কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে পর্ব -১৪

কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৪.
নৈঋতার সাথে কিছু সময় বাক্যালাপের পর রৌদ্রুপ বিছানার ওপর নিজের ব্যাগটা খুলে ঘাঁটাঘাঁটি করল। তারপর ব্যাগ থেকে একটা টুকটুকে লাল শাড়ি বের করে নৈঋতার হাতে ধরিয়ে দিলো। সাথে ব্লাউজ, পেটিকোট সবই আছে। নৈঋতা অবাক হয়ে জানতে চাইল,
“এইসব আপনে কিনছেন?”
রৌদ্রুপ মাথা দুলিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, আসার আগেই বন্ধুকে দিয়ে কিনিয়ে রেখেছিলাম। বিয়ের দিন বউয়ের পরনে শাড়ি থাকবে না, এটা কি মানা যায়? তোমাকে লাল শাড়িতে দেখার অনেক ইচ্ছে আমার। তোমাকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম, সেদিন তোমার পরনে একটা লাল থ্রি-পিস ছিল। কী স্নিগ্ধ লাগছিল তোমায়! ঘটা করে আমার সিঙ্গেল লাইফের পাট চুকিয়ে প্রেমেও পড়ে গিয়েছিলাম সেদিন।”
শেষের কথাটা বলে রৌদ্রুপ নিজেই হাসল।
“পরে নাও এগুলো।”
নৈঋতা ইতস্তত করে বলল,
“আমি ভালোমতো শাড়ি পরতে পারি না। আপনে আগে বাইর করলে তো মায় পরাইয়া দিত।”
“উঁহু, তুমি যেমন পারো তেমনই পরবে। আমিই তো দেখব, অন্য কেউ তো আর দেখবে না। তুমি অগোছালো রূপেও আমার চোখে পৃথিবীর সেরা সুন্দরী, মেয়ে।”
নৈঋতা মাথা নিচু করে বলল,
“আপনে বাইরে যান, আমার পরা শ্যাষ হইলে ডাকমু নে।”
নৈঋতার দিকে ঝুঁকে গিয়ে রৌদ্রুপ ঠাট্টার ছলে বলল,
“কেন? আমি কি পরপুরুষ?”
নৈঋতা লজ্জায় অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। রৌদ্রুপ হাসতে-হাসতে ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে গিয়ে বলল,
“দরজা আটকে নাও। আমি বাইরে আছি।”
নৈঋতা গিয়ে দরজা আটকে দিলো। তারপর শাড়ি হাতে নিয়ে ভাবতে লাগল কীভাবে-কীভাবে ভালোভাবে পরা যায়। রৌদ্রুপ তখন বাইরে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে ঘাঁটাঘাঁটি করছে। গ্রামে পৌঁছেই সে ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছিল। নোটিফিকেশনে দেখল তার বড়ো ভাই আর বন্ধু বেশ কয়েকবার ফোন করেছিল। বন্ধুর মেসেজ দেখে সে আগে বন্ধুকে ফোন করল। জানাল যে তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। কাল তারা ঢাকায় ফিরেই তার বন্ধুর বাড়িতে উঠবে। বন্ধুর সাথে অনেকটা সময় কথা বলে ফোন করল তিহানকে। রিং হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই তিহান ফোন রিসিভ করল। রৌদ্রুপ হ্যালো বলতেই তিহান ব্যস্ত হয়ে বলল,
“হ্যালো রৌদ্র। তুই কোথায় আছিস?”
“আমি গ্রামে আছি, ভাইয়া।”
“এতকিছু হয়ে গেল, একবার তো ফোন করে আমাকে জানাতে পারতি। আমি আজ একটু তাড়াতাড়ি অফিসে গেলাম, আর আজই এত ঝামেলা হতে হলো? সারাদিনে কেউ আমাকে কিছু জানায়নি। একটু আগে বাসায় এসে জানতে পারলাম তুই রাগ করে নৈঋতাকে নিয়ে চলে গিয়েছিস। আবার না কি বলে গেছিস তুই নৈঋতাকে বিয়ে করবি?”
রৌদ্রুপের এবার নিজেকে বড্ড অ’পরা’ধী মনে হলো। এত ঝামেলার মধ্যে বড়ো ভাইটাকে ফোন করে বলার কথা তার মাথাতেই ছিল না। এই মানুষটা যে সবার থেকে আলাদা। রৌদ্রুপকে বুঝার মতো এক ভরসার জায়গা। রৌদ্রুপ অপরাধীর মতো বলল,
“সরি ভাইয়া, রাগের মাথায় আমার আসলে একদমই খেয়াল ছিল না তোমাকে ফোন করার কথা। আজ বাড়িতে সবাই অনেক বাড়াবাড়ি করেছিল নৈঋতাকে নিয়ে। বাড়ি থেকে বের করে দিতে চেয়েছিল মেয়েটাকে।”
“আমি সব শুনেছি বাবার থেকে। এখন নৈঋতা কোথায়?”
“আমার সাথেই আছে।”
“আর বিয়ের ব্যাপারটা?”
“এই মুহূর্তে আমার কাছে এছাড়া আর কোনো উপায় নেই। আমি ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মা-বাবাকে জানিয়ে এসেছি। বাবা অনুমতি দিয়েছে, কিন্তু মা অনেক তেতো কথা শুনিয়েছে। তবু আমি জানিয়ে আসাটা প্রয়োজন বোধ করেছি, তাই জানিয়ে এসেছি।”
“বুঝেছি, এখন বিয়ে কি হয়ে গেছে?”
“হ্যাঁ, কিছুক্ষণ আগেই,” মিনমিনে গলায় বলল রৌদ্রুপ।
তিহান ক্ষণকাল চুপ মে’রে রইল। রৌদ্রুপের অনুশোচনা হলো। নিজের বোকামির জন্য মনে-মনে নিজেকে বকল। ভাইয়া নিশ্চয়ই কষ্ট পেয়েছে। তিহান বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া করল না। শান্ত কন্ঠে শুধু প্রশ্ন করল,
“ঢাকায় কবে ফিরছিস?”
“কাল।”
“কালই?”
“হ্যাঁ, অফিস আছে তো।”
“কোথায় উঠবি?”
“ফাহাদের বাড়ির দোতলা ভাড়া নিয়েছি। ওখানেই উঠব।”
“বাহ্! এটুকু সময়ের মধ্যে দেখছি সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছিস।”
রৌদ্রুপ নিরুত্তর রইল। পরক্ষণেই মিনমিনে গলায় বলল,
“তুমি অন্তত আমার ওপর রাগ কোরো না, ভাইয়া। তুমি তো আমায় বোঝো।”
“কোনো দরকার পড়লে বলিস। রাখছি,” বলেই অভিমানে ফোন কে’টে দিলো তিহান। রৌদ্রুপের নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। ভাইয়াকে একটাবার বলে আসার কথা তার মাথায় এল না কেন? ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল দরজা খোলা। নৈঋতার হয়তো শাড়ি পরা হয়ে গেছে। কখন দরজা খুলেছে তা সে টের পায়নি। সশব্দে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রৌদ্রুপ চা চালিয়ে গিয়ে ঘরে ঢুকল। নৈঋতা বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে চরম বিরক্তি নিয়ে শাড়ি টানাটানি করছিল। রৌদ্রুপকে দেখেই সে সটান দাঁড়িয়ে পড়ল। রৌদ্রুপ সরু চোখে নৈঋতার শাড়ি পরার ধরণ দেখল। গুছিয়ে কুঁচি দিতে পারেনি মেয়েটা। কোনোরকম পেঁচিয়ে পরেছে, তা-ও সেই আগেরবারের মতো হাত দিয়ে আঁচল চেপে ধরে রেখেছে। তবে শাড়িটায় বেশ মানিয়েছে তাকে। দরজা আটকে রৌদ্রুপ এগিয়ে গেল। নৈঋতা শাড়ি খামচে ধরে ধুকধুক বুকে এদিক-ওদিক চঞ্চল দৃষ্টি বিচরণ করছে। রৌদ্রুপ তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বলল,
“কী হয়েছে?”
নৈঋতা মাথা না তুলেই নিচু স্বরে বলল,
“সেফটিপিন আনেননায়?”
“সেফটিপিন দিয়ে কী হবে? এখন তো তোমার আঁচল সামলানোর মানুষ আছেই।”
নৈঋতা লজ্জায় আর দ্বিরুক্তি করতে পারল না। রৌদ্রুপ হাত এগিয়ে নৈঋতার চুলের খোঁপা খুলে ফেলল। মিশমিশে কালো লম্বা চুলগুলো পিঠময় ছড়িয়ে পড়ে নৈঋতার মুখের কাছেও আছড়ে পড়ল। সে আজ সেই প্রথমদিনের মতো জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রৌদ্রুপ মুচকি হেসে ব্যাগ থেকে একটা সেফটিপিন বের করে নৈঋতার কাঁধের কাছের শাড়িতে আটকে দিলো। নৈঋতা জড়োসড়ো হয়ে মাথা নত করে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। সেফটিপিন লাগিয়ে রৌদ্রুপ হঠাৎ খুব কাছে গিয়ে দুহাতে নৈঋতার মুখটা তুলে ধরল। লজ্জা আর সংকোচে নৈঋতা দৃষ্টি তুলল না। কেন জানি আজ ওই চোখে চোখ রাখার সাহস একদমই হচ্ছে না। বরঞ্চ সে শরীরে মৃদু কম্পন অনুভব করছে। গলাটাও শুকিয়ে আসছে। রৌদ্রুপ হুট করেই নৈঋতার থুতনিতে আঙুল ঠেকিয়ে কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে বসল। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নৈঋতা পরপর দুটো ঢোক গিলল। রৌদ্রুপ তাকে লক্ষ্য করে ভ্রুকুটি করে বলল,
“এই মেয়ে, এভাবে কাঁপছো কেন? আমি কি তোমাকে মে’রে ফেলছি?”
নৈঋতা হোঁচট খেল। তার লজ্জা আরও একধাপ বেড়ে গেল। এরপর রৌদ্রুপ একদম নীরব হয়ে গেল। চুপ মে’রে পলকহীন মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নৈঋতার মুখের দিকে। নৈঋতা এলোমেলো হয়ে গেল। এভাবে তাকিয়ে থেকে তাকে লজ্জায় মে’রে ফেলবে না কি? কী মুশকিল! রৌদ্রুপ নৈঋতার গালে আঙুল বুলিয়ে বলল,
“এই রাতকে সাক্ষী রেখে আমি তোমাকে নিজের করে নিলাম, মেঘবতী। আমার শেষ নিঃশ্বাস অবধি তোমাকে নিজের কাছে আগলে রাখব। এক বিন্দু দুঃখকেও আমি তোমায় ছুঁতে দেবো না। এই ঠোঁটের কোণের মিষ্টি হাসিটা দেখতে-দেখতে আমি গোটা জীবন পার করে দিবো। কাল থেকে আমরা আমাদের ছোট্ট চড়ুই পাখির সংসার সাজাব। প্রতিদিন খুব সকালে দুজন মিলে রাঁধব‌। খেয়েদেয়ে আমি অফিসে চলে যাব আর তুমি কলেজে। তুমি তো দুপুরেই ফিরবে, কিন্তু আমাকে তো রাতে ফিরতে হবে। মাঝের সময়টা তোমাকে একা থাকতে হবে। তোমার কি একা থাকলে মন খারাপ হবে?”
নৈঋতা ওপর-নিচে মাথা ঝাঁকাল। রৌদ্রুপ বলল,
“তোমার খারাপ লাগলে আমি কাজের ফাঁকে ফোন করে কথা বলব। তাহলে হবে না?”
নৈঋতা এবারেও হ্যাঁ-সূচক মাথা ঝাঁকাল। রৌদ্রুপ নিশ্চিন্তে আবারও বলল,
“রাতে আমি ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরে তোমার এই মায়াবী মুখটা দেখে সমস্ত ক্লান্তি ভুলে যাব, যেভাবে এতদিন ভুলে ছিলাম। দুপুরের খাবারটা যদিও আলাদা খেতে হবে। তবে সকালের আর রাতের খাবারটা আমরা একসঙ্গে খাব। তারপর গোটা রাত হবে একান্ত আমাদের। শোনো মেয়ে, তুমি কিন্তু ঘুমানোর জন্য আলাদা বালিশ পাবে না। এই যে আমার বুকের এপাশটা তোমার মাথা রাখার জন্য বরাদ্দ। ঠিক আছে?”
নৈঋতা নিঃশব্দে কাঁদছে। এ কান্না পাওয়ার আনন্দের। রৌদ্রুপ তার কান্না দেখে হেসে ফেলল। আলতো হাতে চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
“এই মেয়ে, কান্না বন্ধ। আমার কথা শেষ হয়নি তো। এখনই কেঁদে ভাসিয়ে দিলে কীভাবে বলব? যাইহোক, শোনো। ছুটির দিনগুলোতে আমরা দ্রুত সংসারের কাজকর্ম সেরে দুজন মিলে ঘুরতে বেরুব। উফ্, তুমি আমার প্ল্যান শুনে হাসার বদলে কাঁদছ? এসো তো, বসো এখানে।”
নৈঋতার হাত ধরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় বসাল রৌদ্রুপ। খাবারের প্লেট আর পানি নিয়ে এসে বিছানায় রেখে নিজেও উঠে বসল। ভাত মেখে নৈঋতার মুখের সামনে তুলে ধরলে নৈঋতা লজ্জা পেল। রৌদ্রুপ নৈঋতার মুখে ভাত পুরে দিয়ে বলল,
“লজ্জা পেতে হবে না, ম্যাম।‌ এখন থেকে বরের হাতে খাবার খাওয়ার অভ্যাস করুন। আপনার বর তার বউকে ভালবেসে মুখে তুলে খাওয়াবে, এটা ভালোবাসা প্রকাশের একটা ধরন। চাইলে আপনিও ট্রাই করতে পারেন।”
নৈঋতা মাথা নিচু করে লাজুক হাসছে। আজ জড়তা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছে। কিছুতেই রৌদ্রুপের সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারছে না। লজ্জায় চোখে চোখ রাখতে পারছে না। কী অদ্ভুত! নৈঋতার সাথে রৌদ্রুপ নিজেও খাচ্ছে। খেতে-খেতে রৌদ্রুপ নানা কথার পসরা সাজিয়ে বসল। সবই তাদের বিবাহিত জীবন নিয়ে। নৈঋতা আড়চোখে মানুষটার হাসিখুশি মুখটা দেখে বুকের ভেতর শান্তি অনুভব করল। তৃপ্তি পেল। পাওয়ার আনন্দ বুঝি এমনই হয়? খাওয়া শেষে রৌদ্রুপ গিয়ে জানালার কপাট খুলে রাতের আকাশের পানে তাকাল। আকাশে অজস্র তারকারাজিরা মেলা বসিয়েছে। চাঁদ হচ্ছে তাদের প্রধান। রৌদ্রুপ-নৈঋতার বিয়ের আনন্দে যেন তারা আকাশ জুড়ে আনন্দ মেলার আয়োজন করেছে। কী সুন্দর তাদের আয়োজন! রৌদ্রুপ গলা বাড়িয়ে ডাকল,
“নৈঋ?”
“হুঁ,” ছোট্ট শব্দে সাড়া নৈঋতার।
“এখানে এসো।”
নৈঋতা গুটি-গুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে রৌদ্রুপের পাশে দাঁড়াল। রৌদ্রুপ আকাশের দিকে ইশারা করে বলল,
“মনে হচ্ছে আজ প্রচুর বৃষ্টি হবে।”
নৈঋতা যেন আহাম্মক বনে গেল। কপালে ভাঁজ ফেলে জ্যোৎস্না রাতের ঝকঝকে আকাশের দিকে তাকাল। বোকা-বোকা ভঙ্গিতে বলল,
“আকাশে তো মেঘ নাই।”
“ওই আকাশের কথা বললাম না কি?”
“তাহলে?”
“মনের আকাশ। এই আকাশের মেঘ দেখা যায় না, মেঘবতী। অবশ্য আজ ওই আকাশে মেঘ থাকলে ভালোই হত। মেঘবতীকে নিয়ে বৃষ্টি বিলাস করে রাতটাকে আরও সুন্দর করতে পারতাম। যদিও বৃষ্টি তোমার পছন্দ না। কিন্তু আজকের রাতে আমি অনুরোধ করলে কি তুমি ফিরিয়ে দিতে?”
নৈঋতা কিছু মুহূর্ত চুপ থেকে না-বোধক মাথা নাড়ল। রৌদ্রুপ হাসিমুখে বলল,
“স্বয়ং মেঘবতী যখন আমার কাছে আছে, তখন আর চিন্তা কেন? আজ নিশ্চিত বৃষ্টি হবে, মেঘবতীর বৃষ্টিতে আমি ভিজব।”
নৈঋতা ক্ষণকাল চুপ মে’রে তাকিয়ে থেকে হয়তো রৌদ্রুপের ইঙ্গিতপূর্ণ কথাটা আঁচ করতে পারল। লজ্জায় তার গাল, কান গরম হয়ে উঠল। শাড়ির আঁচল মুঠোয় চেপে ধরে জড়োসড়ো ভঙ্গিমায় মাথা নত করল। রৌদ্রুপ নৈঋতার লাজুক মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে রইল, যেন ওই মুখে তার কত বছরের তৃষ্ণা! রৌদ্রুপের দৃষ্টিতে নৈঋতা আরও এলোমেলো হয়ে যায়। জানালার কাছ থেকে সরে যাওয়ারও সাহস পায় না সে। হুট করেই রৌদ্রুপ এক হাতে নৈঋতার কোমর জড়িয়ে খুব কাছে এনে গা ঘেঁষে দাঁড় করাল। নৈঋতা থতমত খেয়ে গেল। ঘটনার আকস্মিকতায় হৃদপিন্ডে হাতুড়ি পেটা শুরু হলো। অজানা ভয়ে গলা আবারও শুকিয়ে গেল। নৈঋতার হাঁসফাঁস অবস্থা দেখে রৌদ্রুপ ঠোঁট টিপে হাসল। নৈঋতার লজ্জা আরেক ধাপ বাড়িয়ে দিয়ে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে মুগ্ধতামাখা স্বরে ফিসফিসিয়ে বলল,
“চলো মেঘবতী, দুজন মিলে বৃষ্টিতে ভিজি। আজ না হয় বিনা মেঘে আকাশে জ্যোৎস্না ছড়াক, জমিনে বৃষ্টি হোক। আমার মেঘবতীর প্রেমবর্ষণে আমি সিক্ত হই।”

পরদিন দুপুরের আগেই রৌদ্রুপ-নৈঋতা বিদায় নেয়। সঙ্গে নেয় নসিবকে। বিদায়ের মুহূর্তে সামসুদ্দীন বেপারী আর আফিয়া বেগম রৌদ্রুপ আর নৈঋতাকে ধরে হাউমাউ করে কাঁদলেন। এবার যে মেয়ের সঙ্গে ছেলেটাও দূরে চলে যাচ্ছে। রৌদ্রুপ তাদের আশ্বস্ত করে, তাদের দুই ছেলে-মেয়েকেই সে ভালো রাখবে। গতকাল ছিল ছুটির দিন। রৌদ্রুপ অফিস থেকে শুধু আজকের দিনের জন্য ছুটি নিতে পেরেছে। ঢাকায় ফিরে নতুন সংসার সাজিয়ে নেওয়ারও তো তাড়া আছে। সেজন্যই সে দেরি করতে চায়নি। শহরে ফিরে আসার জার্নিটা নৈঋতার একদমই ভালো কা’টেনি। কান্নাকাটি করার কারণে মাথা ধরে গেছে। ওদিকে ভালোভাবে ঘুমও হয়নি। গাড়িতে গোটা রাস্তা রৌদ্রুপের বুকে মাথা ঠেকিয়ে জেগে কা’টিয়েছে। তারা যখন রৌদ্রুপের বন্ধু ফাহাদের বাড়িতে পৌঁছাল, তখন রাত প্রায় আটটা। ফাহাদ নিজে ওদেরকে বাসায় উঠিয়ে দিয়ে গেল। সঙ্গে রাতের খাবারটাও দিয়ে গিয়েছে। দোতলার ঘরগুলো পুরো ফাঁকা। রৌদ্রুপ অবশ্য আস্তে-আস্তে সব ফার্নিচার আনার পরিকল্পনা করে রেখেছে। আপাতত সে ফাহাদকে দিয়ে দুই রুমে দুটো খাট, কাবার্ড আর টুকটাক কিছু জিনিসপত্র আনিয়ে রেখেছে। আজ দিনের বেলায় ফাহাদ এসব কিনে ঘরে সাজিয়ে রেখে গেছে। নসিবকে একটা রুমে যেয়ে ফ্রেশ হতে বলে রৌদ্রুপ অন্য রুমে ঢুকল। নৈঋতা তার পেছন-পেছন রুমে ঢুকেই বিছানা দেখে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। ক্লান্ত শরীরটা এখন বিছানায় এলিয়ে দেওয়া বড্ড জরুরি। নৈঋতা ধপ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই রৌদ্রুপ ব্যাগপত্র রেখে এগিয়ে গেল। বিছানায় এক পা তুলে বসে নৈঋতার কপালে হাত রেখে শুধাল,
“শরীর বেশি খারাপ লাগছে?”
নৈঋতার দুচোখ তখন ঘুমে টলমল। ছোটো-ছোটো চোখে চেয়ে সে অলস ভঙ্গিতে বলল,
“হুঁ, ঘুমাইতে হইব।”
“ঘুমিয়ো, কিন্তু তার আগে ফ্রেশ হয়ে ডিনার করতে হবে। নইলে এমনিতেও শরীর ভালো লাগবে না।”
নৈঋতা অসহায় মুখে বলল,
“আগে একটু ঘুমাই? ভাল্লাগতাছে না।”
“চোখে-মুখে পানির ঝাপটা দিলে ভালো লাগবে, ওঠো।”
অগত্যা নৈঋতা ঠোঁট উলটে রৌদ্রুপের সাহায্যে উঠে বসল। চোখে-মুখে তীব্র অনিচ্ছা নিয়ে ধীর পায়ে বাথরুমে চলে গেল। তার বাচ্চাদের মতো আচরণ দেখে রৌদ্রুপ আপন মনে হাসল। নৈঋতা ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখল নসিব এ ঘরে চলে এসেছে। রৌদ্রুপ নিজেই তাকে ডেকে এনেছে একসাথে খাবার খাওয়ার জন্য। নৈঋতা বেরোনোর সঙ্গে-সঙ্গেই রৌদ্রুপ গিয়ে চটপট ফ্রেশ হয়ে এল। গরম ভাত, সরষে ইলিশ আর মুরগির মাংস ভুনা দিয়ে তিনজন গল্পে-গল্পে খাবার খেল। ফ্রেশ হওয়ার পর নৈঋতার অনেকটা হালকা লাগছিল, তাই খেতেও সমস্যা হলো না। খাওয়ার মাঝে একটা কাণ্ড ঘটল। বরাবরের অভ্যাসবশত রৌদ্রুপ নিজের ভাগের পুরোটা খাবার শেষ না করে অবশিষ্ট কিছু খাবার প্লেটের একপাশে রেখে খাওয়া শেষ করল। নৈঋতাও অভ্যাসবশতই রৌদ্রুপের রেখে দেওয়া খাবার নিজের প্লেটে নিয়ে খেতে লাগল। নসিব এসব বিষয় জানে না বলে মাথা ঘামায়নি। নৈঋতাকে তার অবশিষ্ট খাবার খেতে দেখে রৌদ্রুপের টনক নড়ল। অভ্যাসবশত খাবারটুকু রেখে দিলেও, এতক্ষণে খেয়াল হলো এখন আর তারা নিজের বাড়িতে নেই যে, খাবার ভাগাভাগি করে খেতে হবে। নৈঋতা নিজেও হয়তো খেয়াল করেনি। দীর্ঘদিনের অভ্যাস দুজনের, ভুলবে কী করে? নিজেদের অদ্ভুত অভ্যাস খেয়াল করে রৌদ্রুপের চোখে চেয়ে নৈঋতাও মুচকি হাসল।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here