঁ?”
“বলো, কী বলতে ডেকেছ?”
নৈঋতা আমতা-আমতা করে বলল,
“এইসব কী করতাছেন আপনে?”
“কোনসব?”
“বিয়ার কতা কইতাছি।”
“আপত্তি আছে তোমার?”
“আমি চাই না আমার লাইগা আপনে নিজের পরিবারের লগে সম্পর্ক নষ্ট করেন। তারা অনেক কষ্ট পাইব, আর দোষ দিলে আমারেই দিবো।”
“দোষ তো তুমি করছ না। বাড়িতে থাকতেই আমি এ বিষয়ে বাবার সাথে কথা বলেছি। বাবা তোমার প্রতি হওয়া অন্যায়টা ভালো চোখে দেখেনি। তাই আমাকে অনুমতি দিয়েছে। আমরা তো লুকিয়ে বিয়ে করছি না। তোমার পরিবার আছে, আমার বাবার অনুমতি আছে।”
“খালাম্মার কতা ভাববেন না?”
“বাবা যখন রাজি, তখন মাকে মানিয়ে নেওয়া যাবেই। কিন্তু তুমি আমার কথা ভাববে না? তোমাকে হারিয়ে ফেলে আমি দিব্যি জীবনযাপন করতে পারব ভাবছো? প্রথমেই বলেছিলাম আমি এই হাত মৃ’ত্যুর আগ পর্যন্ত ছাড়ব না। তোমার বিপদের সময়ে আমি আমার প্রতিজ্ঞা কী করে ভুলে যাই? তুমি চাইলেও আমি তোমায় ছাড়ব না, নৈঋ। আমি আমার প্রতিজ্ঞাও রক্ষা করব, আর ভালোবাসাও।”
কথার মাঝেই নৈঋতার বাঁ হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিল রৌদ্রুপ। কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে হাতের আঙুলে কোনো বস্তুর স্পর্শ অনুভব করতেই নৈঋতা চমকে উঠল। কাঁপা গলায় শুধাল,
“কী করেন আপনে?”
আংটিটা ভালোভাবে পরিয়ে দিয়ে তাতে আলতো করে আঙুল বুলিয়ে রৌদ্রুপ বলল,
“এনগেজমেন্ট সারলাম।”
নৈঋতা এবার হতবাক হয়ে গেল। চমকটা সামলে খানিক বাদে ভার গলায় বলল,
“আপনে কোনো কতা বুঝতে চান না ক্যান?”
“বোঝার মতো যথেষ্ট জ্ঞান আমার আছে। অন্য কারো কথা নিয়ে ভেবে অযথা সময় নষ্ট করি না আমি। সারাটা রাস্তা তো আমাকে হারানোর ভয়ে আঁকুপাঁকু মন নিয়ে ছিলে। এখন কী হলো?”
“জেদ কইরেন না। দয়া কইরা আমার-”
“ঘরে মুরব্বি দুজন বসে আছে। তাদের তাড়া আছে। আর অপেক্ষা করানো ঠিক হবে না। যাও, আন্টি-আঙ্কেলের সাথে ও ঘরে এসো। আর যদি এরপরও তোমার মনে হয় বিয়েটা তুমি করবে না, তাহলে যা ভালো মনে হয় কোরো। আমি তোমায় ছাড়ব না এটা যেমন সত্যি, তেমনি আমি তোমায় জোরও করব না এটাও সত্যি,” নৈঋতার কথা শেষ করতে না দিয়ে বলে উঠল রৌদ্রুপ।
নৈঋতাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগই দিলো না। তাড়া দেখিয়ে ঘরে পাঠিয়ে দিলো। ঘরে গিয়ে নৈঋতা চুপ মে’রে রইল। তার নীরবতাকে সম্মতি ধরে নিয়ে আফিয়া বেগম তার মাথায় ভালোভাবে ওড়না টেনে ঘোমটা দিতে-দিতে বললেন,
“শাড়ি-টাড়ি কিনার সুযোগ পায়নায়। মন খারাপ করিস না, মা। বিয়ার পর দেখবি কত শাড়ি তোর আলমারিতে পইড়া থাকব।”
নৈঋতা আর টু শব্দটিও করল না। চুপচাপ বাবা-মায়ের সাথে রৌদ্রুপের ঘরে গেল। চৌকির একপাশে কাজি আর হুজুর বসে ছিলেন। রৌদ্রুপ দাঁড়িয়ে কথা বলছিল তাদের সাথে। নৈঋতাকে নিয়ে আসতেই রৌদ্রুপ আর নৈঋতাকে পাশাপাশি বসানো হলো। কাজি আর হুজুর এখান থেকে বেরিয়ে আবার অন্য কোথাও যাবেন বিয়ে পড়াতে। তারা সময় নষ্ট না করে বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন। কবুল বলার সময় নৈঋতার গলায় কান্নারা দলা পাকাল। সব কেমন স্বপ্নের মতো ঠেকল। কাঁপা-কাঁপা গলায় কোনোমতে সে কবুল বলল। রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করার সময় রৌদ্রুপ খেয়াল করল নৈঋতার হাত কাঁপছে। রৌদ্রুপ সবার অগোচরে মৃদু হাসল। মেয়েটা কিছুক্ষণ আগেও আপত্তি জানাতে চেয়েছিল, আর এখন উত্তেজনায় কাঁপছে। বিয়ে পড়ানো শেষ হলে কাজি আর হুজুর চলে গেলেন। তাড়া থাকায় তাদের আগেভাগেই খাওয়ানো হয়েছিল। সামসুদ্দীন বেপারী মেয়েকে জামাইয়ের হাতে তুলে দিতে গিয়ে রৌদ্রুপের হাত ধরে কেঁদে ফেললেন। পরক্ষণেই নৈঋতাসহ তার পুরো পরিবারের কান্না পর্ব শুরু হলো। তাদেরকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কোনোরকমে থামাল রৌদ্রুপ। আফিয়া বেগম জানতে চাইলেন রৌদ্রুপ এখনই রাতের খাবার খাবে কি না। রৌদ্রুপ জানাল এত তাড়াতাড়ি সে খাবে না। আফিয়া বেগম নিজেই গিয়ে নৈঋতা আর রৌদ্রুপের খাবার এ ঘরে নিয়ে এলেন। টেবিলে রেখে দিয়ে বললেন তাদের যখন ক্ষুধা পাবে, তখন খেয়ে নিতে। সামসুদ্দীন বেপারী ঘরে চলে গেছেন। নৈঋতার দাদি তাদের দোআ করতে গিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। রৌদ্রুপের এক হাত মুঠোয় নিয়ে কাঁপা গলায় অনেক কথা বললেন। তার মূল কথা, নৈঋতাকে যেন রৌদ্রুপ কখনও কষ্ট না দেয়। মেয়েটা যে জন্ম থেকে কষ্ট ছাড়া কিছুই পায়নি। দাদি শাশুড়ির হাত ধরে রৌদ্রুপ হাসিমুখে কথা দিলো। আশ্বস্ত করল সে নৈঋতাকে ভালো রাখবে। নসিব তার দাদিকে নিজের ঘরে ফিরিয়ে নিলে নৈঋতা আবার চুপটি মে’রে বিছানার কোণে বসে রইল। আফিয়া বেগম আবার নিঃশব্দে কাঁদলেন। তার ইচ্ছে করছে শাশুড়ির মতো হাউমাউ করে কাঁদতে। তার মেয়েটা এখনও ছোটো। বিয়ের দিন যে বিবাহিত জীবনের ব্যাপারে কেউ কিছু বুঝিয়ে-পড়িয়ে দিবে, এমন কেউও নেই তাদের। আফিয়া বেগম দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। রৌদ্রুপ আর নৈঋতাকে আবারও খাবারটা তাড়াতাড়ি খেয়ে নেওয়ার কথা বলে নিজেও ঘরে চললেন। তিনি চলে যাওয়ার পর রৌদ্রুপ দরজা আটকে বিছানার কোণে বসা তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর দিকে তাকাল। নৈঋতা আজ আর মাথা তুলে তাকাতে পারল না। কেন জানি তার খুব ভয় লাগছে। বুক কাঁপছে। হাঁটুর কাছের জামা খামচে ধরে রেখেছে সে। রৌদ্রুপকে তো ভয় পাবার কথা না তার। নৈঋতার কপোল বেয়ে এখনও অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। রৌদ্রুপের প্রতি নীরব অভিমানে পু’ড়ছে মেয়েটা। কিছু মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে নৈঋতার নীরবতা লক্ষ্য করে রৌদ্রুপ মৃদু হেসে এগিয়ে গেল। বিছানায় উঠে নৈঋতার মুখোমুখি পা ভাঁজ করে বসে গলা ঝেড়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করল; তবু নৈঋতা মাথা তুলল না।
“বউয়ের কি বরের প্রতি বড্ড বেশি অভিমান হয়েছে?”
রৌদ্রুপের কথা শুনেও না শোনার মতোই বসে রইল নৈঋতা। রৌদ্রুপ বার কয়েক এভাবেই নৈঋতাকে ডাকল। কিন্তু নৈঋতা যেন নিজের মাঝে পাথুরে মূর্তি ভর করিয়েছে। রৌদ্রুপ তার অভিমান টের পেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে হুট করে নৈঋতাকে পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে বলল,
“অভিমান জল করার টেকনিক আমার জানা আছে।”
নৈঋতা ভীষণভাবে চমকে উঠল। আমতা-আমতা করে মিনমিনে গলায় বলল,
“কী করেন? পইড়া যামু, নামান।”
“উঁহু, অভিমান না ভাঙা অবধি এভাবেই শূন্যে ভাসবে।”
নৈঋতা পড়ল বিপাকে। তার ভীষণ লজ্জা লাগছে। ভুল করেও সে রৌদ্রুপের মুখের দিকে তাকাল না। ওই চোখে চোখ পড়লে যে তার আর অভিমান বাঁচিয়ে রাখা চলবে না। তবু নৈঋতা জড়তা নিয়ে বার কয়েক বলল তাকে কোল থেকে নামাতে। রৌদ্রুপ শুনল না। বরঞ্চ সে মজা করে নৈঋতাকে কোল থেকে ফেলে দেওয়ার হু’মকি দিলো। হালকাভাবে দোলও দিতে লাগল। অগত্যা নৈঋতা বাধ্য হয়ে রৌদ্রুপের গলা আঁকড়ে ধরল। তার ছোট্ট পেলবের মতো শরীরটা রৌদ্রুপের কোলে ভয়ে সিটিয়ে রইল। যদিও সে জানে রৌদ্রুপ অযথাই ভয় দেখাচ্ছে, তবু তার ভয় লাগছে। তার ভীতু মুখটা দেখে রৌদ্রুপ শব্দ তুলে হাসতে-হাসতে কোল থেকে নামিয়ে দিলো। মাটিতে দাঁড়িয়ে নৈঋতা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। রৌদ্রুপ বলল,
“মিসেস নৈঋর অভিমান কমেছে?”
নৈঋতা নিরুত্তর থেকে নত হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে নখ খুঁটছে। তার অভিমান সত্যি-সত্যিই একটু ভেঙে গেছে। কিন্তু জড়তা আর লজ্জায় সে কথা বলতে পারছে না। রৌদ্রুপ তার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়ে দুহাতের মাঝে আদুরে মুখটা তুলে ধরল। নৈঋতা তবু তার চোখে চোখ রাখল না। রৌদ্রুপ নিচু স্বরে ডেকে বলল,
“নৈঋ, একবার তাকাবে আমার দিকে?”
এই অনুরোধের বিপক্ষে গিয়ে নৈঋতা এবার আর মুখ ফিরিয়ে নিতে পারল না। চোখ তুলে তাকাতেই রৌদ্রুপের গভীর দুটো চোখে তার দৃষ্টি আটকাল। রৌদ্রুপ বলল,
“তোমাকে আগে থেকে সবটা জানালে তুমি কোনোভাবেই রাজি হতে না, তা আমি জানতাম। কিন্তু তোমাকে আজীবনের জন্য ছেড়ে দেওয়া আমার পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। আমার ভালোবাসা এতটাও তুচ্ছ নয়। তোমাকে কষ্টে রেখে আমি নিজেও ভালো থাকতে পারতাম না। যা হবার হয়েছে, নৈঋ। আজ থেকে তুমি শুধুমাত্র আমাদের জীবন, নিজের সংসার আর পড়াশোনা নিয়ে ভাববে। আর কিচ্ছু নয়। বুঝেছ?”
নৈঋতার চোখের কার্নিশ বেয়ে আবারও দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। ভেজা কন্ঠে বলল,
“কেমনে কী কইরা ফালাইলেন আপনে! আমার অনেক চিন্তা হইতাছে।”
“সব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। আমি আছি তো।”
“যদি কোনো ঝামেলা হয়?”
“নতুন করে আর কিছু হওয়ার বাকি নেই। যা হওয়ার আগেই হয়ে গেছে। ওসব বাবা সামলে নিবে।”
“সত্যিই কি আমি এত ভাগ্যবতী? সব কেমন স্বপ্নের মতো লাগতাছে।”
রৌদ্রুপ নৈঋতার হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,
“আজ থেকে তোমার সব স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা তোমার স্বামীর দায়িত্ব, প্রেমবতী।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here